সিলেট বাংলাদেশের উওর-পূর্বে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ। বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ জেলা দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত। জৈন্তা পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য, জাফলংয়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, ভোলাগঞ্জের সারি সারি পাথরের স্তূপ পর্যটকদের টেনে আনে বারবার। এ জেলার বিশাল সংখ্যক লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। সিলেটের পাথর, বালুর গুণগতমান দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। জেলার প্রাকৃতিক গ্যাস সারা দেশের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে। হযরত শাহজালাল (রহ) ও হযরত শাহ পরান (রহ)-এর পবিত্র মাজার শরীফ এ জেলায় অবস্থিত। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ লোক মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করে। আসে বিপুল সংখ্যক পর্যটক। শীত মৌসুমে সিলেটের হাওর-বাঁওড়গুলো ভরে ওঠে অতিথি পাখির কলরবে।
১৭৬৭ সালে এ অঞ্চল ব্রিটিশদের করায়ত্ত হওয়ার পর ১৭৭২ সালের ৩ জানুয়ারি সিলেট জেলার সৃষ্টি হয়। কালের প্রবাহে ১২টি উপজেলা নিয়ে বর্তমান সিলেট জেলা গঠিত।
সীমানা
পূর্বে ভারতের আসাম, পশ্চিমে সুনামগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা, উত্তরে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়।
জেলার পটভূমি
ঔপনিবেশিক আমলেই সিলেট দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। সিলেট পৌরসভা সৃষ্টি ১৮৭৮ সালে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক মারাত্মক ভূমিকম্প গোটা শহরটিকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তীতে ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে ওঠে ইউরোপীয় ধাঁচের আরও সুন্দর ও আধুনিক শহর। ১৮৯০ এর দশকের শেষ ভাগে বেশ কিছু রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়। ১৯১২-১৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটি শাখা সিলেটের সাথে সংযুক্ত হলে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সিলেটের বিচ্ছিন্নতার প্রকৃত অবসান ঘটে। চা শিল্পের কারণে বিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে প্রবাসী সিলেটীদের এবং সিলেট শহর দ্রুত নগরায়ণ ঘটতে থাকে এবং বর্তমানেও তা অব্যাহত রয়েছে। ১৪ শতকে ইয়েমেনের সাধক পুরুষ হযরত শাহ জালাল (রহ) সিলেট জয় করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। নানকার বিদ্রোহ সিলেটের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
শিল্প ও বাণিজ্য
সিলেটে ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান তেমন একটি গড়ে ওঠেনি। ভারী শিল্পের মধ্যে আছে ফেঞ্চুগঞ্জ প্রাকৃতিক গ্যাস সার কারখানা লিমিটেড। এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিদেশমুখিতা, সস্তা শ্রমের অভাব এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহ এর মূল কারণ। সরকারিভাবে সিলেটে দু’টি বিসিক শিল্প নগরী গড়ে উঠেছে- ১. খাদিম নগর শিল্পনগরী ও ২. গোটাটিকর শিল্পনগরী।
ভাষা ও সংস্কৃতি
ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং ভাষার পরিবর্তন হয় এলাকাভিত্তিক ও দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। সে হিসেবে সিলেটীদের মুখের ভাষা প্রকৃত বাংলা ভাষা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। সিলেট ঐতিহাসিকভাবেই আলাদা ভাষা এবং আলাদা সংস্কৃতি ধারণ ও লালন করে আসছে। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস, যার ফলে ভাষার ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য। পূর্বে সিলেট আসাম রাজ্যের অন্তর্গত থাকার ফলে সিলেটের ভাষা ও সংস্কৃতিতে আসামের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও সিলেটের রয়েছে এক বৈচিত্র্যময় নিজস্ব ভাষা যা নাগরী লিপি হিসেবে পরিচিত। নাগরীর অক্ষর মাত্র ৩২টি। যুক্ত বর্ণ সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। মাত্র আড়াই দিনে শেখা যায়। নাগরী লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টির অনেক পর এর মুদ্রণ শুরু হয়। টাইপ ও ছাপাখানার অভাবে হাতে লিখেই নাগরীর প্রসার ঘটে। বৃহত্তর সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় নাগরী লিপি ও সাহিত্যের প্রচার ও সমাদর ছিল।
খনিজসম্পদ
খনিজসম্পদে ভরপুর সিলেট জেলা। এ জেলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে মূল্যবান খনিজসম্পদ।
প্রাকৃতিক গ্যাস : হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্র, কৈলাশটিলা গ্যাস ক্ষেত্র, সিলেট গ্যাস ক্ষেত্র, সেভরন গ্যাস ক্ষেত্র। বাংলাদেশের মোট গ্যাসের উল্লেখযোগ্য অংশ সিলেটে মজুদ আছে।
অপরিশোধিত তেল : প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে গ্যাস কূপ থেকে খনিজ তেল আহরণ করা হয়। তেল সম্পদের মধ্যে আছে ডিজেল, পেট্রল ও অকটেন।
পাথর : বাংলাদেশের পাথরের চাহিদার ৯০%ই আসে সিলেট থেকে।
চুনাপাথর : সিলেট জেলা চুনাপাথরেও বেশ সমৃদ্ধ।
দর্শনীয় স্থান
আবহমান কাল ধরে সিলেট পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম। সিলেটের পথে-প্রান্তরের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্য। হযরত শাহজালাল (রহ) ও হযরত শাহপরাণ (রহ)-এর স্মৃতি বিজড়িত এ পুণ্যভূমিতে দেশী-বিদেশী ভক্তকুলের আগমন ঘটে। ধর্মীয় গুরুত্বের দিক হতে সিলেটে যে রকম অনন্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও তেমনি। উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান মালনীছাড়া পর্যটকদের কাছে আরেক বিস্ময়। এ ছাড়াও সুরমা নদীর ওপর কিন ব্রিজ না দেখলে সিলেট ভ্রমণ অনেকটাই খালি থেকে যায়।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আছেÑ ১. জাফলং, ২. ভোলাগঞ্জ, ৩. লালাখাল, ৪. তামাবিল, ৫. হাকালুকি হাওর, ৬. শ্রী চৈতন্য দেবের বাড়ি, ৭. হাছন রাজার মিউজিয়াম, ৮. এমএজি ওসমানী বিমানবন্দর, ৯. পর্যটন মোটেল, ১০. জাকারিয়া সিটি, ১১. ড্রিমল্যান্ড পার্ক, ১২. আলী আমজাদের ঘড়ি, ১৩. জিতু মিয়ার বাড়ী, ১৪. মুনিপুরী রাজবাড়ী, ১৫. মুনিপুরী মিউজিয়াম, ১৬. শাহি ঈদগাহ, ১৭. ওসমানী শিশু পার্ক ইত্যাদি।
এক নজরে জেলা
আয়তন- ৩৪৯০ কিলোমিটার, জেলা সৃষ্টির তারিখ- ১৭৭৫ সাল, ভৌগোলিক অবস্থান- ২৪০৪০’ থেকে ২৫০১১’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১০৩৮’ থেকে ৯২০৩০’ দ্রাঘিমাংশ, লোকসংখ্যা- ২৯৫৭০০০ (পুরুষ ১৫২২০০০, মহিলা ১৪৩৫০০০), উপজেলা- ১২টি, থানা- ১৩টি, পৌরসভা- ৪টি, ইউনিয়নÑ ১২টি, গ্রাম- ১৪, শিক্ষার হার- ৪৫.৫৯%, সংসদীয় আসন- ৬টি, প্রধান নদ-নদী- সুরমা, কুশিয়ারা, পিয়াইন, গোয়াইন, সারি, মোট আবাদি জমি- ৩৫১৮০৭ হেক্টর, কৃষিজ সম্পদ- ধান, আলু।