বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ
১৯৪০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল চলছে। আমি তখন তদানীন্তন ময়মনসিংহ জেলার কেন্দুয়া থানার হাইস্কুলে প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। বাবা ১৯০৬ সালে ডাক্তারি পাস করে সরকারি চাকরিতে ঢোকেন। সেই সুবাদে তিনি যেখানে বদলি হতেন সেখানে আমরা সবাই একত্রে থাকতাম। থানা কেন্দ্রে সার্কেল অফিসার সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। তার পরই ডাক্তারদের স্থান। সেই সুবাদে ডাক্তারদের সন্তান-সন্ততিদের উঁচু সামাজিক অবস্থা ছিল। আমরা চার ভাই, ছয় বোন। আমি বাবা-মার অষ্টম সন্তান। পাঁচ মেয়ের পর দ্বিতীয় ছেলে পারিবারিক আদর-যত্ন অন্য ভাইবোনদের চেয়ে একটু বেশি ছিল। আমি সবার কাছ থেকেই একটু বেশি আদর পেয়েছি।
পারিবারিক ঐতিহ্যে ধর্মভীরু ও রক্ষণশীল পরিবার হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিল আমাদের পরিবার। ঈদের আমেজ অন্যদের চেয়ে আমাদের পরিবারে একটু ভিন্ন ছিল। প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠেই আব্বা-আম্মার সাথে বসে কুরআন পড়তে হতো। তারপর আব্বার সাথে হাঁটতে যেতে হতো। ফিরে এসে নাস্তা করে শীতের সময় গরম পানি, গরমের সময় সাধারণ তাপমাত্রার পানি দিয়ে বড় বোনেরা সাবান মেখে গোসল করিয়ে দিত। আমার মা ঈদের সমস্ত জামা কাপড় নিজেই বাসায় তৈরি করতেন। ঈদের নতুন কাপড়ের প্রাচুর্য থাকলেও পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে আমরা ভাইয়েরা সবাই রক্ষিত আসকান (শেরওয়ানি) পায়জামা, লেজওয়াল (প্রেজ) রুমি টুপি পরে আব্বার সাথে ঈদগাহে নামাজ পড়তে যেতাম। আমার যতটা মনে পড়ে, ইমাম সাহেবের পেছনে একটি বিশেষ জায়গা আমাদের জন্য সংরক্ষিত থাকতো। আমার বাবা এবং বড় ভাই তারা প্রত্যেকেই আসকান এবং রুমি টুপি পরতো। বড় ভাই অবশ্য আমার পাঁচ বোনের বড় ছিল। বোনেরা সবাই আমার বড়। সেই সুবাদে বড় ভাইয়ের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি।
ঈদগাহে আমাদের পরিবারের স্বাতন্ত্র্য ফুটে উঠতো। অন্যান্য স্থানীয় অফিসারদের সন্তান-সন্ততি শার্ট পায়জামা অথবা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বেশির ভাগ ঈদগাহে যেত। আমরা চার ভাই প্রায় একই রকমের পোশাক, বাবাও তাই একই পোশাক পরে যেতেন বলে সবাই আমাদের একটু স্বাতন্ত্র্য দৃষ্টিতে দেখতো। বাবার অর্থের প্রাচুর্য ছিল। আমাদের ভাইদের দেখাশোনা করার জন্য দুই- তিনজন লোক মোতায়েন থাকত। ঈদের নামাজ শেষে আমরা ভাইয়েরা-ভাইয়েরাই বেশি কোলাকুলি করতাম। আর সার্কেল অফিসার সাহেব, দারোগা সাহেবের ছেলেদের সাথে কোলাকুলি করেছি বলে মনে পড়ে। নামাজ শেষে বাসায় ফিরে এসে মা-বাবাকে সালাম করতাম। ভাইবোনদেরও সালাম করতাম। পারিবারিক ট্র্যাডিশন হিসেবে সবসময় ছোটরা বড়দের কদমবুসি করতো। অবশ্য তখন আমাদের মাঝে ঈদের বখশিশের ট্র্যাডিশন ছিল না। নামাজের পোশাক খুলে ঈদের পোলাও, কোর্মা, সেমাই, জর্দা সবাই এক সঙ্গে বসে খেতাম। খাওয়ার পরে ঈদের নতুন পোশাক পরিধান করে বন্ধু-বান্ধবের বাসায় গিয়ে মুরব্বিদের সালাম করে দোয়া নিতাম। তেমনিভাবে বন্ধুরাও আমাদের বাসায় এসে মুরব্বিদের সাথে সালাম বিনিময় করতো।
তখনকার ঈদের আমেজটাই ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। প্রত্যেক বাসায় গিয়ে কিছু মিষ্টি খেতে হতো, না খাওয়াটা ছিল অভদ্রতা। ঈদের দিন দুপুর বেলা আমাদের বাসায় কাঙালিভোজের আয়োজন হতো। পাটি বিছিয়ে তাদের সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে তাদের সামনে মা মোড়ায় বসে থাকতেন এবং বাসার কাজের লোকেরা তৃপ্তির সাথে তাদেরকে খাওয়াতো। মনে পড়ে, কোন কোন সময় তাদের খাওয়ানোর পর এক পয়সা দু’পয়সা করে বখশিশও দেয়া হতো। তখন অবশ্য এক পয়সার মূল্য বর্তমান এক টাকার চেয়েও বেশি ছিল। তখনকার ১ টাকা একশ বিরানব্বই ভাগে বিভক্ত ছিল। চৌষট্টি তামার পয়সায় ১ টাকা হতো এবং ৩ পাইয়ে ১ পয়সা হতো। এমনিভাবে চার পয়সায় ১ আনা, চার আনায় ১ সিকি, ২ সিকিতে ১ আধুলি, দুই আধুলিতে ১ টাকা হতো।
স্পষ্ট মনে পড়ে, ১ পাই দিয়ে পুঁটি মাছ মারার বড়শি, সুতো ময়ূরের পাখার কাঠি কেনা যেত। ১ পাই দিয়ে লজেন্স, কোকিজ বিস্কিটও কিনেছি। তখনকার বাংলার রূপ ছিল পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, ঘর ভরা শস্য। এক পয়সায় ১ সের দুধ কিনেছি এটাও মনে আছে। ঈদের দিন বিকেল বেলা বন্ধুদের নিয়ে খেলাধুলায় মেতে উঠতাম। অবশ্য খেলাধুলা করার সময় ঈদের নতুন পোশাক খুলে রেখে দিতাম। খেলার মাঠের তখন অভাব ছিল না। যত্রতত্রই ফুটবল খেলা হতো। যারা বল কিনতে পারতো না তারা অবশ্য বন্ধুরা দিয়ে হলেও খেলায় মেতে উঠতো। তা-ছাড়া আমাদের সাথে মেয়েরা গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, রুমাল চুরি খেলায় স্বতন্ত্রভাবে মেতে থাকতো। কোন কোন জায়গায় ঈদের মেলাও বসতো। বাঁশি কেনার ধুম পড়ে যেত। শীতকালে ঘুড়ি ওড়ানোরও ধুম পড়তো। ঈদের দিন খেলাধুলা নিয়ে বন্ধুদের সাথে কখনো ঝগড়া করেছি এটা মনে পড়ছে না। ঈদের খুশির আমেজ নিয়েই সারাদিন কাটিয়েছি এটা স্পষ্ট মনে পড়ে। এখন আফসোস হয়, যদি সেই পুরনো দিনের পরিবেশটা আবার ফিরে আসতো। তাহলে আমাদের দেশটি কতই না সুন্দর দেশে পরিণত হতো।