স্বপ্নের দেশ

স্বপ্নের দেশ

উপন্যাস ডিসেম্বর ২০১২

মুহাম্মাদ আবদুল্লাহিল বাকী..

আমার নাম হুমায়ূন কবির। আমার ডাক নাম দীপ্ত। আমি পড়ি অষ্টম শ্রেণীতে। রাজশাহী লোকনাথ হাইস্কুলে। আমাদের স্কুল সেই ব্রিটিশ আমলের। পৌনে দুই শ’ বছরের পুরাতন আমাদের স্কুলটা একেবারে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের মতো আকৃতির বিশাল দালানে আমাদের স্কুল। সামনে আছে প্রশস্ত মাঠ। মাঠটা আমাদের খুব প্রিয়। টিফিনের ফাঁকে আমরা এখানে খেলাধুলা করি। মাঠের পশ্চিম পাশে মসজিদ। মসজিদের পেছনে বিশাল পুকুর। পুকুরটাও আমাদের স্কুলের। আমাদের স্কুলের শিক্ষকেরা খুব ভালো। তারা ক্লাসে সুন্দর করে পড়ান। কয়েক বছর ধরে আমাদের স্কুল ছাত্ররা এসএসসিতে খুব ভালো রেজাল্ট করছে। পড়াশোনার বাইরে আমাদের স্কুলে প্রত্যেক বছর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের স্কুলে একটা সমৃদ্ধ পাঠাগার আছে। কত রকমের মজার মজার বই আছে যে সেখানে! আমি স্কুল পাঠাগারের সদস্য। নিয়মিত বই নিয়ে পড়ি। আমার এক চাচা আছেন। তিনি কলেজে অধ্যাপনা করেন। প্রায়ই আমাকে বলেন, দীপ্ত, প্রচুর পড়াশোনা করো। তাহলে জ্ঞানের এক বিশাল জগতে প্রবেশ করতে পারবে। যেখানে ছড়ানো আছে মণিমুক্তো। সেগুলো সংগ্রহ করাই তোমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেই কারণে আমি পুঁথিগত বইয়ের বাইরে নানা রকম বই পড়ি। এখন তো বই পড়া আমার নেশার মতো হয়ে গেছে। চাচার কথা খুব ভালো লাগে আমার। তিনি অন্য ধরনের মানুষ। সারাক্ষণ পড়াশোনার মধ্যে থাকেন। বাড়িতে কয়েক হাজার বইয়ের একটা পাঠাগার আছে তার। নানা বিষয়ে তার জ্ঞান আছে। যখন তিনি কথা বলেন, দেখে মনে হয় ‘চলন্ত বিশ্বকোষ’। সকলে বলেন, চাচা মানুষের খুব উপকার করেন। এক সময় ছাত্ররাজনীতি করতেন। এখন নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। বন্যা-সিডরে ত্রাণতৎপরতা, শীতের সময় শীতার্ত মানুষের জন্য গরম কাপড় সংগ্রহ করার মতো কাজে জীবনের অনেকটা সময় তিনি কাটিয়েছেন। এই কারণে মানুষজন তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করেন। তিনি যেমন নিজে ভালো কাজ করেন, অন্যকেও ভালো কাজ করার উপদেশ দেন। চাচা বলেন, আগামী দিনে দেশকে নাকি আমরাই নেতৃত্ব দেবো। তাই আমাদেরকে সত্যিকার মানুষ হতে হবে। লেখাপড়ার সাথে সাথে আদর্শ চরিত্রও গড়তে হবে। খারাপ মানুষদের কারণেই নাকি এখন দেশের এত অবনতি। আমি তাঁর সব কথা বুঝতে পারি না। তবু মনোযোগ দিয়ে শুনি। চাচা আমাকে গত বছর বাংলা একাডেমির বইমেলায় নিয়ে গিয়েছিলেন। লাখ লাখ বই দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। জীবনে এক সঙ্গে কখনো এত বই দেখিনি। বেছে বেছে তেষট্টিটি বই কিনেছিলাম। টাকা অবশ্য চাচাই দিয়েছিলেন। পড়াশোনা নিয়ে চাচার মধ্যে গভীর দুঃখবোধ রয়েছে। তিনি বিদেশে যেয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চেয়েছিলেন। দাদার আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন, টাকার অভাবে আমি ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারিনি। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল ইউরোপের কোন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নেয়া। সেইবার চাচা আমাকে লালবাগ দুর্গ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুঘল আমলের এই দুর্গটি দেখে, আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। অপূর্ব কারুকার্যখচিত পুরো দুর্গটি। পরীবিবির মাজারটি আরো সুন্দর। বুড়িগঙা নদী তীরের দুর্গ কমপ্লেক্স জুড়ে যেন ইতিহাস ছড়িয়ে আছে। আমি এক নিমিষে চলে গিয়েছিলাম সেই মুঘল যুগে। সাতদিন ধরে আমরা ঢাকা শহরের এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। ঢাকা স্টেডিয়ামে টিকেট কেটে বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কার মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছিলাম। শিশুপার্কে গিয়ে খুব মজা করেছিলাম। আম্মা একদিন আমাকে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রাচীন আমলের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে অনেক কিছু শিখেছিলাম। সেই প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশ এক উন্নত সভ্যতা বুকে নিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় এখানে বৌদ্ধরা উন্নত নগর সভ্যতা গড়েছিলেন। তাদের নির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও হতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। মুঘলরাও শিল্প-সাহিত্যের সমঝদার ছিলেন। সেসব আমলের অনেক নিদর্শন আমি দেখেছিলাম জাদুঘরে। চাচার মতো আমিও মানুষকে ভালোবাসতে চাই। মানুষের বিপদে হাত বাড়িয়ে দিতে আমারও ইচ্ছে করে। তবে সবার আগে আমাকে লেখাপড়াটা ভালোভাবে শেষ করতে হবে। চাচাও তাই বলেন। তিনি বলেন, মানুষের উপকার করতে চাও, এটা ভালো কথা। তবে সবার আগে তোমাকে মানুষ হতে হবে। লেখাপড়া শেখ, তবেই মানুষ হতে পারবে। আমিও চাচার মতো শিক্ষক হতে চাই। কারণ শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর।

দুই. আজ বাংলা বছরের প্রথম দিন। নববর্ষ। আমাদের স্কুলে বৈশাখী মেলা বসেছে। খেলনা-বাঁশি-পিঠাসহ নানা ধরনের খাবারের দোকান সাজিয়ে বসেছে মানুষজন। ‘উত্তরণ ক্রীড়া চক্র’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে। তারা প্রত্যেক বছরই আমাদের স্কুল মাঠে মেলার আয়োজন করে। মেলা উপলক্ষে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমি কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন আর বাংলা বানান লেখা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। আজ হবে ফলাফল ঘোষণা ও পুরস্কার বিতরণ। অনুষ্ঠান শুরু হবে কিছুক্ষণ পরে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মাননীয় মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে আমাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ওপর ক্লাসের একজন ছাত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করছেন। অনুষ্ঠান