হার না মানা বিপু

হার না মানা বিপু

উপন্যাস আগস্ট ২০১২

জুবায়ের হুসাইন... এক.
‘কে আপনারা? আমাকে কেন এভাবে তুলে আনলেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?’
তৃতীয়বারের মতো প্রশ্নগুলো করল বিপ্লব। এবং এবারও কোনো জবাব পেল না।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না ও। এটা কেমন কথা, ওকে তুলে নিল মাইক্রোতে, নিয়ে যাচ্ছে কোথাও; কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা জানতে পারছে না, আবার জিজ্ঞেস করলেও কিছুই বলছে না। কতক্ষণই বা আর নিজেকে শান্ত রাখা যায়?
‘কী আশ্চর্য!’ তবুও শান্তভাবেই বলল বিপ্লব। ‘আমার কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কেন?’
‘অত অধৈর্য হলে কাজে উন্নতি করবে কীভাবে খোকা?’ যেন মেঘের ভেতর থেকে গুড় গুড় শব্দ ভেসে এলো। ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটা। এখনও পর্যন্ত মুখটা দেখতে পারেনি। তবে পেছন সাইড দেখে বোঝা যায় বেশ স্বাস্থ্যবান লোক তিনি। মাথার চুলগুলো সব পেকে সাদা হয়ে গেছে। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হবে বুঝি পাটের আঁশ পাকিয়ে মাথার উপরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘আর কত ধৈর্য ধরতে বলেন আমাকে?’ এবার সত্যি সত্যি ঝাঁঝিয়ে উঠল বিপু ভাইয়া। ‘সেই কখন থেকে জানতে চাচ্ছি আপনারা কে, কেন আমাকে উঠিয়ে নিলেন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেনÑ কোনো জবাবই তো দিচ্ছেন না।’
‘সরি খোকা, আ-অ্যাম রিয়েলি সরি।’
‘দেখুন, আমাকে অত ‘খোকা খোকা’ বলবেন না। আপনি জানেন না আমি কে। যদি জানতেন তাহলে...’
‘সরি তোমাকে কথা শেষ করতে দিতে পারছিনে বলে।’ ওর কথার মাঝেই আবার মেঘ গুড় গুড় করে উঠল। ‘তুমি কে, কী করো, তোমার বাবা-মায়ের নাম কী, তোমার বন্ধু কারা- সব, সব আমি জানি। এও জানি যে তুমি তোমার আদরের ছোট্ট বোন জেসমিনকে অত্যন্ত ভালোবাসো। ইতিমধ্যে সমাধান করেছো বেশ কয়েকটি...’
এবার বিপ্লব তাকে থামিয়ে দিল। বলল, ‘থাক থাক আর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি আমার বিষয়ে সব জেনেই আমাকে এভাবে উঠিয়ে এনেছেন। তো এবার কারণটা একটু খুলে বলবেন কি?’
‘হ্যাঁ খোকা, সে কথাতেই এখন ফিরে আসছি।’ বললেন লোকটা। তারপর ড্রাইভারকে কিছু একটা নির্দেশ দিলেন।
ড্রাইভার গাড়িটা একটা বড় রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড় করালো।

মাথাটা ভীষণ ধরেছে বিপ্লবের। এরকম এককপালে মাথা ব্যথা প্রায়ই করে। তখন নিজেকে স্থির রাখতে পারে না ও। সমস্ত জগৎ টালামাটাল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মা তেল-পানি মাখিয়ে মাথায় ডলে ঘষে দেন। তাতে কিছুটা আরামবোধ হয়। কিন্তু পুরোপুরি সারে না। তখন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
ইদানীং অবশ্য একটা ট্যাবলেট খায় ও। ‘ডিসপিরিন’ নামের ট্যাবলেটটা সামান্য পানিতে গুলে খেয়ে ফেলে ও। খেতে খানিকটা মিষ্টি মিষ্টিও লাগে। এবং তারপর নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। আস্তে আস্তে কমে আসে যন্ত্রণা। এ কারণে ওর পড়ার টেবিলে ট্যাবলেটটা এনে রেখে দেয়। কিন্তু এখন ও অনেক খুঁজেও পেল না একটি ট্যাবলেটও। কবে ফুরিয়ে গেছে তা মনে নেই।
উঠে গিয়ে ওষুধের দোকান থেকে কিনে আনতেও ইচ্ছে করছে না। কাতর স্বরে ডাকল, ‘জেসমিন? জেসমিন একটু এদিকে আসবি বোনটি?’
জেসমিন উঠানে ওর বান্ধবীদের সাথে এক্কাদোক্কা খেলছিল। ভাইয়ার ডাক শুনে ছুটে এলো। জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে ডাকছো ভাইয়া?’
‘একটু তোরাবের দোকানে যেতে পারবি?’ তোরাব হচ্ছে ওষুধের দোকানের মালিকের নাম। তার নামেই ওষুধের দোকানটা এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছে।
‘ডিসপিরিন আনতে হবে? তোমার বুঝি আবার মাথা যন্ত্রণা করছে!’ ভাইয়ের যন্ত্রণাটা বুঝি জেসমিনের শরীরেও বয়ে যাচ্ছে।
জেসমিন আর দেরি করল না। অবশ্য আম্মু বাড়িতে থাকলে আম্মুকেই আগে ডাকত। কিন্তু তিনি কী এক কাজে আমেনা খালার বাড়িতে গেছেন। আসতে রাত হবে, বলে গেছেন। তাই টাকা নিয়ে ছুটল তোরাবের দোকানে।
জেসমনি ফিরে আসতে বেশি সময় নিল না, তারপরও বিপ্লবের কাছে মনে হতে লাগল, এখনও আসছে না কেন ও? যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ডান কপালটা। চোখের ঠিক উপর দিয়ে দপ দপ করে লাফাচ্ছে ওখানকার শিরা।
জেসমিন নিজেই ট্যাবলেটটা গেলাসের পানিতে গুলিয়ে ভাইয়ার মুখে ধরল। বিপ্লব এক ঢোকে তা গিলে ফেলল। তারপর সটান শুয়ে পড়ল। জেসমিন বলল, ‘আমি মাথাটা একটু টিপে দেব ভাইয়া?’
কথাটা খুব ভালো লাগল বিপ্লবের। আসলে কারোর যখন প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তখন কেউ সামান্য মমতা দিয়ে একটা কথা বললেও তা সেটা মধুময় মনে হয়।
বিপ্লব বলল, ‘না আপুমণি, তুমি গিয়ে খেলোগে।’
জেসমিন ‘আচ্ছা’ বলে রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিল। হঠাৎ কী মনে পড়াতে ঘুরে দাঁড়াল। হাতে একটা কাগজ ধরা ছিল ওষুধ নিয়ে ফেরার পর থেকেই। এইমাত্র যেন ওটার কথা মনে পড়ল। এগিয়ে গেল ভাইয়ার কাছে। তারপর কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও।’
কাগজটা হাতে নিতে নিতে বলল বিপ্লব, ‘কী এটা? কে দিয়েছে?’
‘বা রে, তা আমি কি জানি! লোকটা এটা আমার হাতে দিয়ে বলল ‘তোমার বিপু ভাইয়াকে এটা দিও’। তারপর চলে গেল।’ বলেই ঘুরে দাঁড়াল জেসমিন। চলে গেল খোলা দরোজা দিয়ে উঠানে বান্ধবীদের সাথে খেলতে।
ইচ্ছা না করা সত্ত্বেও কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরল বিপ্লব। শেষ বিকেলের লালচে আভা ছড়াচ্ছে সূর্যটা। জানালা গলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করেছে সে আলো। তাতে রুমটা বেশ দেখার মতো হয়েছে। এক অন্যরকম আবহ তৈরি হয়েছে।
কাগজে একটা মাত্র বাক্য লেখা। আর তা পড়েই তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল কিশোর গোয়েন্দা বিপ্লব খান ওরফে বিপু ভাইয়া। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে গেল। ভুলে গেল একটু আগের মাথার যন্ত্রণার কথা।

দুই.
বিষয়টাতে একদম নাক গলাবে না!
এই নিয়ে ছয়বার পড়ল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লেখাটার দিকে। কালো বিন্দুগুলো বড় হতে হতে অদৃশ্য হয়ে বিশালাকার ধারণ করল। বিভিন্ন প্রকারের জন্তুজানোয়ার দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। ঝাঁপসা হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি।
কোথায় যেন হারিয়ে গেল বিপ্লব। তাই হুড়মুড় করে কয়েকটা ছেলে রুমে প্রবেশ করলেও কিছুই টের পেল না। ওর কানের কাছে, বলা যায় কানের মধ্যে মুখ নিয়ে যখন প্রায় চিল্লিয়ে উঠল একজন ‘বিপু, অ্যাই বিপু...?’ তখন ধড়মড় করে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। বার কয়েক চোখ পিটপিট করে পুরোপুরি বাস্তবে ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করল, ‘ও মামুন, তোমরা? কখন এলে?’
‘এসেছি তো প্রায় কয়েক মিনিট হলো, তাই না! তোমার তো কোনো হুঁশই ছিল না, তাই না! কী ভাবছিলে অমন করে? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে?’ মোটা কাচের চশমা পরা ছেলেটার চোখে। ও-ই মামুন।
‘তোমার হাতে ওটা কী?’ বলে উঠল হ্যাংলা মতো ছেলেটা, ওর নাম হিমেল।
মুহূর্তে নিজের হাতে ধরা কাগজটার দিকে তাকাল বিপ্লব। কিন্তু ততক্ষণে কাগজটা চলে গেছে মামুনের হাতে। শব্দ করে পড়লÑ বিষয়টাতে একদম নাক গলাবে না! তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল বিপ্লবের দিকে। ‘মানে কী এর? কে লিখেছে? কাকে লিখেছে?’
‘আমার হাতেই যেহেতু ছিল, কাজেই আমাকে যে লিখেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ বলল বিপ্লব। ‘তবে কে লিখেছে সেটা বলতে পারবো না।’
‘মানে?’ হিমেল বলল এবার।
‘আরে বোসো বোসো।’ ওদেরকে বসতে বলল বিপ্লব। মাথাটা অনেক সেরে উঠেছে এখন।
ওর পাশে খাটে বসল হিমেল ও মামুন। বিপ্লব এতক্ষণ খেয়াল করেনি, ওদের সাথে তৃতীয় একটা ছেলে আছে। একে আগে কখনও দেখেনি ও। ছেলেটা পড়ার টেবিলের সামনে থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে তাতে বসেছে।
বিপ্লব তাকিয়ে আছে তার দিকে। বুঝতে পেরে মামুন বলল, ‘ওকে চিনতে পারছ না, তাই না! চিনবে কেমন করে? আজই তো এলো, তাই না! ওর নাম রাসেল মাহফুজ। আমার ছোট ফুফুর ছেলে। তোমার মতোই রহস্যের পোকা।’
এগিয়ে এলো রাসেল মাহফুজ। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার কথা অনেক শুনেছি। দেখা করার ইচ্ছে ছিল। আজ সেটা পূরণ হলো।’
বিপ্লব নিজের হাতের মধ্যে রাসেল মাহফুজের হাতটা নিয়ে ঝাঁকি দিল কয়েকটা। বলল, ‘খুশি হলাম তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে। তবে সবাই একটু বাড়িয়েই বলে আমার সম্পর্কে।’
‘না বিপু ভাইয়া,’ বাঁধা দিয়ে বলল রাসেল মাহফুজ। ‘যেসব দুঃসাহসিক অভিযানে তুমি গেছ এবং জয়ী হয়েছ, তা সবাই পারে না। সবার দিয়ে ওসব হয়ও না। তুমি জানো না তোমার কত নামডাক চারদিকে।’
‘না না ভাই, আমাকে ওভাবে লজ্জা দেবে না।’ কারোর মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে একদম অভ্যস্ত নয় গোয়েন্দা বিপ্লব খান। ‘আসলে যা করি সব আল্লাহরই ইচ্ছায়। তিনিই আমাকে সহযোগিতা করেছেন বলে ওসব রহস্যের সমাধান করা সম্ভব হয়েছে।’
‘সেটা আমরা সবাই বিশ্বাস করি। তারপরও তোমার মেধা ও বুদ্ধির কাছে আমরা কেন, এই সময়ের অনেকেই কিছুই না।’
‘আচ্ছা বাদ দাও এখন ওসব।’ বিষয়টা এড়িয়ে যেতে বলল বিপ্লব খান। ‘তা মামুন-হিমেল, তোমরা খেলা বাদ দিয়ে হঠাৎ আমার রুমে, কী মনে করে বলো তো?’
‘তুমি তো খেলতে যাওনি, তাই না!’ বলল মামুন। চশমাটা ঠেলে ঠিক করে নিল। ‘আর তাছাড়া...’ থেমে গেল কথা শেষ না করে।
‘আর তাছাড়া?’ কথাটা ধরল কিশোর গোয়েন্দা।
‘আমরা একটা ঝামেলায় পড়েছি।’ বলল হিমেল।
‘কী ঝামেলা?’ বিপ্লবের ভ্রƒজোড়া কুঁচকে উঠল।
ঘটনাটা খুলে বলল হিমেল। ওকে সহযোগিতা করল মামুন ও রাসেল।
ঘটনাটা এরকম : মাঠে যথারীতি খেলছিল ওরা। অন্যান্য খেলা বাদ দিয়ে এখন ক্রিকেটের দিকেই ঝুঁকেছে ওরা। সাইফুল একটা বল মেরে চার বানিয়ে দেয়। ফিল্ডার হিসেবে বলটা আনতে যায় হিমেল। কিন্তু সেখানেই ঘটে বিপত্তিটা। মাঠের ওপাশে একটা মোটা শিশু গাছ আছে। বলটা ওপাশেই কোথাও আছে। খুঁজে বের করতে তাই কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু আসল বিষয় সেটা না, এক জায়গায় তিনটা পেড়া ইট ও কিছু ছাই দেখতে পায় ও। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। কিছু লাকড়িও পড়ে আছে পাশে। বলটা তখনও খুঁজে পায়নি। কিন্তু বল খোঁজার দিকে তখন আর ওর মন নেই। সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ওই তিনটি ইট আর ছাই।
দেরি দেখে মামুন এগিয়ে যায়। বিষয়টা ও-ও খেয়াল করে। ডাকে অন্যদের। ছুটে যায় সবাই। এরপর সবারই অবাক হওয়ার পালা।
আসল জিনিসটা রাসেলই প্রথম দেখে। থোকা থোকা রক্ত আর ছড়ানো ছিটানো পালক দৃষ্টি কাড়ে ওর। সবার দৃষ্টি ওদিকে আকৃষ্ট করে নিজে এগিয়ে যায়। পালক ও রক্তের মাঝে পড়ে আছে মুরগির চারটি পা। পালকে রঙ দেখে বোঝা যায় ওগুলো লাল ও সাদা-কালোই মেশানো ছিল।
বিষয়টা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না রাসেল মাহফুজের। কেননা, ও-ও তো দুয়েকটা রহস্যের সমাধান করেছে। বুঝিয়ে দেয় অন্যদের।
হিমেলই বিষয়টা নিয়ে বিপ্লবের কাছে আসার পরামর্শ দেয়। তারপর ছুটে আসে ওরা।
সব শুনে বিপ্লব বলল, ‘সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে চোরের বেশ আনাগোনা বেড়েছে।’
মামুন বলল, ‘আজ সকালেই আম্মু বলছিল লাল মুরগিটা পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আমি শিওর ওই লাল পালকগুলো আমাদেরই লাল মুরগির ছিল। তাই না!’
কথার শেষে এই ‘তাই না’ বলাটা ওর মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। বন্ধুরা অনেক বলেও এটা বলা থেকে বিরত রাখতে পারেনি ওকে। তাই ও নিয়ে এখন কিছু বলে না।
‘যাক,’ মুখে হালকা হাসি টেনে বলল বিপ্লব। ‘চোরেদের ভালো একটা পিকনিক হয়েছে গত রাতে। এজন্য তো তোমার গর্ববোধ করা উচিত মামুন।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, হর্বে আমি গর্বিত, তাই না।’ মন খারাপ করে ফেলেছে মামুন। ‘তুমি জানো মুরগিটা আমার ছোট বোনের কত প্রিয় ছিল?’
‘চুক চুক’ করে একটা শব্দ করল বিপ্লব। বলল, ‘তাহলে তো ভীষণ দুঃখের কথা, তাই না? মন খারাপ করো না ভাইটি। এর বদলা তুমি হাশরের ময়দানে পাবেই।’
হেসে উঠল সবাই।
‘ভালো হচ্ছে না কিন্তু!’ যেন কেঁদেই ফেলবে মামুন।
‘ও কে ও কে,’ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল বিপ্লব। ‘চোরকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমি নিলাম। আার কথা দিচ্ছি, চোরকে পেলে তার কাছ থেকে তোমার বোনের লাল মুরগিটার দাম আদায় করে ছাড়ব। কিন্তু আমার এই চিরকুটের কী হবে?’
এতক্ষণ যেন ভুলেই গিয়েছিল সবাই। বিপ্লব মনে করে দেয়াতে সবাই কেমন নড়েচড়ে বসল।
রাসেল মাহফুজ বলল, ‘তুমি কিছু আন্দাজ করতে পারো কে লিখতে পারে এটা?’
‘হ্যাঁ,’ বলল মামুন। ‘আমাদেরকে প্রথমে এর লেখককে খুঁজে বের করতে হবে, তাই না!’
ভ্রƒজোড়া আবারও কুঁচকে ফেলল বিপ্লব। গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে বলে মনে হলো। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা টেনে চিমটি কাটল বার কয়েক। চিরকুটটা মামুনের হাতেই ছিল। ওর হাত থেকে নিজের হাতে নিল। আরেকবার পড়ল।
তারপর দড়াম করে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল খাটে। নিষ্পলক তাকিয়ে রইল সিলিংয়ের দিকে।
হিমেল জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় পেয়েছ ওটা?’
এই কথায় তড়াক করে উঠে বসল বিপু। বলল, ‘তাই তো, একথা তো একদমই ভুলে গিয়েছিলাম।’ তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল, ‘জেসমিন, আপুমণি এদিকে একটু আসবে?’
তখন সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। রুমটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। তাই সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে দিল বিপু।
‘আসছি ভাইয়া...’ বাইরে থেকে জবাব দিল জেসমিন।
বিপ্লব এই ফাঁকে পড়ার টেবিলের নিচ থেকে বড় একটা টিনের কৌটা বের করল। ওর মধ্যে মুড়ি ও খেজুর পাটালি রাখা আছে। মুখ খুলে বন্ধুদের সামনে মেলে ধরল।
মুড়ি-পাটালি মুখে দিল সবাই। সবার কাছেই অমৃতের মতো লাগতে লাগল। আসলে সবারই বেশ ক্ষিধে পেয়েছিল কি না!
‘আমাকে কেন ডেকেছ ভাইয়া?’ ভেতরে ঢুকে বলল জেসমিন। ‘আমি তো এখন পড়তে বসব। আম্মু এসে যদি দেখে আমি এখনও পড়তে বসিনি, তাহলে খুব রাগ করবে।’
‘আজ না স্কুল ছুটি দিয়েছে এক মাসের।’ বলল হিমেল। ‘এখন অত না পড়লেও তোমার আম্মু কিছুই বলবেন না।’
‘অ্যাঁ!’ মুখটা বিশেষ ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে নিল জেসমিন। ‘তুমি আমার আম্মুকে চেন নাকি? পড়া ফাঁকি দেয়া আমার আম্মু একদমই পছন্দ করেন না।’
বিপ্লব বলল, ‘না আপু, আমরা এক্ষুনি পড়তে বসব। শুধু একটা প্রশ্নের জবাব শুনতে চাচ্ছে যে সবাই!’
‘তাড়াতাড়ি প্রশ্নটা করে ফেল। ওই শোনো, আজান দিচ্ছে।’
‘এই চিঠিটা তোমাকে কে দিয়েছিল জেসমিন?’ জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।
‘আমি তো লোকটাকে চিনি না। ইয়া লম্বা টিংটিঙে লোকটা। হাঁটলে মনে হয় দু’হাঁটুতে বাড়ি খাচ্ছে। মাথায় লাল একটা ক্যাপ পরা ছিল। কান আর চোখের অনেক খানিকই ঢেকে গিয়েছিল তাতে। আমাকে বলল, ‘এই যে খুকি, শোনো।’ আমি বললাম, না, আমি এখন আপনার কথা শুনতে পারব না। আমার ভাইয়ার ভীষণ মাথা যন্ত্রণা করছে। আম্মু বাড়ি নেই তো, তাই তেল-পানি মাথায় দিতে পারছেন না। সেজন্য আমি এসেছি ডিসপিরিন কিনতে। এটা খেলেই ভাইয়ার মাথা যন্ত্রণা সেরে যাবে। তাই শুনে লোকটা বলল, ‘ঠিক আছে, আমিই তোমাকে ডিসপিরিন কিনে দিচ্ছি।’ বলে লোকটা আমাকে ওষুধ কিনে দিল। টাকা দিতে চাইলাম। প্রথমে নিতে না চাইলেও পরে নিল। তখন আমার হাতে কাগজটা গুঁজে দিয়ে বলল, ‘তোমার বিপু ভাইয়াকে এটা দিও’।’ এতগুলো কথা একসাথে বলে হাঁফিয়ে উঠল জেসমিন। হা করে দম নিতে লাগল। তারপর ‘একটা প্রশ্ন শেষ’ বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
জেসমিন চলে গেলেও কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। শেষে হিমেল বলল, ‘কী বলে গেল ও ওসব?’
‘ও তো অন্য কোনো ভাষায় কথা বলেনি, তাই না!’ বলল মামুন। ‘তুমি যা শুনেছ, আমরাও তাই শুনেছি। বিষয়টা নিশ্চয়ই বিপু ধরতে পেরেছে, তাই না!’ তাকাল বিপ্লবের দিকে।
বিপ্লব একটু নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘তোমাদের মতো বিষয়টা আমার কাছেও পরিষ্কার না। লোকটার যে বর্ণনা জেসমিন দিল, তাতে ওরকম কোনো লোকের সাথে আমার চেনা-জানা আছে বলে মনে পড়ছে না।’
‘কী করবে এখন?’ রাসেল মাহফুজের জিজ্ঞাসা। আসলে ও চাচ্ছে বিষয়টার একটা তদন্ত করতে। রহস্যের গন্ধ পেয়েছে কি না!
রহস্যের গন্ধ বিপ্লব খানও পেয়েছে। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে চিঠির রহস্য উদ্ধার করতেই হবে। এখন বুঝল বন্ধুরাও সেটাই চাচ্ছে। কাজেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারল। বলল, ‘রোজার একমাস ছুটি আছে। স্কুল তো নেই-ই, পড়াশোনারও তেমন চাপ থাকবে না। কাজেই আমরা রহস্যটা নিতে পারি, কী বলো?’ সমর্থনের আশায় প্রত্যেকের মুখের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
রাসেল মাহফুজ বলল, ‘তোমার সাথে কোনো কেসের সঙ্গী হওয়ার সুযোগ আমি একদমই হাতছাড়া করতে চাই না।’
‘আমিও না।’ পূর্ণ সমর্থন জানালো মামুন।
হিমেল একটু আমতা আমতা করতে লাগল, ‘কোনো বিপদ হবে না তো? মানে লোকটা যদি ডেঞ্জারাস হয়?’
‘নাহ্, তোমাকে ঠিক গোয়েন্দা বিপু ভাইয়ার বন্ধু হিসেবে বানাচ্ছে না।’ কথাটা বলল রাসেল। ‘ওর মতো একজন নামকরা দুঃসাহসী কোনো গোয়েন্দার বন্ধু এমন ভীতু হবে, এটা একেবারেই মেনে নেয়া যায় না।’
বিপ্লব বলল, ‘আরে না না, হিমেল একেবারেই ভয় পাচ্ছে না।’ হিমেলের পক্ষ নিল ও। ‘ও আসলে বাজিয়ে দেখছে আমরা ভয় পাচ্ছি কি না। কি, তাই না হিমেল?’ ওর দিকে তাকিয়ে সবার অলক্ষ্যে চোখ টিপল।
হিমেল কোঁত করে একটা ঢোক গিলে জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই।’
‘তাহলে আর কি,’ ঘোষণা করল বিপ্লব। ‘নতুন একটা কেসের সমাধান করতে যাচ্ছি আমরা।’
‘হুররে..!’ চিল্লিয়ে উঠল রাসেল মাহফুজ ও মামুন একসাথে। শেষে হিমেলও গলা মেলালো, ‘হুররে!’ কেমন বেখাপ্পা শোনাল ওর কণ্ঠ।
‘প্রথম কাজ হচ্ছে একজন দলনেতা ঠিক করে নেয়া।’ বলল বিপ্লব সবাই থামলে।
রাসেল মাহফুজ বলল, ‘এখানে আবার দলনেতা ঠিক করার কী আছে। তুমিই আমাদের দলনেতা, গোয়েন্দাপ্রধান।’ সমর্থনের আশায় অন্যদের দিকে তাকাল।
সবাই ওকে সমর্থন জানাল।
‘ঠিক আছে,’ বলল বিপ্লব। ‘তাহলে এখনই দলনেতার কাজ শুরু হয়ে যাক। যাও, সবাই ওজু করে এসো। আমরা একসাথে জামাত করে মাগরিবের নামাজ পড়ব।’

