কায়েস মাহমুদ..
তিনি এক দারুণ পণ্ডিত ব্যক্তি! শাস্ত্র বিশারদ। ইহুদী ধর্মগুরু হিসাবে খুবই নাম ডাক তার।
সুতরাং তাওরাত তার কাছে পরিষ্কার। পরিষ্কার আছে তাওরাতের সকল বিষয় আশয়।
এই পণ্ডিত এবং জ্ঞানী ব্যক্তি মদীনার বাসিন্দা।
তিনি অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা করছেন খেজুর গাছের মাথায় উঠে। সেই সাথে খেজুরও পাড়ছেন।
চোখ তার দূরে, বহু দূরে।
মনের ভেতর তখন তার কেবলই তুফান ছুটছে। কখন আসবেন তিনি? কখন!
সেই কাঙ্খিত স্বপ্নের মহামানবটির জন্যই তার এই প্রবীক্ষার প্রহর গোনা।
খেজুরের দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। নেই তেমন আগ্রহ। যত মনোযোগ আর আগ্রহÑসে কেবল স্বপ্নের মেহমানের জন্য। আলোর রশ্মির জন্য।
তিনি খেজুর পাড়ছেন। আর নিচে তার বৃদ্ধা ফুফু খেজুর কুড়াচ্ছিলেন।
ঠিক এমনি সময়ে! হ্যা, এমনি সময়ে হঠা’ এক ব্যক্তির একটি চিৎকার তার কানে লেগে ধাক্কা খেল। তারপর আটকে গেল হৃদয় গভীরে। লোকটি চিৎকার করে বলছেÑ ‘আরবের অধিকারী ব্যক্তি আজ এসে গেছেন!’
সত্যিই! খেজুর গাছের কাণ্ডে ধরে তিনি আর থাকতে পারলেন না।
নেমে এলেন নিচে। তিনি সমানে কাঁপছেন!
এ কিসের কাঁপন! কিসের শিহরণ! সে কেবল কাঙ্খিত মহাপুরুষকে দেখা এবং পাওয়ার আবেগের কাঁপন। তিনি সাথে সাথে খুশিতে জোরে খুব জোরে তাকবীর দিয়ে উঠলেন।
ফুফু বললেন, আরে তোর কি হলো! এমন করছিস কেন!
তিনি বললেন, ফুফু! আপনি কি জানেন মদিনায় এখন কে পা রেখেছেন!
Ñনাতো!
Ñতিনি সেই হেরার জ্যোতি, সেই মহা মানব, সেই শেষ নবী যার সম্পর্কে তাওরাতে আমি বিস্তারিত জেনেছি। আমি তো এতকাল তাঁর অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম! আজ তিনি এসে গেছেন। এসে গেছেন আমাদের মাঝে। কি সৌভাগ্য মদিনাবাসীর!
ফুফুকে কথাগুলো বলেই তিনি দৌড় দিলেন মহানবীর (সা) কাছে।
তার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে আবেগে।
তখনো তিনি কাঁপছেন সমানে।
রাসূলের (সা) গিয়ে তিনি এক নজর তাঁকে দেখেই বুঝে গেলেন যে ইনিই শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)। তবে আর দেরি কেন!
না। সকল প্রতীক্ষার পালা শেষ। এবার তিনি সাথে সাথেই রাসূলের (সা) কাছে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
ফুফু। বয়সের ভারে কাবু হয়ে গেছেন। তিনিও আস্তে ধীরে পৌঁছে গেলেন রাসূলের (সা) কাছে। এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন।
রাসূলের (সা) চারপাশে মানুষের ভিড় আর ভিড়। মহানবী (সা) তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনÑ ‘তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও। মানুষকে আহার ধরাও। আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখো। আর রাতে গভীর রাতেÑমানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামায পড়ো। তাহলেই তোমরা সহজে জান্নাতে যেতে পারবে।’
তাওরাত জ্ঞানী এবং পণ্ডিত এই ব্যক্তি যখন ইসলাম গ্রহণ করলেনÑতখন তার দূর হয়ে গেল কলিজার পিপাসা।
আনন্দে ভরে উঠলো বদরের চাতাল।
এখন তার জন্য একটিই কাজ।Ñ সেটি হলো ইসলামের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা। রাসূলের (সা) আনুগত্যের জন্য সদা সর্বদা তৎপর থাকা। সেটাকেই তিনি নিজের জীবনের জন্য মান্য করে নিলেন।
এরপর শুরু হলো তার পথ চলা।
ইসলামের পথে। সত্যের পথে। আলোর পথে।
পথটি যে মসৃণ নয় বরং পিচ্ছিলÑ এ কথা তিনি জেনে বুঝেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
সুতরাং যে ব্যক্তি তার জানমাল সর্বস্ব আল্লাহর কাছে কুরবানী দিতে শপথবদ্ধ হয়Ñতার জন্য আর কিসের ভয়! কিসের শঙ্কা! কিসের পরওয়া!
