Home সাহসী মানুষের গল্প সোনা

সোনা

সোনা
মুহাম্মাদ দারিন

বাবু তোমার হাতে ওটা কী?
ব্যাঙ। বামহাতের উপর ডান হাত দিয়ে আলতো করে চেপে ধরে আছে সাড়ে চার বছরের ফাহিম।ওর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে পিট পিট করে তাকাচ্ছে ওটা।
কী? বলে মা লাফ মেরে উঠে দাঁড়ান। দুই হাত দিয়ে ওর দুই হাত আলাদা করেন। ওর বাম হাতে বসে আছে ছোট্ট সবুজ কুচকুচে এক সোনা ব্যাঙ। মা ওর হাত ধরে ঝাঁকি মারেন। লাফ মেরে ওটা যেয়ে পড়ে মেঝের ওপর।
সেলসম্যান ওটা ধরতে যায়। কিন্তু তার আগে ওটা তিড়িং তিড়িং করে লাফ মেরে দোকান থেকে বাইরে চলে যায়।
তুমি ওটা কোথায় পেলে? মা ফাহিমের হাত ধরে রেখেই প্রশ্ন করেন।
ও মায়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ডান হাত নাকে দিতে যাবে এমন সময় মা আবার ওর হাত ধরে বলেন, খবরদার! ওই হাত নাকে-মুখে দিবে না।
কিন্তু ফাহিমের নাক তখন সুড় সুড় করছে। যে করেই হোক হাত তাকে নাকে দিতেই হবে। ও জোরাজুরি করতেই মা তার রুমাল বের করে ওর নাক মুছে দেন ভালো করে। বলেন, না ধোয়া পর্যন্ত এই হাত নাকে-মুখে দিবে না। আচ্ছা, তুমি ব্যাঙ ধরলে কোথা থেকে?
আম্মু শোনো। বলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ফাহিম, রিক্সা থেকে নামার পর ব্যাঙটা আমার পিছে লাফ মেরে মেরে আসছিলো আর বলছিলো- ফাহিম তুমি হাত পাতো আমি তোমার হাতে উঠবো। আমি হাত পাতলাম আর ও আমার হাতে চলে এলো।
ফাহিমের বাম হাত তখনও সামনে ধরা ছিলো। মা তার হাতে ছোট্ট একটা থাবা মেরে বললেন, খবরদার ধরবে না ওই হাতে কিছু?
থাক না। ছোট ছেলে, পেয়েছে হয়তো ব্যাঙ কোথাও। সামনে ছোট্ট সাদা স্কুল কেডস হাতে বসা সেলসম্যান বলল। আপনি বসেন।
মা নিজে টুলে বসেন এবং ফাহিমের হাত ধরে বসান।
ফাহিম এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। চার মাস অতিবাহিত হয়েছে অথচ ওকে ক্লাসে বসানো যাচ্ছে না। জোরজার করে স্কুলে আনলেও ক্লাসে বসালেই কান্না জুড়ে দেয়। মা সেদিন ওকে বলেছিলো, সবাই স্কুলে যায় কী সুন্দর লেখাপড়া করে। আর তুমিতো কিছুই করতে চাও না। তোমার সাথে আমি আর কথা বলব না।
ফাহিম ওর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, আম্মু শোনো, আমার এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি।
মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তার ছোট্ট সোনা বলে কী! কে বলেছে তোমার বয়স হয়নি? দেখো না তোমার থেকে ছোট ছোট বন্ধুরা তোমার স্কুলে যায়। কী সুন্দর সুন্দর কবিতা বলে!
আমি বড় হলে স্কুলে যাব আর মেলা মেলা পড়বো। মায়ের কোলে বসে বলে ফাহিম।
মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। মনে মনে বলেন, আল্লাহ তুমি আমার মানিককে স্কুলে যাওয়ার সুমতি দাও।