তিন.
সবাইকে বিদায় দিয়ে চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল বিপ্লব। মাথা যন্ত্রণার রেশ এখনও হালকা রয়ে গেছে।
জেসমিন প্রবেশ করল। ভাইয়ার সাথে পড়তে বসবে।
বিপ্লব বলল, ‘আপু মণি, আজ কিন্তু তোমাকে একা একাই পড়তে হবে।’
জেসমিন বলল, ‘তোমার মাথা ব্যথা এখনও সারেনি ভাইয়া?’
‘এখনও পুরোপুরি সারেনি। দেখলে না, মামুনরা এসে কেমন জ্বালাতন করল!’
‘তুমি তাহলে রেস্ট নাও। আমি একা একাই পড়ছি।’ বলে বই খুলে বসে গেল বিপ্লবের ছোট বোন জেসমিন।
একটু পর মা ফিরলেন। রুমে উঁকি দিয়ে দেখলেন। বিপ্লবকে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, শরীর খারাপ করছে?’
আস্তে করে জবাব দিল বিপ্লব, ‘হ্যাঁ মা, মাথাটা একটু ধরেছিল। এখন কমে গেছে।’
‘তেল-পানি ফাটিয়ে মাথায় ডলে দেব?’
‘না থাক, লাগবে না। একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে, পড়তে ইচ্ছে না করলে আজ আর বই নিয়ে বসার দরকার নেই।’ বলে চলে গেলেন মা।
বিপ্লব চাইল কিছুটা সময় কিছুই ভাববে না ও। কিন্তু মানুষ বোধহয় এক মুহূর্তও কিছু না কিছু না ভেবে থাকতে পারে না। কোনো সময় ফাঁকা থাকে না মন। এই যেমন এখন শত চেষ্টা করেও ও আজকের ঘটনাগুলো মন থেকে দূরে রাখতে পারল না। যতই চেষ্টা করল, ততই যেন হুমড়ি খেয়ে সামনে এসে হাজির হতে লাগল। তাই মাথার যন্ত্রণার কথা বাদ দিয়ে আপাতত ওসব নিয়েই ভাবতে লাগল। শূন্য দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ভেবে চলল ও।
মামুনদেরকে তো সে সময় বলল যে চিরকুটের ওই লেখাটার ব্যাপারে তদন্ত করবে ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু এগোবে কী করে? সূত্র কোথায়?
দ্বিতীয়ত, আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করেই লাল মাইক্রোটা ওর সামনে এসে দাঁড়ায় এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই খোলা দরোজা দিয়ে ওকে ভেতরে টেনে নেয়া হয়। তারপর চলতে শুরু করে। অনেক জিজ্ঞেস করেও প্রথমেই ওকে ওভাবে তুলে নেয়ার কারণ জানতে পারেনি। অবশেষে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় ওকে। সেখানে লোকটা ওকে তুলে নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন। লোকটা তার পরিচয় দিয়েছেন এভাবেÑ ‘আমার নাম নাজমুল হাসান। পেশায় একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। একটা বেসরকারি ফার্মে আছি। তিন ভাইবোন আমরা। দুই ভাই এক বোন। আমি সবার বড়। আমার পরে মিজানুল হাসান, আমার ভাই এবং সবার ছোট আমাদের বোনটি। বিয়ে হয়েছে বছর চারেক হবে। মিজানুলকে আপাতত বেকারই বলা চলে। একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেছে বছর খানেক। ভালো লাগেনি বলে ছেড়ে দিয়েছে। এখন বাড়িতেই থাকে। আমার বাবা এখনও জীবিত থাকলেও মা মারা গেছেন অনেক আগেই। বাবা রিটায়ার্ড ব্যাংকার। এক ছেলে এক মেয়ে আমার। ওরা স্কুলে পড়ে। ওদের মা একটা কিন্ডার গার্টেনে চাকরি করে।’
একটু থামেন নাজমুল হাসান। এই সময় বেয়ারা এসে দু’টো লাচ্ছি দিয়ে যায়। অন্য কিছু নিতে রাজি হয়নি বিপ্লব। গরমের ভেতরে লাচ্ছিটা বেশ লাগবে বলেই এটা অর্ডার দেয়া হয়েছে।
লাচ্ছির গেলাসটা সামনে নিয়ে স্ট্র দিয়ে নাড়তে লাগলেন নাজমুল হাসান। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
বিপ্লব বলল, ‘মূল কথাটা এখনও কিন্তু বলেননি।’
সম্বিৎ ফিরে পেলেন ভদ্রলোক। মাঝারি বয়সের মানুষ তিনি। কিন্তু দেখলে মনে হবে প্রায় পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ। অত্যধিক চিন্তায় এ অবস্থা হয়েছে বলে ধরে নেয় বিপু। চেহারায় কেমন হতাশার একটা ছাপ যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বিপ্লবের কাছে কেন যেন মনে হতে লাগল লোকটা একসময় বেশ আশাবাদী ছিলেন। বাইরের এই চেহারাটাই তার আসল চেহারা না। ভেতরে ভেতরে কোনো একটা কিছু ঘটে যাচ্ছে। মূলত সে বিষয়টাই তাকে এমন বুড়িয়ে তুলেছে।
‘ও হ্যাঁ,’ বললেন আবার। ‘কী যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, ভালোই চলে যাচ্ছিল আমাদের সংসার। বাবা রিটায়ার্ড করলেও মাস ছয়েক অন্য একটা কোম্পানিতে ক্যাশিয়ারের কাজ করেছেন। এখন বাড়িতেই থাকেন। আমার ছেলেমেয়ে দু’টোকে দেখাশোনা করেন। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের কোনো টাকাই আমরা তুলিনি। ওটা তোলার প্রয়োজনও হয়নি। বাবার ইচ্ছা, তিনি ওই টাকা দিয়ে আমাদের মহল্লায় একটা মসজিদ বানাবেন। প্রতিদিন বেশ দূরেই তাকে নামাজ পড়ার জন্য যেতে হয়। বাজারের ওখানেই আমাদের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদটা। বাবা অবশ্য ওই টাকার একটা অংশ দিয়ে আরো একটা কাজ করতে চেয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন তিনি। অন্য কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু...’
‘এক সেকেন্ড,’ নাজমুল হাসানকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল বিপ্লব। ‘আপনি সব অতীত কাল যোগ করে কথা বলছেন। তার মানে টাকাটার অথবা আপনার আব্বার কোনো...’
বিপ্লবকেও কথা শেষ করতে দিলেন না ভদ্রলোক, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছো। তবে অথবা বললে ভুল হবে। কারণ আমার বাবা এবং টাকাÑ দু’টোই এখন আমার চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। না না, বাবা এখনও জীবিত আছেন। তবে কেমন জীবিত আছেন, সেটা তুমি আমাদের বাড়িতে গেলেই দেখতে পারবে।’
‘তার মানে টাকাটা উনার হাতছাড়া হয়ে গেছে এবং তাতে উনি খুব ভেঙে পড়েছেন, এই তো বলতে চাচ্ছেন আপনি?’
‘প্লিজ বিপু ভাইয়া,’ বিপ্লবের কথার কোনো জবাব না দিয়েই অনেকটা অনুনয় করে বললেন নাজমুল হাসান। ‘বলো তুমি কেসটা হ্যান্ডেল করবে!’
‘আমাকে একটু ভাবার সময় দিতে হবে।’ এতক্ষণ যা শুনলো তাতে বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে। কেসটা নেয়ার যথেষ্ট কারণও ও দেখতে পাচ্ছে। তারপরও নিজের ভারত্ব প্রকাশ করার জন্য কথাটা বলল বিপ্লব। আসলে ও তো একপ্রকার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে যে কেসটা ও নিচ্ছে।
‘আমি বড় আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। প্লিজ! এই উপকারটুকু আমাকে করো। আমি বড় কোনো ডিটেকটিভের কাছে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি চাই না ব্যাপারটা বেশি জানাজানি হোক।’
‘কিন্তু সেটা তো আমি তদন্ত করলেও হতে পারে।’
‘তোমাকে আমার ভরসা আছে। আমার এক বন্ধু তোমার কথা বলেছে আমাকে। তার একটা কাজ তুমি করে দিয়েছিলে।’
বিপ্লব কিছু যেন ভাবতে লাগল।
নাজমুল হাসান আবার বললেন, ‘এই কার্ডটা রাখো। এতে আমার বাড়ির ঠিকানা আছে। কাল আমি সারাদিন বাড়িতেই থাকব। একবার এলে খুব খুশি হবো। আর আমার বিশ্বাস, ওখানে একবার এলে তুমি অবশ্যই কেসটা তদন্ত করতে রাজি হবে।’
কথা আর বেশিদূর এগোয়নি। এরপর রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে ওকে ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় লোকটা।
ঘটনাটা মামুনদেরকে বলা হয়নি। আসলে ওরা এমনভাবে এলো, আর এমনভাবে কথাবার্তা শুরু করল, তাতে বিষয়টা একদমই মনে ছিল না। আর তাছাড়া জেসমিনের নিয়ে আসা ওই নিষেধাজ্ঞামূলক বাক্য লেখা কাগজটাও ওকে ভুলিয়ে রেখেছিল নাজমুল হাসানের কেসটা। আরেকটা কারণ ছিল মাথা যন্ত্রণা।
কিন্তু আগে কোন্টা নিয়ে এগোবে ও? সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিল কাল সকালে আগে নাজমুল হাসানের বাড়িতে যাবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। চিঠির লেখককে ও মুরগিচোরকে খুঁজে বের করার কাজটা পরে করলেও চলবে।
পাশ ফিরে শুলো বিপ্লব। মাথাটা এখন বেশ হালকা লাগছে। চিন্তাগুলো সরে যাচ্ছে মগজ থেকে। শূন্য হয়ে যাচ্ছে বোধহয়।
ওভাবে থাকতে থাকতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

