একদৃষ্টে মহাকাশযানের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি ক্যাপ্টেন ফ্রুগোর সিগন্যালের অপেক্ষায়। চোখ ঘুরিয়ে আরেকবার হেজোর দিকে তাকালাম, কন্ট্রোল রুমে আছে সে। পুরো কাচের দেয়াল ভেদ করে যোগাযোগ সৃষ্টি হলো দুই জোড়া চোখে। ভ্রূ নাচিয়ে জানতে চাইলাম কী খবর? ডান হাতের বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করলো হেজো ওকে! কিছুক্ষণ পর স্ক্রিনে ক্যাপ্টেনের সিগন্যাল এলো স্টার্ট! হেজোকে নির্দেশ দিলাম মহাকাশযান চালু করতে। ধীরে ধীরে মৃদু কম্পন শুরু হল মহাকাশযানে। কয়েক সেকেন্ড পর স্টেশন ত্যাগ করে ছুটে চললো অসীম আকাশের পথে। আমি আবারও মহাকাশযানের সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না চেক করলাম। স্ক্রিনে আমাদের যাত্রাপথের ছবি ভেসে উঠছে। মহাকাশে ২২ লক্ষ আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিতে হবে আমাদের। যাতে সময় লাগবে কোন প্রকার সমস্যা না হলে বিয়াল্লিশ দিন উনিশ ঘণ্টা। বাইশ লক্ষ আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে মিলকিওয়ে গ্যালাক্সিতে। যেটা আমাদের এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী। মিলকিওয়ের একটি গ্রহ আমাদের গন্তব্য। মিলকিওয়েতে একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে রয়েছে প্রায় ২০টির মত গ্রহ। এর একটি গ্রহ সম্প্রতি আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই এ গ্রহটিকে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা। এটি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেকটা নিশ্চিত যে এ গ্রহটিতে বুুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু গ্রহটির দূরত্ব আমাদের গ্রহ থেকে এত বেশি যে এটিতে অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। তারপরও এ গ্রহটিতে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি চলছিলো পুরোদমে, যে জন্য তৈরি করা হয়েছে সর্বাধুনিক এই মহাকাশযান ট্রিপো-১। ট্রিপো ওয়ানের গতি মহাকাশে প্রতি ঘণ্টায় তিন হাজার আলোকবর্ষ। ট্রিপো ওয়ানে বাইরে থেকে কোন প্রকার শক্তি সরবরাহের প্রয়োজন হয় না। এটি চলার জন্য নিজেই মহাকাশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে সক্ষম। এ ছাড়া মহাকাশে যেসব বিপদের কারণে মহাকাশযান ধ্বংস হয় ট্রিপো ওয়ান সেসব বিপদ প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
বেশ জোরেশোরেই এগিয়ে চলে বুদ্ধিমান প্রাণীদের গ্রহে অভিযানের প্রস্তুতি। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েকদিন আগে বুদ্ধিমান প্রাণীদের গ্রহের একটি বিশাল পরিবর্তন ধরা পড়ে বিজ্ঞানীদের চোখে। গ্রহটি তার এতদিনের চিত্র পাল্টে যেন একটি ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে পরিণত হয়। বুদ্ধিমান প্রাণীদের অস্তিত্ব বা গ্রহটির অবস্থান সবছিুই হারিয়ে যায়। এর বায়ুমণ্ডলে পাওয়া যায় মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত পদার্থ। পরিবেশের সর্বত্র উচ্চমাত্রার রেডিয়েশনের প্রভাব দেখা দেয়। বড় ধরনের ধ্বংসলীলা বয়ে গেছে গ্রহটির ওপর দিয়ে ধারণা করছি আমরা। এ ঘটনার পর