তোমাদের আজ জুলুম-শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন মহান নেতা, ফরায়েজী আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রধান নেতা মুহসীন উদ্দীন আহমদ দুদুমিয়া সম্পর্কে বলব। তাঁর সংগ্রামী জীবন এবং জমিদার ও বেনিয়া ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর জীবন ছিল অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে এক জীবন্ত প্রতিবাদ। বাংলার মাটি হতে জুলুম, শোষণ ও নির্যাতন মূলোৎপাটনের সংগ্রামে যে ক’জন দেশপ্রেমিক আজীবন সংগ্রাম করে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন মুহসীন উদ্দীন আহমদ দুদুমিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলায় অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ শাসণ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর অবদান অনবদ্য। তাঁর প্রদর্শিত বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ বিরোধী আন্দোলনে আজো বাংলাদেশবাসীকে যুগপৎ অনুপ্রাণিত করে। স্বৈরাচার ও নির্যাতনমূলক বেনিয়া শাসন নির্মূল করে এদেশে ইসলামী আদর্শভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর জীবনের প্রধান স্বপ্ন। তাই বাংলাদেশে স্বৈরশাসন বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে মুহসীন উদ্দীন আহমদ দুদুমিয়ার নাম স্মরণীয়।
মুহাম্মাদ মুহসীন উদ্দীন আহমদ দুদুমিয়া ১৮১৯ সালে বর্তমান শরীয়তপুর জেলার মুলকতগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৭০-১৮৩৯)। তিনি ছিলেন তাঁর পিতার একমাত্র পুত্র। বাল্যকালে দুদুমিয়া পিতার কাছ থেকে আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষালাভ করেন। তাঁকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর অত্যন্ত মেধাবী দুদুমিয়াকে মাত্র ১২ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য মক্কা শরীফে প্রেরণ করা হয়। কথিত আছে, মক্কা যাত্রার আগে দুদুমিয়া চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে গিয়ে পশ্চিম বাংলার ইসলামী আন্দোলনের নেতা তিতমীরের (১৭৮২-১৮৩১) সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় পূর্ব বাংলায় গড়ে ওঠা ফরায়েজী আন্দোলনের মতো পশ্চিম বাংলায় আর একটি সুসংগঠিত ইসলামী আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল। প্রতিরোধ আন্দোলনে তিতুমীরের সংগ্রামী চেতনা পশ্চিম বাংলায় অত্যাচার, শোষণ ও দলন নীতিকে সমূলে উৎপাটনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। তিতুমীরের সান্নিধ্য দুদুমিয়াকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে।
মক্কা মুকাররমায় শিক্ষা সমাপন ও হজ পালন শেষে দুদুমিয়া দেশে ফেরার পর ফরায়েজী আন্দোলন মজবুত ভিত্তির ওপর সংগঠিত করার কাজে নিজেকে সোপর্দ করেন। পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর সান্নিধ্যে থেকে ছোটবেলা থেকেই তিনি এই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় লক্ষ্য করেছেন। তাঁর পিতা জীবিত থাকাকালীন সময়ে অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে ফরায়েজী আন্দোলনের কর্মীদের সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে তিনি একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় নিজ দলের শক্তি বৃদ্ধির বিষয়ও তিনি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন।