কোনো ভয় বা শঙ্কা নয়। বরং তিনি ইসলাম গ্রহণের ঈমানের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলেন।
ঈমান তো জাগিয়ে তোলে সুপ্ত সাহস এবং চেতনা। ঈমান তো প্রশস্ত করে দেয় হৃদয় সমুদ্রের চেয়েও। বিশ্বাস, সাহস, সংযম, ধৈর্য আর প্রজ্ঞার দ্যুতি ছড়িয়ে দেয় ঈমান। সেই ঈমানের আরোয় আলোকিত তিনি।
এলো খন্দক যুদ্ধ।
যুদ্ধ! যুদ্ধ মানেই তো এক কঠিন পরীক্ষা। ঈমানের পরীক্ষা মুসলমানদের জন্য।
এধরনের পরীক্ষার জন্য তো মুমিনরা সকল সময়ই মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকেন।
তিনিও ছিলেন।
খন্দকে যুদ্ধের ডাক পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। ফুলে ফেঁপে উঠলো তার সাহসের বাদাম।
তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন।
এরপর যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার জীবদ্দশায়Ñপ্রতিটি যুদ্ধেই তিনি আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। সাহসের সাথে, বীরত্বের সাথে মুকাবেলা করেছেন দুশমনদের।
তার সেই সাহসী ভূমিকা ইসলামের ইতিহাসে অমর-অম্লান হয়ে আছে।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত মর্যাদাবান সাহাবী।
সাহাবীদের মধ্যেও তার অবস্থানটি ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক।
এটা পদাধিকার বলে নয়। অর্থের কারণে নয়। গোত্রীয় মর্যাদার কারণে নয়।
বরং আল্লাহপাক এবং রাসূলের (সা) আনুগত্য, ভালোবাসা এবং নিজেকে ঈমানের পরীক্ষায় শতবার উত্তীর্ণ করার কারনেই।
তিনি রাসূলকে (সা) যেমন নিঃশর্তভাবে ভালোবাসতেন, রাসূলও (সা) তাকে তেমনি ভালোবাসতেন।
রাসূলের (সা) কাছে একদিন এক পেয়ালা ‘সারীদ’ আনা হলো। তিনি খাওয়ার পর কিছুটা রয়ে গেল। রাসূল (সা) বললেন, এই ফাঁক দিয়ে একজন জান্নাতী ব্যক্তি প্রবেশ করবে এবং এটে টুকু খেয়ে ফেলবে।’ হযরত সাদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার ভাইকে তিনি অজু করতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন ভাই এসে এটুকু খেয়ে নিক। কিন্তু তার আগেই এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি রাসূলের (সা) রেখে দেয়া সেই এঁটে টুকু খেয়ে রাষূলের (সা) কথা মতো জান্নাতের হকদার হয়ে গেলেন!
কি সৌভাগ্যের ব্যাপার! কি খোশ নসিব!
রাসূলের (সা) কথা মতো তিনিই হলেন দশম জান্নাতী ব্যক্তি। যারা দুনিয়াতেই জান্নাতের শুসংবাদ পেয়েছিলেন। এতবড় সৌভাগ্য আর মর্যাদা কি কোনো কিছুর সাথেই তুরণঅ খলঅ ছরৈ?