গ্রহটিতে অভিযানের সময় কিছুটা এগিয়ে আনা হয়। বিজ্ঞানীরা গ্রহটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছেন। তারা আশঙ্কা করছেন তাদের ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে সেই গ্রহটিতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। হয়তো বুদ্ধিমান প্রাণীরাও; কিন্তু সেখানে সঠিক কী ঘটেছে সেটা অভিযানের আগে কিছুই বোঝা যাবে না। তাই এ অভিযানের আয়োজন। অভিযানটির নাম দেয়া হয়েছে অপারেশন মিলকিওয়ে। যার চিফের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে। আমার সহকারী হিসেবে রয়েছে হেজো। সঙ্গী হিসেবে দেয়া হয়েছে বেশ কিছু দশম প্রজাতির রোবট। যন্ত্রগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। গন্তব্যে পৌঁছে প্রয়োজন হলে এগুলো ব্যবহার করা হবে। অতএব বিশাল মহাকাশযানে প্রাণী বলতে হেজো আর আমি।
মহাকাশযানের চেকআপ শেষ করে কন্ট্রোল রুমের দিকে গেলাম। কন্ট্রোল রুমে ঢুকতেই হেজো বলে উঠল,
: ‘ওয়েলকাম ডিকান প্রিটো, অনারেবল চিফ অব অপারেশন মিলকিওয়ে। মোস্ট ওয়েলকাম ইন মিলকিওয়ে।’ ===অবাক হয়ে তাকালাম হেজোর দিকে। চোখে জিজ্ঞাসা। কী বলছে আবোল তাবোল! আমরা তো কেবল যাত্রা শুরু করলাম। আরো বিয়াল্লিশ দিন লাগবে। মিলকিওয়েতে পৌঁছতে। আরও দুই দিন পর বুদ্ধিমান প্রাণীদের গ্রহে। আমার দৃষ্টি দেখে হেসে ফেললো হোজো বললো, মজা করলাম। মহামান্য ডিকানকে বুদ্ধিমান প্রাণীরা কিভাবে স্বাগত জানাবে তাই বললাম।
: ‘হঠাৎ এত বিনয় শুরু করলে, কী ব্যাপার?’ হেজো আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
: ‘এত বড় একটা অভিযানে চিফকে তো অনার করতেই হবে, না কি?’
: ‘বাদ দাও ওসব।’ হাত নেড়ে বললাম। ‘এসব আমাদের গন্তব্য নিয়ে আলোচনা করি। কোথায় নামবে, কিভাবে শুরু করবে কিছু ঠিক করছো?’
: ‘সে চিন্তাতো আসবে তোমার মাথা থেকে মাই ডিয়ার ডিকান, তুমিই তো অপারেশন চিফ। বুদ্ধিমান প্রাণীদের সাক্ষাৎ পেলে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেব এ হচ্ছে ডিকান প্রিটো আমাদের গ্রহের সবচেয়ে তুখোর মহাকাশ অভিযাত্রী, পাঁচটি অভিযানের সফল দলনেতা।
: ‘এই চুপ! একদম চুপ। বাজে কথা রাখো।’ ধমক দিয়ে থামিয়ে দিই আমি। এ হচ্ছে হেজোর স্বভাব, সবকিছুতে ম
জা করে ও। স্বাভাবিক অবস্থায় যেমন করে তেমনি।
চরম বিপদের মধ্যে ওর রসিকতা থামে না। একবার আমাদের এন্ত্রোমিডার ক্রিউটো গ্রহে অভিযানে গেলে একদল অদ্ভুত দর্শন প্রাণীর কবলে পড়ি আমরা। সে প্রাণীগুলো আমাদের আক্রমণ করতে এলে হেজো সেগুলোকে বলে হাই ডিয়ার্স! আমাকে না ডিকান হচ্ছে চিফ। মারতে হলে তাকে আগে মারো। পরে অবশ্য ওর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় আমরা সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলাম। আমার সব অভিযানের সঙ্গী ছিল হেজো। অসাধারণ মেধাবী আর তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন লোক।
: ‘আমাদের গন্তব্য স্থানের খবর কী?’ হেজোর পিঠে হাত রেখে প্রশ্ন করি আমি।
: ‘কোন খবর নেই, প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু রাডারে শুধু ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’
: ‘রেডিয়েশনের কী খবর?’
