গাজার নিউটন

গাজার নিউটন

বিজ্ঞান আহমেদ বায়েজীদ মে ২০২৪

নাম তার হুসাম আল আত্তার, বয়স ১৫ বছর। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজা উপত্যকায় বাড়ি তার। এই বয়সেই তাকে ডাকা হচ্ছে ‘গাজার নিউটন’ নামে। এর কারণ নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই কিশোর চমকে দিয়েছে সবাইকে। সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে তার সর্বশেষ আবিষ্কার করা বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে সে নিজেদের তাঁবুতে আলোর ব্যবস্থা করেছে।

আইজ্যাক নিউটন ছিলেন একজন ইংলিশ বিজ্ঞানী। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পদার্থবিদ্যা, গণিত ও জোতির্বিদ্যায় যুগান্তকারী অনেক বিষয় উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। আমাদের কাছে নিউটনের সবচেয়ে বেশি পরিচিতি আছে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার নিয়ে। আপেল গাছের তলায় বসে থাকা নিউটনের সেই গল্প তোমরা নিশ্চয়ই জানো। গাছ থেকে মাথায় একটি আপেল পড়ার পর তার মাথায় চিন্তা আসে আপেলটি কেন ওপরে বা ডানে-বামে না গিয়ে নিচে পড়লো। এরপর তিনি আবিষ্কার করেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, যে কারণে ওপর থেকে কোনো বস্তু মাটিতে পড়ে।

হুসাম আল আত্তারের গল্পটা গাজা উপত্যকার অন্যসব শিশুদের মতোই ট্র্যাজেডিতে ভরা। তার পরিবার বাস করতো উত্তর গাজার বেইত লাহিয়া এলাকায়। স্থানীয় জাবেল মুকাবের স্কুলের শিক্ষার্থী হুসাম। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। এর কিছুদিন পর গাজায় প্রবেশ করে ইসরাইলের স্থল বাহিনী। তাদের ট্যাংক আর কামানের গোলায় বিধ্বস্ত হয় লাখো বাড়িঘর। দখলদার বাহিনী গাজায় প্রবেশ করার খবর পেয়ে অন্যসব গাজার বেসামরিক নাগরিকের মতো হুসামের পরিবারও বাড়িঘর ছেড়ে প্রথমে আল নাসর, এরপর পায়ে হেঁটে খান ইউনিস শহরে এবং সেখানেও হামলা শুরু হলে তারা আশ্রয় নেয় রাফাহ শহরে। রাফাহ শহরটি গাজার একেবারে দক্ষিণে মিসর সীমান্তের কাছে।

রাফাহ শহরের খোলা মাঠে আরো কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি পরিবারের সাথে তাঁবু খাটিয়ে বাস করতে শুরু করে হুসামের পরিবার। গাজা উপত্যকায় চারদিকেই ইসরাইলি নৃশংসতা। মিসাইল, রকেট আর কামানের হামলাই শুধু নয়, যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে গাজার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইহুদিবাদী সরকার। খাবার ও ঔষধ প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলো তখন উদ্বাস্তু শিবিরে কঠিন দুর্দিনে। সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারপাশ।

বলা হয়ে থাকে- প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক। তাই তো যুদ্ধের এমনই এক কঠিন পরিস্থিতিতে হুসামের মাথায় কাজ করতে থাকে কীভাবে নিজেদের তাঁবুতে একটু আলোর ব্যবস্থা করা যায়। কয়েক দফায় চেষ্টার পর একদিন সে ঠিকই সফল হয়। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে, চারদিকে থমথমে অন্ধকারের মাঝে রাফাহ শহরের একটি তাঁবুতে আলো জ্বলছে।

হুসাম জানায়, বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের চিন্তা আসে তার মাথায়। এরপর স্থানীয় মার্কেট থেকে পুরোনো পাখা ও ছোটো কয়েকটি যন্ত্র কিনে সে কাজ শুরু করে দেয়। তাঁবুর ওপরে একটি খুঁটির সাথে লাগানো হয় পাখা। বাতাসে পাখা ঘুরলে সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এবং তা দিয়ে জ্বালানো হয় বাল্ব। হুসাম বলে, তাঁবুর ভেতর অন্ধকারে আমার ছোট্ট দু’টি ভাতিজা খুব ভয় পেতো। ওদের ভয় দূর করার চিন্তা থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় আসে আমার।

এক্ষেত্রে গাজা উপত্যকার ঠাণ্ডা আবহাওয়া ও প্রবাহিত বাতাসের সুবিধাকে কাজে লাগিয়েছে হুসাম। পরিবারের ছোট্ট শিশুদের শীতে একটু উষ্ণতা আর অন্ধকারে একটু আলোর ব্যবস্থা করতে কাজে নামে সে। প্রথম দুই দফা ব্যর্থ হয়েও থেমে যায়নি এই অদম্য কিশোর। তৃতীয়বারের চেষ্টায় সে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হয়। হুসাম বলেন, আমি একটির পর একটি ধাপে কাজ করে গেছি। শেষ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ তারের সাহায্যে তাঁবুতে আনতে পেরেছি।

তবে ছোটো পাখা দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ খুবই কম। যেটি দিয়ে একটি পরিবারের সারা সন্ধ্যার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। আবার বাতাস না থাকলে টারবাইন ঘোরে না, তখন বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় না। তবু কিছু করার নেই। কারণ গাজার যুদ্ধপরিস্থিতিতে যেখানে খাবারই জোটে না, প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি- সেখানে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ পাওয়ার আশা করা নিরর্থক। এর মাঝেই হুসামের এই আবিষ্কার সবাইকে চমকে দেয়। বিশেষ করে উদ্বাস্তু শিবিরের কঠিন জীবনের কারণেই তার এই সফলতা বেশি আলোচিত হয়। সারা বিশ্বের নামীদামি সংবাদপত্র তার সাক্ষাৎকার নেয়।

হুসাম জানায়, তার হাতে যেসব যন্ত্রাংশ রয়েছে সেগুলোতে বিদ্যুৎ জমা রাখার ব্যবস্থা নেই। যদি বিদ্যুৎ ধরে রাখার মতো ব্যাটারি পাওয়া যায়, তাহলে আরো বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেটি কাজে লাগানো সম্ভব; কিন্তু রাফাহর মার্কেটে এ ধরনের ব্যাটারি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই উৎপাদিত বিদ্যুৎ জমা করে রাখতে পারছে না সে। শুধু যখন বাতাসে পাখা ঘোরে তখনই বাল্ব জ্বলে।

হুসামের গর্বিত মা জানান, তার ছেলে ছোটোবেলা থেকেই প্রতিভা দেখিয়ে আসছে। হাতের কাছে যেসব ছোটোখাটো ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ পেতো তাই দিয়ে সে এটা-সেটা বানানোর চেষ্টা করতো। ঘরের বিদ্যুৎ লাইনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে নিজেই মেরামত করতো। এর আগে সে পানির নিচে জ¦লতে সক্ষম লাইট আবিষ্কার করেছে এবং দরজা বন্ধ করার স্বয়ংক্রিয় একটি ডিভাইস আবিষ্কার করেছে।

হুসামের ইচ্ছে বড়ো হয়ে বিজ্ঞানচর্চা অব্যাহত রেখে একজন উদ্ভাবক হওয়ার, যে মানুষের কল্যাণে নানা কিছু আবিষ্কার করবে; কিন্তু গাজা উপত্যকার যে কঠিন জীবন, তার মধ্যে বিজ্ঞানচর্চা কতটা সম্ভব হবে সেটি নিয়ে সে এখন চিন্তিত।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