সড়ক নিরাপত্তা -মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস
নাটিকা জুন ২০১৭
কাহিনী সংক্ষেপ বাদল ড্রাইভার একজন আদর্শ গাড়িচালক। দুর্ঘটনা এড়াতে তার একটাই থিউরি-রাস্তায় চলাচলকারী সকল মানুষ আমার সন্তান। এটা মাথায় রেখে গাড়ি চালালে অনেক দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। একবার রাস্তায় একটা তুচ্ছ ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনাকে পুঁজি করে গ্রামের এক পার্টি নেতা হরতালের ডাক দেয়। বাদল ড্রাইভারের গাড়ি সেখানে আটকা পড়ে। ঢাকা থেকে ফেরার পথে এক শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয় বাদল। যাত্রী এবং শিশুটি রক্ষা পেলেও পঙ্গু হয়ে যায় সে। ভর্তি হয় হাসপাতালে। এই সুযোগে এক চা বিক্রেতা বাড়িতে ফোন করে জানায়, বাদল বিয়ে করেছে। সন্দেহপ্রবণ স্ত্রী বাদলের বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় এটা বিশ্বাস করে। পরে আসল ঘটনা শেষে তাদের ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়। দুর্ঘটনারোধে বাদলের এই ভূমিকার জন্য তার পরিবারের যাবতীয় দায় দায়িত্ব গ্রহণ করে শ্রমিক নেতা। চরিত্রলিপি বাদল : আদর্শবান ড্রাইভার পুলিশ : পুলিশ অফিসার জোবেদা : বাদলের স্ত্রী রাব্বি : বাদলের শিশুপুত্র। জাকির : গাড়ির সুপারভাইজার যাত্রী : বাসযাত্রী আক্কাস : চা বিক্রেতা সফুরা : বাদলের মা শিক্ষক : প্রধান শিক্ষক শ্রমিক : শ্রমিক নেতা নেতা : গ্রামের উঠতি নেতা কর্মী ১ : নেতার চামচা কর্মী ২ : নেতার চামচা ছাত্র : ছাত্রনেতা ভূমিকা : প্রাক-দৃশ্য মঞ্চে অনেক শিশু। তাদের চোখে মুখে বাঁচার আকুতি। হাত তুলে শ্লোগানের ভঙ্গিতে নীরবে প্রতিবাদ জানায় ঘাতকদের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে। নেপথ্যে থেকে দরাজ কণ্ঠে ভেসে আসে তাদের আকুতি- আমরা বাঁচতে চাই.....তোমাদের মতো বড় হতে চাই....রাস্তায়, পথে-প্রান্তরে নিরাপদে চলাচল করতে চাই। এবার বন্ধ করো তোমাদের নিষ্ঠুরতা, বন্ধ করো-বন্ধ করো। দৃশ্য-১ /ইনডোর স্থান-বাদল ড্রাইভারের বাড়ি/সময়-দুপুর চরিত্র-বাদল, জোবেদা, রাব্বি (বাদল ড্রাইভারের অতি সাধারণ বাড়ি। খাটের ওপর গভীর ঘুমে অচেতন বাদল। হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখে রাব্বি রাব্বি বলে চিৎকার করে ওঠে) বাদল : না না তোমাকে আমি মরতে দেব না রাব্বি- রাব্বি জোবেদা : কী হইলো? (জোবেদার প্রবেশ) বাদল : (উঠে বসে) রাব্বি আমার রাব্বি কই? জোবেদা : ঘুমের ঘোরে আবোল তাবোল কী কইতাছো? বাদল : ও আমি বাড়িতে! জোবেদা আমি একটা ভয়ঙ্কর খোয়াব দেখেছি। আমি গাড়ি নিয়া ঢাকায় যাইতাছি। ফরিদপুরে রাস্তার