Home নিয়মিত তারা হতে পারতেন আরো বড়

তারা হতে পারতেন আরো বড়

হাসান শরীফ

খেলাধুলা মানেই নায়কের সমারোহ। এখানে খুব দ্রুত খ্যাতি, অর্থ, সম্মান পাওয়া যায়। বলা যায়, অন্যান্য ক্ষেত্রে জীবন যেখানে সবে শুরু, ক্রীড়াঙ্গনে তখন প্রায় শেষ। এখানে আছে মায়াবী হাতছানি। খ্যাতি, সম্মানের সাথে অর্থ যোগ হওয়াতেই খেলাধুলার প্রতি তরুণদের এতো আকর্ষণ। তবে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে : অর্থই সকল অনর্থের মূল। তবে যশ-খ্যাতিও কাউকে কাউকে কম বিপথে চালিত করে না। অর্থ যেমন কারো কারো জীবনে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি যশ-খ্যাতিও সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এমন অনেক অমিতপ্রতিভাধর খেলোয়াড় ছিলেন এবং আছেন, যারা আরো অনেক দূর যেতে পারতেন, কিন্তু হঠাৎ পিছলে পড়ে সেখানে পৌঁছাতে পারেননি। এখানে এ ধরনেরই কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনা করা  হলো।

জর্জ বেস্ট (ফুটবল)

George-Best
George-Best

অনেকে তাকে পেলে, ম্যারাডোনাদের মতো ক্ষণজন্মা প্রতিভাদের একজন হিসেবে বিবেচনা করে। বিশ্বকাপে তিনি কখনো খেলেননি। কিন্তু তবুও ফুটবলের তারকাদের কথা আলোচনা হলে তার নাম ওঠে আসবেই। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলা শুরু করেন। দু’বছর পর ১৯৬৩-৬৪ সালে ১৭ বছর বয়সে খেলেন প্রথম বিভাগে প্রথম ম্যাচ। প্রথম বছরে ১৭টি ম্যাচ। আর তাতেই অবাক গোটা গ্রেট ব্রিটেন। যেকোনো ডিফেন্স তছনছ করে দেয়া স্কিল, গতিতে সবাই বিস্মিত হলো। ফল পেলেন হাতে হাতে। সেই সময়ই তার আয় দাঁড়ায় বছরে ৫০ হাজার পাউন্ড। ২১ বছর বয়সেই লন্ডনের পশ এলাকার কিনে  ফেললেন বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ১৯৬৭-৬৮ তে লিগে শীর্ষ গোলদাতা হওয়ায় উঠে যান খ্যাতির শীর্ষে। শুধু ব্রিটেন নয়, সারা ইউরোপেই বনে গেলেন টেনজারদের হিরো। এ সময় বিভিন্ন পোশাক কোম্পানি এবং প্রসাধন সংস্থার মডেল হতে রাজি হন। ফুটবল দক্ষতাও তুঙ্গে।

কিন্তু তখনই তার জীবনে শুরু হলো অন্ধকার সময়। ব্রিটেনের রক্ষণশীল ফুটবল সমাজকে উপেক্ষা করে তরুণীদের সাথে বিজ্ঞাপনের মডেলরূপে অবতীর্ণ হলেন। কিনে ফেললেন আরও একটি বিরাট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং আরও আধুনিক সব ব্যবস্থাযুক্ত ৩০ হাজার পাউন্ডে একটি বাড়ি। আয়, খ্যাতি বাড়ার পাশাপাশি বেড়ে যায় তার উচ্ছৃঙ্খলতা। এ অপরাধে কয়েকবার বহিষ্কৃত হয়েছেন। প্রথমদিকে সমালোচনা তিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন দুর্দান্ত দক্ষতায়। কিন্তু বেশি দিন পারেননি। অকালেই তাকে ঝরে পড়তে হয়েছে।

গ্যারিঞ্চা (ফুটবল)

১৯৬২’র বিশ্বকাপ ফুটবলে তিনি ছিলেন ব্রাজিলের তারকাদের তারকা। যেমন পেশিবহুল দেহ তেমনি অসাধারণ ড্রিবলিং স্টাইল। ডান প্রান্তের