চার.
মোড়ের গ্যারেজ থেকে বাই সাইকেলটা নিল বিপ্লব। কারিগর দুইদিন লাগিয়ে দিয়েছে মেরামত করতে। গত পরশু স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তায় উঁচু হয়ে থাকা একটা ইটের সাথে ঢাক্কা লাগায় ছিটকে পড়ে ও সাইকেল নিয়ে। ওর তেমন কোনো সমস্যা না হলেও সাইকেলে গলার কাছ থেকে রডটা মচকে যায়। আরো টুকটাক ক্ষতি হয়। সেটা সারতেই দুইদিন।
পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ডটা বের করে ঠিকানাটা দেখে নিল ভালো করে। মনে মনে কয়েকবার আওড়িয়ে মুখস্থ করে নিল। তারপর কার্ডটা পকেটে ফেলে সাইকেলের ছিটে উঠে বসল। প্যাডেলে চাপ দিল।
মূল শহরের মাঝখানটাতেই নাজমুল হাসানের বাড়ি। দো-তলা বিল্ডিংয়ের চারদিক দিয়ে গলা সমান প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরের প্রায় গা-ঘেষেই মূল বিল্ডিং। সবুজ রঙের গেটটাতে কোনো গার্ড চোখে পড়ল না বিপ্লবের।
গেটের সামনে সাইকেল দাঁড় করাল ও। চারপাশটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বেশ নীরব। এই সময়টাতে অধিকাংশ বাড়িঘরই নীরব থাকে। কেননা, সবাই স্কুল-কলেজ বা চাকরি ও ব্যবসাক্ষেত্রে চলে যায়।
পকেট থেকে আবারও কার্ডটা বের করে বাড়ির নম্বরের সাথে মিলিয়ে নিল। হ্যাঁ, এটাই।
ওই তো কলবেলটা দেখা যাচ্ছে। গোল প্লাস্টিকের বাটির মতো প্লেটটার মাঝখানে লাল সুইচটা সহজেই চোখে পড়ে। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ডান হাতের শাহাদাত আঙুল দিয়ে চাপ দিল। ভেতরে কোথাও মিষ্টি একটা আওয়াজ যেন উঠল।
একটু পেছনে সরে এলো ও। প্রায় সাথে সাথে সবুজ গেটের ওপাশে মূল বিল্ডিংয়ের কাঠের দরোজাটা খুলে গেল। অবশ্য কিছুই দেখতে পেল না বিপ্লব। শুধু শব্দ শুনে বুঝল।
বিশ সেকেন্ডের মধ্যে খুলে গেল গেটটা। যেন প্রস্তুতই ছিলেন বাড়ির মালিক।
‘আমি জানতাম তুমি অবশ্যই আসবে।’ হাসিমুখে বললেন নাজমুল হাসান। এই মুহূর্তে তার গায়ে হালকা গোলাপি কালারের একটা ফতুয়া। পরনে লুঙ্গি। ‘এসো, ভেতরে এসো।’
সাইকেলটা উঁচু করে ঠেলে নিয়ে পকেট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল বিপ্লব।
‘এখানেই রাখতে পারো সাইকেলটা।’ বললেন নাজমুল হাসান।
একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে সাইকেল রাখল বিপ্লব। পেছনের তালা এঁটে চাবিটা খুলে প্যান্টের পকেটে রাখল। বলল, ‘ভেতরে প্রবেশ করার আগে আমি বাড়ির চারপাশটা একবার ঘুরে দেখতে চাই, যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।’
‘ও শিওর শিওর। আমার আপত্তি থাকবে কেন? এসো।’ বলে আগে আগে চললেন ভদ্রলোক।
চারপাশে দেখার আসলে তেমন কিছুই নেই। সীমানা প্রাচীর আর মূল ভবনের মাঝে জায়গা হবে পাঁচ থেকে ছয় ফুট। জায়গাটা খালিই পড়ে আছে। ও হ্যাঁ, প্রচুর ময়লা জমে আছে জায়গাটুকুতে। বেশিরভাগই গাছের পাতা আর ছেড়া-টুকরো কাগজ।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বিপ্লবের মনে হলো তৃতীয় কেউ একজন যেন পেছনে এসে দাঁড়াল। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল। একটা ছায়া যেন দ্রুত দেয়ালের ওপাশে সরে গেল। ভ্রƒজোড়া একটু কুঁচকে উঠল ওর। তারপর স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনল।
‘কয়টা রুম আছে বাড়িতে?’ জানতে চাইল বিপ্লব।
‘নিচ তলায় পাঁচটা, আর উপর তলায় চারটাÑ মোট নয়টা রুম।’ জবাব দিলেন নাজমুল হাসান।
‘বাড়িতে কোনো ভাড়াটিয়া থাকে বলে তো মনে হচ্ছে না।’
‘না, বাবা কোনো ভাড়াটে রাখার পক্ষে না। অবশ্য উপর তলায় দু’টো রুম ফাঁকাই পড়ে থাকে। মেহমানরা এলে তখন থাকে।’
‘আচ্ছা এবার ভেতরে চলুন।’ কাঠের দরোজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে জিজ্ঞেস করল আবার, ‘আপনার আব্বা নিশ্চয়ই নিচ তলায় থাকেন?’
‘হ্যাঁ,’ মাথা নেড়ে বললেন ভদ্রলোক। ‘বাবার পাশের রুমটাই আমার ছেলেমেয়েদের। ডানে রুমটাতে আমরা থাকি। নিচ তলাতে বাকি দু’টো রুমের একটা কিচেন ও একটা ড্রয়িং রুম।’
‘তার মানে আপনার ভাই উপরের তলাতে থাকেন।’ নিচের ঠোঁটে দাঁত দিয়ে একটা চিমটি কেটে আবার ছেড়ে দিল বিপ্লব।
‘হ্যাঁ। একটা রুম স্টোররুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আর দু’টো খালি থাকে তা তো বলেইছি।’
কথা বলতে বলতে ড্রয়িং রুমে চলে এসেছিল ওরা, অন্তত রুমের আসবাবপত্র দেখে সেটাই অনুমান করল বিপ্লব। দুই সারি লাল সোফাসেট সাজানো। মাঝখানে বেশ বড়সড় একটা টি-টেবিল। সোফাসেটের কোনায় ফুলদানিতে প্লাস্টিকের রঙিন ফুল।
‘বসো।’ বলে নিজেও বসলেন সোফায় নাজমুল।
বিপ্লব একেবারে মুখোমুখি না বসে একটু সরে গিয়ে একটা সোফায় বসে পড়ল। আর ইচ্ছে করলেও মুখোমুখি বসা যাবে না, কারণ সোফাগুলো অনেকটা এল আকৃতিতে সাজিয়ে রাখা। বিপ্লব যেখানটাতে বসেছে, সেখান থেকে বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশের দরোজাটা পুরোটাই নজরে পড়ে।
‘আপনার বাবা সম্পর্কে বলুন। কোন্ ঘরটাতে থাকেন তিনি?’ সামনে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর গোয়েন্দা।
‘বাবা ওই রুমটাতে থাকেন।’ বিপ্লবের ডানের রুমটা দেখিয়ে বললেন তিনি। ‘এখন ঘুমাচ্ছেন। উঠে পড়বেন শীঘ্রই। তখন তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। অবশ্য পরিচয় করানো না করানো সমান এখন, উনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। কাউকে ভালোমতো চিনতেও পারেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন খালি।’
‘কবে থেকে এটা শুরু হয়েছে?’
‘টাকাটা যেদিন হাতছাড়া হয়ে যায়, তার পরদিন থেকেই।’
‘টাকাটা আসলে কিভাবে হাতছাড়া হয়? মানে বলতে চাচ্ছি, আসলে ঠিক কী ঘটেছিল?’
নাজমুল হাসান একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন, ‘মসজিদের কাজটা বাবা খুব দ্রুতই শুরু করতে চাচ্ছিলেন। কেন জানি না, তিনি একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছিলেন। তাই আমিও চাচ্ছিলাম কাজটা এবার শুরুই করা যাক। বলা তো যায় না কখন কী হয়ে যায়! বাবার বয়সও হয়ে গেছে কি না! আজ থেকে পাঁচদিন আগে, সকালে আমি অফিসে যাব বলে বের হচ্ছি। কান্তা ও সাজিদকে গুছিয়ে নিয়ে ওদের মা-ও রেডি। আমিই প্রতিদিন ওদেরকে ড্রপ করে দিই। দরোজা পর্যন্ত চলে গেছি, এই সময় বাবা ডাকলেন তার রুম থেকে, ‘নজি, আমাকে বাবা নজি বলেই ডাকেন। তো তিনি ডেকে বললেন, নজি, একবার এদিকে এসো তো।’ আমি বাবার ঘুরে গেলাম। বাবা বললেন, ‘চেকটা নিয়ে যাও। মিস্ত্রিকে আমি বলে রেখেছি। আগামী সপ্তাহেই কাজে লেগে যাবে ওরা। তুমি এক ফাঁকে টাকাটা তুলে রেখো। কাল সকালে আব্বাস আসবে। ইট বালি সিমেন্ট রড যা লাগে, ওই কিনে আনবে।’ আমি চেকটা নেয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। বাবা আলমারির মধ্যে হাত ঢোকালেন চেকটা বের করার জন্য। আমি বললাম, ‘কই বাবা, চেকটা দাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদেরও দেরি হচ্ছে।’ কিন্তু বাবা তখনও হাতড়ে  চলেছেন ভেতরে। সম্ভবত ওটা খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি আবার বললাম, ‘তাহলে বাবা আজ থাক, তুমি খুঁজে রেখ, আমি কাল যাওয়ার সময় নিয়ে যাব।’ বলে ঘুরে দাঁড়ালাম। হঠাৎ পেছনে বাবা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘নজি, সর্বনাশ হয়ে গেছে!’ আমি ফিরে তাকালাম। বললাম, ‘বাবা কী হয়েছে?’ বাবা বললেন, ‘চেকটা চুরি হয়ে গেছে।’ আমি বাবাকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘কী বলছ বাবা! চেক কে চুরি করবে? কোথায় রেখেছ তা হয়তো তুমি ভুলে গেছ। ঠিক করে খোঁজো, ঠিকই পেয়ে যাবে। আর না পেলে থাক, বিকেলে তোমার বউমা এসেই খুঁজে দেবে।’ বাবা এবার আরো জোরে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘নর্বনাশ হয়ে গেছেরে নজি, সর্বনাশ হয়ে গেছে! আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।’ বাবা এরপর ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমিও যেন কেমন হয়ে গেলাম। ওদিকে ওদের মা ডাকছে, তাড়াতাড়ি যেতে বলছে। কিন্তু কী করব তা ভেবেই পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করে বাবা ঘুরে পড়ে গেলেন। দ্রুত ধরলাম তাকে। বাইরে থেকে বাচ্চারা ও ওদের মাও ছুটে এলো। ধরাধরি করে বাবাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো। অনেক চেষ্টার পর তার জ্ঞান ফেরানো হলো। সেদিন আর আমাদের বাইরে যাওয়া হলো না। আমি আমার অফিসে ফোনে জানিয়ে দিলাম। সাজিদের মা ওর স্কুলে এবং বাচ্চাদের স্কুলে ফোন করল।’
এতগুলো কথা একবারে বলে হাঁফিয়ে উঠলেন নাজমুল হাসান। এই সময় রুমে প্রবেশ করলেন একজন ভদ্রমহিলা। কে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল বিপ্লব।
ভদ্রমহিলা একটা ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এসেছেন। দুধ দিয়ে লাচ্ছি সেমাই রান্না আর কুচি করে কাটা আম। দু’টোই বিপ্লবের প্রিয়। টি-টেবিলে রাখলেন ট্রেটা। তারপর স্বামীর পাশে বসলেন।
নাজমুল হাসান বললেন, ‘তুমি আসবে সেটা বলতেই ও আর স্কুলে যায়নি আজ। নাও, একটু মুখে দাও।’
‘আপনারাও নেন।’ বলল বিপ্লব।
তিনটে পিরিচে করেই সেমাই আনা হয়েছে। কেবল আম একটা পিরিচে। কাজেই তারাও সেমাইয়ের পিরিচ হাতে উঠিয়ে নিলেন।
‘বাচ্চাদের তো দেখছি না, ওরা কোথায়?’ এক চামচ সেমাই মুখে পুরে গিলে নিয়ে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল গোয়েন্দা বিপ্লব।
‘ওদেরকে কি আর ঘরে ধরে রাখা সম্ভব? কাল স্কুল ছুটি হতেই ছোট মামাকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে আজ যেন এসে নিয়ে যায়। সকালেই চলে আসে ওদের ছোট মামা। ওরা তার সাথেই মামাবাড়ি গেছে।’ জবাবটা দিলেন ভদ্রমহিলা।
এরপর সেমাইটা শেষ করার আগে আর কোনো কথা বলল না কেউ। পানি খেয়ে গেলাস নামিয়ে রেখে বিপ্লব বলল, ‘হুঁ, তারপর কী হলো?’
পানির গেলাস নামিয়ে রাখলেন নাজমুল হাসানও। বললেন, ‘তারপর...’ তার কথার মাঝেই কলবেলটা বেজে উঠল। ‘আমি দেখছি,’ বলে উঠে গেলেন তিনি।
‘যেটুকু শুনলে,’ বললেন ভদ্রমহিলা। ‘তাতে কী মনে হয় তোমার, এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে?’
‘ম্যাডাম, আগে সবটা শুনতে চাই আমি। এরপর বোঝা যাবে এর পেছনে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে কি না।’ কাঁটা চামচে গেঁথে আমের একটা টুকরো গালের মধ্যে চালান করে দিল বিপ্লব। ওফ্! বেশ মিষ্টি।
চোখ বুজে ফেলেছিল বিপ্লব। চোখ খুলতেই নতুন কারোর উপস্থিতি টের পেল রুমে। দরোজার দিকে দৃষ্টিটা আছড়ে পড়ল। দরোজার প্রায় সমান লম্বা লোকটার দেহ। মাথায় একটা কানঢাকা টুপি। তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলেন নাজমুল হাসান। আগের জায়গায় বসতে বসতে আগন্তুকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘আমার ভাই, মিজানুল হাসান। আর মিজু, ও হচ্ছে বিপ্লব খান ওরফে গোয়েন্দা বিপু ভাইয়া।’
এই কথা শুনে মিজানুল হাসান নামের লোকটার ভ্রƒজোড়া বোধহয় কিছুটা কুঁচকে উঠল। কিন্তু মাথায় টুপি থাকার কারণে ঠিক ধরতে পারল না বিপ্লব। তবে লোকটাকে ততটা ভালো লাগল না।

পাঁচ.
‘নাইচ টু মিট ইউ।’ বলে হাত বাড়িয়ে দিল বিপ্লব।
কিছুটা দ্বিধা করল মিজানুল। তবে হাত বাড়িয়ে দিল। বলা যায় বিপ্লবের হাতের আঙুলের সাথে নিজের হাতের আঙুলগুলো ছুঁইয়ে নিল শুধু।
‘হঠাৎ বাড়িতে গোয়েন্দা কেন ভাই?’ জিজ্ঞেস করল মিজানুল।
নাজমুল জবাব দিলেন, ‘বাবার বিষয়টা একটু তদন্ত করার জন্য আমিই ওকে আসতে বলেছি।’
‘বাবার বিষয়টা তদন্ত করা মানে?’ যেন অবাক হলো মিজানুল। ‘ওটা নিয়ে আবার তদন্ত করার কী আছে?’
‘না মানে,...’
‘না না ভাই, আমাদের বাড়ির ব্যাপারে বাইরের কারো নাক গলানো একদমই ঠিক না। ওকে তুমি যেতে বলো। আমাদের গোয়েন্দার কোনো দরকার নেই।’ ভীষণ অসন্তুষ্ট দেখালো মিজানুলকে।
‘আপনি আসলে বুঝতে পারছেন না...’ কথা বলতে চেষ্টা করল বিপ্লব।
ওকে থামিয়ে দিল মিজানুল, বলা যায় ধমকে উঠল, ‘তুমি থামো খোকা। আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে তুমি নাক গলানোর কে? যাও, ভাগো!’
নিজেকে খুবই অপমানিত লাগল বিপ্লবের। তারপরও বসে রইল। এই লোকটার কথায় তো আর ও আসেনি। নাজমুল হাসান ওকে আসতে অনুরোধ করেছেন। উনি যেতে বললেই কেবল যেতে পারে ও। বলল, ‘দেখুন, আপনি আমাকে...’
এবারও ওকে কথা শেষ করতে দিল না মিজানুল। বলল, ‘আবার মুখে মুখে কথা বলছ কেন? আর এখনও কেন বসে আছো? ভাগো বলছি।’ সামনে এগিয়ে গেল সে। মনে হলো বিপ্লবকে জোর করে উঠিয়ে বাইরে বের করে দেবে।
উঠে দাঁড়াল বিপ্লব। চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছে ও। এরপরও আর বসে থাকা যায় না। নাজমুল হাসানের বলার অপেক্ষা করল না আর। ‘এভাবে আমাকে ডেকে এনে অপমান করার কোনো মানেই হয় না।’ কথাটা নাজমুলকে উদ্দেশ্য করে বলল বিপ্লব। ‘নাজমুল হাসান সাহেব, আপনিই আমাকে জোর করেছিলেন আসতে। আগে জানলে আমি আসতাম না। চলি।’
বলে গটগট করে বের হয়ে গেল খোলা দরোজা দিয়ে।
নাজমুল হাসান উঠে দাঁড়ালেন। কিছু বলতে চাইলেন। মিজানুল হাসান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আহ্ ভাই, ওকে যেতে দাও। আমি চাই না আমাদের পারিবারিক ব্যাপার অন্য কেউ জেনে যাক।’
বিপ্লবের মনটাই তেতো হয়ে গেল। ধুর! এভাবে যেচে পড়ে এসে অপমানিত হওয়ার কোনো মানেই হয় না।
বাই সাইকেলের তালা খুলে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে ঘুরিয়ে বের করতে যাবে গেট দিয়ে, এই সময় চোখে পড়ল জিনিসটা। ব্রেকের সাথে বাঁধিয়ে রাখা দু’ভাঁজ করা একটা কাগজ। ব্রেক চেপে আলগা করে কাগজটা খুলে নিল। ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল। এলোমেলোভাবে লেখাÑ বিষয়টাতে নাক গলাতে নিষেধ করেছিলাম। কানে নাওনি। এখনও সময় থাকতে মানে মানে সরে পড়ো। নইলে পস্তাবে।
মুখটা থমথমে হয়ে গেল ওর। বুঝতেই পারছে, গতকাল জেসমিনকে যে সাবধান বাণী সম্বলিত চিঠিটা দিয়েছিল, সেই একই ব্যক্তি এই চিঠিটা লিখেছে। চারপাশটা একবার দেখে নিল। পেছনে তাকাল। নাজমুল হাসানের দরোজার ওপাশে যেন কেউ সরে গেল। এতক্ষণ ওর উপরেই চোখ রেখেছিল হয়তো।
ক্ষণিকের মধ্যেই মুখটা কঠিন হয়ে উঠল ওর। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, কেসটার তদন্ত করবে ও, যদি এই হুমকির বিষয়টা এই ঘটনার সাথে রিলেটেড হয়। একটু আগে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটা বাতিল করে দিল। ও বিশ্বাস করে, যে কাজে বাঁধা বেশি আসে, সেটাতে কাজ করে মজাও বেশি পাওয়া যায়।
আরেকবার খোলা দরোজাটার দিকে তাকাল। নাজমুল হাসান দাঁড়িয়ে আছেন। অনুনয় ঝরে পড়ছে তার চোখেমুখে। ঠোঁট টিপে একটু হাসল বিপ্লব। দ্রুতই আবার তাদের সাথে দেখা হচ্ছে, নিশ্চিত হয়ে নিল ও। শার্টের বুক পকেটে হাত বুলাল। ভিজিটিং কার্ডটা ওখানেই আছে।
তারপর মূল গেট খুলে সাইকেল বের করে তাতে চেপে বসল।
অল্প একটু এগিয়েছে ও, এই সময় আরো দু’টো সাইকেল এসে ওকে ঘিরে ধরল। প্রথমটায় একটু থমকালেও পরক্ষণই মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। একটি সাইকেলে হিমেল এবং অন্য সাইকেলে মামুন ও রাসেল।
‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’ জিজ্ঞেস করল মামুন। ‘আমরা সেই থেকে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাই না।’
‘আমাদের না একটা কেসের তদন্ত করার কথা!’ বলল হিমেল।
বিপ্লব শান্ত রইল। মিটিমিটি হাসছে ও। বলল, ‘চলো, কোথাও বসি। তারপর কথা বলি।’
আশেপাশে বসার মতো জায়গা খুঁজল ওরা। কিছুটা তফাতে ছোট্ট একটা দিঘি মতো দেখতে পেল। আগে কখনও এদিকে আসেনি বিপ্লব। তাই এটা ওর কাছে নতুন। ওটাকেই বসার জায়গা হিসেবে বেছে নিল। অন্যদের বলতে ওরাও রাজি হয়ে গেল।
পাশে সাইকেল তিনটে দাঁড় করিয়ে রেখে জীবন গাছটার নিচে পা ছড়িয়ে বসল ওরা।
‘এবার ঝেড়ে কাঁশো তো বিপু।’ শুরু করল মামুন। ‘কোথায় গিয়েছিলে সাত সকালে আমাদেরকে কিছু না জানিয়ে?’
সংক্ষেপে সবকিছু জানাল ওদেরকে বিপ্লব। এই কেসটায় ওদের সহযোগিতা লাগতে পারে। তাই গতকাল মাইক্রোতে ওকে উঠিয়ে নেয়া থেকে শুরু করে একটু আগ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবই বলল। শেষে বলল, ‘এই কেসে তোমাদের সহযোগিতা লাগতে পারে। তাই সব সময় রেডি থাকবে।’
হিমেল বলল, ‘এরপরও তুমি কেসটা তদন্ত করবে?’
মামুন বলল, ‘মিজানুল হাসানের এই আচরণের পর ওটা নিয়ে আর একেবারেই নাক গলানো ঠিক না। তাই না!’
বিপ্লব নীরবে ওদের দু’জনের কথা শুনল। এবার তাকাল রাসেল মাহফুজের দিকে। আগেই তো জেনেছে ও-ও ছোট খাটো দুয়েকটা কেসের তদন্ত করেছে। ও নিশ্চয়ই নেগেটিভ মত দেবে না বলে ওর বিশ্বাস।
ওকে সত্যিই নিরাশ করল না রাসেল। বলল, ‘তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ বিপু। কেসটা থেকে এখন আর সরে আসার কোনোই উপায় নেই। বিশেষ করে সাইকেলের ব্রেকে আটকে রাখা হুমকি দিয়ে লেখা চিরকুটটা পাওয়ার পর।’
‘তু-তুমি ওকে সমর্থন করছ?’ অবাক হলো মামুন।
বিপ্লব বলল, ‘রাসেল মাহফুজ তো তোমাদের মতো ভীতুর ডিম না। কে না কে হুমকি দিয়ে একটা চিরকুট লিখে রাখল, আর তাতে আমরা লেজ গুটিয়ে পালাব, এটা কেন হবে? বরং একটা লোক বিপদে পড়েছে, তাকে উদ্ধার করা কি আমাদের কর্তব্য না?’
‘কিন্তু তুমি যা বললে, তাতে তো লোকটার কী বিপদ হয়েছে তা পরিষ্কার নয়।’ হিমেল বলল।
‘না তা নয়, কিন্তু নাজমুল হাসানের বাবার যে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। নাজমুল হাসানের কথা অনুযায়ী তারা বেশ বিপদের মধ্যে আছেন। আর তার ভাই মিজানুল হাসানের চরিত্রটাও কেমন রহস্যজনক। তার ভাইয়ের চরিত্রের সাথে এই লোকটার আচার-ব্যবহার খাপ খায় না।’ কথাগুলো বলল বিপ্লব।
‘তারমানে তুমি মিজানুল হাসানকে সন্দেহ করছ?’ রাসেল মাহফুজের জিজ্ঞাসা।
‘এখনও তো জানিই না মূল রহস্যটা কী। কাজেই এই মুহূর্তে কাউকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না। আগে নাজমুল হাসানের কাছ থেকে সবটা শুনি, তারপর কাকে কাকে সন্দেহ করা যায় সেটা দেখা যাবে।’
‘কিন্তু তার সাথে পুনরায় দেখা করবে কিভাবে?’ প্রশ্নটা করল হিমেল।
মামুন বলল, ‘তুমি আবারও ওই বাড়িতে যাবে, তাই না! অত অপমান হওয়ার পরও?’
বিপ্লব জবাব দিল, ‘হয়তো আরো একাধিকবার ও বাড়িতে যেতে হতে পারে। তবে আপাতত না গেলেও চলবে।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে আর কি, লোকটার ভিজিটিং কার্ডটা তো আমার কাছে আছেই।’ পকেট থেকে কার্ডটা বের করে দেখাল। কী মনে হতে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল সেটটা বের করল। আনলক করে ভিজিটিং কার্ডে যে মোবাইল নম্বর দেয়া আছে, সেটাতে কল করল। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে সালাম শুনতে পেল। বিপ্লব সঙ্গীদের দিকে একবার তাকিয়ে সালামের জবাব দিয়ে বলল, ‘আমি গোয়েন্দা বিপ্লব খান বলছি।’
সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দ ঝরে পড়ল যেন ওপাশের কণ্ঠস্বরে। বললেন, ‘আমি জানতাম তুমি ফোন করবে।’
এরপর বিপ্লব মূল কথা বলল। ও জানাল তার সাথে দেখা করতে চায়। তবে অবশ্যই বাড়িতে নয়। নাজমুল হাসানও তাই বললেন। বললেন, ‘আজ বিকেলে জামতলার মোড়ের ব্রিজটার পাশে যে চায়ের দোকানটা আছে, ওখানে চলে এসো।’
রাজি হলো বিপ্লব। জায়গাটা ওরও দারুণ পছন্দের। সময় পেলেই ওখানে ছুটে যায় সিঙ্গারা আর ডালপুরি খেতে। দারুণ বানায় আবুল মিয়া।
এক্ষণই ওর জিভে যেন পানি এসে গেল।
বন্ধুদের যথাসময়ে ওখানে চলে যেতে বলে সাইকেলে চেপে বসল গোয়েন্দাপ্রধান।