ঘোষক অতিথিদের মঞ্চে এসে আসন গ্রহণের অনুরোধ জানালেন। মাইকে জাতীয়সঙ্গীত বেজে উঠলো। মাহজাবিন তাবাসসুম নামে এক বেতারশিল্পী জাতীয় সঙ্গীত গাইছেন। আমরা সকলেই তার সাথে কণ্ঠ মেলালাম। অপূর্ব কণ্ঠে তিনি গেয়ে চলেছেনÑ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করলেন মেসবাহ স্যার। তারপরই শুরু হয়ে গেল নৃত্যানুষ্ঠান। হেড স্যারের মেয়ের সাথে আরো কয়েকজন মেয়ে মিলে ‘আমরা সবাই রাজা, রাজার এই রাজত্বে’ গানটির সাথে নাচ পরিবেশন করলেন। অতিথিরা বক্তৃতা দেয়া শুরু করেছেন। তাঁরা অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। শুনতে শুনতেই লক্ষ্য করলাম, এক ভাইয়া অতিথিদের সামনের টেবিলে, সুন্দর করে র‌্যাপিং পেপারে মোড়া পুরস্কারগুলো এনে সাজিয়ে রাখছেন। বক্তৃতা শেষেই পুরস্কার বিতরণ করা হবে। আমি লোভাতুর চোখে পুরস্কারের প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। বক্তৃতা পর্ব শেষ হয়েছে। পরবর্তী পর্বে যাওয়ার আগে ঘোষক সভাপতি মহোদয়ের সাথে আলাপ করে নিচ্ছেন। মাইকে ঘোষণা করা হলো অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এখন দু’জন কবিতা আবৃত্তি করবে। প্রথমেই ডাকা হলো মাদার বক্স আইডিয়াল স্কুলের জাহিন আফিয়া আইমানকে। সুন্দর একটি ফুটফুটে মেয়ে মঞ্চে এল। অপূর্ব ভঙ্গিতে কবিতা আবৃত্তি করল। আমার শুনে ভালো লাগল। তারপরই ঘোষক আমার নাম ডাকলেন। আমার বুকের ভেতরে দ্রিম দ্রিম শুরু হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে মঞ্চে উঠে এলাম। তবে যত ভয় পেয়েছিলাম কবিতা আবৃত্তির সময় তা কেটে গেল। বেশ সুন্দরভাবেই আল মাহমুদের ‘নোলক’ কবিতাটি আবৃত্তি করলাম। বেশ অবাক হলাম। কবিতা আবৃত্তিতে আমি প্রথম স্থান অধিকার করেছি। মঞ্চে যেয়ে প্রধান অতিথি মহোদয়ের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করলাম। চিত্রাঙ্কন ও বাংলা বানান লেখা প্রতিযোগিতায় যথাক্রমে সপ্তম ও তৃতীয় পুরস্কার পেলাম। পুরস্কার বিতরণ শেষে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বাড়ির সকলকে পুরস্কারগুলো না দেখানো পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না। বের হয়ে এলাম স্কুল থেকে। একটা ফুলফুরে মেজাজে আমি মহাসড়ক ধরে হাঁটছি। স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি খুব সামান্য পথ। আজকের দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তিন. আমার নাম মুনতাহা। আমার চার বছর বয়সী এক ভাই আছে। আমার আব্বু-আম্মু দু’জনেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকরি করেন। আমরা থাকি শহরের পাঠানপাড়ার একটা তেতলা বাড়ির নিচতলায়। এবার আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছি। আম্মুর চেয়ে আব্বুর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরে আব্বু প্রথমেই আমার নাম ধরে ডাকেন। আমার হাতে তুলে দেন চকলেট, চুয়িংগাম, জুস কত কী! তিনি সব সময় বলেন, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর কন্যা ফাতিমাকে খুবই ভালবাসতেন। ছুটির দিনে আব্বু আমাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যান। সেদিন কিছু না কিছু কিনে দেবেন আব্বু। তারপর কস্তুরি বিরিয়ানি হাউজ অথবা নিউফুডে খাওয়া-দাওয়া। আব্বু খুব মজার মানুষ। সারক্ষণ আনন্দ-ফুর্তিতে থাকেন। কত যে মজার মজার কাজ করেন। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়েন। কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। আব্বু দেশী খাবার পছন্দ করেন। তবে আমি ফাস্টফুড খেতে চাইলে কিনে দেন। কখনো কখনো তিনি আমাকে খাইয়ে দেন। তখন আম্মু হাসেন। এত বড় ধিঙি মেয়েকে কেউ খাইয়ে দিচ্ছে এটা দেখে তিনি মজা পান। আব্বু আমার লেখাপড়া বিষয়ে চাপ দেন না। তবে খোঁজখবর রাখেন। ভালো রেজাল্ট করার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। তবে আম্মু এদিক থেকে উল্টো। কখন প্রাইভেট টিউটর আসবে, স্কুলের পড়া ঠিকমতো হলো কি না, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে, রেজাল্ট আরও ভাল করতে হবেÑ এরকম সব বিষয়ে আম্মু সতর্ক নজর রাখেন। আম্মুর শাসনের ভয়ে আমাকে ঠিক মতো পড়াশোনা করতে হয়। আমি যে রেজাল্ট ভালো করার জন্য পড়াশোনা করি তা ঠিক নয়। আমি খারাপ রেজাল্ট করলে আম্মুর মন খারাপ হবে এই জন্য পড়াশোনা করি। পড়াশোনা না থাকলে ভালো হত। মজা করে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ানো যেত। কত জায়গায় যে যেতাম। কত কী যে করতাম। সেটা কেউ হিসাব করেই বলতে পারত না। আম্মু মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন, এই যে পড়াশোনার প্রতি তোমার মনোযোগ কম। বড় হয়ে কী করবে? বড় হয়ে আমি মস্ত বড় কবি হবো। পাহাড়ের কাছে যাব, নদীর কাছে যাব, কাশবনে ঘুরে ঘুরে সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখব। আমার কবিতা পড়বে দেশের মানুষ। কত্ত কত্ত বই বের হবে। প্রত্যেকদিন পত্রিকায় আমার কবিতা বের হবে। আম্মু হাসেন। বলেন, কবিতা লিখতেও অনেক পড়াশোনা করতে হয়। আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হোসেনÑ প্রচুর পড়াশোনা করেন। তাই তো তাদের আজ দেশ জোড়া নাম। আমি বলি, আমিও প্রচুর পড়াশোনা করব। তবে স্কুলের বই পড়তে আমার ভাল লাগে না। আমি মুক্ত বিহঙ্গের মতো নানা বিষয়ে পড়াশোনা করব। তা কর। তবে স্কুলের পড়াশোনা বাদ দিয়ে নয়। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া, তুমি যতই পড়াশোনা কর তাতে কোনো লাভ হবে না। কেননা আমাদের দেশে সবকিছু মূল্যায়ন করা হয় সার্টিফিকেট দেখে। আম্মুর কথাগুলো আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তবে স্কুলের পড়া না করে যে আমার মুক্তি নেই এটা ঠিকই বুঝতে পারি। এমন সময় ডোরবেলটা বেজে ওঠে। আমি দৌড়ে যেয়ে দরজা খুলি। ছোটখালা এসেছেন। তার কোলে দশ মাসের মাহিন। আমি হাত পাততেই ছোট্ট ভাইটি আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খালা ভেতরে আসেন। খালা আমাকে খুব ভালবাসেন। কোর্টের কাছে হড়গ্রামে