garrincha
Garrincha

লাইন ধরে দ্রুত এগোনো এবং অকল্পনীয় ক্রশ পাস ছিলো বিপক্ষ দলের জন্য ত্রাস। বেস্টের মতো গ্যারিঞ্চাও মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে জুনিয়র টিমে সুযোগ পান। ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপের প্রথম দু’টি ম্যাচে খেলতে না পারলেও তৃতীয় ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গ্যারিঞ্চাকে দেখা যায় অন্য চেহারায়। প্রথম মিনিটেই সোভিয়েতের বা প্রান্তকে তছনছ করেছেন গ্যারিঞ্চা। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ে তার অবদান  অসীম। এর পর থেকে গ্যারিঞ্চা মানেই ব্রাজিল, গ্যারিঞ্চা মানেই বোটাকোগো। ১৯৬২’র বিশ্বকাপে গ্যারিঞ্চার শ্রেষ্ঠত্ব আরও প্রমাণিত হলো। দ্বিতীয় ম্যাচে চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে খেলায় পেলে আহত হলে সেই প্রতিযোগিতায় আর খেলতে পারেননি। এবার সব দায়িত্ব গ্যারিঞ্চার কাঁধে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম গোলটি করলেন এবং দ্বিতীয় গোলটিও তার প্রয়াসেই। সেমিফাইনালে চিলির বিরুদ্ধে ৪-২ গোলের মধ্যে তার গোল দু’টি। ফাইনালে গ্যারিঞ্চার অনবদ্য খেলা ব্রাজিলকে আবার চ্যাম্পিয়ন করেছে, সে ম্যাচে চেক হারে ৩-১ গোলে। পেলের জায়গায় ব্রাজিল এখন গ্যারিঞ্চাময়।  জনপ্রিয়তার ভোটেও তিনি এক নম্বর। কিন্তু যশ যে তাকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে তিনি বুঝেও বোঝেননি। পরিবার থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেলেন। রাতের পর রাত তিনি বাড়ির বাইরে কাটালেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মহিলা সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে। ফুটবলেও অনীহা তার। যে ফুটবল তাকে অর্থ যশ-খ্যাতি সবই দিয়েছে, করেছে রাজা। বিশ্বকাপের পর থেকে গ্যারিঞ্চার সঙ্গে ফুটবলের কোনো সম্পর্ক নেই। এক বছর থেকে ফুটবলের বাইরে। ১৯৬৩-তে তিনি হাঁটুভাঙ্গা অবস্থায় হাসপাতালে গেলেন। অস্ত্রোপাচারের পর পা ভালো হলো। কিন্তু বোটাকোগো তাকে নিল না। উচ্ছৃঙ্খলদের স্থান নেই। এই বলে ক্লাব তাকে বিতাড়িত করল। এসে গেলো ১৯৬৬ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের খেলা। কর্তৃপক্ষ তাকে বুড়ো হয়ে গেছে এই অজুহাতে দলে রাখলো না। সতীর্থরা দুঃখ পেলেন। বললেন তুমি গ্যারিঞ্চাই সর্বকালের অন্যতম ফুটবলার হিসেবে সেরাই থাকবে।

mike_tyson
Mike Tyson

মাইক টাইসন (বক্সিং)

মোহাম্মদ আলীর পর আমেরিকার মাইক টাইসন এককভাবে বেশ কয়েক বছর বক্সিং জগতের রাজা ছিলেন। মোহাম্মদ আলীর যোগ্য উত্তরসূরি বিবেচনা করা হতো তাকে। সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপা জয় করে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। টানা ৩৭টি লড়াই জেতার পর ১৯৯০ সালে টোকিওতে লড়াইয়ে অনুষ্ঠিত হয় ডগলাস বাস্টারের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফলে বেশি ওজন নিয়ে লড়াই শুরু করেন। এ জন্য তাকে স্বদেশি বাস্টারের কাছে পরাস্ত হতে হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় পতন। এক সময় নারী নির্যাতনের জন্য  জেলও খাটেন। এরপর অভিনেত্রী স্ত্রী গিভেন্স তাকে ছেড়ে চলে যান। এছাড়া আরও অনেক ঘটনাই তিনি ঘটান। প্রতিদ্বন্দ¡ী ইভান্ডার হলিফিন্ডের কান আর ব্রিটিশ চ্যানেলের লুণ্ঠনের পা কামড়ে দেন। সেই কামড়ের প্রতিশোধ  কিছুদিন  বাদে ঠিকই নিয়ে নেন লুইস। এক সময় এক একটি লড়াই করার জন্য লাখ লাখ ডলার পেতেন। আর বিলাসের মধ্যেই  কাটাতেন। কিন্তু বর্তমানে তার  আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে বক্সিং থেকে অবসর নেন।

ডন ফ্রেজার (সাঁতার)

অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত জন ফ্রেজার। অস্ট্রেলিয়ার এই সাঁতারু অলিম্পিকে একই ইভেন্টে ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে টানা

don-fraser
don-fraser

তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্নে ১ মিনিট ০২.০ সেকেন্ডে সোনাও জয় একটি অলিম্পিক রেকর্ড। ১৯৬৪-র টোকিও অলিম্পিকেও রেকর্ড গড়েন। ১৯৫৬-র অলিম্পিকে ৪´১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল রিলেতেও ছিলেন সোনা জয়ী দলে।