ছয়.
‘হ্যালো, গোয়েন্দা বিপ্লব খান?’
‘জি বলছি। আপনি কে বলছেন প্লিজ!’
‘আমি কে বলছি সেটা বড় কথা নয়, তুমি আমার চিরকুটটা পেয়েছ নিশ্চয়ই। আশা করি ওটা ফলো করবে। না করলে...’
‘সরি, আমি আপনার কথা মানতে বাধ্য নই। তাছাড়া আপনি আপনার পরিচয় দিচ্ছেন না। একজন অচেনা অজানা লোক আমাকে হুমকি দেবে, আমি কেন তার হুমকির ধার ধারতে যাব?’
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল। ‘আমাকে তুমি চেন না খোকা। সেজন্যই এভাবে বাহাদুরি দেখাতে সাহস পাচ্ছ।’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি তো আপনাকে চিনি না।  আর বাহাদুরি দেখানোর কথা বলছেন? ওটা দেখাতে আমি গর্ববোধ করি। আর আপনি কোন্ বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করছেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।’
‘কচি খোকা নও তুমি বিপু ভাইয়া। কাজেই আমার কথা বুঝতে না পারার কথাও নয়।’
একটু ভাবল বিপ্লব। কিছু একটা মনে আসি আসি করেও আসছে না। সেজন্য বেশি অস্বস্তি লাগছে।
‘শেষ বারের মতো তোমাকে নিষেধ করছি, ব্যাপারটাতে একেবারেই নাক গলাবে না। আশা করি আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলবে না তুমি।’ লাইন কেটে দিল।
‘হ্যালো, হ্যালো! হ্যালো কে আপনি? আমার কাছে কী চান?’
কিন্তু বৃথায় গেল। নস্বরটিতে কল দিল বিপ্লব। সুইচ অফ।
বেশ ধন্দে পড়ে গেল কিশোর গোয়েন্দা। লোকটা কে? কেন ওকে এভাবে শাসাচ্ছে? কোন্ ব্যাপারে নাক গলাতে নিষেধ করছে?
‘ভাইয়া, তুমি কী করছ?’ জেসমিন রুমে ঢুকে জানতে চাইল।
বিপ্লব বলল, ‘কিছু না আপুমণি। কেন, কিছু বলবে?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া। জানো, কাল রাতে না আমাদের একটা মুরগি চুরি হয়ে গেছে।’
এই কথা শুনে তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসল বিপ্লব। বলল, ‘কোন্ মুরগিটা?’
‘মাথায় ঝুঁটিওয়ালা যে সাদা-কালো মুরগিটা ছিল, সেটা। সবচেয়ে বেশি ডিম দিত মুরগিটা। আম্মু না সারাদিন খুব কান্নাকাটি করেছে!’
মুরগিটা সত্যিই ঘন ঘন ডিম দিত। বাচ্চাও ফুটিয়েছে কয়েকবার। ওটা আব্বা আম্মা দু’জনেরই বেশ প্রিয় ছিল।
‘আম্মু কোথায় রে এখন?’ জিজ্ঞেস করল বিপু।
‘আম্মু ঘরে শুয়ে আছে। তুমি যাও, আমি খেলতে যাচ্ছি।’ বলে দৌড়ে প্রায় উড়ে চলল জেসমিন।
বিপ্লব নামল বিছানা থেকে। মায়ের রুমের সামনে গিয়ে ডাকল, ‘আম্মু ভেতরে আছো?’
‘আয়, ভেতরে আয়।’ ভেতর থেকে মা বললেন।
বিপ্লব রুমে ঢুকল। মা শুয়ে ছিলেন। গিয়ে বসল তার মাথার কাছে।
মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রে, কিছু বলবি?’
‘আমাদের ঝুঁটিওয়ালা মুরগিটা বলে হারিয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, সকালে মুরগির খাঁচা খোলার সময় দেখি তালাটা ভাঙা।’
‘তোমার খুব কষ্ট হয়েছে, তাই না আম্মু?’
‘হ্যাঁরে বাবা, বড় মায়া পড়ে গিয়েছিল কি না ওর উপর, তাই।’ উঠে বসলেন তিনি। ছেলের মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে দিলেন। ‘তোরও বুঝি মন খারাপ লাগছে?’
‘তোমার মন খারাপ লাগলে আমার না লেগে পারে, বলো?’ মায়ের হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল বিপ্লব।
‘দূর পাগল ছেলে।’ মা হেসে দিলেন। ‘মন খারাপ করে কী হবে? এজন্য মন খারাপ করতে নেই।’
‘তাহলে বলো তোমার মনও আর খারাপ করছে না।’
ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে করে হেসে দিলেন মা। বললেন, ‘ঠিক আছে, আর মন খারাপ করছে না। তা সারাদিন কোথায় ছিলি? নতুন কোনো রহস্য পেয়েছিস বুঝি?’
‘হ্যাঁ মা, তবে এখনও ঠিক বলতে পারছিনে এটার মধ্যে সত্যিই কোনো রহস্য আছে কি না। আজই তদন্ত শুরু করেছি। অবশ্য কাল স্কুল থেকে ফেরার পথেই কেসটা পেয়েছি। আর আজ সারাদিন ওটার তদন্তেই ছিলাম।’
‘যা-ই করিস না কেন, একটু সাবধানে থাকিস। বেশি রিস্ক নিতে যাস না বাপ। আমার খুব ভয় করে।’
‘সে কি মা, তুমি ভয় পাবে কেন? তুমি না আমার মা!’ মায়ের কোলে মাথা গুজল বিপ্লব।
মা ওর মাথার চুলে পিঠে আদরের হাত বুলাতে লাগলেন।

সকালে নাজমুল হাসানের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বন্ধুদের সাথে আলাপ করার পর ওদেরকে বিদায় দিয়ে ও গিয়েছিল ব্যাপারটার একটা তদন্ত করতে। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো তথ্য পেয়েছে ও। একটু আগে অজ্ঞাত নম্বরটা থেকে মোবাইলে কল আসার আগ পর্যন্ত ওসব নিয়েই ভাবছিল। আর তারপরই তো জেসমিন এসে মুরগি হারিয়ে যাওয়ার কথা বলল।
মুরগি হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে গতকাল মামুনদের মুরগি হারিয়ে যাওয়ার কথাটা মনে পড়ে গেল। এবং ওটা যে খেলার মাঠের পাশে কেউ রাতে রান্না করে খেয়েছে, সেটাও মনে পড়ল। কি জানি, হয়তো ওদের মুরগিটার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে।
নাজমুল হাসানের আব্বার বিষয়টা চেক সংক্রান্ত। লোকটা রিটায়ার্ড ব্যাংকার। কাজেই তার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। অবশ্য প্রথমটাতে ব্যাংকের ম্যানেজার কোনো তথ্য দিতেই রাজি হননি। শেষটায় ও নিজের পরিচয় দেয়াতে এবং লোকটার বিপদের কথা জানাতে রাজি হয়েছেন। অবশ্য তিনি যা বলেছেন সেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলা যাবে কি না তাও বুঝতে পারছে না। নাজমুল হাসানের সাথে কথা বলে এবং আরও কিছু তদন্ত করলে তবেই বোঝা যাবে।
নাজমুল হাসানদের বাড়ির সামনে একটা মুদি দোকান আছে। ওই দোকান থেকে জেনে নিয়েছে আরো কিছু তথ্য। দোকানির কাছ থেকেই জানতে পেরেছে নাজমুল হাসানের বাবা কামরুল হাসানের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার কথা। সেখান থেকে ফেরার পর তিনি নাকি পাগল হয়ে গেছেন। অন্তত সবাই সেটাই জানে।
সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিপ্লব। আবুল মিয়ার চায়ের দোকানে যেতে হবে। নাজমুল হাসান সাহেব ওখানেই দেখা করতে বলেছেন। মামুন, হিমেল, রাসেল মাহফুজরাও আসবে ওখানে।
বেশি তাড়া না থাকলেও বেশ দ্রুতই সাইকেল চালাচ্ছে বিপ্লব। আগেই পৌঁছতে চায় ওখানে।
রাস্তাটা মোটামুটি ফাঁকা। বাতাসটাও বেশ মিষ্টি ও ফুরফুরে। বেশ লাগছে। মাথার চুলগুলো উড়ছে। কল্পনায় সেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও। নিজের ছবিটা আঁকার চেষ্টা করল। খুব বেশি স্পষ্ট হলো না।
একটা প্রাইভেট ক্লিনিকের সামনে দিয়ে চলেছে বিপ্লব। আজকাল যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে এরকম হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো। নামও দিচ্ছে বেশ আকর্ষণীয়।
ক্লিনিকটার শেষ প্রান্তে রাস্তার বামে একটা গর্ত মতো ছিল। পানি জমে ছিল তাতে। হাসপাতাল থেকে একটা প্রাইভেট কার বেরিয়ে আসছিল। পেছনে হর্ন দিল ড্রাইভার। সাইড দেয়ার জন্য সরে গেল বিপ্লব। পেছনে তাকিয়েছিল একটু। তাতেই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল এবং ফলে হাতের ভেতরে হ্যান্ডেলটা একটু আলগা হয়ে গেল। টাল সামলাতে সামলাতে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো সাইকেলটা। কিন্তু যা হবার তা হয়েই গেছেÑ প্রাইভেট কারের একটা চাকা পড়েছে ওই গর্তে। আর ব্যস, দুনিয়ার ময়লা কাদা-পানি বিপ্লবের গায়ে এসে আছড়ে পড়ল। কড়া ব্রেক কষল বিপ্লব সাইকেলের। পাশ দিয়ে জোরে হর্ন বাজিয়ে শাঁই করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।
মেজাজটাই তিরিক্ষি হয়ে গেল ওর। পঁচা ও ময়লা পানিতে শরীরের প্রায় সমস্তটাই ভিজে গেছে। এখন এ অবস্থায় গন্তব্যে যাবে কী করে!

