দেলোয়ার হোসেন
গ্রামে ঈদের নামাজ একটু দেরিতেই শুরু হয়। তারপরও হাঁকডাক করে তাগাদা দিতে হয় পাড়ার মানুষ, পথের মানুষকে। ঈদের মাঠে উপস্থিত নামাজিদের সামনে হুজুর ধর্মের কথা বলছেন। দু’চার জন করে লোক এখনো আসছে। হুজুর দেখলেন নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। তিনি বললেন, যে যেখানে আছে জলদি আসতে বলেন, আর দেরি করা যাবে না।
সঙ্গে সঙ্গে আহাদালী সর্দার প্রতি বছরের মতো ঈদের মাঠের বাইর দাঁড়িয়ে বললেন, নামাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে। আপনারা যে যেখানে আছেন জলদি চলে আসেন। ডাক শুনে পথের মানুষ পাড়ার মানুষ যে যেখানে ছিলো, পাটি বোগলে নিয়ে ম্যারাথন দৌড়ের মতো ছুটতে ছুটতে এসে গেলো ঈদের মাঠে। ঝটফট পাটি বিছিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো নামাজে।
ঈদের জামাত শেষ হতেই শুরু হয়ে গেলো কোলাকুলি। ছোটরাও বড়দের সাথে কোলাকুলি করছে। মুখে হাসি, দু’চোখে আনন্দের বন্যা। হুজুরের সঙ্গে ঈদ মোবারক করার জন্য ভিড় জমে গেছে। ভিড়ের মধ্যে নাহিদ ওর আব্বাকে খুঁজছে। তাকে কোথাও না পেয়ে সে এগিয়ে গেলো পশ্চিমে মিম্বরের দিকে। কাছে দূরের কতো মানুষ হুজুরের চারদিকে ভিড় করে আছে। নাহিদ একটু একটু করে এগিয়ে দেখতে পেলো ওর আব্বাকে। তিনি হুজুরের সাথে কোলাকুলি করছেন। তখন ভিড়টাও বেশ কমে এসেছে। নাহিদও ওর আব্বার সাথে কোলাকুলি করে। তারপর তাকালো হুজুরের দিকে। হুজুর তাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। ও খুব ভক্তিভরে হুজুরের সাথে কোলাকুলি করলো। হুজুর মিষ্টি হেসে বললেন, আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। পড়ালেখা করছো?
জী।
তোমার আব্বার নাম কী?
মাহমুদুল্লাহ।
পাশ থেকে মাহমুদুল্লাহ সাহেব বললেন, হুজুর আমার ছেলেটাকে একটু দোয়া করে দেন। মনটা যেন পড়ালেখার মধ্যে থাকে।
কোন ক্লাসে পড়ছে?
ক্লাস এইটে।
পরীক্ষার আগে আমার সাথে যেনো একবার দেখা করে।
মনের মধ্যে অন্যরকম এক আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরলো নাহিদ। এসেই দেখে বন্ধুরা বসে আছে। সে বললো, তোরা কি কিছু খেয়েছিস?
পিন্টু বললো, খেয়েছি। কিন্তু তুইতো দেরি করলি কেন। এবার চল বেরিয়ে পড়ি।
নাহিদ বললো, আর একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি। বলে নাহিদ গেলো ওর দাদীর ঘরে। বৃদ্ধ দাদীকে কদমবুসি করে এসে মাকে কদমবুসি করলো। মা বললেন, কোথাও কিছু খেয়েছিস?
না মা, আমাকে একটু সেমাই দাও। বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যেতে হবে।
গ্রামের পথে পথে চলে মেয়েরা মনের আনন্দে ঘুরছে। ওদের পরনে নতুন কাপড়। ছোট ছোট মেয়েরা রঙিন প্রজাপতির মতো নেচে বেড়াচ্ছে। ঈদের দিনে কারো মনে কোনো কষ্ট নেই, কোনো দুঃখ নেই।
বন্ধু রফিকুল বললো, এবার সবাই আমাদের বাড়িতে চলো।
নাহিদ বললো, আগে আজাদদের বাড়ি ঘুরে গেলে হতো না।
আগে আমাদের বাড়িতেই চল। তারপর সবার বাড়িতেই যাওয়া যাবে।
ঠিক আছে তাই চল, কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না ।
রফিকুলের আব্বা হারুন সাহেব বড় লোক। শহরে তার অনেক ব্যবসা। ওদের বাড়িটাও বেশ বড়। সে বাড়িতে নাহিদকে দু-একবার নিয়েও গেছে ওর বন্ধু। চার বন্ধু ঘরে ঢুকেই দেখে হারুন সাহেব ড্রইং রুমে বসে আছেন। বন্ধুরা তাকে সালাম করলো। হারুন সাহেব রফিকুল আজাদ ও পিন্টুকে একশত টাকার একটি করে নতুন নোট ঈদের বকশিশ দিলেন। শেষে নাহিদকেও কাছে ডেকে একটা নতুন নোট বাড়িয়ে ধরলেন। নাহিদ বললো, চাচা আপনি আমাদের জন্য দোয়া করেন। আমরা সবাই যেনো ভালো রেজাল্ট করতে পারি।
আরে বেটা আমি সবার জন্যই দোয়া করি। নাও এটা তোমার ঈদের বকশিশ। ঈদ সালামি নেবে না কেন? টাকাটা তোমাদের ইচ্ছে মতো খরচ করবে এটা ঈদের একটা বাড়তি আনন্দ।