চারমাস পর ফাহিম আজ ক্লাসে বসেছে। হোক না সেটা ড্রয়িং ক্লাস। ক্লাসে তো বসেছে। এই আনন্দে মা আজ ওর স্কুল কেডস কিনতে এসেছেন। জামা-প্যান্ট অবশ্য ভর্তির সময় তৈরি করা হয়েছিলো।
স্কুল থেকে সরাসরি বাজারে এসেছেন মা ফাহিমকে নিয়ে।
ছোট্ট সাদা জাম্প কেডস ওর পায়ে ঠিক হওয়া এবং পছন্দ হওয়ায় ওটা কেনেন মা।
জুতোর দোকান থেকে বের হয়ে রিক্সা না পাওয়ায় পায়ে হেঁটে এগুতো থাকেন ফাহিম ও তার মা।
খেলনার দোকানের সামনে দিয়ে যেতেই ফাহিম থমকে দাঁড়ায়। টেনে থাকে ওর মায়ের হাত।
মা বলেন, কী হলো?
আমি ব্যাঙ কিনবো। বলল ফাহিম।
ছি! আবারও ব্যাঙ। ঘৃণার সাথে উচ্চারণ করেন মা।
না না না। আমার ব্যাঙ কিনে দাও। জেদ শুরু হয় ফাহিমের।
সোনামণি আমার, ব্যাঙ ভালো না। পঁচা। মা ভোলাতে চান ওকে।
কিন্তু নাছোড় বান্দা জেদি ফাহিমের জেদ শুরু হয়। মায়ের হাত ছাড়িয়ে ও খেলনার দোকানে ঢুকে যায়। মাও ঢোকেন পিছে পিছে।
দোকানের শোকেসে অবিকল জুতার দোকানে ফাহিমের হাত থেকে চলে যাওয়া ব্যাঙের মতো এক ব্যাঙ বসে আছে।
ঘৃনায় মায়ের শরীর ঘিন ঘিন করে ওঠে। মা ফাহিমের হাত ধরে বলেন, ও ভালো না। নিতে হবে না ওটা।
আমি ব্যাঙ নেবোই নেবো। জেদি ফাহিমের জেদ উথলে ওঠে।
এগিয়ে আসে সেলসম্যান। একটু উসকে দেন ফাহিমের জেদকেÑ সুন্দর খেলনা ওটা আপা। আমরা একপিছই এনেছি।
না.. না.. না। একটু আগে আমি এর হাত থেকে ব্যাঙটা ফেলে দিয়েছি।
কী যে বলেন আপা। আমরা একপিছই এনেছি।
মা ফাহিমের হাত ধরে দোকান থেকে বের হতে যান। অমনি শুরু হয় ছেলের কান্না। কান্না জড়িত কণ্ঠে ও বলতে থাকে, ব্যাঙ দে আমার ব্যাঙ দে।
মা পড়ে যান বেকায়দায়। ছেলে এবার শুরু করে অসংলগ্ন কথা। আমি ব্যাঙ নেবোই নেবো। ব্যাঙ কিনে দে আমার ব্যাঙ কিনে দে।
মায়ের না কিনে দেবার মানসিকতা দেখে সেলসম্যান এবার সুর পাল্টে বলে, বাবু ওটা ভালো না। ব্যাঙ পঁচা।
এই কথায় যেন গরম কড়াইতে আরও দুফোঁটা ঘি পড়ে।
ফাহিম ভলিউম বাড়িয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে বলতে থাকে, ব্যাঙ কিনে দে আমার ব্যাঙ কিনে দে। আমি ব্যাঙ নেবো। আমি ব্যাঙ নেবোই নেবো।
মা অবস্থা বেগতিক দেখে ফাহিমকে বলেন, কিনে দেব তাহলে কাল থেকে সবগুলো ক্লাস করতে হবে কিন্তু?
করবো.. করবো। তাহলে আমাকে ব্যাঙ কিনে দাও।
মা সেলসম্যানের দিকে তাকিয়ে বলেন, দেন ওটা।
সেলসম্যান ওটা শোকেস থেকে নিয়ে প্যাকিং করে ফাহিমের হাতে দেন।
মা টাকা পরিশোধ করতে যান। ফাহিম মৃদু চিৎকার করতে থাকে, নাক, নাক.. নাক।
দোকানসুদ্ধ লোক অবাক হয়ে ফাহিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও মাথা নিচু করে বলতে থাকে নাক, নাক।
মা বুঝতে পারেন বিষয়খানা। দ্রুত এসে রুমাল বের করে ফাহিমের চোখের পানি বিশেষ করে নাকের পানি ভালোভাবে মুছে দেন।
ইতিমধ্যে ও প্যাকিং ছিড়ে ব্যাঙ হাতে করে নেড়েচেড়ে দেখছে।