সাত.
ইচ্ছে হলো ড্রাইভারকে কষে কয়েকটা ধমক লাগিয়ে দেয়। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না। কারণ, দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে সে।
সমস্ত শরীর থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়ছে পানি।
পাশেই একটা ফলের দোকান ছিল। দোকানদার এতক্ষণ সবই দেখছিল। এবার নিচে নেমে এলো। বলল, ‘তুমি তো দেখছি একেবারেই ভিজে গেছ। শালার গাড়ি চালানোর স্টাইল দেখ! মনে হয় যেন রাস্তাঘাট সব ওদের বাপদাদার সম্পত্তি।’
বিপ্লব নিজের সমস্ত শরীরে একবার দৃষ্টি বুলালো।
‘কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছিলে বোধহয়। এক কাজ করো, আমার এখানে যে পানি আছে, তা দিয়ে ধুয়ে ফেল।’ আবার বলল দোকানি লোকটা।
বিপ্লব তাই করলো। কিন্তু এই ময়লা-কাদা কি আর এভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করা যায়! কাজেই পুরোপুরি পরিষ্কার হলো না। তবে যে কাজে যাচ্ছিল সে কাজে যেতে এখন আর বাঁধা নেই। বেশি খেয়াল করে না দেখলে বোঝা যাবে না যে ও পঁচা-ময়লা পানি দিয়ে প্রায় গোসল করেছে।
দোকানিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবারও সাইকেলে চেপে বসল। মন এখন কিছুটা ভালো হয়েছে।
‘এই, এই যে খোকা, এই?’
পাশ কাটিয়ে অনেক রিকসাই যাচ্ছিল। তাদেরই একটা রিকসা থেকে এমনই আওয়াজ ভেসে এলো।
ব্রেক কষতে বাধ্য হলো কিশোর গোয়েন্দা।
রিকসা চালক রিকসা ঠেলে পিছিয়ে নিয়ে এলো। নেমে এলো লম্বা টিংটিঙে শরীরের একটা লোক। টকটকে লাল রঙের কলারওয়ালা টি-শার্ট গায়ে লোকটার। মাথায় একটা কানঢাকা টুপি। সেটার রঙও লাল।
চিনতে পারল বিপ্লব- মিজানুল হাসান।
‘আপনি?’ অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ওর।
‘সকালের ঘটনার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।’ বলল মিজানুল হাসান। ‘আসলে মনটা তখন ভালো ছিল না কি না, তাই তোমার সাথে অমন বিহ্যাব করেছি। আমি আবারও দুঃখিত বিপ্লব। ও সরি, বিপু ভাইয়া।’
শেষের কথাটার মধ্যে একটু যেন শ্লেষের আভাস পেল বিপ্লব। মনে মনে একটু হাসল। বলল, ‘আমি ওই ঘটনায় কিছুই মনে করিনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনি কোনো একটা ব্যাপারে এক্সাইটেড আছেন। কাজেই দুঃখিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।’
‘তুমি সত্যিই গ্রেট, বয়। বাংলাদেশ একদিন তোমাকে নিয়ে অনেক গর্ব করবে। সো, অ্যাডভান্স কনগ্রাচুলেশন!’ হাতটা আজকের দিনে দ্বিতীয়বারের মতো বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেকের জন্য।
হাত বাড়াল বিপুও। এবারও একই কায়দায় শুধুমাত্র আঙুলগুলোকে ছুঁয়ে দিল লোকটা। তারপর বিপ্লবকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিল। প্রচণ্ডভাবে চেপে ধরল। ব্যথা পেল ও। কিন্তু কিছু বলল না। লোকটা যদি এতে খুশি হয়, তাহলে ও কেন তাতে বাঁধা দেবে?
এরপর আবারও শুভ কামনা করে বিদায় নিল মিজানুল হাসান।
বিপ্লব কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল। মুখে এক টুকরো হাসি ছড়িয়ে পড়ল। মনে মনে বলল, ‘খালি খালিই লোকটাকে সন্দেহ করছিলাম। আসলে ভালোভাবে না জেনে কারোর ব্যাপারেই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না।’
আবারও সাইকেলে চেপে বসল বিপ্লব।
পথে আর কোনো কিছু ঘটল না। বাকি রাস্তাটুকু পার হতে তাই বেশি দেরিও হলো না।
সাত মিনিট লেট হয়েছে ওর। সেজন্য সবার কাছে ক্ষমা চাইল। খুলে বলল প্রাইভেট কারের ছিটিয়ে দেয়া পানিতে নিজের ভিজে যাওয়ার ঘটনাটা। তবে ইচ্ছে করেই মিজানুল হাসানের সাথে দেখা হওয়া ও তার ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টা চেপে গেল।
নাজমুল হাসান আজ নিজের মাইক্রো নিয়ে আসেননি। অতিরিক্ত সতর্কতার কারণেই এটা করেছেন তিনিÑ বললেন বিপ্লবকে।
আবুল ভাই সিঙ্গারা ভাঁজছেন। সবার সামনে পিরিচে দু’টো করে গরম গরম সিঙ্গারা দিয়েছেন। তরল জাতীয় কিছু হলে এতক্ষণে হয়তো ওগুলো থেকে ধোয়া উড়তে দেখা যেত। ওই গরম সিঙ্গারার একটা কোনোমতে ধরেই কামড় বসাল হিমেল। তারপর হা করে রইল। হা হা করতে লাগল এবং বিশেষ ভঙ্গিতে দুই হাত ছুড়তে লাগল। অর্থাৎ গাল পুড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে।
বিপ্লব বলল, ‘ঠাণ্ডা হতে একটু সময় তো দেবে, নাকি?’
মামুন বলল, ‘খাওয়ার জন্য অত তাড়াহুড়ো করলে তো হবে না, তাই না!’
‘আমি কী করবো?’ এখনও হাত ছুড়ে চলেছে হিমেল। ‘এত সুন্দর সিঙ্গারা সামনে রেখে বসে থাকা যায় নাকি? কী চমৎকার ঘ্রাণ দেখেছ?’
‘ঘ্রাণ কিন্তু দেখা যায় না।’ বলল রাসেল মাহফুজ।
‘দূর!’ বলল হিমেল। ‘সবাই তো এভাবেই বলে।’ আবারও সিঙ্গারাটা উঠিয়ে নিল।
তেড়ে গেল বিপ্লব, ‘করছ কী করছ কী? গাল পুড়িয়ে ফেলবে নাকি?’
এতক্ষণ ছেলেদের কাণ্ডকারখানা উপভোগই করছিলেন নাজমুল হাসান। হয়তো নিজের ছেলেবেলায় চলে গিয়েছিলেন তিনি ওদের মাধ্যমে।
আবুলের চায়ের দোকান নাম হলেও শুধুমাত্র চায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। খাসির কলিজার সিঙ্গারা, ডাল পুরি, বোম্বাই জিলাপি, ছোলা ঘুঘনি প্রভৃতি বিভিন্ন আইটেমের মুখরোচক খাদ্যসামগ্রী বানানো হয় এখানে। আবুলকে সাহায্য করার জন্য একটা ছেলে আছে। সর্বক্ষণ তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। চড়–ই পাখির মতো যেন ফুড়–ৎ ফুড়–ৎ করে উড়ে বেড়ায় ছেলেটা। এই এ টেবিলে তো পরক্ষণই অন্য টেবিলের সামনে দেখা যাবে তাকে।
একটা টেবিলের পুরোটাই দখল করে বসেছে ওরা।
ইতিমধ্যেই হিমেলের দু’টো সিঙ্গারা শেষ হয়ে গেছে। আরো দু’টো নিয়ে এলো নিজে উঠে গিয়ে। মুহূর্তেই ও দু’টোও সাবাড়! এরপর ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে হাক ছাড়ল, ‘এই যে খোকা, দু’টো গরম গরম জিলাপি দাও তো। বড় বড় দেখে দেবে কিন্তু!’
হাসতে গিয়ে গালভর্তি সিঙ্গারা নিয়ে বিষম খেল রাসেল। মামুন ওর মাথায় আস্তে করে থাবা দিল কয়েকটা। পানির গেলাস উঠিয়ে ধরল মুখে।
এবার হেসেই দিলেন নাজমুল হাসান।
তার হাসি দেখে বিপ্লবও হাসল।
ক্রমে সংক্রমিত হলো অন্যদের মাঝেও। এরপর যেন টেবিলটা জুড়ে হাসির হুল্লোড় উঠল।
আবুল হোসেনও হেসে দিল। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো ভাইজানেরা, তুমরা অমন করে হাসতিছাও ক্যান্?’
বিপ্লব বলল, ‘আর বলো না আবুল ভাই। আমাদের এই পেটুক বন্ধুটার খাওয়ার ভঙ্গি দেখে না হেসে আর পারা গেল না।’
‘ও তাই। এই হাসমত, ভাইডিকে দু’টো ডাল পুরি দে।’ ছেলেটাকে বলল আবুল।
ছেলেটাও হাসছিল। দু’টো পুরি নিয়ে এগিয়ে এলো টেবিলের কাছে। পিরিচে রাখতে রাখতে ফিক করে হেসে দিল।
ধমক লাগাল হিমেল, ‘এই ছোড়া, হাসছ কেন? ভাগ!’
আরো একবার ফিক করে হাসল হাসমত। তারপর দ্রুত সরে গেল হিমেলের সামনে থেকে।
এভাবে আরো কিছুক্ষণ চলল।
বিপ্লবের মধ্যে তখন মূল বিষয়টা অবতারণা করার গুরুত্ব বেশি। কিভাবে কথাটা পাড়া যায় তাই ভেবে নিল। শেষে বলল, ‘মিস্টার নাজমুল হাসান, আমরা বোধহয় এবার মূল কথায় আসতে পারি।’
মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন ভদ্রলোক। চেহারায় ফিরে এলো সহজাত গাম্ভীর্য। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও সেটাই চাচ্ছি।’
বিপ্লব বলল, ‘আপনি সকালে বলছিলেন আপনার বাবা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। এরপরের ঘটনা আর শোনা হয়নি।’
‘হ্যাঁ, তারপর থেকেই বলছি এবার।’ শুরু করলেন ভদ্রলোক। তিনি যা বললেন, তা এরকম : বাবাকে অল্প শুশ্রƒষা করতে তার জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দেন। অনেকভাবে জিজ্ঞেস করলেও সব প্রশ্নের জবাব দেন না। ‘হু হা’ করে কাটিয়ে দেন। সেদিন রাতেই আমি বাইরে থেকে ফিরে এসে শুনি বাবা সারাদিনে কিছুই খায়নি। আমি বাবার রুমে ঢুকলাম। বাবা তখন বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখ দু’টো খোলা রেখে চিত হয়ে আছেন তিনি। আমি বাবাকে ডাকলাম কয়েকবার। বাবা কোনো জবাব দিল না। মাথার কাছে বসে আস্তে করে হাত রাখলাম বাবার মাথায়। বললাম, ‘ভাত খেতে ইচ্ছে না করলে অন্য কিছুও তো খেতে পারতে।’ বাবা কোনো জবাব দিলেন না। তেমনি নিষ্পলক সিলিঙের দিকে তাকিয়ে আছেন। খেয়াল করতে দেখলাম বাবার বাম চোখের কোণা দিয়ে পানি গড়িয়ে চলেছে খুবই ধীরে ধীরে। তারমানে বাবা কাঁদছে।
অন্তরটা ব্যথায় গুড়িয়ে গেল। আর সহ্য করতে পারলাম না। বললাম, ‘বাবা, কী হয়েছে তোমার? টাকা হারিয়েছে তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি। সব ঠিক করে ফেলব।’
বাবার মুখটা এবার নড়ে উঠল। শোনা যায় না প্রায় এমনভাবে ফিসফিস করে বললেন, ‘কিছুই ঠিক হবে নারে নজি। সব দোষ তো আমারই। আমিই আমার এই সর্বনাশের জন্য দায়ী।’
‘এসব কী বলছ বাবা?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
বাবা আর কোনো কথা বললেন না। চুপ হয়ে গেলেন। আমি পারলাম না সে রাতে বাবাকে কিছু খাওয়াতে। আমার স্ত্রী পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আগেই। আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘বাবাকে রেস্ট নিতে দাও। ধকলটা উনি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।’
বাবার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছুই খেতে ইচ্ছে করল না। এক গেলাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ছেলেমেয়েরাও পড়ালেখায় মন বসাতে পারল না। বাড়িতে এমন অশান্তি থাকলে কারোরই ভালো থাকার কথা নয়।
ঘুমে আমার চোখ বুজে এসেছিল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ উত্তপ্ত কিছু বাক্য বিনিময় শুনে আমার ঘুম ছুটে গেল। কান খাড়া করে শুনলাম।
আমার স্ত্রী আগেই উঠে গেছে। আমিও বিছানা থেকে নামলাম।
বাবার রুম থেকে কথা কাটাকাটির শব্দ ভেসে আসছে। এগিয়ে গেলাম আমি সেদিকে।
দরোজা খোলায় ছিল। ঢুকে গেলাম আমি।
আগেই বাবার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একলা শুধু মিজানুল বকে যাচ্ছিল। যাচ্ছেতাই ভাষা ব্যবহার করছিল ও। আমাকে দেখে দেড়ে এলো। বলল, ‘দেখ ভাই, বাবাটা কেমন! আমাকে বলছে আমি নাকি...’
কিন্তু ওর কথা শোনার অবস্থা তখন আমার নেই। বাবা পড়ে আছে চেয়ারের পাশে। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছেন। আমি ছুটে গেলাম বাবার কাছে। ডাকতে লাগলাম ‘বাবা বাবা’ করে। কিন্তু বাবা কোনো সায় দিল না। মিজুকে বললম, ‘হাসপাতালে ফোন দে, বাবাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।’
এবার যেন চেতনা ফিরল মিজুর। আমার ও বাবার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। আমি আবারও তাড়া লাগালাম। এবার ও পকেট থেকে মোবাইল বের করে হাসপাতালে ফোন করল।
বাবাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কর্মরত ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে ঘোষণা করেন, তার একটা মিনি স্ট্রোক হয়েছে। অতিরিক্ত মানসিক টেনশনেই এটা ঘটেছে। এরপর তাকে ভর্তি করে নেয়। হাসপাতালে তিনদিন থাকতে হয় তাকে।
বাবাকে বাড়িতে আনা হলো। এখন তিনি রুমেই থাকেন। বাইরে বের হন না।’
থামলেন নাজমুল হাসান। এক গেলাস পানি পুরোটাই খেয়ে ফেললেন।
বিপ্লব জিজ্ঞেস করল, ‘কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল সেদিন আপনার ভাইয়ের সাথে?’
নাজমুল হাসান একটু ইতস্তত করলেন। তারপর বললেন, ‘আসলে আমি তাদের কথা খুব একটা পরিষ্কার শুনতে পাইনি। ঘুমের ঘোরে শুনেছিলাম তো!’
‘ও।’ বলে চুপ হয়ে গেল গোয়েন্দাপ্রধান। এরপর কী জিজ্ঞেস করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। অনেক ভেবে শেষে বলল, ‘আপনার বাবার সাথে একটু কথা বলার ব্যবস্থা করতে পারবেন?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নাজমুল হাসান। বললেন, ‘সেটা করতে পারলে তো ভালোই হতো। কিন্তু তা সম্ভব নয়।’
‘সম্ভব নয় কেন?’
‘বাবা তো কথা বলার অবস্থাতে নেই।’
‘তার মানে?’
‘বাবা হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে আর কথা বলেন না।’
পাক্কা আধা মিনিট কোনো কথা বলতে পারল না বিপ্লব। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল নাজমুলের দিকে।
‘রাসেল মাহফুজ জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তার কী বলেছেন এ ব্যাপারে?’
নাজমুল হাসান জবাব দিলেন, ‘ডাক্তারও ধরতে পারছে না ব্যাপারটা। তারা বলছেন এরকমটা হওয়ার কথা নয়। স্ট্রোকটা বেশি বড় ছিল না। এরকম স্ট্রোকে কথা বলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা নয়।’
এবার বিপ্লব বলল, যেন সহসাই কিছু মনে পড়েছে, ‘আচ্ছা, আপনার বাবা তো সেদিন ব্যাংকে গিয়েছিলেন, তিনি কি কিছু জানতে পেরেছিলেন ব্যাংকে গিয়ে?’
একটু যেন চমকে উঠলেন নাজমুল হাসান। বললেন, ‘মানে? কই, বাবা ব্যাংকে গিয়েছিলেন বলে তো আমি কিছু জানিনে। তোমাকে কে বলল এ কথা?’
বিপ্লব সরাসরি সে কথার কোনো জবাব দিল না। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল। বলল, ‘না মানে, যেতেও তো পারেন। কেন, গেলে কি চেকটা কে ভাঙিয়েছে তা জানা সম্ভব ছিল না? তিনি তো সেটা করতেই পারেন।’ তীক্ষè দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ও।
ওই দৃষ্টির সামনে ভদ্রলোক কেমন চুপসে গেলেন। গলাটা প্রায় খাদে নামিয়ে বললেন, ‘আসলে উনি গিয়েছিলেন কি না তা আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নিয়েছিলাম। চেকটা ওই ব্যাংক থেকে ভাঙানো হয়নি। ব্যাংকের অন্য শাখা থেকে ভাঙানো হয়েছে।’
বিপ্লব মনে মনে হাসল। এ ব্যাপারে তো ও আগেই তদন্ত করে তথ্য জানতে পেরেছে। বর্তমানে সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো অনলাইন হয়ে যাওয়াতে ব্যাংকের নির্ধারিত শাখায় না গিয়েও অন্য শাখার মাধ্যমে টাকা উঠানো ও জমা দেয়া যায়।
তখনকার মতো কথা আর এগোলো না। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে গিয়েছিল। আকাশের অবস্থাও ভালো ছিল না। তাই বিদায় নিল।
নাজমুল হাসান একটা ইজি বাইক নিয়ে তাতে চেপে বসলেন। ব্যাটারিচালিত এই ইজি বাইকগুলোর ব্যাপক চাহিদা এদিকে।
‘কী করবে এখন?’ জিজ্ঞেস করল রাসেল।
বিপ্লব তক্ষুনি কোনো জবাব দিল না। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘একটা নতুন তথ্য জানা গেল।’
অন্যরা সমস্বরে জানতে চাইল, ‘কী?’
বিপ্লব বলল, ‘কামরুল হাসানের হঠাৎ কথা বলা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক।’

