Home গল্প জবা ও দোয়েল

জবা ও দোয়েল

নাছরিন আক্তার
স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে তামান্না আপুকে দেখে আনন্দে মন ভরে যায় জবার। তামান্না আপুর এসএসসি পরীক্ষা শেষ, তাই জবাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছেন। তামান্না আপু আসা মানেই জবার আনন্দে সময় কাটানোর দিন। তামান্না আপুকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে নেয় জবা। এক সাথে দুপুরের খাবার খায় তামান্না আপু ও জবা। আসরের নামাজ পড়ে ছাদে যায় দু’জন। জবা সাথে নিয়ে যায় তার প্রিয় ডায়েরি ও কলম। এ বছরই প্রথম জবা ডায়েরি লেখা শুরু করেছে। ছাদের ওপর গাছ লাগানোর স্টাইলগুলো লক্ষ করেন তামান্না আপু। টবের মধ্যে লাগানো ছোট বড় ফুলগাছ পরিত্যক্ত বড় বালতিতে মাটি ফুড়ে তাতে লাগানো কচি লাউগাছ ইত্যাদি। জবাদের ছাদে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশগুলো চমৎকার উপভোগ করা যায়।
চারদিকে সবুজ গাছপালা, মাথার ওপর বিস্তীর্ণ নীলাকাশ। ছাদের ওপর আমগাছের ছায়ার নিচে বসল দু’জন। গাছে সবুজ কাঁচা আম ঝুলছিল। জবা বলল, আপু, দেখ তোমার মত ডায়েরি লেখা শুরু করেছি। তামান্না আপু বলল, ভালই তো।
জবার ডায়েরি খুলে তামান্না আপুর হাতে দিল আর বলল, পড়। তামান্না আপু চোখ বুলালো Ñ ৩০.০১.১২ ইং সোমবার সকাল ৯টায় লেখা। পড়তে শুরু করলোÑ
এটি হচ্ছে একটি শীতের সকাল। প্রতিদিনের মতো আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। নামাজ আদায় ও কুরআন তেলাওয়াত শেষে আমার হোমওয়ার্কগুলো শেষ করলাম। আম্মু রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। আমি আমাদের পোষা কুকুর টমের সাথে দুষ্টুমি করতে করতে আমাদের বাগিচায় এসে পড়ি। বাগিচায় এসে আমি গাছপালার শ্যামলতায় মুগ্ধ হয়ে যাই। আমার প্রিয় জবাফুল গাছটিতে টকটকে লাল জবাফুল ফুটেছে। সকালের সোনালি রোদের পরশে কুয়াশারা পালিয়েছে। গাছের ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে রোদ পড়েছে বাগিচায়। রোদ দেখে শরীরটা উম পেতে চাইল। রোদের দিকে আসতেই চোখে পড়ল একটি দোয়েল পাখি। মাটিতে বসে রোদ পোহাচ্ছে দোয়েল পাখিটি।
আমি অবাক হলাম, কেন পাখিটি মাটিতে বসে আছে! দোয়েল পাখি যে চঞ্চল পাখি! এক জায়গায় যার মন বসে না, ডালে ডালে উড়ে বেড়ায়, মিষ্টি সুরের গানের পাখি দোয়েলটির কী হলো! আমি দোয়েলটির কাছে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যেই না আমি ওর কাছে যাই, তখনি ও ছোট ছোট গাছগুলোর নিচে উড়ে যায়। আমি লক্ষ করলাম দোয়েল পাখিটি ঠিকমত উড়তে পারছে না।
দোয়েলটিকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। তারপরও ডানা ঝাপটিয়ে অতিকষ্টে উড়ছে। আমি পাখিটি ধরতে চাইলাম। ওর অসুস্থতা আমাকে তাড়া দিতে লাগল। তাই আবারও দোয়েলটির পিছু ছুটলাম। আমি যতবারই ওর কাছে যাই ততবারই ও কষ্ট পেয়েও দূরে সরে যায়। দোয়েল পাখিটি ধরতে না পেরে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি বাগিচায় বড় বড় মোটা গাছগুলোর আড়ালে চুপি চুপি দোয়েলটির কাছে যাই। কিন্তু দোয়েল পাখিটি বাগিচার ছোট ছোট গাছ, ঝোপগুলোর পাশ দিয়ে আমার কাছে থেকে দূরে সরে যায়। এভাবে দোয়েলটি বাগিচার সর্ব উত্তরে ডোবাটির অপর প্রান্তে চলে যায়। ডোবাটি ময়লা পানিতে পরিপূর্ণ। তাই ওপারে যাওয়া আমার সম্ভব নয়। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, পাখিটিতো অসুস্থ, যদি মারা যায় অগত্যা ঘরে ফিরে এলাম। দোয়েল পাখিটির জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। ইঁ ইঁ ইঁ (কান্না)। হে আল্লাহ, তুমি অসুস্থ দোয়েল পাখিটিকে রক্ষা কর। বিপদে আপদে তুমিই একমাত্র রক্ষাকারী।
পড়া শেষ করে তামান্না আপু বলল, ওয়াও, চমৎকার! তুমি এত সুন্দর একটি ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলে। একেবারে নতুন ডায়েরির প্রথম পাতায় একটি দোয়েল পাখি নিয়ে তোমার অভিষেক। তো পরে কি পাখিটির কোনো খোঁজ পেয়েছিলে? ডায়েরির পাতা উল্টালেন তামান্না আপু।
জবা বলল, হ্যাঁ, পেয়েছি। ওসব আর ডায়েরিতে লিখিনি। সেতো আরেক করুণ কাহিনী। শুনবে তুমি? তামান্না আপু বলল, হ্যাঁ বল।