চাচা, আমি শুনেছি শহরের ছেলেমেয়েরা এই সালামির টাকা পয়সা পাওয়ার জন্যই বড়দের সালাম করে থাকে। দোয়া পাওয়ার জন্য নয়। ছেলেমেয়েরা রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এই টাকায় তারা পথের নোংরা খাবার কিনে খায়। তা ছাড়া স্বাধীনতা পেয়ে এমন কিছু করে যা তাদের মোটেই করা উচিত নয়। খরচের একটা অভ্যাসও গড়ে ওঠে। আমি জানি না। নবী-রাসূলদের সময় এমন ঈদের বকশিশ দেয়া নেয়ার প্রচলন ছিলো কি না। আমরা সবার বাড়িতে যাবো। বড়দের সালাম দিয়ে দোয়া চাইবো। তারপর ঈদের শিন্নি খাবো তাতেই বুঝি বেশি আনন্দ।
তুমি ছোট মানুষ কিন্তু এতো বড় কথা বলার সাহস কোথায় পেলে? তবে তোমার কথার মধ্যে যুক্তি আছে, সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে এটা দেখা যাবে যে, এই বকশিশের মধ্যে ভালোর চেয়ে মন্দের ভাগটাই বেশি। তোমার ভাবনাটা তুচ্ছ নয়। তুমি তো ছাত্র হিসেবেও ভালো, ক্লাসের ফার্স্ট বয়।
জি।
কিন্তু ক্লাসের বইতে তো এসব কথা লেখা নেই ।
চাচা, ক্লাসের বই ছাড়াও ভালো কোনো বই পেলেই পড়ি। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করেন বড় হয়ে আমরা যেনো ভালো মন্দের বিষয়গুলো গভীর করে বুঝতে পারি।
হারুন সাহেব নাহিদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থেকে শেষে ওকে কাছে ডেকে বসালেন এবং বললেন, তোমাকে আমি ডবল দোয়া করছি। আল্লাহপাক যেনো তোমার আশা পূরণ করেন
নাহিদের বন্ধুরা ব্যাপার স্যাপার দেখে একেবারে চুপ। তবে নাহিদ হারুন সাহেবের কথায় খুব খুশি হয়ে বললো চাচা, আমার বেয়াদবি হলে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করবো, আপনি কি আমার অনুরোধটা রাখবেন?
হারুন সাহেব ঝটফট বলে উঠলেন, অবশ্যই রাখবো। তুমি কী বলতে চাও বলো।
নাহিদ বললো, চাচা, আপনি শহরে গেলে আমাদের এই চার বন্ধুর জন্য খুব সুন্দর চারটি কলম নিয়ে আসবেন। আমরা বড় হয়েও আপনার দেয়া উপহার বুকে ধরে রাখবো।
চমৎকার আইডিয়া। সত্যি তোমার তুলনা হয় নারে ছেলে। ছোটরা বড়রা সবাই যদি এমন করে একটু ভাবতো।
তখন রফিকুল পিন্টু ও আজাদ পকেট থেকে সালামের টাকাটা বের করে হারুন সাহেবের টেবিলে রেখে বললো, আমরা টাকা নিতে চাই না। ভালো একটা কলম পেলেই বেশি খুশি হবো।
হারুন সাহেব হো হো শব্দে হেসে উঠলেন। তারপর চেঁচিয়ে বললেন, রফিকুলের মা, আমার চারজন বিশেষ মেহমানের জন্য ভালো ভালো খাবার নিয়ে এসো।
হারুন সাহেবের স্ত্রী ভেতর থেকে কথাটা শুনে কাজের মেয়েটার সঙ্গে নিয়ে গোশত, পোলাও, জর্দা, সেমাই ইত্যাদি এনে বললেন, কোথায় আপনার বিশেষ মেহমান?
তোমার চোখের পাওয়ার কি কমতে শুরু করেছে? সামনেই তো বসে আছে।
এই আপনার বিশেষ মেহমান?
হ্যাঁ, আজ আমি নিজের হাতে মেহমানদের পেটপুরে খাওয়াবো।
রফিকুলের আব্বার কথা শুনে নাহিদ এবারও চুপ থাকতে পারলো না। সে হাসতে হাসতে বললো, চাচা আমরা কিন্তু বেশি খেতে পারবো না। কারণ আমরা অনেক বাড়িতে যাবো। সেখানেও অল্পস্বল্প খেতে হবে। যদি না খাই তা হলে তারা কষ্ট পাবে।
হারুন সাহেব বললেন, তুমি ঠিকই বলেছো। ঠিক আছে অল্প করে খাও, যা তোমাদের মন চায়।
খাওয়া শেষ করে চার বন্ধু বেরিয়ে পড়লো। এবাড়ি সেবাড়ি ঘুরে ঘুরে চেয়ে চেয়ে ঈদের সেমাই মিষ্টি খেলো। দোয়াও চাইলো সবার কাছে।
ওদের ব্যবহারে বড়রা খুশি হয়ে বললো, তোমরা নিজের থেকে এলে, একটু মিষ্টি মুখ করলে, আমাদের প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। মনে হচ্ছে এ গাঁয়ে আমরা কেউ কারো পর নই। সবাই একে অপরের আত্মীয়। ঈদের পরও তোমরা কিন্তু মাঝে মাঝে এসো।
আমরা কেন ভুলে যাই যে, মুসলমান ভাই ভাই, কেউ কারো পর নয়। পৃথিবীজুড়ে এমন শান্তির জন্যই তো একদিন আল্লাহ তায়ালা আরবের বুকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা)কে।
Alhamdulillah,Good .valo.