মাসুম বিল্লাহ..
হেজাজের এ পথটি একটু বেশিই গরম। সারাক্ষণ কেমন জানি গা পোড়ানো উত্তাপ, মরুর বালুকণাগুলো যেন এক পশলা বৃষ্টির আশায় চাতক পাখির মতো মুখিয়ে আছে। রৌদ্রের প্রখরতা তার পানির দুষ্প্রাপ্যতাকে মেনে নিয়েই চলে বণিক-সওদাগরদের ব্যবসায়বাণিজ্য। বীরদর্পে মরুভূমির ধুলো আকাশে বাতাসে মিলিয়ে হাঁকিয়ে নেয়া হয় মালবোঝাই উট, ঘোড়া। দুরন্ত সাহস আর সংগ্রামী জীবনই আরব বেদুঈনদের অন্যতম জীবন স্বকীয়তা, জীবন অনুষঙ্গ।
গোলাম মাওলাও বণিকদলের নামকরা সদস্য। অর্ধডজন দেশ ইতোমধ্যেই পায়ে মাড়িয়েছেন এ জাঁদরেল সওদাগর। তবে আজ সে জরুরি কাজে কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে লোহিত সাগরের পাড় ঘেঁষে যে পথটি মক্কার হেজাজ এলাকার দিকে গেছে সে পথে রওয়ানা দিল। মরুভূমিতে পায়ে হাঁটার জোঁ কম। উত্তপ্ত মরুর বালুকণায় চাট পরে হাঁটাও দুরূহ। সঙ্গে রয়েছে পা দেবে যাওয়ার বিড়ম্বনা। সব মিলিয়ে সাহারা মরুভূমি যেন এক চোরাবালির কারখানা।
গোলাম মাওলা ভাবে উটের খুর বোধ হয় দেবে না যাওয়ার জন্য এমন অমসৃণ আর তপ্ত বালু সইতে পারার জন্যই এত শক্ত হয়। এ যেন এক পরিকল্পিত বা¯ুÍসংস্থান। বিশাল মরুভূমি পাড়ি দিতে দিতে এক সময় জোহরের ওয়াক্ত ঘনিয়ে আসে। উটটিকে পাশে দাঁড় করিয়ে ঝটপট দুই রাকাত কসর আদায় করে আবার রওয়ানা দেয় সে। উট চলতে চলতে এসে থামলো জাবালে আকরামের পাদদেশে। তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে বিধায় পানির সন্ধানে উট থেকে নেমে একটু খোঁজাখুঁজি করছিল। শো-শো একটা শব্দও শোনা যাচ্ছে। তবে শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে তা ঠাওর করতে পারল না। চড়াই-উৎরাই করে সে পাহাড়ের বেশ খানিকটা উপরেও উঠেছিল। কিন্তু শব্দটা যে এবার মিলিয়ে গেল! তাজ্জব ব্যাপার! মনকে প্রবোধ দিল এই ভেবে হয়তো কোনো এলাকার সাইমুম (মরুঝড়) হয়ে থাকতে পারে। আবার বাতাসের প্রবাহও অন্য দিকে চলে গেছে। হতাশ হয়ে নিচের দিকে আসছে সে। শক্ত শক্ত পাথর ভেদ করে নিচে নামা-ও দুরূহ ব্যাপার। তবে আরব বেদুঈন বলে কথা। ঝটপট উটটি নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল সে। মাইলখানেক পথ অতিক্রম করতেই তিন-চারজনের একটি ছোট্ট কাফেলার সাক্ষাৎ মিলল। উট থামিয়ে সম্ভাষণ জানিয়ে দল নেতা কে জানতে চাইলে অন্য সদস্যরা একজনের প্রতি ইশারা করল। আরে মুসাগির না! তা কাফেলা যাবে কোথায়? সিরিয়া ও তায়েফ হয়ে দক্ষিণ ইয়েমেনে যাব, তবে বিধি বাম! সাথে যা খাবার দাবার ছিল তা ফুরিয়ে আসছে বিধায় খায়বারে কিছু দিন থেকে যাওয়ার চিন্তা করছিÑ জবাব দিল মুসাগির। কাঙালের কাছে ছেঁড়া রুটি ভিক্ষা চাওয়ার মতো হবে মনে করে পানির প্রসঙ্গটি আড়াল করে দলটিকে বিদায় জানাল গোলাম মাওলা। এ দিকে মরুভূমিতে সত্যি সত্যি সাইমুম শুরু হয়ে গেছে। চারপাশের ধুলায় ধোঁয়াশা অবস্থা। তবে বিশাল সেরওয়ানি (আপাদমস্তক ঢাকা আরব-জুব্বা) ধুলার আস্তরণ থেকে দেহকে রক্ষা করছে। সত্যি আরব দেশে এ ধরনের পোশাকের বিকল্প নেইÑ ভাবে সে। উহুদ পাহাড়ের কাছে একটা কৃত্রিম হ্রদ আছে শুনেছিল এক সময়, তাই উটকে সেদিকে চালিত করল। সেখানে পৌঁছে দেখল চারপাশে পাথর দিয়ে ঘেরাও দেয়া একটি সুদৃশ্য হ্রদ। পানির কাছে নাক নিতেই একটা উৎকট গন্ধ নাকে ঢুকল। ছি! এ পানি মানুষে খায়! কথায় বলে কাঙাল যেখানে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। আর দাঁড়িয়ে না থেকে আবার উট ছুটাল। উট এগিয়ে চলছে তপ্ত মরুর বুক চিরে। কয়েক মাইল অতিক্রম করার পর সে পৌঁছে গেল কুরাউল গামিম নামক পার্বত্য এলাকায়। তার আশা এখানে অন্তত একটা ঝর্ণার দেখা মিললেও মিলতে পারে। খোশ নসিব! হ্যাঁ, ওইতো, পাহাড়ের ঐ জায়গাটা থেকে অনর্গল পানি নেমে আসছে। খোদাকে শুকরিয়া জানিয়ে দ্রুত মশকটি ভরে নিল সে। যাক এবার তাহলে পানি পাওয়া গেল। একেবারে স্বচ্ছ পানি। যেই পানি মুখে নেবে অমনি কালো ছুটওয়ালা ধূসর রঙের হাজার পাখি এসে মশকটি ঝাপ্টা মেরে ফেলে দিল। ধাওয়া করতেই পাহাড়ের আরেক চূড়ায় গিয়ে বসল পাখিটি। মনে মনে ভাগ্যকে দোষ দিয়ে কী যেন ভাবল সে। নিচ থেকে মশকটি কুড়িয়ে নিয়ে আবার পানি ভর্তি করল। হাতে পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে, মশকের খানিকটা পানি কুলি করতে মুখে নিল সে। পায়ের কাছেই ছিল মশকটি। কুলি শেষে বায়ে তাকিয়ে দেখে হাজর পাখিটি আবারও ছোবল মেরে মশকটি কাৎ করে দিয়েছে। এবার আর ধৈর্য নয়, হাতের কাছে পাওয়া ইয়া বড় এক পাথর ছুড়ে মারল পাখিটাকে লক্ষ্য করে। নিশানা সই! পড়বি তো পড়বি একেবারে ঘাড়ের ওপর। ধপাস করে চূড়ার ওপর পড়ল পাখিটা। কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে আস্তে নিথর হয়ে এল দেহটা। এমনভাবে পাখিটাকে মারা ঠিক হয়নিÑ মনে করে পাখিটার কাছে গেল গোলাম। মনে সহানুভূতি আর দরদ উথলে উঠল যখন দেখল পাখিটার ঘাড় বাঁকা হয়ে লম্বা মাথাখানি পাথরের আঘাতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কী এক মায়াবী টানে পাখিটাকে হাতে নিল সে। অমনি চমকে উঠল। বাঁকা, লেজ মোড়ানো কিছু একটা তার দৃষ্টি কাড়ল। একি! পাথরের নিচে এক বিষাক্ত গোখরা আধমরা হয়ে পড়ে আছে। আর এর দেহ নিঃসৃত বিষপানি গড়িয়ে পড়ছে টিলা বেয়ে। ফলে এ পানি খাওয়া মাত্রই নির্ঘাত জমের হাতে চালান।
ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল গোলামের। পাখিটি তার জীবন বাঁচাতে নিজের জীবনকেই বিলিয়ে দিল?
দরদি বন্ধুর নিথর দেহটিকে সহানুভূতির পরশে ওপরে ধরল সে। কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল গাল বেয়ে ঝরে পড়ল পাখিটার কালো পশমের ওপর। উত্তপ্ত এ কয়েক ফোঁটা অশ্রুজলই যেন গোলামের না বলা কথাগুলো মেসেজ করে পাঠাল।
পাখিটাকে কয়েকটা পাথরের নিচে চাপা দিয়ে মুসাগির আবার উট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আজ সন্ধ্যার আগেই যে তাকে শহরে পৌঁছাতে হবে।