বাঁক ঘুরতে রাব্বি আমার গাড়ির নিচে পইড়া ... উহ পিচঢালা কালো রাস্তা রক্তে লাল অইয়া গ্যাছে। কী ভীষণ কষ্ট। পানি দাও জোবেদা। জোবেদা : ছি ছি এমন অলুক্ষণে কথা আর কখনো মুখে আনবা না। (পানি দেয়) রাব্বি স্কুলে গেছে। ইনশাআল্লাহ সহি সালামতে বাড়ি ফিরবো। এবার শুইয়া পড়। বাদল : চোখে ঘুম নাই। জোবেদা : সারারাত গাড়ি চালাছো। শরীরডা ক্লানতো। অহন মাথা থেইক্যা সব চিন্তা ঝাইড়া ফেল। (স্কুলের ড্রেসে রাব্বির প্রবেশ) বাদল : (জড়িয়ে ধরে) বাজান, তুমি বাড়ি আইছো! রাস্তায় কোনো সমস্যা হয় নাই? শরীরডা কেমন আছে? জোবেদা দেখ আমার রাব্বি কত বড় হইছে। বাজান, তুমি কোন কিলাছে পড়? রাব্বি : কিলাস ফোরে। বাদল : রোল নাম্বার? রাব্বি : সাত বাদল : জোবেদা টেপটা দাওতো। (রাব্বিকে) তোমার জন্য জুস আনছি, আনারস আনছি। খুব মজা অইবো তাই না? (জোবেদা টেপ আনে) জানো আমার বাজান ফোরে উঠছে। রোল সাত। দাও (টেপ নিয়ে রাব্বির উচ্চতা মাপে) জোবেদা : একি মাপতাছো কেন? বাদল : মোটর গাড়িতে চাকরি করি, যহন বাড়িতে ফিরি তহন ও ঘুমাই থাহে। যহন বাড়ি থেইক্যা বাইরে যাই, তহন স্কুলে থাহে। বন্ধু-বান্ধবরা পোলাপানের কথা জিগাইলে কিছুই কইতে পারি না। ব্যাগ থেইক্যা নোট বইটা দাও। লিখ্যা রাখি। বাজান, জামা কাপড় খুইলা খাইয়া নাও। (রাব্বির প্রস্থান) জোবেদা : তুমি একটা আজব মানুষ। ড্রাইভার অইয়া সব ভুইলা যাইতাছো। বাদল : রাস্তায় উঠলে আর দিন দুনিয়ার কথা মনে থাহে না। আমাগো একজন শ্রমিক নেতা কী কয় জানো? সাগরে ঝড় উঠলে যেমন ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি হয় তেমনি রাস্তায় ঝড়ের বেগে যানবাহন চলে। সেহানে ২৪ ঘন্টা বিপদ সংকেত জারি থাহে। জোবেদা : কথাডা মনে থাকলে দ্যাশে এতো অ্যাকসিডেন্ট হইতো না বাদল : হেই কথা আর তুইলো না। খোঁয়াড়ের কথা মনে অইলে ... উহ কীযে কষ্ট! এমন কষ্ট আমি জীবনেও পায় নাই। জোবেদা : গাড়ি চালাবার সময় একটা কথা সব সময় মাথায় রাইখো- যারা রাস্তায় চলাচল করে, তারা সকলেই তোমার পোলাপান। মনে কইরো রাব্বি রাস্তা পার হইতাছে। তাইলে বেপরোয়া গাড়ি চালাইবার কথা মনে থাকবো না। বাদল : ঠিক কথা কইছো জোবেদা। দোয়া করো তোমার কথা যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারি। তই সত্যি কথা অইলো অ্যাকসিডেন্টের জন্য শুধু ড্রাইভাররা দায়ী না। খারাপ রাস্তা, যাত্রী, পথচারী সবাই কম বেশি দায়ী। (মোবাইল বাজে) কে?- ও জাকির।