আবদুল হাই শিকদার….
তোমরা যদি থাকতে যুক্তরাজ্যে, ফ্রান্সে কিংবা ইরানে, তাহলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে বড়দের সাথে বেড়াতে যেতে নিশ্চয়ই। তখন তোমাদের বেড়ানোর তালিকায় অতি অবশ্যই শেকসপীয়রের জন্মস্থান স্টার্টফোর্ড, বালজাক কিংবা ভিক্টর হুগোর বাড়ি কিংবা সিরাজ নগরে কবি হাফিজের সমাধিসৌধ থাকতো। তারপর সে সব নিয়ে কত ছবি তুলতে। দেশে ফিরে গল্প করতে, বই লিখতে। এ সবের পেছনে বড়দের একটা ভূমিকা থাকে। তারা আমাদের উৎসাহিত করেন।
কিন্তু যেই সবাই দেশে ফিরলো, অমনি সব বন্ধ। তখন ছুটির দিনগুলো বোকার মতো ঝুলতে থাকে জানালায়। তখন বড়রা বড়জোর মাঝে মাঝে চায়নিজ হোটেলে নিয়ে যায়। বেশি তাগাদা করলে বছরে এক- আধবার কুয়াকাটা নইলে সেন্টমার্টিন নিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। ফলে শুধু কোলাহল আর প্রকৃতি দর্শনই হয়। এ দেশের ইতিহাস ও আত্মা দেখা হয় না। এই না দেখার ফলে আমরা নিজেদের গৌরব ও গর্বের সংস্পর্শ না পেয়ে ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে যাই। এই দুর্দশা থেকে বাইরে যাবার জন্য তোমাদের আজ একটি পরামর্শ দেবো। এই পরামর্শের নাম আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
সশরীরে আমাদের জাতীয় কবিকে তো আর দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কবির নানা স্মৃতিজড়িত স্থান ও বাড়িঘর। সেসব দেখে আমার ভেতরে বড় হতে পারি। আনন্দিত হতে পারি।
তোমরা যারা ঢাকায় থাকো কিংবা থাক ঢাকার বাইরে। তারা ঢাকায় বেড়ানোর জন্য কবির স্মৃতিধন্য স্থানগুলো দেখে চোখ জুড়াতে পার। আর কে না জানে জাতীয় কবিকে বেশি বেশি জানার অর্থ দেশকে, দেশের শিকড়কে বেশি বেশি করে জানা।
সে জন্য সাপ্তাহিক ছুটির একটি দিন আমরা কবির জন্য কাটিয়ে দিতে পারি।
তোমাদের ভ্রমণের দিনটির নাম হতে পারে ‘ঢাকায় নজরুল : কবির ভুবনে একটি দিন।’ দিনটি শুরু করতে হবে সকাল ৮টায়, তাহলে সবগুলো জায়গা দেখে শেষ করতে পারবে, নইলে নয়।
রাজধানী ঢাকার যে কোনো দিক দিয়েই শুরু হোক এবার নজরুল সফর। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রথমেই ধানমন্ডি কবি ভবন, যেখানে নজরুল ইনস্টিটিউট সেখানে যাও। গিয়ে ঢাকায় নজরুল সম্পর্কে মিউজিয়াম, বইপত্র দেখ, বাংলাদেশে নজরুল চর্চার খোঁজ-খবর নাও। মনে রাখতে হবে ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের এই বাড়িতে কবি কাটিয়ে গিয়েছেন দীর্ঘ সময়। সেখান থেকে চলে যাও ঢাকার ৫২ বেচারাম দেওড়ির মৌলভী আবদুল হাসনাত সাহেবের বাড়িতে। বাড়ির স্থাপত্যশৈলী দেখে এখনও মুগ্ধ হয়ে যাবে। এই বাড়িতে বসে নজরুল একবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন। এই বাড়ির কাছেই মশহুর সুফী সাধক হযরত ইউসুফ আল কাদরীর মাজার। অন্যান্য সাধারণ এই মাজারের নির্মাণশৈলী দেখে মন ভরে যাবে। এই মাজারের বাগানে বসেই কবি লেখেন তার বিখ্যাত গান, বাগিচায় বুলবুলি তুই …’। সদরঘাটের পূর্ব- উত্তর কর্নারে ছিল করনেশন পার্ক। এই পার্কের জায়গায় এখন মার্কেট। কিন্তু সেই মঞ্চ এখনও আছে, সেই মঞ্চে বসে কবি গেয়েছেন অনেক গান।
এবার চলে যাও ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলে। ঢাকার নবাব পরিবারের এই বিখ্যাত ভবনে একবার কবিকে দেয়া হয়েছিল সংবর্ধনা। এই নবাব পরিবারের মেয়ে মেহেরবানুর আঁকা ছবি দেখে কবি লিখেছেন ‘খেয়াপারের তরুণীর মতো কলোত্তীর্ণ কবিতা।’
আহসান মঞ্জিল দেখে চলে আস বনগ্রাম লেনে। এখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই পেয়ে যাবে রানু সামের বাড়ি। এই বাড়িতে তিনি তার ছাত্রীকে গান শিখাতেন।
শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ দেখতে ভুলে যেও না। এখানে একদিন অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র ছিল। কবি এখানে এসে গান গেয়েছেন।
তারপর কবি নজরুল কলেজ দেখা। এরপর সোজা চলে যাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফজলুল হক, সলিমুল্লাহ হল দেখে চলে যাও রমনা পার্ক দেখতে। এই রমনার বটতলায় একটু বসো। এখানে বসেই কবি লেখেন ‘নিশি ভোর হলো’ জাগিয়া গানটি।
এবারের গন্তব্য বাংলা একাডেমী। এই বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউজে কবি কাটিয়ে গেছেন বেশ কিছুদিন। তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এখন দোতলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ভবনের সামনের বটগাছের নিচেই এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল মঞ্চ।
বাংলা একাডেমী থেকে তুমি ইচ্ছে করলে মগবাজারের বেলালাবাদ কলোনিতে প্রতিষ্ঠিত নজরুল একাডেমী দেখতে যেতে পার। নজরুল একাডেমী এদেশে নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রথম প্রতিষ্ঠান।
ফার্মগেটের ওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আনন্দ সিনেমা হলের দিকে তাকাও। পাশাপাশি পার্কটির দিকে তাকাও।
এই দু’টি স্থান থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এদেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো বের করেছিলেন ‘নজরুল র্যালি’। শহীদ জিয়ার নির্দেশইে কার্জন হলের সামনে থেকে বিজয় সরণি পর্যন্ত সড়কটির নাম হয় ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ’।
শাহবাগের পিজি হাসপাতালে ঢুকে পড় এবার। এই পিজির ১১৭ নম্বর ক্যাবিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি। এই কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পার কবির স্মৃতির প্রতি।
তারপর টিএসসি চত্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই টিএসসি চত্বরেই সর্বসাধারণের দেখার জন্য শেষ বারের মতো রাখা হয়েছিল কবির লাশ।
পাশেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এই উদ্যানেই অনুষ্ঠিত হয় কবির নামাজে জানাজা। জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশ নিয়েছিল।
জানাজার পর কবির লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে। সেখানে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবিকে। কবি চেয়েছিলেন যেন মসজিদের পাশে তাকে কবর দেয়া হয়।
মসজিদের পাশেই কবিকে কবর দেয়া হলো। কবির এই কবর স্থানটি এখন বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। এখানে কবির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ কর। কামনা কর তার আত্মার মাগফেরাত। প্রার্থনা কর যাতে তোমরাও তার মতো মহৎ মানুষ হতে পারো।
এখন থেকে যদি সময় থাকে তাহলে জাতীয় জাদুঘরে প্রতিষ্ঠিত ‘নজরুল কর্নারে’ যেতে পার। এখানে কবি ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র দেখতে পাবে।
আরো অনেক কিছু দেখার বাকি রয়ে গেল। কিন্তু সন্ধ্যা যে নেমে এসেছে। তারপরও মাত্র একটি দিনে কবির অনেক স্মৃতিধন্য স্থান তোমরা দেখলে। এর মূল্যও কম নয়। প্রতিটি স্থানেরই ছবি তুলতে পার। খাতায় নিতে পার নোট। তারপর লিখে ফেলবে ‘কবির ভুবনে একটি দিন’ নামের ভ্রমণকাহিনী।
সেই লেখা পত্রিকায় যখন ছাপা হবে, তখন দেখবে সবাই তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। আর এই লেখা পড়ে অন্যরাও হবে উৎসাহিত।
এভাবেই আমরা সৃষ্টি করতে পারি একটি ইতিহাস। অর্জন করতে পারি ভ্রমণের নতুন মাত্রা। এভাবে দেশের অন্যান্য নজরুল স্মৃতিস্থানের ওপর চালাতে পার তোমাদের ভ্রমণ-অপারেশন।