Home গল্প ওরা চাঁদে যায়

ওরা চাঁদে যায়

হারুন ইবনে শাহাদাত

আজ নাবিলের মনটা খুশিতে ভরা। গ্রাম থেকে ওর বড় চাচা ও তার বড় ছেলে নাফিস এসেছে। চাচীর হাতে বানানো নারকেল-পুলি, গোশত-পুলি, এলোকেশি, দুধ-চিতই আনতে ভুল করেননি চাচা। নাবিল পিঠা খেতে খুব ভালবাসে। চাচীর হাতের পিঠা হলে তো কথাই নেই। গ্রামের পিঠার মজাই আলাদা। বাসায় যে ওর মা পিঠা বানান না তা নয়। কিন্তু ইট পাথরের ঢাকা শহরের পরিবেশে বানানো পিঠাগুলো কেন যেন গ্রামের খোলা আকাশের নিচে মাটির চুলা আর মাটির পাতিলে বানানো পিঠার মতো মজা লাগে না। নাবিল নাফিসের চেয়ে দুই-তিন বছরের বড়। কিন্তু দুইজনে গলায় গলায় ভাব। নাবিল গ্রামে দাদু-বাড়ি গেলে ওরা দু’জন সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। খাবার সময় ছাড়া ওদের টিকিটিও দেখা যায় না। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুই ভাই। যমুনা নদীর তীর, হেমনগর রাজবাড়ি, বকুলতলা, শিমলা-পলিশা নাফিসের নানা বাড়ি ছোটাছুটি চলে সারাদিন। কখনো ওদের চাচার সাথে পুকুরে মাছ ধরে। নাবিল অবাক হয়ে মাছ ধরা দেখে। জীবন্ত মাছের লাফালাফি দেখে ওরা খুব মজা পায়। ঢাকায় এমন তাজা মাছ খুব একটা দেখা যায় না।
‘ভাইয়া।’ নাফিসের ডাকে নাবিলের ভাবনায় ছেদ পড়ে।
‘কী?’ নাবিল নাফিসকে প্রশ্ন করে।
‘এবার আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?’
‘আব্বুর কাজের যা চাপ, দেখি আব্বু কী বলেন?’ নাবিল ভাবে, নাফিসের কী সুবিধা। সে বাড়ি যাওয়ার সাথে সাথে তাকে নিয়ে সাইকেলে বেরিয়ে পড়ে। কাউকে সাথে নিতে হয় না। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়ালেও কোনো সমস্যা হয় না। ঢাকা শহরটাও যদি এমন নিরাপদ হতো। কত মজা হতো!
‘নাবিল, নাফিস ও তোমার চাচাকে নিয়ে ডাইনিংয়ে আসো।’ নাবিলের মা ডাকেন।
নাবিল, চাচাকে নিয়ে ডাইনিং রুমে যায়। টেবিলে পিঠা-পুলির আয়োজন দেখে ওর মন খুশিতে নেচে ওঠে। ওর প্রিয় গোশত পুলি-পিঠা মুখে দিয়ে চাচার কাছে জানতে চায়, ‘চাচা, পিঠায় মহিষের গোশত নাকি গরুর গোশত দিয়েছেন চাচী?’
চাচা হাসতে হাসতে বলেন, ‘কেন, মহিষের গোশত?’
‘মহিষের গোশত আমার খুব প্রিয়। কিন্তু ঢাকায় কোন্টা গরুর আর কোন্টা মহিষের গোশত চেনার উপায় নেই। কাওরানবাজার নয় তো কাপ্তান বাজার না গেলে মহিষের গোশত কেনাই যায় না।’ নাবিল বলে।
‘ঝাওয়াইল বাজারের কসাইরা খুব বড় একটা মহিষ জবাই করেছিল, সেই মহিষের গোশত দিয়ে তোমার চাচী এই পিঠা বানিয়ে তোমার জন্য পাঠিয়েছে।’ চাচা বলেন।
‘চাচা, চাচীকে বলবেন আমি খুব খুশি হয়েছি। এবার চাচীর জন্য একটি ভাল গিফট কিনবে॥’ নাবিল বলে।
শুধু চাচীর জন্যই কিনবে..
না, না, আপনার জন্য নাফিসের জন্যও কিনবো।
খাওয়া শেষে নাবিল নাফিসকে বলে, ‘চলো, এবার তোমাকে নিয়ে মহাকাশ অভিযানে যাবো।’
নাবিলের কথা শুনে নাফিস বলে, ‘ভাইয়া তোমার চাপা মারা বন্ধ করো। একা একা স্কুলে যেতে পারে না, তিনি কি না আমাকে নিয়ে যাবেন মহাকাশে!’
নাবিল হাসতে হাসতে বলে, ‘ঠিক বলেছো, আমরা শহরের শিশু-কিশোররা একা একা স্কুলে যেতে পারি না। তোমাদের মতো অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারি না। কিন্তু দেশ-বিদেশে এমনকি মহাকাশ অভিযানেও যেতে পারি।’
‘তাহলে চলো।’ নাফিস নাবিলের হাত ধরে বলে।
নাবিল নাফিসকে নিয়ে ওর রুমে যায়। দু’জন পাশাপাশি দু’টি চেয়ারে বসে। নাবিল নাফিসের হাতে একটি জয়ষ্টিক দেয়। দু’জন দুই জোড়া কালো চশমা পরে নিয়ে একটি টেবিলের সামনে বসে বলে, ‘এই হলো আমাদের মহাকাশ যানের সুইচবোর্ড। প্রথমে আমরা চন্দ্রাভিযানে যাবো।’
নাফিস হাসতে হাসতে বলে, ‘ভাইয়া, মহাকাশের আর কোন গ্রহতে এখনো কোন মানুষ যেতে পারেনি, অচেনা, অজানা জায়গায় না যাওয়াই ভাল, কি বলেন?’
‘ঠিক, বলেছো। অচেনা অজানা গ্রহে গিয়ে আবার হারিয়ে যেতে পারি।’