- বল? কয়টায়? (ফোন রেখে) জোবেদা সাড়ে তিনটায় আমার টিপ। হাতে মোটেও সময় নাই। জোবেদা : অহনো রেস্ট নিতে পারলে না - আবার টিপ! বাদল : হেইডাও অ্যাকসিডেন্টের একটা কারণ। জোবেদা : না না তোমারে আমি যাইতে দিবো না। আমরা মাইয়া মানুষ, ঘরে থাহি। রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট এড়াইতে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। আমি অহনই কথাডা আম্ম্াজানরে কইতাছি। মা এদিকে আসোতো। (দৃশ্যান্তর) দৃশ্যÑ২/আউটডোর স্থান-হাইওয়ে সড়ক/সময় - বিকেল চরিত্র : নেতা, কর্মী-১, কর্মী-২, শ্লোগান (রাস্তায় অবরোধ। যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। কারো মাথায় ভারী বোঝা লাগেজপত্র। সন্তান কোলে নিয়ে হেঁটে যায় অসহায় মহিলারা। আটকা পড়ে আছে অ্যাম্বুলেন্স। মিছিলে শ্লোগানে উত্তাল রাজপথ) নেতা : বুঝতে পারছি মাইনসের একটু কষ্ট অইতাছে। কিন্তু কিছুই করার নাই। যাত্রীদের জীবন নিয়া যে খেলা শুরু অইছে তা বন্ধ করতে অইলে কিছু কষ্ট করতেই হইবো। কর্মী-১ : হালাই মাল খাইয়া গাড়ি চালাচ্ছিল। একজনকে শিক্ষা দিতে পারলে সকলেই সাইজ অইয়া যাইবো। কর্মী-২ : লিডার এমন সুযোগ আর মিলবো না। একটা কর্মসূচি দিয়া দ্যান। সামনের ইলেকশনে কামে লাগবো। নেতা : গুড আইডিয়া। সুযোগ বার বার মিলবো না। (্একটা ভ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে) প্রিয় ভায়েরা আপনারা জানেন এখানে দুই দিন অবরোধ চলতাছে। আমাগো একটাই দাবি- ২৪ ঘন্টার মধ্যে ড্রাইভারকে ধইরা ফাঁসি দিতে অইবো। হেই দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়বো না। সকল স্কুল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ থাকবো। শ্লোগান : আমাদের দাবি আমাদের দাবি মানতে হবে মানতে হবে। খুনি ড্রাইভারের মৃত্যুদন্ড দিতে হবে, দিতে হবে। (দৃশ্যান্তর) দৃশ্য-৩/আউটডোর স্থান-রাজপথ/সময়-বিকেল চরিত্র-বাদল, যাত্রী, সুপারভাইজার (একটা বাসের পাশে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে। পাশে ড্রাইভার, সুপারভাইজার) বাদল : যাত্রী ভাইয়েরা সামান্যের জন্য আমরা একটা বিরাট অ্যাকসিডেন্ট থেকে রক্ষা পাইলাম। সামনে শ শ গাড়ি আটকা পড়ছে। আমাগো গতি একটু বেশি থাকলে সব মাস্তানি শেষ অইয়া যাইতো। সুপারভাইজার : আপনিইতো কইলেন গাড়ি জোরে চালান। নয় ফুডা কইরা ফ্যালামু। বাদল : ঢাকায় পৌঁছাইতে সবাই কমবেশি তাড়াহুড়া করছিলেন। অহন কী করবেন। তিন দিনেও পৌঁছাইতে পারবেন না। যাত্রী : স্যরি আমাদের ভুল হয়েছে। