রাহনুমা সিদ্দীকা তাসনীম
বাবা তাঁর স্টাডি রুমে। নির্ঘাৎ পড়ছে কিংবা লিখছে কিছু। বাবা বড্ড ব্যস্ত থাকে আজকাল, নিজের জগতে। একটু উঁকি দিয়ে দেখে এলো সে। হ্যাঁ, আসলেই পড়ছে।
কী পড়ে এতো এই ভর দুপুরে? নাকি নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা! খাঁ খাঁ করছে পুরো বাসাটা। এত নিস্তব্ধতা ভালো লাগে না তানহার। এত কেন চুপচাপ সব? পৃথিবীটাকে তার কাছে অর্থহীন ঠেকে। আবার সেই চরাচর বিস্তৃত বিষণœতা ভর করছে, অসহ্য!
মামণি! বাবা এসেছে বারান্দায়।
বলো বাবা।
কী হয়েছে আজ? পরীক্ষা ছিলো না?
নাহ.. তুমি ভুলে গেলে বাবা। সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো কাল, এখন ত ছুটি!
ওহ! এই রোদের মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে আসো মা। তোমার জন্য একটা দারুণ জিনিস আছে, দেখবে?
একটু পর যাবো। তুমি এখন যাও। পড়ছিলে পড়ো।
না, মনটা একটু শান্ত না হলে সে যেতে পারবে না বাবার সামনে। কিছুক্ষণ একা থাকা দরকার। বাবা চলে গেল। একটু কষ্ট কি পেলো মনে? বাবাটা এমনই। কষ্ট পেলে কক্ষনো বলবে না। চুপ করে সামনে থেকে চলে যাবে।
তানহা-ই বা কী করবে? নিজেকেই কখনো কখনো অপরাধী মনে হয়। মা চলে যাবার পর বাবাটা মানসিকভাবে এত ভেঙে পড়েছেন! সর্বদা হাসিমুখ যে বাবাকে দেখে এসেছে আজন্ম, বড্ড অচেনা লাগে এখন। ক্লাস নেয়া আর বাসার মধ্যেই নিজেকে আটকে ফেলেছেন।
তুহিনটা কোচিং-এ। সামনে এসএসসি পরীক্ষা তার। ওকেও সময় দেয়া দরকার। গতকাল কোচিং-এর মডেল টেস্টের রেজাল্ট দিল। ভালো করেনি তুহিন। পড়াশুনার প্রতি অবহেলাটা চরমে উঠেছে। সারাদিন বাইরে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় ও-ই জানে। বাবা কাল বকলেন ওকে কিছুক্ষণ। এখনো ততটা অবাধ্য হয়নি। নিশ্চুপ হয়ে শুনলো।
তানহার কেমন যেন কান্না পেয়েছিল তখন। মা থাকতে এটা কল্পনাও করা যেত না। জেএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া তুহিন এখন রসায়নে পাস নম্বর তুলতে পারে না।
ত্যালের বোতল খালি আফা। ত্যাল কিনতে পাডান ডেরাইভাররে।
হঠাৎ চমকে গেল ও!
মানিকের মা। তানহাদের গাঁয়ের বাড়ি থেকে দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়া। মা চলে যাওয়ার পর ঘর-দোর সামলানোর জন্য ওকে আনা হয়েছে। নিজের অজান্তেই কখন বিন্দু বিন্দু অশ্র“ পড়ে দু’ গাল ভিজে গেছে খেয়াল করেনি। চোখ মুছে ড্রাইভারকে ফোন করতে গেল।
বাবার রুমে এসে দেখলো বাবা কী যেন দেখছেন মনোযোগ দিয়ে। চলে যেতে উদ্যত হয়েও না গিয়ে বলল, বাবা, কী দেখাবে বলো!
ও তুমি এসেছো! ড্রয়ার থেকে একটা হলদে খাম বের করে হাসিমুখে তানহার হাতে দিয়ে বললেন, দেখো ত মামণি এর ভেতর কী আছে?
