লালমনিরহাট দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী তিস্তা ও ধরলা নদী বিধৌত একটি জেলা। কৃষি নির্ভর লালমনিরহাট জেলা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ও শ্রমঘন শিল্প বিকাশের জন্য অপার সম্ভাবনাময় একটি জনপদ।
জেলার পটভূমি
ইতিহাস বিশ্লেষণে জানা যায়, আজকের লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা একেক সময় একেক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে তা শাসিত হয়েছিল কখনও চাকলাদার-তালুকদার-গোমস্তা-জমিদারগণের দ্বারা, কখনও বা চৌধুরী-জমিদার-জোতদারগণের দ্বারা। মোগল ও ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় পর্যায়ে এ এলাকা শাসিত হয়েছিল চৌধুরী-জমিদার-জোতদারগণের দ্বারা। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন পাঙ্গা পরগনা, পূর্বভাগ পরগনা, কাকিনা পরগনা, তুষভাণ্ডার জমিদারী এবং পাটগ্রাম পরগনার অংশ নিয়েই মূলত আজকের লালমনিরহাট জেলার ভৌগোলিক সীমানা গঠিত। পরবর্তীতে বিবিধ কারণে এ জেলার বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার বিভিন্ন অংশ অন্যান্য পরগনার সাথে যুক্ত হয় এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে অনেক পরগনার অধীনে শাসিত হতে থাকে।
জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাট মহকুমা ‘জেলা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ লালমনিরহাট সদর থানা ‘উপজেলা’ হিসেবে ঘোষিত হয়। ফলে লালমনিরহাট জেলার অধীনে উপজেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫টিÑ পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী এবং লালমনিরহাট সদর। এসময় লালমনিরহাট সদর থানার ছিনাই, রাজারহাট এবং ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়ন পাশ¡বর্তী কুড়িগ্রাম জেলার সাথে যুক্ত হলে নবগঠিত লালমনিরহাট জেলায় ইউনিয়নের সংখ্যা দাড়ায় ৪১টি এবং পৌরসভার সংখ্যা ১টি। তাছাড়া লালমনিরহাট সদর উপজেলার আয়তন দাড়ায় ১০৪ বর্গমাইল।
সীমানা
লালমনিরহাট বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত সীমান্তবর্তী একটি জেলা। এ জেলার উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলা, দক্ষিণে রংপুর জেলা, পূর্বে কুড়িগ্রাম ও ভারতের কোচবিহার জেলা এবং পশ্চিমে রংপুর ও নীলফামারী জেলা। জেলার উত্তরে ধরলা নদী ও দক্ষিণে তিস্তা নদী প্রবাহিত।
শিল্প ও বাণিজ্য
লালমনিরহাটে কোন বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। মাত্র অল্প কয়েকটি মাঝারি আকারের শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে প্রচুর পল-ীভিত্তিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে। স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মধ্যে রয়েছে – বাঁশ (ডালি, কুলা, চালুনী, হাত পাখা, চাটাই, ডোল, গরু বা মহিষের গাড়ির ছই, মাছ ধরার বিভিন্ন যন্ত্র, গবাদি পশুর মুখের টোপর প্রভৃতি), কাঠ (পিড়ে, গছা, উরুন-গাইন, ঢেঁকি প্রভৃতি), মৃৎ (মাটির থালা, হাড়িপাতিল, কলস, হিড়া বা মটকি, কুয়ার পাঠ, খাদ্য বা ট্যাগারী, পয়সা রাখার ব্যাংক সহ বিভিন্ন ধরণের খেলনা), বেত (টালা, ডালি, ডোল, চেয়ার, মোড়া প্রভৃতি), পাট (দড়ি বা রশি, ছিকা, নুছনা, ঝুল, গবাদি পশুর মুখের টোপর প্রভৃতি), ঘাঁনি (তেল, খৈল), লৌহ (ক্যাটারী, ছুরি, চাকু, জাঁতি, দা, কাস্তে, কুড়াল, কোদাল, খন্তা, লাঙ্গলের ফলা, বল-ম, বর্শা, খোঁচা, তীর প্রভৃতি), সেলাই শিল (কাঁথা, নক্সী কাঁথা, হাত পাখা প্রভৃতি), অলংকার শিল (স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি গলার হার, হাতের বালা ও চুড়ি, কানের দুল, নাকের ফুল, কোমরের বিছা) প্রভৃতি ।
