শেখ মিজানুর রহমান
দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর আসে। এটা সত্যিই এক মহা আনন্দের মহা উৎসব। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় “রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাগিদ” যা আমাদের অনুভূতির আবেগে ধ্বনিত হয়। বাচ্চা বুড়ো সবার চোখে টুটে যায় নিঁদ। বছরে একবার এই উৎসব দিবসটি খুশি ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে ফিরে আসে। এই জন্য এটাকে ঈদ বলা হয়।
ঈদ শব্দের অর্থ করতে যেয়ে আরবি ভাষা বিশেষজ্ঞরা এর দুইটি অর্থ প্রকাশ করেছেন। প্রথমটি হচ্ছে ‘ফিরে আসা’। বছরে একবার এই উৎসব দিবসটি খুশি ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে ফিরে আসে। এ জন্য এটাকে ঈদ বলা হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আ’দত বা অভ্যাস। অর্থটি এজন্য যে, ‘আল্লাহ প্রতি বছর ঈদের মাধ্যমে বান্দাকে তাঁর দয়া, এহসান ও করুণা বর্ষণ করে থাকেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈদ হচ্ছে বান্দার জন্য বিরাট আতিথেয়তা। তাই তিনি ঈদের দিন রোজা রাখাকে হারাম করেছেন। ঈদকে তাই আল্লাহর নিয়ামত ও জিয়াফত ভোগ করার চিরন্তন অভ্যাস বা আচার অনুষ্ঠান বলা হয়। আর ঈদুল ফিতর মানে রোজা ভাঙার ঈদ। ব্যাপকার্থে এই দিবসের তাৎপর্য হলো- আল্লাহর নির্দেশে দীর্ঘ এক মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যে তাকওয়া ভিত্তিক চরিত্র গঠনের অনুশীলন করে থাকি তার সমাপনী উৎসব হলো ঈদুল ফিতর। হাদিসে রমজান মাসকে তাকওয়া ও সবরের গুণাবলি অর্জনের পাশাপাশি সমবেদনা প্রকাশের মাস হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সমবেদনার বাস্তব প্রকাশস্বরূপ অর্থহীন বিত্তহীনেরাও যাতে এই উৎসবে শরিক হতে পারে তার ব্যবস্থা করার জন্য ঈদের মাঠে নামাজের জন্য রওয়ানার আগেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তা আদায় না করলে সিয়ামের ফলাফল ঝুলন্ত থাকবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
প্রত্যেক জাতির জাতীয় উৎসব ধর্মীয় রঙে রঙিন নয়। মুসলমানদের ঈদ হচ্ছে ইবাদত। ঈদের নামাজের মাধ্যমে ঐ উৎসবের সূচনা হয়। ঐ দিবসে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে ভাব বিনিময় করা হয় এবং পারস্পরিক সাক্ষাৎ করা হয়। এ সবই ভালো ও কল্যাণকর। এতে অপচয়, অশালীনতা, নগ্নতা ও বেহায়াপনা নেই। সকল কাজ ও অনুষ্ঠান মার্জিত ও যুক্তিসঙ্গত। নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা সম্পূর্ণ ত্র“টিমুক্ত।
মুসলমানদের ঈদ হচ্ছে খুশি ও পবিত্র অনুভূতির প্রকাশ এবং গরিব মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের উৎকৃষ্ট পরিবেশ। যাকাতুল ফিতর দান করে অন্তত বছরে একদিন হলেও ধনী-গরিব সবার খুশিকে ঐক্যবদ্ধ করা হয়। গোটা মুসলিম জাহানে ঐদিন স্বর্গীয় আনন্দের ঢেউ সৃষ্টি হয়।
ঈদের দিনে :
একমাস পরিপূর্ণ সংযমের পর আসে ঈদুল ফিতর। ঈদ তাদেরই জন্য আসে যারা একমাস রোজা রেখেছে। ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওবার পূর্বে ও পরে নিম্নোক্ত কাজগুলো করা উচিতÑ
ষ ঈদের দিন সর্বপ্রথম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং রাসূল (সা)-এর ওপর দরুদ পাঠ করা দরকার।
ষ ঈদের রাতের মর্যাদায় রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহার দুই রাত সজাগ থাকে, যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে সেদিন তার অন্তর মরবে না।” (তাবরানী) এই হাদিস দ্বারা ঈদের রাত্রে ইবাদতের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে।
ষ ঈদের দিন ভোরে ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায় করতে হবে। তারপর ঈদের নামাজ পড়তে হবে। মাঠে ঈদের নামাজ পড়া উত্তম। ঈদের জামাতে পায়ে হেঁটে যাওয়া উত্তম। ঈদের খুৎবা শোনাও জরুরি। ভিন্ন ভিন্ন পথে ঈদের মাঠে আসা-যাওয়া সুন্নত। (বুখারী)
ষ ভোরে উঠে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নাত। ঈদের দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরা উত্তম। নতুন পোশাক পরতে বাধা নেই। তবে অবশ্যই নতুন কাপড় পরতে হবে এ জাতীয় ধারণা অর্থহীন।
ষ ঈদের সময় ছোটদেরকে স্নেহ-আদর এবং বড়দেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত। সাহাবাদের মধ্যে কেউ কেউ একে অন্যকে এই বলে অভিনন্দন জানাতেনÑ ‘আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের কাছ থেকে রমজানের রোজা কবুল করুন এবং পুনরায় রমজানকে ফিরিয়ে দিন।’ সালাম, মোসাফাহা, কুশল বিনিময় এবং আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে ভ্রমণ ইত্যাদি কাজ করা উত্তম।
ষ দীর্ঘ একমাস রোজায় আমাদের নিয়মমাফিক চলা, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে জীবন আচরণের একটা ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। আমরা যেন ঈদের আনন্দে অতিরিক্ত ভুরিভোজে অসুস্থ হয়ে না পড়ি সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
ষ মনে রাখতে হবে, ‘ঈদ’ প্রচলিত অর্থে তথাকথিত কোনো লাগামহীন উৎসব বা পার্বণের নাম নয়। মাসব্যাপী কঠোর সিয়াম সাধনার পর গুনাহ মাফের এই খুশির দিনে আমরা যেন আল্লাহর অপছন্দনীয় কোনো কাজে জড়িয়ে না পড়ি।
ষ ঈদ উপলক্ষে ভালো ও শিক্ষামূলক আলোচনা, নাটক, ফিল্ম, ইসলামী গান ইত্যাদির আয়োজন করা যেতে পারে। তবে ইসলাম বিরোধী কিছু করা যাবে না। তাহলে রোজা ও ঈদের মহিমা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সিয়াম সাধনাকে কবুল করুন, আমাদের জীবনের সব অপরাধগুলো মাফ করে দিন, ঈদের খুশির দিনে আমাদেরকে আরো পবিত্র ও উন্নত জীবন গড়ার শপথ নেয়ার তৌফিক দিন, আমীন।