একটু অবাক হয়ে খুলল সে খামটা।
তিনটে ছবি, পুরোনো। একটাতে সদ্যজাত একটা শিশু কোলে নিয়ে মামণি আর বাবা, আরেকটাতে শুধুই শিশুটা খোলা একটা জানালার পাশে শুয়ে আছে; রোদ এসে পড়ছে তার মুখে, আরেকটাতে বাবা আর মামণির কম বয়সের একটা ছবি।
বাবা হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছেন। তানহা জানে শিশুটা কে। সেই-ই ত! অদ্ভুত! এই ছবি ত সে দেখেনি আগে। বাসায় তার ছোটবেলার এত ছবি আছে কিন্তু এইগুলি ছিলো না।
এগুলি তোমার নীলুফুপ্পি আজ দিয়ে গেছে আমাকে। তোমার জন্মের পর প্রথম তোলা ছবি মা। দেখো কী সুন্দর ছিলে তুমি! এখন ত একদম হয়েছ তোমার মায়ের মত!
বাবা! তানহা বাবার কোলে মুখ লুকালো। থ্যাংক ইউ বাপ্পা!
নিজের ঘরে এসে অনেকক্ষণ দেখলো সে ছবিগুলো। মা, মামণি! তুমি এখন নেই কেন? কেন নেই? খুব দ্রুত মনে পড়ে যাচ্ছে তানহার সবকিছু সবকিছু… ছোটবেলায় মামণির ওড়নার প্রান্ত ধরে রাখত সবসময়।
আম্মি আম্মি তুমি এখন একটু ছাড় আমাকে। রান্না করছি দেখছো না?
না না আমি একদম ছাড়বো না তোমাকে।
ইশ! এই যে দেখো ঠিকমত কাজ করতে পারছি না, ছাড় না মা!
তানহা কখনোই ছাড়ত না।
প্রথম স্কুলে যাবার দিন মামণি বাবাসহ গিয়েছিলো। বাবা বলছে, তুমিও ওর সাথে আজকে থাকো জারিন, অফিস থেকে ছুটি নাও। মেয়েটা না হলে ভয় পাবে। মামণি বলল, তানহা, তুমি এখন বড় হয়েছ না? স্কুলে কি মা থাকে সাথে? তুমি যদি ভয় পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করো তাহলে সবাই বলবে, যাহ! মা কী কিছুই শেখায়নি মেয়েটাকে? সাহস আছে মামণি তোমার?
তানহা বলেছিল, হুঁ, খুব সাহস আছে। তোমরা যাও মামণি। আমি একটুও ভয় পাবো না দেখে নিও। যদিও আশঙ্কা হচ্ছিলো মনে মনে। তাও এ তো তার সম্মানের ব্যাপার, মায়ের সম্মানের ব্যাপার।
তানহাকে সেদিন ক্লাসে বসিয়ে মামণি চলে গিয়েছিলেন। মিসকে কী কী যেন বলে গেলেন, তারপর মিস ক্লাসের সবার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
মেয়েদের কত কত বন্ধু-বান্ধবী থাকে। তানহার ‘বেস্ট ফ্রেন্ড ফর এভার’ ছিলো মা। শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে এই তারুণ্যের দিনগুলোর একান্ত সঙ্গী ছিলেন এই মা। দিনের সব কথা মাকে না বলতে পারলে ও হাঁসফাঁস করত। কার সাথে কী কথা হলো, কোন বন্ধু আজ সবাইকে ফুচকা খাওয়ালো থেকে শুরু করে ক্লাসের দজ্জাল ম্যাম আজ সুমনাকে কী শাস্তি দিল সবই! গল্পের কোন বই শেষ করে কাহিনীটা তার মাকে শোনানো চাই-ই চাই!