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। চলেন চা খেয়ে আসি। (দৃশ্যান্তর) দৃশ্য-৪/ইনডোর স্থান-চা স্টল/সময়-বিকেল চরিত্র-বাদল, আক্কাস, অন্যান্যরা (আক্কাসের চা স্টল। বাদল, যাত্রী ও অন্যান্যরা চা খায়) বাদল : চা-টা খুব ভালো হয়েছে। আক্কাস : বারো বছর ধইরা খাইতাছেন। কহনো খারাব পাইছেন। বাদল : রাস্তায় জ্যাম বাঁধলে তোমার এখানে ছুইটা আসি। খারাব হইলে কি আসতাম। আক্কাস ভাই জামতলায় কী নিয়া গ্যাঞ্জাম হইচে? আক্কাস : একজন ছাত্র চলন্ত গাড়িতে উঠতে গিয়া পইড়া গেছে। তয় মরে নাই- পায় সামান্য আঘাত পাইছে। বাদল : মরে নাই তাই ফাঁসির দাবি। মরলে কী করতো। (আক্কাস ইশারায় চুপ থাকতে বলে) আক্কাস : চুপ করেন হক কথা কইলে মার খাইতে অইবো। বাদল : ছেলেডা কোথায় আছে? আক্কাস : চৌরাস্তার আকরাম ডাক্তারের চেম্বারে। বাদল : একটু দেইখ্যা আসি। (প্রস্থানোদ্যত) আক্কাস : বাদল ভাই আপনার নাম্বার ডা হারাই ফেলছি। আমারে একটা মিসকল দ্যান। বাদল : ফোনে চার্জ নেই। এই কার্ডটা রাখ (কার্ড দেয়) এহানে বাড়ি গাড়ির দুইডা নাম্বারিই আছে। দৃশ্য-৫/ইনডোর স্থান-স্কুল/সময়-সকাল চরিত্র-পুলিশ, শিক্ষক, ছাত্র নেতা, শ্রমিক নেতা (স্কুলের হলরুম। অবরোধ নিয়ে আলোচনা সভা) পুলিশ : এখানে তিন দিন ধরে অবরোধ চলছে। দূর-দূরান্তে যাতায়াতকারী নারী-পুরুষের কষ্ট চোখে দেখা যায় না। শ্রমিক : তিন দিনে বহু গাড়ি ভাঙচুর এবং আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। অবরোধকারীরা একটা সিমপিল ঘটনায় ড্রাইভারের ফাঁসি দাবি করছে। অথচ সব অ্যাকসিডেন্ট ড্রাইভারের কারণে হয় না। পথচারীরা মহাসড়কে মোবাইল ফোনে খোশগল্প করে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়। এভাবে যারা খেয়াল খুশিমত রাস্তায় চলে দুর্ঘটনার জন্য তারা কম দায়ী নয়। পুলিশ : আমরা তদন্ত করে দেখেছি। যে ঘটনার জন্য এখানে অবরোধ শুরু হয়েছে সেই ঘটনায় ড্রাইভার সম্পূর্ণ নির্দোষ। অথচ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ফাঁসি দিতে হবে। দেশে আইন আদালত আছে। বলুন বিচার ছাড়া কিভাবে শাস্তি দেবেন? আমরা যদ্দুর জেনেছি এই অবরোধের জন্য ছাত্ররা দায়ী না। অবরোধে যে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে একজন অছাত্র। আগামী নির্বাচনে এই ইউনিয়ন থেকে প্রার্থী হতে চায়। কী ছাত্রনেতা, ঠিক বলিনি? শিক্ষক : যেভাবেই হোক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এখন কিভাবে সমাধান করা যায়, সেই পথ বের করুন। পুলিশ : থ্যাংক ইউ। মাস্টার সাহেব আমার কি মনে হয় জানেন, সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে বেড়েছে, তাতে বিষয়টা স্কুলের সিলেবাসে থাকা দরকার ছিল। তাহলে পরীক্ষায় পাস করার স্বার্থে সকলেই দুর্ঘটনার কারণ মুখস্থ করত এবং রাস্তায় সাবধানে চলাচল করতো। শিক্ষক : আপনার কথার সাথে আমিও একমত। (দৃশ্যান্তর) দৃশ্য-৬/আউটডোর স্থান-টার্মিনাল/সময়-বিকেল চরিত্র-বাদল, জাকির, যাত্রী (গাড়ি থেকে নামে যাত্রীরা। সবাই একে অপরকে বিদায় দেয়) যাত্রী : চারদিন