শুধু তাই নয়, তার শানেই মহান রাব্বুল আলামীন নাযিল করেছেন আল কুরআনে একাধিক আয়াত। যেমনÑসূরা আল আহক্বাফের ১০ নম্বর, সূরা আলে ইমরানের ১১৩ ও ১১৪ নম্বর, সূরা আল রাদের ১০ ও ৪৩ নম্বর আয়াত।
কোন্ পর্যায়ের মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী হলে এমনটি হয়! কোন্ পর্যায়ে ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এমনটি হতে পারে!
তিনি একবার একটি স্বপ্ন দেখলেন। দারুণ স্বপ্ন!
ঘুম থেকে জেগে উঠেই তিনি ছুটে গেলেন রাসূলের (সা) কাছে। বললেন, ইয়া রাসূল (সা) আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি।
রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, কী স্বপ্ন?
তিনি বললেন, স্বপ্নটি এমনÑ আমি যেন একটি সবুজ উদ্যান দেখতে পেলাম। যার মাঝখানে রয়েছে একটি লোহার খুঁটি। খুঁটির গোড়া মাটিতে এবং আগা আকাশে। খুঁটির আগায় একটি রশি বাঁধা। খুঁটি ওপরে ওঠো। আমি উঠে রশি ধরলাম। তখন আমাকে বলা হলো : শক্ত ভাবে আঁকড়ে থাকো। রশিটি আমার হাতে থাকা অবস্থায় আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি।”
হে রাসূল (সা)! এই স্বপ্নটির অর্থ কি!
রাসূল (সা) তাকে বললেন, “উদ্যানটি হলো ইসলামের উদ্যান। আর খুঁটি হলো ইসলামের খুঁটি। আর রশি হলো ইসলামের রশি। তুমি আমৃত্যু ইসলামের ওপর থাকবে।”
এই অসাধারণ মর্যাদার অধিকারী সাহসীর মধ্যে ছিলো না কোনো প্রকার অহংকার কিংবা দেমাগ। বরং সকল সময় আল্লাহর ভয়ে থাকতেন কম্পমান। ভীত এবং কম্পমান।
তিনি সরল সহজ জীবন যাপন করতেন।
একবার তিনি লাকড়ীর বোঝা মাথায় নিয়ে হাঁটছেন। এমন সময় লোকে বললো, কি আশ্চর্য! আপনার মত মানুষ লাকড়ী বইছেন! তাও মাথায় করে!
তিনি হেসে বিনয়ের সাথে জবাব দিলেনÑ “হ্যা, ঠিক। তবে আমি এই কাজের মাধ্যমে আমার অহংকার ও আভিজাত্য চূর্ণ বিচূর্ণ করতে চাই। কারণ আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি : যার অন্তরে একটি সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”
স্বয়ং আল্লাহপাক এবং রাসূল (সা) যার মর্যাদার সনদ প্রদান করেছিলেনÑ সেই মহান সৌভাগ্যবান সাহাবীর নামÑআবদুল্লাহ ইবনে সালাম।
যিনি পেয়েছিলেন সুবাসিত ভোরের সন্ধান। তার মতো ঈমান, ঈমানের দৃঢ়তা এবং ইসলামের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মতো সাহস ও যোগ্যতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন।
তাহলে আমরাও হতে পারি জান্নাতের অধিবাসী। যেটা আমাদের সকলেই কাম্য। দুনিয়ার মর্যাদা, সহায়-সম্পদ ও সুখ সমৃদ্ধি খুবই ক্ষণস্থায়ী। একমাত্র স্থায়ী হলো জান্নাতের সুখ ও মর্যংদা।
এসো সেই সুখ এবং মর্যাদা অর্জনের জন্য আমার আল্লাহকে ভয় করি।
ইসলামকে ভালোবাসি।
রাসূলকে (সা) মনে-প্রাণে গ্রহণ করে তাঁরই আদর্শে জীবন গড়ে সফল হই। তাহলে আমরাও পেতে পারি সুবাসিত ভোরের ঘ্রাণ।