হলুদ পিশাচ
উপন্যাস সেপ্টেম্বর ২০১০
রকিব হাসান এক. ‘আমি এখানে থাকতে চাই না, মা। প্লিজ, আমাকে ফেলে যেও না।’ মায়ের হাত আঁকড়ে ধরল অঞ্জন। ওর ভাল নাম রফিকুজ্জামান। ছোট দোতলা বাড়িটার সামনের সিঁড়ি থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করল মাকে। ফিরে তাকালেন মিসেস জামান, অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে ভ্রƒকুটি করলেন। ‘অঞ্জন, তোমার বয়স এখন বারো। যথেষ্ট বড় হয়েছ। ছেলেমানুষি কোরো না,’ হাতটা ছেলের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। ‘বড় হয়েছ, বড় হয়েছÑতোমার এই এক কথা শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল!’ রাগ করে বলল অঞ্জন। মায়ের মুখে স্নেহের হাসি ফুটল। ছেলের চুলে আঙুল বুলিয়ে আদর করতে গেলেন। ‘ছাড়ো, আমার এ সব ভাল্লাগে না!’ ঝাড়া দিয়ে মায়ের হাতটা সরিয়ে পিছিয়ে গেল অঞ্জন। আরেকটু হলেই বারান্দায় উঠার সিঁড়ি থেকে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল। ‘বেশ, আমাকে যখন দেখতেই পারো না...’ কথাটা শেষ না করে সিঁড়ির বাকি দুটো ধাপ উঠে সামনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন মা। দরজায় থাবা দিলেন। ছেলের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘ওখানেই থাকো।’ ‘আমি এলে অসুবিধে কী?’ ‘তোমার জুতোর ফিতে খোলা,’ মা বললেন। ‘তাতে কী? ফিতে খোলা রাখলে পরতে আরাম লাগে।’ ‘ফিতেয় পা পড়লে টান লেগে পড়ে যাবে,’ মা বললেন। ‘উফ্, মা,’ অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে চোখ ঘুরিয়ে বলল অঞ্জন, ‘জুতোর ফিতেয় পা দিয়ে কাউকে পড়তে দেখেছ?’ ‘না, তা দেখিনি,’ মৃদু হাসি ফুটল মা’র মুখে। ‘তুমি আসলে আসল বিষয়টা থেকে আমার মন সরিয়ে রাখতে চাইছ,’ মুখ গোমড়া করে অঞ্জন বলল। ‘সারা জীবনের জন্য ওই ভয়ানক বুড়িটার কাছে ফেলে যেতে চাইছ আমাকে...’ ‘ছিহ্, অঞ্জন! বড়দের সম্মান করে কথা বলো। দিলারা আন্টি ভয়ানক বুড়ি নন। তিনি তোমার বাবার ফুফু। তোমার দাদু...’ ‘আমি তাকে চিনি না,’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। বুঝতে পারছে বাড়াবাড়ি করে ফেলছে, কিন্তু সামলাতে পারছে না নিজেকে। এমন একটা কাজ কি করে করতে পারছে মা? কিভাবে এক বুড়ির কাছে ওকে ফেলে যেতে পারছে, যে মহিলাকে কোনদিন দেখেইনি ও? ওর মা ফিরে না আসা পর্যন্ত এতগুলো দিন কি করে কাটাবে এখানে? ‘অঞ্জন, অনেক বোঝানো হয়েছে তোমাকে,’ অধৈর্য ভঙ্গিতে মা বললেন। আবার কিল মারলেন সামনের দরজায়। ‘আর কোন উপায় থাকলে তোমাকে রেখে যেতাম না।’ এ সময় ঘেউ ঘেউ করে উঠল নেড়ি, অঞ্জনের কুকুর, ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মুখ বের করে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। ‘উহ্, কুকুরটাও এবার জ্বালাতন শুরু করল!’ কপাল চাপড়ালেন মিসেস জামান। ‘বের করে আনব ওকে?’ অধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। ‘আনো,’ মা জবাব দিলেন। ‘এভাবে চেঁচিয়ে দিলারা আন্টিকে এখন ঘাবড়ে না দিলেই বাঁচি।’ ‘আসছি, নেড়ি! চেঁচাস না,’ হাত নাড়ল অঞ্জন। খোয়া বিছানো ড্রাইভওয়ে ধরে ছুটল ও। ট্যাক্সির কাছে এসে দাঁড়াল। বিরক্ত চোখে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে ড্রাইভার। টান দিয়ে দরজা খুলল অঞ্জন। উত্তেজিত একটা হাঁক ছেড়ে, লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামল নেড়ি। ছোট জাতের বিদেশী কুকুর। ছোট আঙিনাটা জুড়ে পাক খেয়ে ছুটে বেড়াতে শুরু করল। ‘ওর কাণ্ড দেখে মনেই হয় না বুড়ো হয়েছে ও,’ দৌড়াতে থাকা কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন। এই প্রথমবারের মতো ওর মুখে হাসি দেখা গেল। ‘এই তো। ওটাই তো রয়েছে তোমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য,’ মা বললেন। ‘চোখের পলকে সময় কেটে যাবে, দেখো। মাত্র তো দুটো সপ্তাহ। ততদিনে আমি আর তোমার বাবা ঢাকায় একটা বাসা খুঁজে বের করে ফেলতে পারব। টেরই পাবে না কখন তোমাকে নিতে চলে এসেছি আমি।’ বড় এক টুকরো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল সূর্য। সামনের ছোট্ট আঙিনাটায় ঘন ছায়া পড়ল। ছায়াটা ভালো লাগল না কুকুরটার। তাড়াতাড়ি ফিরে এল হাঁপাতে হাঁপাতে। লম্বা জিভটা ঝুলে পড়ল দাঁতের ফাঁক দিয়ে। নিচু হয়ে ওটার পিঠ চাপড়ে দিল অঞ্জন। মুখ তুলে তাকাল দোতলার দিকে। দোতলার জানালায় পর্দা টানা। জানালার একটা পাল্লা কবজা থেকে খুলে গিয়ে কাত হয়ে ঝুলছে। কেমন বিষণœ মনে হলো বাড়িটাকে। দরজায় আবার থাবা দিচ্ছেন মা। ‘মা, থাবা দিচ্ছ কেন?’ প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল অঞ্জন। ‘তুমি না বলেছিলে দিলারা দাদু কানে শোনেন না?’ ‘ও, তাই তো,’ মুখ লাল হলো মার। ‘কী আর করব, ঘ্যানর ঘ্যানর করে মাথাটা এমনই গরম করে দিলে, ভুলে গিয়েছিলাম।’ কানে শোনে না, এমন একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে চোদ্দটা দিন কী করে কাটাব আমি, বিষণœ হয়ে আরেকবার ভাবল অঞ্জন। কথা বলব কী করে? কোন কিছুর প্রয়োজন হলেও তো চাইতে পারব না। অঞ্জনের বাবা জামান সাহেবের অবশ্য ছেলেকে এখানে থাকতে পাঠানোর ইচ্ছে ছিল না। বলেছেন, ‘ফুফু পাগল। ফুফা মারা যাওয়ার পর থেকেই কেমন বদলে গেছে। হঠাৎ করে কানটা গেল খারাপ হয়ে। একেবারেই কানে শোনে না। কালো একটা বিড়ালকে নিয়ে একা থাকে বাড়িতে। আশপাশের কারও সঙ্গে কথা বলে না। নিজের ব্যাপারেই উদাসীন, অঞ্জনের যতœ নেবে কী করে?’ দু’দিন আগে আড়াল থেকে বাবা আর মাকে আলোচনা করতে শুনেছে অঞ্জন। ‘এ ছাড়া আর তো কোন উপায়ও নেই আমাদের,’ মা বলেছেন। ‘আর কেউ নেই যার কাছে ওকে রেখে যাওয়া যাবে। আমরা থাকব হোটেলে, ওকে রাখব কোথায়? আলাদা রুমে রাখতে গেলে অনেক খরচ। তা ছাড়া আমরা বাসার খোঁজে ঘুরে বেড়াব ও তখন কী করবে? তুমিও আর ঢাকায় বদলি হওয়ার সময় পেলে না...’ ‘বদলিটা কি আমি ইচ্ছে করে হয়েছি? করা হয়েছে।’ ‘বাধা দিয়ে তো দেখতে পারতে।’ ‘করি চাকরি। বাধা দিয়ে কী করব? আর দিলেই কি আমার কথা শুনত। অনেক বছর তো নোয়াখালীতে থাকলাম। এর আগেও তিন বার বদলি ক্যানসেল করিয়েছি, তুমি জানো। এবার কিছুতেই শুনল না...’ ‘ভালমতো চেষ্টাই করনি। করলে কি আর শোনে না।’ হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবা। অঞ্জনের মার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, পারবেন না। বলেছেন, ‘ঠিক আছে, তোমার কথাই সই। আমি কাল চলে যাব। তুমি এখানকার কাজ সেরে, কুমিল্লায় ফুফুর বাসায় ওকে রেখে সোজা ঢাকায় চলে যেও।’ ‘তুমি অকারণ দুশ্চিন্তা কোরো না,’ নরম হলেন মা। ‘আমার মনে হয় ভালই লাগবে ওর, একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। অসময়ে মানুষকে কিভাবে মানিয়ে চলতে হয়, শেখাও তো দরকার...’ হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বিশালদেহী একজন মহিলা। বাধা পড়ল অঞ্জনের ভাবনায়। মহিলার হাতে একটা বড় গোশত কাটার ছুরি। তাতে রক্ত লেগে আছে। দুই. মহিলাকে দেখেই ঘেউ ঘেউ শুরু করল নেড়ি। পিছিয়ে যাচ্ছে। মিসেস জামান চুপ করে তাকিয়ে আছেন মহিলার দিকে। আতঙ্কিত চোখে হাঁ করে রক্তাক্ত ছুরিটা দেখছে অঞ্জন। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল মহিলার মুখে। কে এই মহিলা, বুঝতে অসুবিধে হলো না অঞ্জনের। ওর কল্পনার সঙ্গে মিলল না দাদু দিলারা বানুর চেহারা। দাদু শুনে কল্পনা করেছিল ছোটখাটো, ভঙ্গুর শরীরের, ধবধবে সাদা চুলওয়ালা একজন বৃদ্ধা। কিন্তু সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা মস্ত শরীর, চওড়া কাঁধ, কালো কুচকুচে চুল দেখে অবাক হলো ও। বয়স খুব বেশি না দাদুর, এখনও চুলও পাকেনি। দাদুর পরনে সালোয়ার-কামিজ, দেখতে অনেকটা পাঞ্জাবি মহিলাদের মত লাগছে। কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে যাওয়া চুলগুলোকে রবার ব্যান্ড দিয়ে ঘোড়ার লেজের মত করে বেঁধেছেন। বড় বড় গোল চোখের মণি বিড়ালের চোখের মত কটা। ‘রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ট্যাক্সিটা দেখেই বুঝেছি তোমরা এসেছ,’ মিসেস জামানকে বললেন তিনি। ‘জামানের চিঠি পেয়েছি আমি।’ অঞ্জনকে ভয়ে ভয়ে ছুরিটার দিকে তাকাতে দেখে বললেন, ‘গোশত কাটছিলাম। গরুর গোশত।’ হাতের ছুরিটা ওর দিকে তাক করে বললেন, ‘কি, গরুর গোশত ভাল লাগে তোমার?’ ‘অ্যাঁ...হ্যাঁ,’ কোনমতে জবাব দিল অঞ্জন। ছুরি হাতে দিলারা দাদুকে দেখে যে দুরুদুরু শুরু হয়েছিল বুকের ভেতর, সেটা এখনও থামেনি। দরজার পাল্লাটা পুরো খুলে দিলেন দাদু। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দ্বিধা করছে অঞ্জন আর ওর মা। ‘ওর তো বেশ বাড়ন্ত শরীর,’ অঞ্জনকে দেখিয়ে ওর মাকে বললেন দাদু। ‘বয়সের তুলনায় ভালই বেড়েছে। ওর বাবার মত ইট্টুক নয়। ছোটবেলায় ওর বাপ এতই খুদে ছিল, আমি ওকে মুরগির ছানা ডাকতাম।’ হাসলেন তিনি। পায়ের কাছে রাখা অঞ্জনের সুটকেসটা তুলে নিলেন মিসেস জামান, অস্বস্তিভরা চোখে ফিরে তাকালেন ছেলের দিকে। ‘হ্যাঁ...বয়সের তুলনায় লম্বাই হয়ে গেছে, তবে গায়ে কিছু নেই, দেখছেন না।’ ‘ঠিক আছে, রেখে যাও। গরুর গোশত খাইয়ে ওকে আমি মোটা করে দেবো,’ দাদু বললেন। ‘এই দেখো, আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি। এসো, এসো।’ মায়ের পেছন পেছন হলরুমে ঢুকল অঞ্জন। ওর পায়ের কাছে থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে এল নেড়ি। ‘কুকুরটাকে থামাতে পারো না?’ মা বললেন। ‘অসুবিধে নেই, বুড়িটা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না,’ অঞ্জন জবাব দিল। ‘চুপ। বলেছি না, অভদ্রের মত কথা বলবে না।’ রান্নাঘরে গিয়ে হাত থেকে ছুরিটা রেখে ফিরে তাকালেন দাদু। তাঁর কটা চোখের দৃষ্টি স্থির হলো অঞ্জনের ওপর। অঞ্জনকে ভালমত দেখলেন। ‘তাহলে গরুর গোশত পছন্দ করো তুমি?’ আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি। মাথা ঝাঁকাল অঞ্জন। ‘ভাল,’ মহিলা বললেন। ‘তোমার বাবাও গরু পছন্দ করে। তবে রান্না করা গোশতের চেয়ে গোশতের বড়া খেতে ভালবাসে ও।’ ‘আমারও বড়াই ভাল লাগে,’ বলল অঞ্জন। মনে পড়ল, দাদু কানে শোনেন না। মিসেস জামানকে জিজ্ঞেস করলেন দাদু। ‘তোমার ছেলে কোন ঝামেলা করে না তো?’ ‘না, করে না,’ মাথা নাড়লেন মিসেস জামান। ‘সুটকেসটা কোথায় রাখব?’ শুনতে পাননি দাদু। তাই জবাব দিলেন না। অঞ্জনের গাল টিপে আদর করে দিয়ে বললেন, ‘দেখে তো ভাল ছেলেই মনে হচ্ছে। চেহারাটাও সুন্দর। দুষ্টুমি করে না তো?’ ওর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন দাদু। ‘কি, করো না তো? দুষ্টুমি না করলে, শান্ত হয়ে থাকলে, তোমাকে আমি গোশতের বড়া বানিয়ে খাওয়াব,’ মস্ত থাবা দিয়ে ঘোড়ার লেজের মত চুল মুঠো করে ধরে টানলেন দাদু। ‘গোশত দিয়ে বানানো সামুসা পছন্দ করো? তা-ও খাওয়াব। তোমার বাবাকেও খাওয়াতাম। কিন্তু তোমার বাবা আমাকে দেখতে পারত না। মুরগির ছানাটা আমার সম্পর্কে তোমাকে কী বলেছে, অঞ্জন? নিশ্চয়ই বলেছে, আমি একটা ভয়াবহ ডাইনি বুড়ি, তাই না?’ ‘না না, বাবা কিছু বলেনি,’ বলে অসহায়ের মত মায়ের দিকে তাকাল অঞ্জন। ‘আসলেই আমি ডাইনি বুড়ি!’ দাদু বললেন। নিজের রসিকতায় নিজেই হা-হা করে হাসলেন। হাসিটা ঘাবড়ে দিল নেড়িকে। ঘেউ ঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠে অঞ্জনের দাদুর পায়ে কামড়াতে গেল। লাথি মেরে কুকুরটাকে সরিয়ে দিলেন দাদু। চোখের পাতা সরু করে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, ‘খবরদার, কুত্তা, বেশি শয়তানি করলে তোকে কেটেই গোশতের বড়া বানাব আমি!’ কুঁই কুঁই করে খাটো লেজটা নেড়ে পিছিয়ে গেল নেড়ি। বুঝে গেছে, এই মহিলাকে ভয় দেখাতে পারবে না। ‘এটা?’ সুটকেসটা উঁচু করে দেখালেন মিসেস জামান। ‘দোতলায় নিয়ে যাও, স্টাডিতে ওর থাকার ব্যবস্থা করেছি,’ বলে আঙুল তুলে ওপর দিকে দেখালেন দাদু। ‘আমার কাজ আছে। তোমাদের খাবার দিতে হবে।’ ‘না, আমি খাব না। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। অঞ্জনের জিনিসপত্রগুলো গোছগাছ করে দিয়ে চলে যাব...’ দাদু কানে শোনেন না মনে পড়াতে থেমে গেলেন। রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন দাদু। অঞ্জন বলল, ‘তুমি যা-ই বলো, মা, বুড়িটা আজব!’ ‘আহ্, একজন ভদ্র মহিলার সম্পর্কে এভাবে বলো না তো! তোমার এত খারাপ লাগছে কেন বুঝলাম না। আমার তো ভালই লাগছে।’ একটু থেমে মা বললেন। ‘শোনো, সময় কাটানো নিয়ে ভাবছ তো? এখানে তোমার বয়সী অনেক ছেলে পাবে। ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিলেই আর একা একা লাগবে না।’ ‘কিন্তু দাদু আমাকে যদি ঘরে বসিয়ে রাখে?’ ‘তা কেন রাখবেন? তিনিও চাইবেন না, তোমার বয়সী একটা ছেলে সারাণ বাড়িতে বসে থাকুক।’ ‘হুঁ!’ কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারল না অঞ্জন। আচমকা ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন মা, নিচু হয়ে গালে গাল ঠেকালেন। কিন্তু অঞ্জনের মুখে হাসি ফুটল না। কিছু না বলে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইল। ‘আমি চাই, তুমি গুডবয় হয়ে থাকো,’ আবার বললেন তিনি। ‘যাতে ফিরে এসে আমি শুনতে পাই, তিনি বলেন, অঞ্জন খুব ভাল ছেলে।’ মাকে আর দুঃখ দিতে চাইল না অঞ্জন। ‘চলো, সুটকেসটা আমার ঘরে নিয়ে যাই।’ জিনিসপত্রে ঠাসা ভারী সুটকেসটা। সরু সিঁড়ি দিয়ে বয়ে নিয়ে এল দু’জনে মিলে। স্টাডিটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হলো না। দরজা খোলাই আছে। ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বড় বড় বইয়ের তাক, পুরনো আমলের শক্ত মলাটে বাঁধাই বইয়ে ঠাসা। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা মেহগনি কাঠের টেবিল। পর্দা টানা একমাত্র জানালাটার নিচে সরু একটা খাট রাখা। জানালাটা দিয়ে পেছনের আঙিনা দেখা যায়। লম্বা এক চিলতে আয়তাকার জায়গা, সবুজ ঘাসে ঢাকা; বাঁ পাশে টিনের চালা লাগানো গ্যারেজÑএক সময় গাড়িটাড়ি ছিল বোধহয়, এখন নেই। ডান পাশে উঁচু খুঁটির বেড়া। আঙিনার পেছন দিকে তারের জাল দিয়ে ঘেরা খানিকটা জায়গা। ঘরের বাতাসে ছত্রাকের গন্ধ। তার সঙ্গে ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ মিশে রয়েছে। মার দিকে তাকাল অঞ্জন। সুটকেস খুলে জিনিসপত্র বের করে গোছাচ্ছেন মা, আর বারবার অস্থির ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখছেন। তাড়াহুড়া করে কাজ শেষ করলেন। ‘আমি যাই,’ মা বললেন। আরেকবার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। হাতব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে গুঁজে দিলেন অঞ্জনের শার্টের পকেটে। ‘নাও, নিজের পছন্দমতো কিছু কিনে নিও। ভাল থেকো। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে নিতে ফিরে আসব।’ হাত নেড়ে মাকে বিদায় জানাল অঞ্জন। বুকের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, যেন ডানা নেড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য প্রজাপতি। গলার ভেতরটা শুকনো খসখসে। ‘ঢাকা থেকে ফোন করব আমি,’ বেরিয়ে যাবার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে মা বললেন। তারপর, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া মায়ের জুতোর শব্দ শুনল অঞ্জন। চাপা একটা বিষণœ হাঁক ছাড়ল নেড়ি, যেন বুঝতে পারছে, এই আজব বাড়িটাতে এক আজব মহিলার সঙ্গে ফেলে যাওয়া হয়েছে ওদের। এখানে কোন আনন্দ নেই। জানালার দিকে এগোল অঞ্জন। এক হাতে পর্দাটা সরিয়ে ধরে রাখল। ছোট, সবুজ আঙিনাটার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের দুরুদুরু কমছে না। কয়েক মিনিট পর মার ট্যাক্সিটা দেখতে পেল খোয়া বিছানো পথে। ফিরে যাচ্ছে। রাস্তার বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল ট্যাক্সি। ইঞ্জিনের শব্দও যখন মিলিয়ে গেল, জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ধপ করে খাটে বসে পড়ল অঞ্জন। বইয়ের তাকগুলোর দিকে তাকাল অঞ্জন। সারাটা দিন এখানে কী করব আমি? দুই হাতে মাথা চেপে ধরে নিজেকে প্রশ্ন করল ও। ভিডিও গেম নেই। কম্পিউটার নেই। এমনকি একটা টেলিভিশনও নেই। কী করে সময় কাটাব আমি? আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে, খাট থেকে উঠে বইয়ের তাকের কাছে এসে দাঁড়াল ও। বইগুলোর নাম দেখতে লাগল। বিজ্ঞানের ওপর লেখা প্রচুর বই রয়েছে। জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, ডাক্তারিবিদ্যাসহ পুরনো মিসরের ওপর লেখা নানা রকম বই, যার বেশির ভাগই পুরনো, ধুলোয় ঢাকা। হলদে হয়ে গেছে পাতা। ব্ল্যাক ম্যাজিকের ওপর কয়েকটা বই দেখে অবাক হলো অঞ্জন। ভাবছে, কার বই এগুলো? দাদার? তিনি কি বিজ্ঞানী ছিলেন? গবেষণা করতেন? কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে ব্ল্যাক ম্যাজিকের সম্পর্ক কী? নিজের পড়ার মত কোন বই না দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল ওর। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল বড় আলমারিটার দিকে। টান দিয়ে দরজা খুলল। কী যেন লাফিয়ে পড়ল মাথায়। ভীষণ চমকে গিয়ে ‘আউ!’ করে উঠল অঞ্জন। ভয়ে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল ও। তিন. মাথায় কী পড়েছে বুঝতে সময় লাগল না। বিড়াল! আলমারির ওপর শুয়ে নিশ্চয় ঘুমাচ্ছিল, দরজা খোলার শব্দে ভয় পেয়ে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছে। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে অঞ্জনের হৃৎপিণ্ডটা। টান দিয়ে মাথার ওপর থেকে ফেলে দিল বিড়ালটাকে। ক্রুদ্ধস্বরে ফোঁসফোঁস করছে ওটা। দরজার দিকে এগোল। ফিরে তাকিয়ে অঞ্জন দেখে, দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন দাদু। মুখে কৌতুকের হাসি। কখন এসে দাঁড়িয়েছেন ওখানে, জানে না অঞ্জন। ‘কুসি, আলমারির ওপর কী করছিলে?’ বিড়ালটাকে জিজ্ঞেস করলেন দাদু। ‘অকারণে ভয় দেখালে ছেলেটাকে।’ পোষা বিড়ালকে তুমি করে বলছেন! অবাক লাগল অঞ্জনের। মিউ মিউ করে দাদুর পায়ে গা ঘষল বিড়ালটা। ‘ভয় পেয়েছ, অঞ্জন?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন দাদু। ‘না,’ জোর নেই অঞ্জনের গলায়, ‘ভয় পাইনি, তবে চমকে গিয়েছিলাম।’ ‘কুসির ব্যাপারে সাবধান। ভীষণ পাজি ও, এক নম্বরের শয়তান,’ আবার বললেন দাদু। নিচু হয়ে ঘাড়ের চামড়া খামচে ধরে উঁচু করলেন বিড়ালটাকে। ঝুলিয়ে রেখে নাড়তে থাকলেন। বিড়ালটাকে শূন্যে ঝুলতে দেখে, তীè হাঁক ছাড়ল নেড়ি। ভাবল, অসহায় হয়ে গেছে, এখন ভয় দেখানো যাবে। খাটো লেজটা জোরে জোরে নেড়ে লাফিয়ে উঠে বিড়ালটাকে ধরার চেষ্টা করল। না পেরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। আবার লাফ দিল। আবার মিস করল। আবার লাফ। বিড়ালটার ঝুলে থাকা লেজ কামড়ানোর চেষ্টা করছে। ‘এই নেড়ি, থাম! থাম বলছি!’ চেঁচিয়ে ধমক দিল অঞ্জন। দাদুর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে বিড়ালটা। শরীর মুচড়ে, নানাভাবে কসরত করেও ছুটতে না পেরে, রাগে চিৎকার করে উঠল। কালো থাবা বাড়িয়ে আঁচড়ে দিতে চাইল হাতে। বিড়ালটাকে এমন করতে দেখে আরও জোরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল কুকুরটা। টেনে ওটাকে সরিয়ে নিল অঞ্জন। বিড়ালটাকে হাত থেকে ছেড়ে দিলেন দাদু। চারপায়ে লাফিয়ে নামল ওটা মেঝেতে, সুড়–ৎ করে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। ‘অ্যাই পাজি কুত্তা, চুপ কর!’ নেড়িকে ধমক দিলেও বিড়ালটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোয় খুশিই হয়েছে। এখনও আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছেন দাদু। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ‘কুত্তাটাকে আনো এদিকে,’ নিচুস্বরে বললেন তিনি। সরু হয়ে গেছে চোখের পাতা। ফ্যাকাশে ঠোঁট দুটো চেপে বসেছে। ‘অ্যাঁ?’ নেড়িকে চেপে ধরল অঞ্জন। ‘আনো ওটাকে,’ শীতল কণ্ঠে বললেন দাদু। ‘বেয়াড়া জানোয়ারকে ঘরের ভেতর জায়গা দিতে রাজি নই আমি। একটাকে দিয়েই যথেষ্ট শিা হয়েছে।’ একটা মানে, নিশ্চয় বিড়ালটার কথা বলছেন দাদু। ‘কিন্তু...’ বলতে গিয়ে থেমে গেল অঞ্জন, মনে পড়ল, দাদু কানে শোনেন না। ‘কুসি একটা শয়তান,’ কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হলো না দাদুর, মুখের ভাবও নরম হলো না। ‘ওটাকে রাগানো ঠিক নয়।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলেন তিনি। ‘নিয়ে এসো কুকুরটাকে।’ দুই হাতে শক্ত করে কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখে দ্বিধা করছে অঞ্জন। ‘কুকুরটার ব্যবস্থা আমাকে করতেই হবে,’ কঠিন কণ্ঠে দাদু বললেন। ‘নিয়ে এসো।’ ভয় পেয়ে গেল অঞ্জন। ‘ব্যবস্থা করতে হবে’ বলে কী বোঝাতে চেয়েছেন দাদু? রক্তাক্ত ছুরি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দাদুর চেহারাটা কল্পনায় দেখতে পেল অঞ্জন। চার. আর কোনও উপায় নেই দেখে, বাধ্য ছেলের মত নেড়িকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামল অঞ্জন। দাদুকে অনুসরণ করে চলে এল পেছনের আঙিনায়। ‘তৈরিই ছিলাম আমি,’ ফিরে তাকিয়ে অঞ্জন আসছে কি না দেখে নিয়ে বললেন তিনি। ‘যখনই শুনেছি, কুকুর নিয়ে আসবে, বানিয়ে রেখেছি এটা।’ তারের জালে ঘেরা জায়গাটার দিকে এগোনোর সময় অঞ্জনের হাত চেটে দিল নেড়ি। ‘এটা তোমার কুকুর রাখার জায়গা।’ ‘ওই খোঁয়াড়টা?’ ‘খোঁয়াড় দেখলে কোথায়? এত সুন্দর বেড়া, নতুন তারের জাল কিনে বানালাম।’ জালের ঘেরের ভেতর ঢুকে একটা লম্বা দড়ি দেখিয়ে বললেন, ‘ওটা দিয়ে কুত্তাটার কলারে বাঁধো। এখানে থাকতে খারাপ লাগবে না ওর।’ বাঁকা চোখে কুকুরটার দিকে তাকালেন তিনি। ‘কুসির সঙ্গেও টক্কর লাগবে না। আমি চাই না, সারাণ বিড়ালটার সঙ্গে ও মারামারি করুক।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অঞ্জন। জানে এই খোঁয়াড়ে বন্দী থাকতে ভাল লাগবে না কুকুরটার। কিন্তু কোন উপায়ও নেই, জানে অঞ্জন। দাদুর সঙ্গে তর্ক করে লাভ হবে না, আর তর্ক করবেই বা কিভাবে, কানেই তো শোনেন না। তিনি যা বলবেন একতরফাভাবে সেটাই মেনে নিতে হবে। কুকুরটার কলারে দড়ির এক মাথা বাঁধল ও। নেড়ির মাথায় হাত রেখে আদর করে দিয়ে সোজা হয়ে দাদুর দিকে তাকাল। বুকের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি রেখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কটা চোখের তারা উজ্জ্বল রোদে জ্বলছে। ঠাণ্ডা হাসি ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে। অঞ্জনের মনে হলো, বিজয়োল্লাস। দাদুর আচরণ খুব অদ্ভুত লাগছে ওর কাছে। ‘এই তো সোনা ছেলে,’ অঞ্জনকে উঠে আসার সময় দিলেন দাদু। ‘তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম। এসো, ঘরে এসো। খাওয়া হয়নি নিশ্চয় অনেকণ।’ অঞ্জনকে চলে যেতে দেখে করুণ চিৎকার করে উঠল নেড়ি। ফিরে তাকাল অঞ্জন। খপ করে লোহার মত শক্ত আঙুলে ওর হাত চেপে ধরে, বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে চললেন দাদু। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ছোট্ট রান্নাঘরটায় জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা টেবিলে অঞ্জনকে বসতে ইশারা করলেন দাদু। একটা খোপ খোপ ছাপ দেয়া প্ল্যাস্টিকের চাদরে ঢাকা টেবিলটা। নাস্তা এনে টেবিলে রাখতে রাখতে অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে ভ্রƒকুটি করলেন তিনি। তীè দৃষ্টিতে দেখছেন। দুধ আর বিস্কুট খাওয়া শেষ করে দাদুর দেয়া একটা পেপার ন্যাপকিন দিয়ে ওপরের ঠোঁটে লেগে থাকা দুধ মুছল অঞ্জন। ‘নেড়িকে নিয়ে হাঁটতে যাচ্ছি আমি।’ একভাবে তাকিয়ে আছেন দাদু। কোন ভাবান্তর নেই চেহারায়। ও। অকারণে বললাম, দাদু তো আমার কথা শুনতে পায় না, ভাবল অঞ্জন। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে নেড়ির দিকে ইঙ্গিত করে, দুই আঙুল টেবিলে রেখে হাঁটিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল কী করতে চায়। বুঝলেন দাদু। মাথা ঝাঁকালেন। উফ্, কী যন্ত্রণা, ভাবল ও। বধির মানুষকে কিছু বোঝানো বড় কঠিন। হাত নেড়ে দাদুকে গুড-বাই জানিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল অঞ্জন, নেড়িকে ওর কারাগার থেকে বের করার জন্য। কয়েক মিনিট পর, শিকল টেনে নিয়ে পথের মোড়ের গাছগুলোর গোড়া শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে চলল নেড়ি। জায়গাটা বেশ সুন্দর। আবাসিক এলাকা। রাস্তার পাশে আরও বাড়িঘর আছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সামনে চারকোনা আঙিনা। একটা বট গাছকে ঘিরে ছোটাছুটি করে খেলতে দেখল কয়েকটা ছেলেকে। একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ধুচ্ছেন বাগানের হোস পাইপের সাহায্যে পানি ছিটিয়ে। মোটা একটা গাছের গুঁড়ির চারপাশে ঘুরে কী যেন শুঁকতে শুঁকতে উল্টো দিকে এগিয়ে যেতে চাইল নেড়ি। কোনমতেই কথা শোনাতে না পেরে নিচু হয়ে ওটাকে তুলে নিতে যাবে অঞ্জন, খপ করে কে যেন ওর কাঁধ চেপে ধরল। ‘এই, কী নাম তোমার?’ কানের কাছে বলে উঠল একটা অপরিচিত কণ্ঠ। পাঁচ. চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অঞ্জন দেখল, ওরই বয়সী একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখছে ওকে। ‘ওভাবে আমার কাঁধ চেপে ধরলে কেন?’ এখনও ধড়াস ধড়াস করছে অঞ্জনের বুকের ভেতর। ‘তোমাকে ভয় দেখাতে,’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘ও!’ আর কোন কথা খুঁজে পেল না অঞ্জন। আচমকা শিকলে হ্যাঁচকা টান মেরে আরেকটু হলেই ওকে ফেলে দিচ্ছিল নেড়ি। হেসে উঠল ছেলেটা। খাটো করে ছাঁটা চুল। হাসি মুখে তাকিয়ে আছে অঞ্জনের দিকে। গায়ে বড় মাপের ঢলঢলে লাল রঙের টি-শার্ট, পরনে কালো প্যান্ট আর পায়ে উজ্জ্বল হলুদ রঙের নাইক জুতো। ‘তুমি কে বললে না তো?’ আবার জিজ্ঞেস করল ছেলেটা। খুব সহজ আচরণ। কোন রকম জড়তা নেই ছেলেটার। ‘কে আবার?’ আচমকা কাঁধ চেপে ধরায় রাগ যায়নি অঞ্জনের। ‘আমি, আমি।’ শিকল টেনে গাছের গুঁড়ির চারপাশে ঘোরাচ্ছে ওকে নেড়ি। ‘বেড়াতে এলে নাকি?’ অঞ্জনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল ছেলেটা। ‘হ্যাঁ।’ ‘কাদের বাড়িতে?’ ‘দিলারা বানু। ওই যে, রাস্তার মাথার সতেরো নম্বর বাড়ি...’ ‘চিনি ওনাকে। উনি তোমার কী হন?’ ‘দাদু।’ ‘আপন দাদু? তাঁর তো কোন ছেলেপুলে আছে বলে শুনিনি।’ ‘উনি আমার বাবার ফুফু।’ ‘ও। তা থাকবে তো কিছু দিন?’ ‘হ্যাঁ, হপ্তা দুয়েক। ...ওটা তোমার সাইকেল?’ ছেলেটার পেছনে একটু দূরে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা একটা লাল সাইকেল দেখাল অঞ্জন। ‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘খুব সুন্দর,’ অঞ্জন বলল। ‘ওরকম একটা সাইকেল আমারও আছে।’ ‘তোমার কুকুরটাকে আমার পছন্দ হয়েছে,’ নেড়ির দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। ‘কেমন বোকা বোকা। বোকা কুকুরদের আমার পছন্দ।’ ‘আমারও,’ হাসল অঞ্জন। ‘ওর নাম কী? নামটাও কি বোকা বোকা?’ ঝুঁকে নেড়ির পিঠ চাপড়ে আদর করতে গেল ছেলেটা, কিন্তু সরে গেল কুকুরটা। ‘ওর নাম নেড়ি।’ ‘হ্যাঁ, বোকা বোকাই তো,’ বলল ছেলেটা। ‘ভীষণ বোকা নাম। বিশেষ করে একটা বিদেশী কুকুরের।’ ‘নামটা অবশ্য আমি রাখিনি,’ অঞ্জন বলল। ‘বাবা রেখেছেন। ও যখন আমাদের বাড়িতে এল, আমিও খুব ছোট, কারও নাম রাখার মতো বয়সই হয়নি আমার।’ আবার হাত বাড়াল ছেলেটা। সাহস করে ওর হাত শুঁকল নেড়ি, এত জোরে লেজ দোলাচ্ছে, শরীরটাও দুলছে ভীষণভাবে, লম্বা জিভটা বেরিয়ে প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। ‘আমার নামটাও কিন্তু বোকা বোকা শোনায়,’ বলে অঞ্জনের জিজ্ঞেস করার অপোয় রইল ছেলেটা। ‘কী নাম?’ জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। ‘ইপু,’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘কই বোকা বোকা, সুন্দর নাম।’ ‘কিন্তু আমার ভাল লাগে না,’ প্যান্টে লেগে থাকা একটা শুকনো ঘাসের ডগা টোকা দিয়ে ফেলল ইপু। ‘মেয়েদের নাম মনে হয়।’ ‘নাহ্, ইপু তো আজকাল হরদম ছেলেদের নাম রাখা হচ্ছে। আমার নাম...’ বাধা দিল ইপু, ‘বোকা বোকা নাকি?’ ‘কী জানি!’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল অঞ্জন। ‘তবে স্কুলে কেউ কেউ খেপায় অঞ্জন, ঝনঝন, বলে।’ ‘অঞ্জন, ঝনঝন,’ খিলখিল করে হাসল ইপু। ‘ভালই তো। বেশ ছন্দ আছে। কিন্তু বোকা বোকা নয়।’ খুশি হলো অঞ্জন। ওকে যে বোকা ভাবেনি ছেলেটা, তাতে স্বস্তি বোধ করল। ধীরে ধীরে বিষণœতা কেটে যাচ্ছে। ‘এখন কি হাঁটতে বেরোলে?’ জিজ্ঞেস করল ইপু। ‘হ্যাঁ, আশপাশটা ঘুরে দেখছি।’ ‘এখানে দেখার কিছু নেই,’ ইপু বলল। ‘আবাসিক এলাকা। শুধু বাড়িঘর। বড়ই একঘেয়ে। মার্কেটে যেতে চাও? বেশি দূরে না।’ হাত তুলে মার্কেটটা কোনদিকে দেখাল ও। দ্বিধা করল অঞ্জন। বেশি দূরে যাবে, দাদুকে বলে আসেনি। ও কোথায় গেল না গেল সেটা নিয়ে ওর দাদু নিশ্চয়ই মাথা ঘামাবেন না। ছয়. ‘বেশ, চলো,’ অঞ্জন বলল, ‘দেখেই আসি মার্কেটটা।’ ‘একটা খেলনা কিনব আমি,’ ইপু বলল। ‘আমার এক কাজিনকে উপহার দিতে হবে।’ হ্যান্ডেলের এক মাথা ধরে সাইকেলটাকে টেনে তুলল ও। ‘আসলে ওদিকেই যাচ্ছিলাম। তোমাকে দেখে থেমেছি।’ ‘তোমার বয়স কতো হলো?’ শিকল ধরে নেড়িকে টেনে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। ‘বারো।’ ‘আমারও বারো,’ অঞ্জন বলল। ‘তোমার সাইকেলটা একটু চালিয়ে দেখি?’ মাথা নেড়ে মানা করে দিয়ে সরু সিটটায় চেপে বসল ইপু। ‘না। তবে পাশপাশে তোমাকে দৌড়াতে দিতে আপত্তি নেই।’ রাগ করল না অঞ্জন, বরং ইপু প্যাড্ল্ ঘোরানো শুরু করতেই পাশপাশে দৌড়ে চলল। ‘তুমি আসলেই বোকা,’ হেসে বলল ইপু। কয়েকটা ব্লক পরে, রাস্তার পাশের বসত বাড়িগুলো শেষ হলো, মার্কেটে ঢুকল ওরা। পাশাপাশি সারি দিয়ে বানানো কতগুলো দোতলা বাড়ি, সেগুলোতে দোকান আর অফিস। একটা লাল ইটের বাড়ি রয়েছে, পোস্ট অফিস। এ ছাড়া একটা ব্যাংক, একটা চুল কাটার দোকান, একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। আর আছে একটা হার্ডওয়্যারের দোকান, সামনে বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে : এখানে পাখির খাবার পাওয়া যায়। ‘খেলনার দোকানটা ওদিকে,’ হাত তুলে দেখাল ইপু। ‘খেলনার দোকান আসলে এখানে দুটো রয়েছে। একটা নতুন, একটা পুরনো। পুরনোটাই আমার বেশি পছন্দ। কারণ ওখানে সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিসও পাওয়া যায়।’ দোকানের সামনে সাইকেলটা স্ট্যান্ডে রাখল ইপু। ‘মাঝে মাঝে দোকানের মালিকটা কেমন কুচুটে হয়ে ওঠে। মেজাজ খারাপ থাকলে তোমার কুত্তাটাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না।’ ‘চলো, ঢুকে দেখা যাক,’ টান দিয়ে দরজার পাল্লা খুলল অঞ্জন। কুকুরটাকে টানতে হলো না, ওটাই আগে মাথা ঢুকিয়ে দিল দোকানের ভেতর, অঞ্জনকেই বরং টেনে ঢোকাল। অঞ্জন দেখল, আবছা অন্ধকার, নিচু ছাদওয়ালা, সরু একটা ঘরে ঢুকেছে ওরা। মৃদু আলো চোখে সইয়ে নিতে সময় লাগল। দোকান না বলে গুদাম বললেই বেশি মানায়। দুই দিকেই দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু তাক, বাক্স আর খেলনায় ঠাসা, ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর রাখা লম্বা একটা ডিসপ্লে কাউন্টার, দুই পাশে ফাঁক এতই কম, অঞ্জনের মত সরু হলেই শুধু তার মাঝখান দিয়ে চলাফেরা করতে পারে, তা-ও চেপেচুপে। দোকানের সামনের দিকে, পুরনো ফ্যাশনের একটা কাঠের ক্যাশ কাউন্টারের ওপাশে উঁচু টুলে বসে পত্রিকা পড়ছে একজন গোমড়ামুখো মানুষ। মাথা জুড়ে টাক, চাঁদির ঠিক মাঝখানে এক গুচ্ছ সাদা চুল। মস্ত গোঁফের দুই মাথা নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। অঞ্জন আর ইপুকে দোকানে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকাল দোকানদার, গোঁফের মাথা দুটো যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে। চারপাশে স্তূপ করে রাখা খেলনার দিকে তাকাল অঞ্জন। এত পুরু হয়ে ধুলোর স্তর জমে রয়েছে, দেখলে মনে হয় শত বছরেও পরিষ্কার করা হয়নি। সবকিছুই যেন তালগুলো পাকানো, পুতুল ফেলে রাখা হয়েছে বিল্ডিং-সেটের পাশে, ছবি আঁকার সরঞ্জাম রয়েছে জন্তু-জানোয়ারের মূর্তিগুলোর কাছে। ফুটবলের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে কয়েকটা বাঁশি। দোকানে আর কোন খরিদদার নেই, শুধু ওরা দু’জন। ‘নিন্টেন্ডো গেম নেই এদের কাছে?’ ফিসফিস করে ইপুকে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন, এমন পরিবেশে জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে ও। ‘মনে হয় না,’ ফিসফিসিয়ে জবাব দিল ইপু। ‘দাঁড়াও, জিজ্ঞেস করি।’ সামনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল ও, ‘এই যে, শুনছেন, নিন্ডেন্ডো গেম আছে?’ মুখ তুলে কানের পেছনে চুলকাল লোকটা। পত্রিকা পড়ায় বাধা দেয়াতে যেন বিরক্ত হয়েছে। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘না, ওসব আজেবাজে জিনিস রাখি না আমি।’ দোকানের পেছন দিকে এগিয়ে গেল ইপু ও অঞ্জন। ‘খেলনা খোঁজার আর জায়গা পেলে না!’ পুরনো একটা খেলনা পিস্তল তুলে নিল অঞ্জন। গুলির বদলে এটা পানি ছোঁড়ে। ম্যাগাজিনে পানি ভরে ট্রিগার টিপলেই নলের মুখ দিয়ে পিচকারির মত পানি বেরোয়। ‘আমার মতে, খেলনা খোঁজার এরচেয়ে ভাল জায়গা আর পাওয়া যাবে না,’ ইপু বলল। ‘এখানে সত্যিকারের গুপ্তধন পেয়ে যেতে পারো তুমি।’ ‘কী জানি,’ হাত ওল্টাল অঞ্জন। ‘আরে, দেখো!’ একটা লাঞ্চবক্স তুলে নিল ও। একপাশে কালো মুখোশ পরা একজন ডাকাতের ছবি। হাতে লম্বা লাঠি। নিচে নাম লেখা। পড়ল ও, ‘টুক্কু ঠেঙাড়ে। এই টুক্কুটা আবার কে?’ ‘বোকা নামের ডাকাত, লাঠি দিয়ে লোকের মাথা ফাটিয়ে নিশ্চয়ই টাকা-পয়সা সব কেড়ে নিত,’ অঞ্জনের হাত থেকে লাঞ্চবক্সটা নিল ইপু। ‘ধাতুর তৈরি, প্ল্যাস্টিক না। অনেক পুরনো, হয়তো কোনও জমিদারের ছেলের ছিল। ভাবছি, আমার কাজিন এটা পছন্দ করবে কি না।’ ‘আজব উপহার,’ অঞ্জন বলল। ‘আমার কাজিনটাও আজব,’ ইপু বলল। ‘এই, দেখো এটা।’ পুরনো লাঞ্চবক্সটা রেখে বড় একটা বাক্স তুলে নিল ও। ‘ম্যাজিক সেট।’ গায়ের লেখাটা পড়ল, ‘তোমার বন্ধুদের অবাক করে দাও। একশোটা অসাধারণ ম্যাজিক দেখাতে পারবে।’ ‘বাপরে, এত ম্যাজিক,’ অঞ্জন বলল। মৃদু আলোকিত দোকানটার আরও ভেতরে ঢুকল ও। শিকল টেনে ওকে নিয়ে চলেছে নেড়ি। সারাণ শুঁকে চলেছে কী যেন। ‘হেই...’ অবাক হয়ে বলল অঞ্জন। সরু একটা দরজা। পেছনে আরেকটা অন্ধকার ঘর। প্রথমটার চেয়ে, অঞ্জন দেখল, এই ঘরটায় আলো আরও কম, আরও বেশি ধুলোয় ভরা। ভেতরে পা রেখে প্রথমে অন্ধকার সইয়ে নিল চোখে। অসংখ্য খেলনার খালি বাক্স পড়ে রয়েছে, পুরনো হতে হতে হলদে হয়ে গেছে মলাট, ক্রিকেট খেলার গ্লাভসগুলোর চামড়া এতই পুরনো, বুড়ো মানুষের মুখের মত কুঁচকানো। এ সব আবর্জনা কারা কেনে? ভাবল ও। বেরিয়ে আসতে যাবে, এ সময় চোখে পড়ল জিনিসটা। হলুদ রঙের একটা কৌটা। জেলির বয়ামের সমান। তুলে নিতে গিয়ে অবাক হলো অঞ্জন। ভীষণ ভারী। কৌটাটার আকার দেখে বোঝাই যায় না, এতটা ওজন হবে। মৃদু আলোয় চোখের সামনে এনে ওটা দেখতে লাগল ও। গায়ের লেবেলটা এখনও লাগানো রয়েছে, তবে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে লেখাগুলো। লেবেলের ওপরের দিকে বড় করে লেখা রয়েছে: ভুতুড়ে জেলি। তার নিচে, আরেকটু ছোট অরে লেখা : অনেক ধরনের খেলা খেলতে পারবে এই জেলির সাহায্যে। সাংঘাতিক তো, ভাবল ও। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল কৌটাটা। মনে পড়ল, মা ওকে একশো টাকা দিয়ে গেছেন। শার্টের পকেটেই রয়েছে সেটা। হঠাৎ ধমক শোনা গেল, ‘এই, এখানে কী করছ তোমরা?’ ফিরে তাকিয়ে দেখে অঞ্জন, দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দোকানের মালিক। কুতকুতে চোখ দুটো রাগে জ্বলছে। সাত. লোকটার কথায় চমকে গিয়ে জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল নেড়ি। শিকল ধরে টেনে কুকুরটাকে কাছে নিয়ে এল অঞ্জন। ‘ইয়ে...এই জিনিসটার দাম কত?’ কৌটাটা উঁচু করে দেখাল ও। ‘ওটা বিক্রি হবে না,’ স্বর নামিয়ে জবাব দিল মালিক। কুঁচকে রয়েছে ভুরু। ‘কেন?’ ‘বেশি পুরনো,’ লোকটা জবাব দিল। ‘হয়তো কাজ করবে না, খেলতে পারবে না ওটা দিয়ে।’ ‘ডেট চলে গেছে?’ ‘না, তা যায়নি। তবে পুরনো।’ ‘নিয়ে দেখতে পারি, কাজ করে কি না,’ অঞ্জন বলল। ‘যেহেতু পুরনো, কম দামে দিয়ে দিন না। দেবেন?’ ‘কী ওটা?’ দরজায় উঁকি দিল ইপু। ‘জানি না,’ অঞ্জন বলল। ‘লেবেলে লিখেছে ভুতুড়ে জেলি।’ লোকটার পাশ কাটিয়ে এল ইপু। অঞ্জনের হাত থেকে কৌটাটা নিল। দেখতে দেখতে বলল, ‘ওহ্, দারুণ জিনিস, আমারও একটা দরকার।’ ‘এই একটাই আছে,’ অঞ্জন বলল। ‘তাই?’ তাকগুলোতে এ ধরনের আরও কৌটা খুঁজতে শুরু করল ইপু। ‘আর নেই,’ দোকানের মালিক বলল। ‘এটা আমি নেব,’ ইপু বলল অঞ্জনকে, লোকটার কথা কানেই ঢুকছে না। ‘স্যরি,’ বলে ইপুর হাত থেকে কৌটাটা নিয়ে নিল অঞ্জন। ‘আমি এটা প্রথম দেখেছি।’ ‘আমি তোমার কাছ থেকে কিনে নেব,’ ইপু বলল। ‘দু’জনেই ভাগাভাগি করে নাও না কেন?’ দোকানের মালিক বলল। ‘তার মানে আপনি আমাদের কাছে জিনিসটা বেচবেন?’ অধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। কানের পেছনে চুলকাল। ‘আমি কিন্তু এখনও বলছি এটার ডেট এক্সপায়ার হয়ে গেছে...’ ‘কত দিতে হবে?’ জানতে চাইল অঞ্জন। ‘বিশ টাকা দিলেই চলবে,’ অঞ্জনকে বলল লোকটা। ‘তবে আবারও বলছি, এটা নিশ্চয়ই ভাল নেই। অনেক পুরনো হয়ে গেছে।’ ‘হলে হোক,’ শার্টের পকেট থেকে একশো টাকার নোটটা বের করল অঞ্জন। ‘কাজ না হলে ফেরত আনতে পারবে না কিন্তু,’ গোমড়ামুখে বলল দোকানের মালিক। ‘আনলে নেব না।’ দোকানের সামনের ক্যাশ কাউন্টারের দিকে রওনা হলো লোকটা। কয়েক মিনিট পর, হাতে হলুদ রঙের কৌটাটা নিয়ে উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে এল অঞ্জন। ধুলোয় ভরা অন্ধকার জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরে খুশি। গম্ভীর মুখে পেছনে বেরোল ইপু। ‘কী, লাঞ্চবক্সটা কিনলে না?’ অঞ্জন জিজ্ঞেস করল। ‘আমাকে ভোলানোর চেষ্টা কোরো না,’ খড়খড় করে উঠল ইপু। ‘শোনো, এটার জন্য আমি ৫০ টাকা দিতে রাজি আছি।’ ভুতুড়ে জেলির কৌটাটার দিকে হাত বাড়াল ও। সরিয়ে নিল অঞ্জন। ‘কোন কিছু পছন্দ হলে সেটা না নিয়ে তোমার শান্তি নেই!’ ‘দাঁড়াও, একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়,’ কাত করে রাখা সাইকেলটা টান দিয়ে সোজা করল ইপু। ‘চলো, জিনিসটা নিয়ে ভাগাভাগি করে খেলি আমরা।’ ‘না,’ মাথা নাড়ল অঞ্জন। ‘তুমি তোমার সাইকেলটায় হাত ছোঁয়াতেও দাওনি আমাকে।’ ‘সাইকেলে চড়ে বাড়ি যেতে চাও? এই নাও।’ সাইকেলটা অঞ্জনের দিকে ঠেলে দিল ইপু। ‘উঁহুঁ,’ ধরল না অঞ্জন। ‘তোমার ওই বোকা সাইকেলে এখন আর আমি চড়তে চাই না।’ ‘সাইকেল বোকা হয় কী করে?’ প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল অঞ্জন। নেড়ির শিকল ধরে টানল। হেঁটে চলল ফুটপাথ দিয়ে। ‘সাইকেল বোকা হয় কী করে?’ নাছোড়বান্দা ইপু। সাইকেল ঠেলে নিয়ে অঞ্জনের পাশে হাঁটছে। ‘নাহ্, তুমি ছাড়বে না,’ হাল ছেড়ে দিল অঞ্জন। ‘বেশ, বাড়ি চলো। কিছুণের জন্য খেলতে দেব তোমাকে।’ ‘দেবে! সত্যি? তোমার মনটা খুব উদার, সত্যি, অঞ্জন।’ হাসল অঞ্জন। ইপুকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। দাদুর কণ্ঠ কানে এল। উত্তেজিত স্বরে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। বসার ঘরে ঢুকল অঞ্জন। ঘরে দাদু ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। শুধু কুসি বসে আছে। আর কোন মানুষ নেই, তাহলে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি? অঞ্জনদেরকে দেখে লাফিয়ে উঠে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কালো বিড়ালটা। ইপুকে দেখে ভুরু কোঁচকালেন দাদু। ‘দাদু, ও ইপু,’ নতুন বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিল অঞ্জন। ভুলে গেল দাদু কানে শোনেন না। ‘ওটা কী?’ ভুতুড়ে জেলির কৌটাটার দিকে আঙুল তুললেন দাদু। ‘দেখি?’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদুর হাতে কৌটাটা দিল অঞ্জন। ভুরু কুঁচকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন দাদু। লেবেলটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছেন। এইটুকু লেখা পড়তে কি এতণ লাগে? অবাক হলো অঞ্জন। অবশেষে কৌটাটা অঞ্জনকে ফিরিয়ে দিলেন তিনি। নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে অঞ্জন, হঠাৎ ফিসফিস করে দাদু বললেন, ‘সাবধানে থেকো।’ ফিরে তাকাল অঞ্জন। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন দাদু। কথাটা কি সত্যি শুনেছে ও? নাকি ওর কল্পনা। চিন্তিত ভঙ্গিতে দরজার দিকে ঘুরল ও। দেখে, দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে কুসি। হলুদ চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ‘আমার দাদু কানে শোনেন না,’ সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় ইপুকে বলল অঞ্জন। অঞ্জনের ঘরে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল একবার ইপু। তারপর জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে জানালা দিয়ে তাকাল বাইরে। ‘সময় কাটাবে কী করে?’ ‘সেই দুশ্চিন্তাটা তো আমারও,’ অঞ্জন বলল। তাকের বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ইপু, ‘এত ম্যাজিকের বই কেন এখানে? এগুলো দিয়ে কী করেন তোমার দাদু?’ তাক থেকে পুরনো, মোটা একটা বই টেনে নামাল ইপু। ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝাড়ল। ‘দেখো আবার, জাদু করে তোমাকে না আবার নিউট বানিয়ে ফেলেন।’ ‘নিউট কী?’ ‘এক ধরনের গিরগিটি।’ পুরনো বইটার হলদে হয়ে আসা পাতাগুলো ওল্টাল ও। ‘তুমি বলেছিলে, এখানে নাকি কিছুই করার নেই তোমার। এত বই, পড়েই তো সময় কাটাতে পারো।’ ‘দেখছ না কী সব বই, এগুলো পড়তে ভাল লাগে নাকি?’ ঠোঁট ওল্টাল অঞ্জন। বইটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিয়ে ডেস্কের কাছে এসে দাঁড়াল ইপু। ওর চোখ ভুতুড়ে জেলির কৌটাটার দিকে। ‘খোলো ওটা। এত পুরনো হয়েছেÑহয়তো দোকানদারের কথাই ঠিকÑভেতরের জিনিস হয়তো সত্যিই নষ্ট হয়ে গেছে।’ ‘আমারও তাই মনে হয়,’ কৌটাটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগল অঞ্জন। মুখটা ধরে টান দিল অঞ্জন। খুলল না ওটা। ‘টিন খোলার যন্ত্র দিয়ে খুলতে হবে হয়তো,’ ইপু বলল। ‘যন্ত্র পাবো কোথায়?’ আবার লেবেলটার দিকে তাকাল অঞ্জন। ‘এই যে, দেখো, কোন নির্দেশনা দেয়নি। ভেতরে কী আছে, তা-ও লেখা নেই। কী করে বুঝব, এটা দিয়ে কিভাবে খেলতে হয়?’ ‘ভুতুড়ে জেলিÑলিখেই তো দিয়েছে, আর কিছু লেখার দরকার আছে কি?’ সিনেমার ভ্যাম্পায়ারের মতো বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠল ইপু। থাবা দিয়ে অঞ্জনের গলা চেপে ধরল। দম বন্ধ করে ওকে মেরে ফেলার ভঙ্গি করল। হেসে উঠল অঞ্জন। ‘ছাড়ো। নাহ্, তুমি কোন বুদ্ধি দিতে পারলে না।’ আছাড় দিয়ে কৌটাটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘এই খেলনাটা দিয়ে কী করে খেলতে হয়...’ কথা শেষ হলো না ওর। আচমকা ‘ফুট’ করে খুলে গেল কৌটার ঢাকনা। ‘আরে, দেখো!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ওর গলা থেকে হাত সরিয়ে আনল ইপু। কৌটার ভেতর কী আছে দেখার জন্য মাথা নামিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। আট. ভেতরের জিনিসটা উজ্জ্বল হলুদ, জেলির মতো থকথকে। ছাদ থেকে ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক আলোয় চকচক করছে। ‘ছুঁয়ে দেখো,’ ইপু বলল। তবে অঞ্জন ছুঁয়ে দেখার আগেই কৌটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল ও। ‘ওরে বাবা, কী ঠাণ্ডা। ছুঁয়ে দেখো। ভীষণ ঠাণ্ডা।’ ভেতরে আঙুল ঢোকাল অঞ্জন। খুব ঠাণ্ডা। আর জেলির চেয়ে ঘন। অনেক বেশি ভারী। আঠাল জিনিসটার ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দিল অঞ্জন। বের করে আনতে গিয়ে দেখে, বেরোচ্ছে না। জোরে টান দিতে হটাৎ করে শব্দ তুলে বেরিয়ে এল। ‘আশ্চর্য,’ ইপু বলল। ‘এর চেয়ে খারাপ জিনিস দেখেছি আমি,’ অঞ্জন বলল। ‘আমার ধারণা অন্ধকারে জ্বলে এটা,’ বলে প্রায় ছুটে গিয়ে গিয়ে দরজার পাশের সুইচবোর্ডের কাছে দাঁড়াল ইপু। ‘ফসফরাসের মতো।’ সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল ও। কিন্তু ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। পর্দা ভেদ করে আসছে বিকেলের রোদের আলো। ‘আলমারিতে ঢুকে দেখা যেতে পারে,’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ইপু। কৌটাটা হাতে নিয়ে আলমারির দিকে এগোল অঞ্জন। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ইপুও ঢুকে দাঁড়াল ওর পাশে। দরজাটা লাগিয়ে দিল। ‘এহ্, ন্যাপথলিনের গন্ধে দম আটকে আসছে।’ তবে অন্ধকারে সত্যিই জ্বলে ভুতুড়ে জেলি। কৌটার ভেতর থেকে গোল হলুদ আলোর আভা বেরোচ্ছে। ‘অদ্ভুত, আসলেই অদ্ভুত,’ ইপু বলল। ন্যাপথলিনের তীব্র গন্ধ এড়াতে দুই আঙুলে নাক টিপে ধরে রেখেছে। ‘দুর,’ কিছুটা হতাশ হয়েই বলল অঞ্জন, ‘আমি অন্য কিছু আশা করেছিলাম।’ ‘কী, ভুতুড়ে কিছু?’ ‘ভুতুড়ে কি না জানি না, তবে অন্য কিছু।’ ‘বেশ, তোমার রাখতে ইচ্ছে না করলে আমি নিয়ে যাই,’ ইপু জবাব দিল। ‘আমি রাখব না, তা তো বলিনি,’ তাড়াতাড়ি বলল অঞ্জন। ‘চলো বেরোই এখান থেকে,’ ইপু বলল। ‘উফ্, মারা গেলাম!’ পাল্লাটা ঠেলে খুলল অঞ্জন। আলমারি থেকে বেরোল দু’জনে। দরজাটা আবার লাগিয়ে দিল অঞ্জন। কয়েক সেকেন্ড কোন কথা না বলে তাজা বাতাসে দম নিল। কৌটাটা অঞ্জনের হাত থেকে নিয়ে আবার ভেতরে হাত ঢোকাল ইপু। এক খাবলা থকথকে পদার্থ তুলে আনল খামচি দিয়ে। হাতের তালুতে রেখে মুঠো বন্ধ করে চাপ দিল। ‘কৌটার বাইরে আনলে ভেতরের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা লাগে,’ অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল ও। ‘দেখো, চাপ দিয়ে চ্যাপ্টা করে ফেললেও ছেড়ে দিলেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।’ ‘হ্যাঁ, একেবারেই বাচ্চাদের খেলনা,’ জিনিসটা খুব একটা আনন্দ দিচ্ছে না অঞ্জনকে। ‘আছাড় দাও। দেখো, রবারের মত লাফায় কি না।’ হাতের জিনিসটাকে বলের মত গোল করে ওপর থেকে মাটিতে ছেড়ে দিল ইপু। লাফিয়ে উঠল ওটা, আবার ওর হাতে এসে পড়ল। আরেকটু জোরে আছাড় দিল ও। তেরছা ভঙ্গিতে লাফিয়ে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে দরজা দিয়ে ভেতরের বারান্দায় বেরিয়ে গেল ভুতুড়ে জেলির বলটা। ‘সত্যিই খুব ভাল লাফায়, বলের চেয়ে বেশি।’ বারান্দা থেকে বলটা নিয়ে এল ইপু। ‘এবার দেখি, টানলে কতটা লম্বা হয়।’ দুই হাতে ধরে টানতে শুরু করল ও। লম্বা দড়ির মত হয়ে গেল। ‘বাপরে! লম্বাও তো হয় অনেক। ছেঁড়ে না।’ ‘হুঁ,’ এবারও খুশি হলো না অঞ্জন। ‘বললামই তো একেবারে বাচ্চাদের খেলনা। নাম দেখে আমি ভেবেছিলাম এ জিনিসটা দিয়ে এমন কিছু করা যাবে, যা দেখে সত্যিই অবাক হবার মতো।’ ‘দেখো, একই রকম ঠাণ্ডা থাকছে এটা, একটুও গরম হচ্ছে না, হাতের উত্তাপেও না,’ ইপু বলল। দেয়ালের দিকে চোখ পড়ল ওর। গোল একটা হলুদ দাগ পড়েছে কাঠের দেয়ালে, যেখানে বাড়ি খেয়েছিল বলটা। ‘ও, দাগও তো পড়ে দেখা যাচ্ছে।’ ‘নেড়ির ভাল লাগবে,’ অঞ্জন বলল। ‘বাইরে চলো। ওর সঙ্গে গিয়ে খেলা যাক। একা থেকে আর কষ্ট পাবে না বেচারা।’ ‘চলো,’ ইপু রাজি। যেটুকু ভুতুড়ে জেলি কৌটা থেকে বের করেছিল, সেটা আবার ভরে রাখল ইপু। তারপর নিচতলায় নেমে, পেছনের আঙিনায় বেরিয়ে এল দু’জনে। উল্লসিত ভঙ্গিতে এমন শুরু করল নেড়ি, যেন কতকাল ওদের দেখে না। কৌটা থেকে আবার এক খাবলা ভুতুড়ে জেলি বের করল ইপু। বাকিটুকু বের করে নিল অঞ্জন। সেগুলো দিয়ে দু’জনে দুটো বল বানাল। ‘একেবারেই আকৃতি বদলাচ্ছে না, আশ্চর্য,’ হলুদ বলটাকে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে লুফে নিল ইপু। ‘যেমন বানাচ্ছি, ঠিক তেমনই থেকে যাচ্ছে।’ অঞ্জনও ওর বলটা ওপর দিকে ছুড়ে দিল। এক হাত দিয়ে বিকেলের রোদ আড়াল করে আরেক হাতে লুফে নিল বলটা।’ বাহাদুরি দেখানোর জন্য অঞ্জনের চেয়ে আরও ওপরে ছুড়ল ইপু। কিন্তু ধরতে পারল না। ওর বাড়ানো হাতের কিনার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘দুর!’ মাটিতে পড়ে ড্রপ খেল বলটা, একবার, দুবার, গিয়ে পড়ল নেড়ির সামনে। চমকে গিয়ে প্রথমে লাফিয়ে উঠল নেড়ি, তারপর নাক নামিয়ে বল শুঁকতে লাগল। ‘না না নেড়ি!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ‘থাক, থাক!’ কিন্তু চির অবাধ্য নেড়ি ওর কথা শুনল না, মাথা নামিয়ে হলুদ বলটা চাটতে শুরু করল। ‘না না, রাখ, রাখ!’ শঙ্কিত হলো অঞ্জন। ঝাঁপ দিল কুকুরটাকে ল্য করে। কিন্তু দেরি করে ফেলল। বলটাকে দাঁতে কামড়ে তুলে নিল নেড়ি। চিবাতে শুরু করল। ‘না, নেড়ি, না!’ চিৎকার করে বলল অঞ্জন। ‘গিলিসনে! গিলিসনে!’ গিলে ফেলল নেড়ি। ‘সর্বনাশ!’ ককিয়ে উঠল ইপু। দুই হাত মুঠো করে কিল মারল নিজের গায়েই। ‘অর্ধেকটা জেলিই খেয়ে ফেলেছে। এখন খেলব কী দিয়ে!’ কিন্তু খেলা নিয়ে মাথাব্যথা নেই অঞ্জনের। নেড়ির দুই চোয়াল চেপে ধরে টান দিয়ে হাঁ করাল। কুকুরটার মুখের ভেতর দেখল। নেই হলুদ গোল্লাটা। গিলে ফেলেছে। ‘হাঁদা কুত্তা!’ কুকুরটার মুখ ছেড়ে দিল অঞ্জন। ‘এত্তবড় পাজি...উফ্!’ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর মুখ। জিনিসটায় কী আছে কে জানে। বিষাক্ত কোনো রাসায়নিক থাকলে কুকুরটা অসুস্থ হয়ে পড়তে পড়ে? এমনকি, মারাও যেতে পারে! নয়. ‘আজ বড়া বানাবেন?’ কাগজে লিখে দাদুর দিকে বাড়িয়ে ধরল অঞ্জন। নিজের ঘরের ডেস্কে পাওয়া একটা পুরনো প্যাড থেকে ছিঁড়ে নিয়েছে। চুল ঠিক করতে করতে কাগজটার দিকে তাকালেন দাদু। রান্নাঘরে জানালা দিয়ে আসা সকালের রোদের আলোয় ময়দার মত সাদা লাগছে তাঁর মুখটা। ‘বড়া? কিসের বড়া?’ শীতল কণ্ঠে বললেন তিনি। অবাক হলো অঞ্জন। গোশতের বড়া বানিয়ে খাওয়ানোর কথা তিনিই তো বলেছিলেন। তবে এখন আর মনে করিয়ে দিল না। ‘যাও, তোমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করোগে,’ শীতল কণ্ঠেই বললেন তিনি। ঘরেই ছিল কালো বিড়ালটা, হেঁটে এল খাবার টেবিলের কাছে। সেটার মাথা চাপড়ে আদর করলেন তিনি। ‘আমার মত একটা বুড়ি ডাইনির সঙ্গে থাকার কোন দরকার নেই তোমার।’ তিন দিন হলো এ বাড়িতে এসেছে অঞ্জন। দাদুর সঙ্গে আন্তরিক হওয়ার বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে যত চেষ্টা করে, দাদু তত বেশি শীতল হন। নাহ্, মহিলাটা ভালো নাÑকুটিলই, ভাবল অঞ্জনÑভীষণ কুটিল। নাস্তা খাচ্ছে ও। দুধে ভেজানো খই। শেষ চামচটুকু মুখে পুরে বাটিটা ঠেলে দিল। প্রতিদিন এই এক খাবার দিয়েই নাস্তা খেতে হচ্ছে। আর যেন কিছু নেই। গিলতে গিলতে আর ভালো লাগে না, প্রচণ্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে। তা-ও যদি দুধের সঙ্গে চিনি থাকত। চিনি নিতে দেন না দাদু, যেন খাবারটাকে যতটা সম্ভব বিস্বাদ করার জন্যই। জানালার বাইরের উজ্জ্বল রোদের দিকে তাকাল অঞ্জন। মুখ ফেরাল দাদুর দিকে। রান্নাঘরের ছোট্ট টেবিলটার অন্য পাশে ওর মুখোমুখি বসেছেন তিনি। চা খাচ্ছেন। কালো কড়া চা। বিশ্রী শব্দ করে টান দিয়ে মুখের ভেতর নিচ্ছেন তেতো জিনিসটা। এই প্রথম তাঁর গলার লকেটটা চোখে পড়ল ওর। মাখন রঙা, দেখতে মানুষের বাহুর হাড়ের মত। মানুষের হাড় দিয়েই বানায়নি তো? তীè দৃষ্টিতে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল অঞ্জন, ওটা নকল, না আসল হাড়। ওর দৃষ্টি ল্য করে তাড়াতাড়ি লকেটটা ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন দাদু। ‘বসে আছো কেন এখনও? যাও, বাইরে গিয়ে তোমার বন্ধুর সঙ্গে খেলা করোগে,’ কঠিন স্বরে বললেন তিনি। লম্বা চুমুক দিয়ে শেষবারের মতো দাঁতের বিশ্রী শব্দ তুলে কাপের চাটুকু গিলে নিলেন। হ্যাঁ, যাচ্ছি, ভাবল অঞ্জন, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়াই ভালো। চেয়ারটা পেছনে ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। এঁটো বাটিটা নিয়ে এল সিংকের কাছে। নাহ্, এই অবস্থা আর বেশি দিন সহ্য করতে পারব না, ভীষণ মন খারাপ লাগছে অঞ্জনের। বুড়িটা আমাকে দেখতে পারে না। ঘৃণা করে। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিজের ঘরে উঠে এল ও। চুল আঁচড়াল। মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে গত রাতে, সেটার কথা ভাবল। মা-ই টেলিফোন করেছিলেন। ‘কী অবস্থা, মা?’ জিজ্ঞেস করেছে অঞ্জন। মার গলা শুনতে খুব ভাল লেগেছে, যদিও যন্ত্রের মাধ্যমে। ‘ভালই,’ বলতে গিয়ে কিছুটা দ্বিধা করেছেন মা। ‘ভালই মানে? বাবা কেমন আছে? বাসা পেয়েছ?’ ‘আমরা ভালই আছি,’ কান্ত মনে হচ্ছিল মার কণ্ঠ। ‘কিন্তু ঢাকায় বাসা পাওয়া যে এত কঠিন হয়ে গেছে, ভাবিনি। পছন্দসই বাসা পাই না, হয় অস্বাভাবিক ভাড়া, নয়তো অন্যান্য অসুবিধে। একটা বাসা সব দিক থেকে পছন্দও হয়েছে, ভাড়াও সাধ্যের মধ্যে, কিন্তু কাছাকাছি যে স্কুলটা আছে, সেটা ভালো নয়।’ ‘অসুবিধে নেই। অত ভাল স্কুলে না-ই বা পড়লাম,’ অঞ্জন বলেছে। ওর এখন ভাল বাসা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। এ সময় বাবার কণ্ঠস্বর কানে এসেছে, তবে কী বলছেন বোঝা যায়নি। ‘আমাকে কবে নিতে আসবে, মা?’ অঞ্জন জিজ্ঞেস করেছে। জবাব দিতে কিছুটা সময় নিলেন মা। ‘বাসার সমস্যাটা মিটে গেলেই আসব। যা ভেবেছিলাম, তারচেয়ে দু’চার দিন হয়তো বেশি সময় লাগবে। তোমার কী অবস্থা, অঞ্জন? ভাল আছো?’ আরও বেশ কিছুদিন কুমিল্লায় থাকতে হবে, এই খারাপ খবরটা শুনে অঞ্জনের মনে হচ্ছিল চিৎকার করে কাঁদে, দেয়ালে লাথি মেরে পা ফাটিয়ে ফেলে। কিন্তু এমনিতেই মার মন ভাল না, তাঁর কষ্ট বাড়াতে চাইল না। বলল, ও ভালই আছে, একজন নতুন বন্ধু জোগাড় করেছে। মার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে তখন বাবা কথা বলেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। তারপর বলেছেন, ‘থাকো ওখানে, অসুবিধে হবে না।’ আছিই তো। অসুবিধে যে কতটা হচ্ছে সেটা আর তোমরা বুঝবে কী, বিষণœ হয়ে গিয়েছিল অঞ্জন। বাবা-মার কণ্ঠ শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওর, বাড়ি যাবার জন্য। তারপর আজ সকালে দাদুর এই আচরণ। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চিরুনিটা রেখে দিল অঞ্জন। ড্রেসারের আয়নায় নিজেকে দেখল। লাল খোপ খোপ একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে। পরনে কালো প্যান্ট। নিচে নেমে, রান্নাঘর দিয়ে তাড়াহুড়া করে বাইরে বেরোনোর সময় দেখল, কুসির সঙ্গে কথা বলছেন দাদু, কোন কিছু নিয়ে ভীষণ তর্ক করছেন যেন। এটা নতুন কিছু নয়। ছুটে বেরিয়ে এল পেছনের দরজা দিয়ে। ডাকতে ডাকতে কুকুরের খোঁয়াড়টার দিকে ছুটল, ‘নেড়ি! এই নেড়ি!’ কিন্তু সাড়া দিল না কুকুরটা। খোঁয়াড়ের মাঝখানে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। মৃদু নাক ডাকছে। ‘এই, ইপুদের বাড়ি যাবি?’ জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। নড়ে উঠল নেড়ি। কিন্তু চোখ মেলল না। ‘ঠিক আছে, তুই ঘুমো।’ কুকুরটার গামলাটা দেখল অঞ্জন, পানি আছে কি না। ভরে দিল। তারপর পা বাড়াল গেটের দিকে। * ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছে ও। বাবা-মার কথা ভাবছে। এ সময় ডাক শুনল, ‘এই...এই!’ সামনে এসে দাঁড়াল দুটো ছেলে। ওর পথরোধ করে দাঁড়াল। চমকে গিয়ে ছেলে দুটোর দিকে তাকাতে লাগল অঞ্জন। একবার এর মুখের দিকে, একবার ওর মুখের দিকে। ছেলে দুটো যমজ। অবিকল এক চেহারা। দুজনেই বিশালদেহী, মাংসল শরীর, খাটো করে ছাঁটা চুল, গোলগাল মুখ। দু’জনের পরনেই গেঞ্জি। বুকের কাছে একটা ব্যান্ড দলের নাম ছাপ মারা। পরনে ঢোলা প্যান্ট, পায়ে জুতো, ফিতে বাঁধেনি, মোজাও পরেনি। দু’জনেরই বয়স চৌদ্দ-পনেরো হবে, অনুমান করল অঞ্জন। ‘কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করল একজন। চোখের পাতা সরু করে তাকাল। ছেলে দুটোকে ভাল লাগল না অঞ্জনের। পিছিয়ে গেল। ‘আমি...আমি আমার দাদুর বাড়িতে এসেছি।’ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল দুই ভাই। কুটিল হাসি। ‘এখান দিয়ে তুমি হাঁটতে পারবে না,’ অঞ্জনের প্রায় গায়ের ওপর উঠে এল একজন। ‘হ্যাঁ। তুমি এখানকার বাসিন্দা নও,’ সুর মেলাল আরেকজন। ‘সরকারি রাস্তায় হাঁটতে আবার বাসিন্দা হওয়া লাগে নাকি?’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল অঞ্জনের। বলেই বুঝল, ভুল করে ফেলেছে। আশপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কি না, ওকে সাহায্য করার মত। ছেলে দুটোর ভাবভঙ্গি ভাল না। গায়েও হাত তুলতে পারে। কিন্তু কাউকে নজরে পড়ল না। সমস্ত বাড়িগুলোর সামনের দরজা বন্ধ। আঙিনাগুলো নির্জন। দূরের রাস্তা দিয়ে একজন লোককে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখল। চেঁচিয়ে ডাকলেও লোকটার কানে যাবে না। আর কেউ নেই আশপাশে। কেউ ওকে সাহায্য করতে আসবে না। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে অঞ্জন। ছেলে দুটোর চোখে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অঞ্জনের দিকে। দশ. ‘কোথায় যাচ্ছিলে?’ জিজ্ঞেস করল একজন। এক হাতের আঙুল মুঠো পাকিয়ে ফেলেছে। অঞ্জনের একেবারে গায়ের ওপর এসে দাঁড়াল, ইঞ্চি দুয়েক দূরে। আরও কয়েক পা পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল ওকে। ‘একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে,’ অঞ্জন জবাব দিল। ভাবছে, হয়তো মিথ্যেই ভয় দেখাচ্ছে ওকে ছেলে দুটো, কোন তি করবে না। ‘যাওয়া যাবে না,’ বলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল ছেলেটা। দেঁতো হাসি হেসে দু’জনেই আবার অঞ্জনের দিকে এগোল। মোড়ের কাছে চলে আসতে বাধ্য করল। ‘তুমি এখানকার বাসিন্দা নও,’ একই কথা বলল আবার এক ভাই। চোখের পাতা সরু করে নিজেকে ভয়ঙ্কর বোঝাতে চাইল। ‘এই, আমাকে যেতে দাও,’ অঞ্জন বলল। সরে গিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে হাঁটার চেষ্টা করল অঞ্জন। কিন্তু কিছুতেই ওকে যেতে দিল না দুই ভাই। ‘রাস্তার ভাড়া দিলে হয়তো ছাড়া যেতে পারে,’ একজন বলল। ‘হ্যাঁ,’ দ্রুত সুর মেলাল অন্যজন। ‘এই এলাকায় যারা থাকে না, তাদের রাস্তা ব্যবহার করতে ভাড়া লাগে।’ ‘আমার কাছে টাকা নেই,’ বলল অঞ্জন। তারপর মনে পড়ল পকেটে আশি টাকা রয়েছে। টাকাটা কি ওরা কেড়ে নেবে? হ্যাঁ, নেবে। প্রথমে ধরে পেটাবে, তারপর কেড়ে নেবে। ভাবল অঞ্জন। ‘ভাড়া দিতে হবে,’ খিকখিক করে হাসল একজন। ‘দেখি, তোমার কাছে কী আছে?’ সামনে এসে ওকে ধরার জন্য হাত বাড়াল দুই ভাই। পিছিয়ে গেল অঞ্জন। ভয় ওর পা ভারী করে ফেলেছে। হঠাৎ রাস্তার আরেক মোড় থেকে চিৎকার শোনা গেল, ‘এই, কী করছ?’ ছেলে দুটোর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল অঞ্জন, ইপুকে ছুটে আসতে দেখল সাইকেলে চেপে। ডাকল, ‘অঞ্জন!’ মুখ ফিরিয়ে তাকাল দুই যমজ। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল একজন। আরেকজন মুখ বাঁকাল। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দুই পা রাস্তায় নামিয়ে দিল ইপু। পরনে নীল রঙের প্যান্ট, গায়ে হলুদ শার্ট। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে আসায় মুখ লাল হয়ে গেছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখে বনবিড়ালের হিংস্র দৃষ্টি নিয়ে দুই ভাইয়ের দিকে তাকাল ইপু।। অঞ্জনের দিকে ফিরে বলল, ‘হারু-তরু কিছু কেড়ে নিতে চাইছে নাকি তোমার কাছ থেকে?’ ‘ইয়ে...’ দ্বিধা করছে অঞ্জন। ‘ওকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলাম আমরা,’ তরু বলল। হাসল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। ‘আমাদের এখানে আসাতে,’ ভাইয়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যোগ করল হারু। কিছু বলতে যাচ্ছিল হারু, কিন্তু বাধা দিল ইপু। ‘থাক, আর অভিনন্দন জানাতে হবে না। ওকে তোমরা কিছু করবে না বলে দিলাম।’ ‘তোমার কথায়?’ খিকখিক করে হাসল হারু। ‘ঠিক আছে, কিছু করব না,’ ইপুর দিকে এগোল তরু। ‘তবে তোমার সাইকেলটা আমাদের ধার দিতে হবে।’ ‘খবরদার, ধরবে না বলে দিলাম,’ ঝাঁঝিয়ে উঠল ইপু। থাবা দিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলের এক মাথা চেপে ধরল তরু। ‘না না, খবরদার!’ চেঁচিয়ে উঠে হ্যান্ডেলটা টেনে সরানোর চেষ্টা করল ইপু। তরু হ্যান্ডেলটা ছাড়ল না। হারু জোরে এক ধাক্কা মারল ইপুকে। উল্টে পড়ে গেল ইপু। টান লেগে হ্যান্ডেল ছুটে গেল তরুর হাত থেকে। সাইকেলটা পড়ল ইপুর গায়ের ওপর। কংক্রিটের রাস্তায় মাথা ঠুকে যাওয়ায় ‘আহ্!’ করে উঠল ইপু। দুই হাত দিয়ে বাতাসে খামচি মেরে যেন কিছু ধরার চেষ্টা করতে লাগল। সাইকেলটা পড়েই আছে গায়ের ওপর। ও উঠে দাঁড়ানোর আগেই নিচু হয়ে হ্যান্ডেল চেপে ধরে টান দিয়ে তুলে নিল হারু। পা ঘুরিয়ে সিটের ওপর বসে প্যাডলে চাপ দিল। ‘এই দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমাকে নিয়ে যাও!’ সাইকেলের পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে হেসে বলল ওর ভাই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রাস্তার মোড় ঘুরে ইপুর বাইকটা নিয়ে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল দুই ভাই। ‘ইপু,’ ওর পাশে গিয়ে বসল অঞ্জন। ‘তোমার কিছু হয়নি তো?’ ইপুর হাত ধরে ওকে টেনে তুলল অঞ্জন। উঠে দাঁড়িয়ে মাথার পেছনটা ডলতে ডলতে ইপু বলল, ‘ওই শয়তান দুটোকে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না!’ কাপড় থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলে আবার হাত দিল মাথার পেছনে। ‘উহ্! ব্যথা করছে।’ ‘ওরা কে?’ অঞ্জন জিজ্ঞেস করল। ‘হারু-তরু, যমজ ভাই,’ মুখ বিকৃত করে জবাব দিল ইপু। ‘শয়তানের হাড্ডি।’ পায়ে হাত বুলিয়ে দেখল কোথাও কেটেছে কি না। শুধু আঁচড় লেগেছে। ‘নিজেদের বিরাট কিছু ভাবে ওরা। আসলে তো কেউ দেখতে পারে না।’ ‘তোমার সাইকেলটার কী হবে?’ শান্তকণ্ঠে বলল ইপু, ‘ওটা ফেরত পাব। এরকম কাণ্ড আগেও করেছে ওরা। চালিয়ে-টালিয়ে শখ মিটে গেলে কোথাও ফেলে রেখে যাবে।’ ‘কিন্তু ওদের বাড়িতে...’ ‘বিচার দিতে যাবে তো?’ বাধা দিয়ে বলল ইপু, ‘কোন লাভ নেই। একেবারেই বুনো ওরা। দেখার কেউ নেই। নানীর বাড়িতে থাকে, কিন্তু ওই নানীকেও কখনই বাড়িতে থাকতে দেখি না। তোমাকে বিরক্ত করছিল নাকি?’ মাথা ঝাঁকাল অঞ্জন। রসিকতা করে বলল, ‘মেজাজ এত খারাপ করে দিচ্ছিল, আরেকটু হলেই পেটানো শুরু করতাম।’ হাসল না ইপু। ‘তবে আমি ওদের পেটাতে পারলে খুশি হতাম,’ রাগ করে বলল ও। ‘তবে শায়েস্তা আমি করব, কোন একদিন। এখানকার সমস্ত ছেলেকে জ্বালিয়ে মারে ওরা। কেউ ভয়ে মুখ খোলে না। ওদের ধারণা হয়ে গেছে, যা ইচ্ছে তাই করতে পারে ওরা।’ ‘তোমার হাঁটু কেটে গেছে,’ অঞ্জন বলল। ‘বাড়ি গিয়ে পরিষ্কার করে স্যাভলন লাগানো দরকার,’ চোখ ঘুরিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলল ইপু। ‘পরে দেখা করব তোমার সঙ্গে, ঠিক আছে? আজ আর হবে না, বিকেলে একখানে যেতে হবে আমাকে। হয়তো কাল দেখা করতে পারব।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল ও, মাথার পেছনটা ডলতে ডলতে। অঞ্জনও দাদুর বাড়ির দিকে ফিরে চলল। আস্তে আস্তে হাঁটছে। হারু-তরুর কথা ভাবছে, কল্পনায় মারামারি করছে ওদের সঙ্গে, পিটিয়ে ভর্তা বানাচ্ছে, ইপু হয়েছে দর্শক, চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে ওকে। বাড়ি ফিরে দেখল, সামনের ঘরের ধুলো ঝাড়ছেন দাদু। ফিরেও তাকালেন না ওর দিকে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে উঠে চলে এল অঞ্জন। এখন আমি কী করব? পায়চারি করতে করতে ভাবছে ও। চোখ পড়ল ভুতুড়ে জেলির কৌটাটার ওপর। বুক শেলফে মাঝখানের তাকে রেখেছে। হেঁটে তাকের কাছে গিয়ে কৌটাটা তুলে নিল। ঢাকনা খুলল। কৌটাটা প্রায় ভর্তি। তার মানে নেড়ি খুব বেশি খায়নি, ভেবে, কিছুটা স্বস্তি বোধ করল ও। নেড়ি! ওর কথা ভুলেই গিয়েছিল। বেচারা কুকুরটার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। ভুতুড়ে জেলির কৌটাটা নামিয়ে রেখে, ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল অঞ্জন। রেলিং ধরে একেক লাফে তিনটে করে ধাপ ডিঙিয়ে নেমে এল নিচে। সামান্যতম গতি না কমিয়ে, রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে যেন উড়ে এসে পড়ল পেছনের আঙিনায়। ‘নেড়ি! এই নেড়ি!’ চেঁচিয়ে ডাকল। আঙিনার অর্ধেকটা পেরিয়ে এসে ওর মনে হলো কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ফুলে গেছে কুকুরটার চোখ দুটো। মুখ হাঁ করে রেখেছে। লম্বা জিভটা দুলছে এপাশ ওপাশ। গালের কষার লোম বেয়ে সাদা লালা গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। ‘নেড়ি!’ ঘন ঘন দম নিচ্ছে কুকুরটা, খসখসে শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে, কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে নেড়ি! খোঁয়াড়টার কাছে যখন পৌঁছল অঞ্জন, চোখ উল্টে দিয়েছে নেড়ি। হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেল। শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে উঁচু-নিচু হচ্ছে পেটটা। ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে। এগারো. ‘নেড়ি, কী হয়েছে তোর!’ হাঁটু গেড়ে কুকুরটার পাশে বসে পড়ল অঞ্জন। গলার কলার ধরে টান দিতে গিয়ে ল করল, আঙুল ঢুকছে না। গলা আর বেল্টের মাঝখানের ফাঁক বন্ধ হয়ে গেছে। গলায় আঁটো হয়ে চেপে বসেছে বেল্টটা। ফুলে উঠল কুকুরটার বুক। ঝাঁকি খেল। খোলা মুখ দিয়ে এক খাবলা লালা গড়িয়ে পড়ল। ‘চুপ কর, নেড়ি, শান্ত হয়ে থাক!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। পাগলের মতো চোখ ঘোরাচ্ছে নেড়ি। অঞ্জনকে যেন দেখছে না, ওর কথাও শুনতে পাচ্ছে না। ‘শান্ত হ, নেড়ি, শান্ত হ।’ কলারে জোর করে আঙুল ঢুকিয়ে টান দিল অঞ্জন। গলায় প্রায় কেটে বসে গেছে চামড়ার বেল্টটা। হাত কাঁপছে অঞ্জনের। বেল্টটাকে টেনে কুকুরটার মাথার ওপর দিয়ে খুলে আনার চেষ্টা করছে। খোল, খোল, খুলে আয়, বারবার বলছে অঞ্জন। হ্যাঁ! হয়েছে। অবশেষে কলারটা খুলে আনল অঞ্জন। যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে উঠল একবার কুকুরটা। ‘নেড়ি, খুলে গেছে! আর ভয় নেই!’ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কুকুরটা। এখনও জোরে জোরে হাফাচ্ছে। প্রায় মরতে মরতে বেঁচেছে নেড়ি, অঞ্জন আসতে আরেকটু দেরি করলেই... কী ঘটত, সেটা আর ভাবতে চাইল না ও। অবশেষে নেড়ি যখন শান্ত হলো, কলারটা হাতে নিয়ে দেখল অঞ্জন। ‘এই নেড়ি, এটা এত ছোট হলো কী করে রে?’ কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করল ও। বেড়ার কাছে হেঁটে গেল নেড়ি। লপাৎ লপাৎ করে পানির গামলা থেকে পানি খেতে লাগল। এতণ উত্তেজনায় খেয়াল করেনি অঞ্জন, এখন ভাল করে দেখে বুঝল, বেল্টটা ছোট হয়নি। কুঁচকে ছোট হওয়া সম্ভবও না চামড়ার তৈরি জিনিসটা। তাহলে হঠাৎ করে ওটা নেড়ির গলায় এঁটে গিয়ে ওকে দম বন্ধ করে মারতে চাইছিল কেন? কুকুরটার দিকে তাকাল ও। তৃষ্ণার্ত ভঙ্গিতে একনাগাড়ে পানি খেয়ে চলেছে নেড়ি। একবার মুখ তুলে ফিরে তাকাল অঞ্জনের দিকে। তারপর আবার মুখ নামাল পানিতে। বড় হয়ে গেছে কুকুরটা। ভুল দেখছে না তো? না। সত্যিই আকারে বড় হয়ে গেছে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? নেড়ির যা বয়স এখন, মানুষের বয়সের তুলনায় আশি বছরের বুড়ো। এ বয়সে আর ওর বাড়ার কথা নয়। নিশ্চয়ই আমার চোখের ভুল, ভেবে, কলারটা ছুড়ে ফেলে দিল অঞ্জন। আসলে অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকার কারণে ভুলভাল দেখছি, নিজেকে বোঝাল ও। দরজায় এসে দাঁড়ালেন দাদু। অঞ্জনকে খেতে ডাকলেন। বাটিতে শুকনো খাবার ঢেলে রাখল অঞ্জন। পানির গামলা থেকে মুখই তুলছে না কুকুরটা। তাড়াহুড়া করে বাড়ির দিকে রওনা হলো অঞ্জন। * পরদিন সকালে ইপুদের বাড়ির দিকে রওনা হলো অঞ্জন। আকাশে ঘন মেঘ, বাতাসে শরতের আমেজ। ইপুদের পড়শির বাড়ির সামনের চত্বরে বড় একটা আমগাছের নিচে ওকে দেখতে পেল অঞ্জন। ‘এই, কী হয়েছে?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল ও। তারপর দেখল, কোন কিছুর ওপর ঝুঁকে রয়েছে ইপু, দ্রুত নড়ছে ওর হাত দুটো। কী যেন করছে। অঞ্জনকে দেখে মুখ না তুলেই চেঁচিয়ে ডাকল, ‘জলদি এসো, আমাকে সাহায্য করো!’ দৌড়ে গেল অঞ্জন। কাছে গিয়ে দেখল, গাছের গায়ে বাঁধা একটা বিড়ালের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে ইপু। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হিসিয়ে উঠল বিড়ালটা, থাবা মারতে চাইল ইপুর হাতে। ঝট করে হাতটা সরিয়ে এনে সাবধানে আবার হাত বাড়াল ও। দড়ির বড় গিঁটটা খোলার চেষ্টা করল। ‘হারু-তরুর কাজ,’ খ্যাঁচখ্যাঁচ করতে থাকা বিড়ালটার চিৎকারকে ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বলল ইপু। ‘সারা রাতই নিশ্চয়ই এখানে বাঁধা ছিল বেচারা।’ আতঙ্কে একনাগাড়ে চেঁচিয়ে চলেছে বিড়ালটা, অদ্ভুত চিৎকারটাকে একেবারে মানুষের চিৎকারের মত শোনাচ্ছে। ‘এই বিড়াল, চুপ থাক,’ ইপুর হাত ল্য করে আবার থাবা চালাতেই ধমক দিয়ে বলল অঞ্জন। ইপুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কী করব?’ ‘না, এখন আর কিছু করার নেই,’ জবাব দিল ইপু। গিঁটটা ধরে টান দিল। ‘ওই শয়তান দুটোকেও এভাবে বেঁধে রাখতে পারলে খুশি হতাম।’ আফসোস করল অঞ্জন। ‘নিশ্চয়ই ভীষণ ভয় পেয়েছে বিড়ালটা।’ ‘হয়েছে,’ বলে উঠল ইপু। টান দিয়ে দড়ি খুলে দিল। শেষবারের মতো আরেকবার চেঁচিয়ে উঠে, লেজ খাড়া করে দৌড় দিল বিড়ালটা। এক ছুটে ঢুকে পড়ল উঁচু একটা পাতাবাহারের ঝোপে। একবারের জন্যও ফিরে তাকাল না আর। উঠে দাঁড়িয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল ইপু। পরনে রঙচটা জিনসের প্যান্ট, গায়ে ঢলঢলে প্রায় হাঁটুর কাছে নেমে আসা হলুদ রঙের টি-শার্ট। শার্টের ঝুলটা দেখল ও, বিড়ালটা থাবা মেরে ফুটো করে দিয়েছে। ‘ওই দুই শয়তানের জ্বালায় অস্থির হয়ে গেলাম,’ বলল ও। ‘পুলিশকে জানানো দরকার,’ অঞ্জন বলল। ‘লাভ কী? কিছুই স্বীকার করবে না দুই ভাই,’ গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ইপু। তারপর যোগ করল, ‘বিড়ালটা তো আর সাী দিতে পারবে না।’ ‘হুঁ!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল অঞ্জন। ইপুকে নিয়ে দাদুর বাড়িতে চলল ও। সারাটা পথ আলোচনা করল দু’জনে, কিভাবে শিা দেয়া যায় হারু-তরুকে। কিন্তু কোন উপায় বের করতে পারল না। স্টাডিতে এল দু’জনে, যেখান ঘুমায় অঞ্জন। ইপু জিজ্ঞেস করল, ‘কী করা যায় এখন, বলো তো?’ ‘বই পড়তে পারি,’ তাকে রাখা ধুলোয় ঢাকা বইগুলোর দিকে আঙুল তুলে নিরস কণ্ঠে বলল অঞ্জন। ‘জাদু করে হারু-তরুকে জব্দ করতে পারলে খুশি হতাম। বলা যায় না, নিউট বানানোর কৌশলও পেয়ে যেতে পারি কোনও একটা বইয়ের মধ্যে।’ ‘বাদ দাও নিউট,’ হাত নাড়ল ইপু। ‘ভুতুড়ে জেলি কোথায় রেখেছ?’ অঞ্জন জবাব দেবার আগেই তাকে রাখা কৌটাটা চোখে পড়ল ওর। নেয়ার জন্য একসঙ্গে তাকের দিকে ছুটল দু’জনে। আগে পৌঁছল ইপু। থাবা দিয়ে নামিয়ে আনল তাক থেকে। একবার তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ‘অঞ্জন, দেখো অবস্থা!’ কৌটাটা উঁচু করে ধরল ও। ঢাকনা ঠেলে খুলে কিনার দিয়ে উপচে বেরিয়ে আসছে আঠাল হলুদ জেলির মতো জিনিসটা। বারো. ‘অ্যাঁ? ঢাকনাটা ফেটে গেল নাকি?’ অঞ্জনের প্রশ্ন। ইপুর হাত থেকে কৌটাটা নিয়ে ভালমত দেখল। ঢাকনাটা খুলে একটা পাশ উঁচু হয়ে আছে। কৌটার ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে হলুদ জেলি। ঢাকনা সরিয়ে এক খাবলা হলুদ জেলি বের করল ও। ‘অদ্ভুত তো!’ চেঁচিয়ে উঠে বলল। ‘বাড়ছে জিনিসটা!’ হাতের তালুতে নিয়ে চাপ দিল। ‘বাড়ছে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই।’ ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে!’ ইপু বলল। ‘এতই বেড়েছে, কৌটা থেকে বেরিয়ে পড়ে যাচ্ছে।’ ‘দেখো, আগের মত ঠাণ্ডাও লাগছে না,’ অঞ্জন বলল। বল বানিয়ে ইপুর দিকে ছুড়ে দিল ও। লুফে নিল ইপু। ‘হ্যাঁ, তাই তো। আশ্চর্য!’ আবার অঞ্জনের দিকে ছুড়তে গেল বলটা। কিন্তু ওর তালুতে আটকে রইল ওটা। ‘আরে, আঠাও তো হয়ে গেছে। অঞ্জন, সেই একই জিনিস আছে তো, নাকি বদলে ফেলেছ?’ ‘বদলাব কেন?’ ভুরু নাচাল অঞ্জন। ‘আগে তো এ রকম আঠা ছিল না,’ ইপু বলল। ‘আমার মনে হয় বাতাস লেগে নষ্ট হয়ে গেছে, ঢাকনা খোলার পর। জিনিসটার কার্যকারিতা খতম।’ কৌটা থেকে আরেক খাবলা হলুদ জেলি বের করল অঞ্জন। বল বানিয়ে মেঝেতে আছাড় দিল। ‘দেখো, আগের মত লাফাচ্ছে না আর। মেঝেতে আটকে গেছে।’ ‘আশ্চর্য!’ আবার বলল ইপু। ‘নাহ্, নষ্টই হয়ে গেছে। ট্র্যাশ বিনে ফেলে দিতে হবে,’ অঞ্জন বলল। মেঝে থেকে টেনে তুলল হলুদ জেলি। ‘না লাফালে এটা রেখে আর কী করব?’ ‘উঁহুঁ, এখনই ফেলা বোধ হয় উচিত হবে না,’ ইপু বলল। ‘আরও কী পরিবর্তন হয় এটার, দেখা দরকার।’ দরজার কাছে মিউ করে বিড়ালের ডাক শোনা গেল। ফিরে তাকিয়ে কুসিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুরু কোঁচকাল অঞ্জন। মাথাটা এক পাশে কাত করে রেখেছে বিড়ালটা। হলুদ চোখ দুটো তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর দিকে, নাকি ওর হাতের ভুতুড়ে জেলির দিকে? ‘ওই বিড়ালটাকে খুব বুদ্ধিমান বিড়াল মনে হয়,’ ইপু বলল। ‘দুর, অন্য সব বোকা বিড়ালের মতই বোকা বিড়াল এটাও,’ বিড়বিড় করল অঞ্জন। ‘দেখো। মনে হচ্ছে ভুতুড়ে জেলি নিয়ে বল খেলতে চায়।’ ‘স্যরি, বিড়াল,’ ইপু বলল। ‘এই বলটা লাফায় না।’ যেন বুঝতে পারল বিড়ালটা। হতাশ ভঙ্গিতে মিউ করে, ঘুরে দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেল। ‘এ জিনিস এখন রাখব কোথায়?’ কোটাটা দেখাল অঞ্জন। ‘বেড়ে তো আর কৌটাতেও জায়গা হচ্ছে না।’ ‘এই যে, এটাতে রাখলে কেমন হয়?’ নিচের তাক থেকে একটা খালি কফির টিন টেনে বের করল ইপু। ‘হ্যাঁ। রাখা যায়,’ হাতের জেলিটুকু টিনের ভেতর ছুড়ে ফেলল অঞ্জন। ইপুও খানিকটা হলুদ জেলি বের করে নিয়েছে। হাতের তালুতে রেখে চাপ দিল। ‘দেখো। আগের মত আর জ্বলছেও না, হলুদ আভা বেরোচ্ছে না।’ অঞ্জনের দিকে তুলল জিনিসটা। ‘তবে গরম। অনেক বেশি গরম।’ ‘জ্যান্ত হয়ে গেছে!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। মুখ বাঁকিয়ে রসিকতা করল, ‘বাবাগো! জ্যান্ত পিশাচ! পালাও!’ হেসে উঠে অঞ্জনকে তাড়া করল ইপু। হলুদ জেলিটা অঞ্জনের মাথায় লাগিয়ে দিতে চাইল। ‘এসো, ধরো! তোমার ভুতুড়ে জেলি তুমি নিয়ে নাও!’ ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলে, থাবা দিয়ে ইপুর হাত থেকে জেলি কেড়ে নিল অঞ্জন। তারপর গোল করে বল বানিয়ে ফেলে দিল কফির টিনে। কৌটার বাকি জেলিটুকুও বের করে নিয়ে টিনে রাখল। দু’জনেই তাকাল টিনের ভেতর। অর্ধেকের বেশি ভরেছে। টিনটা অঞ্জনের দিকে ঠেলে দিয়ে ইপু বলল, ‘মুখে দেয়ার সাহস আছে?’ ‘না, নেই। তোমার সাহস আছে?’ কফির টিনটা আবার ইপুর দিকে ঠেলে দিল অঞ্জন। ‘আমি তোমাকে আগে খেতে বলেছি,’ হেসে বলল ইপু। ‘খাও। দেখো, খেতে কেমন লাগে।’ মুখ বাঁকাল অঞ্জন। মাথা নাড়ল। তারপর আচমকা খামচা দিয়ে এক খাবলা জেলি তুলে ইপুর মুখে লাগিয়ে দিতে গেল। মুখ সরিয়ে নিল ইপু। অঞ্জনের হাত থেকে মেঝেতে কার্পেটের ওপর পড়ে গেল জেলির বল। ছোঁ মেরে ওটা তুলে নিয়ে অঞ্জনকে ল্য করে ছুঁড়ে মারল ইপু। মাথা নামিয়ে ফেলল অঞ্জন। ওর মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে দেয়ালে আটকে চ্যাপ্টা হয়ে গেল হলুদ জেলির বলটা। টিন থেকে আরেক খাবলা জেলি তুলে নিল অঞ্জন। ছুড়ল ইপুকে ল্য করে। ভুতুড়ে জেলি নিয়ে খেলতে খেলতে ডিনারের সময় হয়ে গেল। ঘরের দেয়াল আর মেঝেতে লেগে যাওয়া জেলি আর দাগ পরিষ্কার করছে ওরা, এ সময় নেড়ির চিৎকার ভেসে এল জানালা দিয়ে। জানালার দিকে ছুটল দু’জনে। আগে পৌঁছল অঞ্জন। আকাশের রঙ এখনও ধূসর, মেঘে ঢাকা। বোধ হয় একা থাকতে ভাল না লাগাতেই খোঁয়াড় থেকে বেরোনোর জন্য চেঁচামেচি করছে নেড়ি। ‘এই নেড়ি,’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ‘থাম! চুপ কর!’ ‘অঞ্জন, তোমার কুকুরটার কী হয়েছে বলো তো?’ ইপু জিজ্ঞেস করল। ‘বেড়েই তো চলেছে। দেখো, কত বড় হয়ে গেছে।’ সত্যি, আগের দ্বিগুণ হয়ে গেছে কুকুরটা। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল অঞ্জন। তেরো. ‘নেড়ি, ফিরে আয়! এই নেড়ি!’ ফিরল না মস্ত কুকুরটা। দৌড়ে চলেছে। ওটার বিশাল পা থপ্-থপ্ শব্দ তুলছে কংক্রিটের রাস্তায়। ‘আয় বলছি!’ চিৎকার করে বলল অঞ্জন। কুকুরটার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। মরিয়া হয়ে ধরার চেষ্টা করছে। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ডটা। ছুটতে ছুটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। তবু ধরতে পারছে না কুকুরটাকে। অন্ধকার রাত। তারা নেই আকাশে। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছিল। অন্ধকারেও চকচক করছে কংক্রিটের ভেজা রাস্তা। নেড়ির মস্ত ছুটন্ত পা যেন ঢাকের শব্দ তুলছে রাস্তায় পড়ে। প্রতিধ্বনি তুলছে। কুকুরটার মস্ত কান দুটো জোরাল বাতাসে ডানার মতো উড়ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ি খাচ্ছে মাথার দুই পাশে। ছোটার তালে তালে ওপরে-নিচে দুলছে বিশাল মাথাটা। কিন্তু অঞ্জনের ডাকে সাড়া দিয়ে একটিবারের জন্য ফিরে তাকাচ্ছে না। ‘নেড়ি! নেড়ি!’ ঝড়ো বাতাসে চাপা পড়ে যাচ্ছে অঞ্জনের ডাক। আরও জোরে চিৎকার করতে চাইল ও। শব্দ বেরোল না মুখ দিয়ে। কুকুরটাকে পালাতে দেয়া যাবে না, আটকাতে হবে। ধরতে হবে, যে করেই হোক। এতবড় কুকুর রাস্তায় ছাড়া থাকাটা নিরাপদ নয় মোটেও। টাট্টু ঘোড়ার সমান বড় হয়ে গেছে নেড়ি। মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। এ হারে বড় হতে থাকলে হাতি হতে দেরি হবে না। ‘নেড়ি, নেড়ি, থাম সোনা!’ কিন্তু ওর ডাক কানেই ঢুকছে না কুকুরটার। শোঁ-শোঁ শব্দে বয়ে চলা, পাক খেতে থাকা ঝড়ো বাতাস যেন অঞ্জনের ডাক আটকে ফেলছে, পৌঁছতে দিচ্ছে না কুকুরটার কানে। তবু হাল ছাড়ছে না অঞ্জন। দৌড়ে চলেছে। বুকের মধ্যে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। দেহের প্রতিটি পেশি ব্যথা হয়ে গেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ ল করল, দুটো ছেলে কুকুরটার আগে আগে দৌড়াচ্ছে। আরে, হারু-তরু! দৈত্যাকার জানোয়ারটার কাছ থেকে প্রাণভয়ে দৌড়ে পালাতে চাইছে দুই যমজ ভাই। নেড়ি ওদের তাড়া করেছে, বুঝতে পারল অঞ্জন। মোড় নিল ছেলেগুলো, আরও অন্ধকার একটা রাস্তায় গিয়ে পড়ল। ওদের অনুসরণ করছে নেড়ি, লাফাতে লাফাতে ছুটেছে। অন্ধকারে অঞ্জনও দৌড়াচ্ছে, সবার পেছনে থেকে রহস্যময় এক কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে যেন। আশপাশটা পুরোপুরি নীরব। শুধু নেড়ির বিশাল পায়ের একটানা থপ্-থপ্ থপ্-থপ্ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ও, না আছে। চকচকে পাকা রাস্তায় হারু-তরুর জুতোর খটা-খট্ শব্দ। ফোঁস-ফোঁস করে হাঁপাচ্ছে অঞ্জন। কুকুরটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে ওটার পেছনে লেগে থাকতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। ফুসফুসে যেন আগুন ধরে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ডটা ফেটে বেরিয়ে আসার জোগাড়। আতঙ্কিত হয়ে দেখল অঞ্জন, পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে গেছে কুকুরটা। আকাশের দিকে মুখ তুলে কানফাটা গর্জন করল। কুকুরের ডাক নয়। ভয়াল গর্জন। বাস্তব কোনও প্রাণীর সঙ্গে এর মিল নেই। বদলাতে শুরু করল নেড়ির আকৃতি। কপালটা ফুলে উঠে সামনে ঠেলে বেরোল, বড় হয়ে গেল। চোখ দুটো চওড়া হয়ে গিয়ে ফোলা কপালের মধ্যে বসে গেল। হাঁ করা মুখের ভেতর থেকে বেরোল বড় বড় শ্বদন্ত। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে গর্জন করল ভুতুড়ে জানোয়ারটা। আগের চেয়ে জোরে। রক্ত পানি করা হাঁক। ‘দানব হয়ে গেছে ও! দানব!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘মায়ানেকড়ে!’ ঘুম ভেঙে গেল ওর। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠল। বুঝল, বিছানায় রয়েছে। দাদুর বাড়ির স্টাডিতে, এখন যেটা অঞ্জনের শোবার ঘর। বিছানাটা অস্বস্তিকর লাগছে। মনে হচ্ছে, জায়গা হচ্ছে না। লাফিয়ে উঠে বসল অঞ্জন। ওর পায়ের দিকে তাকাল। হাতের দিকে তাকাল। দানবীয় হাত-পা। এতবড় হয়ে গেছে ও, শরীরের তুলনায় বিছানাটা এখন অনেক ছোট। দৈত্য হয়ে গেছি আমি! দৈত্য! প্রচণ্ড আতঙ্কে মুখ হাঁ করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে গেল ও। স্বর বেরোল না গলা দিয়ে। চোদ্দ. ওর চিৎকারই ওকে জাগিয়ে দিল। এবার সত্যি সত্যি ঘুম ভেঙেছে। প্রথম দুঃস্বপ্নটা দেখার পর স্বপ্নের মধ্যেই জেগে যেতে দেখেছে নিজেকে। তখন আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছে দৈত্য হয়ে গেছে। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন। এবার সত্যি জেগেছে তো? উঠে বসল। চোখ মিটমিট করল। চোখের পাতা ডলল। ভাল করে তাকানোর চেষ্টা করল। দরদর করে ঘামছে। চাদরটা মেঝেতে পড়ে গেছে, ঘুমের মধ্যে ফেলে দিয়েছে গা থেকে। ঘামে ভিজে পাজামাটা পায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে। ঘরের কোন কিছুই পরিচিত লাগছে না। স্বপ্নটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, কোথায় আছে বুঝতে কিছুটা সময় লাগল। দিলারা দাদুর বাড়িতে রয়েছে। পুরোপুরি সজাগ। স্বাভাবিক আকৃতির দেহ। জোরাল বাতাসে পর্দা উড়ল। কোনা বাড়ি খেল ওর গায়ে। বাতাস সড়াৎ করে টান দিয়ে জানালার বাইরে নিয়ে গেল পর্দাটা। বিছানায় বসে আছে অঞ্জন। গায়ের কাঁপুনি এখনও থামেনি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। হালকা ফিতের মতো কুণ্ডলী পাকানো ধূসর মেঘ ভেসে যাচ্ছে আধখানা ফ্যাকাশে চাঁদের ওপর দিয়ে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে ঝাঁকি খাচ্ছে গাছের মাথা, ফিসফিস শব্দ করছে। নেড়িকে দেখল, গভীর ঘুমে অচেতন। কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। তারের বেড়ায় গা ঠেকিয়ে। দুঃস্বপ্নে দেখা দানবে পরিণত হয়নি নেড়ি। তবে অনেক বড় হয়েছে। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে ওর দেহে। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে ভাবছে অঞ্জন। হয়তো কোনও একটা গ্ল্যান্ডের সমস্যা। হাই তুলল অঞ্জন। ঘুমে ঘোলাটে হয়ে আছে মাথার ভেতরটা। ঠিকমত চিন্তা করতে পারছে না। আগামীকাল সকালে একজন পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে কুকুরটাকে। আবার হাই তুলে, বিছানায় শুতে যাবে, ঠিক এই সময় চোখে পড়ল জিনিসটা। তাকে রাখা কফির টিন। যেটাতে ভুতুড়ে জেলি ভরে রেখেছিল। এ-কি! টিনের মুখ দিয়ে উপচে পড়ছে হলুদ জেলি। থরথর করে কাঁপছে। জ্যান্ত প্রাণীর মত। পনেরো. ‘কই, ঠিকই তো আছে তোমার কুকুরটা, বয়সের তুলনায় পুরোপুরি সুস্থ,’ নেড়ির গলার নিচে চুলকে দিলেন ডাক্তার। পশু ডাক্তার আবদুল খালেক। ‘সাদা চুলগুলো দেখো। একেবারে স্বাভাবিক।’ কুকুরটার প্রায় মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলেন তিনি। ‘তাই না রে, বুড়ো কুকুর?’ ডাক্তারের হাত চেটে দিল কুকুরটা। হাসলেন ডাক্তার। সরু নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ঠেলে তুলে দিলেন ওপরে। তাঁর চকচকে কপালে প্রতিফলিত হলো ছাদের বাতিটা। সাদা ডাক্তারি অ্যাপ্রনে হাত মুছলেন তিনি। ছোট, উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত ঘরটায় নেড়ির কাছ থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জন ও ইপু। অনেকণ ধরে কুকুরটাকে পরীা করেছেন ডাক্তার, সে-সময়টায় ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে ছিল দু’জনে। এখন, ডাক্তারের রায় শোনার পর, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। টান টান ভাবটা নেই আর মুখে। ‘তাহলে এই বড় হওয়াটা স্বাভাবিক বলছেন আপনি?’ অঞ্জন জিজ্ঞেস করল। মাথা ঝাঁকালেন পশু ডাক্তার। ফিরে গেলেন ঘরের কোণে রাখা তাঁর ডেস্কে। ‘স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে, তবে এ জাতের কুকুরের জন্য ব্যাপারটা অস্বাভাবিক,’ মোলায়েম স্বরে বলে, ডেস্কের ওপর ঝুঁকে কাগজে খসখস করে লিখতে শুরু করলেন। ‘খুবই অস্বাভাবিক। তিন-চার দিনের মধ্যেই রক্ত পরীার ল্যাবরেটরি রিপোর্ট পেয়ে যাব। তখন আরও কিছু জানতে পারব। তবে আমার যেটা অবাক লাগছে, কুকুরটা পুরোপুরি সুস্থ। কোন রোগ পেলাম না, শঙ্কিত হওয়ারও কোন কারণ দেখছি না।’ ‘ককার স্প্যানিয়েল কি এত বড় হয়?’ নিচু হয়ে নেড়ির গলার নিচে চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। গলায় বাঁধা শিকলের এক মাথা ধরে রেখেছে, ঢিল হয়ে ওর হাতে ঝুলছে শিকলটা। বেরিয়ে যেতে চাইল নেড়ি। দরজার দিকে টেনে নিতে চাইল অঞ্জনকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে টান দিয়ে কুকুরটাকে আটকে রাখল ও। ভীষণ জোর লাগছে তাতে। শুধু যে বড় হয়েছে নেড়ি, তা নয়, সাথে সাথে শক্তিও বেড়েছে। কয়েক দিন আগেও যা ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি। ‘নাহ্,’ মাথা নাড়লেন ডাক্তার। ‘কখনই এত বড় হয় না। এ জন্যই রক্তের হরমোন টেস্ট করতে দিচ্ছি। রক্ত নিলাম। গ্ল্যান্ডিউলার স্যাম্পল নিলাম। ল্যাবরেটরি পরীার ফলাফল থেকে হয়তো আমাদের প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।’ লেখা শেষ করে টান দিয়ে প্যাডের কাগজটা ছিঁড়ে নিলেন তিনি। ‘এই যে,’ কাগজটা বাড়িয়ে দিলেন অঞ্জনের দিকে। ‘ভাল একটা ডগ ফুড লিখে দিলাম। এটা নিয়ম করে খাওয়াবে। আসল খাবার কমিয়ে দেবে। আগের মত ছোট হয়তো আর হবে না কখনও কুকুরটা, তবে আশা করি বাড়বেও না আর।’ ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিয়ে দরজার দিকে ফিরল অঞ্জন। আবার টান দিল নেড়ি। এবার আর বাধা দিল না অঞ্জন, শিকলের টানে কুকুরটার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলল। ওদের পেছন পেছন এল ইপু। ‘ডাক্তার যখন বলেছেন...’ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল ইপু। ‘সর্বনাশ, এত্ত দেরি হয়ে গেছে! আমার অঙ্কের মাস্টার চলে এসেছেন নিশ্চয়ই। মা আজ আর আমাকে আস্ত রাখবে না।’ ফুটপাথ ধরে উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করল ইপু। আরেকটু হলেই ধাক্কা খেতো রাস্তার একজন লোকের গায়ে। ইপুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কুকুরটার দিকে তাকাল অঞ্জন। ‘চল, যাই।’ পশু ডাক্তারের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চলল ও। কুকুরটার শিকল ধরে রেখেছে। ডাক্তারের আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছে না, দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। একটা দোকানের সামনে দাঁড়াল। ‘একটা আইসক্রিম খেলে মন্দ হয় না,’ বিড়বিড় করে নিজেকেই বলল। ‘তাতে মন খুশি হবে।’ দোকানের উল্টো দিকে একটা কাঁটাতারের বেড়ার কংক্রিটের খুঁটির সঙ্গে শিকলটা বাঁধল ও। ‘থাক এখানে। আমি আসছি।’ বলে দোকানের দিকে এগোল ও। কথা শুনল না নেড়ি। টান দিয়ে শিকল খোলার চেষ্টা করতে লাগল। ফিরে তাকিয়ে আবার বলল অঞ্জন, ‘আমার দেরি হবে না।’ ছুটে দোকানের ভেতর ঢুকে পড়ল ও। দোকানে তিন-চারজন খরিদ্দার রয়েছে, আর তার কারণে আইসক্রিম কিনে বেরোতে কিছুটা সময় লাগল অঞ্জনের। বেরিয়ে দেখে কুকুরটার শিকল খুলছে হারু-তরু। ‘এই, খুলো না, খুলো না!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ফিরে তাকাল দুই ভাই। দু’জনের মাংসল মুখে একই ধরনের হাসি। ‘দেখো, কে আসছে,’ একজন বলল ওর ভাইকে। অন্যজন খুঁটি থেকে শিকলটা খুলে ফেলল। দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথে উঠল অঞ্জন। এক হাতে আইসক্রিম বারটা ধরে রেখে অন্য হাত বাড়াল, ‘দাও শিকলটা আমার হাতে।’ শিকলের মাথাটা অঞ্জনের দিকে বাড়িয়ে দিল তরু, ‘নাও, ধরো।’ অঞ্জন ধরতে যেতেই ঝট করে সরিয়ে নিল। হেসে বলল, ‘পারলে না, পারলে না।’ মজা পেয়ে খিকখিক করে হেসে একে অন্যের গায়ে চাপড় মারল দুই ভাই। ‘দেখো, বোকামি কোরো না,’ অঞ্জন বলল। ‘শিকলটা আমার হাতে দাও।’ ‘যে পায় সে রাখে,’ ভাইয়ের দিকে তাকাল তরু। ‘কী বলো, হারু?’ ‘নিশ্চয়ই,’ হেসে মাথা ঝাঁকাল হারু। ‘জঘন্য একটা কুৎসিত কুকুর। তবে এটার মালিক এখন আমরা। কুকুরের চেহারা নিয়ে মাথা ঘামাব না।’ ‘মতা থাকলে আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নাও,’ চোখের পাতা সরু করে অঞ্জনের দিকে তাকাল তরু। অঞ্জনের হাতের আইসক্রিমটার দিকে তাকাল হারু। তারপর সামনে এগিয়ে আচমকা এক থাবা মারল। রাস্তায় পড়ে ভেঙে গেল আইসক্রিম-বারটা। যেন কী সাংঘাতিক মজার কাজ করে ফেলেছে, হাসতে লাগল দুই ভাই। কিন্তু ওদের হাসি থামিয়ে দিল নেড়ি। চাপা স্বরে ভয়ানক গর্জন করে উঠল। ঠোঁট দুটো সরে মাঢ়ির ওপর উঠে গিয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে চেহারা। গরগর করতে করতে আবার এক প্রচণ্ড হাঁক ছাড়ল। ‘সাবধান, হারু...’ বলে হাত থেকে শিকল ছেড়ে দিল তরু। আরেকবার ক্রুদ্ধ গর্জন করে লাফিয়ে উঠল নেড়ি। পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে সামনের দুই পা তরুর বুকে তুলে ধাক্কা মারল। চিত হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল তরু। হারু ততণে দৌড়াতে শুরু করেছে। রাস্তায় খট্ খট্ শব্দ তুলছে ওর জুতোর তলা। পড়িমরি করে ছুটছে। পশু ডাক্তারের অফিস পেরিয়ে, পোস্ট অফিসের পাশ কাটিয়েও থামল না। ‘এই দাঁড়াও! হারু, দাঁড়াও!’ বলে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনমতে উঠে দাঁড়াল তরু। একটা মুহূর্তও দেরি না করে ভাইকে অনুসরণ করল। তাড়া করল নেড়ি। থাবা দিয়ে শিকলের মাথাটা ধরার চেষ্টা করল অঞ্জন। ফসকে গেল। ‘নেড়ি, দাঁড়া! যাসনে! নেড়ি!’ কিন্তু শুনল না কুকুরটা। রাগে চিৎকার করে, রাস্তায় মস্ত পায়ের শব্দ তুলে তাড়া করেছে দুই ভাইকে। যতই এগোচ্ছে, ততই গতি বাড়াচ্ছে। দোকানের সামনে বরফের মত জমে গেছে যেন অঞ্জন। কী করবে বুঝতে পারছে না। এ রকম ঘটনা স্বপ্নে দেখেছিল। কেঁপে উঠল অঞ্জন। স্বপ্নের বাকি দৃশ্যটা মনে পড়ল। কিভাবে দুই ভাইকে তাড়া করতে করতে ভুতুড়ে প্রাণী হয়ে গিয়েছিল নেড়ি। কিভাবে অঞ্জনও দৈত্যে পরিণত হয়েছিল। পুরো ঘটনাটা কি এখন বাস্তবে ঘটবে? শিউরে উঠল ও। ষোলো. সেদিন সন্ধ্যায় ইপুকে ফোন করল অঞ্জন। ‘আমি যদি তোমাদের বাড়িতে আসি, অসুবিধে আছে? একটা ছোটখাটো সমস্যা হয়েছে।’ ‘ছোটখাটো? কিন্তু তোমার গলা শুনে তো মনে হচ্ছে বিরাট সমস্যা,’ ইপু বলল। ‘হয়তো বিরাট সমস্যাই,’ অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল অঞ্জন। ‘আসব?’ ‘তরু আর হারুর কোন খোঁজ পেয়েছ? সমস্যাটা কি ওরাই?’ ‘না,’ অঞ্জন বলল। ‘আগেই বলেছি, আমি নেড়ির কাছে পৌঁছানোর আগেই ওরা গায়েব হয়ে গিয়েছিল। চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছিল নেড়ি। বহু কষ্টে ওকে টেনে বাড়ি নিয়ে গিয়ে খোঁয়াড়ে ভরেছি।’ ‘তাহলে সমস্যাটা কি তোমার?’ ইপু জিজ্ঞেস করল। ‘টেলিফোনে বলা যাবে না। দেখাতে হবে,’ অঞ্জন বলল। ‘আমি আসছি। রাখি।’ রিসিভার রেখে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নামল ও, হাতে একটা বালতি। দাদু রান্নাঘরে, অঞ্জনের দিকে পেছন করে আছেন, গোশত কাটার বড় ছুরিটা দিয়ে কোন কিছু কোপাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি সরে এল অঞ্জন। বেরিয়ে এসে তাড়াহুড়া করে চলল ইপুদের বাড়িতে। ইপুদের বাড়ির সামনের আঙিনায় পাতাবাহারের নিচু বেড়া। ওর বাবাÑইপু বলেছেÑলনের ব্যাপারে রীতিমত খেপা। একেবারে ইঞ্চি মেপে নিখুঁতভাবে ঘাস ছাঁটেন, দেড় ইঞ্চি উঁচু ঘাসগুলো কার্পেটের মত সমান আর মসৃণ। বাড়ির সামনে চমৎকার একটা ফুলের বাগান। মোলায়েম বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে অসংখ্য লাল আর সাদা গোলাপ। সামনের দরজায় টোকা দিল অঞ্জন। ‘বালতিতে কী?’ দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল ইপু। ‘দেখো,’ জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে অঞ্জন, পুরোটা রাস্তা দৌড়ে এসেছে। দাদুর গ্যারেজ থেকে নিয়ে আসা অ্যালুমিনিয়ামের বালতিটা উঁচু করে দেখাল ও। ‘সর্বনাশ,’ চেঁচিয়ে উঠল ইপু। দুই হাত উঠে এসেছে মুখের ওপর, চোখ বড় বড়। ‘হ্যাঁ, সর্বনাশ!’ ইপুর কথার প্রতিধ্বনি করল অঞ্জন। ঘরে ঢুকল। ‘ভুতুড়ে জেলি। বেড়েই চলেছে। দেখো, বালতিটাও ভরে গেছে। কী করব আমরা?’ ‘আমরা মানে?’ অঞ্জনকে বসার ঘরের দিকে নিয়ে চলল ইপু। ‘দেখো, ব্যাপারটা রসিকতা নয়,’ গম্ভীর স্বরে বলল অঞ্জন। ‘কিন্তু তুমি তো এটা আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে রাজি হওনি,’ মনে করিয়ে দিল ইপু। ‘এখন করব,’ অঞ্জন বলল। ‘সত্যি বলতে কী, এখন এটা তোমাকে দিয়ে দিতেও রাজি আমি। নেবে? পয়সা লাগবে না।’ বালতিটা ইপুর দিকে বাড়িয়ে ধরল ও। ‘না,’ মাথা নাড়ল ইপু। ‘নামিয়ে রাখো না। অকারণে হাতে ধরে রেখেছ কেন?’ লাল রঙের একটা সোফা দেখাল ও। ‘ওটার ওপাশে রাখো। আমি ওই ভুতুড়ে জেলির দিকে তাকাতে পারছি না। গা ছমছম করে।’ ‘আমারও তো করে!’ ককিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘কী করি এখন বলো তো? যতবার তাকাই, দেখি, আগের চেয়ে বেড়েছে। নেড়ির মত...’ ঝট করে হাত তুলল ইপু। ‘দাঁড়াও! দাঁড়াও! নেড়ির মত বললে না?’ ইপু কী বলতে চায় বুঝে ফেলেছে অঞ্জনও। হলুদ জেলির একটা বল খেয়ে ফেলেছিল নেড়ি! ‘তোমার কী মনে হয়...’ বলতে গেল অঞ্জন। ‘হ্যাঁ,’ বাধা দিয়ে বলল ইপু। ‘নেড়িও বড় হচ্ছে ভুতুড়ে জেলি খেয়ে ফেলাতেই।’ ‘কী করি বলো না,’ আবার ককিয়ে উঠল অঞ্জন। বিচলিত ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করল ঘরের ভেতর। দুই হাত প্যান্টের পকেটে। ‘এই জেলিটা বেড়েই চলেছে, নেড়িরও একই অবস্থা। এখানে আমি একা। সাহায্য করার কেউ নেই। কেউ না।’ ‘কেন, তোমার দাদু?’ বলে মেঝেতে রাখা বালতিটার দিকে তাকাল ইপু। ‘তোমার দাদু নিশ্চয়ই কোনও একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারবেন...’ ‘না, তা তিনি করবেন না। তিনি কানে শোনেন না, আর শুনলেও আমার এ সব কথা শুনতে চাইতেন না। আমাকে দেখতে পারেন না। সারাটা দিন বসে বসে শুধু জিগসো পাজল খেলেন আর বিড়ালটার সঙ্গে ঝগড়া করেন।’ ‘হুঁ, বেশ, দাদুর কথা তাহলে ভুলে যাও,’ হতাশ ভঙ্গিতে বলল ইপু। ‘যদি পশু ডাক্তারকে বলতে পারো...’ ‘তাঁকে বলে লাভ কী?’ রুকণ্ঠে বলল অঞ্জন। ‘তিনি কি আমার কথা বিশ্বাস করবেন? ভুতুড়ে জেলি খেয়ে নেড়ি বড় হয়েছে, একথা তাঁকে বলতে গেলে তিনি আমাকে পাগলা গারদে পাঠাবেন।’ ধপ করে সোফায় বসে পড়ল ও। ‘আমি এখানে একেবারেই একা, ইপু। আমাকে সাহায্য করার কেউ নেই। এমনকি এ ব্যাপারে কথা বলার পর্যন্ত কেউ নেই।’ ‘শুধু আমি বাদে?’ ‘হ্যাঁ,’ ইপুর চোখে চোখে তাকাল অঞ্জন, ‘শুধু তুমি বাদে।’ সোফার আরেক প্রান্তে বসল ইপু। দ্বিধা করে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কী করতে পারি?’ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল অঞ্জন। বালতিটা তুলে এনে ইপুর সামনে রাখল। ‘এটা আমরা ভাগাভাগি করে নিতে পারি। তুমি খানিকটা নিয়ে নাও।’ ‘তাতে লাভটা কী? তারচেয়ে চলো না কেন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসি?’ বালতিটার দিকে তাকিয়ে বলল ইপু। বালতির কানার কাছে উঠে এসেছে হলুদ জেলি। ‘ফেলে দেব? উচিত হবে না,’ অঞ্জন বলল। ‘কেন হবে না? এসো আমার সঙ্গে।’ বালতিটা তুলতে হাত বাড়াল ইপু। বালতিটা সরিয়ে নিল অঞ্জন। ‘ডাস্টবিনে ফেললেই সমস্যার সমাধান হবে না। যদি ডাস্টবিন ভরে উপচে পড়ে? তারপরও বাড়তে থাকে? পুরো শহর ভরে ফেলে?’ ‘তাই তো! তখন সমস্যাটা অনেক বড় হয়ে যাবে,’ ইপু বলল। ‘কী করব, বুঝতে পারছি না।’ ‘তা ছাড়া,’ উত্তেজিত কণ্ঠে অঞ্জন বলল, ‘সত্যিই যদি এটা খেয়ে নেড়ি বড় হয়ে থাকে, প্রমাণ করার জন্যও জিনিসটা লাগবে। বুঝতে পারছ না? ডাক্তারকে দেখাতে হবে। যাতে কুকুরটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেন তিনি।’ ‘কিন্তু...’ ‘যদি তুমি আমাকে সাহায্য করতেই চাও,’ অঞ্জন বলল, ‘এখান থেকে খানিকটা নিয়ে নিলেই আমি বেঁচে যাই।’ ‘নিতে সাহস হচ্ছে না,’ ইপু বলল। ‘তবু, ঠিক আছে, নিতে পারি, অল্প একটু।’ উঠে দাঁড়াল ও। বালতিটার পাশ কাটিয়ে এগোল। ‘আমি আসছি।’ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও। একটু পরেই ফিরে এল একটা কফির টিন নিয়ে। হাসিমুখে বলল, ‘এটা ভরে দাও।’ টিনটার দিকে তাকিয়ে থেকে অঞ্জন বলল, ‘মাত্র এটুকু নেবে?’ রুকণ্ঠে বলে উঠেও তাড়াতাড়ি স্বর কোমল করল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, এতেও কিছুটা কমবে।’ হাঁটু গেড়ে বসে বালতির মাঝখানে জেলির মধ্যে টিনটা ডুবিয়ে দিল ও। পরণে ‘বাপরে!’ বলে চিৎকার দিয়ে, দুই হাত তুলে পেছনে ছিটকে পড়ল, মেঝের ওপর। ‘কী হয়েছে?’ তাড়াতাড়ি ইপুর দিকে এগিয়ে এল অঞ্জন। ‘এমন টান দিয়ে টিনটাকে নিয়ে গেল না!’ ভয় দেখা যাচ্ছে ইপুর চোখে। ‘স্রেফ টেনে নিয়ে গেল। দেখো।’ বালতির দিকে তাকাল অঞ্জন। টিনটা দেখা যাচ্ছে না। ‘আরে তাই তো?’ ‘এমন জোরে টান মারল!’ গলা কাঁপছে ইপুর। উঠে এসে সোজা হয়ে বসল আবার বালতির কাছে। ঝুঁকে ভেতরে তাকাল। ‘দেখি তো,’ বলে জেলির মত থকথকে জিনিসটার ভেতরে দুই হাত ঢুকিয়ে দিল অঞ্জন। ‘হ্যাঁ, টানে, তুমি ঠিকই বলেছ, ‘আমার হাত টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। আর খুব গরম। জ্যান্ত প্রাণীর মত।’ ‘আর বোলো না, আমার ভয় লাগছে!’ কেঁপে উঠল ইপু। ‘টিনটা বালতি থেকে বের করো।’ দুই হাতে চেপে ধরে, জোরে টান দিয়ে অবশেষে টিনটা বের করে আনল অঞ্জন। পুরো টিনটা কানায় কানায় ভর্তি। ওটার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল ও, যেন বমি আসছে। ‘ওয়াক!’ ‘সত্যিই আমাকে নিতে বলছ?’ অঞ্জনের বাড়িয়ে ধরা টিনটা নেবার কোন আগ্রহ দেখা গেল না ইপুর মাঝে। ‘রাখো না, অল্প সময়ের জন্য,’ অঞ্জন বলল। ‘এটার হাত থেকে মুক্তি পাবার একটা উপায় খুঁজে বের না করা পর্যন্ত।’ ‘নিয়ে গিয়ে হারু-তরুকে খাইয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়,’ ইপু বলল। ‘হ্যাঁ, খাইয়ে ওদের দৈত্য বানাই, আর আমাদেরকেই মাথায় তুলে আছাড় মারুক,’ শিউরে উঠল অঞ্জন। ‘তা ঠিক,’ মাথা ঝাঁকাল ইপু। ‘ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অঞ্জন, সাবধান থেকো, সহজে ছাড়বে না ওরা তোমাকে। ‘সুখবরটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ,’ দমে গেছে অঞ্জন। একে ভুতুড়ে জেলির সমস্যা, তার ওপর হারু-তরু...আর ভাবতে চাইল না ও। হাতে লেগে যাওয়া জেলি তুলে বালতিতে ফেলতে লাগল। বলল, ‘আমি বরং যাই। বেরোনোর আগে দাদুকে রান্নাঘরে দেখে এসেছি, খাবার তৈরি করছেন। গোশত দিয়ে কিছু বানাবেন বোধ হয়। দেরি করে গেলে রেগে যেতে পারেন।’ ‘ভালই তো, গোশত...’ ‘কচুর ভাল,’ ঝাঁজাল কণ্ঠে বলল অঞ্জন। বালতিটা আবার তুলে নিল অঞ্জন। কফির টিনে ভরে দিয়ে খুব অল্পই কমেছে জেলি। যে হারে বাড়ে, ওটুকু বেড়ে ভরে যেতে সময় লাগবে না। দরজার কাছে ওকে এগিয়ে দিল ইপু। ‘দরকার হলে ফোন কোরো।’ নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে এল অঞ্জন। পেছনে দরজাটা লাগিয়ে দিল ইপু। লন ধরে চুপচাপ হাঁটতে লাগল অঞ্জন। হঠাৎ পাতাবাহারের ঝোপ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল হারু-তরু। প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো। যখন বের করল, দেখা গেল আঙুলগুলো মুঠো পাকানো। সতেরো. সামনে এসে অঞ্জনের পথ আটকে দাঁড়াল দুই ভাই। ওদের খাটো করে ছাঁটা সোনালি চুলে বিকেলের রোদ চমকাচ্ছে। বিমল হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুখে। বিমূঢ় হয়ে একবার এর মুখের দিকে, একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে অঞ্জন। কেউ কোন কথা বলছে না। আচমকা বালতির হাতল চেপে ধরল তরু। অঞ্জনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলল। ভারি শব্দ করে মাটিতে পড়ে কাত হয়ে গেল বালতিটা। হলুদ জেলি গড়িয়ে পড়তে লাগল ঘাসের ওপর। অদ্ভুত, কুৎসিত শব্দ করছে, হাড্ডি থেকে রস চুষে খাওয়ার মত। ‘এই...’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। আর কিছু বলার সুযোগ পেল না ও। ওর পেটে ঘুসি মারল তরু। অঞ্জনের মনে হলো, বিদ্যুৎ প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে। দম আটকে গেল ব্যথায়। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগল ফুসফুস। পরের ঘুসিটা আর আসতে দেখল না ও। চোয়ালে লাগল, ডান চোখের নিচে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল ও। ঝটকা দিয়ে ওপরে উঠে গেল দুই হাত। দু’জনই এখন মারছে ওকে। কতণ ধরে মারল ওরা, বলতে পারবে না অঞ্জন। হঠাৎ একজন ওর কাঁধে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে ঠাণ্ডা ভেজা ঘাসের ওপর চিৎ করে ফেলে দিল। সারা গায়ে ব্যথা। বমি পাচ্ছে অঞ্জনের। চোখ বুজে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। পেটের তীè ব্যথাটা চলে যাওয়ার অপো করছে। মাটি যেন দুলছে উত্তাল ঢেউয়ে পড়া নৌকার মত। হাত বাড়িয়ে মাটি খামচে ধরে যেন পতন রোধ করতে চাইল অঞ্জন। কতণ পর বলতে পারবে না, অবশেষে দুলুনি যখন থামল মনে হলো, চোখ মেলে অঞ্জন দেখে ওর গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইপু। চোখ বড় বড় করে ইপু বলল, ‘অঞ্জন...’ গুঙিয়ে উঠে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল ও। বোঁ করে চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। বন বন করে ঘুরছে যেন ঘাসগুলো। চিত হয়ে শুয়ে পড়তে বাধ্য হলো আবার। ‘ওরা চলে গেছে?’ চোখ বুজে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। মাথা ঘোরা বন্ধ হওয়ার অপো করছে। ‘হ্যাঁ,’ হাঁটু গেড়ে অঞ্জনের পাশে বসল ইপু। ‘তোমার কী অবস্থা? মাকে ডাকব?’ চোখ মেলল অঞ্জন। ‘না না, ডাকার দরকার নেই, আমি ভালই আছি।’ নিজের হাতটা তুলে এনে গালে রাখল অঞ্জন। ‘উহ্!’ ব্যথা লাগায় হাতটা সরিয়ে নিল ও। ফুলে গেছে। কয়েক মিনিট পর আবার উঠে বসল ও। মাথা ঘোরা বন্ধ হয়েছে। দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। নিঃশ্বাস অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফুলে ওঠা গাল ডলল। ‘প্রতিশোধ আমরা নেব,’ সান্ত্বনা দিল ইপু। ‘ওদের একটা শিা না দিয়ে ছাড়ব না।’ বালতিটার ওপর চোখ পড়ল অঞ্জনের। কাত হয়ে পড়ে আছে। ঘাসের ওপর গড়িয়ে পড়েছে হলুদ জেলি। অনেকখানি জায়গা জুড়ে পুরু হয়ে জমে রয়েছে। ঝুঁকে বালতিটা তুলে সোজা করে রাখল ইপু। ‘আল্লাহ্ই জানে, ঘাস মেরে ফেলবে কি না। লনের কোন তি হলে বাবা রেগে আগুন হয়ে যাবে।’ ‘উফ্, এত ভারি,’ গুঙিয়ে উঠল অঞ্জন। অনেকখানি জেলি দুই হাতে খামচে ধরে বালতিতে তোলার চেষ্টা করল ও। ‘নড়েও না।’ ‘অল্প অল্প করে তোলো,’ ইপু বলল। ‘কী করে তুলব? এমনভাবে লেগে রয়েছে, ছোটানোই তো যায় না,’ অবাক হয়ে বলল অঞ্জন। ‘দেখো, টেনেও আলাদা করা যাচ্ছে না।’ ‘টফির মত,’ ইপু বলল। ‘টফি মেশিনে কখনও টফি বানাতে দেখেছ? মস্ত একটা গোল তাল হয়ে গিয়ে ঘুরতে থাকে, ময়দার তালের চেয়ে অনেক বেশি আঠা।’ ‘টফি হলে তো কোন কথাই ছিল না,’ বিড়বিড় করল অঞ্জন। ‘অতি জঘন্য জিনিস।’ দু’জনে একসঙ্গে চেষ্টা করে জেলিটাকে বলের মত বানিয়ে ফেলল ওরা। তারপর ধরাধরি করে তুলে বালতিতে ফেলল। বিশ্রী একটা চটাৎ শব্দ করে বালতির মধ্যে ঢুকে গেল বলটা, বালতি ভরে ফেলল। জেলির ভেতরে হাত আটকে গেল ইপু ও অঞ্জনের। ‘বাপরে বাপ, কী আঠা!’ মুখ বাঁকাল ইপু। ‘মনে হচ্ছে আমার হাত গিলে ফেলছে,’ অঞ্জন বলল। টানাটানি করে অবশেষে হাত দুটো বের করে আনল। শার্টে হাত মুছল। ‘জ্যান্ত প্রাণীর মত চোষে।’ ‘বাড়ি নিয়ে যাও,’ ইপু বলল। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে, সামনের জানালা দিয়ে হাত নেড়ে ওকে যেতে ইশারা করছেন ওর মা। ‘মা আবার ডাকে কেন? অঞ্জন, আমি যাচ্ছি।’ অঞ্জনের গালের ঘুসি খেয়ে ফোলা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল ও। ‘তোমার দাদু দেখলে কী করবেন, কে জানে।’ ‘হয়তো খেয়ালই করবেন না,’ বিষণœ কণ্ঠে জবাব দিল অঞ্জন। বালতির হাতল ধরে তুলে নিল বালতিটা। ‘জঘন্য এই জিনিসটাকে নিয়ে কী করি, বলো তো?’ ‘কাল খেলনার দোকানে নিয়ে যাব। যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে আসাটাই সবচেয়ে নিরাপদ।’ বড় বড় পা ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল ইপু। অঞ্জনের কাছে বুদ্ধিটা বিশেষ গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। কিন্তু তর্ক করারও সাহস হলো না, ইপুর সহযোগিতা হারানোর ভয়ে। বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল ওকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়ে দাদুর বাড়ির দিকে রওনা হলো অঞ্জন। মাথার ভেতরটা দপ্ দপ্ করছে। পেটের ভেতর ব্যথা। বাড়ি পৌঁছে বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে পা টিপে টিপে এগোল গ্যারেজের দিকে, ভুতুড়ে জেলির বালতিটা লুকিয়ে রাখার জন্য। একপাশের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল ভেতরে। বালতিটা মেঝেতে রেখে, ওল্টানো একটা ঠেলাগাড়ির ওপাশে ঠেলে দিল ওটা। দেখল, বালতি ভরে গেছে ভুতুড়ে জেলিতে। ইপুকে যেটুকু দিয়েছিল, সেটুকু বেড়ে গেছে আবার। নাহ্, এই বালতিতেও কুলোবে না, ভাবল অঞ্জন। আরও বড় কিছু খুঁজে বের করা দরকার। স্টোররুমে বড়সড় গামলা কিংবা পিপা পাওয়া যেতে পারে। বড় ট্রাংক জাতীয় কিছু হলেও চলবে। চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকল ও। দাদুর সামনে যাওয়ার আগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে। তাঁকে এখনও রান্নাঘরে ব্যস্ত দেখা গেল। স্টোভের ওপর ঝুঁকে রয়েছেন। হাঁড়িতে নাড়ছেন কিছু। পা টিপে টিপে ওপরতলায় উঠে এল ও। হাত-মুখ ধুয়ে নিল। গালের ফুলে ওঠা লাল হয়ে থাকা জায়গাটার কোনও ব্যবস্থা করতে পারল না। কাপড় বদলে পরিষ্কার একটা প্যান্ট পরল, একটা নতুন শার্ট গায়ে দিল। চুল আঁচড়াল। ডাইনিং রুমের টেবিলে এসে বসতেই দাদুর চোখ পড়ল ফুলে ওঠা গালের দিকে। ‘মারামারি করেছ?’ চোখের পাতা সরু করে তাকালেন তিনি। ‘আমি ওদের সঙ্গে লাগতে যাইনি,’ দাদুর চোখের দিকে তাকাল না অঞ্জন, কাঁটাচামচে করে গরুর এক টুকরো গোশত তুলে মুখে ফেলল। ‘ওরাই গায়ে পড়ে...’ দাদু কানে শোনেন না মনে হওয়াতে থেমে গেল ও। খাওয়ার সময় মাঝে মাঝে অঞ্জনের গালের ফোলা জায়গাটার দিকে তাকালেও এ নিয়ে আর কোন কথা বললেন না দাদু। ওর খারাপ লাগছে কি না, এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই দাদুর, ভেবে মন খারাপ হলো অঞ্জনের। ওর ব্যথা করছে কি না, সেটাও একবার জিজ্ঞেস করলেন না। তাতে অবশ্য একদিক থেকে ভালই হলো। তিনি উদ্বিগ্ন হলে প্রশ্ন করে করে সব জেনে নিতেন, হয়তো ঢাকায় ওর বাবা-মাকেও ফোন করতেন। খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে এল অঞ্জন। দাদুর শুতে যাবার অপো করতে লাগল। বার বার তাকাচ্ছে ঘড়ির কাঁটার দিকে। কিন্তু ওগুলো যেন চলতে চাইছে না। এত আস্তে ঘুরছে, সহ্য হচ্ছে না অঞ্জনের। অবশেষে রাত দশটা বাজল। পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বাইরে বেরোল অঞ্জন। গ্যারেজের দিকে চলল। আঠারো. পরিষ্কার রাত। বাতাস ঠাণ্ডা। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা চিৎকার যেন ঢেউয়ের মত ওঠানামা করছে। কালো আকাশে খুদে বিন্দুর মত ঝলমল করছে তারাগুলো। অঞ্জনের হাতের টর্চের আলো সামনের ড্রাইভওয়েতে গোল হয়ে পড়ে আগে আগে চলেছে। অন্ধকার গ্যারেজটার দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে ওকে। অঞ্জন ভেতরে ঢুকতেই, কালো দেয়ালের কাছে কী যেন খসখস শব্দ করল। হয়তো শুকনো পাতা। আমি যখন দরজা খুলেছি, বাতাসে উড়ে এসে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে পড়েছে। টর্চের আলো ঘোরাল ও। হাতটা কাঁপছে। স্থির থাকছে না আলোটা। ওল্টানো ঠেলাগাড়ির ওপর আলো ফেলল প্রথমে। তারপর ধীর পায়ে ওটার কাছে এসে নিচু হয়ে ঝুঁকে ভুতুড়ে জেলির বালতির দিকে হাত বাড়াল। টান দিল বালতির ঢাকনা ধরে। হাতটা ঘুরে গিয়ে টর্চের আলো পড়ল গ্যারেজের ছাদে। আবার টর্চ ঘুরিয়ে বালতির ভেতর আলো ফেলল ও। দম আটকে গেল নিজের অজান্তেই। হলুদ জেলি থিরথির করে কাঁপছে জীবন্ত প্রাণীর মত। আরেকটু বাড়লে কানা বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। বাপরে বাপ, কত দ্রুত বাড়ছে! শঙ্কিত হলো অঞ্জন। ভারী বালতিটা এক হাতে বয়ে নেয়া খুব কঠিন। টর্চটা বগলে চেপে, দুই হাতে বালতির হাতল ধরল ও। টান দিয়ে তুলে নিল ওটা। যাতে কিনার দিয়ে ছলকে না পড়ে সে-চেষ্টা করতে করতে, অন্ধকারে বালতিটা নিয়ে বাড়ির দিকে চলল ও। বাড়িতে ঢুকে, স্টোররুমে নামার সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল। ভারী বালতিটা নামিয়ে রাখল মেঝেতে। স্টোররুমটা মাটির নিচের ঘরে। ওপরে সিঁড়ির মাথার কাছে একপাশের দেয়ালে বসানো সুইচবোর্ডটা হাতড়ে বের করে সুইচ টিপল। নিচতলার ঘরে জ্বলে উঠল একটা অল্প পাওয়ারের বাল্ব্। ফ্যাকাশে হলদে আলো ছড়িয়ে পড়ল নিচতলার কংক্রিটের মেঝেতে। বালতিটা টান দিয়ে তুলে নিয়ে, ধীরে ধীরে নেমে চলল সিঁড়ি বেয়ে। সাবধান রইল যাতে পা পিছলে পড়ে না যায়। ভার সামলানোর সুবিধের জন্য একপাশের দেয়ালে কাঁধ ঠেকিয়ে রেখেছে। সিঁড়িটা নেমেছে ঘরের ভেতর। সেখানে নেমে ফ্যাকাশে আলো চোখে সয়ে আসার অপো করল ও। দেখল, স্টোররুমটা বেশ বড় একটা ঘর। নিচু ছাদ। ভেজা ভেজা। নানা ধরনের বাক্স ছড়িয়ে পড়ে আছে। কোণের দিকে দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে পুরনো খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনের স্তূপ। কিছু পুরনো ভাঙা আসবাবপত্র আছে। গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত নানা টুকিটাকি বাতিল জিনিস ঢেকে রাখা হয়েছে হলুদ একটা পুরনো বিছানার চাদর দিয়ে। সিঁড়ির গোড়া থেকে সরে এসে সামনে পা বাড়াতেই মুখ ছুঁয়ে গেল কী যেন। চিৎকার দিয়ে হাত থেকে বালতিটা ছেড়ে দিল অঞ্জন, ঝটকা দিয়ে দুই হাত ওপরে তুলে ফেলল। মুখে লাগা জিনিসটা কী, বুঝতে পারল। আঠাল মাকড়সার জাল। খামচি দিয়ে টেনে সেগুলো সরানোর চেষ্টা করল। মুখের চামড়ায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে জ্যান্ত কী যেন। হঠাৎ বুঝতে পারল, মাকড়সা। পোকা-মাকড়কে ভীষণ ভয় পায় ও। পাগলের মত থাবা মেরে ফেলে দিতে চাইল মাকড়সাটাকে। মাটিতে পড়ে আট পায়ে হেঁটে প্রাণীটাকে সরে যেতে দেখেও শান্ত হলো না ও। এখনও গালে লেগে রয়েছে ওটার ছোঁয়া, সুড়সুড়ি লাগছে। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে যেন হৃৎপিণ্ডটা। দেয়ালে লাগানো তাকগুলো চোখে পড়ল। আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি ঘরটায়। সেই আলোয় ভুতুড়ে জেলি রাখার উপযুক্ত একটা পাত্র খুঁজল ওর চোখ। লম্বা জিনিসটা দেখতে পেল। উপুড় করে ফেলে রাখা। অনেকটা নৌকার মত। কী ওটা? ভালমত দেখার জন্য কাছে এগোল। পুরনো আমলের একটা স্টিলের বড় বেসিন। প্রায় ছোটখাটো বেসিনের সমান। বেসিনটা ওল্টাল ও। যথেষ্ট জায়গা। এক নজর দেখেই বুঝে গেল ও, এটাতে রাখা যাবে। বালতিটা বয়ে নিয়ে এল বেসিনটার কাছে। ভেতরে ঢালার জন্য উঁচু করতেই ব্যথা লাগল পেটের পেশিতে, যেখানে ঘুসি মেরেছিল হারু-তরু। তীè ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে। গুঙিয়ে উঠল ও। বেসিনের কিনারে বালতিটা খাড়া করে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুণ, ব্যথা চলে যাওয়ার অপোয়। আস্তে আস্তে ব্যথা কমে এলে কাত করে দিল বালতিটা। ঘন হলুদ জেলির মত জিনিসটা থ্যাপ্ থ্যাপ্ করে বিশ্রী শব্দ তুলে ঝরে পড়ল বেসিনের ভেতর। বেসিনটা ভরতে কত সময় লাগবে? মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করল অঞ্জন। এটাও যদি ভরে যায়, তখন কী করবে? যখনকার চিন্তা তখন, এখনই ভেবে মাথাটাকে আর গরম করতে চাইল না। ‘মিঁআঁওঁ!’ করে তীè এক চিৎকার শোনা গেল। ভীষণ চমকে ঘুরে দাঁড়াতে গেল অঞ্জন। তার আগেই পিঠে এসে পড়ল কালো বিড়ালটা। কুসি। উনিশ. ঝাড়া দিয়ে পিঠ থেকে বিড়ালটাকে ফেলতে চাইল অঞ্জন। ওর শার্টে থাবার নখ বসিয়ে দিয়ে প্রায় ঝুলে রইল বিড়ালটা। আরেকবার তীè চিৎকার করে উঠল। ওটার নখের আঁচড় লাগছে অঞ্জনের পিঠের চামড়ায়। বিড়ালটাকে ফেলতে না পেরে রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড করল ও। চিত হয়ে পড়ল বেসিনের মধ্যে। জেলিতে ডুবিয়ে মারতে চাইল বিড়ালটাকে। কিন্তু ওটা ওর চেয়ে অনেক বেশি প্রি। যেন অঞ্জনের ইচ্ছে বুঝতে পেরেই লাফ দিয়ে সরে গেল সময়মত, মেঝেতে গিয়ে পড়ল। আর আঠাল জেলিতে পিঠ ডুবে গেল অঞ্জনের। চিত হয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়েছে। চার হাত-পা বেসিনের বাইরে। মাথাটা বেসিনের ভেতর। হাত-পা ছুড়ে নিজেকে তোলার চেষ্টা করল ও। কিন্তু আঠাল পদার্থ বিস্ময়কর শক্তিতে টান দিয়ে ওকে নামিয়ে নিতে চাইছে। ওর শরীর আটকে গেছে, সিমেন্টে আটকানোর মত। কেঁপে কেঁপে, নীরবে বুদবুদ ছড়াতে ছড়াতে যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে ভয়াল ওই ভুতুড়ে জেলি। ওর মুখের কাছে উঠে আসছে। দম বন্ধ করে মারবে আমাকে! ভাবনাটা অবশ করে দিল যেন ওকে। জিনিসটার উষ্ণতা ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল, ওর বুকে, ওর পিঠে, ওর গলায়। আমি নড়তে পারছি না! আমি আটকে গেছি! জিনিসটা আমাকে দম আটকে মারতে চায়! মুখে আঠা আঠা উষ্ণ ছোঁয়া লাগতে ঝটকা দিয়ে মাথা উঁচু করল অঞ্জন। মুচড়ে মুচড়ে দেহ থেকে আঠার আকর্ষণ ছাড়িয়ে নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করল। বহু কষ্টে, হাঁপাতে হাঁপাতে, চিৎকার দিয়ে, কোনমতে দেহটাকে উঁচু করল, বসার ভঙ্গিতে। আরও উঁচু হয়ে গেল হলুদ জিনিসটা, ধরতে চাইছে ওকে, টেনে নামিয়ে নিতে চাইছে বেসিনের মধ্যে। দুই হাতে বেসিনের কিনার চেপে ধরল অঞ্জন। হাতের ওপর ভর করে গায়ের জোরে নিজেকে টেনে তুলতে লাগল। ওপরে! আরও ওপরে! দেহটা বের করে আনছে ঘন জেলি থেকে। কিন্তু ও শক্তি বাড়ালে জিনিসটাও বাড়ায়, কিছুতেই ওকে বেরোতে দিতে রাজি নয়। ওপরে। ওপরে। আবার চিৎকার করে উঠল অঞ্জন, হলুদ জেলি লাফ দিয়ে ওর কাঁধে উঠে পড়েছে। জিনিসটা ওর কাঁধ চেপে, গলার চারপাশ ঘিরে ধরে টেনে নামানোর চেষ্টা করল। নিচে নামাচ্ছে। নিচে। আমাকে কাবু করে ফেলেছে, ভাবল অঞ্জন। আর মুক্তি নেই আমার। চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। আঠাল জেলি ওর গলা চেপে ধরেছে। ফুটফুট করে বুদবুদ বেরোচ্ছে হলুদ তালটা থেকে। টানছে ওকে। টেনে নামাচ্ছে। ‘না!’ চেষ্টা করো, নিজেকে বোঝাল অঞ্জন। মাথা ওপরে তোলো। থেমো না। চালিয়ে যাও। উঠছে। উঠছে। হ্যাঁ! বেসিনের কিনার চেপে ধরে, নিজেকে ওপরে ঠেলছে অঞ্জন। টেনে তুলছে। তুলছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। হ্যাঁ! হ্যাঁ! পরাজিত করছে জ্যান্ত জেলিটাকে। জোরে আরেক টান দিলেই বেসিন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে অঞ্জন। দাঁতে দাঁত চেপে জোরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ও। হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল ঠাণ্ডা মেঝেতে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ নড়াচড়া টের পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে কুসি। মাথাটা একপাশে কাত করা, হলুদ চোখ দুটো জ্বলছে। প্রচণ্ড রাগে লাফিয়ে উঠে বিড়ালটাকে তেড়ে গেল অঞ্জন। ধাঁ করে লাথি মারল। কিন্তু লাগাতে পারল না। অবিশ্বাস্য প্রিতায় লাফ দিয়ে সরে গেল বিড়ালটা। লাফাতে লাফাতে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। বিশ. সারাটা রাত ভাল ঘুম হলো না অঞ্জনের। অস্থির হয়ে রইল ঘুমের মধ্যেও। বার বার দুঃস্বপ্ন দেখে, চমকে চমকে জেগে ওঠে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হলুদ প্যাড আর একটা মার্কার পেন নিয়ে এল নাস্তার টেবিলে। ‘এ অবস্থা কেন?’ ভুরু নাচালেন দাদু। এক বাটি খই রাখলেন ওর সামনে। ‘ডাস্টবিনে পড়েছিলে? না বিড়ালে ধাক্কা দিয়েছিল?’ যেন খুব রসিকতার কথা বলে ফেলেছেন। মাথা নাড়তে নাড়তে হা-হা করে হাসলেন তিনি। ‘বিড়ালে ধাক্কা দিয়েছিল, আপনি জানলেন কী করে?’ বলেই মনে পড়ল অঞ্জনের, জবাব পাবে না, কানে শোনেন না দাদু। খইয়ের বাটিটাকে ঠেলে সরিয়ে হাতের প্যাডটা দেখাল। ‘খই সরালে কেন? পুতিয়ে যাবে তো,’ আবার বাটিটা ওর সামনে ঠেলে দিলেন দাদু। ‘না খেলে ভিটামিন পাবে না, শক্তি পাবে না শরীরে। তখন কুসি আরও সুযোগ পাবে।’ ‘ওই বিড়ালটার আমি ঘাড় না মটকেছি তো কী বললাম! খালি সুযোগ পেয়ে নিই।’ বিড়বিড় করে বলে লিখতে শুরু করল প্যাডে। অঞ্জনকে লিখতে দেখে আগ্রহী হলেন দাদু। টেবিলের পাশ ঘুরে এসে ওর পেছনে দাঁড়ালেন। প্যাডের দিকে চোখ। বড় বড় অরে লিখল অঞ্জন : দাদু একটা ভীষণ সমস্যায় পড়েছি। আপনার সাহায্য দরকার। স্টোররুমে একটা বেসিন হলুদ রঙের ভুতুড়ে জেলিতে ভর্তি হয়ে গেছে। বেড়েই চলেছে ওটা। কোনমতেই থামাতে পারছি না। কলম রেখে প্যাডটা দাদুর সামনে উঁচু করে ধরল অঞ্জন। চেয়ারে বসেই ফিরে তাকাল দাদুর দিকে। তাঁর ফ্যাকাশে মুখে সকালের রোদ পড়েছে। হঠাৎ করেই দাদুকে অনেক বয়স্ক লাগল। দ্রুত চোখ বোলালেন অঞ্জনের লেখায়। ঠোঁট দুটো পরস্পরের সঙ্গে চেপে বসেছে। অধীর হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন। অবশেষে চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়ল দাদুর ঠোঁটে। পেছনে মাথা ঝাঁকি দিয়ে হেসে উঠলেন তিনি। অবাক হলো অঞ্জন। চেয়ারটা পেছনে ঠেলে সরিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর কাঁধে হাত রেখে ঠেলা দিলেন দাদু। ‘বুড়ো মানুষের সঙ্গে রসিকতা করে কোন লাভ আছে?’ আবার টেবিল ঘুরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসলেন। ‘তোমার বাবার সঙ্গে একটা পার্থক্য তোমার আছে, ও সারাণ মুখ গোমড়া করে রাখত, কিন্তু তোমার মধ্যে রসবোধ আছে।’ ‘দুর, আমি কী বোঝাতে চাইলাম, আর বুড়িটা কী বুঝল!’ চেঁচিয়ে বলে আছাড় দিয়ে প্যাডটা টেবিলে রাখল অঞ্জন। ওর রাগ দেখে হা-হা করে হাসলেন দাদু। তাতে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল অঞ্জনের। জ্বলন্ত চোখে তাকাল। হাত দুটো মুঠো হয়ে গেল। দেখেও যেন দেখলেন না দাদু। ‘ভুতুড়ে জেলি! কী কল্পনা!’ হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেছে দাদুর। হাত দিয়ে মুছলেন। ‘যাও, বাইরে যাও। খেলা করোগে। আজেবাজে কথা ভেবে মাথা গরম কোরো না।’ গটগট করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল অঞ্জন। ওপরে নিজের ঘরে চলে এল। পরনের ময়লা কাপড়গুলো খুলে ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। পরিষ্কার কাপড় পরল। বুড়িটা ওর কথা বিশ্বাস করল না, ভাবছে অঞ্জন। এখন ইপু যা বলেছিল, তাই করতে হবে। দোকানে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে ভুতুড়ে জেলি। ইস্, কোন কুণে যে কৌটাটার ওপর চোখ পড়েছিল ওর! ইপুকে ফোন করল অঞ্জন। কাঁপা হাতে নম্বর টিপল। ইপু জানাল, খেলনার দোকানটা সকাল ১০টায় খোলে। বিশ মিনিটের মধ্যে কাছের মোড়টায় দেখা করবে। রিসিভার রেখে দিল অঞ্জন। গ্যারেজে রওনা হলো বড় প্লাস্টিকের বস্তা আনার জন্য। * ঠিক সময়ে হাজির হলো ইপু। প্লাস্টিকের একটা বাজারের ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে ভুতুড়ে জেলি, ওর কাছে যতখানি ছিল। সাইকেলের হ্যান্ডেল বারে ঝুলিয়ে এনেছে। আরও একবার, ইপুর সাইকেলের পাশে পাশে চলতে হলো অঞ্জনকে। তবে এবার আর দৌড়াতে পারল না। ওর হাতের বস্তাটা এতই ভারী, ফুটপাথ ধরে প্রায় টেনেহিঁচড়ে নিতে হলো। ‘বেসিনটাও ভর্তি হয়ে গিয়েছিল,’ ইপুকে বলল অঞ্জন। মোড়ের কাছে এসে রাস্তার একটা খাঁজে আটকে গেল ভারী বস্তার কোনাটা। টেনে সরাতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল ও। ‘বস্তা ফেটে বেরিয়ে না গেলেই এখন বাঁচি।’ ‘আর মাত্র দুটো বাড়ি, সেগুলো পেরোলেই দোকানটা,’ আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করল ওকে ইপু। রাস্তায় ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গতি কমাল একটা ট্যাক্সি। জানালা দিয়ে মুখ বের করে হাসল তরুণ ড্রাইভার। চলে গেল গাড়িটা। বস্তাটার দিকে অবাক চোখে তাকাচ্ছে পথচারীরা। একজন মহিলাকে বস্তার দিকে তাকিয়ে থেমে যেতে দেখে হাত নাড়ল ইপু, ‘হাই, আন্টি।’ মহিলা ওর মায়ের বান্ধবী। জবাবে হাত নেড়ে, দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ইপুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের দিকে চলে গেলেন তিনি। সাইকেল থেকে নামল ইপু। ঠেলে নিয়ে চলল সাইকেলটা। অঞ্জন ওর বস্তাটা প্রায় হিঁচড়ে নিয়ে এগোল। পরের বাড়িটার কাছে এসে, রাস্তা পেরিয়ে, খেলনার দোকানের দিকে চলল দু’জনে। কিন্তু রাস্তার মাঝখানেই থমকে দাঁড়াল। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে। দোকানের দরজায় তালা ঝোলানো। জানালাগুলোও বন্ধ। হাতে লেখা ছোট একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে দোকানের দরজায়। তাতে লেখা : দোকান বন্ধ। একুশ. জঘন্য জিনিসটার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া অঞ্জন। বস্তাটা টেনে এনে দোকানের সামনে রাখল। কিল মারতে শুরু করল দরজায়। আশা, যদি ভেতরে কেউ থেকে থাকে। ‘এই, শুনছেন? ভেতরে কেউ আছেন? দরজা খুলুন!’ চেঁচিয়ে বলল ও। সাড়া নেই। দুই হাতে আরও জোরে কিল মারতে শুরু করল। কোন জবাব এল না ভেতর থেকে। হাত ধরে টেনে ওকে সরিয়ে আনল ইপু। ‘দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে,’ বলল পাশের দোকানের এক কর্মচারী। ‘ব্যবসায় লোকসান দিয়ে চলে গেছে। দেখছ না, দরজা-জানালা বন্ধ, সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে।’ ‘হ্যাঁ, তা তো পাচ্ছি,’ বিড়বিড় করল অঞ্জন। ধুম করে কিল মারল দরজার গায়ে। ‘আমারে সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে।’ ‘দোকানদারের দোষ কী? তোমাকে তো মানা করেছিল এটা কিনতে,’ ইপু বলল। ‘কিল মারা বন্ধ করো, অঞ্জন। হাতে ব্যথা পাবে।’ ‘এখন কী করব?’ অঞ্জনের প্রশ্ন। ‘আর কোন নতুন বুদ্ধি বের করতে পেরেছ?’ মাথা নাড়ল ইপু। ‘আমি তো একবার বুদ্ধি বের করলাম। এবার তোমার পালা, তুমি করো।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল অঞ্জন। ‘দাদুকে বস্তাটা দিয়ে বলতে পারি, এর ভেতর গরুর গোশত আছে। তখন বড় ছুরিটা দিয়ে মারবে বস্তার গায়ে কোপ।’ ‘তোমার মাথাটা ঠিক নেই, অঞ্জন,’ ইপু বলল। সহানুভূতি দেখিয়ে একটা হাত রাখল অঞ্জনের কাঁধে। বস্তার দিকে তাকিয়ে আছে দু’জনেই। ভেতরেও বাড়ছে মনে হলো হলুদ জেলি, নড়াচড়া করছে, যেন শ্বাস নিচ্ছে। বস্তা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দেখে ভয় পেয়ে গেল অঞ্জন। ‘চলো, বাড়ি ফিরে যাই,’ গলা কাঁপছে ওর। ‘যেতে যেতে দেখি কিছু ভেবে বের করা যায় কি না।’ বহু কসরৎ করে বস্তাটা দাদুর বাড়িতে টেনে নিয়ে এল ওরা। ভাগ্যিস, ফাটেনি। আকাশের অনেক ওপরে চড়েছে সূর্যটা। পেছনের আঙিনায় যখন পৌঁছল, ঘেমে নেয়ে গেছে অঞ্জন। হাত ব্যথা করছে। মাথা দপ্ দপ্ করছে। ‘আনলাম তো, এখন?’ দুর্বল কণ্ঠে বলল অঞ্জন। ফোলা বস্তাটা ছেড়ে দিয়ে ইপুর দিকে তাকাল। গ্যারেজের দেয়ালে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে রাখল ইপু। হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগের ভেতর বেড়েছে ভুতুড়ে জেলি। গ্যারেজের দরজার পাশে ফেলে রাখা অ্যালুমিনিয়ামের বড় ট্র্যাশ ক্যানটা দেখাল ও। ‘ওই ড্রামে ভরলে কেমন হয়? অনেক বড়ই তো দেখা যাচ্ছে, জায়গা হয়ে যাবে।’ ভাল করে দেখার জন্য ওটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও। ‘ঢাকনাটাও ঠিকমত আটকায়।’ ‘হুঁ!’ খুব একটা আশা করতে পারছে না আর অঞ্জন। শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। ঢাকনাটা টান দিয়ে তুলল ইপু। তারপর নিজের ব্যাগটা উপুড় করে ঢেলে দিল। থ্যাপাৎ করে বিশ্রী শব্দ তুলে ড্রামের তলায় পড়ল এক তাল আঠাল পদার্থ। নিজের বস্তাটা ড্রামের কাছে টেনে আনল অঞ্জন। তুলতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল, ‘যা ভারী!’ ‘দাঁড়াও, আমিও ধরি,’ ইপু বলল। দু’জনে মিলে বস্তাটা ড্রামের মুখের কাছে উঁচু করে ধরল। বস্তার মুখের দিকটা রইল ড্রামের ভেতরে, কাত হয়ে। পেছনটা ধরে রাখল ইপু। অঞ্জন বস্তার মুখে বাঁধা দড়ি খুলে দিল। হড়হড় করে ড্রামে পড়তে লাগল ভুতুড়ে জেলি। ড্রামের গায়ে বাড়ি খেয়ে ঘিনঘিনে শব্দ তুলল। ওপরে লাফিয়ে উঠতে লাগল এমনভাবে, যেন লাফ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অঞ্জন। ঢাকনাটা তুলে লাগিয়ে দিল ড্রামের মুখে। দুই পাশের হ্যান্ডেল দুটো চেপে বসিয়ে দিল ঢাকনার ওপর। ‘উহ্, বাঁচা গেল!’ ইপু বলল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ড্রামটার দিকে তাকিয়ে রইল দু’জনে। ভয় পাচ্ছে, যেন ঢাকনাটা ঝটকা দিয়ে খুলে যাবে। ‘এখন কী করব?’ ভয় যাচ্ছে না অঞ্জনের। জবাব দিতে যাচ্ছিল ইপু, দাদুকে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল। পেছনের আঙিনায় চোখ বোলাচ্ছেন তিনি। ওদের ওপর চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে বললেন, ‘অঞ্জন, তোমার সুখবর আছে!’ ট্র্যাশ ক্যানটার দিকে চট করে তাকাল আরেকবার অঞ্জন। তারপর ছুটল দাদুর দিকে। ইপু চলল ওর পেছন পেছন। দাদুর হাতে একটা কাগজ। চিঠি। ‘আজ বিকেলেই তোমাকে নিতে আসছে তোমার মা,’ দাদুর মুখে চওড়া হাসি। আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল ও। এখানে আসার পর এই প্রথম একটা খুশির খবর পেয়েছে, সবচেয়ে খুশির খবর। ‘আমি চলে যাব! চলে যাব!’ বলে চেঁচাতে লাগল অঞ্জন। দাদু ফিরে যাচ্ছেন রান্নাঘরে। ‘আমি চলে যাব! ইপু, আর থাকতে হবে না এখানে!’ কিন্তু ইপুকে দেখে খুশি মনে হলো না। হাত তুলে ড্রামটা দেখিয়ে বলল, ‘ওটার কী হবে?’ ‘যা হয় হোকগে। ড্রামে ভরে ঢাকনা আটকে রেখেছি, আর বেরোতে পারবে না ভুতুড়ে জেলি,’ অঞ্জন বলল। ‘আমি এখান থেকে পালাতে পারছি, এটাই বড় কথা!’ ‘কিন্তু কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? তোমার দাদু ঢাকনা খুলবেন, লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসবে ওই শয়তান জেলি। তিনি কি তখন সামলাতে পারবেন? ভুতুড়ে জেলির কথা বড়দের কাউকে জানানো উচিত। কিংবা এটার একটা ব্যবস্থা করা উচিতÑতুমি চলে যাওয়ার আগে। কৌটাটা কিনে এনে সমস্যাটা সৃষ্টি করেছ, এটা ভুলে গেলে চলবে না।’ তাই তো, এটা তো ভাবেনি! হাসি চলে গেল মুখ থেকে। আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। হঠাৎ ঘেউ ঘেউ শুনে ফিরে তাকাল অঞ্জন। নিজের ঝামেলা আর অতি উত্তেজনায় কুকুরটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। ফিরে তাকাল খোঁয়াড়ের দিকে। ‘কী হয়েছে, নেড়ি? এই নেড়ি!’ ডাকতে ডাকতে খোঁয়াড়ের দিকে দৌড় দিল ও। বাইশ. টান দিয়ে গেটটা খুলেই থমকে গেল অঞ্জন। ‘নেড়ি!’ যে কুকুরটা অঞ্জনের দিকে দৌড়ে এল, ওটা দেখতে নেড়ির মতই, কিন্তু আকারে টাট্টু ঘোড়ার সমান হয়ে গেছে। আগে যা ছিল, এখন তার দ্বিগুণ বড়। ‘না!’ উত্তেজিত কুকুরটাকে আসতে দেখে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়ল অঞ্জন। ‘এই, দাঁড়া, দাঁড়া, গায়ের ওপর উঠিস না।’ অঞ্জন উঠে দাঁড়ানোর আগেই ভয়ঙ্করভাবে চেঁচানো শুরু করল নেড়ি। মস্ত পায়ের থপ্ থপ্ শব্দ তুলে পেছনের আঙিনা পেরিয়ে রাস্তার দিকে ছুটল কুকুরটা। ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না!’ চেঁচিয়ে উঠল ইপু। দুই হাত মুখের কাছে। তাকিয়ে আছে বাড়ির পাশ দিয়ে যেদিকে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেছে কুকুরটা সেদিকে। ‘বাপরে বাপ, কত্তবড় হয়েছে!’ ‘ওকে থামানো দরকার! নইলে কাকে আবার আক্রমণ করে বসে!’ চেঁচিয়ে বলল ইপু। ‘নেড়ি! নেড়ি! জলদি আয়!’ পাগলের মত ডাকতে ডাকতে পেছনে ছুটল অঞ্জন। না দেখে ইপুর সাইকেলটায় পা বেঁধে গিয়ে পড়ল ট্র্যাশ ক্যানটার ওপর। ‘না!’ চেঁচিয়ে উঠল ও। অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখল, ধাক্কা লেগে কাত হয়ে যাচ্ছে ড্রামটা। ঝনাৎ করে পাকা রাস্তায় পড়ল ওটা। অঞ্জনও পড়ে গেল ওটার সঙ্গে। ঢাকনাটা খুলে গিয়ে চাকার মত গড়িয়ে চলে গেল। ড্রাম থেকে গড়িয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল হলুদ জেলি। অবিশ্বাস্য দ্রুত ড্রামের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ভুতুড়ে জেলি। সরে গেল ড্রামের মুখের কাছ থেকে, যেন ওই বন্দিশালার ভেতরে ঢুকতে চায় না আর। থিরথির করে কাঁপছে, বিশ্রী শব্দ করছে, কী করবে যেন বোঝার চেষ্টা করছে। তারপর আচমকা নিজেকে টেনে লম্বা করে থামের মত খাড়া হয়ে দাঁড়াল। আতঙ্কিত চোখে ওটার দিকে তাকিয়ে আছে দু’জনে। কাঁপতে থাকা হলুদ জেলির তালটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, নবজাত ঘোড়ার বাচ্চার মত টলতে টলতে নিজেকে খাড়া রাখার চেষ্টা করছে। বারবার আকার বদলাচ্ছে, ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকানোর ভঙ্গিতে ঘোরাচ্ছে ওপর দিকটা। তারপর, জোরাল একটা শব্দ করে, ধনুকের মত বাঁকা হয়ে লাফ দিল অঞ্জনকে ল্য করে। অঞ্জন তখনও পড়ে রয়েছে মাটিতে। ‘ওঠো, অঞ্জন!’ চেঁচিয়ে উঠল ইপু। ‘জলদি ওঠো! তোমার গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাবে তো!’ তেইশ. বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। লাফাতে লাফাতে ওর দিকে ছুটে আসছে হলুদ জেলির তাল। আরেকবার বুনো চিৎকার দিয়ে গড়িয়ে সরে গেল ও। ‘পালাও, অঞ্জন!’ আবার চেঁচিয়ে বলল ইপু। একটা হাত বাড়িয়ে দিল অঞ্জনের দিকে। হাত ধরে টেনে তুলল। ‘জ্যান্ত হয়ে গেছে ওটা! জলদি পালাও!’ গ্যারেজের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজেকে খাড়া করে ফেলল হলুদ জেলি। একটা সেকেন্ড যেন দেয়াল কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর খোসা ছাড়ানোর মত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটে এল ওদেরকে ল্য করে। ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ ‘প্লিজ, বাঁচাও আমাদের!’ গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড় দিল দু’জনে। আগে আগে রয়েছে ইপু। পেছনে অঞ্জন। ভয়ে পা দুটো দুর্বল লাগছে ওর, মনে হচ্ছে যেন রাবার হয়ে গেছে। ড্রাইভওয়ে ধরে সামনের আঙিনার দিকে ছুটছে ইপু। চেঁচাচ্ছে, ‘বাঁচাও, বাঁচাও, প্লিজ, বাঁচাও আমাদের!’ অঞ্জনও চেঁচাতে চাইছে, কিন্তু খসখসে হয়ে গেছে গলা, ঠিকমত স্বর বেরোতে চাইছে না। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। মাথার চাঁদি দপ্ দপ্ করছে। ছুটতে ছুটতেই ঘুরে তাকিয়ে দেখল, ঠিক ওদের পেছনেই রয়েছে ভুতুড়ে জেলি। গতি বাড়ছে ক্রমেই। প্রতিটি লাফের সঙ্গে বিশ্রী শব্দ করছে। ঢেব। ঢেব। ঢেব। মাটিতে, ঘাসের মধ্য থেকে কেঁচো টেনে বের করছিল একটা দোয়েল, জেলির তালটাকে আসতে দেখেনি, চাপা পড়ে গেল ওটার নিচে। গুঙিয়ে উঠল অঞ্জন। ফিরে তাকিয়ে দেখল, দোয়েলটা আটকা পড়েছে হলুদ বলের গায়ে। ডানা নেড়ে ছাড়া পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল, শেষ চিৎকার দিল একটা, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল জেলির ভেতরে। ঢেব। ঢেব। ঢেব। দিক পরিবর্তন করল ভুতুড়ে জেলি। একইভাবে লাফাচ্ছে, কাঁপছে, প্রতিটি লাফের সঙ্গে ঘাসের ওপর বড় বড় দাগ রেখে আসছে। মনে হচ্ছে, গোলাকার অদ্ভুত পদচিহ্ন। ‘ওটা সত্যিই জ্যান্ত হয়ে গেছে!’ চেঁচিয়ে বলল ইপু। দুই হাতে গাল চেপে ধরেছে। ‘জ্যান্ত জেলির বল!’ ‘কী করব আমরা এখন? কী করব?’ নিজের আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরটাকে নিজের কানেই অপরিচিত লাগল অঞ্জনের। ‘ধরে ফেলছে আমাদের!’ অঞ্জনের হাত ধরে টানল ইপু। ‘পালাও!’ জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির সামনের দিকে ছুটল ওরা। ‘এই, কী হচ্ছে?’ শোনা গেল একটা পরিচিত কণ্ঠ। ‘এই?’ চমকে দাঁড়িয়ে গেল অঞ্জন। ফুটপাথের দিকে ফিরে তাকাল। হারু-তরু দাঁড়িয়ে আছে, দু’জনের গোলগাল মুখে অবিকল এক রকম হাসি। ‘আরে, আমার প্রিয় ঘুসি প্র্যাকটিসের বালিশটা যে,’ এক ভাই বলল অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে। ঘুসি উঁচিয়ে ভয় দেখাতে চাইল অঞ্জনকে। দু’জনেই এগিয়ে এসে ড্রাইভওয়েতে ঢুকল। তারপর হঠাৎ উজ্জ্বল হাসি মলিন হতে হতে উধাও হয়ে গেল, নিচের চোয়াল ঝুলে হাঁ হয়ে গেছে, আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে বিশাল হলুদ তালটার দিকে, ড্রাইভওয়ে ধরে লাফাতে লাফাতে ছুটে আসছে। ‘সরে যাও!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘পালাও!’ ইপু বলল। কিন্তু এতটাই চমকে গেছে দুই ভাই, নড়ার মতাও হারিয়ে ফেলেছে যেন। প্রচণ্ড আতঙ্কে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে ওদের, কোটর থেকে ঠেলে বেরোনোর জোগাড়। ঢেব। ঢেব। ঢেব। ক্রমেই গতি বাড়ছে মস্ত জেলির তালটার। লাফাতে লাফাতে সোজা এসে পড়ল পাশাপাশি দাঁড়ানো দুই ভাইয়ের গায়ের ওপর। ধাক্কা লাগার ধ্যাপাৎ শব্দটা কানে আসতেই চোখ বুজে ফেলল অঞ্জন। ‘বাবাগো!’ ‘মেরে ফেলল!’ চিৎকার করছে দুই ভাই। চিত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওদের গায়ের কাছে ঢেব ঢেব করে লাফাচ্ছে হলুদ জেলি। হাত ছুড়ছে। আঠাল হলুদ জেলির কবল থেকে নিজেদের রা করার জন্য ছটফট করছে। ‘বাঁচাও আমাদের!’ ‘প্লিজ, অঞ্জন, কিছু একটা করো!’ ককিয়ে উঠল দুই ভাই। হঠাৎ দৌড় দিল অঞ্জন। চিৎকার করে বলল, ‘এই জেলির বল, এই, এদিকে! আমাকে ধর!’ জ্যান্ত প্রাণীর মত থমকে গেল বলটা। কাকে আগে ধরবে, দ্বিধায় পড়ে গেছে যেন। ‘হারু-তরু, জলদি পালাও!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ‘বেশিণ আটকে রাখতে পারব না দানবটাকে।’ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দুই ভাই। হাড় চোষার মত বিশ্রী, ভুতুড়ে শব্দ করছে জেলির তালটা। তড়াক করে অঞ্জনের দিকে এক লাফ দিল। তৈরি ছিল অঞ্জন। লাফিয়ে সরে গেল একপাশে। ততণে পড়িমরি করে দৌড়াতে শুরু করেছে দুই ভাই। বরফের মত জমে গেছে যেন ইপু। কী করবে বুঝতে পারছে না। ‘আমি সিঁড়ির দিকে যাচ্ছি, তুমি গেটের দিকে যাও!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ‘একসঙ্গে দু’জনের পিছু নিতে পারবে না ওটা!’ ‘কিন্তু...’ বলতে গেল ইপু। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই সামনের বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল অঞ্জন। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে খুলে গেল বাড়ির সামনের দরজা। দাদু বেরিয়ে এলেন। ‘এই, এত চেঁচামেচি কিসের?’ দরজার পাল্লা আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে বললেন তিনি। হলুদ তালটার দিকে চোখ পড়তেই বড় বড় হয়ে গেল চোখ। তাঁর চিৎকারে অঞ্জনের দিক থেকে ঘুরে গেল হলুদ বল। দাদুর দিকে ফিরল। বরফের মত জমে গেলেন যেন দাদু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলেন যেন যা দেখছেন ঠিক দেখছেন কি না। তারপর, সামনের দরজাটা খুলে রেখেই পাক খেয়ে ঘুরে দৌড়ে চলে গেলেন ঘরের ভেতর। ঢেব। ঢেব। সামনের সিঁড়ির কাছে দ্বিধা করতে লাগল ভুতুড়ে জেলি। এক জায়গায় থেকে লাফাতে লাগল, একবার, দুবার, তিনবার। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে অঞ্জন। ঘন ঘন শ্বাস টানছে। বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইপু। লাফাতে লাফাতে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ভুতুড়ে জেলি, জোরে এক লাফ দিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ল। ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। ‘সর্বনাশ!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘দাদুকে মেরে ফেলবে!’ এ সময় ঘরের ভেতর থেকে শোনা গেল দাদুর রক্ত জমাট করা চিৎকার। চব্বিশ. তিন লাফে সিঁড়ি ডিঙিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ল অঞ্জন। ‘কী করছ?’ পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল ইপু। ‘দাদুকে বাঁচাতে হবে,’ জবাব দিল অঞ্জন। খোলা দরজা দিয়ে ছুটে ঢুকল ঘরের ভেতর। ছোট্ট ঘরটার মাঝখান জুড়ে রয়েছে মস্ত জেলির তালটা। নাচছে, কাঁপছে, লাফাচ্ছে, কার্পেটে আঠাল রস লাগাচ্ছে, ছাপ ফেলছে। দেয়ালের কাছে দাদুকে কোণঠাসা করে ফেলেছে জেলির তাল। ‘পালান, দাদু, পালান!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। বলেই মনে পড়ল দাদু কানে শোনেন না। তা ছাড়া, পালানোর পথ নেই দাদুর, নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে। ‘বেরোও এখান থেকে, বেরিয়ে যাও!’ অঞ্জনকে চেঁচিয়ে বললেন দাদু। তীè, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর। ‘কিন্তু দাদু...’ ‘এখুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে!’ আবার চেঁচিয়ে বললেন দাদু। মাথার চুল এলোমেলো। কটা চোখের তীè দৃষ্টি হলুদ তালটার ওপর স্থির। যেন মনের জোরে ওটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কী করবে বুঝতে পারছে না অঞ্জন। ইপুও ঢুকেছে। দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জনের পেছনে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। অঞ্জনের দাদুর দিকে জেলির তালটাকে এগোতে দেখে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ‘বেরোও!’ আবার তীèস্বরে চিৎকার করে বললেন দাদু। ‘নিজেরা বাঁচো। আমার কথা ভেবো না। আমি এটা বানিয়েছি! এখন আমাকেই খেসারত দিতে হবে!’ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না অঞ্জন। কী বলছেন দাদু! মাথা ঘুরছে অঞ্জনের। ঘরটা দুলছে, বনবন করে ঘুরছে মনে হলো। দাদু যে আর্ম চেয়ারটায় বসেন সেটার পেছনটা আঁকড়ে ধরে পতন ঠেকাল। কয়েক দিন আগের দৃশ্যগুলো ফুটে উঠল মনের পর্দায়। দাদুর গলায় ঝোলানো হাড়ের লকেটটার কথা মনে পড়ল, সারাণ পরে থাকেন তিনি। মনে পড়ল, স্টাডিতে তাক ভর্তি রহস্যময় বইগুলোর কথা। ‘আমি এটা বানিয়েছি! এখন আমাকেই খেসারত দিতে হবে!’ দাদুর কথার মানে পরিষ্কার হয়ে আসছে অঞ্জনের কাছে। খেলনার দোকান থেকে ভুতুড়ে জেলির কৌটাটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। হাতে নিয়ে দেখছিলেন দাদু। দুই হাতের তালুতে চেপে ধরে রেখেছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। লেবেলটার দিকে তাকিয়েছিলেন। ঠোঁট নড়ছিল। মনে হচ্ছিল, লেবেল পড়ছেন। আসলে কী করছিলেন তিনি? ‘সাবধান,’ কৌটাটা ফিরিয়ে দেয়ার পর বলেছিলেন তিনি। ‘খুব সাবধান।’ তার মানে এটা বিপজ্জনক জানতেন বলেই সাবধান করেছিলেন। ‘আপনি এ কাজ করেছেন!’ চিৎকার করে বলল অঞ্জন, এমন এক কণ্ঠে, নিজের কাছেই অচেনা লাগল। কথাগুলো যেন বিস্ফোরিত হলো ওর মুখ থেকে। ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। ‘হ্যাঁ, আপনিই এ কাজ করেছেন। কৌটার খেলনাকে আপনি জাদু করে দিয়েছিলেন!’ দাদুর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলল ও। তাঁর কথা নিশ্চয় শোনেননি তিনি, অঞ্জন ভাবছে, তবে আমার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেই বুঝতে পেরেছেন। তাঁর কটা চোখে পানি টলমল করতে লাগল। পানিতে ভরে গিয়ে ফ্যাকাশে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছেন তালটার দিকে দাদু।। ‘ঢেব ঢেব’ আওয়াজ তুলে তাঁর সামনে ক্রমাগত লাফাচ্ছে বিশাল জেলির তালটা, প্রায় আড়াল করে ফেলেছে তাঁকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁর। ‘আমি ইচ্ছে করে করিনি! ও করিয়েছে আমাকে দিয়ে!’ আঙুল তুললেন তিনি। পঁচিশ. অঞ্জনের মনে হলো ইপুর দিকে আঙুল তুলেছেন দাদু। ঘুরে তাকিয়ে বুঝতে পারল, ইপু নয়, ওর পেছনে দাঁড়ানো কুসিকে দেখাচ্ছেন। লিভিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে, পিঠ বাঁকিয়ে, রাগে ফোঁস-ফোঁস করছে বিড়ালটা, জ্বলন্ত হলুদ চোখে তাকিয়ে আছে দাদুর দিকে। ‘ও করেছে! সব ওর শয়তানি!’ বিড়ালটার দিকে আঙুল তুলে নাচাতে লাগলেন তিনি রাগে। মস্ত হলুদ তালটা ড্রপ খেয়ে এক কদম পিছিয়ে এল, যেন দাদুর কথার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে। জানালা দিয়ে আসা আলোয় অদ্ভুত ছায়া পড়ল ওটার গায়ে। থিরথির করে কেঁপে কেঁপে যেন শ্বাস নিচ্ছে জেলির তালটা। বিড়ালটার দিক থেকে ইপুর দিকে চোখ ফেরাল অঞ্জন। কিছুই বলছে না ইপু। আতঙ্ক আর বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ‘যত নষ্টের মূল হলো ওটা!’ বিড়ালটাকে দেখিয়ে বললেন দাদু। জবাবে আবার ফোঁস-ফোঁস করে উঠল কুসি। একই জায়গায় থেকে লাফাচ্ছে হলুদ তালটা, ভেতরে নিথর হয়ে রয়েছে দুই ভাই। ‘আরে, দেখো!’ বিড়ালটাকে হঠাৎ পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে যেতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ওর বাহু খামচে ধরল ইপু। হাতটা বরফের মত শীতল। বড় হতে লাগল বিড়ালটা। অনবরত ফোঁস-ফোঁস করছে। সামনের পা দুটো উঁচু করে বারবার বাতাসে থাবা চালাচ্ছে। সবাই তাকিয়ে আছে। কেউ নড়ছে না। ঘরের মধ্যে শুধু হলুদ জেলিটার বিচিত্র শোষণের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। আর থেকে থেকে ঢেব ঢেব করে লাফাচ্ছে। একই রকম শব্দ করে লাফাচ্ছে অঞ্জনের হৃৎপিণ্ডটা। ক্রমশ উঁচু হচ্ছে বিড়ালটা। দুই থাবা সামনে বাড়ানো। যতই বড় হচ্ছে, আকৃতি বদলে যাচ্ছে বিড়ালটার। মানুষে রূপ নিচ্ছে। ভুতুড়ে অন্ধকারে ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে হাত-পাগুলো। তারপর অন্ধকার থেকে সরে এল ছায়ামূর্তিটা। কুসি এখন একজন অল্প বয়সী তরুণী, লালচে চুল, ফ্যাকাশে চামড়া, হলুদ চোখÑবিড়ালটার যেমন ছিল, যা এখানে আসার পর থেকেই দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে বেরিয়েছে অঞ্জনকে। মহিলার পরনের লম্বা কালো আলখেল্লার ঝুল গোড়ালির কাছে দোল খাচ্ছে। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছে ও, অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দাদুর দিকে। ‘ওই যে, দেখলে তো?’ শান্তকণ্ঠে অঞ্জন আর ইপুকে বললেন তিনি। ‘ওই ডাইনিটার কথাই বলেছিলাম।’ তারপর কুসির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার ওপর তোমার জাদুর মতা কেটে গেছে। আর আমি তোমার হয়ে কাজ করব না।’ ঝাঁকি দিয়ে মাথাটা পেছনে নিয়ে গিয়ে খিলখিল করে হাসল কুসি, লালচে চুলগুলো ঝাঁকি খাচ্ছে আলখেল্লার কালো, উঁচু কলারের ওপর। ‘তুমি কী করবে না করবে, সেটা আমি ঠিক করব, দিলারা।’ ‘না,’ মাথা নাড়লেন দাদু। ‘আমাকে দিয়ে অনেক গোলামি করিয়েছ তুমি, কুসি। আর শুনব না।’ ‘কী করবে?’ আবার হাসল কুসি। ‘আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই, গাধা কোথাকার। তবে হ্যাঁ, এক হিসেবে মুক্ত আমি করে দেব তোমাকেÑতোমাদের সবাইকেইÑমেরে ফেলে। হ্যাঁ, তোমাদের সবাইকেই মরতে হবে।’ অঞ্জনের দিকে ফিরলেন দাদু। চোখের ভয় চাপা দিতে পারলেন না। ‘তোমার দাদা মারা যাবার পর, ও আমার বন্ধু সেজে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। আমি তখন একা। মন-টন খারাপ। ভেবেছিলাম, একা থাকি, একজন সঙ্গী পেলে মন্দ হয় না। ওকে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু ও আমাকে জাদু করলÑব্ল্যাক ম্যাজিকের সাহায্যে, আমাকে বধির করে দিল। কথা বলে কেউ কিছু বোঝাতে পারে না আমাকে, ধীরে ধীরে পড়শিরা সবাই আমার এখানে আসা বন্ধ করে দিল। নিজের বাড়িতে নিজেই বন্দী হলাম।’ ‘কিন্তু, দাদু...’ বলতে গেল অঞ্জন। ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ থাকতে ইশারা করলেন দাদু। ‘ও আমাকে সাবধান করে দিয়েছে, এখানে কোনও মেহমান রাখা চলবে না। আমি ওর হুকুমের চাকর। ওর ইচ্ছেমত আমাকে দিয়ে কাজ করিয়েছে। আমিও ব্ল্যাক ম্যাজিক জানি। আমার স্বামীর কাছে শিখেছিলাম। তবে জাদুর মতায় কুসির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারিনি কখনও। তোমাকে দেখে ভীষণ রেগে গিয়েছিল ও। বাড়ি থেকে তাড়াতে বলল। বললাম, কোথায় তাড়াব? এখানে কোথাও তোমার যাওয়ার জায়গা নেই। ও শুনল না, চাপাচাপি করতে লাগল। ওর ভয় ছিল, ওর শয়তানির কথা তুমি সব জেনে যাবে। আর তাহলে তুমি আমাকে ওর জাদুর প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করবে। তখন আমি একটা চালাকি করলাম। বললাম, এমন কিছু করব আমি, যাতে তুমি সব সময় ব্যস্ত থাকো, আর ওর বিষয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ না পাও। তখন তোমার খেলনা ভুতুড়ে জেলিকে সত্যি সত্যি ভুতুড়ে বানিয়ে দিলাম।’ ‘কিন্তু শেষ রা করতে পারলে না,’ শীতল কণ্ঠে বলল কুসি। ‘নিজেও বাঁচবে না আর এখন, ছেলে দুটোকেও বাঁচাতে পারবে না।’ ‘কেন, ওরা তোমার কী তি করেছে?’ দাদুর চোখে আগুন। ‘আমাকে মারো। ওদেরকে যেতে দাও।’ ‘না,’ মিহি কণ্ঠে কুসি বলল। বুকের ওপর দুই হাত রাখল আড়াআড়ি। হলুদ চোখ দুটো জ্বলছে। ‘ওরা অনেক বেশি জেনে ফেলেছে। আর ওদের যেতে দেয়া যায় না।’ ‘এখান থেকে বেরোতে হবে আমাদের,’ ইপুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল অঞ্জন, চোখ হলুদ তালটার দিকে। ‘ডাইনিটা কিছু করার আগেই।’ ‘কিন্তু কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল ইপু। ‘দরজা আগলে রেখেছে কুসি, দেখছ না?’ ছোট্ট ঘরটায় চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল অঞ্জনের দৃষ্টি। পালানোর পথ খুঁজছে। কিন্তু নেই। একটা হাত তুলে ধীরে ধীরে নিজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কুসি, যেন জাদুর মতা দিয়ে হলুদ বলটাকে কাছে টানতে চাইছে। কেঁপে উঠল ওটা। জোরে জোরে লাফ দিল, একবার, দুবার, তারপর যেন অদৃশ্য সুতোর অমোঘ টানে আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করল ডাইনির দিকে। ‘না, কুসি, দোহাই তোমার!’ ককিয়ে উঠলেন দাদু। ‘থামো!’ তাঁর কথায় কান দিল না কুসি। আঙুলের ইশারায় অঞ্জন ও ইপুকে দেখাল হলুদ তালটাকে। ফুটফুট করে অসংখ্য বুদবুদ ফুটল ওটার গায়ে। তারপর গড়িয়ে এগোল। ‘মেরে ফেলো ছেলে দুটোকে,’ আদেশ দিল কুসি। গতি বাড়াল মস্ত তালটা। কার্পেটের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অঞ্জন ও ইপুর দিকে। ‘হঠাৎ দৌড় দেবে, কুসির পাশ কাটিয়ে দরজার বাইরে চলে যাবে,’ ফিসফিস করে ইপুকে বলল অঞ্জন। গড়িয়ে আসা ভুতুড়ে জেলির কাছ থেকে পিছিয়ে সরে যাচ্ছে। ‘আমাদের দরজা পেরোতে দেবে না ডাইনিটা,’ ইপু বলল। ‘ছেলেগুলোকে মেরে ফেলো,’ আবার আদেশ দিল কুসি, দুই হাত ওপরে তুলে ঝাঁকাল। ‘চেষ্টা করলে একজন অন্তত বেরোতে পারব,’ অঞ্জন বলল। ‘আমি ওকে ব্যস্ত রাখছি, তুমি বেরিয়ে যাও।’ ‘আর লাভ নেই, বেরোতে পারব না, দেরি হয়ে গেছে!’ চিৎকার করে বলল ইপু। কয়েক ফুট দূরে এসে ওদের পথ আটকে দিয়ে লাফাতে শুরু করল তালটা। সারা গা কাঁপছে থিরথির করে, স্পন্দিত হচ্ছে জীবন্ত প্রাণীর মত। ‘আমাদেরকে কি ভেতরে টেনে নেবে ওটা!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘কিংবা পিষে মারবে!’ ইপু বলল। ‘মারো ছেলে দুটোকে!’ চেঁচিয়ে আদেশ দিল কুসি। ‘শেষ করে দাও!’ ছাব্বিশ. আবার গড়াতে শুরু করল তালটা। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল অঞ্জন। বরফের মত জমে গেছে যেন। পা দুটোকে মনে হচ্ছে কয়েক টন ওজন। ওর হাত চেপে ধরল ইপু। দম আটকে অপো করতে লাগল দু’জনে। অঞ্জন ভাবছে, হলুদ তালটা এসে যখন ধাক্কা মারবে, কতখানি ব্যথা পাবে? আর যদি ভেতরে টেনে নেয়, দম আটকে মরার যন্ত্রণা কতখানি হবে? হঠাৎ বিকট গর্জন শোনা গেল। অবাক হয়ে ভুতুড়ে জেলির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে অঞ্জন, ডাকটা কোনখান থেকে এসেছে। দরজার দিকে ইপুকে তাকিয়ে থাকতে দেখল ও। চেঁচিয়ে উঠল, ‘নেড়ি!’ দরজার কাছে চলে এসেছে দৈত্যাকার কুকুরটা। কুসির ঠিক পেছনে। মেঘ গর্জনের শব্দ হচ্ছে ওর ডাকে। নিচু ছাদে প্রতিধ্বনি তুলছে। শেষ মুহূর্তে দরজার কাছ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কুসি। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে। অঞ্জনকে দেখে, তাড়াহুড়া করে দরজা দিয়ে ঢুকতে গেল নেড়ি। উত্তেজিত হয়ে দুই পা তুলে দিল কুসির পিঠে, ওকে ঠেলে সরানোর জন্য। বিশাল কুকুরটার ওজন সামলাতে পারল না কুসি। সামনে ঝুঁকে গেল দেহটা। হুমড়ি খেয়ে পড়ল একেবারে ভুতুড়ে জেলির ওপর। শত্র“মিত্র চেনে না ভুতুড়ে জেলি। কুসিকে আটকে ফেলল। ওটার ভেজা গা থেকে চ্যাটাৎ করে শব্দ হলো। তারপর বিশ্রী, চোষার মত আওয়াজ। কুসির হাত দুটো আগে পড়েছে তালটার গায়ে। মুহূর্তে ঢুকে গেল জেলির ভেতর। পরণে টান দিয়ে কুসির দেহের সামনের অংশ মুখসহ ভেতরে টেনে নিল ভুতুড়ে জেলি। এ সব কিছুই ল করল না নেড়ি। ওর দৃষ্টি অঞ্জনের দিকে। লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকে ওর দিকে ছুটে গেল। ‘আরে থাম, থাম!’ কুকুরটাকে ঝাঁপ দিতে দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল অঞ্জন। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে কুকুরটা। ‘নেড়ি!’ আবার চিৎকার করে উঠল অঞ্জন। হাত বাড়াল কুকুরটাকে ধরার জন্য। ও যে বদলে যাচ্ছে, নেড়ি নিজে সেটা বুঝল না। জিভ বের করে অঞ্জনের গাল চাটতে লাগল। শক্ত করে ওকে ধরে রেখেছে অঞ্জন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছোট হয়ে গেল নেড়ি। আগে যেমন ছিল ও। ‘অঞ্জন, দেখো,’ ইপু চেঁচিয়ে বলল, ‘জেলির তালটাও ছোট হয়ে যাচ্ছে।’ ফিরে তাকাল অঞ্জন। সত্যি। হলুদ তালটাও দ্রুত ছোট হচ্ছে। ছোট হয়ে যাওয়া ভুতুড়ে জেলির বলের দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন ও ইপু। কুসিকে খুঁজছে ওদের চোখ। কিন্তু ডাইনিটাকে উধাও করে দিয়েছে ভুতুড়ে জেলি। আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে আবার। কার্পেটের ওপর পড়ে রয়েছে সাদামাঠা একটা হলুদ রঙের ছোট বল। ‘যাক, ভালয় ভালয় শেষ হলো সব,’ জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন দাদু। ‘কুসি গায়েব হয়ে গেছে,’ অঞ্জন তাকিয়ে আছে ভুতুড়ে ছোট বলটার দিকে। ‘গেল কোথায়?’ ‘কোথায় আর যাবে, নিশ্চয়ই হজম করে ফেলেছে ওকে ভুতুড়ে জেলি। ভাল হয়েছে। আর কোনদিন কাউকে জ্বালাতে আসবে না,’ দাদু বললেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে, আমি এখন কানে শুনতে পাচ্ছি! কান ঠিক হয়ে গেছে!’ ঠিক এই সময় খুলে গেল আবার দরজার পাল্লা। দরজায় দেখা দিল একটা ছায়ামূর্তি। লিভিং রুমে পা রাখল। আঠাশ. ‘মা!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। মা’র দিকে ছুটল ও। দুই হাতে জড়িয়ে ধরল মাকে। ‘হচ্ছিল কী এখানে?’ মিসেস জামান জিজ্ঞেস করলেন। ‘ওই ছেলে দুটো এমন করে ছুটে পালাল কেন? চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল ভূতে তাড়া করেছে!’ ‘ভূত নয়, ডাইনির কবলে পড়েছিল, মা,’ অঞ্জন বলল। ‘তোমাকে দেখে কি যে খুশি লাগছে, মা, উফ্।’ মিসেস জামানকে নিয়ে রান্নাঘরে চললেন দাদু । ‘চা বানাই। লম্বা একটা গল্প শোনাব তোমাকে।’ ‘বেশি লম্বা গল্প শোনার সময় নেই, আন্টি,’ বলে অঞ্জনের দিকে তাকালেন তিনি। চোখে প্রশ্ন। ‘বিকেল ৪টের বাস ধরতে হবে আমাদের। টিকেট নিয়ে এসেছি।’ ‘মা, আমার মনে হয় গল্পটা তোমার ভাল লাগবে,’ মাকে বলল অঞ্জন। ইপুর দিকে তাকাল। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ইপু। রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন দিলারা দাদু ও মিসেস জামান। কান্ত ভঙ্গিতে একটা সোফায় বসে পড়ল ইপু ও অঞ্জন। ‘তোমার সঙ্গে নিশ্চয় আর কোনদিন দেখা হবে না,’ ইপু বলল। ‘মানে, ঢাকায় চলে গেলে আর তো কখনও এখানে আসবে না।’ ‘না...ইয়ে...আ-আমি তোমাকে চিঠি লিখতে পারি...’ হঠাৎ কেমন ভাষা হারিয়ে ফেলল অঞ্জন। ‘ঠিক আছে, লিখো,’ উজ্জ্বল হলো ইপুর মুখ। ‘তা ছাড়া ফোনও করতে পারবে। আমাদের বাড়ির নম্বরে ফোন করো। ঢাকায় গিয়ে টেলিফোন পেলে তোমাদের ওখানকার নম্বরটা দিয়ো আমাকে।’ ‘নিশ্চয় দেব,’ যোগাযোগের উপায় খুঁজে পেয়ে আড়ষ্টতা কেটে গেল অঞ্জনের। ‘অঞ্জন, একটা জিনিস চাইলে দেবে?’ ইপু জিজ্ঞেস করল। ‘নিশ্চয় দেব,’ কৌতূহলী হলো অঞ্জন। ‘শুনলে তোমার অবাক লাগবে।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল ইপু, ‘আমাকে...ইয়ে...উঁম্...অল্প একটু ভুতুড়ে জেলি দিয়ে যাবে? তোমার স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব।’ ‘নিশ্চয়ই,’ অঞ্জন বলল। ‘পুরোটাই রেখে দাও না, আমার কোন আপত্তি নেই।’ কার্পেটের দিকে তাকাল দু’জনে। ‘আরে, নেই তো!’ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ইপু। ছোট হলুদ বলটা যেখানে পড়ে ছিল, সেখানে ছুটে এল দু’জনে। সত্যিই নেই বলটা। ডাইনিটার মতই উধাও হয়ে গেছে, রহস্যময়ভাবে। হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল নেড়ি। আবার কে এল? ফিরে তাকাল অঞ্জন। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে হারু-তরু। ‘তোমরা?’ অঞ্জন বলল। ‘ভেতরে আসতে পারি,’ বিব্রত ভঙ্গিতে বলল হারু। ‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে আমাদের কথা আছে,’ যোগ করল তরু। অঞ্জন বলল, ‘এসো। আবার কী কথা?’ ‘মাপ চাইতে এলাম তোমার কাছে,’ ভেতরে পা দিয়ে হারু বলল। ‘তুমি আমাদের বাঁচিয়েছ,’ বলল তরু। ‘যথেষ্ট শিা হয়েছে আমাদের,’ হারু বলল। ‘আর শয়তানি করব না,’ তরু বলল। ‘এই যে, কান ধরছি।’ ‘আরে না না, কান ধরতে হবে না, করো কী!’ অঞ্জন বলল। দুই দিক থেকে অঞ্জনকে জড়িয়ে ধরল দুই ভাই। ‘বলো, আমাদের মাফ করেছ।’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, করেছি, ছাড়ো, ছাড়ো!’ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল হারু-তরু। দু’জনে অঞ্জনের দুটো হাত ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে বলল, ‘তুমি একটা অসাধারণ ছেলে। সত্যি!’ Ñ শেষ Ñ ওকে সম্পূর্ণ রহস্য উপন্যাস হলুদ পিশাচ রকিব হাসান এক. ‘আমি এখানে থাকতে চাই না, মা। প্লিজ, আমাকে ফেলে যেও না।’ মায়ের হাত আঁকড়ে ধরল অঞ্জন। ওর ভাল নাম রফিকুজ্জামান। ছোট দোতলা বাড়িটার সামনের সিঁড়ি থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করল মাকে। ফিরে তাকালেন মিসেস জামান, অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে ভ্রƒকুটি করলেন। ‘অঞ্জন, তোমার বয়স এখন বারো। যথেষ্ট বড় হয়েছ। ছেলেমানুষি কোরো না,’ হাতটা ছেলের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। ‘বড় হয়েছ, বড় হয়েছÑতোমার এই এক কথা শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল!’ রাগ করে বলল অঞ্জন। মায়ের মুখে স্নেহের হাসি ফুটল। ছেলের চুলে আঙুল বুলিয়ে আদর করতে গেলেন। ‘ছাড়ো, আমার এ সব ভাল্লাগে না!’ ঝাড়া দিয়ে মায়ের হাতটা সরিয়ে পিছিয়ে গেল অঞ্জন। আরেকটু হলেই বারান্দায় উঠার সিঁড়ি থেকে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল। ‘বেশ, আমাকে যখন দেখতেই পারো না...’ কথাটা শেষ না করে সিঁড়ির বাকি দুটো ধাপ উঠে সামনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন মা। দরজায় থাবা দিলেন। ছেলের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘ওখানেই থাকো।’ ‘আমি এলে অসুবিধে কী?’ ‘তোমার জুতোর ফিতে খোলা,’ মা বললেন। ‘তাতে কী? ফিতে খোলা রাখলে পরতে আরাম লাগে।’ ‘ফিতেয় পা পড়লে টান লেগে পড়ে যাবে,’ মা বললেন। ‘উফ্, মা,’ অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে চোখ ঘুরিয়ে বলল অঞ্জন, ‘জুতোর ফিতেয় পা দিয়ে কাউকে পড়তে দেখেছ?’ ‘না, তা দেখিনি,’ মৃদু হাসি ফুটল মা’র মুখে। ‘তুমি আসলে আসল বিষয়টা থেকে আমার মন সরিয়ে রাখতে চাইছ,’ মুখ গোমড়া করে অঞ্জন বলল। ‘সারা জীবনের জন্য ওই ভয়ানক বুড়িটার কাছে ফেলে যেতে চাইছ আমাকে...’ ‘ছিহ্, অঞ্জন! বড়দের সম্মান করে কথা বলো। দিলারা আন্টি ভয়ানক বুড়ি নন। তিনি তোমার বাবার ফুফু। তোমার দাদু...’ ‘আমি তাকে চিনি না,’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। বুঝতে পারছে বাড়াবাড়ি করে ফেলছে, কিন্তু সামলাতে পারছে না নিজেকে। এমন একটা কাজ কি করে করতে পারছে মা? কিভাবে এক বুড়ির কাছে ওকে ফেলে যেতে পারছে, যে মহিলাকে কোনদিন দেখেইনি ও? ওর মা ফিরে না আসা পর্যন্ত এতগুলো দিন কি করে কাটাবে এখানে? ‘অঞ্জন, অনেক বোঝানো হয়েছে তোমাকে,’ অধৈর্য ভঙ্গিতে মা বললেন। আবার কিল মারলেন সামনের দরজায়। ‘আর কোন উপায় থাকলে তোমাকে রেখে যেতাম না।’ এ সময় ঘেউ ঘেউ করে উঠল নেড়ি, অঞ্জনের কুকুর, ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মুখ বের করে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। ‘উহ্, কুকুরটাও এবার জ্বালাতন শুরু করল!’ কপাল চাপড়ালেন মিসেস জামান। ‘বের করে আনব ওকে?’ অধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। ‘আনো,’ মা জবাব দিলেন। ‘এভাবে চেঁচিয়ে দিলারা আন্টিকে এখন ঘাবড়ে না দিলেই বাঁচি।’ ‘আসছি, নেড়ি! চেঁচাস না,’ হাত নাড়ল অঞ্জন। খোয়া বিছানো ড্রাইভওয়ে ধরে ছুটল ও। ট্যাক্সির কাছে এসে দাঁড়াল। বিরক্ত চোখে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে ড্রাইভার। টান দিয়ে দরজা খুলল অঞ্জন। উত্তেজিত একটা হাঁক ছেড়ে, লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামল নেড়ি। ছোট জাতের বিদেশী কুকুর। ছোট আঙিনাটা জুড়ে পাক খেয়ে ছুটে বেড়াতে শুরু করল। ‘ওর কাণ্ড দেখে মনেই হয় না বুড়ো হয়েছে ও,’ দৌড়াতে থাকা কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন। এই প্রথমবারের মতো ওর মুখে হাসি দেখা গেল। ‘এই তো। ওটাই তো রয়েছে তোমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য,’ মা বললেন। ‘চোখের পলকে সময় কেটে যাবে, দেখো। মাত্র তো দুটো সপ্তাহ। ততদিনে আমি আর তোমার বাবা ঢাকায় একটা বাসা খুঁজে বের করে ফেলতে পারব। টেরই পাবে না কখন তোমাকে নিতে চলে এসেছি আমি।’ বড় এক টুকরো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল সূর্য। সামনের ছোট্ট আঙিনাটায় ঘন ছায়া পড়ল। ছায়াটা ভালো লাগল না কুকুরটার। তাড়াতাড়ি ফিরে এল হাঁপাতে হাঁপাতে। লম্বা জিভটা ঝুলে পড়ল দাঁতের ফাঁক দিয়ে। নিচু হয়ে ওটার পিঠ চাপড়ে দিল অঞ্জন। মুখ তুলে তাকাল দোতলার দিকে। দোতলার জানালায় পর্দা টানা। জানালার একটা পাল্লা কবজা থেকে খুলে গিয়ে কাত হয়ে ঝুলছে। কেমন বিষণœ মনে হলো বাড়িটাকে। দরজায় আবার থাবা দিচ্ছেন মা। ‘মা, থাবা দিচ্ছ কেন?’ প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল অঞ্জন। ‘তুমি না বলেছিলে দিলারা দাদু কানে শোনেন না?’ ‘ও, তাই তো,’ মুখ লাল হলো মার। ‘কী আর করব, ঘ্যানর ঘ্যানর করে মাথাটা এমনই গরম করে দিলে, ভুলে গিয়েছিলাম।’ কানে শোনে না, এমন একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে চোদ্দটা দিন কী করে কাটাব আমি, বিষণœ হয়ে আরেকবার ভাবল অঞ্জন। কথা বলব কী করে? কোন কিছুর প্রয়োজন হলেও তো চাইতে পারব না। অঞ্জনের বাবা জামান সাহেবের অবশ্য ছেলেকে এখানে থাকতে পাঠানোর ইচ্ছে ছিল না। বলেছেন, ‘ফুফু পাগল। ফুফা মারা যাওয়ার পর থেকেই কেমন বদলে গেছে। হঠাৎ করে কানটা গেল খারাপ হয়ে। একেবারেই কানে শোনে না। কালো একটা বিড়ালকে নিয়ে একা থাকে বাড়িতে। আশপাশের কারও সঙ্গে কথা বলে না। নিজের ব্যাপারেই উদাসীন, অঞ্জনের যতœ নেবে কী করে?’ দু’দিন আগে আড়াল থেকে বাবা আর মাকে আলোচনা করতে শুনেছে অঞ্জন। ‘এ ছাড়া আর তো কোন উপায়ও নেই আমাদের,’ মা বলেছেন। ‘আর কেউ নেই যার কাছে ওকে রেখে যাওয়া যাবে। আমরা থাকব হোটেলে, ওকে রাখব কোথায়? আলাদা রুমে রাখতে গেলে অনেক খরচ। তা ছাড়া আমরা বাসার খোঁজে ঘুরে বেড়াব ও তখন কী করবে? তুমিও আর ঢাকায় বদলি হওয়ার সময় পেলে না...’ ‘বদলিটা কি আমি ইচ্ছে করে হয়েছি? করা হয়েছে।’ ‘বাধা দিয়ে তো দেখতে পারতে।’ ‘করি চাকরি। বাধা দিয়ে কী করব? আর দিলেই কি আমার কথা শুনত। অনেক বছর তো নোয়াখালীতে থাকলাম। এর আগেও তিন বার বদলি ক্যানসেল করিয়েছি, তুমি জানো। এবার কিছুতেই শুনল না...’ ‘ভালমতো চেষ্টাই করনি। করলে কি আর শোনে না।’ হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবা। অঞ্জনের মার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, পারবেন না। বলেছেন, ‘ঠিক আছে, তোমার কথাই সই। আমি কাল চলে যাব। তুমি এখানকার কাজ সেরে, কুমিল্লায় ফুফুর বাসায় ওকে রেখে সোজা ঢাকায় চলে যেও।’ ‘তুমি অকারণ দুশ্চিন্তা কোরো না,’ নরম হলেন মা। ‘আমার মনে হয় ভালই লাগবে ওর, একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। অসময়ে মানুষকে কিভাবে মানিয়ে চলতে হয়, শেখাও তো দরকার...’ হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বিশালদেহী একজন মহিলা। বাধা পড়ল অঞ্জনের ভাবনায়। মহিলার হাতে একটা বড় গোশত কাটার ছুরি। তাতে রক্ত লেগে আছে। দুই. মহিলাকে দেখেই ঘেউ ঘেউ শুরু করল নেড়ি। পিছিয়ে যাচ্ছে। মিসেস জামান চুপ করে তাকিয়ে আছেন মহিলার দিকে। আতঙ্কিত চোখে হাঁ করে রক্তাক্ত ছুরিটা দেখছে অঞ্জন। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল মহিলার মুখে। কে এই মহিলা, বুঝতে অসুবিধে হলো না অঞ্জনের। ওর কল্পনার সঙ্গে মিলল না দাদু দিলারা বানুর চেহারা। দাদু শুনে কল্পনা করেছিল ছোটখাটো, ভঙ্গুর শরীরের, ধবধবে সাদা চুলওয়ালা একজন বৃদ্ধা। কিন্তু সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা মস্ত শরীর, চওড়া কাঁধ, কালো কুচকুচে চুল দেখে অবাক হলো ও। বয়স খুব বেশি না দাদুর, এখনও চুলও পাকেনি। দাদুর পরনে সালোয়ার-কামিজ, দেখতে অনেকটা পাঞ্জাবি মহিলাদের মত লাগছে। কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে যাওয়া চুলগুলোকে রবার ব্যান্ড দিয়ে ঘোড়ার লেজের মত করে বেঁধেছেন। বড় বড় গোল চোখের মণি বিড়ালের চোখের মত কটা। ‘রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ট্যাক্সিটা দেখেই বুঝেছি তোমরা এসেছ,’ মিসেস জামানকে বললেন তিনি। ‘জামানের চিঠি পেয়েছি আমি।’ অঞ্জনকে ভয়ে ভয়ে ছুরিটার দিকে তাকাতে দেখে বললেন, ‘গোশত কাটছিলাম। গরুর গোশত।’ হাতের ছুরিটা ওর দিকে তাক করে বললেন, ‘কি, গরুর গোশত ভাল লাগে তোমার?’ ‘অ্যাঁ...হ্যাঁ,’ কোনমতে জবাব দিল অঞ্জন। ছুরি হাতে দিলারা দাদুকে দেখে যে দুরুদুরু শুরু হয়েছিল বুকের ভেতর, সেটা এখনও থামেনি। দরজার পাল্লাটা পুরো খুলে দিলেন দাদু। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দ্বিধা করছে অঞ্জন আর ওর মা। ‘ওর তো বেশ বাড়ন্ত শরীর,’ অঞ্জনকে দেখিয়ে ওর মাকে বললেন দাদু। ‘বয়সের তুলনায় ভালই বেড়েছে। ওর বাবার মত ইট্টুক নয়। ছোটবেলায় ওর বাপ এতই খুদে ছিল, আমি ওকে মুরগির ছানা ডাকতাম।’ হাসলেন তিনি। পায়ের কাছে রাখা অঞ্জনের সুটকেসটা তুলে নিলেন মিসেস জামান, অস্বস্তিভরা চোখে ফিরে তাকালেন ছেলের দিকে। ‘হ্যাঁ...বয়সের তুলনায় লম্বাই হয়ে গেছে, তবে গায়ে কিছু নেই, দেখছেন না।’ ‘ঠিক আছে, রেখে যাও। গরুর গোশত খাইয়ে ওকে আমি মোটা করে দেবো,’ দাদু বললেন। ‘এই দেখো, আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি। এসো, এসো।’ মায়ের পেছন পেছন হলরুমে ঢুকল অঞ্জন। ওর পায়ের কাছে থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে এল নেড়ি। ‘কুকুরটাকে থামাতে পারো না?’ মা বললেন। ‘অসুবিধে নেই, বুড়িটা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না,’ অঞ্জন জবাব দিল। ‘চুপ। বলেছি না, অভদ্রের মত কথা বলবে না।’ রান্নাঘরে গিয়ে হাত থেকে ছুরিটা রেখে ফিরে তাকালেন দাদু। তাঁর কটা চোখের দৃষ্টি স্থির হলো অঞ্জনের ওপর। অঞ্জনকে ভালমত দেখলেন। ‘তাহলে গরুর গোশত পছন্দ করো তুমি?’ আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি। মাথা ঝাঁকাল অঞ্জন। ‘ভাল,’ মহিলা বললেন। ‘তোমার বাবাও গরু পছন্দ করে। তবে রান্না করা গোশতের চেয়ে গোশতের বড়া খেতে ভালবাসে ও।’ ‘আমারও বড়াই ভাল লাগে,’ বলল অঞ্জন। মনে পড়ল, দাদু কানে শোনেন না। মিসেস জামানকে জিজ্ঞেস করলেন দাদু। ‘তোমার ছেলে কোন ঝামেলা করে না তো?’ ‘না, করে না,’ মাথা নাড়লেন মিসেস জামান। ‘সুটকেসটা কোথায় রাখব?’ শুনতে পাননি দাদু। তাই জবাব দিলেন না। অঞ্জনের গাল টিপে আদর করে দিয়ে বললেন, ‘দেখে তো ভাল ছেলেই মনে হচ্ছে। চেহারাটাও সুন্দর। দুষ্টুমি করে না তো?’ ওর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন দাদু। ‘কি, করো না তো? দুষ্টুমি না করলে, শান্ত হয়ে থাকলে, তোমাকে আমি গোশতের বড়া বানিয়ে খাওয়াব,’ মস্ত থাবা দিয়ে ঘোড়ার লেজের মত চুল মুঠো করে ধরে টানলেন দাদু। ‘গোশত দিয়ে বানানো সামুসা পছন্দ করো? তা-ও খাওয়াব। তোমার বাবাকেও খাওয়াতাম। কিন্তু তোমার বাবা আমাকে দেখতে পারত না। মুরগির ছানাটা আমার সম্পর্কে তোমাকে কী বলেছে, অঞ্জন? নিশ্চয়ই বলেছে, আমি একটা ভয়াবহ ডাইনি বুড়ি, তাই না?’ ‘না না, বাবা কিছু বলেনি,’ বলে অসহায়ের মত মায়ের দিকে তাকাল অঞ্জন। ‘আসলেই আমি ডাইনি বুড়ি!’ দাদু বললেন। নিজের রসিকতায় নিজেই হা-হা করে হাসলেন। হাসিটা ঘাবড়ে দিল নেড়িকে। ঘেউ ঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠে অঞ্জনের দাদুর পায়ে কামড়াতে গেল। লাথি মেরে কুকুরটাকে সরিয়ে দিলেন দাদু। চোখের পাতা সরু করে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, ‘খবরদার, কুত্তা, বেশি শয়তানি করলে তোকে কেটেই গোশতের বড়া বানাব আমি!’ কুঁই কুঁই করে খাটো লেজটা নেড়ে পিছিয়ে গেল নেড়ি। বুঝে গেছে, এই মহিলাকে ভয় দেখাতে পারবে না। ‘এটা?’ সুটকেসটা উঁচু করে দেখালেন মিসেস জামান। ‘দোতলায় নিয়ে যাও, স্টাডিতে ওর থাকার ব্যবস্থা করেছি,’ বলে আঙুল তুলে ওপর দিকে দেখালেন দাদু। ‘আমার কাজ আছে। তোমাদের খাবার দিতে হবে।’ ‘না, আমি খাব না। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। অঞ্জনের জিনিসপত্রগুলো গোছগাছ করে দিয়ে চলে যাব...’ দাদু কানে শোনেন না মনে পড়াতে থেমে গেলেন। রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন দাদু। অঞ্জন বলল, ‘তুমি যা-ই বলো, মা, বুড়িটা আজব!’ ‘আহ্, একজন ভদ্র মহিলার সম্পর্কে এভাবে বলো না তো! তোমার এত খারাপ লাগছে কেন বুঝলাম না। আমার তো ভালই লাগছে।’ একটু থেমে মা বললেন। ‘শোনো, সময় কাটানো নিয়ে ভাবছ তো? এখানে তোমার বয়সী অনেক ছেলে পাবে। ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিলেই আর একা একা লাগবে না।’ ‘কিন্তু দাদু আমাকে যদি ঘরে বসিয়ে রাখে?’ ‘তা কেন রাখবেন? তিনিও চাইবেন না, তোমার বয়সী একটা ছেলে সারাণ বাড়িতে বসে থাকুক।’ ‘হুঁ!’ কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারল না অঞ্জন। আচমকা ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন মা, নিচু হয়ে গালে গাল ঠেকালেন। কিন্তু অঞ্জনের মুখে হাসি ফুটল না। কিছু না বলে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইল। ‘আমি চাই, তুমি গুডবয় হয়ে থাকো,’ আবার বললেন তিনি। ‘যাতে ফিরে এসে আমি শুনতে পাই, তিনি বলেন, অঞ্জন খুব ভাল ছেলে।’ মাকে আর দুঃখ দিতে চাইল না অঞ্জন। ‘চলো, সুটকেসটা আমার ঘরে নিয়ে যাই।’ জিনিসপত্রে ঠাসা ভারী সুটকেসটা। সরু সিঁড়ি দিয়ে বয়ে নিয়ে এল দু’জনে মিলে। স্টাডিটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হলো না। দরজা খোলাই আছে। ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বড় বড় বইয়ের তাক, পুরনো আমলের শক্ত মলাটে বাঁধাই বইয়ে ঠাসা। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা মেহগনি কাঠের টেবিল। পর্দা টানা একমাত্র জানালাটার নিচে সরু একটা খাট রাখা। জানালাটা দিয়ে পেছনের আঙিনা দেখা যায়। লম্বা এক চিলতে আয়তাকার জায়গা, সবুজ ঘাসে ঢাকা; বাঁ পাশে টিনের চালা লাগানো গ্যারেজÑএক সময় গাড়িটাড়ি ছিল বোধহয়, এখন নেই। ডান পাশে উঁচু খুঁটির বেড়া। আঙিনার পেছন দিকে তারের জাল দিয়ে ঘেরা খানিকটা জায়গা। ঘরের বাতাসে ছত্রাকের গন্ধ। তার সঙ্গে ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ মিশে রয়েছে। মার দিকে তাকাল অঞ্জন। সুটকেস খুলে জিনিসপত্র বের করে গোছাচ্ছেন মা, আর বারবার অস্থির ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখছেন। তাড়াহুড়া করে কাজ শেষ করলেন। ‘আমি যাই,’ মা বললেন। আরেকবার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। হাতব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে গুঁজে দিলেন অঞ্জনের শার্টের পকেটে। ‘নাও, নিজের পছন্দমতো কিছু কিনে নিও। ভাল থেকো। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে নিতে ফিরে আসব।’ হাত নেড়ে মাকে বিদায় জানাল অঞ্জন। বুকের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, যেন ডানা নেড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য প্রজাপতি। গলার ভেতরটা শুকনো খসখসে। ‘ঢাকা থেকে ফোন করব আমি,’ বেরিয়ে যাবার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে মা বললেন। তারপর, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া মায়ের জুতোর শব্দ শুনল অঞ্জন। চাপা একটা বিষণœ হাঁক ছাড়ল নেড়ি, যেন বুঝতে পারছে, এই আজব বাড়িটাতে এক আজব মহিলার সঙ্গে ফেলে যাওয়া হয়েছে ওদের। এখানে কোন আনন্দ নেই। জানালার দিকে এগোল অঞ্জন। এক হাতে পর্দাটা সরিয়ে ধরে রাখল। ছোট, সবুজ আঙিনাটার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের দুরুদুরু কমছে না। কয়েক মিনিট পর মার ট্যাক্সিটা দেখতে পেল খোয়া বিছানো পথে। ফিরে যাচ্ছে। রাস্তার বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল ট্যাক্সি। ইঞ্জিনের শব্দও যখন মিলিয়ে গেল, জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ধপ করে খাটে বসে পড়ল অঞ্জন। বইয়ের তাকগুলোর দিকে তাকাল অঞ্জন। সারাটা দিন এখানে কী করব আমি? দুই হাতে মাথা চেপে ধরে নিজেকে প্রশ্ন করল ও। ভিডিও গেম নেই। কম্পিউটার নেই। এমনকি একটা টেলিভিশনও নেই। কী করে সময় কাটাব আমি? আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে, খাট থেকে উঠে বইয়ের তাকের কাছে এসে দাঁড়াল ও। বইগুলোর নাম দেখতে লাগল। বিজ্ঞানের ওপর লেখা প্রচুর বই রয়েছে। জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, ডাক্তারিবিদ্যাসহ পুরনো মিসরের ওপর লেখা নানা রকম বই, যার বেশির ভাগই পুরনো, ধুলোয় ঢাকা। হলদে হয়ে গেছে পাতা। ব্ল্যাক ম্যাজিকের ওপর কয়েকটা বই দেখে অবাক হলো অঞ্জন। ভাবছে, কার বই এগুলো? দাদার? তিনি কি বিজ্ঞানী ছিলেন? গবেষণা করতেন? কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে ব্ল্যাক ম্যাজিকের সম্পর্ক কী? নিজের পড়ার মত কোন বই না দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল ওর। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল বড় আলমারিটার দিকে। টান দিয়ে দরজা খুলল। কী যেন লাফিয়ে পড়ল মাথায়। ভীষণ চমকে গিয়ে ‘আউ!’ করে উঠল অঞ্জন। ভয়ে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল ও। তিন. মাথায় কী পড়েছে বুঝতে সময় লাগল না। বিড়াল! আলমারির ওপর শুয়ে নিশ্চয় ঘুমাচ্ছিল, দরজা খোলার শব্দে ভয় পেয়ে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছে। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে অঞ্জনের হৃৎপিণ্ডটা। টান দিয়ে মাথার ওপর থেকে ফেলে দিল বিড়ালটাকে। ক্রুদ্ধস্বরে ফোঁসফোঁস করছে ওটা। দরজার দিকে এগোল। ফিরে তাকিয়ে অঞ্জন দেখে, দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন দাদু। মুখে কৌতুকের হাসি। কখন এসে দাঁড়িয়েছেন ওখানে, জানে না অঞ্জন। ‘কুসি, আলমারির ওপর কী করছিলে?’ বিড়ালটাকে জিজ্ঞেস করলেন দাদু। ‘অকারণে ভয় দেখালে ছেলেটাকে।’ পোষা বিড়ালকে তুমি করে বলছেন! অবাক লাগল অঞ্জনের। মিউ মিউ করে দাদুর পায়ে গা ঘষল বিড়ালটা। ‘ভয় পেয়েছ, অঞ্জন?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন দাদু। ‘না,’ জোর নেই অঞ্জনের গলায়, ‘ভয় পাইনি, তবে চমকে গিয়েছিলাম।’ ‘কুসির ব্যাপারে সাবধান। ভীষণ পাজি ও, এক নম্বরের শয়তান,’ আবার বললেন দাদু। নিচু হয়ে ঘাড়ের চামড়া খামচে ধরে উঁচু করলেন বিড়ালটাকে। ঝুলিয়ে রেখে নাড়তে থাকলেন। বিড়ালটাকে শূন্যে ঝুলতে দেখে, তীè হাঁক ছাড়ল নেড়ি। ভাবল, অসহায় হয়ে গেছে, এখন ভয় দেখানো যাবে। খাটো লেজটা জোরে জোরে নেড়ে লাফিয়ে উঠে বিড়ালটাকে ধরার চেষ্টা করল। না পেরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। আবার লাফ দিল। আবার মিস করল। আবার লাফ। বিড়ালটার ঝুলে থাকা লেজ কামড়ানোর চেষ্টা করছে। ‘এই নেড়ি, থাম! থাম বলছি!’ চেঁচিয়ে ধমক দিল অঞ্জন। দাদুর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে বিড়ালটা। শরীর মুচড়ে, নানাভাবে কসরত করেও ছুটতে না পেরে, রাগে চিৎকার করে উঠল। কালো থাবা বাড়িয়ে আঁচড়ে দিতে চাইল হাতে। বিড়ালটাকে এমন করতে দেখে আরও জোরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল কুকুরটা। টেনে ওটাকে সরিয়ে নিল অঞ্জন। বিড়ালটাকে হাত থেকে ছেড়ে দিলেন দাদু। চারপায়ে লাফিয়ে নামল ওটা মেঝেতে, সুড়–ৎ করে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। ‘অ্যাই পাজি কুত্তা, চুপ কর!’ নেড়িকে ধমক দিলেও বিড়ালটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোয় খুশিই হয়েছে। এখনও আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছেন দাদু। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ‘কুত্তাটাকে আনো এদিকে,’ নিচুস্বরে বললেন তিনি। সরু হয়ে গেছে চোখের পাতা। ফ্যাকাশে ঠোঁট দুটো চেপে বসেছে। ‘অ্যাঁ?’ নেড়িকে চেপে ধরল অঞ্জন। ‘আনো ওটাকে,’ শীতল কণ্ঠে বললেন দাদু। ‘বেয়াড়া জানোয়ারকে ঘরের ভেতর জায়গা দিতে রাজি নই আমি। একটাকে দিয়েই যথেষ্ট শিা হয়েছে।’ একটা মানে, নিশ্চয় বিড়ালটার কথা বলছেন দাদু। ‘কিন্তু...’ বলতে গিয়ে থেমে গেল অঞ্জন, মনে পড়ল, দাদু কানে শোনেন না। ‘কুসি একটা শয়তান,’ কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হলো না দাদুর, মুখের ভাবও নরম হলো না। ‘ওটাকে রাগানো ঠিক নয়।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলেন তিনি। ‘নিয়ে এসো কুকুরটাকে।’ দুই হাতে শক্ত করে কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখে দ্বিধা করছে অঞ্জন। ‘কুকুরটার ব্যবস্থা আমাকে করতেই হবে,’ কঠিন কণ্ঠে দাদু বললেন। ‘নিয়ে এসো।’ ভয় পেয়ে গেল অঞ্জন। ‘ব্যবস্থা করতে হবে’ বলে কী বোঝাতে চেয়েছেন দাদু? রক্তাক্ত ছুরি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দাদুর চেহারাটা কল্পনায় দেখতে পেল অঞ্জন। চার. আর কোনও উপায় নেই দেখে, বাধ্য ছেলের মত নেড়িকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামল অঞ্জন। দাদুকে অনুসরণ করে চলে এল পেছনের আঙিনায়। ‘তৈরিই ছিলাম আমি,’ ফিরে তাকিয়ে অঞ্জন আসছে কি না দেখে নিয়ে বললেন তিনি। ‘যখনই শুনেছি, কুকুর নিয়ে আসবে, বানিয়ে রেখেছি এটা।’ তারের জালে ঘেরা জায়গাটার দিকে এগোনোর সময় অঞ্জনের হাত চেটে দিল নেড়ি। ‘এটা তোমার কুকুর রাখার জায়গা।’ ‘ওই খোঁয়াড়টা?’ ‘খোঁয়াড় দেখলে কোথায়? এত সুন্দর বেড়া, নতুন তারের জাল কিনে বানালাম।’ জালের ঘেরের ভেতর ঢুকে একটা লম্বা দড়ি দেখিয়ে বললেন, ‘ওটা দিয়ে কুত্তাটার কলারে বাঁধো। এখানে থাকতে খারাপ লাগবে না ওর।’ বাঁকা চোখে কুকুরটার দিকে তাকালেন তিনি। ‘কুসির সঙ্গেও টক্কর লাগবে না। আমি চাই না, সারাণ বিড়ালটার সঙ্গে ও মারামারি করুক।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অঞ্জন। জানে এই খোঁয়াড়ে বন্দী থাকতে ভাল লাগবে না কুকুরটার। কিন্তু কোন উপায়ও নেই, জানে অঞ্জন। দাদুর সঙ্গে তর্ক করে লাভ হবে না, আর তর্ক করবেই বা কিভাবে, কানেই তো শোনেন না। তিনি যা বলবেন একতরফাভাবে সেটাই মেনে নিতে হবে। কুকুরটার কলারে দড়ির এক মাথা বাঁধল ও। নেড়ির মাথায় হাত রেখে আদর করে দিয়ে সোজা হয়ে দাদুর দিকে তাকাল। বুকের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি রেখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কটা চোখের তারা উজ্জ্বল রোদে জ্বলছে। ঠাণ্ডা হাসি ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে। অঞ্জনের মনে হলো, বিজয়োল্লাস। দাদুর আচরণ খুব অদ্ভুত লাগছে ওর কাছে। ‘এই তো সোনা ছেলে,’ অঞ্জনকে উঠে আসার সময় দিলেন দাদু। ‘তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম। এসো, ঘরে এসো। খাওয়া হয়নি নিশ্চয় অনেকণ।’ অঞ্জনকে চলে যেতে দেখে করুণ চিৎকার করে উঠল নেড়ি। ফিরে তাকাল অঞ্জন। খপ করে লোহার মত শক্ত আঙুলে ওর হাত চেপে ধরে, বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে চললেন দাদু। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ছোট্ট রান্নাঘরটায় জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা টেবিলে অঞ্জনকে বসতে ইশারা করলেন দাদু। একটা খোপ খোপ ছাপ দেয়া প্ল্যাস্টিকের চাদরে ঢাকা টেবিলটা। নাস্তা এনে টেবিলে রাখতে রাখতে অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে ভ্রƒকুটি করলেন তিনি। তীè দৃষ্টিতে দেখছেন। দুধ আর বিস্কুট খাওয়া শেষ করে দাদুর দেয়া একটা পেপার ন্যাপকিন দিয়ে ওপরের ঠোঁটে লেগে থাকা দুধ মুছল অঞ্জন। ‘নেড়িকে নিয়ে হাঁটতে যাচ্ছি আমি।’ একভাবে তাকিয়ে আছেন দাদু। কোন ভাবান্তর নেই চেহারায়। ও। অকারণে বললাম, দাদু তো আমার কথা শুনতে পায় না, ভাবল অঞ্জন। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে নেড়ির দিকে ইঙ্গিত করে, দুই আঙুল টেবিলে রেখে হাঁটিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল কী করতে চায়। বুঝলেন দাদু। মাথা ঝাঁকালেন। উফ্, কী যন্ত্রণা, ভাবল ও। বধির মানুষকে কিছু বোঝানো বড় কঠিন। হাত নেড়ে দাদুকে গুড-বাই জানিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল অঞ্জন, নেড়িকে ওর কারাগার থেকে বের করার জন্য। কয়েক মিনিট পর, শিকল টেনে নিয়ে পথের মোড়ের গাছগুলোর গোড়া শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে চলল নেড়ি। জায়গাটা বেশ সুন্দর। আবাসিক এলাকা। রাস্তার পাশে আরও বাড়িঘর আছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সামনে চারকোনা আঙিনা। একটা বট গাছকে ঘিরে ছোটাছুটি করে খেলতে দেখল কয়েকটা ছেলেকে। একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ধুচ্ছেন বাগানের হোস পাইপের সাহায্যে পানি ছিটিয়ে। মোটা একটা গাছের গুঁড়ির চারপাশে ঘুরে কী যেন শুঁকতে শুঁকতে উল্টো দিকে এগিয়ে যেতে চাইল নেড়ি। কোনমতেই কথা শোনাতে না পেরে নিচু হয়ে ওটাকে তুলে নিতে যাবে অঞ্জন, খপ করে কে যেন ওর কাঁধ চেপে ধরল। ‘এই, কী নাম তোমার?’ কানের কাছে বলে উঠল একটা অপরিচিত কণ্ঠ। পাঁচ. চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অঞ্জন দেখল, ওরই বয়সী একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখছে ওকে। ‘ওভাবে আমার কাঁধ চেপে ধরলে কেন?’ এখনও ধড়াস ধড়াস করছে অঞ্জনের বুকের ভেতর। ‘তোমাকে ভয় দেখাতে,’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘ও!’ আর কোন কথা খুঁজে পেল না অঞ্জন। আচমকা শিকলে হ্যাঁচকা টান মেরে আরেকটু হলেই ওকে ফেলে দিচ্ছিল নেড়ি। হেসে উঠল ছেলেটা। খাটো করে ছাঁটা চুল। হাসি মুখে তাকিয়ে আছে অঞ্জনের দিকে। গায়ে বড় মাপের ঢলঢলে লাল রঙের টি-শার্ট, পরনে কালো প্যান্ট আর পায়ে উজ্জ্বল হলুদ রঙের নাইক জুতো। ‘তুমি কে বললে না তো?’ আবার জিজ্ঞেস করল ছেলেটা। খুব সহজ আচরণ। কোন রকম জড়তা নেই ছেলেটার। ‘কে আবার?’ আচমকা কাঁধ চেপে ধরায় রাগ যায়নি অঞ্জনের। ‘আমি, আমি।’ শিকল টেনে গাছের গুঁড়ির চারপাশে ঘোরাচ্ছে ওকে নেড়ি। ‘বেড়াতে এলে নাকি?’ অঞ্জনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল ছেলেটা। ‘হ্যাঁ।’ ‘কাদের বাড়িতে?’ ‘দিলারা বানু। ওই যে, রাস্তার মাথার সতেরো নম্বর বাড়ি...’ ‘চিনি ওনাকে। উনি তোমার কী হন?’ ‘দাদু।’ ‘আপন দাদু? তাঁর তো কোন ছেলেপুলে আছে বলে শুনিনি।’ ‘উনি আমার বাবার ফুফু।’ ‘ও। তা থাকবে তো কিছু দিন?’ ‘হ্যাঁ, হপ্তা দুয়েক। ...ওটা তোমার সাইকেল?’ ছেলেটার পেছনে একটু দূরে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা একটা লাল সাইকেল দেখাল অঞ্জন। ‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘খুব সুন্দর,’ অঞ্জন বলল। ‘ওরকম একটা সাইকেল আমারও আছে।’ ‘তোমার কুকুরটাকে আমার পছন্দ হয়েছে,’ নেড়ির দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। ‘কেমন বোকা বোকা। বোকা কুকুরদের আমার পছন্দ।’ ‘আমারও,’ হাসল অঞ্জন। ‘ওর নাম কী? নামটাও কি বোকা বোকা?’ ঝুঁকে নেড়ির পিঠ চাপড়ে আদর করতে গেল ছেলেটা, কিন্তু সরে গেল কুকুরটা। ‘ওর নাম নেড়ি।’ ‘হ্যাঁ, বোকা বোকাই তো,’ বলল ছেলেটা। ‘ভীষণ বোকা নাম। বিশেষ করে একটা বিদেশী কুকুরের।’ ‘নামটা অবশ্য আমি রাখিনি,’ অঞ্জন বলল। ‘বাবা রেখেছেন। ও যখন আমাদের বাড়িতে এল, আমিও খুব ছোট, কারও নাম রাখার মতো বয়সই হয়নি আমার।’ আবার হাত বাড়াল ছেলেটা। সাহস করে ওর হাত শুঁকল নেড়ি, এত জোরে লেজ দোলাচ্ছে, শরীরটাও দুলছে ভীষণভাবে, লম্বা জিভটা বেরিয়ে প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। ‘আমার নামটাও কিন্তু বোকা বোকা শোনায়,’ বলে অঞ্জনের জিজ্ঞেস করার অপোয় রইল ছেলেটা। ‘কী নাম?’ জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। ‘ইপু,’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘কই বোকা বোকা, সুন্দর নাম।’ ‘কিন্তু আমার ভাল লাগে না,’ প্যান্টে লেগে থাকা একটা শুকনো ঘাসের ডগা টোকা দিয়ে ফেলল ইপু। ‘মেয়েদের নাম মনে হয়।’ ‘নাহ্, ইপু তো আজকাল হরদম ছেলেদের নাম রাখা হচ্ছে। আমার নাম...’ বাধা দিল ইপু, ‘বোকা বোকা নাকি?’ ‘কী জানি!’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল অঞ্জন। ‘তবে স্কুলে কেউ কেউ খেপায় অঞ্জন, ঝনঝন, বলে।’ ‘অঞ্জন, ঝনঝন,’ খিলখিল করে হাসল ইপু। ‘ভালই তো। বেশ ছন্দ আছে। কিন্তু বোকা বোকা নয়।’ খুশি হলো অঞ্জন। ওকে যে বোকা ভাবেনি ছেলেটা, তাতে স্বস্তি বোধ করল। ধীরে ধীরে বিষণœতা কেটে যাচ্ছে। ‘এখন কি হাঁটতে বেরোলে?’ জিজ্ঞেস করল ইপু। ‘হ্যাঁ, আশপাশটা ঘুরে দেখছি।’ ‘এখানে দেখার কিছু নেই,’ ইপু বলল। ‘আবাসিক এলাকা। শুধু বাড়িঘর। বড়ই একঘেয়ে। মার্কেটে যেতে চাও? বেশি দূরে না।’ হাত তুলে মার্কেটটা কোনদিকে দেখাল ও। দ্বিধা করল অঞ্জন। বেশি দূরে যাবে, দাদুকে বলে আসেনি। ও কোথায় গেল না গেল সেটা নিয়ে ওর দাদু নিশ্চয়ই মাথা ঘামাবেন না। ছয়. ‘বেশ, চলো,’ অঞ্জন বলল, ‘দেখেই আসি মার্কেটটা।’ ‘একটা খেলনা কিনব আমি,’ ইপু বলল। ‘আমার এক কাজিনকে উপহার দিতে হবে।’ হ্যান্ডেলের এক মাথা ধরে সাইকেলটাকে টেনে তুলল ও। ‘আসলে ওদিকেই যাচ্ছিলাম। তোমাকে দেখে থেমেছি।’ ‘তোমার বয়স কতো হলো?’ শিকল ধরে নেড়িকে টেনে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। ‘বারো।’ ‘আমারও বারো,’ অঞ্জন বলল। ‘তোমার সাইকেলটা একটু চালিয়ে দেখি?’ মাথা নেড়ে মানা করে দিয়ে সরু সিটটায় চেপে বসল ইপু। ‘না। তবে পাশপাশে তোমাকে দৌড়াতে দিতে আপত্তি নেই।’ রাগ করল না অঞ্জন, বরং ইপু প্যাড্ল্ ঘোরানো শুরু করতেই পাশপাশে দৌড়ে চলল। ‘তুমি আসলেই বোকা,’ হেসে বলল ইপু। কয়েকটা ব্লক পরে, রাস্তার পাশের বসত বাড়িগুলো শেষ হলো, মার্কেটে ঢুকল ওরা। পাশাপাশি সারি দিয়ে বানানো কতগুলো দোতলা বাড়ি, সেগুলোতে দোকান আর অফিস। একটা লাল ইটের বাড়ি রয়েছে, পোস্ট অফিস। এ ছাড়া একটা ব্যাংক, একটা চুল কাটার দোকান, একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। আর আছে একটা হার্ডওয়্যারের দোকান, সামনে বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে : এখানে পাখির খাবার পাওয়া যায়। ‘খেলনার দোকানটা ওদিকে,’ হাত তুলে দেখাল ইপু। ‘খেলনার দোকান আসলে এখানে দুটো রয়েছে। একটা নতুন, একটা পুরনো। পুরনোটাই আমার বেশি পছন্দ। কারণ ওখানে সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিসও পাওয়া যায়।’ দোকানের সামনে সাইকেলটা স্ট্যান্ডে রাখল ইপু। ‘মাঝে মাঝে দোকানের মালিকটা কেমন কুচুটে হয়ে ওঠে। মেজাজ খারাপ থাকলে তোমার কুত্তাটাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না।’ ‘চলো, ঢুকে দেখা যাক,’ টান দিয়ে দরজার পাল্লা খুলল অঞ্জন। কুকুরটাকে টানতে হলো না, ওটাই আগে মাথা ঢুকিয়ে দিল দোকানের ভেতর, অঞ্জনকেই বরং টেনে ঢোকাল। অঞ্জন দেখল, আবছা অন্ধকার, নিচু ছাদওয়ালা, সরু একটা ঘরে ঢুকেছে ওরা। মৃদু আলো চোখে সইয়ে নিতে সময় লাগল। দোকান না বলে গুদাম বললেই বেশি মানায়। দুই দিকেই দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু তাক, বাক্স আর খেলনায় ঠাসা, ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর রাখা লম্বা একটা ডিসপ্লে কাউন্টার, দুই পাশে ফাঁক এতই কম, অঞ্জনের মত সরু হলেই শুধু তার মাঝখান দিয়ে চলাফেরা করতে পারে, তা-ও চেপেচুপে। দোকানের সামনের দিকে, পুরনো ফ্যাশনের একটা কাঠের ক্যাশ কাউন্টারের ওপাশে উঁচু টুলে বসে পত্রিকা পড়ছে একজন গোমড়ামুখো মানুষ। মাথা জুড়ে টাক, চাঁদির ঠিক মাঝখানে এক গুচ্ছ সাদা চুল। মস্ত গোঁফের দুই মাথা নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। অঞ্জন আর ইপুকে দোকানে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকাল দোকানদার, গোঁফের মাথা দুটো যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে। চারপাশে স্তূপ করে রাখা খেলনার দিকে তাকাল অঞ্জন। এত পুরু হয়ে ধুলোর স্তর জমে রয়েছে, দেখলে মনে হয় শত বছরেও পরিষ্কার করা হয়নি। সবকিছুই যেন তালগুলো পাকানো, পুতুল ফেলে রাখা হয়েছে বিল্ডিং-সেটের পাশে, ছবি আঁকার সরঞ্জাম রয়েছে জন্তু-জানোয়ারের মূর্তিগুলোর কাছে। ফুটবলের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে কয়েকটা বাঁশি। দোকানে আর কোন খরিদদার নেই, শুধু ওরা দু’জন। ‘নিন্টেন্ডো গেম নেই এদের কাছে?’ ফিসফিস করে ইপুকে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন, এমন পরিবেশে জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে ও। ‘মনে হয় না,’ ফিসফিসিয়ে জবাব দিল ইপু। ‘দাঁড়াও, জিজ্ঞেস করি।’ সামনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল ও, ‘এই যে, শুনছেন, নিন্ডেন্ডো গেম আছে?’ মুখ তুলে কানের পেছনে চুলকাল লোকটা। পত্রিকা পড়ায় বাধা দেয়াতে যেন বিরক্ত হয়েছে। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘না, ওসব আজেবাজে জিনিস রাখি না আমি।’ দোকানের পেছন দিকে এগিয়ে গেল ইপু ও অঞ্জন। ‘খেলনা খোঁজার আর জায়গা পেলে না!’ পুরনো একটা খেলনা পিস্তল তুলে নিল অঞ্জন। গুলির বদলে এটা পানি ছোঁড়ে। ম্যাগাজিনে পানি ভরে ট্রিগার টিপলেই নলের মুখ দিয়ে পিচকারির মত পানি বেরোয়। ‘আমার মতে, খেলনা খোঁজার এরচেয়ে ভাল জায়গা আর পাওয়া যাবে না,’ ইপু বলল। ‘এখানে সত্যিকারের গুপ্তধন পেয়ে যেতে পারো তুমি।’ ‘কী জানি,’ হাত ওল্টাল অঞ্জন। ‘আরে, দেখো!’ একটা লাঞ্চবক্স তুলে নিল ও। একপাশে কালো মুখোশ পরা একজন ডাকাতের ছবি। হাতে লম্বা লাঠি। নিচে নাম লেখা। পড়ল ও, ‘টুক্কু ঠেঙাড়ে। এই টুক্কুটা আবার কে?’ ‘বোকা নামের ডাকাত, লাঠি দিয়ে লোকের মাথা ফাটিয়ে নিশ্চয়ই টাকা-পয়সা সব কেড়ে নিত,’ অঞ্জনের হাত থেকে লাঞ্চবক্সটা নিল ইপু। ‘ধাতুর তৈরি, প্ল্যাস্টিক না। অনেক পুরনো, হয়তো কোনও জমিদারের ছেলের ছিল। ভাবছি, আমার কাজিন এটা পছন্দ করবে কি না।’ ‘আজব উপহার,’ অঞ্জন বলল। ‘আমার কাজিনটাও আজব,’ ইপু বলল। ‘এই, দেখো এটা।’ পুরনো লাঞ্চবক্সটা রেখে বড় একটা বাক্স তুলে নিল ও। ‘ম্যাজিক সেট।’ গায়ের লেখাটা পড়ল, ‘তোমার বন্ধুদের অবাক করে দাও। একশোটা অসাধারণ ম্যাজিক দেখাতে পারবে।’ ‘বাপরে, এত ম্যাজিক,’ অঞ্জন বলল। মৃদু আলোকিত দোকানটার আরও ভেতরে ঢুকল ও। শিকল টেনে ওকে নিয়ে চলেছে নেড়ি। সারাণ শুঁকে চলেছে কী যেন। ‘হেই...’ অবাক হয়ে বলল অঞ্জন। সরু একটা দরজা। পেছনে আরেকটা অন্ধকার ঘর। প্রথমটার চেয়ে, অঞ্জন দেখল, এই ঘরটায় আলো আরও কম, আরও বেশি ধুলোয় ভরা। ভেতরে পা রেখে প্রথমে অন্ধকার সইয়ে নিল চোখে। অসংখ্য খেলনার খালি বাক্স পড়ে রয়েছে, পুরনো হতে হতে হলদে হয়ে গেছে মলাট, ক্রিকেট খেলার গ্লাভসগুলোর চামড়া এতই পুরনো, বুড়ো মানুষের মুখের মত কুঁচকানো। এ সব আবর্জনা কারা কেনে? ভাবল ও। বেরিয়ে আসতে যাবে, এ সময় চোখে পড়ল জিনিসটা। হলুদ রঙের একটা কৌটা। জেলির বয়ামের সমান। তুলে নিতে গিয়ে অবাক হলো অঞ্জন। ভীষণ ভারী। কৌটাটার আকার দেখে বোঝাই যায় না, এতটা ওজন হবে। মৃদু আলোয় চোখের সামনে এনে ওটা দেখতে লাগল ও। গায়ের লেবেলটা এখনও লাগানো রয়েছে, তবে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে লেখাগুলো। লেবেলের ওপরের দিকে বড় করে লেখা রয়েছে: ভুতুড়ে জেলি। তার নিচে, আরেকটু ছোট অরে লেখা : অনেক ধরনের খেলা খেলতে পারবে এই জেলির সাহায্যে। সাংঘাতিক তো, ভাবল ও। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল কৌটাটা। মনে পড়ল, মা ওকে একশো টাকা দিয়ে গেছেন। শার্টের পকেটেই রয়েছে সেটা। হঠাৎ ধমক শোনা গেল, ‘এই, এখানে কী করছ তোমরা?’ ফিরে তাকিয়ে দেখে অঞ্জন, দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দোকানের মালিক। কুতকুতে চোখ দুটো রাগে জ্বলছে। সাত. লোকটার কথায় চমকে গিয়ে জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল নেড়ি। শিকল ধরে টেনে কুকুরটাকে কাছে নিয়ে এল অঞ্জন। ‘ইয়ে...এই জিনিসটার দাম কত?’ কৌটাটা উঁচু করে দেখাল ও। ‘ওটা বিক্রি হবে না,’ স্বর নামিয়ে জবাব দিল মালিক। কুঁচকে রয়েছে ভুরু। ‘কেন?’ ‘বেশি পুরনো,’ লোকটা জবাব দিল। ‘হয়তো কাজ করবে না, খেলতে পারবে না ওটা দিয়ে।’ ‘ডেট চলে গেছে?’ ‘না, তা যায়নি। তবে পুরনো।’ ‘নিয়ে দেখতে পারি, কাজ করে কি না,’ অঞ্জন বলল। ‘যেহেতু পুরনো, কম দামে দিয়ে দিন না। দেবেন?’ ‘কী ওটা?’ দরজায় উঁকি দিল ইপু। ‘জানি না,’ অঞ্জন বলল। ‘লেবেলে লিখেছে ভুতুড়ে জেলি।’ লোকটার পাশ কাটিয়ে এল ইপু। অঞ্জনের হাত থেকে কৌটাটা নিল। দেখতে দেখতে বলল, ‘ওহ্, দারুণ জিনিস, আমারও একটা দরকার।’ ‘এই একটাই আছে,’ অঞ্জন বলল। ‘তাই?’ তাকগুলোতে এ ধরনের আরও কৌটা খুঁজতে শুরু করল ইপু। ‘আর নেই,’ দোকানের মালিক বলল। ‘এটা আমি নেব,’ ইপু বলল অঞ্জনকে, লোকটার কথা কানেই ঢুকছে না। ‘স্যরি,’ বলে ইপুর হাত থেকে কৌটাটা নিয়ে নিল অঞ্জন। ‘আমি এটা প্রথম দেখেছি।’ ‘আমি তোমার কাছ থেকে কিনে নেব,’ ইপু বলল। ‘দু’জনেই ভাগাভাগি করে নাও না কেন?’ দোকানের মালিক বলল। ‘তার মানে আপনি আমাদের কাছে জিনিসটা বেচবেন?’ অধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। কানের পেছনে চুলকাল। ‘আমি কিন্তু এখনও বলছি এটার ডেট এক্সপায়ার হয়ে গেছে...’ ‘কত দিতে হবে?’ জানতে চাইল অঞ্জন। ‘বিশ টাকা দিলেই চলবে,’ অঞ্জনকে বলল লোকটা। ‘তবে আবারও বলছি, এটা নিশ্চয়ই ভাল নেই। অনেক পুরনো হয়ে গেছে।’ ‘হলে হোক,’ শার্টের পকেট থেকে একশো টাকার নোটটা বের করল অঞ্জন। ‘কাজ না হলে ফেরত আনতে পারবে না কিন্তু,’ গোমড়ামুখে বলল দোকানের মালিক। ‘আনলে নেব না।’ দোকানের সামনের ক্যাশ কাউন্টারের দিকে রওনা হলো লোকটা। কয়েক মিনিট পর, হাতে হলুদ রঙের কৌটাটা নিয়ে উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে এল অঞ্জন। ধুলোয় ভরা অন্ধকার জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরে খুশি। গম্ভীর মুখে পেছনে বেরোল ইপু। ‘কী, লাঞ্চবক্সটা কিনলে না?’ অঞ্জন জিজ্ঞেস করল। ‘আমাকে ভোলানোর চেষ্টা কোরো না,’ খড়খড় করে উঠল ইপু। ‘শোনো, এটার জন্য আমি ৫০ টাকা দিতে রাজি আছি।’ ভুতুড়ে জেলির কৌটাটার দিকে হাত বাড়াল ও। সরিয়ে নিল অঞ্জন। ‘কোন কিছু পছন্দ হলে সেটা না নিয়ে তোমার শান্তি নেই!’ ‘দাঁড়াও, একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়,’ কাত করে রাখা সাইকেলটা টান দিয়ে সোজা করল ইপু। ‘চলো, জিনিসটা নিয়ে ভাগাভাগি করে খেলি আমরা।’ ‘না,’ মাথা নাড়ল অঞ্জন। ‘তুমি তোমার সাইকেলটায় হাত ছোঁয়াতেও দাওনি আমাকে।’ ‘সাইকেলে চড়ে বাড়ি যেতে চাও? এই নাও।’ সাইকেলটা অঞ্জনের দিকে ঠেলে দিল ইপু। ‘উঁহুঁ,’ ধরল না অঞ্জন। ‘তোমার ওই বোকা সাইকেলে এখন আর আমি চড়তে চাই না।’ ‘সাইকেল বোকা হয় কী করে?’ প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল অঞ্জন। নেড়ির শিকল ধরে টানল। হেঁটে চলল ফুটপাথ দিয়ে। ‘সাইকেল বোকা হয় কী করে?’ নাছোড়বান্দা ইপু। সাইকেল ঠেলে নিয়ে অঞ্জনের পাশে হাঁটছে। ‘নাহ্, তুমি ছাড়বে না,’ হাল ছেড়ে দিল অঞ্জন। ‘বেশ, বাড়ি চলো। কিছুণের জন্য খেলতে দেব তোমাকে।’ ‘দেবে! সত্যি? তোমার মনটা খুব উদার, সত্যি, অঞ্জন।’ হাসল অঞ্জন। ইপুকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। দাদুর কণ্ঠ কানে এল। উত্তেজিত স্বরে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। বসার ঘরে ঢুকল অঞ্জন। ঘরে দাদু ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। শুধু কুসি বসে আছে। আর কোন মানুষ নেই, তাহলে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি? অঞ্জনদেরকে দেখে লাফিয়ে উঠে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কালো বিড়ালটা। ইপুকে দেখে ভুরু কোঁচকালেন দাদু। ‘দাদু, ও ইপু,’ নতুন বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিল অঞ্জন। ভুলে গেল দাদু কানে শোনেন না। ‘ওটা কী?’ ভুতুড়ে জেলির কৌটাটার দিকে আঙুল তুললেন দাদু। ‘দেখি?’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদুর হাতে কৌটাটা দিল অঞ্জন। ভুরু কুঁচকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন দাদু। লেবেলটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছেন। এইটুকু লেখা পড়তে কি এতণ লাগে? অবাক হলো অঞ্জন। অবশেষে কৌটাটা অঞ্জনকে ফিরিয়ে দিলেন তিনি। নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে অঞ্জন, হঠাৎ ফিসফিস করে দাদু বললেন, ‘সাবধানে থেকো।’ ফিরে তাকাল অঞ্জন। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন দাদু। কথাটা কি সত্যি শুনেছে ও? নাকি ওর কল্পনা। চিন্তিত ভঙ্গিতে দরজার দিকে ঘুরল ও। দেখে, দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে কুসি। হলুদ চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ‘আমার দাদু কানে শোনেন না,’ সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় ইপুকে বলল অঞ্জন। অঞ্জনের ঘরে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল একবার ইপু। তারপর জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে জানালা দিয়ে তাকাল বাইরে। ‘সময় কাটাবে কী করে?’ ‘সেই দুশ্চিন্তাটা তো আমারও,’ অঞ্জন বলল। তাকের বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ইপু, ‘এত ম্যাজিকের বই কেন এখানে? এগুলো দিয়ে কী করেন তোমার দাদু?’ তাক থেকে পুরনো, মোটা একটা বই টেনে নামাল ইপু। ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝাড়ল। ‘দেখো আবার, জাদু করে তোমাকে না আবার নিউট বানিয়ে ফেলেন।’ ‘নিউট কী?’ ‘এক ধরনের গিরগিটি।’ পুরনো বইটার হলদে হয়ে আসা পাতাগুলো ওল্টাল ও। ‘তুমি বলেছিলে, এখানে নাকি কিছুই করার নেই তোমার। এত বই, পড়েই তো সময় কাটাতে পারো।’ ‘দেখছ না কী সব বই, এগুলো পড়তে ভাল লাগে নাকি?’ ঠোঁট ওল্টাল অঞ্জন। বইটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিয়ে ডেস্কের কাছে এসে দাঁড়াল ইপু। ওর চোখ ভুতুড়ে জেলির কৌটাটার দিকে। ‘খোলো ওটা। এত পুরনো হয়েছেÑহয়তো দোকানদারের কথাই ঠিকÑভেতরের জিনিস হয়তো সত্যিই নষ্ট হয়ে গেছে।’ ‘আমারও তাই মনে হয়,’ কৌটাটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগল অঞ্জন। মুখটা ধরে টান দিল অঞ্জন। খুলল না ওটা। ‘টিন খোলার যন্ত্র দিয়ে খুলতে হবে হয়তো,’ ইপু বলল। ‘যন্ত্র পাবো কোথায়?’ আবার লেবেলটার দিকে তাকাল অঞ্জন। ‘এই যে, দেখো, কোন নির্দেশনা দেয়নি। ভেতরে কী আছে, তা-ও লেখা নেই। কী করে বুঝব, এটা দিয়ে কিভাবে খেলতে হয়?’ ‘ভুতুড়ে জেলিÑলিখেই তো দিয়েছে, আর কিছু লেখার দরকার আছে কি?’ সিনেমার ভ্যাম্পায়ারের মতো বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠল ইপু। থাবা দিয়ে অঞ্জনের গলা চেপে ধরল। দম বন্ধ করে ওকে মেরে ফেলার ভঙ্গি করল। হেসে উঠল অঞ্জন। ‘ছাড়ো। নাহ্, তুমি কোন বুদ্ধি দিতে পারলে না।’ আছাড় দিয়ে কৌটাটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘এই খেলনাটা দিয়ে কী করে খেলতে হয়...’ কথা শেষ হলো না ওর। আচমকা ‘ফুট’ করে খুলে গেল কৌটার ঢাকনা। ‘আরে, দেখো!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ওর গলা থেকে হাত সরিয়ে আনল ইপু। কৌটার ভেতর কী আছে দেখার জন্য মাথা নামিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। আট. ভেতরের জিনিসটা উজ্জ্বল হলুদ, জেলির মতো থকথকে। ছাদ থেকে ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক আলোয় চকচক করছে। ‘ছুঁয়ে দেখো,’ ইপু বলল। তবে অঞ্জন ছুঁয়ে দেখার আগেই কৌটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল ও। ‘ওরে বাবা, কী ঠাণ্ডা। ছুঁয়ে দেখো। ভীষণ ঠাণ্ডা।’ ভেতরে আঙুল ঢোকাল অঞ্জন। খুব ঠাণ্ডা। আর জেলির চেয়ে ঘন। অনেক বেশি ভারী। আঠাল জিনিসটার ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দিল অঞ্জন। বের করে আনতে গিয়ে দেখে, বেরোচ্ছে না। জোরে টান দিতে হটাৎ করে শব্দ তুলে বেরিয়ে এল। ‘আশ্চর্য,’ ইপু বলল। ‘এর চেয়ে খারাপ জিনিস দেখেছি আমি,’ অঞ্জন বলল। ‘আমার ধারণা অন্ধকারে জ্বলে এটা,’ বলে প্রায় ছুটে গিয়ে গিয়ে দরজার পাশের সুইচবোর্ডের কাছে দাঁড়াল ইপু। ‘ফসফরাসের মতো।’ সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল ও। কিন্তু ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। পর্দা ভেদ করে আসছে বিকেলের রোদের আলো। ‘আলমারিতে ঢুকে দেখা যেতে পারে,’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ইপু। কৌটাটা হাতে নিয়ে আলমারির দিকে এগোল অঞ্জন। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ইপুও ঢুকে দাঁড়াল ওর পাশে। দরজাটা লাগিয়ে দিল। ‘এহ্, ন্যাপথলিনের গন্ধে দম আটকে আসছে।’ তবে অন্ধকারে সত্যিই জ্বলে ভুতুড়ে জেলি। কৌটার ভেতর থেকে গোল হলুদ আলোর আভা বেরোচ্ছে। ‘অদ্ভুত, আসলেই অদ্ভুত,’ ইপু বলল। ন্যাপথলিনের তীব্র গন্ধ এড়াতে দুই আঙুলে নাক টিপে ধরে রেখেছে। ‘দুর,’ কিছুটা হতাশ হয়েই বলল অঞ্জন, ‘আমি অন্য কিছু আশা করেছিলাম।’ ‘কী, ভুতুড়ে কিছু?’ ‘ভুতুড়ে কি না জানি না, তবে অন্য কিছু।’ ‘বেশ, তোমার রাখতে ইচ্ছে না করলে আমি নিয়ে যাই,’ ইপু জবাব দিল। ‘আমি রাখব না, তা তো বলিনি,’ তাড়াতাড়ি বলল অঞ্জন। ‘চলো বেরোই এখান থেকে,’ ইপু বলল। ‘উফ্, মারা গেলাম!’ পাল্লাটা ঠেলে খুলল অঞ্জন। আলমারি থেকে বেরোল দু’জনে। দরজাটা আবার লাগিয়ে দিল অঞ্জন। কয়েক সেকেন্ড কোন কথা না বলে তাজা বাতাসে দম নিল। কৌটাটা অঞ্জনের হাত থেকে নিয়ে আবার ভেতরে হাত ঢোকাল ইপু। এক খাবলা থকথকে পদার্থ তুলে আনল খামচি দিয়ে। হাতের তালুতে রেখে মুঠো বন্ধ করে চাপ দিল। ‘কৌটার বাইরে আনলে ভেতরের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা লাগে,’ অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল ও। ‘দেখো, চাপ দিয়ে চ্যাপ্টা করে ফেললেও ছেড়ে দিলেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।’ ‘হ্যাঁ, একেবারেই বাচ্চাদের খেলনা,’ জিনিসটা খুব একটা আনন্দ দিচ্ছে না অঞ্জনকে। ‘আছাড় দাও। দেখো, রবারের মত লাফায় কি না।’ হাতের জিনিসটাকে বলের মত গোল করে ওপর থেকে মাটিতে ছেড়ে দিল ইপু। লাফিয়ে উঠল ওটা, আবার ওর হাতে এসে পড়ল। আরেকটু জোরে আছাড় দিল ও। তেরছা ভঙ্গিতে লাফিয়ে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে দরজা দিয়ে ভেতরের বারান্দায় বেরিয়ে গেল ভুতুড়ে জেলির বলটা। ‘সত্যিই খুব ভাল লাফায়, বলের চেয়ে বেশি।’ বারান্দা থেকে বলটা নিয়ে এল ইপু। ‘এবার দেখি, টানলে কতটা লম্বা হয়।’ দুই হাতে ধরে টানতে শুরু করল ও। লম্বা দড়ির মত হয়ে গেল। ‘বাপরে! লম্বাও তো হয় অনেক। ছেঁড়ে না।’ ‘হুঁ,’ এবারও খুশি হলো না অঞ্জন। ‘বললামই তো একেবারে বাচ্চাদের খেলনা। নাম দেখে আমি ভেবেছিলাম এ জিনিসটা দিয়ে এমন কিছু করা যাবে, যা দেখে সত্যিই অবাক হবার মতো।’ ‘দেখো, একই রকম ঠাণ্ডা থাকছে এটা, একটুও গরম হচ্ছে না, হাতের উত্তাপেও না,’ ইপু বলল। দেয়ালের দিকে চোখ পড়ল ওর। গোল একটা হলুদ দাগ পড়েছে কাঠের দেয়ালে, যেখানে বাড়ি খেয়েছিল বলটা। ‘ও, দাগও তো পড়ে দেখা যাচ্ছে।’ ‘নেড়ির ভাল লাগবে,’ অঞ্জন বলল। ‘বাইরে চলো। ওর সঙ্গে গিয়ে খেলা যাক। একা থেকে আর কষ্ট পাবে না বেচারা।’ ‘চলো,’ ইপু রাজি। যেটুকু ভুতুড়ে জেলি কৌটা থেকে বের করেছিল, সেটা আবার ভরে রাখল ইপু। তারপর নিচতলায় নেমে, পেছনের আঙিনায় বেরিয়ে এল দু’জনে। উল্লসিত ভঙ্গিতে এমন শুরু করল নেড়ি, যেন কতকাল ওদের দেখে না। কৌটা থেকে আবার এক খাবলা ভুতুড়ে জেলি বের করল ইপু। বাকিটুকু বের করে নিল অঞ্জন। সেগুলো দিয়ে দু’জনে দুটো বল বানাল। ‘একেবারেই আকৃতি বদলাচ্ছে না, আশ্চর্য,’ হলুদ বলটাকে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে লুফে নিল ইপু। ‘যেমন বানাচ্ছি, ঠিক তেমনই থেকে যাচ্ছে।’ অঞ্জনও ওর বলটা ওপর দিকে ছুড়ে দিল। এক হাত দিয়ে বিকেলের রোদ আড়াল করে আরেক হাতে লুফে নিল বলটা।’ বাহাদুরি দেখানোর জন্য অঞ্জনের চেয়ে আরও ওপরে ছুড়ল ইপু। কিন্তু ধরতে পারল না। ওর বাড়ানো হাতের কিনার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘দুর!’ মাটিতে পড়ে ড্রপ খেল বলটা, একবার, দুবার, গিয়ে পড়ল নেড়ির সামনে। চমকে গিয়ে প্রথমে লাফিয়ে উঠল নেড়ি, তারপর নাক নামিয়ে বল শুঁকতে লাগল। ‘না না নেড়ি!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ‘থাক, থাক!’ কিন্তু চির অবাধ্য নেড়ি ওর কথা শুনল না, মাথা নামিয়ে হলুদ বলটা চাটতে শুরু করল। ‘না না, রাখ, রাখ!’ শঙ্কিত হলো অঞ্জন। ঝাঁপ দিল কুকুরটাকে ল্য করে। কিন্তু দেরি করে ফেলল। বলটাকে দাঁতে কামড়ে তুলে নিল নেড়ি। চিবাতে শুরু করল। ‘না, নেড়ি, না!’ চিৎকার করে বলল অঞ্জন। ‘গিলিসনে! গিলিসনে!’ গিলে ফেলল নেড়ি। ‘সর্বনাশ!’ ককিয়ে উঠল ইপু। দুই হাত মুঠো করে কিল মারল নিজের গায়েই। ‘অর্ধেকটা জেলিই খেয়ে ফেলেছে। এখন খেলব কী দিয়ে!’ কিন্তু খেলা নিয়ে মাথাব্যথা নেই অঞ্জনের। নেড়ির দুই চোয়াল চেপে ধরে টান দিয়ে হাঁ করাল। কুকুরটার মুখের ভেতর দেখল। নেই হলুদ গোল্লাটা। গিলে ফেলেছে। ‘হাঁদা কুত্তা!’ কুকুরটার মুখ ছেড়ে দিল অঞ্জন। ‘এত্তবড় পাজি...উফ্!’ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর মুখ। জিনিসটায় কী আছে কে জানে। বিষাক্ত কোনো রাসায়নিক থাকলে কুকুরটা অসুস্থ হয়ে পড়তে পড়ে? এমনকি, মারাও যেতে পারে! নয়. ‘আজ বড়া বানাবেন?’ কাগজে লিখে দাদুর দিকে বাড়িয়ে ধরল অঞ্জন। নিজের ঘরের ডেস্কে পাওয়া একটা পুরনো প্যাড থেকে ছিঁড়ে নিয়েছে। চুল ঠিক করতে করতে কাগজটার দিকে তাকালেন দাদু। রান্নাঘরে জানালা দিয়ে আসা সকালের রোদের আলোয় ময়দার মত সাদা লাগছে তাঁর মুখটা। ‘বড়া? কিসের বড়া?’ শীতল কণ্ঠে বললেন তিনি। অবাক হলো অঞ্জন। গোশতের বড়া বানিয়ে খাওয়ানোর কথা তিনিই তো বলেছিলেন। তবে এখন আর মনে করিয়ে দিল না। ‘যাও, তোমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করোগে,’ শীতল কণ্ঠেই বললেন তিনি। ঘরেই ছিল কালো বিড়ালটা, হেঁটে এল খাবার টেবিলের কাছে। সেটার মাথা চাপড়ে আদর করলেন তিনি। ‘আমার মত একটা বুড়ি ডাইনির সঙ্গে থাকার কোন দরকার নেই তোমার।’ তিন দিন হলো এ বাড়িতে এসেছে অঞ্জন। দাদুর সঙ্গে আন্তরিক হওয়ার বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে যত চেষ্টা করে, দাদু তত বেশি শীতল হন। নাহ্, মহিলাটা ভালো নাÑকুটিলই, ভাবল অঞ্জনÑভীষণ কুটিল। নাস্তা খাচ্ছে ও। দুধে ভেজানো খই। শেষ চামচটুকু মুখে পুরে বাটিটা ঠেলে দিল। প্রতিদিন এই এক খাবার দিয়েই নাস্তা খেতে হচ্ছে। আর যেন কিছু নেই। গিলতে গিলতে আর ভালো লাগে না, প্রচণ্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে। তা-ও যদি দুধের সঙ্গে চিনি থাকত। চিনি নিতে দেন না দাদু, যেন খাবারটাকে যতটা সম্ভব বিস্বাদ করার জন্যই। জানালার বাইরের উজ্জ্বল রোদের দিকে তাকাল অঞ্জন। মুখ ফেরাল দাদুর দিকে। রান্নাঘরের ছোট্ট টেবিলটার অন্য পাশে ওর মুখোমুখি বসেছেন তিনি। চা খাচ্ছেন। কালো কড়া চা। বিশ্রী শব্দ করে টান দিয়ে মুখের ভেতর নিচ্ছেন তেতো জিনিসটা। এই প্রথম তাঁর গলার লকেটটা চোখে পড়ল ওর। মাখন রঙা, দেখতে মানুষের বাহুর হাড়ের মত। মানুষের হাড় দিয়েই বানায়নি তো? তীè দৃষ্টিতে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল অঞ্জন, ওটা নকল, না আসল হাড়। ওর দৃষ্টি ল্য করে তাড়াতাড়ি লকেটটা ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন দাদু। ‘বসে আছো কেন এখনও? যাও, বাইরে গিয়ে তোমার বন্ধুর সঙ্গে খেলা করোগে,’ কঠিন স্বরে বললেন তিনি। লম্বা চুমুক দিয়ে শেষবারের মতো দাঁতের বিশ্রী শব্দ তুলে কাপের চাটুকু গিলে নিলেন। হ্যাঁ, যাচ্ছি, ভাবল অঞ্জন, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়াই ভালো। চেয়ারটা পেছনে ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। এঁটো বাটিটা নিয়ে এল সিংকের কাছে। নাহ্, এই অবস্থা আর বেশি দিন সহ্য করতে পারব না, ভীষণ মন খারাপ লাগছে অঞ্জনের। বুড়িটা আমাকে দেখতে পারে না। ঘৃণা করে। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিজের ঘরে উঠে এল ও। চুল আঁচড়াল। মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে গত রাতে, সেটার কথা ভাবল। মা-ই টেলিফোন করেছিলেন। ‘কী অবস্থা, মা?’ জিজ্ঞেস করেছে অঞ্জন। মার গলা শুনতে খুব ভাল লেগেছে, যদিও যন্ত্রের মাধ্যমে। ‘ভালই,’ বলতে গিয়ে কিছুটা দ্বিধা করেছেন মা। ‘ভালই মানে? বাবা কেমন আছে? বাসা পেয়েছ?’ ‘আমরা ভালই আছি,’ কান্ত মনে হচ্ছিল মার কণ্ঠ। ‘কিন্তু ঢাকায় বাসা পাওয়া যে এত কঠিন হয়ে গেছে, ভাবিনি। পছন্দসই বাসা পাই না, হয় অস্বাভাবিক ভাড়া, নয়তো অন্যান্য অসুবিধে। একটা বাসা সব দিক থেকে পছন্দও হয়েছে, ভাড়াও সাধ্যের মধ্যে, কিন্তু কাছাকাছি যে স্কুলটা আছে, সেটা ভালো নয়।’ ‘অসুবিধে নেই। অত ভাল স্কুলে না-ই বা পড়লাম,’ অঞ্জন বলেছে। ওর এখন ভাল বাসা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। এ সময় বাবার কণ্ঠস্বর কানে এসেছে, তবে কী বলছেন বোঝা যায়নি। ‘আমাকে কবে নিতে আসবে, মা?’ অঞ্জন জিজ্ঞেস করেছে। জবাব দিতে কিছুটা সময় নিলেন মা। ‘বাসার সমস্যাটা মিটে গেলেই আসব। যা ভেবেছিলাম, তারচেয়ে দু’চার দিন হয়তো বেশি সময় লাগবে। তোমার কী অবস্থা, অঞ্জন? ভাল আছো?’ আরও বেশ কিছুদিন কুমিল্লায় থাকতে হবে, এই খারাপ খবরটা শুনে অঞ্জনের মনে হচ্ছিল চিৎকার করে কাঁদে, দেয়ালে লাথি মেরে পা ফাটিয়ে ফেলে। কিন্তু এমনিতেই মার মন ভাল না, তাঁর কষ্ট বাড়াতে চাইল না। বলল, ও ভালই আছে, একজন নতুন বন্ধু জোগাড় করেছে। মার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে তখন বাবা কথা বলেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। তারপর বলেছেন, ‘থাকো ওখানে, অসুবিধে হবে না।’ আছিই তো। অসুবিধে যে কতটা হচ্ছে সেটা আর তোমরা বুঝবে কী, বিষণœ হয়ে গিয়েছিল অঞ্জন। বাবা-মার কণ্ঠ শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওর, বাড়ি যাবার জন্য। তারপর আজ সকালে দাদুর এই আচরণ। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চিরুনিটা রেখে দিল অঞ্জন। ড্রেসারের আয়নায় নিজেকে দেখল। লাল খোপ খোপ একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে। পরনে কালো প্যান্ট। নিচে নেমে, রান্নাঘর দিয়ে তাড়াহুড়া করে বাইরে বেরোনোর সময় দেখল, কুসির সঙ্গে কথা বলছেন দাদু, কোন কিছু নিয়ে ভীষণ তর্ক করছেন যেন। এটা নতুন কিছু নয়। ছুটে বেরিয়ে এল পেছনের দরজা দিয়ে। ডাকতে ডাকতে কুকুরের খোঁয়াড়টার দিকে ছুটল, ‘নেড়ি! এই নেড়ি!’ কিন্তু সাড়া দিল না কুকুরটা। খোঁয়াড়ের মাঝখানে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। মৃদু নাক ডাকছে। ‘এই, ইপুদের বাড়ি যাবি?’ জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। নড়ে উঠল নেড়ি। কিন্তু চোখ মেলল না। ‘ঠিক আছে, তুই ঘুমো।’ কুকুরটার গামলাটা দেখল অঞ্জন, পানি আছে কি না। ভরে দিল। তারপর পা বাড়াল গেটের দিকে। * ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছে ও। বাবা-মার কথা ভাবছে। এ সময় ডাক শুনল, ‘এই...এই!’ সামনে এসে দাঁড়াল দুটো ছেলে। ওর পথরোধ করে দাঁড়াল। চমকে গিয়ে ছেলে দুটোর দিকে তাকাতে লাগল অঞ্জন। একবার এর মুখের দিকে, একবার ওর মুখের দিকে। ছেলে দুটো যমজ। অবিকল এক চেহারা। দুজনেই বিশালদেহী, মাংসল শরীর, খাটো করে ছাঁটা চুল, গোলগাল মুখ। দু’জনের পরনেই গেঞ্জি। বুকের কাছে একটা ব্যান্ড দলের নাম ছাপ মারা। পরনে ঢোলা প্যান্ট, পায়ে জুতো, ফিতে বাঁধেনি, মোজাও পরেনি। দু’জনেরই বয়স চৌদ্দ-পনেরো হবে, অনুমান করল অঞ্জন। ‘কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করল একজন। চোখের পাতা সরু করে তাকাল। ছেলে দুটোকে ভাল লাগল না অঞ্জনের। পিছিয়ে গেল। ‘আমি...আমি আমার দাদুর বাড়িতে এসেছি।’ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল দুই ভাই। কুটিল হাসি। ‘এখান দিয়ে তুমি হাঁটতে পারবে না,’ অঞ্জনের প্রায় গায়ের ওপর উঠে এল একজন। ‘হ্যাঁ। তুমি এখানকার বাসিন্দা নও,’ সুর মেলাল আরেকজন। ‘সরকারি রাস্তায় হাঁটতে আবার বাসিন্দা হওয়া লাগে নাকি?’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল অঞ্জনের। বলেই বুঝল, ভুল করে ফেলেছে। আশপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কি না, ওকে সাহায্য করার মত। ছেলে দুটোর ভাবভঙ্গি ভাল না। গায়েও হাত তুলতে পারে। কিন্তু কাউকে নজরে পড়ল না। সমস্ত বাড়িগুলোর সামনের দরজা বন্ধ। আঙিনাগুলো নির্জন। দূরের রাস্তা দিয়ে একজন লোককে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখল। চেঁচিয়ে ডাকলেও লোকটার কানে যাবে না। আর কেউ নেই আশপাশে। কেউ ওকে সাহায্য করতে আসবে না। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে অঞ্জন। ছেলে দুটোর চোখে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অঞ্জনের দিকে। দশ. ‘কোথায় যাচ্ছিলে?’ জিজ্ঞেস করল একজন। এক হাতের আঙুল মুঠো পাকিয়ে ফেলেছে। অঞ্জনের একেবারে গায়ের ওপর এসে দাঁড়াল, ইঞ্চি দুয়েক দূরে। আরও কয়েক পা পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল ওকে। ‘একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে,’ অঞ্জন জবাব দিল। ভাবছে, হয়তো মিথ্যেই ভয় দেখাচ্ছে ওকে ছেলে দুটো, কোন তি করবে না। ‘যাওয়া যাবে না,’ বলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল ছেলেটা। দেঁতো হাসি হেসে দু’জনেই আবার অঞ্জনের দিকে এগোল। মোড়ের কাছে চলে আসতে বাধ্য করল। ‘তুমি এখানকার বাসিন্দা নও,’ একই কথা বলল আবার এক ভাই। চোখের পাতা সরু করে নিজেকে ভয়ঙ্কর বোঝাতে চাইল। ‘এই, আমাকে যেতে দাও,’ অঞ্জন বলল। সরে গিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে হাঁটার চেষ্টা করল অঞ্জন। কিন্তু কিছুতেই ওকে যেতে দিল না দুই ভাই। ‘রাস্তার ভাড়া দিলে হয়তো ছাড়া যেতে পারে,’ একজন বলল। ‘হ্যাঁ,’ দ্রুত সুর মেলাল অন্যজন। ‘এই এলাকায় যারা থাকে না, তাদের রাস্তা ব্যবহার করতে ভাড়া লাগে।’ ‘আমার কাছে টাকা নেই,’ বলল অঞ্জন। তারপর মনে পড়ল পকেটে আশি টাকা রয়েছে। টাকাটা কি ওরা কেড়ে নেবে? হ্যাঁ, নেবে। প্রথমে ধরে পেটাবে, তারপর কেড়ে নেবে। ভাবল অঞ্জন। ‘ভাড়া দিতে হবে,’ খিকখিক করে হাসল একজন। ‘দেখি, তোমার কাছে কী আছে?’ সামনে এসে ওকে ধরার জন্য হাত বাড়াল দুই ভাই। পিছিয়ে গেল অঞ্জন। ভয় ওর পা ভারী করে ফেলেছে। হঠাৎ রাস্তার আরেক মোড় থেকে চিৎকার শোনা গেল, ‘এই, কী করছ?’ ছেলে দুটোর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল অঞ্জন, ইপুকে ছুটে আসতে দেখল সাইকেলে চেপে। ডাকল, ‘অঞ্জন!’ মুখ ফিরিয়ে তাকাল দুই যমজ। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল একজন। আরেকজন মুখ বাঁকাল। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দুই পা রাস্তায় নামিয়ে দিল ইপু। পরনে নীল রঙের প্যান্ট, গায়ে হলুদ শার্ট। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে আসায় মুখ লাল হয়ে গেছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখে বনবিড়ালের হিংস্র দৃষ্টি নিয়ে দুই ভাইয়ের দিকে তাকাল ইপু।। অঞ্জনের দিকে ফিরে বলল, ‘হারু-তরু কিছু কেড়ে নিতে চাইছে নাকি তোমার কাছ থেকে?’ ‘ইয়ে...’ দ্বিধা করছে অঞ্জন। ‘ওকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলাম আমরা,’ তরু বলল। হাসল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। ‘আমাদের এখানে আসাতে,’ ভাইয়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যোগ করল হারু। কিছু বলতে যাচ্ছিল হারু, কিন্তু বাধা দিল ইপু। ‘থাক, আর অভিনন্দন জানাতে হবে না। ওকে তোমরা কিছু করবে না বলে দিলাম।’ ‘তোমার কথায়?’ খিকখিক করে হাসল হারু। ‘ঠিক আছে, কিছু করব না,’ ইপুর দিকে এগোল তরু। ‘তবে তোমার সাইকেলটা আমাদের ধার দিতে হবে।’ ‘খবরদার, ধরবে না বলে দিলাম,’ ঝাঁঝিয়ে উঠল ইপু। থাবা দিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলের এক মাথা চেপে ধরল তরু। ‘না না, খবরদার!’ চেঁচিয়ে উঠে হ্যান্ডেলটা টেনে সরানোর চেষ্টা করল ইপু। তরু হ্যান্ডেলটা ছাড়ল না। হারু জোরে এক ধাক্কা মারল ইপুকে। উল্টে পড়ে গেল ইপু। টান লেগে হ্যান্ডেল ছুটে গেল তরুর হাত থেকে। সাইকেলটা পড়ল ইপুর গায়ের ওপর। কংক্রিটের রাস্তায় মাথা ঠুকে যাওয়ায় ‘আহ্!’ করে উঠল ইপু। দুই হাত দিয়ে বাতাসে খামচি মেরে যেন কিছু ধরার চেষ্টা করতে লাগল। সাইকেলটা পড়েই আছে গায়ের ওপর। ও উঠে দাঁড়ানোর আগেই নিচু হয়ে হ্যান্ডেল চেপে ধরে টান দিয়ে তুলে নিল হারু। পা ঘুরিয়ে সিটের ওপর বসে প্যাডলে চাপ দিল। ‘এই দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমাকে নিয়ে যাও!’ সাইকেলের পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে হেসে বলল ওর ভাই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রাস্তার মোড় ঘুরে ইপুর বাইকটা নিয়ে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল দুই ভাই। ‘ইপু,’ ওর পাশে গিয়ে বসল অঞ্জন। ‘তোমার কিছু হয়নি তো?’ ইপুর হাত ধরে ওকে টেনে তুলল অঞ্জন। উঠে দাঁড়িয়ে মাথার পেছনটা ডলতে ডলতে ইপু বলল, ‘ওই শয়তান দুটোকে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না!’ কাপড় থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলে আবার হাত দিল মাথার পেছনে। ‘উহ্! ব্যথা করছে।’ ‘ওরা কে?’ অঞ্জন জিজ্ঞেস করল। ‘হারু-তরু, যমজ ভাই,’ মুখ বিকৃত করে জবাব দিল ইপু। ‘শয়তানের হাড্ডি।’ পায়ে হাত বুলিয়ে দেখল কোথাও কেটেছে কি না। শুধু আঁচড় লেগেছে। ‘নিজেদের বিরাট কিছু ভাবে ওরা। আসলে তো কেউ দেখতে পারে না।’ ‘তোমার সাইকেলটার কী হবে?’ শান্তকণ্ঠে বলল ইপু, ‘ওটা ফেরত পাব। এরকম কাণ্ড আগেও করেছে ওরা। চালিয়ে-টালিয়ে শখ মিটে গেলে কোথাও ফেলে রেখে যাবে।’ ‘কিন্তু ওদের বাড়িতে...’ ‘বিচার দিতে যাবে তো?’ বাধা দিয়ে বলল ইপু, ‘কোন লাভ নেই। একেবারেই বুনো ওরা। দেখার কেউ নেই। নানীর বাড়িতে থাকে, কিন্তু ওই নানীকেও কখনই বাড়িতে থাকতে দেখি না। তোমাকে বিরক্ত করছিল নাকি?’ মাথা ঝাঁকাল অঞ্জন। রসিকতা করে বলল, ‘মেজাজ এত খারাপ করে দিচ্ছিল, আরেকটু হলেই পেটানো শুরু করতাম।’ হাসল না ইপু। ‘তবে আমি ওদের পেটাতে পারলে খুশি হতাম,’ রাগ করে বলল ও। ‘তবে শায়েস্তা আমি করব, কোন একদিন। এখানকার সমস্ত ছেলেকে জ্বালিয়ে মারে ওরা। কেউ ভয়ে মুখ খোলে না। ওদের ধারণা হয়ে গেছে, যা ইচ্ছে তাই করতে পারে ওরা।’ ‘তোমার হাঁটু কেটে গেছে,’ অঞ্জন বলল। ‘বাড়ি গিয়ে পরিষ্কার করে স্যাভলন লাগানো দরকার,’ চোখ ঘুরিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলল ইপু। ‘পরে দেখা করব তোমার সঙ্গে, ঠিক আছে? আজ আর হবে না, বিকেলে একখানে যেতে হবে আমাকে। হয়তো কাল দেখা করতে পারব।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল ও, মাথার পেছনটা ডলতে ডলতে। অঞ্জনও দাদুর বাড়ির দিকে ফিরে চলল। আস্তে আস্তে হাঁটছে। হারু-তরুর কথা ভাবছে, কল্পনায় মারামারি করছে ওদের সঙ্গে, পিটিয়ে ভর্তা বানাচ্ছে, ইপু হয়েছে দর্শক, চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে ওকে। বাড়ি ফিরে দেখল, সামনের ঘরের ধুলো ঝাড়ছেন দাদু। ফিরেও তাকালেন না ওর দিকে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে উঠে চলে এল অঞ্জন। এখন আমি কী করব? পায়চারি করতে করতে ভাবছে ও। চোখ পড়ল ভুতুড়ে জেলির কৌটাটার ওপর। বুক শেলফে মাঝখানের তাকে রেখেছে। হেঁটে তাকের কাছে গিয়ে কৌটাটা তুলে নিল। ঢাকনা খুলল। কৌটাটা প্রায় ভর্তি। তার মানে নেড়ি খুব বেশি খায়নি, ভেবে, কিছুটা স্বস্তি বোধ করল ও। নেড়ি! ওর কথা ভুলেই গিয়েছিল। বেচারা কুকুরটার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। ভুতুড়ে জেলির কৌটাটা নামিয়ে রেখে, ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল অঞ্জন। রেলিং ধরে একেক লাফে তিনটে করে ধাপ ডিঙিয়ে নেমে এল নিচে। সামান্যতম গতি না কমিয়ে, রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে যেন উড়ে এসে পড়ল পেছনের আঙিনায়। ‘নেড়ি! এই নেড়ি!’ চেঁচিয়ে ডাকল। আঙিনার অর্ধেকটা পেরিয়ে এসে ওর মনে হলো কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ফুলে গেছে কুকুরটার চোখ দুটো। মুখ হাঁ করে রেখেছে। লম্বা জিভটা দুলছে এপাশ ওপাশ। গালের কষার লোম বেয়ে সাদা লালা গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। ‘নেড়ি!’ ঘন ঘন দম নিচ্ছে কুকুরটা, খসখসে শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে, কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে নেড়ি! খোঁয়াড়টার কাছে যখন পৌঁছল অঞ্জন, চোখ উল্টে দিয়েছে নেড়ি। হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেল। শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে উঁচু-নিচু হচ্ছে পেটটা। ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে। এগারো. ‘নেড়ি, কী হয়েছে তোর!’ হাঁটু গেড়ে কুকুরটার পাশে বসে পড়ল অঞ্জন। গলার কলার ধরে টান দিতে গিয়ে ল করল, আঙুল ঢুকছে না। গলা আর বেল্টের মাঝখানের ফাঁক বন্ধ হয়ে গেছে। গলায় আঁটো হয়ে চেপে বসেছে বেল্টটা। ফুলে উঠল কুকুরটার বুক। ঝাঁকি খেল। খোলা মুখ দিয়ে এক খাবলা লালা গড়িয়ে পড়ল। ‘চুপ কর, নেড়ি, শান্ত হয়ে থাক!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। পাগলের মতো চোখ ঘোরাচ্ছে নেড়ি। অঞ্জনকে যেন দেখছে না, ওর কথাও শুনতে পাচ্ছে না। ‘শান্ত হ, নেড়ি, শান্ত হ।’ কলারে জোর করে আঙুল ঢুকিয়ে টান দিল অঞ্জন। গলায় প্রায় কেটে বসে গেছে চামড়ার বেল্টটা। হাত কাঁপছে অঞ্জনের। বেল্টটাকে টেনে কুকুরটার মাথার ওপর দিয়ে খুলে আনার চেষ্টা করছে। খোল, খোল, খুলে আয়, বারবার বলছে অঞ্জন। হ্যাঁ! হয়েছে। অবশেষে কলারটা খুলে আনল অঞ্জন। যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে উঠল একবার কুকুরটা। ‘নেড়ি, খুলে গেছে! আর ভয় নেই!’ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কুকুরটা। এখনও জোরে জোরে হাফাচ্ছে। প্রায় মরতে মরতে বেঁচেছে নেড়ি, অঞ্জন আসতে আরেকটু দেরি করলেই... কী ঘটত, সেটা আর ভাবতে চাইল না ও। অবশেষে নেড়ি যখন শান্ত হলো, কলারটা হাতে নিয়ে দেখল অঞ্জন। ‘এই নেড়ি, এটা এত ছোট হলো কী করে রে?’ কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করল ও। বেড়ার কাছে হেঁটে গেল নেড়ি। লপাৎ লপাৎ করে পানির গামলা থেকে পানি খেতে লাগল। এতণ উত্তেজনায় খেয়াল করেনি অঞ্জন, এখন ভাল করে দেখে বুঝল, বেল্টটা ছোট হয়নি। কুঁচকে ছোট হওয়া সম্ভবও না চামড়ার তৈরি জিনিসটা। তাহলে হঠাৎ করে ওটা নেড়ির গলায় এঁটে গিয়ে ওকে দম বন্ধ করে মারতে চাইছিল কেন? কুকুরটার দিকে তাকাল ও। তৃষ্ণার্ত ভঙ্গিতে একনাগাড়ে পানি খেয়ে চলেছে নেড়ি। একবার মুখ তুলে ফিরে তাকাল অঞ্জনের দিকে। তারপর আবার মুখ নামাল পানিতে। বড় হয়ে গেছে কুকুরটা। ভুল দেখছে না তো? না। সত্যিই আকারে বড় হয়ে গেছে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? নেড়ির যা বয়স এখন, মানুষের বয়সের তুলনায় আশি বছরের বুড়ো। এ বয়সে আর ওর বাড়ার কথা নয়। নিশ্চয়ই আমার চোখের ভুল, ভেবে, কলারটা ছুড়ে ফেলে দিল অঞ্জন। আসলে অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকার কারণে ভুলভাল দেখছি, নিজেকে বোঝাল ও। দরজায় এসে দাঁড়ালেন দাদু। অঞ্জনকে খেতে ডাকলেন। বাটিতে শুকনো খাবার ঢেলে রাখল অঞ্জন। পানির গামলা থেকে মুখই তুলছে না কুকুরটা। তাড়াহুড়া করে বাড়ির দিকে রওনা হলো অঞ্জন। * পরদিন সকালে ইপুদের বাড়ির দিকে রওনা হলো অঞ্জন। আকাশে ঘন মেঘ, বাতাসে শরতের আমেজ। ইপুদের পড়শির বাড়ির সামনের চত্বরে বড় একটা আমগাছের নিচে ওকে দেখতে পেল অঞ্জন। ‘এই, কী হয়েছে?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল ও। তারপর দেখল, কোন কিছুর ওপর ঝুঁকে রয়েছে ইপু, দ্রুত নড়ছে ওর হাত দুটো। কী যেন করছে। অঞ্জনকে দেখে মুখ না তুলেই চেঁচিয়ে ডাকল, ‘জলদি এসো, আমাকে সাহায্য করো!’ দৌড়ে গেল অঞ্জন। কাছে গিয়ে দেখল, গাছের গায়ে বাঁধা একটা বিড়ালের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে ইপু। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হিসিয়ে উঠল বিড়ালটা, থাবা মারতে চাইল ইপুর হাতে। ঝট করে হাতটা সরিয়ে এনে সাবধানে আবার হাত বাড়াল ও। দড়ির বড় গিঁটটা খোলার চেষ্টা করল। ‘হারু-তরুর কাজ,’ খ্যাঁচখ্যাঁচ করতে থাকা বিড়ালটার চিৎকারকে ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বলল ইপু। ‘সারা রাতই নিশ্চয়ই এখানে বাঁধা ছিল বেচারা।’ আতঙ্কে একনাগাড়ে চেঁচিয়ে চলেছে বিড়ালটা, অদ্ভুত চিৎকারটাকে একেবারে মানুষের চিৎকারের মত শোনাচ্ছে। ‘এই বিড়াল, চুপ থাক,’ ইপুর হাত ল্য করে আবার থাবা চালাতেই ধমক দিয়ে বলল অঞ্জন। ইপুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কী করব?’ ‘না, এখন আর কিছু করার নেই,’ জবাব দিল ইপু। গিঁটটা ধরে টান দিল। ‘ওই শয়তান দুটোকেও এভাবে বেঁধে রাখতে পারলে খুশি হতাম।’ আফসোস করল অঞ্জন। ‘নিশ্চয়ই ভীষণ ভয় পেয়েছে বিড়ালটা।’ ‘হয়েছে,’ বলে উঠল ইপু। টান দিয়ে দড়ি খুলে দিল। শেষবারের মতো আরেকবার চেঁচিয়ে উঠে, লেজ খাড়া করে দৌড় দিল বিড়ালটা। এক ছুটে ঢুকে পড়ল উঁচু একটা পাতাবাহারের ঝোপে। একবারের জন্যও ফিরে তাকাল না আর। উঠে দাঁড়িয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল ইপু। পরনে রঙচটা জিনসের প্যান্ট, গায়ে ঢলঢলে প্রায় হাঁটুর কাছে নেমে আসা হলুদ রঙের টি-শার্ট। শার্টের ঝুলটা দেখল ও, বিড়ালটা থাবা মেরে ফুটো করে দিয়েছে। ‘ওই দুই শয়তানের জ্বালায় অস্থির হয়ে গেলাম,’ বলল ও। ‘পুলিশকে জানানো দরকার,’ অঞ্জন বলল। ‘লাভ কী? কিছুই স্বীকার করবে না দুই ভাই,’ গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ইপু। তারপর যোগ করল, ‘বিড়ালটা তো আর সাী দিতে পারবে না।’ ‘হুঁ!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল অঞ্জন। ইপুকে নিয়ে দাদুর বাড়িতে চলল ও। সারাটা পথ আলোচনা করল দু’জনে, কিভাবে শিা দেয়া যায় হারু-তরুকে। কিন্তু কোন উপায় বের করতে পারল না। স্টাডিতে এল দু’জনে, যেখান ঘুমায় অঞ্জন। ইপু জিজ্ঞেস করল, ‘কী করা যায় এখন, বলো তো?’ ‘বই পড়তে পারি,’ তাকে রাখা ধুলোয় ঢাকা বইগুলোর দিকে আঙুল তুলে নিরস কণ্ঠে বলল অঞ্জন। ‘জাদু করে হারু-তরুকে জব্দ করতে পারলে খুশি হতাম। বলা যায় না, নিউট বানানোর কৌশলও পেয়ে যেতে পারি কোনও একটা বইয়ের মধ্যে।’ ‘বাদ দাও নিউট,’ হাত নাড়ল ইপু। ‘ভুতুড়ে জেলি কোথায় রেখেছ?’ অঞ্জন জবাব দেবার আগেই তাকে রাখা কৌটাটা চোখে পড়ল ওর। নেয়ার জন্য একসঙ্গে তাকের দিকে ছুটল দু’জনে। আগে পৌঁছল ইপু। থাবা দিয়ে নামিয়ে আনল তাক থেকে। একবার তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ‘অঞ্জন, দেখো অবস্থা!’ কৌটাটা উঁচু করে ধরল ও। ঢাকনা ঠেলে খুলে কিনার দিয়ে উপচে বেরিয়ে আসছে আঠাল হলুদ জেলির মতো জিনিসটা। বারো. ‘অ্যাঁ? ঢাকনাটা ফেটে গেল নাকি?’ অঞ্জনের প্রশ্ন। ইপুর হাত থেকে কৌটাটা নিয়ে ভালমত দেখল। ঢাকনাটা খুলে একটা পাশ উঁচু হয়ে আছে। কৌটার ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে হলুদ জেলি। ঢাকনা সরিয়ে এক খাবলা হলুদ জেলি বের করল ও। ‘অদ্ভুত তো!’ চেঁচিয়ে উঠে বলল। ‘বাড়ছে জিনিসটা!’ হাতের তালুতে নিয়ে চাপ দিল। ‘বাড়ছে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই।’ ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে!’ ইপু বলল। ‘এতই বেড়েছে, কৌটা থেকে বেরিয়ে পড়ে যাচ্ছে।’ ‘দেখো, আগের মত ঠাণ্ডাও লাগছে না,’ অঞ্জন বলল। বল বানিয়ে ইপুর দিকে ছুড়ে দিল ও। লুফে নিল ইপু। ‘হ্যাঁ, তাই তো। আশ্চর্য!’ আবার অঞ্জনের দিকে ছুড়তে গেল বলটা। কিন্তু ওর তালুতে আটকে রইল ওটা। ‘আরে, আঠাও তো হয়ে গেছে। অঞ্জন, সেই একই জিনিস আছে তো, নাকি বদলে ফেলেছ?’ ‘বদলাব কেন?’ ভুরু নাচাল অঞ্জন। ‘আগে তো এ রকম আঠা ছিল না,’ ইপু বলল। ‘আমার মনে হয় বাতাস লেগে নষ্ট হয়ে গেছে, ঢাকনা খোলার পর। জিনিসটার কার্যকারিতা খতম।’ কৌটা থেকে আরেক খাবলা হলুদ জেলি বের করল অঞ্জন। বল বানিয়ে মেঝেতে আছাড় দিল। ‘দেখো, আগের মত লাফাচ্ছে না আর। মেঝেতে আটকে গেছে।’ ‘আশ্চর্য!’ আবার বলল ইপু। ‘নাহ্, নষ্টই হয়ে গেছে। ট্র্যাশ বিনে ফেলে দিতে হবে,’ অঞ্জন বলল। মেঝে থেকে টেনে তুলল হলুদ জেলি। ‘না লাফালে এটা রেখে আর কী করব?’ ‘উঁহুঁ, এখনই ফেলা বোধ হয় উচিত হবে না,’ ইপু বলল। ‘আরও কী পরিবর্তন হয় এটার, দেখা দরকার।’ দরজার কাছে মিউ করে বিড়ালের ডাক শোনা গেল। ফিরে তাকিয়ে কুসিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুরু কোঁচকাল অঞ্জন। মাথাটা এক পাশে কাত করে রেখেছে বিড়ালটা। হলুদ চোখ দুটো তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর দিকে, নাকি ওর হাতের ভুতুড়ে জেলির দিকে? ‘ওই বিড়ালটাকে খুব বুদ্ধিমান বিড়াল মনে হয়,’ ইপু বলল। ‘দুর, অন্য সব বোকা বিড়ালের মতই বোকা বিড়াল এটাও,’ বিড়বিড় করল অঞ্জন। ‘দেখো। মনে হচ্ছে ভুতুড়ে জেলি নিয়ে বল খেলতে চায়।’ ‘স্যরি, বিড়াল,’ ইপু বলল। ‘এই বলটা লাফায় না।’ যেন বুঝতে পারল বিড়ালটা। হতাশ ভঙ্গিতে মিউ করে, ঘুরে দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেল। ‘এ জিনিস এখন রাখব কোথায়?’ কোটাটা দেখাল অঞ্জন। ‘বেড়ে তো আর কৌটাতেও জায়গা হচ্ছে না।’ ‘এই যে, এটাতে রাখলে কেমন হয়?’ নিচের তাক থেকে একটা খালি কফির টিন টেনে বের করল ইপু। ‘হ্যাঁ। রাখা যায়,’ হাতের জেলিটুকু টিনের ভেতর ছুড়ে ফেলল অঞ্জন। ইপুও খানিকটা হলুদ জেলি বের করে নিয়েছে। হাতের তালুতে রেখে চাপ দিল। ‘দেখো। আগের মত আর জ্বলছেও না, হলুদ আভা বেরোচ্ছে না।’ অঞ্জনের দিকে তুলল জিনিসটা। ‘তবে গরম। অনেক বেশি গরম।’ ‘জ্যান্ত হয়ে গেছে!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। মুখ বাঁকিয়ে রসিকতা করল, ‘বাবাগো! জ্যান্ত পিশাচ! পালাও!’ হেসে উঠে অঞ্জনকে তাড়া করল ইপু। হলুদ জেলিটা অঞ্জনের মাথায় লাগিয়ে দিতে চাইল। ‘এসো, ধরো! তোমার ভুতুড়ে জেলি তুমি নিয়ে নাও!’ ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলে, থাবা দিয়ে ইপুর হাত থেকে জেলি কেড়ে নিল অঞ্জন। তারপর গোল করে বল বানিয়ে ফেলে দিল কফির টিনে। কৌটার বাকি জেলিটুকুও বের করে নিয়ে টিনে রাখল। দু’জনেই তাকাল টিনের ভেতর। অর্ধেকের বেশি ভরেছে। টিনটা অঞ্জনের দিকে ঠেলে দিয়ে ইপু বলল, ‘মুখে দেয়ার সাহস আছে?’ ‘না, নেই। তোমার সাহস আছে?’ কফির টিনটা আবার ইপুর দিকে ঠেলে দিল অঞ্জন। ‘আমি তোমাকে আগে খেতে বলেছি,’ হেসে বলল ইপু। ‘খাও। দেখো, খেতে কেমন লাগে।’ মুখ বাঁকাল অঞ্জন। মাথা নাড়ল। তারপর আচমকা খামচা দিয়ে এক খাবলা জেলি তুলে ইপুর মুখে লাগিয়ে দিতে গেল। মুখ সরিয়ে নিল ইপু। অঞ্জনের হাত থেকে মেঝেতে কার্পেটের ওপর পড়ে গেল জেলির বল। ছোঁ মেরে ওটা তুলে নিয়ে অঞ্জনকে ল্য করে ছুঁড়ে মারল ইপু। মাথা নামিয়ে ফেলল অঞ্জন। ওর মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে দেয়ালে আটকে চ্যাপ্টা হয়ে গেল হলুদ জেলির বলটা। টিন থেকে আরেক খাবলা জেলি তুলে নিল অঞ্জন। ছুড়ল ইপুকে ল্য করে। ভুতুড়ে জেলি নিয়ে খেলতে খেলতে ডিনারের সময় হয়ে গেল। ঘরের দেয়াল আর মেঝেতে লেগে যাওয়া জেলি আর দাগ পরিষ্কার করছে ওরা, এ সময় নেড়ির চিৎকার ভেসে এল জানালা দিয়ে। জানালার দিকে ছুটল দু’জনে। আগে পৌঁছল অঞ্জন। আকাশের রঙ এখনও ধূসর, মেঘে ঢাকা। বোধ হয় একা থাকতে ভাল না লাগাতেই খোঁয়াড় থেকে বেরোনোর জন্য চেঁচামেচি করছে নেড়ি। ‘এই নেড়ি,’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ‘থাম! চুপ কর!’ ‘অঞ্জন, তোমার কুকুরটার কী হয়েছে বলো তো?’ ইপু জিজ্ঞেস করল। ‘বেড়েই তো চলেছে। দেখো, কত বড় হয়ে গেছে।’ সত্যি, আগের দ্বিগুণ হয়ে গেছে কুকুরটা। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল অঞ্জন। তেরো. ‘নেড়ি, ফিরে আয়! এই নেড়ি!’ ফিরল না মস্ত কুকুরটা। দৌড়ে চলেছে। ওটার বিশাল পা থপ্-থপ্ শব্দ তুলছে কংক্রিটের রাস্তায়। ‘আয় বলছি!’ চিৎকার করে বলল অঞ্জন। কুকুরটার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। মরিয়া হয়ে ধরার চেষ্টা করছে। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ডটা। ছুটতে ছুটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। তবু ধরতে পারছে না কুকুরটাকে। অন্ধকার রাত। তারা নেই আকাশে। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছিল। অন্ধকারেও চকচক করছে কংক্রিটের ভেজা রাস্তা। নেড়ির মস্ত ছুটন্ত পা যেন ঢাকের শব্দ তুলছে রাস্তায় পড়ে। প্রতিধ্বনি তুলছে। কুকুরটার মস্ত কান দুটো জোরাল বাতাসে ডানার মতো উড়ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ি খাচ্ছে মাথার দুই পাশে। ছোটার তালে তালে ওপরে-নিচে দুলছে বিশাল মাথাটা। কিন্তু অঞ্জনের ডাকে সাড়া দিয়ে একটিবারের জন্য ফিরে তাকাচ্ছে না। ‘নেড়ি! নেড়ি!’ ঝড়ো বাতাসে চাপা পড়ে যাচ্ছে অঞ্জনের ডাক। আরও জোরে চিৎকার করতে চাইল ও। শব্দ বেরোল না মুখ দিয়ে। কুকুরটাকে পালাতে দেয়া যাবে না, আটকাতে হবে। ধরতে হবে, যে করেই হোক। এতবড় কুকুর রাস্তায় ছাড়া থাকাটা নিরাপদ নয় মোটেও। টাট্টু ঘোড়ার সমান বড় হয়ে গেছে নেড়ি। মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। এ হারে বড় হতে থাকলে হাতি হতে দেরি হবে না। ‘নেড়ি, নেড়ি, থাম সোনা!’ কিন্তু ওর ডাক কানেই ঢুকছে না কুকুরটার। শোঁ-শোঁ শব্দে বয়ে চলা, পাক খেতে থাকা ঝড়ো বাতাস যেন অঞ্জনের ডাক আটকে ফেলছে, পৌঁছতে দিচ্ছে না কুকুরটার কানে। তবু হাল ছাড়ছে না অঞ্জন। দৌড়ে চলেছে। বুকের মধ্যে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। দেহের প্রতিটি পেশি ব্যথা হয়ে গেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ ল করল, দুটো ছেলে কুকুরটার আগে আগে দৌড়াচ্ছে। আরে, হারু-তরু! দৈত্যাকার জানোয়ারটার কাছ থেকে প্রাণভয়ে দৌড়ে পালাতে চাইছে দুই যমজ ভাই। নেড়ি ওদের তাড়া করেছে, বুঝতে পারল অঞ্জন। মোড় নিল ছেলেগুলো, আরও অন্ধকার একটা রাস্তায় গিয়ে পড়ল। ওদের অনুসরণ করছে নেড়ি, লাফাতে লাফাতে ছুটেছে। অন্ধকারে অঞ্জনও দৌড়াচ্ছে, সবার পেছনে থেকে রহস্যময় এক কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে যেন। আশপাশটা পুরোপুরি নীরব। শুধু নেড়ির বিশাল পায়ের একটানা থপ্-থপ্ থপ্-থপ্ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ও, না আছে। চকচকে পাকা রাস্তায় হারু-তরুর জুতোর খটা-খট্ শব্দ। ফোঁস-ফোঁস করে হাঁপাচ্ছে অঞ্জন। কুকুরটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে ওটার পেছনে লেগে থাকতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। ফুসফুসে যেন আগুন ধরে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ডটা ফেটে বেরিয়ে আসার জোগাড়। আতঙ্কিত হয়ে দেখল অঞ্জন, পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে গেছে কুকুরটা। আকাশের দিকে মুখ তুলে কানফাটা গর্জন করল। কুকুরের ডাক নয়। ভয়াল গর্জন। বাস্তব কোনও প্রাণীর সঙ্গে এর মিল নেই। বদলাতে শুরু করল নেড়ির আকৃতি। কপালটা ফুলে উঠে সামনে ঠেলে বেরোল, বড় হয়ে গেল। চোখ দুটো চওড়া হয়ে গিয়ে ফোলা কপালের মধ্যে বসে গেল। হাঁ করা মুখের ভেতর থেকে বেরোল বড় বড় শ্বদন্ত। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে গর্জন করল ভুতুড়ে জানোয়ারটা। আগের চেয়ে জোরে। রক্ত পানি করা হাঁক। ‘দানব হয়ে গেছে ও! দানব!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘মায়ানেকড়ে!’ ঘুম ভেঙে গেল ওর। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠল। বুঝল, বিছানায় রয়েছে। দাদুর বাড়ির স্টাডিতে, এখন যেটা অঞ্জনের শোবার ঘর। বিছানাটা অস্বস্তিকর লাগছে। মনে হচ্ছে, জায়গা হচ্ছে না। লাফিয়ে উঠে বসল অঞ্জন। ওর পায়ের দিকে তাকাল। হাতের দিকে তাকাল। দানবীয় হাত-পা। এতবড় হয়ে গেছে ও, শরীরের তুলনায় বিছানাটা এখন অনেক ছোট। দৈত্য হয়ে গেছি আমি! দৈত্য! প্রচণ্ড আতঙ্কে মুখ হাঁ করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে গেল ও। স্বর বেরোল না গলা দিয়ে। চোদ্দ. ওর চিৎকারই ওকে জাগিয়ে দিল। এবার সত্যি সত্যি ঘুম ভেঙেছে। প্রথম দুঃস্বপ্নটা দেখার পর স্বপ্নের মধ্যেই জেগে যেতে দেখেছে নিজেকে। তখন আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছে দৈত্য হয়ে গেছে। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন। এবার সত্যি জেগেছে তো? উঠে বসল। চোখ মিটমিট করল। চোখের পাতা ডলল। ভাল করে তাকানোর চেষ্টা করল। দরদর করে ঘামছে। চাদরটা মেঝেতে পড়ে গেছে, ঘুমের মধ্যে ফেলে দিয়েছে গা থেকে। ঘামে ভিজে পাজামাটা পায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে। ঘরের কোন কিছুই পরিচিত লাগছে না। স্বপ্নটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, কোথায় আছে বুঝতে কিছুটা সময় লাগল। দিলারা দাদুর বাড়িতে রয়েছে। পুরোপুরি সজাগ। স্বাভাবিক আকৃতির দেহ। জোরাল বাতাসে পর্দা উড়ল। কোনা বাড়ি খেল ওর গায়ে। বাতাস সড়াৎ করে টান দিয়ে জানালার বাইরে নিয়ে গেল পর্দাটা। বিছানায় বসে আছে অঞ্জন। গায়ের কাঁপুনি এখনও থামেনি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। হালকা ফিতের মতো কুণ্ডলী পাকানো ধূসর মেঘ ভেসে যাচ্ছে আধখানা ফ্যাকাশে চাঁদের ওপর দিয়ে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে ঝাঁকি খাচ্ছে গাছের মাথা, ফিসফিস শব্দ করছে। নেড়িকে দেখল, গভীর ঘুমে অচেতন। কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। তারের বেড়ায় গা ঠেকিয়ে। দুঃস্বপ্নে দেখা দানবে পরিণত হয়নি নেড়ি। তবে অনেক বড় হয়েছে। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে ওর দেহে। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে ভাবছে অঞ্জন। হয়তো কোনও একটা গ্ল্যান্ডের সমস্যা। হাই তুলল অঞ্জন। ঘুমে ঘোলাটে হয়ে আছে মাথার ভেতরটা। ঠিকমত চিন্তা করতে পারছে না। আগামীকাল সকালে একজন পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে কুকুরটাকে। আবার হাই তুলে, বিছানায় শুতে যাবে, ঠিক এই সময় চোখে পড়ল জিনিসটা। তাকে রাখা কফির টিন। যেটাতে ভুতুড়ে জেলি ভরে রেখেছিল। এ-কি! টিনের মুখ দিয়ে উপচে পড়ছে হলুদ জেলি। থরথর করে কাঁপছে। জ্যান্ত প্রাণীর মত। পনেরো. ‘কই, ঠিকই তো আছে তোমার কুকুরটা, বয়সের তুলনায় পুরোপুরি সুস্থ,’ নেড়ির গলার নিচে চুলকে দিলেন ডাক্তার। পশু ডাক্তার আবদুল খালেক। ‘সাদা চুলগুলো দেখো। একেবারে স্বাভাবিক।’ কুকুরটার প্রায় মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলেন তিনি। ‘তাই না রে, বুড়ো কুকুর?’ ডাক্তারের হাত চেটে দিল কুকুরটা। হাসলেন ডাক্তার। সরু নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ঠেলে তুলে দিলেন ওপরে। তাঁর চকচকে কপালে প্রতিফলিত হলো ছাদের বাতিটা। সাদা ডাক্তারি অ্যাপ্রনে হাত মুছলেন তিনি। ছোট, উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত ঘরটায় নেড়ির কাছ থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জন ও ইপু। অনেকণ ধরে কুকুরটাকে পরীা করেছেন ডাক্তার, সে-সময়টায় ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে ছিল দু’জনে। এখন, ডাক্তারের রায় শোনার পর, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। টান টান ভাবটা নেই আর মুখে। ‘তাহলে এই বড় হওয়াটা স্বাভাবিক বলছেন আপনি?’ অঞ্জন জিজ্ঞেস করল। মাথা ঝাঁকালেন পশু ডাক্তার। ফিরে গেলেন ঘরের কোণে রাখা তাঁর ডেস্কে। ‘স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে, তবে এ জাতের কুকুরের জন্য ব্যাপারটা অস্বাভাবিক,’ মোলায়েম স্বরে বলে, ডেস্কের ওপর ঝুঁকে কাগজে খসখস করে লিখতে শুরু করলেন। ‘খুবই অস্বাভাবিক। তিন-চার দিনের মধ্যেই রক্ত পরীার ল্যাবরেটরি রিপোর্ট পেয়ে যাব। তখন আরও কিছু জানতে পারব। তবে আমার যেটা অবাক লাগছে, কুকুরটা পুরোপুরি সুস্থ। কোন রোগ পেলাম না, শঙ্কিত হওয়ারও কোন কারণ দেখছি না।’ ‘ককার স্প্যানিয়েল কি এত বড় হয়?’ নিচু হয়ে নেড়ির গলার নিচে চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। গলায় বাঁধা শিকলের এক মাথা ধরে রেখেছে, ঢিল হয়ে ওর হাতে ঝুলছে শিকলটা। বেরিয়ে যেতে চাইল নেড়ি। দরজার দিকে টেনে নিতে চাইল অঞ্জনকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে টান দিয়ে কুকুরটাকে আটকে রাখল ও। ভীষণ জোর লাগছে তাতে। শুধু যে বড় হয়েছে নেড়ি, তা নয়, সাথে সাথে শক্তিও বেড়েছে। কয়েক দিন আগেও যা ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি। ‘নাহ্,’ মাথা নাড়লেন ডাক্তার। ‘কখনই এত বড় হয় না। এ জন্যই রক্তের হরমোন টেস্ট করতে দিচ্ছি। রক্ত নিলাম। গ্ল্যান্ডিউলার স্যাম্পল নিলাম। ল্যাবরেটরি পরীার ফলাফল থেকে হয়তো আমাদের প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।’ লেখা শেষ করে টান দিয়ে প্যাডের কাগজটা ছিঁড়ে নিলেন তিনি। ‘এই যে,’ কাগজটা বাড়িয়ে দিলেন অঞ্জনের দিকে। ‘ভাল একটা ডগ ফুড লিখে দিলাম। এটা নিয়ম করে খাওয়াবে। আসল খাবার কমিয়ে দেবে। আগের মত ছোট হয়তো আর হবে না কখনও কুকুরটা, তবে আশা করি বাড়বেও না আর।’ ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিয়ে দরজার দিকে ফিরল অঞ্জন। আবার টান দিল নেড়ি। এবার আর বাধা দিল না অঞ্জন, শিকলের টানে কুকুরটার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলল। ওদের পেছন পেছন এল ইপু। ‘ডাক্তার যখন বলেছেন...’ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল ইপু। ‘সর্বনাশ, এত্ত দেরি হয়ে গেছে! আমার অঙ্কের মাস্টার চলে এসেছেন নিশ্চয়ই। মা আজ আর আমাকে আস্ত রাখবে না।’ ফুটপাথ ধরে উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করল ইপু। আরেকটু হলেই ধাক্কা খেতো রাস্তার একজন লোকের গায়ে। ইপুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কুকুরটার দিকে তাকাল অঞ্জন। ‘চল, যাই।’ পশু ডাক্তারের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চলল ও। কুকুরটার শিকল ধরে রেখেছে। ডাক্তারের আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছে না, দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। একটা দোকানের সামনে দাঁড়াল। ‘একটা আইসক্রিম খেলে মন্দ হয় না,’ বিড়বিড় করে নিজেকেই বলল। ‘তাতে মন খুশি হবে।’ দোকানের উল্টো দিকে একটা কাঁটাতারের বেড়ার কংক্রিটের খুঁটির সঙ্গে শিকলটা বাঁধল ও। ‘থাক এখানে। আমি আসছি।’ বলে দোকানের দিকে এগোল ও। কথা শুনল না নেড়ি। টান দিয়ে শিকল খোলার চেষ্টা করতে লাগল। ফিরে তাকিয়ে আবার বলল অঞ্জন, ‘আমার দেরি হবে না।’ ছুটে দোকানের ভেতর ঢুকে পড়ল ও। দোকানে তিন-চারজন খরিদ্দার রয়েছে, আর তার কারণে আইসক্রিম কিনে বেরোতে কিছুটা সময় লাগল অঞ্জনের। বেরিয়ে দেখে কুকুরটার শিকল খুলছে হারু-তরু। ‘এই, খুলো না, খুলো না!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ফিরে তাকাল দুই ভাই। দু’জনের মাংসল মুখে একই ধরনের হাসি। ‘দেখো, কে আসছে,’ একজন বলল ওর ভাইকে। অন্যজন খুঁটি থেকে শিকলটা খুলে ফেলল। দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথে উঠল অঞ্জন। এক হাতে আইসক্রিম বারটা ধরে রেখে অন্য হাত বাড়াল, ‘দাও শিকলটা আমার হাতে।’ শিকলের মাথাটা অঞ্জনের দিকে বাড়িয়ে দিল তরু, ‘নাও, ধরো।’ অঞ্জন ধরতে যেতেই ঝট করে সরিয়ে নিল। হেসে বলল, ‘পারলে না, পারলে না।’ মজা পেয়ে খিকখিক করে হেসে একে অন্যের গায়ে চাপড় মারল দুই ভাই। ‘দেখো, বোকামি কোরো না,’ অঞ্জন বলল। ‘শিকলটা আমার হাতে দাও।’ ‘যে পায় সে রাখে,’ ভাইয়ের দিকে তাকাল তরু। ‘কী বলো, হারু?’ ‘নিশ্চয়ই,’ হেসে মাথা ঝাঁকাল হারু। ‘জঘন্য একটা কুৎসিত কুকুর। তবে এটার মালিক এখন আমরা। কুকুরের চেহারা নিয়ে মাথা ঘামাব না।’ ‘মতা থাকলে আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নাও,’ চোখের পাতা সরু করে অঞ্জনের দিকে তাকাল তরু। অঞ্জনের হাতের আইসক্রিমটার দিকে তাকাল হারু। তারপর সামনে এগিয়ে আচমকা এক থাবা মারল। রাস্তায় পড়ে ভেঙে গেল আইসক্রিম-বারটা। যেন কী সাংঘাতিক মজার কাজ করে ফেলেছে, হাসতে লাগল দুই ভাই। কিন্তু ওদের হাসি থামিয়ে দিল নেড়ি। চাপা স্বরে ভয়ানক গর্জন করে উঠল। ঠোঁট দুটো সরে মাঢ়ির ওপর উঠে গিয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে চেহারা। গরগর করতে করতে আবার এক প্রচণ্ড হাঁক ছাড়ল। ‘সাবধান, হারু...’ বলে হাত থেকে শিকল ছেড়ে দিল তরু। আরেকবার ক্রুদ্ধ গর্জন করে লাফিয়ে উঠল নেড়ি। পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে সামনের দুই পা তরুর বুকে তুলে ধাক্কা মারল। চিত হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল তরু। হারু ততণে দৌড়াতে শুরু করেছে। রাস্তায় খট্ খট্ শব্দ তুলছে ওর জুতোর তলা। পড়িমরি করে ছুটছে। পশু ডাক্তারের অফিস পেরিয়ে, পোস্ট অফিসের পাশ কাটিয়েও থামল না। ‘এই দাঁড়াও! হারু, দাঁড়াও!’ বলে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনমতে উঠে দাঁড়াল তরু। একটা মুহূর্তও দেরি না করে ভাইকে অনুসরণ করল। তাড়া করল নেড়ি। থাবা দিয়ে শিকলের মাথাটা ধরার চেষ্টা করল অঞ্জন। ফসকে গেল। ‘নেড়ি, দাঁড়া! যাসনে! নেড়ি!’ কিন্তু শুনল না কুকুরটা। রাগে চিৎকার করে, রাস্তায় মস্ত পায়ের শব্দ তুলে তাড়া করেছে দুই ভাইকে। যতই এগোচ্ছে, ততই গতি বাড়াচ্ছে। দোকানের সামনে বরফের মত জমে গেছে যেন অঞ্জন। কী করবে বুঝতে পারছে না। এ রকম ঘটনা স্বপ্নে দেখেছিল। কেঁপে উঠল অঞ্জন। স্বপ্নের বাকি দৃশ্যটা মনে পড়ল। কিভাবে দুই ভাইকে তাড়া করতে করতে ভুতুড়ে প্রাণী হয়ে গিয়েছিল নেড়ি। কিভাবে অঞ্জনও দৈত্যে পরিণত হয়েছিল। পুরো ঘটনাটা কি এখন বাস্তবে ঘটবে? শিউরে উঠল ও। ষোলো. সেদিন সন্ধ্যায় ইপুকে ফোন করল অঞ্জন। ‘আমি যদি তোমাদের বাড়িতে আসি, অসুবিধে আছে? একটা ছোটখাটো সমস্যা হয়েছে।’ ‘ছোটখাটো? কিন্তু তোমার গলা শুনে তো মনে হচ্ছে বিরাট সমস্যা,’ ইপু বলল। ‘হয়তো বিরাট সমস্যাই,’ অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল অঞ্জন। ‘আসব?’ ‘তরু আর হারুর কোন খোঁজ পেয়েছ? সমস্যাটা কি ওরাই?’ ‘না,’ অঞ্জন বলল। ‘আগেই বলেছি, আমি নেড়ির কাছে পৌঁছানোর আগেই ওরা গায়েব হয়ে গিয়েছিল। চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছিল নেড়ি। বহু কষ্টে ওকে টেনে বাড়ি নিয়ে গিয়ে খোঁয়াড়ে ভরেছি।’ ‘তাহলে সমস্যাটা কি তোমার?’ ইপু জিজ্ঞেস করল। ‘টেলিফোনে বলা যাবে না। দেখাতে হবে,’ অঞ্জন বলল। ‘আমি আসছি। রাখি।’ রিসিভার রেখে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নামল ও, হাতে একটা বালতি। দাদু রান্নাঘরে, অঞ্জনের দিকে পেছন করে আছেন, গোশত কাটার বড় ছুরিটা দিয়ে কোন কিছু কোপাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি সরে এল অঞ্জন। বেরিয়ে এসে তাড়াহুড়া করে চলল ইপুদের বাড়িতে। ইপুদের বাড়ির সামনের আঙিনায় পাতাবাহারের নিচু বেড়া। ওর বাবাÑইপু বলেছেÑলনের ব্যাপারে রীতিমত খেপা। একেবারে ইঞ্চি মেপে নিখুঁতভাবে ঘাস ছাঁটেন, দেড় ইঞ্চি উঁচু ঘাসগুলো কার্পেটের মত সমান আর মসৃণ। বাড়ির সামনে চমৎকার একটা ফুলের বাগান। মোলায়েম বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে অসংখ্য লাল আর সাদা গোলাপ। সামনের দরজায় টোকা দিল অঞ্জন। ‘বালতিতে কী?’ দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল ইপু। ‘দেখো,’ জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে অঞ্জন, পুরোটা রাস্তা দৌড়ে এসেছে। দাদুর গ্যারেজ থেকে নিয়ে আসা অ্যালুমিনিয়ামের বালতিটা উঁচু করে দেখাল ও। ‘সর্বনাশ,’ চেঁচিয়ে উঠল ইপু। দুই হাত উঠে এসেছে মুখের ওপর, চোখ বড় বড়। ‘হ্যাঁ, সর্বনাশ!’ ইপুর কথার প্রতিধ্বনি করল অঞ্জন। ঘরে ঢুকল। ‘ভুতুড়ে জেলি। বেড়েই চলেছে। দেখো, বালতিটাও ভরে গেছে। কী করব আমরা?’ ‘আমরা মানে?’ অঞ্জনকে বসার ঘরের দিকে নিয়ে চলল ইপু। ‘দেখো, ব্যাপারটা রসিকতা নয়,’ গম্ভীর স্বরে বলল অঞ্জন। ‘কিন্তু তুমি তো এটা আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে রাজি হওনি,’ মনে করিয়ে দিল ইপু। ‘এখন করব,’ অঞ্জন বলল। ‘সত্যি বলতে কী, এখন এটা তোমাকে দিয়ে দিতেও রাজি আমি। নেবে? পয়সা লাগবে না।’ বালতিটা ইপুর দিকে বাড়িয়ে ধরল ও। ‘না,’ মাথা নাড়ল ইপু। ‘নামিয়ে রাখো না। অকারণে হাতে ধরে রেখেছ কেন?’ লাল রঙের একটা সোফা দেখাল ও। ‘ওটার ওপাশে রাখো। আমি ওই ভুতুড়ে জেলির দিকে তাকাতে পারছি না। গা ছমছম করে।’ ‘আমারও তো করে!’ ককিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘কী করি এখন বলো তো? যতবার তাকাই, দেখি, আগের চেয়ে বেড়েছে। নেড়ির মত...’ ঝট করে হাত তুলল ইপু। ‘দাঁড়াও! দাঁড়াও! নেড়ির মত বললে না?’ ইপু কী বলতে চায় বুঝে ফেলেছে অঞ্জনও। হলুদ জেলির একটা বল খেয়ে ফেলেছিল নেড়ি! ‘তোমার কী মনে হয়...’ বলতে গেল অঞ্জন। ‘হ্যাঁ,’ বাধা দিয়ে বলল ইপু। ‘নেড়িও বড় হচ্ছে ভুতুড়ে জেলি খেয়ে ফেলাতেই।’ ‘কী করি বলো না,’ আবার ককিয়ে উঠল অঞ্জন। বিচলিত ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করল ঘরের ভেতর। দুই হাত প্যান্টের পকেটে। ‘এই জেলিটা বেড়েই চলেছে, নেড়িরও একই অবস্থা। এখানে আমি একা। সাহায্য করার কেউ নেই। কেউ না।’ ‘কেন, তোমার দাদু?’ বলে মেঝেতে রাখা বালতিটার দিকে তাকাল ইপু। ‘তোমার দাদু নিশ্চয়ই কোনও একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারবেন...’ ‘না, তা তিনি করবেন না। তিনি কানে শোনেন না, আর শুনলেও আমার এ সব কথা শুনতে চাইতেন না। আমাকে দেখতে পারেন না। সারাটা দিন বসে বসে শুধু জিগসো পাজল খেলেন আর বিড়ালটার সঙ্গে ঝগড়া করেন।’ ‘হুঁ, বেশ, দাদুর কথা তাহলে ভুলে যাও,’ হতাশ ভঙ্গিতে বলল ইপু। ‘যদি পশু ডাক্তারকে বলতে পারো...’ ‘তাঁকে বলে লাভ কী?’ রুকণ্ঠে বলল অঞ্জন। ‘তিনি কি আমার কথা বিশ্বাস করবেন? ভুতুড়ে জেলি খেয়ে নেড়ি বড় হয়েছে, একথা তাঁকে বলতে গেলে তিনি আমাকে পাগলা গারদে পাঠাবেন।’ ধপ করে সোফায় বসে পড়ল ও। ‘আমি এখানে একেবারেই একা, ইপু। আমাকে সাহায্য করার কেউ নেই। এমনকি এ ব্যাপারে কথা বলার পর্যন্ত কেউ নেই।’ ‘শুধু আমি বাদে?’ ‘হ্যাঁ,’ ইপুর চোখে চোখে তাকাল অঞ্জন, ‘শুধু তুমি বাদে।’ সোফার আরেক প্রান্তে বসল ইপু। দ্বিধা করে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কী করতে পারি?’ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল অঞ্জন। বালতিটা তুলে এনে ইপুর সামনে রাখল। ‘এটা আমরা ভাগাভাগি করে নিতে পারি। তুমি খানিকটা নিয়ে নাও।’ ‘তাতে লাভটা কী? তারচেয়ে চলো না কেন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসি?’ বালতিটার দিকে তাকিয়ে বলল ইপু। বালতির কানার কাছে উঠে এসেছে হলুদ জেলি। ‘ফেলে দেব? উচিত হবে না,’ অঞ্জন বলল। ‘কেন হবে না? এসো আমার সঙ্গে।’ বালতিটা তুলতে হাত বাড়াল ইপু। বালতিটা সরিয়ে নিল অঞ্জন। ‘ডাস্টবিনে ফেললেই সমস্যার সমাধান হবে না। যদি ডাস্টবিন ভরে উপচে পড়ে? তারপরও বাড়তে থাকে? পুরো শহর ভরে ফেলে?’ ‘তাই তো! তখন সমস্যাটা অনেক বড় হয়ে যাবে,’ ইপু বলল। ‘কী করব, বুঝতে পারছি না।’ ‘তা ছাড়া,’ উত্তেজিত কণ্ঠে অঞ্জন বলল, ‘সত্যিই যদি এটা খেয়ে নেড়ি বড় হয়ে থাকে, প্রমাণ করার জন্যও জিনিসটা লাগবে। বুঝতে পারছ না? ডাক্তারকে দেখাতে হবে। যাতে কুকুরটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেন তিনি।’ ‘কিন্তু...’ ‘যদি তুমি আমাকে সাহায্য করতেই চাও,’ অঞ্জন বলল, ‘এখান থেকে খানিকটা নিয়ে নিলেই আমি বেঁচে যাই।’ ‘নিতে সাহস হচ্ছে না,’ ইপু বলল। ‘তবু, ঠিক আছে, নিতে পারি, অল্প একটু।’ উঠে দাঁড়াল ও। বালতিটার পাশ কাটিয়ে এগোল। ‘আমি আসছি।’ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও। একটু পরেই ফিরে এল একটা কফির টিন নিয়ে। হাসিমুখে বলল, ‘এটা ভরে দাও।’ টিনটার দিকে তাকিয়ে থেকে অঞ্জন বলল, ‘মাত্র এটুকু নেবে?’ রুকণ্ঠে বলে উঠেও তাড়াতাড়ি স্বর কোমল করল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, এতেও কিছুটা কমবে।’ হাঁটু গেড়ে বসে বালতির মাঝখানে জেলির মধ্যে টিনটা ডুবিয়ে দিল ও। পরণে ‘বাপরে!’ বলে চিৎকার দিয়ে, দুই হাত তুলে পেছনে ছিটকে পড়ল, মেঝের ওপর। ‘কী হয়েছে?’ তাড়াতাড়ি ইপুর দিকে এগিয়ে এল অঞ্জন। ‘এমন টান দিয়ে টিনটাকে নিয়ে গেল না!’ ভয় দেখা যাচ্ছে ইপুর চোখে। ‘স্রেফ টেনে নিয়ে গেল। দেখো।’ বালতির দিকে তাকাল অঞ্জন। টিনটা দেখা যাচ্ছে না। ‘আরে তাই তো?’ ‘এমন জোরে টান মারল!’ গলা কাঁপছে ইপুর। উঠে এসে সোজা হয়ে বসল আবার বালতির কাছে। ঝুঁকে ভেতরে তাকাল। ‘দেখি তো,’ বলে জেলির মত থকথকে জিনিসটার ভেতরে দুই হাত ঢুকিয়ে দিল অঞ্জন। ‘হ্যাঁ, টানে, তুমি ঠিকই বলেছ, ‘আমার হাত টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। আর খুব গরম। জ্যান্ত প্রাণীর মত।’ ‘আর বোলো না, আমার ভয় লাগছে!’ কেঁপে উঠল ইপু। ‘টিনটা বালতি থেকে বের করো।’ দুই হাতে চেপে ধরে, জোরে টান দিয়ে অবশেষে টিনটা বের করে আনল অঞ্জন। পুরো টিনটা কানায় কানায় ভর্তি। ওটার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল ও, যেন বমি আসছে। ‘ওয়াক!’ ‘সত্যিই আমাকে নিতে বলছ?’ অঞ্জনের বাড়িয়ে ধরা টিনটা নেবার কোন আগ্রহ দেখা গেল না ইপুর মাঝে। ‘রাখো না, অল্প সময়ের জন্য,’ অঞ্জন বলল। ‘এটার হাত থেকে মুক্তি পাবার একটা উপায় খুঁজে বের না করা পর্যন্ত।’ ‘নিয়ে গিয়ে হারু-তরুকে খাইয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়,’ ইপু বলল। ‘হ্যাঁ, খাইয়ে ওদের দৈত্য বানাই, আর আমাদেরকেই মাথায় তুলে আছাড় মারুক,’ শিউরে উঠল অঞ্জন। ‘তা ঠিক,’ মাথা ঝাঁকাল ইপু। ‘ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অঞ্জন, সাবধান থেকো, সহজে ছাড়বে না ওরা তোমাকে। ‘সুখবরটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ,’ দমে গেছে অঞ্জন। একে ভুতুড়ে জেলির সমস্যা, তার ওপর হারু-তরু...আর ভাবতে চাইল না ও। হাতে লেগে যাওয়া জেলি তুলে বালতিতে ফেলতে লাগল। বলল, ‘আমি বরং যাই। বেরোনোর আগে দাদুকে রান্নাঘরে দেখে এসেছি, খাবার তৈরি করছেন। গোশত দিয়ে কিছু বানাবেন বোধ হয়। দেরি করে গেলে রেগে যেতে পারেন।’ ‘ভালই তো, গোশত...’ ‘কচুর ভাল,’ ঝাঁজাল কণ্ঠে বলল অঞ্জন। বালতিটা আবার তুলে নিল অঞ্জন। কফির টিনে ভরে দিয়ে খুব অল্পই কমেছে জেলি। যে হারে বাড়ে, ওটুকু বেড়ে ভরে যেতে সময় লাগবে না। দরজার কাছে ওকে এগিয়ে দিল ইপু। ‘দরকার হলে ফোন কোরো।’ নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে এল অঞ্জন। পেছনে দরজাটা লাগিয়ে দিল ইপু। লন ধরে চুপচাপ হাঁটতে লাগল অঞ্জন। হঠাৎ পাতাবাহারের ঝোপ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল হারু-তরু। প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো। যখন বের করল, দেখা গেল আঙুলগুলো মুঠো পাকানো। সতেরো. সামনে এসে অঞ্জনের পথ আটকে দাঁড়াল দুই ভাই। ওদের খাটো করে ছাঁটা সোনালি চুলে বিকেলের রোদ চমকাচ্ছে। বিমল হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুখে। বিমূঢ় হয়ে একবার এর মুখের দিকে, একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে অঞ্জন। কেউ কোন কথা বলছে না। আচমকা বালতির হাতল চেপে ধরল তরু। অঞ্জনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলল। ভারি শব্দ করে মাটিতে পড়ে কাত হয়ে গেল বালতিটা। হলুদ জেলি গড়িয়ে পড়তে লাগল ঘাসের ওপর। অদ্ভুত, কুৎসিত শব্দ করছে, হাড্ডি থেকে রস চুষে খাওয়ার মত। ‘এই...’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। আর কিছু বলার সুযোগ পেল না ও। ওর পেটে ঘুসি মারল তরু। অঞ্জনের মনে হলো, বিদ্যুৎ প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে। দম আটকে গেল ব্যথায়। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগল ফুসফুস। পরের ঘুসিটা আর আসতে দেখল না ও। চোয়ালে লাগল, ডান চোখের নিচে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল ও। ঝটকা দিয়ে ওপরে উঠে গেল দুই হাত। দু’জনই এখন মারছে ওকে। কতণ ধরে মারল ওরা, বলতে পারবে না অঞ্জন। হঠাৎ একজন ওর কাঁধে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে ঠাণ্ডা ভেজা ঘাসের ওপর চিৎ করে ফেলে দিল। সারা গায়ে ব্যথা। বমি পাচ্ছে অঞ্জনের। চোখ বুজে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। পেটের তীè ব্যথাটা চলে যাওয়ার অপো করছে। মাটি যেন দুলছে উত্তাল ঢেউয়ে পড়া নৌকার মত। হাত বাড়িয়ে মাটি খামচে ধরে যেন পতন রোধ করতে চাইল অঞ্জন। কতণ পর বলতে পারবে না, অবশেষে দুলুনি যখন থামল মনে হলো, চোখ মেলে অঞ্জন দেখে ওর গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইপু। চোখ বড় বড় করে ইপু বলল, ‘অঞ্জন...’ গুঙিয়ে উঠে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল ও। বোঁ করে চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। বন বন করে ঘুরছে যেন ঘাসগুলো। চিত হয়ে শুয়ে পড়তে বাধ্য হলো আবার। ‘ওরা চলে গেছে?’ চোখ বুজে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল অঞ্জন। মাথা ঘোরা বন্ধ হওয়ার অপো করছে। ‘হ্যাঁ,’ হাঁটু গেড়ে অঞ্জনের পাশে বসল ইপু। ‘তোমার কী অবস্থা? মাকে ডাকব?’ চোখ মেলল অঞ্জন। ‘না না, ডাকার দরকার নেই, আমি ভালই আছি।’ নিজের হাতটা তুলে এনে গালে রাখল অঞ্জন। ‘উহ্!’ ব্যথা লাগায় হাতটা সরিয়ে নিল ও। ফুলে গেছে। কয়েক মিনিট পর আবার উঠে বসল ও। মাথা ঘোরা বন্ধ হয়েছে। দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। নিঃশ্বাস অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফুলে ওঠা গাল ডলল। ‘প্রতিশোধ আমরা নেব,’ সান্ত্বনা দিল ইপু। ‘ওদের একটা শিা না দিয়ে ছাড়ব না।’ বালতিটার ওপর চোখ পড়ল অঞ্জনের। কাত হয়ে পড়ে আছে। ঘাসের ওপর গড়িয়ে পড়েছে হলুদ জেলি। অনেকখানি জায়গা জুড়ে পুরু হয়ে জমে রয়েছে। ঝুঁকে বালতিটা তুলে সোজা করে রাখল ইপু। ‘আল্লাহ্ই জানে, ঘাস মেরে ফেলবে কি না। লনের কোন তি হলে বাবা রেগে আগুন হয়ে যাবে।’ ‘উফ্, এত ভারি,’ গুঙিয়ে উঠল অঞ্জন। অনেকখানি জেলি দুই হাতে খামচে ধরে বালতিতে তোলার চেষ্টা করল ও। ‘নড়েও না।’ ‘অল্প অল্প করে তোলো,’ ইপু বলল। ‘কী করে তুলব? এমনভাবে লেগে রয়েছে, ছোটানোই তো যায় না,’ অবাক হয়ে বলল অঞ্জন। ‘দেখো, টেনেও আলাদা করা যাচ্ছে না।’ ‘টফির মত,’ ইপু বলল। ‘টফি মেশিনে কখনও টফি বানাতে দেখেছ? মস্ত একটা গোল তাল হয়ে গিয়ে ঘুরতে থাকে, ময়দার তালের চেয়ে অনেক বেশি আঠা।’ ‘টফি হলে তো কোন কথাই ছিল না,’ বিড়বিড় করল অঞ্জন। ‘অতি জঘন্য জিনিস।’ দু’জনে একসঙ্গে চেষ্টা করে জেলিটাকে বলের মত বানিয়ে ফেলল ওরা। তারপর ধরাধরি করে তুলে বালতিতে ফেলল। বিশ্রী একটা চটাৎ শব্দ করে বালতির মধ্যে ঢুকে গেল বলটা, বালতি ভরে ফেলল। জেলির ভেতরে হাত আটকে গেল ইপু ও অঞ্জনের। ‘বাপরে বাপ, কী আঠা!’ মুখ বাঁকাল ইপু। ‘মনে হচ্ছে আমার হাত গিলে ফেলছে,’ অঞ্জন বলল। টানাটানি করে অবশেষে হাত দুটো বের করে আনল। শার্টে হাত মুছল। ‘জ্যান্ত প্রাণীর মত চোষে।’ ‘বাড়ি নিয়ে যাও,’ ইপু বলল। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে, সামনের জানালা দিয়ে হাত নেড়ে ওকে যেতে ইশারা করছেন ওর মা। ‘মা আবার ডাকে কেন? অঞ্জন, আমি যাচ্ছি।’ অঞ্জনের গালের ঘুসি খেয়ে ফোলা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল ও। ‘তোমার দাদু দেখলে কী করবেন, কে জানে।’ ‘হয়তো খেয়ালই করবেন না,’ বিষণœ কণ্ঠে জবাব দিল অঞ্জন। বালতির হাতল ধরে তুলে নিল বালতিটা। ‘জঘন্য এই জিনিসটাকে নিয়ে কী করি, বলো তো?’ ‘কাল খেলনার দোকানে নিয়ে যাব। যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে আসাটাই সবচেয়ে নিরাপদ।’ বড় বড় পা ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল ইপু। অঞ্জনের কাছে বুদ্ধিটা বিশেষ গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। কিন্তু তর্ক করারও সাহস হলো না, ইপুর সহযোগিতা হারানোর ভয়ে। বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল ওকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়ে দাদুর বাড়ির দিকে রওনা হলো অঞ্জন। মাথার ভেতরটা দপ্ দপ্ করছে। পেটের ভেতর ব্যথা। বাড়ি পৌঁছে বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে পা টিপে টিপে এগোল গ্যারেজের দিকে, ভুতুড়ে জেলির বালতিটা লুকিয়ে রাখার জন্য। একপাশের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল ভেতরে। বালতিটা মেঝেতে রেখে, ওল্টানো একটা ঠেলাগাড়ির ওপাশে ঠেলে দিল ওটা। দেখল, বালতি ভরে গেছে ভুতুড়ে জেলিতে। ইপুকে যেটুকু দিয়েছিল, সেটুকু বেড়ে গেছে আবার। নাহ্, এই বালতিতেও কুলোবে না, ভাবল অঞ্জন। আরও বড় কিছু খুঁজে বের করা দরকার। স্টোররুমে বড়সড় গামলা কিংবা পিপা পাওয়া যেতে পারে। বড় ট্রাংক জাতীয় কিছু হলেও চলবে। চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকল ও। দাদুর সামনে যাওয়ার আগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে। তাঁকে এখনও রান্নাঘরে ব্যস্ত দেখা গেল। স্টোভের ওপর ঝুঁকে রয়েছেন। হাঁড়িতে নাড়ছেন কিছু। পা টিপে টিপে ওপরতলায় উঠে এল ও। হাত-মুখ ধুয়ে নিল। গালের ফুলে ওঠা লাল হয়ে থাকা জায়গাটার কোনও ব্যবস্থা করতে পারল না। কাপড় বদলে পরিষ্কার একটা প্যান্ট পরল, একটা নতুন শার্ট গায়ে দিল। চুল আঁচড়াল। ডাইনিং রুমের টেবিলে এসে বসতেই দাদুর চোখ পড়ল ফুলে ওঠা গালের দিকে। ‘মারামারি করেছ?’ চোখের পাতা সরু করে তাকালেন তিনি। ‘আমি ওদের সঙ্গে লাগতে যাইনি,’ দাদুর চোখের দিকে তাকাল না অঞ্জন, কাঁটাচামচে করে গরুর এক টুকরো গোশত তুলে মুখে ফেলল। ‘ওরাই গায়ে পড়ে...’ দাদু কানে শোনেন না মনে হওয়াতে থেমে গেল ও। খাওয়ার সময় মাঝে মাঝে অঞ্জনের গালের ফোলা জায়গাটার দিকে তাকালেও এ নিয়ে আর কোন কথা বললেন না দাদু। ওর খারাপ লাগছে কি না, এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই দাদুর, ভেবে মন খারাপ হলো অঞ্জনের। ওর ব্যথা করছে কি না, সেটাও একবার জিজ্ঞেস করলেন না। তাতে অবশ্য একদিক থেকে ভালই হলো। তিনি উদ্বিগ্ন হলে প্রশ্ন করে করে সব জেনে নিতেন, হয়তো ঢাকায় ওর বাবা-মাকেও ফোন করতেন। খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে এল অঞ্জন। দাদুর শুতে যাবার অপো করতে লাগল। বার বার তাকাচ্ছে ঘড়ির কাঁটার দিকে। কিন্তু ওগুলো যেন চলতে চাইছে না। এত আস্তে ঘুরছে, সহ্য হচ্ছে না অঞ্জনের। অবশেষে রাত দশটা বাজল। পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বাইরে বেরোল অঞ্জন। গ্যারেজের দিকে চলল। আঠারো. পরিষ্কার রাত। বাতাস ঠাণ্ডা। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা চিৎকার যেন ঢেউয়ের মত ওঠানামা করছে। কালো আকাশে খুদে বিন্দুর মত ঝলমল করছে তারাগুলো। অঞ্জনের হাতের টর্চের আলো সামনের ড্রাইভওয়েতে গোল হয়ে পড়ে আগে আগে চলেছে। অন্ধকার গ্যারেজটার দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে ওকে। অঞ্জন ভেতরে ঢুকতেই, কালো দেয়ালের কাছে কী যেন খসখস শব্দ করল। হয়তো শুকনো পাতা। আমি যখন দরজা খুলেছি, বাতাসে উড়ে এসে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে পড়েছে। টর্চের আলো ঘোরাল ও। হাতটা কাঁপছে। স্থির থাকছে না আলোটা। ওল্টানো ঠেলাগাড়ির ওপর আলো ফেলল প্রথমে। তারপর ধীর পায়ে ওটার কাছে এসে নিচু হয়ে ঝুঁকে ভুতুড়ে জেলির বালতির দিকে হাত বাড়াল। টান দিল বালতির ঢাকনা ধরে। হাতটা ঘুরে গিয়ে টর্চের আলো পড়ল গ্যারেজের ছাদে। আবার টর্চ ঘুরিয়ে বালতির ভেতর আলো ফেলল ও। দম আটকে গেল নিজের অজান্তেই। হলুদ জেলি থিরথির করে কাঁপছে জীবন্ত প্রাণীর মত। আরেকটু বাড়লে কানা বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। বাপরে বাপ, কত দ্রুত বাড়ছে! শঙ্কিত হলো অঞ্জন। ভারী বালতিটা এক হাতে বয়ে নেয়া খুব কঠিন। টর্চটা বগলে চেপে, দুই হাতে বালতির হাতল ধরল ও। টান দিয়ে তুলে নিল ওটা। যাতে কিনার দিয়ে ছলকে না পড়ে সে-চেষ্টা করতে করতে, অন্ধকারে বালতিটা নিয়ে বাড়ির দিকে চলল ও। বাড়িতে ঢুকে, স্টোররুমে নামার সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল। ভারী বালতিটা নামিয়ে রাখল মেঝেতে। স্টোররুমটা মাটির নিচের ঘরে। ওপরে সিঁড়ির মাথার কাছে একপাশের দেয়ালে বসানো সুইচবোর্ডটা হাতড়ে বের করে সুইচ টিপল। নিচতলার ঘরে জ্বলে উঠল একটা অল্প পাওয়ারের বাল্ব্। ফ্যাকাশে হলদে আলো ছড়িয়ে পড়ল নিচতলার কংক্রিটের মেঝেতে। বালতিটা টান দিয়ে তুলে নিয়ে, ধীরে ধীরে নেমে চলল সিঁড়ি বেয়ে। সাবধান রইল যাতে পা পিছলে পড়ে না যায়। ভার সামলানোর সুবিধের জন্য একপাশের দেয়ালে কাঁধ ঠেকিয়ে রেখেছে। সিঁড়িটা নেমেছে ঘরের ভেতর। সেখানে নেমে ফ্যাকাশে আলো চোখে সয়ে আসার অপো করল ও। দেখল, স্টোররুমটা বেশ বড় একটা ঘর। নিচু ছাদ। ভেজা ভেজা। নানা ধরনের বাক্স ছড়িয়ে পড়ে আছে। কোণের দিকে দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে পুরনো খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনের স্তূপ। কিছু পুরনো ভাঙা আসবাবপত্র আছে। গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত নানা টুকিটাকি বাতিল জিনিস ঢেকে রাখা হয়েছে হলুদ একটা পুরনো বিছানার চাদর দিয়ে। সিঁড়ির গোড়া থেকে সরে এসে সামনে পা বাড়াতেই মুখ ছুঁয়ে গেল কী যেন। চিৎকার দিয়ে হাত থেকে বালতিটা ছেড়ে দিল অঞ্জন, ঝটকা দিয়ে দুই হাত ওপরে তুলে ফেলল। মুখে লাগা জিনিসটা কী, বুঝতে পারল। আঠাল মাকড়সার জাল। খামচি দিয়ে টেনে সেগুলো সরানোর চেষ্টা করল। মুখের চামড়ায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে জ্যান্ত কী যেন। হঠাৎ বুঝতে পারল, মাকড়সা। পোকা-মাকড়কে ভীষণ ভয় পায় ও। পাগলের মত থাবা মেরে ফেলে দিতে চাইল মাকড়সাটাকে। মাটিতে পড়ে আট পায়ে হেঁটে প্রাণীটাকে সরে যেতে দেখেও শান্ত হলো না ও। এখনও গালে লেগে রয়েছে ওটার ছোঁয়া, সুড়সুড়ি লাগছে। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে যেন হৃৎপিণ্ডটা। দেয়ালে লাগানো তাকগুলো চোখে পড়ল। আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি ঘরটায়। সেই আলোয় ভুতুড়ে জেলি রাখার উপযুক্ত একটা পাত্র খুঁজল ওর চোখ। লম্বা জিনিসটা দেখতে পেল। উপুড় করে ফেলে রাখা। অনেকটা নৌকার মত। কী ওটা? ভালমত দেখার জন্য কাছে এগোল। পুরনো আমলের একটা স্টিলের বড় বেসিন। প্রায় ছোটখাটো বেসিনের সমান। বেসিনটা ওল্টাল ও। যথেষ্ট জায়গা। এক নজর দেখেই বুঝে গেল ও, এটাতে রাখা যাবে। বালতিটা বয়ে নিয়ে এল বেসিনটার কাছে। ভেতরে ঢালার জন্য উঁচু করতেই ব্যথা লাগল পেটের পেশিতে, যেখানে ঘুসি মেরেছিল হারু-তরু। তীè ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে। গুঙিয়ে উঠল ও। বেসিনের কিনারে বালতিটা খাড়া করে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুণ, ব্যথা চলে যাওয়ার অপোয়। আস্তে আস্তে ব্যথা কমে এলে কাত করে দিল বালতিটা। ঘন হলুদ জেলির মত জিনিসটা থ্যাপ্ থ্যাপ্ করে বিশ্রী শব্দ তুলে ঝরে পড়ল বেসিনের ভেতর। বেসিনটা ভরতে কত সময় লাগবে? মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করল অঞ্জন। এটাও যদি ভরে যায়, তখন কী করবে? যখনকার চিন্তা তখন, এখনই ভেবে মাথাটাকে আর গরম করতে চাইল না। ‘মিঁআঁওঁ!’ করে তীè এক চিৎকার শোনা গেল। ভীষণ চমকে ঘুরে দাঁড়াতে গেল অঞ্জন। তার আগেই পিঠে এসে পড়ল কালো বিড়ালটা। কুসি। উনিশ. ঝাড়া দিয়ে পিঠ থেকে বিড়ালটাকে ফেলতে চাইল অঞ্জন। ওর শার্টে থাবার নখ বসিয়ে দিয়ে প্রায় ঝুলে রইল বিড়ালটা। আরেকবার তীè চিৎকার করে উঠল। ওটার নখের আঁচড় লাগছে অঞ্জনের পিঠের চামড়ায়। বিড়ালটাকে ফেলতে না পেরে রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড করল ও। চিত হয়ে পড়ল বেসিনের মধ্যে। জেলিতে ডুবিয়ে মারতে চাইল বিড়ালটাকে। কিন্তু ওটা ওর চেয়ে অনেক বেশি প্রি। যেন অঞ্জনের ইচ্ছে বুঝতে পেরেই লাফ দিয়ে সরে গেল সময়মত, মেঝেতে গিয়ে পড়ল। আর আঠাল জেলিতে পিঠ ডুবে গেল অঞ্জনের। চিত হয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়েছে। চার হাত-পা বেসিনের বাইরে। মাথাটা বেসিনের ভেতর। হাত-পা ছুড়ে নিজেকে তোলার চেষ্টা করল ও। কিন্তু আঠাল পদার্থ বিস্ময়কর শক্তিতে টান দিয়ে ওকে নামিয়ে নিতে চাইছে। ওর শরীর আটকে গেছে, সিমেন্টে আটকানোর মত। কেঁপে কেঁপে, নীরবে বুদবুদ ছড়াতে ছড়াতে যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে ভয়াল ওই ভুতুড়ে জেলি। ওর মুখের কাছে উঠে আসছে। দম বন্ধ করে মারবে আমাকে! ভাবনাটা অবশ করে দিল যেন ওকে। জিনিসটার উষ্ণতা ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল, ওর বুকে, ওর পিঠে, ওর গলায়। আমি নড়তে পারছি না! আমি আটকে গেছি! জিনিসটা আমাকে দম আটকে মারতে চায়! মুখে আঠা আঠা উষ্ণ ছোঁয়া লাগতে ঝটকা দিয়ে মাথা উঁচু করল অঞ্জন। মুচড়ে মুচড়ে দেহ থেকে আঠার আকর্ষণ ছাড়িয়ে নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করল। বহু কষ্টে, হাঁপাতে হাঁপাতে, চিৎকার দিয়ে, কোনমতে দেহটাকে উঁচু করল, বসার ভঙ্গিতে। আরও উঁচু হয়ে গেল হলুদ জিনিসটা, ধরতে চাইছে ওকে, টেনে নামিয়ে নিতে চাইছে বেসিনের মধ্যে। দুই হাতে বেসিনের কিনার চেপে ধরল অঞ্জন। হাতের ওপর ভর করে গায়ের জোরে নিজেকে টেনে তুলতে লাগল। ওপরে! আরও ওপরে! দেহটা বের করে আনছে ঘন জেলি থেকে। কিন্তু ও শক্তি বাড়ালে জিনিসটাও বাড়ায়, কিছুতেই ওকে বেরোতে দিতে রাজি নয়। ওপরে। ওপরে। আবার চিৎকার করে উঠল অঞ্জন, হলুদ জেলি লাফ দিয়ে ওর কাঁধে উঠে পড়েছে। জিনিসটা ওর কাঁধ চেপে, গলার চারপাশ ঘিরে ধরে টেনে নামানোর চেষ্টা করল। নিচে নামাচ্ছে। নিচে। আমাকে কাবু করে ফেলেছে, ভাবল অঞ্জন। আর মুক্তি নেই আমার। চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। আঠাল জেলি ওর গলা চেপে ধরেছে। ফুটফুট করে বুদবুদ বেরোচ্ছে হলুদ তালটা থেকে। টানছে ওকে। টেনে নামাচ্ছে। ‘না!’ চেষ্টা করো, নিজেকে বোঝাল অঞ্জন। মাথা ওপরে তোলো। থেমো না। চালিয়ে যাও। উঠছে। উঠছে। হ্যাঁ! বেসিনের কিনার চেপে ধরে, নিজেকে ওপরে ঠেলছে অঞ্জন। টেনে তুলছে। তুলছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। হ্যাঁ! হ্যাঁ! পরাজিত করছে জ্যান্ত জেলিটাকে। জোরে আরেক টান দিলেই বেসিন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে অঞ্জন। দাঁতে দাঁত চেপে জোরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ও। হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল ঠাণ্ডা মেঝেতে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ নড়াচড়া টের পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে কুসি। মাথাটা একপাশে কাত করা, হলুদ চোখ দুটো জ্বলছে। প্রচণ্ড রাগে লাফিয়ে উঠে বিড়ালটাকে তেড়ে গেল অঞ্জন। ধাঁ করে লাথি মারল। কিন্তু লাগাতে পারল না। অবিশ্বাস্য প্রিতায় লাফ দিয়ে সরে গেল বিড়ালটা। লাফাতে লাফাতে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। বিশ. সারাটা রাত ভাল ঘুম হলো না অঞ্জনের। অস্থির হয়ে রইল ঘুমের মধ্যেও। বার বার দুঃস্বপ্ন দেখে, চমকে চমকে জেগে ওঠে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হলুদ প্যাড আর একটা মার্কার পেন নিয়ে এল নাস্তার টেবিলে। ‘এ অবস্থা কেন?’ ভুরু নাচালেন দাদু। এক বাটি খই রাখলেন ওর সামনে। ‘ডাস্টবিনে পড়েছিলে? না বিড়ালে ধাক্কা দিয়েছিল?’ যেন খুব রসিকতার কথা বলে ফেলেছেন। মাথা নাড়তে নাড়তে হা-হা করে হাসলেন তিনি। ‘বিড়ালে ধাক্কা দিয়েছিল, আপনি জানলেন কী করে?’ বলেই মনে পড়ল অঞ্জনের, জবাব পাবে না, কানে শোনেন না দাদু। খইয়ের বাটিটাকে ঠেলে সরিয়ে হাতের প্যাডটা দেখাল। ‘খই সরালে কেন? পুতিয়ে যাবে তো,’ আবার বাটিটা ওর সামনে ঠেলে দিলেন দাদু। ‘না খেলে ভিটামিন পাবে না, শক্তি পাবে না শরীরে। তখন কুসি আরও সুযোগ পাবে।’ ‘ওই বিড়ালটার আমি ঘাড় না মটকেছি তো কী বললাম! খালি সুযোগ পেয়ে নিই।’ বিড়বিড় করে বলে লিখতে শুরু করল প্যাডে। অঞ্জনকে লিখতে দেখে আগ্রহী হলেন দাদু। টেবিলের পাশ ঘুরে এসে ওর পেছনে দাঁড়ালেন। প্যাডের দিকে চোখ। বড় বড় অরে লিখল অঞ্জন : দাদু একটা ভীষণ সমস্যায় পড়েছি। আপনার সাহায্য দরকার। স্টোররুমে একটা বেসিন হলুদ রঙের ভুতুড়ে জেলিতে ভর্তি হয়ে গেছে। বেড়েই চলেছে ওটা। কোনমতেই থামাতে পারছি না। কলম রেখে প্যাডটা দাদুর সামনে উঁচু করে ধরল অঞ্জন। চেয়ারে বসেই ফিরে তাকাল দাদুর দিকে। তাঁর ফ্যাকাশে মুখে সকালের রোদ পড়েছে। হঠাৎ করেই দাদুকে অনেক বয়স্ক লাগল। দ্রুত চোখ বোলালেন অঞ্জনের লেখায়। ঠোঁট দুটো পরস্পরের সঙ্গে চেপে বসেছে। অধীর হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন। অবশেষে চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়ল দাদুর ঠোঁটে। পেছনে মাথা ঝাঁকি দিয়ে হেসে উঠলেন তিনি। অবাক হলো অঞ্জন। চেয়ারটা পেছনে ঠেলে সরিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর কাঁধে হাত রেখে ঠেলা দিলেন দাদু। ‘বুড়ো মানুষের সঙ্গে রসিকতা করে কোন লাভ আছে?’ আবার টেবিল ঘুরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসলেন। ‘তোমার বাবার সঙ্গে একটা পার্থক্য তোমার আছে, ও সারাণ মুখ গোমড়া করে রাখত, কিন্তু তোমার মধ্যে রসবোধ আছে।’ ‘দুর, আমি কী বোঝাতে চাইলাম, আর বুড়িটা কী বুঝল!’ চেঁচিয়ে বলে আছাড় দিয়ে প্যাডটা টেবিলে রাখল অঞ্জন। ওর রাগ দেখে হা-হা করে হাসলেন দাদু। তাতে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল অঞ্জনের। জ্বলন্ত চোখে তাকাল। হাত দুটো মুঠো হয়ে গেল। দেখেও যেন দেখলেন না দাদু। ‘ভুতুড়ে জেলি! কী কল্পনা!’ হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেছে দাদুর। হাত দিয়ে মুছলেন। ‘যাও, বাইরে যাও। খেলা করোগে। আজেবাজে কথা ভেবে মাথা গরম কোরো না।’ গটগট করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল অঞ্জন। ওপরে নিজের ঘরে চলে এল। পরনের ময়লা কাপড়গুলো খুলে ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। পরিষ্কার কাপড় পরল। বুড়িটা ওর কথা বিশ্বাস করল না, ভাবছে অঞ্জন। এখন ইপু যা বলেছিল, তাই করতে হবে। দোকানে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে ভুতুড়ে জেলি। ইস্, কোন কুণে যে কৌটাটার ওপর চোখ পড়েছিল ওর! ইপুকে ফোন করল অঞ্জন। কাঁপা হাতে নম্বর টিপল। ইপু জানাল, খেলনার দোকানটা সকাল ১০টায় খোলে। বিশ মিনিটের মধ্যে কাছের মোড়টায় দেখা করবে। রিসিভার রেখে দিল অঞ্জন। গ্যারেজে রওনা হলো বড় প্লাস্টিকের বস্তা আনার জন্য। * ঠিক সময়ে হাজির হলো ইপু। প্লাস্টিকের একটা বাজারের ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে ভুতুড়ে জেলি, ওর কাছে যতখানি ছিল। সাইকেলের হ্যান্ডেল বারে ঝুলিয়ে এনেছে। আরও একবার, ইপুর সাইকেলের পাশে পাশে চলতে হলো অঞ্জনকে। তবে এবার আর দৌড়াতে পারল না। ওর হাতের বস্তাটা এতই ভারী, ফুটপাথ ধরে প্রায় টেনেহিঁচড়ে নিতে হলো। ‘বেসিনটাও ভর্তি হয়ে গিয়েছিল,’ ইপুকে বলল অঞ্জন। মোড়ের কাছে এসে রাস্তার একটা খাঁজে আটকে গেল ভারী বস্তার কোনাটা। টেনে সরাতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল ও। ‘বস্তা ফেটে বেরিয়ে না গেলেই এখন বাঁচি।’ ‘আর মাত্র দুটো বাড়ি, সেগুলো পেরোলেই দোকানটা,’ আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করল ওকে ইপু। রাস্তায় ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গতি কমাল একটা ট্যাক্সি। জানালা দিয়ে মুখ বের করে হাসল তরুণ ড্রাইভার। চলে গেল গাড়িটা। বস্তাটার দিকে অবাক চোখে তাকাচ্ছে পথচারীরা। একজন মহিলাকে বস্তার দিকে তাকিয়ে থেমে যেতে দেখে হাত নাড়ল ইপু, ‘হাই, আন্টি।’ মহিলা ওর মায়ের বান্ধবী। জবাবে হাত নেড়ে, দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ইপুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের দিকে চলে গেলেন তিনি। সাইকেল থেকে নামল ইপু। ঠেলে নিয়ে চলল সাইকেলটা। অঞ্জন ওর বস্তাটা প্রায় হিঁচড়ে নিয়ে এগোল। পরের বাড়িটার কাছে এসে, রাস্তা পেরিয়ে, খেলনার দোকানের দিকে চলল দু’জনে। কিন্তু রাস্তার মাঝখানেই থমকে দাঁড়াল। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে। দোকানের দরজায় তালা ঝোলানো। জানালাগুলোও বন্ধ। হাতে লেখা ছোট একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে দোকানের দরজায়। তাতে লেখা : দোকান বন্ধ। একুশ. জঘন্য জিনিসটার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া অঞ্জন। বস্তাটা টেনে এনে দোকানের সামনে রাখল। কিল মারতে শুরু করল দরজায়। আশা, যদি ভেতরে কেউ থেকে থাকে। ‘এই, শুনছেন? ভেতরে কেউ আছেন? দরজা খুলুন!’ চেঁচিয়ে বলল ও। সাড়া নেই। দুই হাতে আরও জোরে কিল মারতে শুরু করল। কোন জবাব এল না ভেতর থেকে। হাত ধরে টেনে ওকে সরিয়ে আনল ইপু। ‘দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে,’ বলল পাশের দোকানের এক কর্মচারী। ‘ব্যবসায় লোকসান দিয়ে চলে গেছে। দেখছ না, দরজা-জানালা বন্ধ, সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে।’ ‘হ্যাঁ, তা তো পাচ্ছি,’ বিড়বিড় করল অঞ্জন। ধুম করে কিল মারল দরজার গায়ে। ‘আমারে সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে।’ ‘দোকানদারের দোষ কী? তোমাকে তো মানা করেছিল এটা কিনতে,’ ইপু বলল। ‘কিল মারা বন্ধ করো, অঞ্জন। হাতে ব্যথা পাবে।’ ‘এখন কী করব?’ অঞ্জনের প্রশ্ন। ‘আর কোন নতুন বুদ্ধি বের করতে পেরেছ?’ মাথা নাড়ল ইপু। ‘আমি তো একবার বুদ্ধি বের করলাম। এবার তোমার পালা, তুমি করো।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল অঞ্জন। ‘দাদুকে বস্তাটা দিয়ে বলতে পারি, এর ভেতর গরুর গোশত আছে। তখন বড় ছুরিটা দিয়ে মারবে বস্তার গায়ে কোপ।’ ‘তোমার মাথাটা ঠিক নেই, অঞ্জন,’ ইপু বলল। সহানুভূতি দেখিয়ে একটা হাত রাখল অঞ্জনের কাঁধে। বস্তার দিকে তাকিয়ে আছে দু’জনেই। ভেতরেও বাড়ছে মনে হলো হলুদ জেলি, নড়াচড়া করছে, যেন শ্বাস নিচ্ছে। বস্তা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দেখে ভয় পেয়ে গেল অঞ্জন। ‘চলো, বাড়ি ফিরে যাই,’ গলা কাঁপছে ওর। ‘যেতে যেতে দেখি কিছু ভেবে বের করা যায় কি না।’ বহু কসরৎ করে বস্তাটা দাদুর বাড়িতে টেনে নিয়ে এল ওরা। ভাগ্যিস, ফাটেনি। আকাশের অনেক ওপরে চড়েছে সূর্যটা। পেছনের আঙিনায় যখন পৌঁছল, ঘেমে নেয়ে গেছে অঞ্জন। হাত ব্যথা করছে। মাথা দপ্ দপ্ করছে। ‘আনলাম তো, এখন?’ দুর্বল কণ্ঠে বলল অঞ্জন। ফোলা বস্তাটা ছেড়ে দিয়ে ইপুর দিকে তাকাল। গ্যারেজের দেয়ালে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে রাখল ইপু। হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগের ভেতর বেড়েছে ভুতুড়ে জেলি। গ্যারেজের দরজার পাশে ফেলে রাখা অ্যালুমিনিয়ামের বড় ট্র্যাশ ক্যানটা দেখাল ও। ‘ওই ড্রামে ভরলে কেমন হয়? অনেক বড়ই তো দেখা যাচ্ছে, জায়গা হয়ে যাবে।’ ভাল করে দেখার জন্য ওটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও। ‘ঢাকনাটাও ঠিকমত আটকায়।’ ‘হুঁ!’ খুব একটা আশা করতে পারছে না আর অঞ্জন। শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। ঢাকনাটা টান দিয়ে তুলল ইপু। তারপর নিজের ব্যাগটা উপুড় করে ঢেলে দিল। থ্যাপাৎ করে বিশ্রী শব্দ তুলে ড্রামের তলায় পড়ল এক তাল আঠাল পদার্থ। নিজের বস্তাটা ড্রামের কাছে টেনে আনল অঞ্জন। তুলতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল, ‘যা ভারী!’ ‘দাঁড়াও, আমিও ধরি,’ ইপু বলল। দু’জনে মিলে বস্তাটা ড্রামের মুখের কাছে উঁচু করে ধরল। বস্তার মুখের দিকটা রইল ড্রামের ভেতরে, কাত হয়ে। পেছনটা ধরে রাখল ইপু। অঞ্জন বস্তার মুখে বাঁধা দড়ি খুলে দিল। হড়হড় করে ড্রামে পড়তে লাগল ভুতুড়ে জেলি। ড্রামের গায়ে বাড়ি খেয়ে ঘিনঘিনে শব্দ তুলল। ওপরে লাফিয়ে উঠতে লাগল এমনভাবে, যেন লাফ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অঞ্জন। ঢাকনাটা তুলে লাগিয়ে দিল ড্রামের মুখে। দুই পাশের হ্যান্ডেল দুটো চেপে বসিয়ে দিল ঢাকনার ওপর। ‘উহ্, বাঁচা গেল!’ ইপু বলল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ড্রামটার দিকে তাকিয়ে রইল দু’জনে। ভয় পাচ্ছে, যেন ঢাকনাটা ঝটকা দিয়ে খুলে যাবে। ‘এখন কী করব?’ ভয় যাচ্ছে না অঞ্জনের। জবাব দিতে যাচ্ছিল ইপু, দাদুকে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল। পেছনের আঙিনায় চোখ বোলাচ্ছেন তিনি। ওদের ওপর চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে বললেন, ‘অঞ্জন, তোমার সুখবর আছে!’ ট্র্যাশ ক্যানটার দিকে চট করে তাকাল আরেকবার অঞ্জন। তারপর ছুটল দাদুর দিকে। ইপু চলল ওর পেছন পেছন। দাদুর হাতে একটা কাগজ। চিঠি। ‘আজ বিকেলেই তোমাকে নিতে আসছে তোমার মা,’ দাদুর মুখে চওড়া হাসি। আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল ও। এখানে আসার পর এই প্রথম একটা খুশির খবর পেয়েছে, সবচেয়ে খুশির খবর। ‘আমি চলে যাব! চলে যাব!’ বলে চেঁচাতে লাগল অঞ্জন। দাদু ফিরে যাচ্ছেন রান্নাঘরে। ‘আমি চলে যাব! ইপু, আর থাকতে হবে না এখানে!’ কিন্তু ইপুকে দেখে খুশি মনে হলো না। হাত তুলে ড্রামটা দেখিয়ে বলল, ‘ওটার কী হবে?’ ‘যা হয় হোকগে। ড্রামে ভরে ঢাকনা আটকে রেখেছি, আর বেরোতে পারবে না ভুতুড়ে জেলি,’ অঞ্জন বলল। ‘আমি এখান থেকে পালাতে পারছি, এটাই বড় কথা!’ ‘কিন্তু কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? তোমার দাদু ঢাকনা খুলবেন, লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসবে ওই শয়তান জেলি। তিনি কি তখন সামলাতে পারবেন? ভুতুড়ে জেলির কথা বড়দের কাউকে জানানো উচিত। কিংবা এটার একটা ব্যবস্থা করা উচিতÑতুমি চলে যাওয়ার আগে। কৌটাটা কিনে এনে সমস্যাটা সৃষ্টি করেছ, এটা ভুলে গেলে চলবে না।’ তাই তো, এটা তো ভাবেনি! হাসি চলে গেল মুখ থেকে। আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। হঠাৎ ঘেউ ঘেউ শুনে ফিরে তাকাল অঞ্জন। নিজের ঝামেলা আর অতি উত্তেজনায় কুকুরটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। ফিরে তাকাল খোঁয়াড়ের দিকে। ‘কী হয়েছে, নেড়ি? এই নেড়ি!’ ডাকতে ডাকতে খোঁয়াড়ের দিকে দৌড় দিল ও। বাইশ. টান দিয়ে গেটটা খুলেই থমকে গেল অঞ্জন। ‘নেড়ি!’ যে কুকুরটা অঞ্জনের দিকে দৌড়ে এল, ওটা দেখতে নেড়ির মতই, কিন্তু আকারে টাট্টু ঘোড়ার সমান হয়ে গেছে। আগে যা ছিল, এখন তার দ্বিগুণ বড়। ‘না!’ উত্তেজিত কুকুরটাকে আসতে দেখে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়ল অঞ্জন। ‘এই, দাঁড়া, দাঁড়া, গায়ের ওপর উঠিস না।’ অঞ্জন উঠে দাঁড়ানোর আগেই ভয়ঙ্করভাবে চেঁচানো শুরু করল নেড়ি। মস্ত পায়ের থপ্ থপ্ শব্দ তুলে পেছনের আঙিনা পেরিয়ে রাস্তার দিকে ছুটল কুকুরটা। ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না!’ চেঁচিয়ে উঠল ইপু। দুই হাত মুখের কাছে। তাকিয়ে আছে বাড়ির পাশ দিয়ে যেদিকে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেছে কুকুরটা সেদিকে। ‘বাপরে বাপ, কত্তবড় হয়েছে!’ ‘ওকে থামানো দরকার! নইলে কাকে আবার আক্রমণ করে বসে!’ চেঁচিয়ে বলল ইপু। ‘নেড়ি! নেড়ি! জলদি আয়!’ পাগলের মত ডাকতে ডাকতে পেছনে ছুটল অঞ্জন। না দেখে ইপুর সাইকেলটায় পা বেঁধে গিয়ে পড়ল ট্র্যাশ ক্যানটার ওপর। ‘না!’ চেঁচিয়ে উঠল ও। অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখল, ধাক্কা লেগে কাত হয়ে যাচ্ছে ড্রামটা। ঝনাৎ করে পাকা রাস্তায় পড়ল ওটা। অঞ্জনও পড়ে গেল ওটার সঙ্গে। ঢাকনাটা খুলে গিয়ে চাকার মত গড়িয়ে চলে গেল। ড্রাম থেকে গড়িয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল হলুদ জেলি। অবিশ্বাস্য দ্রুত ড্রামের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ভুতুড়ে জেলি। সরে গেল ড্রামের মুখের কাছ থেকে, যেন ওই বন্দিশালার ভেতরে ঢুকতে চায় না আর। থিরথির করে কাঁপছে, বিশ্রী শব্দ করছে, কী করবে যেন বোঝার চেষ্টা করছে। তারপর আচমকা নিজেকে টেনে লম্বা করে থামের মত খাড়া হয়ে দাঁড়াল। আতঙ্কিত চোখে ওটার দিকে তাকিয়ে আছে দু’জনে। কাঁপতে থাকা হলুদ জেলির তালটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, নবজাত ঘোড়ার বাচ্চার মত টলতে টলতে নিজেকে খাড়া রাখার চেষ্টা করছে। বারবার আকার বদলাচ্ছে, ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকানোর ভঙ্গিতে ঘোরাচ্ছে ওপর দিকটা। তারপর, জোরাল একটা শব্দ করে, ধনুকের মত বাঁকা হয়ে লাফ দিল অঞ্জনকে ল্য করে। অঞ্জন তখনও পড়ে রয়েছে মাটিতে। ‘ওঠো, অঞ্জন!’ চেঁচিয়ে উঠল ইপু। ‘জলদি ওঠো! তোমার গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাবে তো!’ তেইশ. বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। লাফাতে লাফাতে ওর দিকে ছুটে আসছে হলুদ জেলির তাল। আরেকবার বুনো চিৎকার দিয়ে গড়িয়ে সরে গেল ও। ‘পালাও, অঞ্জন!’ আবার চেঁচিয়ে বলল ইপু। একটা হাত বাড়িয়ে দিল অঞ্জনের দিকে। হাত ধরে টেনে তুলল। ‘জ্যান্ত হয়ে গেছে ওটা! জলদি পালাও!’ গ্যারেজের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজেকে খাড়া করে ফেলল হলুদ জেলি। একটা সেকেন্ড যেন দেয়াল কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর খোসা ছাড়ানোর মত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটে এল ওদেরকে ল্য করে। ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ ‘প্লিজ, বাঁচাও আমাদের!’ গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড় দিল দু’জনে। আগে আগে রয়েছে ইপু। পেছনে অঞ্জন। ভয়ে পা দুটো দুর্বল লাগছে ওর, মনে হচ্ছে যেন রাবার হয়ে গেছে। ড্রাইভওয়ে ধরে সামনের আঙিনার দিকে ছুটছে ইপু। চেঁচাচ্ছে, ‘বাঁচাও, বাঁচাও, প্লিজ, বাঁচাও আমাদের!’ অঞ্জনও চেঁচাতে চাইছে, কিন্তু খসখসে হয়ে গেছে গলা, ঠিকমত স্বর বেরোতে চাইছে না। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। মাথার চাঁদি দপ্ দপ্ করছে। ছুটতে ছুটতেই ঘুরে তাকিয়ে দেখল, ঠিক ওদের পেছনেই রয়েছে ভুতুড়ে জেলি। গতি বাড়ছে ক্রমেই। প্রতিটি লাফের সঙ্গে বিশ্রী শব্দ করছে। ঢেব। ঢেব। ঢেব। মাটিতে, ঘাসের মধ্য থেকে কেঁচো টেনে বের করছিল একটা দোয়েল, জেলির তালটাকে আসতে দেখেনি, চাপা পড়ে গেল ওটার নিচে। গুঙিয়ে উঠল অঞ্জন। ফিরে তাকিয়ে দেখল, দোয়েলটা আটকা পড়েছে হলুদ বলের গায়ে। ডানা নেড়ে ছাড়া পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল, শেষ চিৎকার দিল একটা, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল জেলির ভেতরে। ঢেব। ঢেব। ঢেব। দিক পরিবর্তন করল ভুতুড়ে জেলি। একইভাবে লাফাচ্ছে, কাঁপছে, প্রতিটি লাফের সঙ্গে ঘাসের ওপর বড় বড় দাগ রেখে আসছে। মনে হচ্ছে, গোলাকার অদ্ভুত পদচিহ্ন। ‘ওটা সত্যিই জ্যান্ত হয়ে গেছে!’ চেঁচিয়ে বলল ইপু। দুই হাতে গাল চেপে ধরেছে। ‘জ্যান্ত জেলির বল!’ ‘কী করব আমরা এখন? কী করব?’ নিজের আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরটাকে নিজের কানেই অপরিচিত লাগল অঞ্জনের। ‘ধরে ফেলছে আমাদের!’ অঞ্জনের হাত ধরে টানল ইপু। ‘পালাও!’ জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির সামনের দিকে ছুটল ওরা। ‘এই, কী হচ্ছে?’ শোনা গেল একটা পরিচিত কণ্ঠ। ‘এই?’ চমকে দাঁড়িয়ে গেল অঞ্জন। ফুটপাথের দিকে ফিরে তাকাল। হারু-তরু দাঁড়িয়ে আছে, দু’জনের গোলগাল মুখে অবিকল এক রকম হাসি। ‘আরে, আমার প্রিয় ঘুসি প্র্যাকটিসের বালিশটা যে,’ এক ভাই বলল অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে। ঘুসি উঁচিয়ে ভয় দেখাতে চাইল অঞ্জনকে। দু’জনেই এগিয়ে এসে ড্রাইভওয়েতে ঢুকল। তারপর হঠাৎ উজ্জ্বল হাসি মলিন হতে হতে উধাও হয়ে গেল, নিচের চোয়াল ঝুলে হাঁ হয়ে গেছে, আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে বিশাল হলুদ তালটার দিকে, ড্রাইভওয়ে ধরে লাফাতে লাফাতে ছুটে আসছে। ‘সরে যাও!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘পালাও!’ ইপু বলল। কিন্তু এতটাই চমকে গেছে দুই ভাই, নড়ার মতাও হারিয়ে ফেলেছে যেন। প্রচণ্ড আতঙ্কে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে ওদের, কোটর থেকে ঠেলে বেরোনোর জোগাড়। ঢেব। ঢেব। ঢেব। ক্রমেই গতি বাড়ছে মস্ত জেলির তালটার। লাফাতে লাফাতে সোজা এসে পড়ল পাশাপাশি দাঁড়ানো দুই ভাইয়ের গায়ের ওপর। ধাক্কা লাগার ধ্যাপাৎ শব্দটা কানে আসতেই চোখ বুজে ফেলল অঞ্জন। ‘বাবাগো!’ ‘মেরে ফেলল!’ চিৎকার করছে দুই ভাই। চিত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওদের গায়ের কাছে ঢেব ঢেব করে লাফাচ্ছে হলুদ জেলি। হাত ছুড়ছে। আঠাল হলুদ জেলির কবল থেকে নিজেদের রা করার জন্য ছটফট করছে। ‘বাঁচাও আমাদের!’ ‘প্লিজ, অঞ্জন, কিছু একটা করো!’ ককিয়ে উঠল দুই ভাই। হঠাৎ দৌড় দিল অঞ্জন। চিৎকার করে বলল, ‘এই জেলির বল, এই, এদিকে! আমাকে ধর!’ জ্যান্ত প্রাণীর মত থমকে গেল বলটা। কাকে আগে ধরবে, দ্বিধায় পড়ে গেছে যেন। ‘হারু-তরু, জলদি পালাও!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ‘বেশিণ আটকে রাখতে পারব না দানবটাকে।’ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দুই ভাই। হাড় চোষার মত বিশ্রী, ভুতুড়ে শব্দ করছে জেলির তালটা। তড়াক করে অঞ্জনের দিকে এক লাফ দিল। তৈরি ছিল অঞ্জন। লাফিয়ে সরে গেল একপাশে। ততণে পড়িমরি করে দৌড়াতে শুরু করেছে দুই ভাই। বরফের মত জমে গেছে যেন ইপু। কী করবে বুঝতে পারছে না। ‘আমি সিঁড়ির দিকে যাচ্ছি, তুমি গেটের দিকে যাও!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। ‘একসঙ্গে দু’জনের পিছু নিতে পারবে না ওটা!’ ‘কিন্তু...’ বলতে গেল ইপু। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই সামনের বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল অঞ্জন। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে খুলে গেল বাড়ির সামনের দরজা। দাদু বেরিয়ে এলেন। ‘এই, এত চেঁচামেচি কিসের?’ দরজার পাল্লা আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে বললেন তিনি। হলুদ তালটার দিকে চোখ পড়তেই বড় বড় হয়ে গেল চোখ। তাঁর চিৎকারে অঞ্জনের দিক থেকে ঘুরে গেল হলুদ বল। দাদুর দিকে ফিরল। বরফের মত জমে গেলেন যেন দাদু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলেন যেন যা দেখছেন ঠিক দেখছেন কি না। তারপর, সামনের দরজাটা খুলে রেখেই পাক খেয়ে ঘুরে দৌড়ে চলে গেলেন ঘরের ভেতর। ঢেব। ঢেব। সামনের সিঁড়ির কাছে দ্বিধা করতে লাগল ভুতুড়ে জেলি। এক জায়গায় থেকে লাফাতে লাগল, একবার, দুবার, তিনবার। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে অঞ্জন। ঘন ঘন শ্বাস টানছে। বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইপু। লাফাতে লাফাতে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ভুতুড়ে জেলি, জোরে এক লাফ দিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ল। ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। ‘সর্বনাশ!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘দাদুকে মেরে ফেলবে!’ এ সময় ঘরের ভেতর থেকে শোনা গেল দাদুর রক্ত জমাট করা চিৎকার। চব্বিশ. তিন লাফে সিঁড়ি ডিঙিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ল অঞ্জন। ‘কী করছ?’ পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল ইপু। ‘দাদুকে বাঁচাতে হবে,’ জবাব দিল অঞ্জন। খোলা দরজা দিয়ে ছুটে ঢুকল ঘরের ভেতর। ছোট্ট ঘরটার মাঝখান জুড়ে রয়েছে মস্ত জেলির তালটা। নাচছে, কাঁপছে, লাফাচ্ছে, কার্পেটে আঠাল রস লাগাচ্ছে, ছাপ ফেলছে। দেয়ালের কাছে দাদুকে কোণঠাসা করে ফেলেছে জেলির তাল। ‘পালান, দাদু, পালান!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। বলেই মনে পড়ল দাদু কানে শোনেন না। তা ছাড়া, পালানোর পথ নেই দাদুর, নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে। ‘বেরোও এখান থেকে, বেরিয়ে যাও!’ অঞ্জনকে চেঁচিয়ে বললেন দাদু। তীè, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর। ‘কিন্তু দাদু...’ ‘এখুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে!’ আবার চেঁচিয়ে বললেন দাদু। মাথার চুল এলোমেলো। কটা চোখের তীè দৃষ্টি হলুদ তালটার ওপর স্থির। যেন মনের জোরে ওটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কী করবে বুঝতে পারছে না অঞ্জন। ইপুও ঢুকেছে। দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জনের পেছনে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। অঞ্জনের দাদুর দিকে জেলির তালটাকে এগোতে দেখে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ‘বেরোও!’ আবার তীèস্বরে চিৎকার করে বললেন দাদু। ‘নিজেরা বাঁচো। আমার কথা ভেবো না। আমি এটা বানিয়েছি! এখন আমাকেই খেসারত দিতে হবে!’ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না অঞ্জন। কী বলছেন দাদু! মাথা ঘুরছে অঞ্জনের। ঘরটা দুলছে, বনবন করে ঘুরছে মনে হলো। দাদু যে আর্ম চেয়ারটায় বসেন সেটার পেছনটা আঁকড়ে ধরে পতন ঠেকাল। কয়েক দিন আগের দৃশ্যগুলো ফুটে উঠল মনের পর্দায়। দাদুর গলায় ঝোলানো হাড়ের লকেটটার কথা মনে পড়ল, সারাণ পরে থাকেন তিনি। মনে পড়ল, স্টাডিতে তাক ভর্তি রহস্যময় বইগুলোর কথা। ‘আমি এটা বানিয়েছি! এখন আমাকেই খেসারত দিতে হবে!’ দাদুর কথার মানে পরিষ্কার হয়ে আসছে অঞ্জনের কাছে। খেলনার দোকান থেকে ভুতুড়ে জেলির কৌটাটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। হাতে নিয়ে দেখছিলেন দাদু। দুই হাতের তালুতে চেপে ধরে রেখেছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। লেবেলটার দিকে তাকিয়েছিলেন। ঠোঁট নড়ছিল। মনে হচ্ছিল, লেবেল পড়ছেন। আসলে কী করছিলেন তিনি? ‘সাবধান,’ কৌটাটা ফিরিয়ে দেয়ার পর বলেছিলেন তিনি। ‘খুব সাবধান।’ তার মানে এটা বিপজ্জনক জানতেন বলেই সাবধান করেছিলেন। ‘আপনি এ কাজ করেছেন!’ চিৎকার করে বলল অঞ্জন, এমন এক কণ্ঠে, নিজের কাছেই অচেনা লাগল। কথাগুলো যেন বিস্ফোরিত হলো ওর মুখ থেকে। ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। ‘হ্যাঁ, আপনিই এ কাজ করেছেন। কৌটার খেলনাকে আপনি জাদু করে দিয়েছিলেন!’ দাদুর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলল ও। তাঁর কথা নিশ্চয় শোনেননি তিনি, অঞ্জন ভাবছে, তবে আমার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেই বুঝতে পেরেছেন। তাঁর কটা চোখে পানি টলমল করতে লাগল। পানিতে ভরে গিয়ে ফ্যাকাশে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছেন তালটার দিকে দাদু।। ‘ঢেব ঢেব’ আওয়াজ তুলে তাঁর সামনে ক্রমাগত লাফাচ্ছে বিশাল জেলির তালটা, প্রায় আড়াল করে ফেলেছে তাঁকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁর। ‘আমি ইচ্ছে করে করিনি! ও করিয়েছে আমাকে দিয়ে!’ আঙুল তুললেন তিনি। পঁচিশ. অঞ্জনের মনে হলো ইপুর দিকে আঙুল তুলেছেন দাদু। ঘুরে তাকিয়ে বুঝতে পারল, ইপু নয়, ওর পেছনে দাঁড়ানো কুসিকে দেখাচ্ছেন। লিভিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে, পিঠ বাঁকিয়ে, রাগে ফোঁস-ফোঁস করছে বিড়ালটা, জ্বলন্ত হলুদ চোখে তাকিয়ে আছে দাদুর দিকে। ‘ও করেছে! সব ওর শয়তানি!’ বিড়ালটার দিকে আঙুল তুলে নাচাতে লাগলেন তিনি রাগে। মস্ত হলুদ তালটা ড্রপ খেয়ে এক কদম পিছিয়ে এল, যেন দাদুর কথার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে। জানালা দিয়ে আসা আলোয় অদ্ভুত ছায়া পড়ল ওটার গায়ে। থিরথির করে কেঁপে কেঁপে যেন শ্বাস নিচ্ছে জেলির তালটা। বিড়ালটার দিক থেকে ইপুর দিকে চোখ ফেরাল অঞ্জন। কিছুই বলছে না ইপু। আতঙ্ক আর বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ‘যত নষ্টের মূল হলো ওটা!’ বিড়ালটাকে দেখিয়ে বললেন দাদু। জবাবে আবার ফোঁস-ফোঁস করে উঠল কুসি। একই জায়গায় থেকে লাফাচ্ছে হলুদ তালটা, ভেতরে নিথর হয়ে রয়েছে দুই ভাই। ‘আরে, দেখো!’ বিড়ালটাকে হঠাৎ পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে যেতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ওর বাহু খামচে ধরল ইপু। হাতটা বরফের মত শীতল। বড় হতে লাগল বিড়ালটা। অনবরত ফোঁস-ফোঁস করছে। সামনের পা দুটো উঁচু করে বারবার বাতাসে থাবা চালাচ্ছে। সবাই তাকিয়ে আছে। কেউ নড়ছে না। ঘরের মধ্যে শুধু হলুদ জেলিটার বিচিত্র শোষণের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। আর থেকে থেকে ঢেব ঢেব করে লাফাচ্ছে। একই রকম শব্দ করে লাফাচ্ছে অঞ্জনের হৃৎপিণ্ডটা। ক্রমশ উঁচু হচ্ছে বিড়ালটা। দুই থাবা সামনে বাড়ানো। যতই বড় হচ্ছে, আকৃতি বদলে যাচ্ছে বিড়ালটার। মানুষে রূপ নিচ্ছে। ভুতুড়ে অন্ধকারে ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে হাত-পাগুলো। তারপর অন্ধকার থেকে সরে এল ছায়ামূর্তিটা। কুসি এখন একজন অল্প বয়সী তরুণী, লালচে চুল, ফ্যাকাশে চামড়া, হলুদ চোখÑবিড়ালটার যেমন ছিল, যা এখানে আসার পর থেকেই দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে বেরিয়েছে অঞ্জনকে। মহিলার পরনের লম্বা কালো আলখেল্লার ঝুল গোড়ালির কাছে দোল খাচ্ছে। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছে ও, অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দাদুর দিকে। ‘ওই যে, দেখলে তো?’ শান্তকণ্ঠে অঞ্জন আর ইপুকে বললেন তিনি। ‘ওই ডাইনিটার কথাই বলেছিলাম।’ তারপর কুসির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার ওপর তোমার জাদুর মতা কেটে গেছে। আর আমি তোমার হয়ে কাজ করব না।’ ঝাঁকি দিয়ে মাথাটা পেছনে নিয়ে গিয়ে খিলখিল করে হাসল কুসি, লালচে চুলগুলো ঝাঁকি খাচ্ছে আলখেল্লার কালো, উঁচু কলারের ওপর। ‘তুমি কী করবে না করবে, সেটা আমি ঠিক করব, দিলারা।’ ‘না,’ মাথা নাড়লেন দাদু। ‘আমাকে দিয়ে অনেক গোলামি করিয়েছ তুমি, কুসি। আর শুনব না।’ ‘কী করবে?’ আবার হাসল কুসি। ‘আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই, গাধা কোথাকার। তবে হ্যাঁ, এক হিসেবে মুক্ত আমি করে দেব তোমাকেÑতোমাদের সবাইকেইÑমেরে ফেলে। হ্যাঁ, তোমাদের সবাইকেই মরতে হবে।’ অঞ্জনের দিকে ফিরলেন দাদু। চোখের ভয় চাপা দিতে পারলেন না। ‘তোমার দাদা মারা যাবার পর, ও আমার বন্ধু সেজে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। আমি তখন একা। মন-টন খারাপ। ভেবেছিলাম, একা থাকি, একজন সঙ্গী পেলে মন্দ হয় না। ওকে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু ও আমাকে জাদু করলÑব্ল্যাক ম্যাজিকের সাহায্যে, আমাকে বধির করে দিল। কথা বলে কেউ কিছু বোঝাতে পারে না আমাকে, ধীরে ধীরে পড়শিরা সবাই আমার এখানে আসা বন্ধ করে দিল। নিজের বাড়িতে নিজেই বন্দী হলাম।’ ‘কিন্তু, দাদু...’ বলতে গেল অঞ্জন। ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ থাকতে ইশারা করলেন দাদু। ‘ও আমাকে সাবধান করে দিয়েছে, এখানে কোনও মেহমান রাখা চলবে না। আমি ওর হুকুমের চাকর। ওর ইচ্ছেমত আমাকে দিয়ে কাজ করিয়েছে। আমিও ব্ল্যাক ম্যাজিক জানি। আমার স্বামীর কাছে শিখেছিলাম। তবে জাদুর মতায় কুসির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারিনি কখনও। তোমাকে দেখে ভীষণ রেগে গিয়েছিল ও। বাড়ি থেকে তাড়াতে বলল। বললাম, কোথায় তাড়াব? এখানে কোথাও তোমার যাওয়ার জায়গা নেই। ও শুনল না, চাপাচাপি করতে লাগল। ওর ভয় ছিল, ওর শয়তানির কথা তুমি সব জেনে যাবে। আর তাহলে তুমি আমাকে ওর জাদুর প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করবে। তখন আমি একটা চালাকি করলাম। বললাম, এমন কিছু করব আমি, যাতে তুমি সব সময় ব্যস্ত থাকো, আর ওর বিষয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ না পাও। তখন তোমার খেলনা ভুতুড়ে জেলিকে সত্যি সত্যি ভুতুড়ে বানিয়ে দিলাম।’ ‘কিন্তু শেষ রা করতে পারলে না,’ শীতল কণ্ঠে বলল কুসি। ‘নিজেও বাঁচবে না আর এখন, ছেলে দুটোকেও বাঁচাতে পারবে না।’ ‘কেন, ওরা তোমার কী তি করেছে?’ দাদুর চোখে আগুন। ‘আমাকে মারো। ওদেরকে যেতে দাও।’ ‘না,’ মিহি কণ্ঠে কুসি বলল। বুকের ওপর দুই হাত রাখল আড়াআড়ি। হলুদ চোখ দুটো জ্বলছে। ‘ওরা অনেক বেশি জেনে ফেলেছে। আর ওদের যেতে দেয়া যায় না।’ ‘এখান থেকে বেরোতে হবে আমাদের,’ ইপুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল অঞ্জন, চোখ হলুদ তালটার দিকে। ‘ডাইনিটা কিছু করার আগেই।’ ‘কিন্তু কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল ইপু। ‘দরজা আগলে রেখেছে কুসি, দেখছ না?’ ছোট্ট ঘরটায় চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল অঞ্জনের দৃষ্টি। পালানোর পথ খুঁজছে। কিন্তু নেই। একটা হাত তুলে ধীরে ধীরে নিজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কুসি, যেন জাদুর মতা দিয়ে হলুদ বলটাকে কাছে টানতে চাইছে। কেঁপে উঠল ওটা। জোরে জোরে লাফ দিল, একবার, দুবার, তারপর যেন অদৃশ্য সুতোর অমোঘ টানে আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করল ডাইনির দিকে। ‘না, কুসি, দোহাই তোমার!’ ককিয়ে উঠলেন দাদু। ‘থামো!’ তাঁর কথায় কান দিল না কুসি। আঙুলের ইশারায় অঞ্জন ও ইপুকে দেখাল হলুদ তালটাকে। ফুটফুট করে অসংখ্য বুদবুদ ফুটল ওটার গায়ে। তারপর গড়িয়ে এগোল। ‘মেরে ফেলো ছেলে দুটোকে,’ আদেশ দিল কুসি। গতি বাড়াল মস্ত তালটা। কার্পেটের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অঞ্জন ও ইপুর দিকে। ‘হঠাৎ দৌড় দেবে, কুসির পাশ কাটিয়ে দরজার বাইরে চলে যাবে,’ ফিসফিস করে ইপুকে বলল অঞ্জন। গড়িয়ে আসা ভুতুড়ে জেলির কাছ থেকে পিছিয়ে সরে যাচ্ছে। ‘আমাদের দরজা পেরোতে দেবে না ডাইনিটা,’ ইপু বলল। ‘ছেলেগুলোকে মেরে ফেলো,’ আবার আদেশ দিল কুসি, দুই হাত ওপরে তুলে ঝাঁকাল। ‘চেষ্টা করলে একজন অন্তত বেরোতে পারব,’ অঞ্জন বলল। ‘আমি ওকে ব্যস্ত রাখছি, তুমি বেরিয়ে যাও।’ ‘আর লাভ নেই, বেরোতে পারব না, দেরি হয়ে গেছে!’ চিৎকার করে বলল ইপু। কয়েক ফুট দূরে এসে ওদের পথ আটকে দিয়ে লাফাতে শুরু করল তালটা। সারা গা কাঁপছে থিরথির করে, স্পন্দিত হচ্ছে জীবন্ত প্রাণীর মত। ‘আমাদেরকে কি ভেতরে টেনে নেবে ওটা!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘কিংবা পিষে মারবে!’ ইপু বলল। ‘মারো ছেলে দুটোকে!’ চেঁচিয়ে আদেশ দিল কুসি। ‘শেষ করে দাও!’ ছাব্বিশ. আবার গড়াতে শুরু করল তালটা। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল অঞ্জন। বরফের মত জমে গেছে যেন। পা দুটোকে মনে হচ্ছে কয়েক টন ওজন। ওর হাত চেপে ধরল ইপু। দম আটকে অপো করতে লাগল দু’জনে। অঞ্জন ভাবছে, হলুদ তালটা এসে যখন ধাক্কা মারবে, কতখানি ব্যথা পাবে? আর যদি ভেতরে টেনে নেয়, দম আটকে মরার যন্ত্রণা কতখানি হবে? হঠাৎ বিকট গর্জন শোনা গেল। অবাক হয়ে ভুতুড়ে জেলির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে অঞ্জন, ডাকটা কোনখান থেকে এসেছে। দরজার দিকে ইপুকে তাকিয়ে থাকতে দেখল ও। চেঁচিয়ে উঠল, ‘নেড়ি!’ দরজার কাছে চলে এসেছে দৈত্যাকার কুকুরটা। কুসির ঠিক পেছনে। মেঘ গর্জনের শব্দ হচ্ছে ওর ডাকে। নিচু ছাদে প্রতিধ্বনি তুলছে। শেষ মুহূর্তে দরজার কাছ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কুসি। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে। অঞ্জনকে দেখে, তাড়াহুড়া করে দরজা দিয়ে ঢুকতে গেল নেড়ি। উত্তেজিত হয়ে দুই পা তুলে দিল কুসির পিঠে, ওকে ঠেলে সরানোর জন্য। বিশাল কুকুরটার ওজন সামলাতে পারল না কুসি। সামনে ঝুঁকে গেল দেহটা। হুমড়ি খেয়ে পড়ল একেবারে ভুতুড়ে জেলির ওপর। শত্র“মিত্র চেনে না ভুতুড়ে জেলি। কুসিকে আটকে ফেলল। ওটার ভেজা গা থেকে চ্যাটাৎ করে শব্দ হলো। তারপর বিশ্রী, চোষার মত আওয়াজ। কুসির হাত দুটো আগে পড়েছে তালটার গায়ে। মুহূর্তে ঢুকে গেল জেলির ভেতর। পরণে টান দিয়ে কুসির দেহের সামনের অংশ মুখসহ ভেতরে টেনে নিল ভুতুড়ে জেলি। এ সব কিছুই ল করল না নেড়ি। ওর দৃষ্টি অঞ্জনের দিকে। লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকে ওর দিকে ছুটে গেল। ‘আরে থাম, থাম!’ কুকুরটাকে ঝাঁপ দিতে দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল অঞ্জন। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে কুকুরটা। ‘নেড়ি!’ আবার চিৎকার করে উঠল অঞ্জন। হাত বাড়াল কুকুরটাকে ধরার জন্য। ও যে বদলে যাচ্ছে, নেড়ি নিজে সেটা বুঝল না। জিভ বের করে অঞ্জনের গাল চাটতে লাগল। শক্ত করে ওকে ধরে রেখেছে অঞ্জন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছোট হয়ে গেল নেড়ি। আগে যেমন ছিল ও। ‘অঞ্জন, দেখো,’ ইপু চেঁচিয়ে বলল, ‘জেলির তালটাও ছোট হয়ে যাচ্ছে।’ ফিরে তাকাল অঞ্জন। সত্যি। হলুদ তালটাও দ্রুত ছোট হচ্ছে। ছোট হয়ে যাওয়া ভুতুড়ে জেলির বলের দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন ও ইপু। কুসিকে খুঁজছে ওদের চোখ। কিন্তু ডাইনিটাকে উধাও করে দিয়েছে ভুতুড়ে জেলি। আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে আবার। কার্পেটের ওপর পড়ে রয়েছে সাদামাঠা একটা হলুদ রঙের ছোট বল। ‘যাক, ভালয় ভালয় শেষ হলো সব,’ জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন দাদু। ‘কুসি গায়েব হয়ে গেছে,’ অঞ্জন তাকিয়ে আছে ভুতুড়ে ছোট বলটার দিকে। ‘গেল কোথায়?’ ‘কোথায় আর যাবে, নিশ্চয়ই হজম করে ফেলেছে ওকে ভুতুড়ে জেলি। ভাল হয়েছে। আর কোনদিন কাউকে জ্বালাতে আসবে না,’ দাদু বললেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে, আমি এখন কানে শুনতে পাচ্ছি! কান ঠিক হয়ে গেছে!’ ঠিক এই সময় খুলে গেল আবার দরজার পাল্লা। দরজায় দেখা দিল একটা ছায়ামূর্তি। লিভিং রুমে পা রাখল। আঠাশ. ‘মা!’ চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। মা’র দিকে ছুটল ও। দুই হাতে জড়িয়ে ধরল মাকে। ‘হচ্ছিল কী এখানে?’ মিসেস জামান জিজ্ঞেস করলেন। ‘ওই ছেলে দুটো এমন করে ছুটে পালাল কেন? চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল ভূতে তাড়া করেছে!’ ‘ভূত নয়, ডাইনির কবলে পড়েছিল, মা,’ অঞ্জন বলল। ‘তোমাকে দেখে কি যে খুশি লাগছে, মা, উফ্।’ মিসেস জামানকে নিয়ে রান্নাঘরে চললেন দাদু । ‘চা বানাই। লম্বা একটা গল্প শোনাব তোমাকে।’ ‘বেশি লম্বা গল্প শোনার সময় নেই, আন্টি,’ বলে অঞ্জনের দিকে তাকালেন তিনি। চোখে প্রশ্ন। ‘বিকেল ৪টের বাস ধরতে হবে আমাদের। টিকেট নিয়ে এসেছি।’ ‘মা, আমার মনে হয় গল্পটা তোমার ভাল লাগবে,’ মাকে বলল অঞ্জন। ইপুর দিকে তাকাল। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ইপু। রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন দিলারা দাদু ও মিসেস জামান। কান্ত ভঙ্গিতে একটা সোফায় বসে পড়ল ইপু ও অঞ্জন। ‘তোমার সঙ্গে নিশ্চয় আর কোনদিন দেখা হবে না,’ ইপু বলল। ‘মানে, ঢাকায় চলে গেলে আর তো কখনও এখানে আসবে না।’ ‘না...ইয়ে...আ-আমি তোমাকে চিঠি লিখতে পারি...’ হঠাৎ কেমন ভাষা হারিয়ে ফেলল অঞ্জন। ‘ঠিক আছে, লিখো,’ উজ্জ্বল হলো ইপুর মুখ। ‘তা ছাড়া ফোনও করতে পারবে। আমাদের বাড়ির নম্বরে ফোন করো। ঢাকায় গিয়ে টেলিফোন পেলে তোমাদের ওখানকার নম্বরটা দিয়ো আমাকে।’ ‘নিশ্চয় দেব,’ যোগাযোগের উপায় খুঁজে পেয়ে আড়ষ্টতা কেটে গেল অঞ্জনের। ‘অঞ্জন, একটা জিনিস চাইলে দেবে?’ ইপু জিজ্ঞেস করল। ‘নিশ্চয় দেব,’ কৌতূহলী হলো অঞ্জন। ‘শুনলে তোমার অবাক লাগবে।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল ইপু, ‘আমাকে...ইয়ে...উঁম্...অল্প একটু ভুতুড়ে জেলি দিয়ে যাবে? তোমার স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব।’ ‘নিশ্চয়ই,’ অঞ্জন বলল। ‘পুরোটাই রেখে দাও না, আমার কোন আপত্তি নেই।’ কার্পেটের দিকে তাকাল দু’জনে। ‘আরে, নেই তো!’ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ইপু। ছোট হলুদ বলটা যেখানে পড়ে ছিল, সেখানে ছুটে এল দু’জনে। সত্যিই নেই বলটা। ডাইনিটার মতই উধাও হয়ে গেছে, রহস্যময়ভাবে। হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল নেড়ি। আবার কে এল? ফিরে তাকাল অঞ্জন। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে হারু-তরু। ‘তোমরা?’ অঞ্জন বলল। ‘ভেতরে আসতে পারি,’ বিব্রত ভঙ্গিতে বলল হারু। ‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে আমাদের কথা আছে,’ যোগ করল তরু। অঞ্জন বলল, ‘এসো। আবার কী কথা?’ ‘মাপ চাইতে এলাম তোমার কাছে,’ ভেতরে পা দিয়ে হারু বলল। ‘তুমি আমাদের বাঁচিয়েছ,’ বলল তরু। ‘যথেষ্ট শিা হয়েছে আমাদের,’ হারু বলল। ‘আর শয়তানি করব না,’ তরু বলল। ‘এই যে, কান ধরছি।’ ‘আরে না না, কান ধরতে হবে না, করো কী!’ অঞ্জন বলল। দুই দিক থেকে অঞ্জনকে জড়িয়ে ধরল দুই ভাই। ‘বলো, আমাদের মাফ করেছ।’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, করেছি, ছাড়ো, ছাড়ো!’ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল হারু-তরু। দু’জনে অঞ্জনের দুটো হাত ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে বলল, ‘তুমি একটা অসাধারণ ছেলে। সত্যি!’ Ñ শেষ Ñ
আরও পড়ুন...