পর ঢাকায় পৌঁছালাম। পথে ভাল-মন্দ অনেক কথা হইছে। ভুল হলে ক্ষমা করবেন। বাদল : গাড়িতে উইঠ্যা কহনো তাড়াহুড়া করবেন না। আল্লাহর রহম ছাড়া কেউ গন্তব্যে পৌঁছাইতে পারে না। যাত্রী : আমি যাই। (যাত্রীর প্রস্থান) বাদল : জাকির জাকির : জে বস। বাদল : কতদিন রাব্বিরে দেহি নাই। বুড়া মাই কিভাবে আছে জানি না। যতো কষ্টই হোক আজ বাড়িতে ফিরবো। তুই কিছু খাদ্য খাবার কিইনা আন। খালি হাতে গেলে ইজ্জত থাকবো না। এইনে (টাকা দেয়) জাকির : ঢাকায় আম আনারস সস্তা। দেহি পাই কিনা। (দৃশ্যান্তর) দৃশ্য-৭ স্থান-রাস্তা/সময়-দিন চরিত্র-বাদল ও অন্যান্যরা (বিকট শব্দে অ্যাকসিডেন্ট করে বাদলের গাড়ি। রাস্তায় উল্টে পড়ে গাড়িটা। লোকজনের এলোমেলো ছোটাছুটি, কান্নাকাটি। হুইসেল বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসে। বাদলকে নেয়া হয় হাসপাতালে) দৃশ্য-৮/ইনডোর স্থান-বাদলের বাড়ি/সময়-বিকেল চরিত্র- জোবেদা, সফুরা, জাকির, রাব্বি (সফুরা নামায শেষে মোনাজাত করে। পাশে খাটে বসে মোবাইল টেপে জোবেদা) মোনাজাত : আয় আল্লাহ, আয় রাহমানুর রাহিম, তুমি সবকিছু পারো। আমার বাদলরে তুমি সহি সালামতে ফিরাই দাও। (মোনাজাত শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে) বউমা, কোন খোঁজ খবর পাইলে? জোবেদা : না মা ফোন বন্ধ। সফুরা : সেদিন সাভারে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটলো। সেই থেইক্যা আমার শরীরডা কেমন জ্বালা পুড়া করতাছে। কী যে অইলো আল্লাহ জানে। (জোবেদার ফোন বেজে ওঠে) ঠিক আমার বাদল ফোন করছে। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। জোবেদা : (ফোন রিসিভ করে) কেডা?... বাদলের বন্ধু ... কী কইলেন? মাইয়া নিয়া হোটেলে-... হ্যালো--হ্যালো--লাইন কাইটা দিছে। হায় হায় শেষ পর্যন্ত আমার কপালে এই ছিল। (আঁচলে মুখ ঢেকে হাউমাও করে কাঁদে) সফুরা : কী হইলো বউমা? জোবেদা : কী আর হইবো-তোমার ছোয়াল বিয়া করছে। তাইতো কই, কেন দেরি কইরা আসে। হরতাল অবরোধ মিথ্যা। আমাগো চোহে ধুলা দিয়া নতুন বউ নিয়া মজা করে। সফুরা : না না হেইডা হইতে পারে না। বাদল আমার পেট থেইক্যা দুনিয়ায় আসছে। হ্যারে আমি ভালো কইরা চিনি। জোবেদা : মোটরগাড়ির লোক- যেহানে রাত সেহানে কাত, হ্যাগো বিশ্বাস করা যায় না। সফুরা : মাথা ঠান্ডা করো বউমা (প্যাকেট হাতে জাকিরের প্রবেশ) জাকির : খালাম্মা... সফুরা : আমার বাদল কই? জাকির : না না আর কইতে হইবো না (চিৎকার করে কেঁদে ওঠে) খোদা তুমি একি করলে। বুড়া বয়সে আমারে না নিয়ে বাদলরে নিয়ে গেলে। রাব্বিকে এতিম করলে! জোবেদা : হায় হায় এখন আমার কী হইবো- জাকির : একি আপনারা কাঁদছেন কেন? (রাব্বির