শরীফ আবদুল গোফরান..
দেয়ালঘেরা একটি বাড়ি। বাড়ির চারদিকে গাছগাছালি। গাছে গাছে কতো রঙের পাখি! সকাল-সন্ধ্যায় পাখিদের গানে মন ভরে যায়। এই বাড়িতে বাস করতেন একজন বড় কবি। তিনি প্রতিদিন পাখিদের গান শুনতেন। পাখিদের সাথে কথা বলতেন। কবিতা লিখতেন। কবি একটি বড় রাতা মোরগ পালতেন। মোরগটিও পাখিদের সাথে সুর মিলিয়ে ডাক দিতো কুক্কুরু-কু। দেয়ালের ওপর উঠে খেলা করতো, দৌড়াদৌড়ি করতো। দেয়ালঘেঁষা ছিলো গাঁয়ের পথ। এই পথে গাঁয়ের মানুষ যাতায়াত করতো।
একদিন বিকেল বেলা। কবির মোরগটি দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে ডাক দিচ্ছে। এই পথে তখন যাচ্ছিল গাঁয়ের এক দরিদ্র লোক। ডাক শুনতেই তার চোখ পড়লো মোরগটির দিকে। তার লোভ হলো। সে মোরগটিকে ধরে নিয়ে পালিয়ে গেল। কবি সাহেব তখন বাড়িতে ছিলেন না। কিছুক্ষণ পরই তিনি বাড়ি ফিরলেন। বাড়ির গেটে আসতেই এক লোক বলল, ও পাড়ার এক লোক আপনার মোরগটিকে চুরি করে নিয়ে গেছে। কবি বললেন, যাও লোকটাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এসো। যেই কথা সেই কাজ। আরো কয়েকজন মিলে দরিদ্র লোকটিকে কবির কাছে ধরে নিয়ে এলেন। লোকটি জোড় হাত করে কাঁপতে কাঁপতে কবির সামনে এসে দাঁড়ালো। কবি তাকে দেখে একটুও রাগ করলেন না। তিনি তাকে নরম ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, কিরে তোর কাছে মসলা কিনার টাকা পয়সা আছে? লোকটি মাথা নেড়ে বললো, না হুজুর আমার পকেটে কোনো টাকা পয়সা নেই। তাহলে মোরগটা রান্না করবি কী করে? কবি পকেট থেকে কিছু টাকা বের করলেন, লোকটার হাতে দিলেন। বললেন, যা- এই টাকা দিয়ে কিছু মসলা কিনে নিস। লোকটি কবির আচরণে অবাক হলো। তাঁর এতো শখের পালা মোরগটি চুরি করার পরও তিনি একটুও রাগ করলেন না। বরং মসলা কিনার জন্য টাকাও দিয়ে দিলেন। এমন উদার মানুষ কি আছে? আচ্ছা বন্ধুরা, তোমরা কি বলতে পারো কে সেই কবি, যিনি এতো উদার? এতো মহৎ? হ্যাঁ, তিনি হলেন সবার প্রিয় কবি কাজী কাদের নওয়াজ। আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রচলিত ধারার অন্যতম সার্থক কবি তিনি।
আচ্ছা বলতো, কবি কাদের নওয়াজ কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন? বলছি, শোন। ১৯০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি কবি কাজী কাদের নওয়াজ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী আল্লাহ নওয়াজ আর মাতা ফাতেমাতুন্নেছা। কবি কাজী কাদের নওয়াজের স্ত্রীর নাম ছিলো নাসেরা বিবি। কবি ছিলেন নিঃসন্তান। কবি কাজী কাদের নওয়াজ ছিলেন একজন প্রেমিক কবি। তিনি ফুল-পাখি ও মানুষকে যেমনি ভালোবাসতেন, তেমনি ভালোবাসতেন তোমাদের মতো ছোট্ট বন্ধুদের। কবিতা ছিলো এই কবির প্রাণ। তবে তার ছোটদের জন্য লেখা গল্পের ভাণ্ডারও কম নয়।
কাজী কাদের নওয়াজের প্রথম শিশুতোষ কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। তখন তাঁর বয়স কতো জানো? মাত্র চৌদ্দ বছর। পরবর্তী জীবনে তিনি আরো বহু কবিতা রচনা করেছেন। স্বাভাবিক কবিশক্তির অধিকারী কাজী কাদের নওয়াজ বাংলা কাব্য সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট আসনের দাবিদার। তিনি শিশু সাহিত্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন। ফলে বাংলা একাডেমী ১৯৬৩ সালে শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করে। তিনি সহজ সরল ভাষায় ছোটদের মনের মতো করে অজস্র কবিতা লিখেছেন। তৎকালীন বিকাশ, শীশমহল, মিনার, শিশু-সওগাত, গুলবাগিচা, শিশু সাথী, শুকতারা, জলছবি, খেলাঘর, আলাপনী, রঙধনু, সবুজ পাতা, আজাদ প্রভৃতি পত্রিকায় এসব কবিতা প্রকাশিত হতো। ১৯২৩ সালে যখন কবির প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় তখন তিনি মাত্র অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন। কলকাতার বিকাশ পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রথম কবিতাটির নাম ‘স্বদেশ স্মৃতি’-