মা ওর হাতে ধরা ব্যাঙের দিকে তাকিয়ে একবার নাক সিটকে ওর হাত ধরে বের হন।
বাড়ি এসে ফাহিম ব্যাঙটাকে হাতছাড়া করেনি। এমনকি গোসল করেছে ওটা হাতে। দুপুরে মা ওকে খাওয়ানোর সময়ও ওটা ওর হাতে ছিল। সারা বিকাল খেলা করেছে ব্যাঙটাকে শার্টের বুক পকেটে নিয়ে।
সন্ধ্যায় ব্যাঙটাকে ফেলে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মা ওকে অল্প একটু পড়াতে পেরেছেন। বিকালে একটু দৌড়াদৌড়ি করায় রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে ফাহিম।
অন্যদিনে সকাল আটটার আগে ফাহিমের ঘুম ভাঙে না। অথচ আজ সাতটায় উঠেই ও মাকে বলা শুরু করে, আম্মু তাড়াতাড়ি স্কুলে নিয়ে চলো। দেরি হলে সবাই সামনে বসে পড়বে।
মা অবাক হন। যে ছেলে স্কুলে যেতে চায় না সে কি না স্কুলে যাওয়ার জন্য পাগলপারা। ছেলের এই মতির জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানান তিনি।
আজ কোনো কান্না কাটি করেনি ও। সবগুলো ক্লাস করে।
স্কুল থেকে ফেরার সময় ফাহিম ওর মাকে বলে, জানো আম্মু, ব্যাঙ না আমাকে রাতে বলেছিলো আমাকে স্কুলে আসতে। আমি নিয়মিত স্কুলে আসলে ও নাকি আমার সাথে খেলা করবে।
ব্যাঙ তোমার সাথে কথা বলেছে? মা তো অবাক।
হ্যাঁ, বলেছে তো! ফাহিমের নির্লিপ্ত জবাব।
স্কুলে আসার কথা বলে তো ভালো কথায় বলেছে।
আবার নিয়মিত লেখাপড়াও করতে বলেছে আমাকে। বলে ও বুক পকেট থেকে সবুজ কুচকুচে সেই সোনা ব্যাঙটা বের করে।
মা নাক সিঁটকিয়ে ফাহিমের হাতে ধরা ব্যাঙের দিকে তাকান। ব্যাঙটাকে জীবন্ত বলে মনে হয় তার কাছে।
ফাহিম বলে চলে, জানো আম্মু, আমি এর নাম দিয়েছি ‘সোনা’।
মা জানতে চান, সোনা কেন?
সোনা বলেছে ওর চেহারা নাকি সোনা ব্যাঙের মতো। হড়বড় করে ফাহিম আরো কিছু বলতে থাকে।
কিন্তু মায়ের ওসব কথায় কান নেই। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সোনা অর্থাৎ সোনা ব্যাঙের দিকে। অবাক হয়ে ভাবেন ফাহিম সোনা ব্যাঙের নাম জানলো কী করে?
তিনি আরো অবাক হলেন যখন সোনা কথা বলে উঠলো। বলল, হ্যাঁ, ফাহিম ঠিক বলেছে। এখন থেকে ও নিয়মিত ত‹ুলে যাবে এবং লেখাপড়াও করবে। আমি ভিন গ্রহের প্রাণী। এসেছিলাম পৃথিবীতে ঘুরতে। সূর্যের তাপে গতকাল আমি প্রায় মরতে বসেছিলাম। এমন সময় ফাহিম রাতÍা থেকে তুলে আমাকে র?া করে। ও খুব ভালো ছেলে। আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু ওর সোনা নামক ব্যাঙ খেলনাটা থেকে যাবে। পিৎজ সোনাকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিবেন না।
বলে কী ব্যাঙটা! মা কি ভুল ফনলেন? ভাবলেন, হোক না ভুল, তার মানিক ভালোভাবে লেখাপড়া করলেই হলো।
ব্যাঙটা এখন তার সামনের দুইপা উল্টোভাবে মুখে ঠেস দিয়ে ফাহিমের হাতে ঘুমাচ্ছে। মা আলতোভাবে হাত বুলান সোনার গায়ে।

SHARE

Leave a Reply