প্রবেশ) রাব্বি : মা, দাদী, কী অইচে? আমার বাজান কহন বাড়ি আইবো? জোবেদা : তোর বাজান আর জীবনেও আসবো না। আয় খোদা, এই বয়সে আমার সোয়ামিরা কাইড়া নিলে-অহন আমি কারে নিয়া থাকুম। জাকির : আহ্হা কিসেব আবোল তাবোল বকতাছেন। সবাই থামেন। বস মরে নাই। সফুরা : অ্যা! মরে নাই! কোথায় তোমার বস? জাকির : হাসপাতালে। অ্যাকসিডেন্ট কইরা পায় সামান্য আঘাত পাইছে। সফুরা : না না আমার বিশ্বাস হয় না ও বাঁইচা থাকলে তুমি একা একা বাড়ি আইতে না। জোবেদা : সব নাটক। ও, নতুন বউ নিয়া ঘর সংসার করতাছে। জাকির : খালাম্মা এসব কী কই তাছেন? জোবেদা : বুকে হাত দিয়া কওতো-বাদল বিয়া করে নাই ? জাকির : ছি: ছি: বাদল ড্রাইভারের মতো ভালো মানুষ মোটর লাইনে খুঁইজা পাইবেন না। হ্যারে নিয়া এমন খারাপ ধারণা করতাছেন কেন। আমার সাথে হাসপাতালে চলেন। সব ধারণা বদলে যাবে। (দৃশ্যান্তর) দৃশ্য-৯/আউটডোর স্থান-হাসপাতাল চত্বর/সময়-দিন চরিত্র-বাদল, সফুরা, জোবেদা, শ্রমিক (হাসপাতালে থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে বের হয় বাদল। সাথে একজন শ্রমিক নেতা। সফুরা জড়িয়ে ধরে তাকে।) সফুরা : বাবা, তুই বাঁইচা আছিস! বাদল : তোমাদের দোয়ায় আমার কিছুই অয়নায়। আমার রাব্বিরে বাঁচাইতে গিয়া পায় সামান্য আঘাত পাইছি। সফুরা : রাব্বিতো বাড়িতেই আছিল। বাদল : মা, তোমরাইতো কইতে, রাস্তার সব মানুষ কলিজার টুকরা সন্তানের মতো। হেইডা মাথায় রাইখা গাড়ি চালাইলে অ্যাকসিডেন্ট কম হইবো। জোবেদা : সে কবেকার কতা অহনো মনে রাখছো। বাদল : বাদল ড্রাইভার কোন ভাল কথা ভুইলা যায় না। তোমাগো কথা রক্ষা করতে গিয়া একটা পা হারাইছি। কিন্তু অসংখ্য রাব্বিকে রক্ষা করতে পারছি। সফুরা : বাবা, তুই নাকি বিয়া করছিস? বাদল : বিয়া! (হো হো করে হেসে) এমন আজব কথা কোথায় পাইছো? জোবেদা : তোমার বন্ধু ফোন করছিল। এই দ্যাহো-(ফোন দেয়) বাদল : (ফোন করে) হ্যালো- কেডা?- ও আক্কাস ভাই, তোমার ভাবিরে কী কইছো? কণ্ঠ : নাম্বারটা ঠিক আছে কিনা দেখতে গিয়া একটু মশকারা করছি। ভাবির কাছে দাও-(জোবেদাকে ফোন দেয়) ভাবি, যা কইছি সব মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা। বাদল ভাই আমার ১২ বছরের পরিচিত। হের মত ভালো মানুষ আর হয় না। (সবাই হাসে) সফুরা : দেখলে বউমা, আমার ছোয়াল কহনো খারাব কাজ করতে পারে না। শ্রমিক : ভাবিজান, এতোদিন ঘর, সংসার কইরা হ্যারে চিনতে পারো নায়। বাদল ড্রাইভার আমাদের সকলের অহংকার। তার শিক্ষা অনুযায়ী এখন থেইকা আমাদের একটাই স্লোগান-রাস্তায় চলাচলকারী সব মানুষ কলিজার টুকরা সন্তান। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব সকলেরই। (যবনিকাপাত)
আরও পড়ুন...