‘স্বদেশ ত্যাজিয়া বিদেশেতে আমি
আসিয়াছি বহুদিন,
স্মৃতিটি আজিও জাগে হৃদিপটে
প্রাণে বাজে সেই বীণ।’
কাজী কাদের নওয়াজের শিশুপাঠ্য কবিতাগুলোর মধ্যে সার্থক কবিতা হলো- ‘ঘুম-পাড়ানী গান’ এবং ‘হারানো টুপী’। যেমন-
‘চাঁদের আলোয় ফুল ফুটেছে
চকোর উড়ে যায়,
ঝিরঝিরিয়ে বইছে হাওয়া
আয়রে ও ঘুম আয়।
নীল আকাশের অসীম শেষে
মেঘগুলো সব হাওয়ায় ভেসে
কোন অজানা পরীর দেশে
খবর নিয়ে যায়,
বাইরে কোথাও নাইরে পড়া
আয়রে ও ঘুম আয়।’
কবি কাজী কাদের নওয়াজের শিশুসাহিত্য গ্রন্থাকারে প্রকাশিত একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘দাদুর বৈঠক’। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। এই বইটি কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্য শ্রেণীভুক্ত ছিলো।
‘দাদুর বৈঠকের’ গল্পগুলো গ্রাম্য সুখ-দুঃখের কাহিনী, বাস্তব জীবনের পাঁচালী। তাতে আছে কল্পনার রঙ খেলা। সরল ও মধুর সে সব গল্প। বুড়োদের নিকট থেকে সংগ্রহ করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নতুনভাবে এসব গল্প তিনি উপস্থাপন করেছেন। কবি কাজী কাদের নওয়াজের শিশুসাহিত্যের প্রতিটি কবিতা ছন্দময় ধ্বনি মাধুর্যমণ্ডিত। আরবি, ফার্সি ও যুক্ত শব্দের সার্থক প্রয়োগ তাঁর কবিতাকে করেছে মহিমান্বিত। মার্জিত ভাষায় রচিত তাঁর শিশুসাহিত্য সৃষ্টির আরেক বৈশিষ্ট্য।
কাহিনী কাব্য রচনায় কবি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। গ্রাম্য উপমা, রূপক, অনুপ্রাস দিয়ে একটি গ্রাম্য আবহ গড়ে তুলেছেন এই কবি। অতি তুচ্ছ একটি ঘটনাকে রূপময়ী কবিতাকারে বর্ণনায় তিনি একজন কুশলী শিল্পী। যেমন-
‘নাতনী, সে নাতনী
চাদ নহে, চাঁদনী
তার তরে তারাহার
আজো আমি গাঁথিনি।’
অথবা-
‘ডাক নাম তার ‘রাশু’
হাস্য উচ্ছল ঠোঁট দু’টি তাই
আমরা বলি ‘হাসু’।
আম্মা তাকে জড়িয়ে বুকে
বলেন পরশমণি,
আব্বা বলেন দরশ পেয়ে
তুইরে হরষ খনি।’
কবি কাজী কাদের নওয়াজের গল্প কম হলেও খুব মজার। তোমরা ওসব গল্প যদি পড়ো দেখবে, পড়তে পড়তে এক সময় কল্পনায় ঠিকই দাদুর আসরে চলে যেতে পারবে। যেমন দেখো কবি তাঁর ‘দাদু সেখের বৈঠক’ গল্পটি কিভাবেই বর্ণনা করেছেনÑ
“বলতে কি সেকালের পল্লীবাসী একালের মতো শুধু ঝগড়া বিবাদ নিয়েই থাকত না। তখন গ্রামে প্রাণ ছিল, শান্তি ছিল। বেশ মনে আছে, আমাদের দালান বাড়ির পাশেই ছিল এক শাখাবহুল বটগাছ। সেই বটতলে, আজিজ মিয়ার দোকানের উঠোনটার কোলঘেঁষে বসত ছেলেদের আসর। গ্রামের বৃদ্ধ ইয়াসিন শেখ ছিলেন সে বৈঠকের গল্পদাদু। সন্ধ্যার পর হতেই দলে দলে ছেলেরা গিয়ে হাজির হতো বটতলে। দাদু শেখ ধীরে ধীরে গল্প বলতে শুরু করতেন। সে সব গল্প রূপকথার রাজ্যের সেই ‘পাঁচ কন্যা’, ‘বিহঙ্গম-বিহঙ্গমী’ বা ডালিম কুমারকে নিয়ে নয়। দাদু শেখ পল্লীর সুখ-দুঃখের কাহিনীগুলো কল্পনার রঙ ফলিয়ে এমনি সরস ও মধুর করে তুলতেন যে, সবাই সাগ্রহে শুনতো আর মুগ্ধ হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় চাকরকে ঘুষ দিয়ে আমরা চলে আসতুম গল্প শুনতে। সে কী সুখের সময় ছিল।”
কবি কাজী কাদের নওয়াজ ছিলেন তোমাদের মতো ছোট্ট শিশু-কিশোরদের বন্ধু। তিনি ছিলেন শিশু-দরদি, প্রকৃতিপ্রেমিক, মানবপ্রেমিক কবি। সবার সাথে ছিলো তাঁর ভাব। জীবন-কর্মে সাহিত্য সাধনায় তিনি ছিলেন ভালোমনের মূর্তপ্রতীক। গল্পরসিক এই কবি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। আছে তাঁর লেখা গল্প-কবিতা আর স্মৃতি। ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি এই মহান গল্পরসিক ছোট বড় সবার কবি কাজী কাদের নওয়াজ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরজগতে। তাঁর লেখা গল্প-কবিতা আজো আমাদের তাড়া করে নিয়ে যায় পুরনো দিনের সেই বটতলার দাদুর আসরে।