: ‘আগের মতই। তবে আমরা যেতে যেতে তো বিয়াল্লিশ দিন লাগবে। এর মধ্যে রেডিয়েশন কমলে ভাল। প্রাণীগুলোরও কোন খবর নেই। বাছারা হয়তো ঘুমিয়ে আছে সবাই।’ শেষ লাইনটা বলে হেসে উঠল তেজো।
যতই সহজভাবে বলুক আমি জানি হেজো খুব সিরিয়াসলিই বিষয়টা নিয়ে ভাবছে। ওর এমনটাই স্বভাব। সবকিছুইতে মনে ভাব করে যেন কিছুই করবে না। পরে দেখা যায় আমার অনেক কাজই ও নিজ দায়িত্বে করে দেয়। এই যে ট্রিপো ওয়ানের কন্ট্রোল, গন্তব্যের খোঁজখবর রাখাসহ সবকিছুই ও নিজ দায়িত্বে করছে। আমাকে অলস বসিয়ে রেখেছে। ওর কথা হচ্ছে ‘চিফ শুধু মাথা খাটিয়ে প্লান করবে। সে কাজ করলে চিন্তা করবে কখন।’
মহাকাশযানের ল্যাবরেটরিতে অভিযানের কিছু প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি। হঠাৎ লাউড স্পিকারে হেজোর কণ্ঠ পেলাম ‘ডিকান, আমরা গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছি। চোখের সামনে কাক্সিক্ষত গ্রহটিকে দেখা যাচ্ছে।’ ল্যাবরেটরি থেকে বের হয়ে কন্ট্রোল রুমে গেলাম। কন্ট্রোল প্যানেলে পাশের মনিটরে ভেসে উঠেছে গ্রহটির ছবি। গ্রহটির একদম কাছাকাছি মহাকাশযানটিকে নিয়ে গেল হেজো। গ্রহটির দিকে চেয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। রাডারের চোখ যতদূর যায় শুধু ধ্বংসস্তূপ। কোথাও কোন স্বাভাবিকতা নেই। তবে আগে যে এ গ্রহে সুগঠিত স্থাপনাসমূহ ছিল তা বোঝা যায়। বুদ্ধিমান প্রাণীদের কোন অস্তিত্ব কোথাও দেখা গেল না। পাহাড়গুলো উলঙ্গ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোথাও গভীরতা ও বিশালতা দেখে সমুদ্রগুলো চিনতে পারলাম। তবে তাতে পানি বা অন্য কোন তরল পদার্থের ছিটেফোঁটাও নেই।
: ‘মহাপ্রলয় বলতে যা বোঝায় তাই বোধ হয় ঘটে গেছে এখানে।’ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো হেজো।
: ‘যাই হোক নামার প্রস্তুতি নাও। উপযুক্ত জায়গা দেখে অবস্থান নেবে যাতে কাজে সুবিধা হয়। আমি রোবটগুলোকে চালু করি। পরিবেশ না বুঝে নামা ঠিক হবে না। আগে ওগুলো পাঠিয়ে দেখতে হবে কী অবস্থা।’ বলে আমি কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
কিছুক্ষণ পর পাঁচ রোবটকে নামিয়ে দিলাম গ্রহটির বুকে। স্ক্রিনে গতিবিধি দেখে ওদের নিয়ন্ত্রণ করছে হেজো। রোবটগুলো গ্রহটির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলো। বিপজ্জনক কোন কিছুরই আভাস না পেয়ে হেজোকে বললাম, রোবটগুলোর মাধ্যমে ধ্বংসস্তূপের কিছু নমুনা সংগ্রহ করতে। হেজো রোবটগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তুর কিছু নমুনা সংগ্রহ করল। আমি সেগুলো ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলাম। একটি বস্তু পরীক্ষা করে প্রাচীন কিছু নির্মাণসমগ্রীর সন্ধান পেলাম। আমাদের গ্রহে কয়েক শ’ বছর আগে যে ধরনের উপকরণ ব্যবহার করে ভবন নির্মাণ করা হতো অনেকটা সে রকম। কিছু স্টিলের এবং কংক্রিটের নমুনাও পেলাম। কয়েকটি হাড় পেলাম রোবটদের সংগৃহীত নমুনার মধ্যে। বুদ্ধিমান