‘ভাইয়া আমাদের এ নভোযানের নাম কী?’
‘কেন চাঁদে যাওয়ার যান এ্যাপোলো-১১। তোমার মনে নেই পৃথিবীর ইতিহাসের সেই অবিস্মরণীয় দিনটির কথা। ২০ জুলাই, ১৯৬৯। আমেরিকার কেপ কেনেডি থেকে সকাল ৯টা ৩২ মিনিটে তিন মহাকাশ অভিযাত্রী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্সকে নিয়ে চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি জমায় ‘এ্যাপোলো-১১’। ১৬ জুলাই রওনা হয়ে তারা চাঁদে পৌঁছান ২০ জুলাই (বাংলাদেশ তারিখ ২১ জুলাই)।’
‘ভাইয়া তোমার মাথায় অনেক শার্প। দিন তারিখ আমার খুব একটা মনে থাকে না।’ নাফিস বলে।
‘মনে রাখবে যতই ভুলিবে ততই পড়িবে, তাহলেই মনে থাকবে।’ নাবিল বলে।
‘বা চমৎকার! যতই ভুলিবে ততই পড়িবে।’ নাফিস নাবিলের এই কথাটি কয়েকবার আবৃত্তি করে।
‘শোন, নীল আর্মসট্রং এর নিকট থেকে ধার করা আমাদের এই নভোযান, এ্যাপোলো-১১ এর চারটি প্রধান অংশ হলো : ১. ফ্রিস্টেজ রকেট স্যাটার্ন-৫ (তিনটি রকেট নিয়ে তৈরি) ২. সার্ভিস মডিউল- রকেট ইঞ্জিন ও জ্বালানির জায়গা ৩. লুনার মডিউল ‘ঈগল’- বিশেষভাবে তৈরি ছোট গাড়ি, যা চাঁদের বুকে চলার উপযোগী ৪. কম্যান্ড মডিউল ও কলম্বিয়া- মহাকাশযানের মূল নিয়ন্ত্রক অংশ। চাঁদের বুকে পৌঁছবার ৬২ থেকে ৭৫ মাইল দূর থেকেই আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন লুনার মডিউলে প্রবেশ করেন। কম্যান্ড মডিউল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এটি চাঁদে নামতে শুরু করে। চাঁদের পৃষ্ঠ অসমান হওয়ায় চাঁদের আকাশে সমান্তরালভাবে একে চালিয়ে নিয়ে সুবিধেমতো ইতস্তত নুড়ি ছড়ানো একটি জায়গায় নামানো হয়। এর প্রায় ৭ ঘণ্টা পরে আর্মস্ট্রং প্রথম মানব হিসেবে পা রেখেছিলেন চাঁদের মাটিতে।’
নাবিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই নাফিস জানতে চায়, ‘ভাইয়া, আমাদের হাতে অত সময় নেই, ৭ ঘণ্টা কেন ১ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে পারবো না। আচ্ছা ভাইয়া, ওরা কতক্ষণ ছিলো চাঁদের মাটিতে।’
নাবিল বলে, ‘নীল আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন চাঁদের বুকে সময় কাটান ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। এ সময় তারা চাঁদের বুকে পরীক্ষা চালানোর নানা যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং চাঁদের পাথর সংগ্রহ করেন। অভিযানের শেষাংশে তারা ফিরে যান লুনার মডিউলে। এটি চাঁদের বুক থেকে উঠে এসে কম্যান্ড মডিউলের সাথে যুক্ত হয়। আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন কম্যান্ড মডিউলে চলে আসে এবং লুনার মডিউলকে ছেড়ে দেয়া হয় মহাশূন্যে। পরবর্তীতে রকেট চাঁদের মহাকর্ষ কাটিয়ে পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করে। ২৪ জুলাই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের ঠিক আগে সার্ভিস মডিউল পরিত্যক্ত হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩ কিলোমিটার উঁচুতে মহাকাশযান থেকে তিনটি বিরাট প্যারাসুট দিয়ে নেমে আসেন তারা। কম্যান্ড মডিউল নিরাপদে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে।’
নাফিস খুশিতে হাত তালি দিতে দিতে বলে ওঠে, ‘কী মজা! আমরা ছুটে চলছি এই মাটি থেকে ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০৩ কিলোমিটার দূরে বায়ুশূন্য ও প্রাণহীন পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদে।’
নাবিল ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলে, ‘মজা বুঝবে একটু পর। চাঁদে দিনের বেলা তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি কেলভিন এবং রাতে ১০০ ডিগ্রি কেলভিন।’
‘নাবিল, নাফিস তোমরা কি সারাদিন ভিডিও গেম নিয়েই পড়ে থাকবে, নাকি নাওয়া-খাওয়ার দরকার আছে?’ নাবিলের আম্মুর ডাকে দুই ভাই চমকে ওঠে।

SHARE

Leave a Reply