ছোট্টবেলা থেকে মামণি তাদের দুই ভাইবোনের মনে গেঁথে দিয়েছেন, শোন তোমাদের বড় হতে হবে, আলী (রা)’র মতো, মুয়াজের (রা) মতো। আসমার (রা) মতো, ফাতিমার (রা) মতো। এত সুন্দর কুরআন পড়তেন মামণি! তিনিই তো শেখাতেন ফজরের পর পবিত্র ভোরগুলোতে। আর কখনো সেসব দিন ফিরে আসবে না তানহার জীবনে। এই কয়েকমাস আগের সকালগুলো কত অন্যরকম ছিলো। বারান্দায় মামণি, বাবা, ও আর তুহিন মিলে রাজ্যের যত গল্প করত নাস্তা খেতে খেতে। ইসলাম, গল্পের বই, বিজ্ঞান, মুভি… এমন কি রাজনীতি-অর্থনীতির বড় বড় ব্যাপারে তুহিনটা পর্যন্ত বিজ্ঞের মত কথা বলত। ওর আজব আজব কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ত তানহা।
চারটার কাছাকাছি বাজে। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতে গেল তানহা। তুহিন এসেছে।
আসসালামু আলাইকুম বুবু।
সালামের জবাব দিয়ে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে। শুকনো মুখে ক্লান্তভাবে ঢুকল বাসায়। তানহার বুকটা হু হু করে উঠল। তার আদরের ভাইটার আজ এ কী অবস্থা! কী করবে সে? কত দিক সামলাবে আর?
নামাজ পড়েছিলি?
হুঁ।
সকালে কী কী খেলি?
যা যা দিয়েছো সওওব। এক্ষণ ক্ষুধা পেয়েছে বুবু। ভাত দাও। হাসিমুখে বললো তুহিন।
কোচিং থেকে আর কোথায় কোথায় গেলি? ছুটি ত আড়াইটায় হওয়ার কথা। এখন চারটে বাজতে চলল।
ওহ! তুমি যা প্রশ্ন করো না! কোথায় আর যাবো, খেলতে গেলাম মাঠে।
তুহিনের গলার আওয়াজ শুনে বাবা এলেন।
বাবানি, তুমি গোসল করে, খেয়ে, রেস্ট নিয়ে একটু আমার ঘরে এসো।
হুঁ। বাবা কী বলেছে শুনলে? আগে গোসল করে এসো, আমি ভাত দিচ্ছি টেবিলে। বলেই তানহা চলে গেল।
বাবা ছেলের কী কথা হলো কে জানে। দেখলো তুহিন বই পত্র নিয়ে বাবার স্টাডি রুমে গেল। পড়াচ্ছে বাবা।
তানহা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ওর দু’আ কবুল করেছেন আল্লাহ। বাবাকে একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছে আজ।
তানহা জানে তার ছোট্ট কাঁধে কত বড় দায়িত্ব। এই পুরো সংসার… বাবাটার পাশে থাকা উচিত তার, তার নিজেকে গড়ে তুলতে হবে, তুহিনকে গড়ে তুলতে হবে, মায়ের স্বপ্নের মত করে।
ছবিগুলি হাতে করে আবার বারান্দায় এলো সে। মামণি যেন বলছে, আমি কী শিখিয়েছি আম্মি তোমায়? মনে আছে ত? তোমার সাহস আছে ত?
দেখতে দেখতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো। একটা দু’টা করে তারা জ্বলে উঠছে আকাশে। আজান দেবে এক্ষুনি।
আশৈশব অভ্যেস ছিলো এই! অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। আজ যেন মেঘ ভেঙে জল ঝর ঝর করে পড়ল… তানহা হু হু করে কেঁদে ওঠে।
কিন্তু মনে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি, একটা প্রত্যয়! “তুমি দেখো মামণি, তোমার মেয়ে তোমার যতেœ গড়া বাগানের ফুলগুলিকে একটুও মলিন হতে দেবে না, কিছুতেই না! অপূর্ব সে উদ্যানে নিশ্চয়ই আমরা আবার একসাথে হেঁটে যাবো. হাতে হাত রেখে ইনশাআল্লাহ। সেদিন আর হারিয়ে যেতে দেব না মামণি তোমায়।”
Heart-touching! Jazakillah appi.