আট.
ঘুম আসছিল না বিপ্লবের। বারবার সারাদিনের ঘটনাগুলো মনের পর্দায় ভেসে ভেসে উঠছিল। আপাতত তিনজনেক সন্দেহের তালিকায় এনেছে ওÑ চিঠি লিখে হুমকিদাতা (মোবাইলে কলও নিশ্চয়ই সে করেছে), মিজানুল হাসান এবং নাজমুল হাসান স্বয়ং। নাজমুল হাসান চরিত্রটা কেমন ঘোলাটে ওর কাছে। কেমন যেন রহস্যময়তা আছে তার মধ্যে।
এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে বিপ্লব। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল বলতে পারবে না, কানের কাছে কম্পন শুনে ঘুম টুটে গেল। মোবাইলে ভাইব্রেশন দেয়া থাকে ওর সমসময়। ঘুমানোর আগে মাথার পাশে বালিশের অল্প নিচে রেখে দেয়।
চোখ না খুলেই হাতড়ে মোবাইলটা উঠিয়ে নিল। চোখের সামনে ধরে এক চোখ মেলে দেখল কে কল দিয়েছে। অচেনা নম্বর। একটু অবাক হলো ও এত রাতে অচেনা নম্বর থেকে কল আসায়। ইয়েস বাটন টিপে কানে ধরে সালাম দিল ও। ওপাশের কথা শুনল ও। আগের ওই লোক, এবারও ওকে হুমকি দিয়ে কথা বলল। বিপু বলল, ‘হ্যালো, আপনি আপনার পরিচয় দিচ্ছেন না কেন? কী চান আমার কাছে?... হ্যালো, শুনুন, আপনি যে-ই হন না কেন, আপনার পরিচয় না দিলে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না। ... কী বলছেন? ... আমি কী করব না করব সেটা আপনাকে জানাতে যাব কেন? ... আপনি আমাকে আদেশ দেয়ার কে? .... আরে বাবা, আমি তো আপনাকে চিনিই না।... দেখুন, এভাবে চিঠি লিখে আর ফোনে হুমকি না দিয়ে সামনা-সামনি আসেন না। আপনার মতো অনেক মানুষকে আমি ঘোল খাইয়ে ছেড়েছি। আপনিও... কী বললেন?’
আগে থেকেই মোবাইলটা লো-ব্যাটারি দেখাচ্ছিল। চার্জ দিতে ভুলে গিয়েছিল ও। এক্ষণে বন্ধ হয়ে গেল। তাই কথা শেষ করতে পারল না।
বিছানায় ঠাঁই বসে রইল ও। ঘুম পুরোপুরি পালিয়ে গেছে চোখ থেকে।
পাশে শুয়ে ছিল ছোট বোন জেসমিন। ভাইয়ের মোবাইলে কথা বলায় ও-ও জেগে গেছে। জিজ্ঞেস করল, ‘কে ফোন করেছিল ভাইয়া এত রাতে?’
বিপ্লব আস্তে করে বলল, ‘তুমিও জেগে গেছ? ঘুমিয়ে পড়ো আপু।’
‘কে করেছিল ফোনটা?’ আবারও জিজ্ঞেস করল জেসমিন।
‘একটা লোক।’
‘এত রাতে কেন? দিনে ফোন করতে বলতে পারো না?’
‘আচ্ছা আমি বলে দেব। এখন ঘুমিয়ে পড় তো।’ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
জেসমিন ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। বিপ্লবের সহসায় ঘুম এলো না। ভাবতে লাগল, কে লোকটা? এভাবে বারবার হুমকি দিচ্ছে কেন? কী সম্পর্ক এই কেসের সাথে লোকটার? আড়াল থেকেই কেবল ভয় দেখাচ্ছে, সামনে আসছে না কেন? ভয় পাচ্ছে সামনে আসতে?
চোখ দু’টো বুজে আসছিল ওর, এই সময় জানালায় ‘ঠুক ঠুক’ আওয়াজ হলো। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’
জবাব এলো, ‘আমি মামুন। একটু বাইরে আসবে?’
‘এত রাতে কেন? কী হয়েছে?’
‘শিগগির বাইরে এসো। দারুণ একটা ঘটনা ঘটেছে।’
বিপ্লব এবার বাইরে বের না হয়ে পারল না। আস্তে শব্দ না করে বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে দরোজা পর্যন্ত গেল। তারপর শব্দ না করেই দরোজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আলতো করে লাগিয়ে দিল।
বাইরে মামুন অপেক্ষা করছে। বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে ওকে। ওর হাতে একটা টর্চ। জ্বালতেও ভয় পাচ্ছে।
‘কী হয়েছে মামুন?’ জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।
‘মুরগি চোর ধরা পড়েছে। জলদি চলো।’ বলে ঘুরে দাঁড়াল মামুন।
‘কোথায়? কিভাবে ধরা পড়ল?’
‘খেলার মাঠের ওখানে, রাসেলকে রেখে এসেছি। রাসেল তোমাকে ফোন দিয়েছিল, তাই না। কিন্তু তোমার মোবাইলটা বোধহয় বন্ধ। সংযোগ পায়নি।’
বিপ্লব তার মোবাইল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা খুলে বলল। তারপর দ্রুত চলল মামুনের সাথে মুরগি চোর দেখতে।
‘কিভাবে ধরলে মুরগি চোরকে? কে চোর তা চিনতে পেরেছ?’ হাঁটতে হাঁটতেই জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।
মামুন বলল, ‘ওরা তিন চারজন হবে। অনেকগুলো মুরগি ধরে এনেছে। বস্তায় করে নিয়ে এসেছে ওরা।’
‘ওদেরকে কোথায় রেখে এসেছ তাই বলো।’
‘ওরা তো মাঠের ওখানটাতেই আছে। রাসেলকে পাহারায় রেখে এসেছি, তাই না।’
‘কিন্তু মাত্র দু’জন মিলে তিন-চারজন চোরকে ধরলে কিভাবে?’
‘আরে চোর ধরেছি তোমাকে কে বলল? ওরা তো চুরি করা মুরগি দিয়ে পিকনিক করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিভাবে ওদেরকে ধরবে, তাই না, সে প্ল্যান করার জন্যই তো তোমাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘তারমানে চোরকে তোমরা আটকাওনি?’
‘আরে না, ওদেরকে দেখেই তোমাকে ফোন দিয়েছিল রাসেল। কিন্তু তোমার মোবাইল বন্ধ দেখে আমাকে পাঠিয়ে দিল তোমাকে ডেকে আনার জন্য।’
‘ও।’
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে লাইট জ্বেলে আলো ফেলে পথ দেখে নিচ্ছে মামুন।
ওরা খেলার মাঠে চলে এসেছিল। মামুন বিপ্লবকে টেনে ধরল। ঠোঁটে আঙুল রেখে ফিস ফিস করে বলল, ‘সাবধান, শব্দ করলেই ওরা পালিয়ে যাবে কিন্তু!’
‘কিন্তু রাসেল কোথায়?’ অন্ধকারেই চারপাশে তাকিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।
‘এই, তুমি আস্তে বলো। শুনে ফেলবে তো ওরা, তাই না।’
‘কিন্তু কোথায় ও?’ আস্তে করেই বলল বিপ্লব। ‘আর চোরগুলোও বা কোথায় পিকনিক করছে?’
চারপাশে তাকাল মামুন। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। বলল, ‘এখানেই তো ছিল রাসেল!’
আস্তে করে ডাকল বিপ্লব, ‘রাসেল? রাসেল তুমি কোথায়?’
কোনো সাড়া এলো না। আবারও ডাকল। এবারও সাড়া মিলল না।
কিছুটা শঙ্কিত হয়ে উঠল এবার ওরা। ওর কিছু হয়ে যায়নি তো?
মামুন তাই ভেঙে পড়ল। হড়বড় করে বলতে লাগল, ‘ও তো এখানেই ছিল। ওরা ওর কোনো ক্ষতি করেনি তো? ওর কিছু হয়ে গেলে আমি বাবা-মাকে কী জবাব দেব?’
বিপ্লব ওকে শান্ত থাকতে বলে বলল, ‘এখনই ভেঙে পড়ো না। আগে দেখতে দাও বিষয়টা।’ তারপর মামুনের হাত থেকে টর্চটা নিজের হাতে নিল। এগিয়ে চলল। ডাকতে লাগল অনুচ্ছ স্বরে রাসেলের নাম ধরে।
না, মাঠের পাশের বাগানে কেউ নেই। কেউ পিকনিকের প্রস্তুতিও নিচ্ছে না। তাহলে? এবার বিপ্লবের মনেও অজানা আশঙ্কা উঁকি দিতে লাগল।
বাগান ছাড়িয়ে অন্যপাশে চলে এলো ওরা। কিসে যেন পা বেঁধে হোঁচট খেল বিপ্লব। টর্চের আলো ফেলল। একটা মানুষই তো মনে হচ্ছে।
ভালো করে আলো ফেলে দেখল। হ্যাঁ, একটা মানুষই।
হাঁটু মুড়ে বসে মানুষটার মুখে আলো ফেলল। তড়াক করে বুকের খাঁচায় হৃৎপিণ্ডটা আছড়ে পড়ল। রাসেল মাহফুজ পড়ে আছে!
মামুন হাউমাউ করে উঠল, ‘এই তো রাসেল! কী হয়েছে ওর? ওভাবে পড়ে আছে কেন?’
বিপ্লব ওকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। রাসেলের নাকের নিচে হাত নিয়ে দেখল, হ্যাঁ, নিঃশ্বাস পড়ছে। আলো জ্বেলে হাত দিয়ে ওর শরীরে হাত বুলিয়ে দেখল কোথাও কোনো আঘাত বা ক্ষতের চিহ্ন আছে কি না। বুকের কাছটায় হাত নিতেই রাসেলের বুক পকেটে অর্ধেক বেরিয়ে থাকা এক টুকরো কাগজ ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওটা মামুনের অলক্ষেই উঠিয়ে নিজের পকেটে রাখল। এটার কথা এখনই ওকে জানাতে চায় না। খারাপ কিছু লেখা থাকলে হয়তো আরো ভেঙে পড়বে। আগে নিজে একা পড়ে দেখতে চায়। বাম হাতটা বেকায়দাভাবে পিঠের নিচে পড়ে আছে রাসেলের। ভাবল বিপ্লব, ওই হাতে কোনো সমস্যা হয়নি তো! বলল, ‘ধরো, ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।’
রাসেলকে ধরাধরি করে মামুনদের বাড়ি নিয়ে এলো ওরা। তবে সাবধান থাকল, বাড়ির কেউ যেন জেগে না যায়। মামুনের রুমের দরোজা ভেজানো ছিল। আস্তে করে খুলে রাসেলকে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো। বিপ্লব বলল, ‘একটু পানি নিয়ে এসো।’
রুমেই জগে পানি ছিল। ওটা এগিয়ে দিল মামুন।
বিপ্লব কিছু পানি হাতে নিয়ে রাসেলের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল। কয়েকবারের চেষ্টায় চোখ খুলল রাসেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বিপ্লব ও মামুন।
উঠতে গিয়েও কঁকিয়ে উঠল রাসেল। ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কবজিটা চেপে ধরল। ব্যথায় নীল হয়ে উঠল চেহারা।
বুঝতে পারল বিপ্লব, যা আশঙ্কা করেছিল তাই হয়েছে। দ্রুত ওর বাম হাতটা ধরল ও। বলল, ‘ব্যথা করছে?’
রাসেল জবাব দিলল, ‘বোধহয় ভেঙে গেছে! আউ!’ গুঙিয়ে উঠল।
ভালো করে দেখল বিপ্লব। না, ভাঙেনি বোধহয়। একটু মালিশ করে দিতেই কিছুটা আরামবোধ করল রাসেল।
রাসেল এবার হাতটা নিজের মাথার পেছনে নিয়ে গেল। ওখানে একটা মাঝারি সাইজের আলু গজিয়ে আছে। ব্যথায় টনটন করছে, জানাল ও।
বিপ্লব বলাতে পানি দিয়ে গামছা ভিজিয়ে চেপে ধরল মামুন।
বিপ্লব বলল, ‘তুমি বরং রাতটা রেস্ট নাও। ভোরেই চলে আসব আমি। তখন শোনা যাবে কী ঘটেছিল।’ বলে আর দাঁড়াল না। বেরিয়ে এলো বাইরে। অবশ্য টর্চ সঙ্গে নিয়েই। এই ঘোর অন্ধকার রাতে টর্চ ছাড়া বাড়ি ফেরা দুস্কর হবে।
ফিরে চলেছে বিপ্লব। পেছনে ঘনীভূত হচ্ছে রহস্যের জাল। বুঝতেই পারছে না কোন্ দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে এবারের কেসটা।