তার বিয়ে হয়েছে। খালু জর্জ কোর্টের এডভোকেট। তার বেশ নামডাক আছে। রাজশাহী কোর্টের বেশ জাঁদরেল এডভোকেট তিনি। খালাকে দেখে আম্মু বেশ খুশি হলেন। আম্মু গল্পে মেতেছেন খালার সাথে। সাথে রান্নার কাজও চলছে। আজ আমাদের বাড়িতে বিরিয়ানি হবে। মাটন বিরিয়ানি আমার খুব প্রিয়। ভুরভুর করে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাড়িময়। খালার পিচ্চিটাকে সাথে আমি খেলা করছি। কিছুক্ষণ আগে আমার কোলে প্রস্রাব করে দিয়েছে। দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলছে এখন। আমি তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। খালার কথা শুনে আমার আনন্দে লাফ দিতে ইচ্ছে করল। তিনি বিকেলে আমাদের সকলকে বাণিজ্য মেলায় নিয়ে যাবেন। কালেক্টরেট মাঠে বাণিজ্যমেলা বসেছে। কত কিছু যে পাওয়া যায় ওখানে। আমার স্কুলের বান্ধবী দেখে এসে পরদিন গল্প করেছিল। কী কী কিনব তা মনের মধ্যে একটা লিস্ট করে ফেললাম। দুপুরের খাবার সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা বের হলাম। আমাদের পাঠানপাড়ার বাসা থেকে কালেক্টরেট মাঠ বেশি দূরে নয়। রিক্শাতে অল্প সময়ে পৌঁছে গেলাম। মেলার প্রবেশপথে দীর্ঘ লাইন। আমরা দশ টাকায় টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়ালাম। মেলার মাঠে প্রবেশ করে আমার কী যে ভাল লাগল। কত কিছুর যে দোকান বসেছে। খাবার, খেলনা, গয়নাগাটি, জুতা-কাপড় সব আছে। যা দেখি তাই কিনতে ইচ্ছে করে। আমি একটা বার্বি পুতুল কিনলাম। পুতুলের চোখ-নাক সব যেন জীবন্ত। দেখে মনে হয় সত্যিকার মানুষ। আমরা মাঠে বসে মজাদার হালিম খেলাম। ঢাকার কলাবাগানের বিখ্যাত মামা হালিম। তারা প্রত্যেক বছরই বাণিজ্য মেলায় স্টল দেয়। সারাক্ষণ তাদের স্টলে ভিড় করে থাকে মানুষজন। সূর্য যখন ডুবতে বসেছে তখন আমরা বাড়ি ফিরছি। দিনের আলো ক্রমে ফিকে হয়ে আসছে। মেলা থেকে আমি আর আমার ভাই অনেক কিছু কিনেছি। দু’হাত ভরা কাগজের ব্যাগ। আমার মনে পড়ে গেল ফুপাতো ভাই দীপ্তর কথা। ওর সাথে আমার চমৎকার বন্ধুত্ব।

চার. দাদু দারুণ দারুণ সব গল্প জানেন। দাদু অর্থাৎ মুনতাহার দাদু। তাঁর নাকি চুরাশি বছর বয়স চলছে। নানান জায়গায় চাকরি করেছেন। ভ্রমণও করেছেন দুনিয়ার অনেক দেশ। মুনতাহাদের বাসায় এলেই দীপ্ত দাদু কাছে গল্প শোনে। পাকিস্তান আমলে তিনি কিছুদিন সেনা বাহিনীতে চাকরি করেছিলেন। সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের পেশোয়ারে। ওখান থেকে চেষ্টা-চরিত্র করে চলে যান ইংল্যান্ডে। তাঁর ভাগ্য ওখানেই খুলে যায়। হোটেল ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। দাদু কিছুটা অস্থির চিত্তের মানুষ ছিলেন। একদিন সব ছেড়ে ছুড়ে ইংল্যান্ড থেকে চলেও আসেন। তারপর দেশের বনজঙ্গল ঘুরে পাখি দেখা শুরু করেন। বার্ড ওয়াচার হিসেবে তাঁর দেশ জোড়া সুনামও ছিল। তিনি আবার বিদেশে পাড়ি জমান। এবার যান আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায়। ওখানে গিয়ে তিনি কাঠের ব্যবসায় শুরু করেন। সব