রোমে দ্বিতীয়বার ১০০ মিটারে সোনা জয়ের পর ডন একটু অন্য মেজাজের হয়ে গেলেন। দলের সাঁতার কর্মকর্তাদের সংগে মাঝে মধ্যেই ঝগড়া বাধাচ্ছেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। তাই শাস্তিও পেতে হয়েছে। তবুও প্রতিভার কারণে দলে রাখা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালের মার্চে একটি মোটর দুর্ঘটনায় আহত হওয়ায় সাত মাস পর ট্রায়ালে নেমেও যোগ্যতা প্রমাণ করলেন। টোকিতে সময় নিলেন মিনিটের কম। ৫৯:৫ সেকেন্ড। কিন্তু তার সব কৃতিত্ব ঢাকা পড়ে গেল একটি ঘটনায়। টোকিওর সাফল্য তাকে আরও উচ্ছৃঙ্খল করে তোলে। দলের কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করে শেষ রাত অবধি রইলেন হাপ সম্রাটের প্রাসাদের পার্টিতে। প্রমোদের সময় একটি চুরির ঘটনায় হাতে নাতে ধরা পড়লেন। অস্ট্রেলিয়ার সুইমিং ইউনিয়ন পরদিন তাকে ১০ বছরের জন্য সাসপেন্ড করে। অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন তিনি। সবাই তাকে দূরে সরিয়ে দিলো। তার সব কৃতিত্ব ধুলোয় মিশে যায়। পরে তিনি স্বীকার করেন, বেশি সাফল্য তাকে উচ্ছৃঙ্খল করে তুলেছিল।

আজহারউদ্দিন (ক্রিকেটার)
অভিষেকের প্রথম তিনটি টেস্টেই তিনি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন, একদিনের ক্রিকেটে এক সময়ে সর্বাধিক ম্যাচ খেলে সর্বাধিক রান সংগ্রহের রেকর্ড গড়েছিলেন, ভারতের সর্বকালের অন্যতম অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, এমন এক ক্রিকেটার ক্রিকেট মাঠে যাওয়া তো দূরের কথা, কমেন্ট্রি বক্স থেকেও বিতাড়িত হয়েছেন। তার নাম মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। যার উইলো ইতিহাস গড়তো, তিনি নিজেই ইতিহাসে পরিণত হন সহসা। যে ক্রিকেটের জন্য তিনি পরিচিত, সেই খেলাটি থেকেই তিনি হন নির্বাসিত।

Azharuddin
Azharuddin

ড্যাশিং, রিস্টি এবং এলিগেন্স এই হায়দ্রাবাদি ব্যাটসম্যানটি ভারতীয় ক্রিকেট দলের মিডল অর্ডারের মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছিলেন। তার ফ্লিক, গ্লান্স এবং ড্রাইভগুলো ছিল মনোমুগ্ধকর। একবার সেট হতে পারলে তাকে থামানো হয়ে পড়তো খুবই কঠিন। টেস্ট এবং একদিনের উভয় ধরনের ক্রিকেটেই তিনি ছিলেন চমৎকার। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডও গড়েছিলেন। তাছাড়া ভারতীয় কোনো ব্যাটসম্যান হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরির কৃতিত্বও তার ছিল।

শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই নয়, বোলিং এবং ফিল্ডিংও তিনি ছিলেন চমৎকার। অবশ্য ইনজুরির কারণে তিনি ক্যারিয়ারের শেষদিকে বোলিং করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে ফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ারের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন বিশ্বের অন্যতম। বিশেষ করে গালি এবং ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ফিল্ডার হিসেবে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি ১৫৬টি ক্যাচ নেওয়ার বিশ্বরেকর্ডও গড়েছিলেন। টেস্টেও তিনি ১০৫টি ক্যাচ নেয়ার কৃতিত্ব সৃষ্টি করেন।

এতোসব গুণের কারণে তিনি হতে পারতেন, সর্বকালের সেরাদের একজন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ক্যারিয়ার শেষ হয় ৯৯টি টেস্ট থেকে ৬২১৫ রান করে। পাতানো খেলার অভিযোগ তার ক্যারিয়ার হঠাৎ থামিয়ে দেয়। এছাড়া পারিবারিক আরো কিছু সমস্যাও তাকে পিছু টেনে ধরেছিল। খেলার দিকে অখণ্ড মনোযোগী হতে পারেননি। পরিণতিতে যেখানে যাওয়ার কথা, তার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেননি।

SHARE

Leave a Reply