নয়.
ভোরের আলো ফুটতেই সাইকেল নিয়ে ছুটল বিপ্লব। মোড়ের মসজিদ থেকে নামাজ সারল। তারপর সোজা মামুনদের বাড়ি।
রাসেল তখনও ঘুমিয়ে। অবশ্য আগেই উঠে পড়েছে মামুন। নামাজ শেষ করেছে ঘরেই।
বিপ্লব সাইকেলটা উঠানে রেখে মামুনের রুমে প্রবেশ করল। মামুনদের বাড়িটা ইটের তৈরি হলেও উপরে টিনের ছাউনি। তিনটা রুমের একটাতে থাকে ও।
বিপ্লবকে প্রবেশ করতে দেখে মামুন বলল, ‘ও এখনও ঘুমাচ্ছে।’
‘রাতে আর কোনো সমস্যা হয়নি তো?’ জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।
‘না।’ জবাব দিল মামুন। ‘একবার শুধু উঠে পানি খেতে চাইল। তারপর আবারও ঘুমিয়েছে।’
‘কিন্তু এখন তো ওকে তুলতে হবে। নামাজের সময় চলে যাচ্ছে তো।’ বলে নিজেই মৃদু ঝাঁকি দিয়ে রাসেল মাহফুজকে জাগিয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান।
রাসেল চোখ ডলতে ডলতে উঠে পড়ল। বাম হাতটা এখনও ভালোভাবে নাড়াতে পারছে না, বুঝতে পারল বিপ্লব।
‘সরি,’ বলল রাসেল। ‘উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল।’ তারপর বিছানা থেকে নেমে কলপাড়ে গিয়ে ওজু করে এলো। মামুন ওকে সাহায্য করল।
ওকে নামাজ পড়তে দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল অন্যরা। ও নামাজ পড়া শেষ করতেই বিপ্লব জিজ্ঞেস করল, ‘এবার বলো, কী হয়েছিল কাল রাতে? তোমাকে কারা ওভাবে মেরে ফেলে গিয়েছিল?’
বিছানায় বিপ্লবের পাশে বসল রাসেল। মিটি মিটি হাসছে ও।
বিপ্লব অবাক হলো। ওর এই হাসার কারণ বুঝতে পারছে না।
রাসেল বলল, ‘তোমার জানার কথা কারা আমাকে মেরে ফেলে গেছে।’ এখনও একইভাবে হাসছে ও।
বিপ্লব ধন্দে পড়ে গেল। কী বোঝাতে চাইছে রাসেল? বোকা বোকা মনে হচ্ছে ওর নিজেকে। বলল, ‘হেয়ালি রেখে এখন খুলে বলো তো কী হয়েছিল?’
‘ওরকম পিত্তি জ্বলানো হাসবে না বলে দিলাম।’ বলল মামুন। ‘আমরা কত টেনশনে ছিলাম তুমি জান?’
‘সরি।’ বলল রাসেল। ‘তোমাদেরকে আর টেনশনে রাখতে চাই না। আসলে কারা আমাকে আক্রমণ করেছিল তা আমি নিজেই জানিনে। মামুনকে তো বললাম তোমাকে ডেকে আনার কথা। আমি ওদের ওপর চোখ রাখতে লাগলাম। আম গাছটার আড়ালেই ছিলাম আমি হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওভাবে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুম এসে চোখ বুজিয়ে দিয়েছিল, তা টের পাইনি। হঠাৎ পিঠে একটা আঘাত পেলাম। সম্বিৎ ফিরে পেলাম আমি। তখনই কেউ আমার মুখ চেপে ধরল পেছন থেকে। অন্য একজন আমাকে উঁচু করে ধরল। আমাকে অনেকটা চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল। কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পর বাম হাতটা মুচড়ে দিল। অন্য একজন শক্ত কিছু দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করল। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। তারপরও ছাড়ল না ওরা। আমার কানের পেছনে একটা কারাতে চালাল কেউ। মুহূর্তে অগণিত তারাফুল দেখতে পেলাম চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে। তারপর জ্ঞান হারালাম। এরপর তো তোমরাই আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলে তাই না!’ থামল রাসেল মাহফুজ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে।
‘এটা তোমার একদম ঠিক হয়নি, তাই না!’ রাসেল থামতে একটু সময় নিয়ে বলল মামুন। ‘তুমি তো নিজেকে গোয়েন্দা বলে দাবি করো, এই সামান্য কাজটা করতে পারলে না? সামান্য মুরগি চোরকে ধরতে গিয়ে উল্টো তাদের হাতেই মার খেলে?’
ওর বলার ধরণে হেসে দিল বিপ্লব। বলল, ‘এই থামো মামুন। ওর তো ঘুম চলে এসেছিল। কাজেই ওর কী দোষ? সব দোষ তো ওই ব্যাটা ঘুমের। কী বলো রাসেল?’
রাসেল বুঝল ওকে কিছুটা তীরস্কার করল বিপ্লব। কিন্তু গায়ে মাখল না। বলল, ‘আমি জানতাম গোয়েন্দা বিপু অন্যরকম মানুষ। কেবল দুশমনদের বেলাতেই সে কঠোর এবং নিষ্ঠুর। কিন্তু এখন দেখছি নিজের বন্ধুদেরকেও সে ছেড়ে কথা বলে না।’
‘সরি রাসেল।’ বলল বিপ্লব। ‘আমি যদি কোনোভাবে তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি সেজন্য ক্ষমা চাচ্ছি। এখন আমাদেরকে এই কেসটা নিয়ে কয়েকটা বিষয় ভাবতে হবে। তোমরা আমাকে সাহায্য করবে কথা দিয়েছিলে। আমি তোমাদেরকে কিছু কাজ দিতে চাই।’
মামুন ও রাসেলের মুখের দিকে তাকাল ও পালাক্রমে।
রাসেল বলল, ‘তুমি আমার কথায় কোনো কষ্ট নিও না। আসলে ওভাবে ঘুমিয়ে যাওয়াটা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু কেন যে ঘুমটা চলে এলো...। যাকগে, এখন বলো, কী করতে হবে আমাকে?’
‘তুমি কি কিছু ভেবেছ কেসটা নিয়ে?’ সরাসরি প্রশ্নটা করল বিপ্লব।
‘ভেবেছি কয়েকটা বিষয়। কিন্তু কোনো কনক্লুশানে আসতে পারিনি। ওসব বাদ দাও, তোমার প্ল্যানটাই বলো।’
এরপর সারাদিনে কী কাজ ওদের তা বুঝিয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান। খেলার মাঠের ওই বাগানের দিকে খেয়াল রাখবে মামুন ও রাসেল। দেখবে কারোর অস্বাভাবিক চলাচল ওদিকে লক্ষ করা যায় কি না। আজ সারাদিনে কারা কারা ওদিকে যায় এবং আসে, সব রেকর্ড করবে। সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়লেই ওকে মোবাইলে জানাবে। ও নিজে যাবে হিমেলকে নিয়ে কয়েকটা জরুরি কাজ সারতে। মূল শহরে যেতে হতে পারে। সন্ধ্যার সময় বাজারের মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়বে একসাথে। তখনই পরবর্তী করণীয় ঠিক করে নেবে।
অবশ্য এর আগে গতরাতে রাসেলের পকেটে পাওয়া কাগজের কথাটা বলতে ভুলল না বিপ্লব। বিষয়টা ওদেরকেও জানানোর তাগাদা অনুভব করল বলেই জানাল। কাগজে যথারীতি কয়েকটা বাক্য লেখা। এবং সবগুলোই হুমকি দিয়ে। কাজটা থেকে বিরত থাকতেও বলা হয়েছে তাতে। উল্লেখ করা হয়েছে, বেড়াতে আসা এক মেহমানকে দিয়েই বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা কতটা ভয়ঙ্কর। এরপরেও যদি না থামে, তাহলে শেষ এবং ভয়ঙ্কর পরিণতির জন্য যেন অপেক্ষা করে।
এ থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায় যে, চিরকুট লিখে ও ফোন করে হুমকিদাতা এবং মুরগি চোর একই। অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তি ওরা এই কাজে জড়িত। কাজেই, গোয়েন্দাদেরকেও সাবধান থাকতে হবে। সে কথা ভালোভাবেই জানিয়ে দিল বিপ্লব।
সাবধানে থাকবে বলে কথা দিল মামুন ও রাসেল মাহফুজ।
গতরাতের ঘটনাটা আর কাউকে জানাতে নিষেধ করে বাইরে বেরিয়ে এলো গোয়েন্দাপ্রধান। সাইকেলে চেপে বসল। পথে হিমেলদের বাড়ি গিয়ে ওকে সংক্ষিপ্ত আকারে সব জানিয়ে ওর করণীয় জানিয়ে দিল। আপাতত ও মিজানুল হাসানের উপর রজর রাখবে। সেজন্য এখনই বেরিয়ে যেতে বলল।
বিপ্লব বাড়ি ফিরে চলেছে। প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে ওর। এরকম জটিল কোনো বিষয় নিয়ে ভাবার সময় ওর কেন জানি ঘন ঘন ক্ষিধে পায়। আগে এটা হতো না। ইদানীং এই রোগটা দেখা দিয়েছে।
আপন মনেই সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল বিপ্লব। রাস্তা ফাঁকা থাকায় এবং সূর্য এখনও তীব্রভাবে আলো ছড়ানো শুরু না করাতে বেশ খোশ মেজাজেই চলছিল ও। ফুরফুরে একটা বাতাস ওর শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল। যেন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে ভেসে চলেছে ও।
এতটায় আত্মমগ্ন হয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল যে, কখন একটা লোক ওর সাইকেলের সাথে ঢাক্কা খেল তা ও বুঝতেই পারল না। বুঝল যখন লোকটা হাচড়ে-পাচড়ে উঠে দাঁড়াল এবং ওকে কঠিন ভাষায় দু’টো ধমক লাগাল, তখন।
পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নিল বিপ্লব। ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। সাইকেল রেখে লোকটাকে উঠতে সাহায্য করল। বলল, ‘কোথাও লাগেনি তো আপনার? আসলে আমি একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম তো, তাই আপনাকে দেখতে পাইনি।’
লোকটা কিছুই বলল না। কেমন ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।
বিপ্লব এবার ভালো করে দেখল তাকে। মাঝবয়সী লোকটার মাথার চুলগুলো সাদা-কালো। অর্থাৎ অর্ধেক চুলই পেকে গেছে। নাকের নিচে হালকা গোঁফ। চোখের মণি দু’টো কটা। ঠোঁট দু’টো কালো কুটকুটে। অত্যধিক ধূমপানের ফলÑ ভাবল ও। গায়ে একটা সাদা পাঞ্জাবি। পরনে সাদা পাজামা। পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। হ্যাংলা শরীরটা যেন বাতাসে দোল খাচ্ছে। সব মিলিয়ে মলিন একটা ছাপ তার শরীরে স্পষ্ট।
‘আপনি এই এলাকায় নতুন বুঝি?’ লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ল না বিপ্লবের। ‘কোথায় এসেছেন? কাদের বাড়িতে?’
লোকটা এ কথার কোনো জবাব দিল না। তবে এবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘আমি একটা ঠিকানা খুঁজছি। তুমি কি বলতে পারবে ওটা কোথায়?’
‘কিসের ঠিকানা খুঁজছেন? বলেন, আমি চিনিয়ে দিচ্ছি।’
পাঞ্জাবির পকেটে কিছু যেন খুঁজল লোকটা। নিরাশ হয়ে হাত বের করে এনে বলল, ‘হারিয়ে গেছে!’
‘কী হারিয়ে গেছে?’
‘ঠিকানা।’
‘মানে?’ বুঝতে পারে না বিপ্লব।
‘এই খোকা, তুমি কে?’ হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল লোকটা।
থতমত খেয়ে গেল বিপ্লব। কোনো কথা বের হলো না এ কথার জবাবে মুখ থেকে।
‘আমি কে?’ আবারও বলে উঠল লোকটা। কেমন অসংলগ্নভাবে কথা বলা শুরু করেছে এবার সে।
ভয় পেয়ে গেল বিপ্লব। পাগল-টাগল না তো?
‘কে আপনি?’
‘আমি?’ একটু যেন ভাবল। ‘কে আমি? এই খোকা, বলো না আমার নাম কী? আমি কোথায়?’
‘আপনার নাম মনে পড়ছে না? কোত্থেকে এসেছেন আপনি?’
‘আমি কোত্থেকে এসেছি? আমার নাম কী? এই, এই ছোড়া, বলছ না কেন আমার নাম কী?... ও, তুমি সেই লোক, তাই না? বুঝতে পেরেছি, আবারও ওটা নিতে এসেছ। কিন্তু কতবার তোমাকে বলেছি, ওটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। শুনছ না কেন আমার কথা? প্লিজ! আমাকে ছেড়ে দাও না! আমি আর দুষ্টুমি করব না। এই দেখ, আমি কান ধরছি। কান ধরে উঠবোস করছি। এক.. দুই... তিন....’ লোকটা সত্যি সত্যি কান ধরে উঠবোস শুরু করে দিল।
বিপ্লব কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এ কোন্ ঝামেলায় পড়ল সাত সকালে? লোকটাকে এভাবে ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না। আহারে, নিজের নামটাও ভুলে বসে আছে। কেউ নিশ্চয়ই টর্চার করেছে তাকে। হয়তো স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে।
এইসব ভাবছিল বিপ্লব। তাই খেয়াল করেনি লোকটা কখন ওর সাইকেল ধরে টানতে শুরু করেছে। খেয়াল হতেই এগিয়ে গেল ও। বলল, ‘এ কী, আপনি আমার সাইকেল ধরে টানছেন কেন?’
লোকটা শুনল বলে মনে হলো না। শুনলেও কোনো পাত্তা দিল না। মুখে বলে চলল, ‘এই তো আমার চান্দুর সাইকেল। আহারে, কত্ত ময়লা জমে আছে।’ নিজের পাঞ্জাবি দিয়ে মুছতে লাগল। তারপর হঠাৎ সাইকেল সামান্য উঁচু করে একটা আছাড় মারল।
বিপ্লব আর সহ্য করতে পারল না। লোকটাকে ধরে পাশে সরিয়ে দিল। তারপর সাইকেলটা উঠিয়ে ঘুরে তাকাল। বলল, ‘আপনি যেই হন না কেন, আর কোনো সহানুভূতি আমার কাছ থেকে পাবেন না। আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু আমার সাইকেলের কোনো ক্ষতি মেনে নিতে পারিনে।’
‘সহানুভূতি?’ যেন ব্যাঙ্গ করল লোকটা। ‘এটা আবার কী জিনিস? খায় না গায়ে মাখে?’
পিত্তি জ্বলে গেল বিপ্লবের। মনে মনে কয়েকটা কড়া কথা গুছিয়ে নিল বলার জন্য। কিন্তু তার আগেই লোকটা হঠাৎ ভো-দৌড় শুরু করে দিল। অবাক হলো ও। সাতসকালে ও এসব কিসের পাল্লায় পড়ল?
ধীরে ধীরে ধাতস্ত হলো বিপ্লব। তারপর আবারও সাইকেলে চেপে বসল।
দশ.
প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছিল বিপ্লবের। তাই একটা চায়ের দোকানে ঢুকে দু’টো সিঙ্গারার অর্ডার দিল। চেয়ারে বসতেই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বার। রিসিভ করল ও। হিমেল করেছে কল। জানাল, মিজানুল হাসানের উপর নজর রাখতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছে ও। তথ্যগুলো এখনই গোয়েন্দাপ্রধানের জানা উচিত। তারপর ও যা বলল তা এ রকমÑ মিজানুল হাসান অ্যাডিক্টেড। নিয়মিত হেরোইন নেয় সে। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিদিনই নিয়ম মেনে যায় সে। আরো অনেকেই যায় ওখানে। ওখানে যারা যারা যায়, তাদের নাম শুনলে বিশ্বাস হবে না যে ওরা এই মরণনেশায় নিজেদেরকে ভাসিয়ে দিতে পারে। নাম শুনে তাই সত্যিই আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল বিপ্লব। থম মেরে বসে রইল পাক্কা দুই মিনিট।
দোকানের ছেলেটা সিঙ্গারা দিয়ে চলে গেছে আগেই। এখন এসেছে আরো কিছু লাগবে কি না জানতে।
সম্বিৎ ফিরে পেল বিপ্লব। সিঙ্গারাই এখনো খাওয়া শেষ হয়নি। অন্য কিছুর অর্ডার দেবে কিভাবে? তাছাড়া হিমেল ওকে যে তথ্য জানালো, তাতে কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করল না। ঢকঢক করে পুরো গেলাসের পানি গিলে সিঙ্গারার দাম মিটিয়ে সাইকেলে চেপে বসল ও। নাজমুল হাসানের বাড়ির চারপাশটা একবার ঘুরে দেখতে হবে। সুযোগ মতো আশেপাশের লোকজনের কাছে কিছু বিষয়ে খোঁজও নিতে হবে।
বিপ্লব অবশ্য আগেই ধারণা করেছিল যে, মিজানুল হাসান লোকটা স্বাভাবিক না। তার দেহের দিকে তাকালে সেটা স্পষ্ট হয়। যারা নিয়মিত মাদক সেবন করে, তাদের শরীরটা ধুনকের মতো কিছুটা বেঁকে যায় সম্মুখে। চোখে-মুখে সবসময় একটা ঘোর ঘোর ভাব লেগে থাকে। কথাবার্তা প্রায়ই অসংলগ্ন হয়ে যায়।
আচ্ছা, আজ সকালে যে লোকটার সাথে ও ঢাক্কা খেয়েছিল, সেও কি অ্যাডিক্টেড? কে লোকটা? এই কেসে তার কী ভূমিকা? নাকি কাকতালীয়ভাবেই তার সাথে ওর ঢাক্কা লেগে গেছে? এই কেসের সাথে হয়তো লোকটার কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু কোনো সূত্রকেই ও হাতছাড়া করতে চায় না। লোকটা সম্পর্কেও তাই তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হতে পারে সে-ই এই কেসটা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবে। কেঁচো খুড়তেই তো সাপ বেরোয়।
সরাসরি নাজমুল হাসানের বাড়ির সামনে গেল না ও। কিছুটা ঘুরে রাস্তার ওপাশে সাইকেল দাঁড় করাল। এখানে একটা মুদি দোকান আছে। উদ্দেশ্য দোকানিকে কয়েকটা প্রশ্ন করা।
সামনে ঝুলিয়ে রাখা কলার ছড়া থেকে একটা কলা ছিড়ে নিল বিপ্লব। ও সাধারণত বাইরে থেকে কলা কিনে খায় না। কে জানে, কোন্ কলায় কেমিক্যাল দেয়া আছে। শেষে কোন্ বিষ পেটে ঢুকে যায়! কিন্তু দোকানির কাছ থেকে কথা আদায় করতে হলে কিছু একটা তো করতেই হবে। ভাব জমাতে হবে আগে।
এক কামড়ে প্রায় অর্ধেকটা কলা মুখে চালান করে দোকানিকে বলল, ‘দারুণ কলা তো? কোথাকার?’
খুশি হলো দোকানি। বলল, ‘আমার গ্রামের। ওখান থেকেই আনাই আমি। বাইরের কলা বিক্রি করি না। লোকে কিনতেও চায় না কেমিক্যাল দেয়া বলে।’
‘খুব ভালো। আপনার মতো সবাই যতি সতর্ক হতো তাহলে ভালো হতো।’ আরো একটা কামড় দিল কলায়। একটা বনরুটি নিল অন্য হাতে। ‘কতদিন আছেন এখানে?’
‘তা তো বছর আষ্টেক হবে।’
‘তাহলে তো এই এলাকার সবাইকে চেনেন আপনি। সবকিছুই জানা আপনার।’
‘তা বলতে পারেন। এলাকার সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার কাছ থেকে ছাড়া সওদাপাতি করে না।’
‘বাকিও দেন নিশ্চয়ই?’
‘কারবার করতে গেলে তো বাকি দিতেই হয়।’
‘শোধ করে তো সবাই ঠিক মতো?’
‘হ্যাঁ করে।’
‘কেউ শোধ দিতে ঝামেলা করে না?’
‘সবাই না, তবে দুই একজন তো করেই।’
‘তারপরও তাদেরকে বাকি দেন?’
‘কী করব বলো ভাই। গরিব মানুষ, ব্যবসা করে তো সংসার চালাতে হবে।’
‘বাড়িতে কে কে আছে আপনার?’
‘দুই মেয়ে এক ছেলে আর কালামের মা।’
‘কালামের মা বুঝি আপনার স্ত্রী?’
হেসে দিল দোকানি। উপর-নিচ মাথা নাড়ল।
‘বাকি শোধ করতে কে বেশি গড়িমসি করে?’
এই প্রশ্নের জবাব দিতে কিছুটা ইতস্তত করল দোকানি। আড়চোখে ঘন ঘন সামনের বাড়িটার দিকে তাকাল। বিপ্লব বুঝতে পারল ব্যাপারটা। বাড়িটা নাজমুল হাসানদের। ‘ওদেরকেও বাকি দেন?’
‘ও বাড়ির ছোটছেলেটা মাঝে মাঝে ঝামেলা বাঁধায়।’
‘ও বাড়ির সবাইকে চেনেন আপনি?’
‘চিনব না কেন? বাড়ির মালিক তো ফেরেশতার মতো মানুষ। ব্যাংকে চাকরি করত। এখন অবসর নিয়েছেন। আর বড় বউটাও খুব ভালো। আমাকে অনেকভাবে সাহায্য করেন।’
‘নাজমুল হাসান লোকটা কেমন?’
‘উনিও খুব ভালো মানুষ। কিন্তু...’
‘কিন্তু কী?’
‘মিজুটা একটা গুণ্ডা। নেশাখোর।’
‘মিজুটা কে? ও বাড়ির ছোট ছেলে বুঝি?’ বিপ্লব জানে, তারপরও কথা আদায় করার জন্য জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, পাজির পা-ঝাড়া একটা। অত ভালো মানুষের ও রকম একটা বদ সন্তান কিভাবে জন্মালো বুঝি না। ওর জন্য তো আমিনটা অকালেই চলে গেল।’ দোকানিকে কেমন মনমরা মনে হলো।
এই আমিনটা কে তা চিনতে পারল না বিপ্লব। জিজ্ঞেস করল, ‘এই আমিনটা কে?’
‘কামরুল সাহেবের মেজো ছেলে। সেও খুব ভালো ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, ছোট ছেলেটার কারণে অকালে মরে গেল। আহারে!’
‘কী হয়েছিল তার? কিভাবে মারা গেল আমিন?’
‘নেশা করে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন ছোটটা। মেজোটা সব জানিয়ে দিয়েছিল বাপকে। রাতে ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল। ওইদিন বোধহয় একটু বেশিই নেশা করেছিল। বাপকে খুন করার জন্য ছুরি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল। তাকে বাঁচাতে গিয়েই নিজে মরে গেল বেচারা!’
মুখের কাছে রুটি ধরা অবস্থায় স্থির হয়ে গেল বিপ্লবের। এ যে নাটক-উপন্যাসের গল্প! বিশ্বাস করতে পারছে না ও। নাজমুল হাসান এই বিষয়টা চেপে গেছেন। বুঝতে পারছে ইচ্ছে করেই চেপে গেছেন। কিন্তু কেন? তাহলে কি ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নেয়া ছাড়া আরো কোনো ব্যাপার আছে? পরিবারটাকে এখন বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে।