জবা বলল, ঘরে ফিরে ডায়েরিতে লিখে ফেললাম। তাড়াতাড়ি স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। ঘর থেকে বেরুতেই দেখি চাচী আম্মু পাখি সম্পর্কে বলছেন। খাঁচায় একটি অসুস্থ দোয়েল পাখি নিয়ে প্রভা নেড়েচেড়ে দেখছে আর কথা বলেছ। চাচী আম্মুর কাছে শুনলাম দোয়েলটিকে ধরার বর্ণনা। বুঝতে পারলাম একটু আগে ডায়েরিতে যে দোয়েল পাখিটির কথা লিখেছিলাম, সে এখন খাঁচায় বন্দী। স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই স্কুলের পথে পা বাড়ালাম। স্কুল লাইব্রেরির একটি ম্যাগাজিনে কবি আবুল হোসেন আজাদের একটি ছড়া পড়েছিলাম। বেশ চমৎকার, শুনবে?
“দোয়েল, দোয়েলরে তুই মাঠে ঘাটে/ সবখানেতে আছিস
গাছের ডালে নদীর পাড়ে/ লেজটি তুলে নাচিস।
ঘুরে ঘুরে/বেড়াস উড়ে/ কাছে কিংবা দূরে
থাকিস শুধু দৃষ্টি জুড়ে/চঞ্চলতায় বাঁচিস …
….ভোরবেলাতে ঘুম ভাঙাতে /সবার সাথে উঠিস
এ-ডাল ও-ডাল করে গাছে/ শিষটি দিয়ে ছুটিস।”
আমি ভেবেছিলামÑ যাক এবার দোয়েলটি আমাদের বাড়িতে থাকবে। সুস্থ হলেই ওকে ছেড়ে দিব আমরা। আমি জানি এত আনন্দ এবং কষ্ট দু-ই আছে। আমার জন্য তো আমি দুয়েল পাখিটিকে কষ্ট দিতে পারি না। তুমি কী বল, আপুু?
তামান্না আপু বলল, তোমার ভাবনা ঠিক আছে। জবা আবার বলতে শুরু করল, তারপর অনেক আনন্দে আশা নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরে যা শুনেছিলাম তা অতি কষ্টেরই বটে। দুপুর নাগাদ দোয়েল পাখিটি খাঁচায় বন্দী অবস্থায় মারা যায়। চাচী আম্মু ওটাকে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছেন। এখনও দোয়েল পাখি দেখলে সে অসুস্থ দোয়েলটির কথা মনে পড়ে যায়। আর ওর কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়।
তামান্না আপু বলল, দেখ মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে ‘মায়ের ভালোবাসা’ গল্পটি। পাখিদের মধ্যে স্নেহ-মায়া ভালোবাসা রয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী (সা)ও পাখিদের ভালবাসতেন।
জবা বলল, জান আপু, প্রায়ই দু’একটা নতুন পাখি দেখি যেগুলোর নাম আমি জানি না। চেনা পাখিগুলো হলোÑ হাঁস, মুরগি, কবুতর, চড়–ই, চিল, টিয়া, শালিক, কাক, কোকিল, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, টুনটুনি, বুলবুলি, বউ কথা কও, কোয়েল আর …. আর কী? ওহ: মনে পড়ছে না।
তামান্না আপু বলল, কুটুম পাখি, অতিথি পাখি ইত্যাদি। দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি। আর কোন কোন দেশে দোয়েল পাখি পাওয়া যায়, জান কি?
জবা টবের মাটিতে জন্মানো ঘাস থেকে একটি বুনো ঘাসফুল ছিঁড়ে নিয়ে বলল, না তো, আমি জানি না।
তামান্না আপু বলল, বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশে দোয়েল পাখি পাওয়া যায়।
জবা বলল, আচ্ছা আপু, পাখিদের ওড়ার ব্যাপারটা দেখ। মহান আল্লাহ ওদের কত্ত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন! তামান্না আপু বলল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন অতি উত্তম গঠনে আর মানুষের জন্য পৃথিবী ও অন্যান্য সৃষ্টিকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন।
জবা মনোযোগ দিয়ে শোনে।
তামান্না আপু বলল, পাখিরা সৌন্দর্যের প্রতীক। আমাদের দেশে প্রচুর পাখি রয়েছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির এক অনন্য নিদর্শন। আমাদের বিবেককে জাগ্রত ও বিকশিত করার জন্য আমাদের চাপপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাখি ও প্রাণীর ভূমিকা রয়েছে। নৈতিক মূল্যবোধের প্রভাবেই অসুস্থ দোয়েলটির জন্য তোমার মনে সহযোগিতার ইচ্ছা জেগেছে। আর হ্যাঁ, পাখিদের ওড়া দেখেই উড়োজাহাজ আবিষ্কারের সূচনা হয়েছে।
জবা বলল, হ্যাঁ, অলবার রাইট ও উইলবার রাইট দুই ভাই মিলে সর্বপ্রথম উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেন।
তামান্না আপু বলল, আমাদেরকে পাখির মতোই সুন্দর জীবন গড়তে হবে, বিশ্বজগৎ ঘুরে দেখতে হবে, আমাদের জ্ঞান ভা-ারকে সমৃদ্ধ করতে হবে আর মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে হবে। কেননা, আল্লাহ পৃথিবীতে আমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন। মায়ের ডাকে ছাদ থেকে নেমে আসে তামান্না আপু ও জবা।
লাউয়ের মাচায় একটি দোয়েল এসে তখনও উড়ে উড়ে শীষ বাজাচ্ছে।

SHARE

Leave a Reply