প্রাণীদের হাড়ই হয়তো। সেগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা শুরু করলাম। ডিএনএ টেস্ট করে বুঝলাম এই প্রাণীরা দীর্ঘদিন গ্রহের বুকে বিচরণ করছে। বংশানুক্রমেই তাদের বাস এখানে তবে ডিএনতে উচ্চ মাত্রার ধ্বংসাত্মক রাসায়নিক পদার্থ পেলাম যা, এদের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। ডিএনএ থেকে মস্তিষ্কের মেরোরি সেলগুলোকে আলাদা করলাম এরপর সেগুলো পরীক্ষা করে যা পেলাম তা এ গ্রহের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসই বলা চলে। প্রতিটি মস্তিষ্কের মেমোরি সেলে আলাদা আলাদা তথ্য থাকলেও তা প্রায় একই রকম সব তথ্য একত্রিত করে যা পেলাম তা এরকম গ্রহটির নাম পৃথিবী। কয়েক শ’ কোটি বছর আগে এখানে প্রাণের আবির্ভাব হয়। অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে এরাই একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী, যাদের নাম ছিল মানুষ। এক সময় মানুষেরা বর্বর জীবন যাপন করলেও ধীরে ধীরে তাদের উন্নতি হতে থাকে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করে যুগে যুগেই বিজ্ঞানের প্রতিযোগিতা শুরু হয় দেশগুলোর মধ্যে, যা এক সময় প্রতিহিংসায় রূপ নেয়। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে ধ্বংসাত্মক বস্তু আবিষ্কারও চলতে থাকে পুরোদমে, যা ব্যবহার করা হয় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। এক পর্যায়ে বিজ্ঞানের চরম শিখরে পৌঁছে বেশ কিছু দেশ। কিন্তু এরা একে অন্যকে ধ্বংস করতে ব্যবহার করে নিজেদের আবিষ্কারকে। যার ফলস্বরূপ আজকের এই পরিণতি।
প্রাপ্ত তথ্যগুলো দিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে হেজোকে দেখাতেই ও বললো, ‘বুদ্ধিমান প্রাণীরা মনে হচ্ছে অজান্তেই নিজেদের মধ্যে বোকামি লালন করতে কিংবা বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই মনে হয় জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামিটা করেছে তারা।’
: ‘সবচেয়ে বড় কথা ওরা প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতায় মেতে ছিল। অন্যের ওপর কর্তৃত্ব করার মনোভাব মানুষকে প্রবলভাবে তাড়িত করেছে। যার ফলে আবিষ্কার করেছে একের পর এক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র, যার বলি হয়েছে নিজেরা আর পৃথিবী নামের এই সুন্দর গ্রহটি।
: ‘বিজ্ঞানের নামে নিজেরা নিজেদের ধ্বংসের ফাঁদ তৈরি করেছে।’
: ‘যাই হোক।’ প্রসঙ্গ পাল্টালাম, আমি আমাদের কাজ তো শেষবার ফেরার পালা।’ রোবটগুলোকে মহাকাশযানে ফিরিয়ে আনলো হেজো। ওদেরকে আবার ঘুম পাড়িয়ে রেখে ফেরার যাত্রা শুরু করলাম আমরা। পেছনে পড়ে রইল বিজ্ঞানের অভিশাপে নিজেদের ধ্বংস করা এক মানুষ জাতি আর তাদের সুন্দর গ্রহ পৃথিবী।
আহমেদ বায়েজীদ
Great!!
Keep it up!!!
We want large science fictions with reflection of unique creativity.
Very very nice.
Thanks a lot to Kishor Kontho & Mr. Ahmed.