এগারো.
প্রথম দিনই বাড়িটা ঘুরে দেখার সময় জানালাটা দেখে গিয়েছিল বিপ্লব। ওই জানালাটাকে ঘিরেই তাই আজকের প্ল্যানটা সাজাল।
মামুন ও রাসেলকে যথারীতি মুরগি চোরের উপর নজর রাখতে বলে হিমেলকে নিয়ে রওনা দিল ও। মূলত ওই মুদি দোকানদারের সাথে কথা বলার পরই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরো বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে সে।
রাত নয়টা পার হয়ে গেছে। নাজমুল হাসানের বাড়ির চারপাশটা অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই বোধহয়। এটাই চাইছিল বিপ্লব। অপারেশন চালাতে অন্ধকারটা কাজে দেবে।
বাড়ির পেছনে চলে এসেছে হিমেলকে নিয়ে বিপু। বিকালে ফেরার পথে দেখে গিয়েছিল। ছোট্ট একটা ঝোপ মতো আছে এখানটাতে। ওর মধ্যেই সাইকেল লুকিয়ে রাখবে। তার আগে সাইকেলটা প্রাচীরে হেলান দিয়ে তাতে উঠে বসল বিপ্লব। উঠে বসল দেয়ালের উপরে। সাইকেলটা ঠেলে নিয়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে রাখল হিমেল। তারপর দেয়ালের সামনে এসে হাত দু’টো লম্বা করে উপরে মেলে ধরল। ঝুঁকে ওকে টেনে তুলল বিপ্লব। তারপর যতটা সম্ভব শব্দ না করে ভেতরে লাফিয়ে পড়ল। ওভাবেই পড়ে রইল মিনিট খানিক। বুঝতে চেষ্টা করল কেউ ওদেরকে দেখে ফেলেছে কি না। যখন নিশ্চিত হলো, না কেউ দেখেনি বা শব্দও শোনেনি, তখন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
জানালাটার কাছে চলে এলো ওরা। আস্তে করে উঁকি দিল। বন্ধ জানালা। ভেতরেও অন্ধকার। কাজেই কিছুই নজরে এলো না।
জানালাটার পাশ ঘেষে একটা পাইপ উঠে গেছে দো-তলায়। ওটা বেয়েই উঠতে হবে। বিসমিল্লাহ বলে শুরু করল বিপ্লব। বাড়িটা দো-তলা হওয়ায় খুব বেশি সমস্যা হলো না এবং দেরিও হলো না। এরপর হিমেলের পালা। একটু ইতস্তত করে ও-ও উঠতে শুরু করল। এ রকম কাজে আগে অভ্যস্ত নয় ও, তাই বেশ দিরি করে ফেলল। দুইবার তো হাত ফসকে পড়েও গেল। উপর থেকে সাহস জোগাল বিপ্লব।
ছাদে চলে এসেছে ওরা। এখন ছাদে ওঠার দরোজাটা খোলা থাকলেই হয়।
মোবাইল টর্চটা জ্বালল বিপ্লব। হ্যাঁ, ওদেরকে সহযোগিতা করতে দরোজাটা খোলা আছে।
ধীরে ধীরে নেমে এলো ওরা। এই সময় চারদিকে তীব্র ঝলক দিয়ে বাতি জ্বলে উঠল। ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে।
দেয়ালের সাথে নিজেদের শরীর সেধিয়ে নিল ছেলেরা। নেমে এলো দো-তলায়। এখানকার প্রত্যেকটা রুমই অন্ধকার। এরকমটিই থাকার কথা।
পরিকল্পনাটা আরেকবার ঝালিয়ে নিল বিপ্লব। মিজানুল হাসান কি ফিরেছে বাড়িতে? এত সকালে তো তার বাড়ি ফেরার কথা নয়।
সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলাতে নামার উদ্যোগ নিতেই কয়েকটা কথা কানে ঢুকল ওদের। থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো। আড়াল মতো পজিশন নিয়ে নিল।
না, কেউ এগিয়ে আসছে না। এবার তাই নিচে নামার সিদ্ধান্ত নিল বিপ্লব। ইশারায় হিমেলকে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে সিঁড়ির ধাপে পা রাখল বিপ্লব।
নেমে এলো নিচে। এবং দু’জনের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় কানে ঢুকতে লাগল ওর। কথাগুলো আসছে বামের রুমটা থেকে। ওটাই মিস্টার কামরুল হাসানের রুম, নাজমুল হাসান বলেছিলেন। ইলেকট্রিসিটি আসলেও এখানকার আলো জ্বালা হয়নি। তাতে বরং লাভই হলো গোয়েন্দাপ্রধানের। পা টিপে টিপে গিয়ে দাঁড়াল দরোজার পাশে। ভেতরে কথা কাটাকাটি চলছে। একজনের কথা চিনতে পারল ওÑ মিজানুল হাসান। এবং তখনই ঝাঁ করে একটা বিষয় মনে পড়ে গেল। এই কণ্ঠেই ওকে মোবাইলে হুমকি দেয়া হয়েছে। এখন স্পষ্ট চিনতে পারছে। ইশ্! নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হলো ওর। এটা আগে ধরতে পারেনি কেন? তাহলে হয়তো আরো আগেই কেসটার একটা সমাধান করা সম্ভব হতে পারতো।
দরোজায় সাবধানে কান পাতল বিপ্লব।
‘তুমি এটা কোনোভাবেই করতে পারো না বাবা।’ বলল মিজানুল।
‘আমাকে তুমি আর ভয় দেখিও না।’ বলল অন্য একটা কণ্ঠ। এই কণ্ঠের সাথে অপরিচিত বিপ্লব। কণ্ঠটার মধ্যে কেমন ভেঙে পড়ার সুর স্পষ্ট। ‘অনেক সহ্য করেছি আমি। আর না। আর একটি টাকাও তুমি পাবে না।’
‘কিন্তু টাকা তো আমার দরকার। তুমি তো জানোই, প্রতি সপ্তাহেই আমার অনেকগুলো টাকা লাগে। এই সপ্তায় একটি টাকাও তুমি আমাকে দাওনি। আমি বিভিন্নভাবে তা ম্যানেজ করেছি। কিন্তু আর সম্ভব নয়। এখন টাকা আমার লাগবেই।’
‘আমি বলেছি তো, আর একটি টাকাও আমি তোমাকে দেব না।’
‘কিন্তু টাকা কিভাবে আদায় করতে হয় তা তো আমার ভালোই জানা আছে বাপজান! আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করো না। বরং ভালোই ভালোই টাকাটা দিয়ে দাও। তাতে উভয়েরই লাভ।’
‘মিজু, এটা তুই বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। আয়, আমিই তোকে টাকা দিচ্ছি। উনাকে আর জ্বালাসনে।’
তৃতীয় একটি কণ্ঠ বলে উঠল এবার। এ কণ্ঠটা ওর পরিচিতÑ নাজমুল হাসান। অন্য কণ্ঠটা কি তাহলে...
বিপ্লবের ভাবনায় ছেদ পড়ল। নাজমুল বলে উঠল, ‘না বড় ভাই, তোমার কাছ থেকে আমি টাকা নেব না। উনিই আমাকে টাকা দেবেন। কারণ, উনিই আমাকে জন্ম দিয়েছেন। জন্মদাতা হিসেবে পুত্রের প্রতি একটা কর্তব্য আছে না!’ খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল সে।
হ্যাঁ, বাকি কণ্ঠটার মালিক ওদের বাবা কামরুল হাসানেরইÑ নিশ্চিত হয়ে গেল বিপ্লব। তারমানে নাজমুল হাসান যে বলেছিলেন উনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন...
এবারও ভাবনায় ছেদ পড়ল ওর। এবার কথা বলে উঠলেন কামরুল হাসান, ‘হ্যাঁ, জন্মদাতা হিসেবে পুত্রের প্রতি আমার কর্তব্য আছে। আমি ভুল করেছি সেই কর্তব্যটা পালন না করে। তোমাকে নূন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল আমার জন্মাবার পরপরই।’
‘বাবা তুমি এসব কী বলছ?’ নাজমুলের কণ্ঠ।
‘আপনি থামুন বাবা, প্লিজ!’ এবার মহিলা কণ্ঠ। নিশ্চয়ই নাজমুল হাসানের স্ত্রীর।
‘না বউমা, আমাকে বলতে দাও। আমি সত্যিই ভুল করেছি ওর মতো একটা কুলাঙ্গারকে জন্ম দিয়ে। ও আমাকে সারাজীবন জ্বালিয়ে আসছে। শেষ বয়সে এখনও ওর অত্যাচার আমার হাড়-মাংসকে ভস্ম করে দিচ্ছে। যখন যা চেয়েছে, তখনই তাই আমি ওকে দিয়েছি। কোনো কিছু দিতে কার্পণ্য করিনি। আজ তার এই প্রতিদান ও আমাকে দিচ্ছে। শোন্ নজি, সেদিন আমার কোনো চেক চুরি হয়নি। আমিই ওকে দিয়েছিলাম চেকটা ভাঙাতে। ও আমাকে বলেছিল একটা ব্যবসা শুরু করবে। কিন্তু আমি জানতাম না যে ও আমাকে আবারও ঠকাবে। এবার আমি আর সহ্য করব না। এবার...’
তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল মিজু, ‘না বাবা, তোমাকে যে আরো সহ্য করতে হবে। হ্যাঁ, যখন যা চেয়েছি তাই এনে দিয়েছ আমাকে। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে দিতে পারোনি। জানো সেটা কী? একটু মমতা মাখানো আদর। একটু মায়ের সোহাগ। মা-টা তো তোমার জন্যই আমাকে ছেড়ে চলে গেল।’
‘তোমার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী নই। সেই আমাকে চিকিৎসা করাতে দেয়নি।’
‘হ্যাঁ মা-ই তোমাকে চিকিৎসা করাতে দেয়নি। কিন্তু কেন দেয়নি? দেয়নি, কারণ তোমার টাকায় মা নতুন করে জীবন পেতে চায়নি।’
‘মিজু এবার থাম বলছি!’ ধমকে উঠলেন নাজমুল।
‘কেন থামব বড় ভাই? যা সত্যি তাই তো বলছি আমি। তুমিই বলো, ভাবি তুমিও বলো, আমি কি একটি কথাও মিথ্যা বলছি?’
‘মিজু, এসব বরং এখন থাক।’ বললেন ভাবি। ‘তুমি তো জানো বাবার শরীরটা এখন ভালো যাচ্ছে না। পরে না হয় একসময় এসব নিয়ে কথা বলা যাবে।’
‘না ভাবি। আমি এখনই শেষ করতে চায়। আমি আর পারছিনে। কলঙ্ক কতক্ষণ বয়ে বেড়ানো যায় বলো?’
‘কলঙ্ক? কিসের কলঙ্ক? বরং কলঙ্ক তো তুমিই আমাকে দিয়ে চলেছ প্রতিনিয়ত।’ কামরুল হাসানের গলার জোর বেশ কমে এসেছে। ‘প্রতিদিন রাতদুপুরে নেশা করে বাড়ি ফেরো, এটাই আমার কলঙ্ক। অকাজে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা খরচ করো, এটাই আমার কলঙ্ক। পাপ করেছি আমি, বড় পাপ করেছি। তোমাকে বেশি প্রশ্রয় দিয়েছি। তার প্রায়শ্চিত্ত তো এখন করতেই হবে।’
‘বাবা থাক না এসব এখন।’ অনুনয় ঝরে পড়ল নাজমুল হাসানের কণ্ঠে।
‘কেন থাকবে, কেন থাকবে? সংসার চালাতে দিনের পর দিন আমি কষ্ট করে গেছি। নিজে খেয়ে না খেয়ে আমি টাকা রোজগার করেছি। তোমাদেরকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। দুই তিনটে মাস্টার রেখে পড়িয়েছি। কিন্তু একটা জিনিস আমি করিনি। তোমাদেরকে শাসন করিনি। তোমাদের সকল অন্যায় আবদার আমি পূরণ করে চলেছি। কখনও বলিনি- এটা করতে নেই। এতে পাপ হয়ে। ওটা করলে মানুষের ক্ষতি হয়। নিজের আমল নষ্ট হয়ে যায়। আমি তোমাদেরকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। সেজন্য সব দোষ তো আমারই। হ্যাঁ হ্যাঁ আমারই। নজি, বউমা, আমি আর বাঁচতে চাই না। তোমাদের মা-ও ঠিক এই কারণেই বাঁচতে চায়নি। আর সহ্য করতে পারছিল না ওর অত্যাচার। তাই এক প্রকার স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথই বেছে নিয়েছে। এক কাজ করো, আমাকে এক শিশি বিষ এনে দাও। আমিও আর বাঁচতে চাইনে। আমি মরতে চাই। আমি মরতে চাই!’ হাহাকার করে উঠলেন কামরুল হাসান।
‘তুমি কেন নিজেকে নিজে মারবে?’ বলে উঠল মিজানুল। ‘তাহলে তো তোমার পাপের শাস্তি ভোগ করা হবে না। তুমি যেহেতু আমার মতো কুলাঙ্গারকে জন্ম দিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছ, কাজেই তোমাকে আমার হাতেই মরতে হবে।’
এরপর ধস্তাধস্তির শব্দ হলো।
বিপ্লব আর স্থির থাকতে পারল না। দরোজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। এবং প্রবেশ করে যা দেখল, তাতে ওর চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল।

বারো.
‘থামুন আপনারা!’ একটু পরেই বাঘের মতো গর্জন করে উঠল বিপ্লব। নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেল ও। এত গুরুগম্ভীর নিজের কণ্ঠ আগে কখনও শোনেনি।
যে যেভাবে ছিল, সেভাবেই স্থির হয়ে গেল সবাই।
চিত হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন কামরুল হাসান। তার উপর ঝুঁকে ছিল মিজানুল। নাজমুল ও তার স্ত্রী মিজানুলকে ছাড়াতে গিয়েছিলেন।
সবাই পেছন ফিরে বিপ্লবকে দেখল। পরক্ষণই আবার হুংকার ছাড়ল মিজানুল। আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার উপর।
‘আপনারা এটা কী করছেন?’ আবার চিল্লালো বিপ্লব। ‘এই যে মিস্টার হ্যাংলা মিজু সাহেব, আপনার সব অপকর্মের তথ্য-প্রমাণ আমার কাছে আছে। আপনি এটা করে নিজেকে কোনোভাবেই কিন্তু বাঁচাতে পারবেন না।’
এবার বাবাকে ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল মিজানুল। এগিয়ে এলো বিপ্লবের দিকে। বিপ্লব একটা ঢোক গিললেও চোখ বড় বড় করে মিজানুলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘অনেকভাবেই তোমাকে বারণ করেছিলাম।’ বলল মিজানুল। ‘কিন্তু তুমি শোনোনি। ঠিক ঠিক পৌঁছে গেছ। ঠিক আছে, এসেই যখন পরেছ, তখন লাস্ট সিনটা এবার আমিই পরিচালনা করব।’ বলে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
নাজমুল গেল পিছু পিছু। বিপ্লব এগিয়ে গেল কামরুল হাসানকে উঠতে সাহায্য করতে।
একটু পরেই ফিরে এলো মিজানুল। হাতে একটা ছুরি। প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা ফলাটা চিক চিক করছে ইলেকট্রিকের আলো পড়ে। নিজের অজান্তেই একটা ঢোক গিলল বিপ্লব। এটা দিয়ে ওকে মারবে নাকি লোকটা? বোঝায় যায় খেপাটে নেকড়ের মতো হয়ে গেছে। তার উপরে নেশাগ্রস্ত। কাজেই কী যে করে বসে তার কোনো ঠিক নেই।
‘দেখুন,’ বলল ও। ‘আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে আমি নাক গলাতে চাইনি। আপনারা না ডাকলে আমি আসতাম না এবং জানতেও পারতাম এখানে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে চলেছে।’
‘এখন আর ওসব বলে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না টিকটিকি।’ স্পষ্ট তীরস্কার ঝরে পড়ল মিজানুলের কণ্ঠে। তেরছাভাবে বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ‘অনেক বেশি জেনে ফেলেছ তুমি। কাজেই তোমাকে এখান থেকে জীবিত বের হতে দিতে পারিনে আমি। আমাকে যদি অতটাই বোকা ভেবে থাক, তাহলে চরম ভুল করে ফেলেছ। এখন তার মাশুল তো তোমাকে দিতেই হবে।’
ছুরি ধরা হাতটা সামনে বাড়িয়ে ধরে এগিয়ে আসতে লাগল মিজানুল বিপ্লবের দিকে। প্রমাদ গুনল বিপ্লব। চোখ বন্ধ করে ফেলল। পেটে ছুরির ফলা ঢোকার কষ্ট আর তীব্র একটা যন্ত্রণার জন্য অপেক্ষায় রইল। দম বন্ধ করে ফেলল। এই বুঝি ‘ঘ্যাঁচ’ করে ছুরির ফলাটা ওর পেটের চামড়া ভেদ করে ঢুকে গেল। হড়হড় করে বেরিয়ে এলো নাড়িভুড়ি আর রক্ত। অপেক্ষায় আছে ও।
হঠাৎ ‘ধাম’ করে একটা শব্দ হলো। আরো প্রায় দশ সেকেন্ড পর চোখ খুলল ও। হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে মিজানুল। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন কামরুল হাসান। হাতে একটা ফুলদানির ভাঙা অংশ।
ঘটনার আকস্মিকতায় বাকহারা হয়ে গেল বিপ্লব। এই সময়ই রুমে প্রবেশ করল হিমেল, মামুন ও রাসেল মাহফুজ। ওরা রুমে ঢুকে রুমের পরিবেশ দেখে স্টাচু হয়ে গেল।
এরপর আরেকটা শব্দ হলো। শব্দটা কিছু পতনের। সবাই দেখল, কামরুল হাসান ঢলে পড়ে গেছেন।

আবুল ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসেছে ছেলেরা। হিমেল যথারীতি একের পর এক সিঙ্গারা-পুরি সাবাড় করে চলেছে।
‘নাজমুল হাসান হঠাৎ কেন গোয়েন্দার সাহায্য নিতে চাইলেন?’ কথাটা জিজ্ঞেস করল রাসেল।
গতকাল রাতের ঘটনাটা নিয়েই আলাপ করছিল ওরা। ওটা নিয়ে বিপ্লবের কাছ থেকে পরিষ্কার জানার জন্যই এখানে জড়ো হয়েছে ছেলেরা।
‘তিনি ভেবেছিলেন হয়তো এতে মিজানুল হাসান তার ভুল বুঝতে পেরে ধ্বংসের পথ থেকে সরে আসবে।’ বলল বিপ্লব। ‘যখন জানতে পারবে ওদের ব্যাপারে গোয়েন্দা কাজ করছে, তখন হয়তো আর ওপথে যাবে না। আমার মনে হয় এই ক্ষীণ আশাটা দেখতে পেয়েই উনি আমার কাছে এসেছিলেন।’
‘সে না হয় বুঝলাম,’ বলল হিমেল, ‘কিন্তু উনি উনার পরিবারের অনেক কথায় চেপে গেলেন কেন? এই যেমন ওদের একটি ভাইয়ের অকালে মৃত্যু বরণ করার কথা, যেটার পেছনে মিজানুলের হাত আছে?’
‘এটার উত্তরও সহজ। তিনি চাননি ব্যাপারটা বেশি জানাজানি হয়ে যাক। কেউই চাইবে না তার কলঙ্কের কথা অন্যরা জেনে যাক। মিজানুল হাসান ছিল ওই পরিবারের জন্য একটি কলঙ্ক। আসলে সন্তানকে ছোটবেলা থেকে ঠিক মতো মানুষ করে তুলতে ব্যর্থ হলে তার দায় দায়িত্ব বাবা-মায়ের উপর এসেই বর্তায়। একসময় তারাও বুঝতে পারেন, কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে না। কাদাকে নরম অবস্থায় যেমন ইচ্ছে তেমন আকৃতি দেয়া যায়। কিন্তু তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেলে তা দিয়ে নিজের মন মতো কিছুই গঠন করা সম্ভব হয় না। কিছু বানাতে গেলেই ভেঙে যায়।’
এই কথায় পরিবেশটা কেমন ভারী হয়ে গেল। বুঝতে পেরে বিপ্লবই বলল আবার, ‘এই, তোমরা এমন মনমরা হয়ে গেলে কেন? আরে বাবা, আমরা তো আর অমন ছেলে না। আমরা বাবা-মায়ের প্রত্যেকটা কথা মেনে চলি। বড়দের সম্মান করি। আমাদের চেয়ে ছোটদের আদর-স্নেহ করি। সমবয়সীদের সাথে ভালো ব্যবহার করি। শিক্ষকরা আমাদের ভালোবাসেন। আমাদের বাবা-মা আমাদেরকে নিয়ে গর্ব করেন।’
মামুন বলল, ‘কিন্তু আমি তো সবসময় আমার মায়ের কথা শুনতে পারিনে। বিকেলে খেলার সময় মা কোনো কাজের কথা বললে আমি তো তা না করেই খেলার মাঠে চলে যায়, তাই না!’
‘দুর বোকা!’ ওর পিঠে আস্তে করে একটা থাবা মারল বিপ্লব। ‘এটা কিছুই না। এতে বাবা-মা কিছু মনে করেন না। তারা জানেন, সময়টা ছেলেমেয়েদের খেলার সময়। তাই একটু মন খারাপ করলেও মনে কষ্ট নেন না।’
‘মিজানুল হাসান লোকটা খুবই পাজি!’ মুখভর্তি গরম জিলাপি নিয়ে বলল হিমেল। ‘মানুষকে শুধু হুমকি দিতেই জানে।’
‘ওটা তো অনেকটা তার বাবার কারণেই হয়েছে। তিনি নিজেও স্বীকার করে গেছেন যে, তিনি তাকে যথার্থভাবে শিক্ষা দিতে পারেননি। নৈতিকতা শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। আসলে মানুষের মাঝে এই নৈতিকতার অভাবেই সারা দুনিয়াব্যাপী এত অশান্তি হচ্ছে।’
‘তোমরা যা-ই বলো,’ বলল রাসেল। ‘কামরুল হাসান লোকটার জন্য খুবই খারাপ লাগছে। তার মৃত্যুটা দেখ, কত অস্বাভাবিক। মসজিদ বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। অথচ সেই টাকাটা তিনি তার নেশাখোর ছেলেকে দিয়ে দিয়ে একটা নাটক সাজালেন। বোবা হয়ে যাওয়ার অভিনয় করলেন।’
‘তোমরা জেনে অবাক হবে,’ বিপ্লব বলল। ‘নাজমুল হাসানের ছেলেমেয়েরা নিজের ইচ্ছায় তাদের মামাবাড়ি যায়নি। নাজমুল হাসানই জোর করে ওদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে করে পরিবারের এই অশান্তি ওদেরকে স্পর্শ করতে না পারে।’
‘আমরা দোয়া করি এমন পারিবারিক অশান্তিতে যেন আর কোনো পরিবারকে ভুগতে না হয়, তাই না!’ বলে সবার মুখের দিকে তাকাল মামুন।
হেসে দিল সবাই।
হাসি থামিয়ে বিপ্লব বলল, ‘চলো, আজ রাতে আমরা পিকনিক করি।’
‘মুরগি চুরি করে?’ প্রশ্ন করল হিমেল।
‘আরে না, আমরা তো আর মিজানুল হাসানের মতো বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বাপের কাছ থেকে টাকা না পেয়ে মানুষের বাড়ি থেকে চুরি করা হাঁস-মুরগি দিয়ে পিকনিক করতে পারিনে। বেচারা তো এখন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আছে। সুস্থ হয়ে ফিরে এলেই হয়।’
‘চলো তাহলে এবার উঠা যাক।’ বলে উঠে দাঁড়াল রাসেল মাহফুজ।
উঠে দাঁড়াল অন্যরাও।
হিমেল বলল, ‘এবার ঈদটা তো এখানেই কাটাবে রাসেল, তাই না?’
রাসেল মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তোমাদের ছেড়ে এবার আমি একদমই ঈদ করতে পারব না।’
বিপ্লব তখন অন্য বিষয় ভেবে চলেছে। টানা স্কুল বন্ধ। একটা যা রহস্য পেয়েছিল, তার সমাধান তো শেষ করে ফেলল। এখন এতগুলো দিন কিভাবে কাটাবে? ইশ্! আরেকটা রহস্য যদি এই মুহূর্তে পেয়ে যেত, তাহলে ভালো হতো।
ওকে নতুন এক রহস্যের সূত্র দিতেই যেন অচেনা একটা নতুন নম্বর থেকে ওর মোবাইলে কল এলো। ও রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল রাজহাঁসের মতো একটা ফ্যাঁসফেসে কণ্ঠ- ‘হ্যাঁ গোয়েন্দা বিপু, এবার তৈরি হয়ে যাও চূড়ান্ত অধ্যায়ের জন্য।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