ভাষা ও সংস্কৃতি
এ অঞ্চলের অধিবাসীগণ যে ভাষায় কথা বলতেন, উত্তরবঙ্গের অনেক গবেষক এ ভাষাকে সরাসরি বাংলা ভাষা না বলে ‘কামতাবিহারী ভাষা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। লোকসমাজে প্রচলিত ছড়া, ছেল-ক (ধাঁধাঁ বা ছিল্কা), প্রবাদ-প্রবচন, মেয়েলী গীত, মন্ত্র, লোকসঙ্গীত প্রভৃতি লোক সাহিত্যের মূল্যবান উপাদান। এগুলোর মধ্য দিয়ে সন্ধান মিলে আবহমানকাল ধরে চলে আসা মানুষের রুচি, বিশ¡াস, আচার-আচরণ, সংস্কার, রসবোধ, সুখ-দুঃখ, উপদেশ, নিষেধ ইত্যাদির।
খনিজ সম্পদ
পাটগ্রামে পাথরের সন্ধান পাওয়া গেছে যা দেশীয় পদ্ধতিতে উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে সঠিক অনুসরণের মাধ্যমে এ পাথর উত্তোলিত হলে তা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বাড়বে। একই উপজেলা ও ধরলা নদী অববাহিকায় যে বালি আছে তা নির্মাণ কাজের জন্য উত্তম বলে বিবেচিত। তাছাড়া এটি কাঁচ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা তার সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
লালমনিরহাট জেলায় তিন ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে; সড়ক, রেল এবং নৌ যোগাযোগ। এর মধ্যে সড়ক যোগাযোগই প্রধান। এছাড়া রেল যোগাযোগও যথেষ্ট জনপ্রিয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি বিভাগীয় হেড কোয়ার্টার লালমনিরহাটে অবস্থিত।
দর্শনীয় স্থান
লালমনিরহাট জেলার আত্মপ্রকাশ অধূনা হলেও এ ভূ-খণ্ড প্রাচীনকাল থেকে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভাস্বর। এ জেলার দর্শনীয় স্থান/ঐতিহ্যসমূহ সারা দেশের অপরাপর জেলাসমূহের চেয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ জেলায় রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত দহগ্রাম-আংগরপোতা ছিটমহল সহ বাংলাদেশের ৩৩টি ছিটমহল, তিন বিঘা করিডোর, শতাব্দি প্রাচীন রেল লাইন ও রেল সেতু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবহ বিমান ঘাটি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহ ৬ নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার, বহুল আলোচিত তিস্তা ব্যারেজ, শতাব্দি প্রাচীন মসজিদ-মন্দির সহ অসংখ্য ঐতিহাসিক স্পাপনা। মোট কথা লালমনিরহাট জেলা পর্যটকদের জন্য বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এক আকর্ষণীয় জেলা।
এক নজরে জেলা
ভৌগোলিক অবস্থান : ২৫০৪৮” থেকে ২৬০২৭” উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮০৩৮” থেকে ৮৯০৩৬” পূর্ব দ্রাঘিমা
আয়তন : ১২৪১.৪৬ বর্গ কিলোমিটার
উপজেলা : ৫টি
থানা : ৫টি
পৌরসভা : ২টি
ইউনিয়ন : ৪২টি
গ্রাম : ৪৭৬টি
নদী : ৭টি
মোট জনসংখ্যা : ১,২৩২,৮৯৭ জন
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার : ১.৫২%