১৮৩৯ সালে পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর ইন্তেকালের পর মুহাম্মদ মুহসীন উদ্দীন আহমদ দুদুমিয়া ফরায়েজীদের ওস্তাদ বা নেতা নির্বাচিত হন। দুদুমিয়া ফরায়েজী আন্দোলনকে সারাদেশে একটি সুসংগঠিত আন্দোলনের রূপ দেন। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথেই ফরায়েজী আন্দোলনের ইতিহাসে এক নব অধ্যায়ের সূচনা হয়। নেতৃত্ব লাভের পরই তিনি অত্যাচারী জালেম হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ও আপসহীন মনোভাব গ্রহণ করেন। তিনি মুসলিম প্রজাদের ওপর আরোপিত বিভিন্ন বেআইন ও পৌত্তলিক কর (যেমনÑ দাড়ি রাখার ওপর কর, দুর্গা পূজা ও কালী পূজা কর) প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং এ বিষয়ে মুসলমানদের সংগঠিত করেন। ইংরেজ নীলকুঠির সাহেবদের ব্যাপারেও দুদুমিয়া আপসহীন ভূমিকা গ্রহণ করেন। কারণ হিন্দু জমিদারদের সহায়তায় নীল কুঠিয়ালরা কৃষকদের নানাভাবে হয়রানি করতো। এইসব অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করেন। হিন্দু জমিদারদের অন্যায় কার্যকলাপ এবং অত্যাচার নির্যাতনে বাধা দেয়ায় জমিদাররা দুদুমিয়ার বিরোধিতা শুরু করে। দুদুমিয়ার নির্দেশে প্রজা সাধারণ জমিদারদের পূজা কর দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে জমিদারগণ তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। হিন্দু জমিদাররা প্রকাশ্য গরু জবাইতেও বাধা দিতে থাকে। দুদুমিয়া এই অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ হন। তিনি কানাইপুরের শিকদার নামে পরিচিত অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে ১৮৪১ সালে ফরায়েজী বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু জমিদার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আপস করে এবং প্রজা নির্যাতনমূলক সব পদক্ষেপ প্রত্যাহার করে। ১৮৪২ সালে তিনি ফরিদপুরের জমিদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে দুদুমিয়ার সংগ্রামের সাফল্য বার্তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর আন্দোলনের প্রতি জনগণের সমর্থন ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। দেশের নিপীড়িত জনগণ দলে দলে তাঁর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। জেমস ওয়াইজ তার ইস্টার্ন বেঙ্গল গ্রন্থে বলেছেন, ‘ফরিদপুর, পাবনা, বাকেরগঞ্জ, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার ঘরে ঘরে শ্রদ্ধার সঙ্গে দুদুমিয়ার নাম উচ্চারিত হতে থাকে।’
দুদুমিয়ার আন্দোলনের বিস্তারে হিন্দু জমিদার ও নীল কররা বিব্রতবোধ করতে থাকে। তারা প্রজা বিদ্রোহ দমনে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে হিন্দু জমিদাররা নীলকরদের প্ররোচিত করে। অনেক জমিদার ও নীলকরদের সাথে দুদুমিয়ার সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের ফলে শত শত ফরায়েজী কর্মীকে কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু কৃষক সমাজে দুদুমিয়ার জনপ্রিয়তা এতই প্রবল ছিল যে, ইংরেজ সরকার তাঁকে বন্দী করতে সাহস পেত না। মাদারীপুরের প্রভাবশালী নীলকর এন্ডারসন ডানলপের প্রভাবে দুদুমিয়ার বিরুদ্ধে বহু ফৌজদারী মামলা রুজু করা হয়। তাঁকে কয়েকবার গ্রেফতার করা হয় এবং আদালতে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আদালতে সাক্ষীর অভাবে দুদুমিয়া খালাস পান। ১৮৪৬ সালে ডানলপের গোমস্তা ও হিন্দু জমিদারের বাহিনী দুদুমিয়ার বাড়িঘর আক্রমণ ও তছনছ করলে এর প্রত্যুত্তরে দুদুমিয়ার বাহিনী ডানলপের কাছারি আক্রমণ করে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে। ভীতসন্ত্রস্ত জমিদার ও নীল কুঠিয়ালরা এরপরও হয়রানিমূলক তৎপরতা অব্যাহত রাখে।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজরা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা দুদুমিয়াকে গ্রেফতার করে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কলকাতার জেলে আটকে রাখে। ইংরেজদের ভয় ছিল যে, দুদুমিয়ার আহ্বানে যে কোনো মুহূর্তে পঞ্চাশ হাজার লোক সাড়া দিতে এবং তাঁর যে কোনো আদেশ মান্য করতে প্রস্তুত ছিল। দুই বছর পর কারামুক্ত হয়ে ফরিদপুর পৌঁছার পর তাঁকে আবার জেলে ঢোকানো হয়। ১৮৬০ সালে ফরিদপুরের জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ঢাকার বংশালে বসবাস করতে থাকেন।
বাংলার মুক্তিসংগ্রামের এই মহানায়ক ১৮৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। ১৩৭ বংশাল রোডে তাঁর বাসস্থান সংলগ্ন স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। হ