সময় ভাগ্য তাঁর সাথে ছিল। কাঠের ব্যবসা করেও তিনি প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হন। নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে তাঁর যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তিনি আমাদের সেসব গল্প বলেন। এতই মজাদার সেসব গল্প আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। কিছু কিছু গল্প তো গোয়েন্দা কাহিনীকেও হার মানায়। দাদু এখন বলছেন দার্জিলিংয়ের গল্প। ওখানে নাকি মধ্যরাতে সূর্য ওঠে। ‘টাইগার হিল’ নামে পাহাড়ের চূড়ো থেকে প্রথম সূর্যোদয় দেখা যায়। কী যে অপূর্ব লাগে সেই সূর্যোদয় চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। দাদু বললেন, দার্জিলিংয়ের শীতের গল্প। সারা বছর নাকি হাড় কাঁপানো শীত পড়ে ওখানে। আমি আর মুনতাহা দু’জনে অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের দেশে তো মাত্র মাস দুয়েকের মত শীত পড়ে, তাতেই আমরা কাবু হয়ে যায়। তাহলে দার্জিলিংয়ের মানুষজন বাঁচে কী করে? দাদুর কাছেই শোনা গেল, শীতের মধ্যে থাকতে থাকতে তাদের নাকি অভ্যেস হয়ে গেছে। দাদুর কাছে শুনলাম, দার্জিলিংয়ের সবুজ চায়ের কথা। মুনতাহার আম্মু নাস্তা পাঠিয়েছেন। মুচমুচে আলু ভাজা, নুডুলস, সেমাই। দীপ্ত আলু ভাজা মুচমুচ করে দাঁতের নিচে ভাঙতে ভাঙতে বলল, আচ্ছা দাদু, আপনি যে কেনিয়ার জঙ্গলে কাঠ কাটতেন কখনো বাঘ বা কোন জন্তু আপনাকে আক্রমণ করেনি। দাদু সেমাই খাচ্ছিলেন। দীপ্তর প্রশ্নে মুচকি হাসলেন। বললেন, তুমি জঙ্গলে যাবে, কাঠ কাটবে, জীব-জন্তু আক্রমণ করবে না, এটা খুব কম ক্ষেত্রেই হয়। মুনতাহা বলল, দাদু তাহলে আপনাকেও কি বাঘ আক্রমণ করেছিল? দাদু বললেন, আক্রমণ করেনি। তবে তাড়া করেছিল। আমরা কেনিয়ার যে বনে কাঠ কাটতাম, ওখানে ছিল শুধু চিতাবাঘ। ওরা বেশ ক্ষিপ্র। একদিন হল কী, আমার সাথে চারজন কেনিয়ান ছিল। আমরা পাঁচজনে জঙ্গলের বেশ গভীরেই চলে গিয়েছিলাম। সব গাছ কাটার অনুমতি আমাদের ছিল না। যেসব গাছ কাটা যাবে, তার একটা তালিকা ধরিয়ে দিয়েছিল কেনিয়ার বন বিভাগ। তালিকার ভেতরেই আছে এমন একটা বিশাল গাছ আমরা কাটতে শুরু করে দিলাম। কাটা গাছটা গিয়ে পড়ল আরেকটা গাছের ওপরে। গাছটার নিচে একটা চিতা ছানাপোনা নিয়ে ঝিমুচ্ছিল। কাটা গাছটায় চিতার একটা বাচ্চা আহত হলো। কোন মা কী আর নিচের চোখে সন্তানের ক্ষতি সহ্য করতে পারে। বিদ্যুৎ বেগে চিতাটা লাফিয়ে উঠল। তারপরই আমাদের তাড়া করল। আমরা ছুটছি, পেছনে হিংস্র চিতা। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল। সামনে কয়েকটা বিশাল উঁচু গাছ পেয়ে গেলাম। আমরা পড়িমরি গাছের মগডালে উঠে পড়লাম। এদিকে গাছের নিচে চিতার কী লাফালাফি! আমাদের অবাক করে দিয়ে চিতা গাছ বেয়ে ওপরে উঠে আসতে লাগল। আমাদেন সাথে ছিল উদুম্বে নামে এক কেনিয়ান। তাঁর ছিল পাহাড় সমান সাহস। সে গাছের বড় একটা ডাল ভেঙে চিতটার শরীরে একটা মোক্ষম ঘা বসিয়ে দিল। চিতাটা পড়ে গেল মাটিতে। খবর পেয়ে বন বিভাগের মানুষজন এসে চিতাকে ভাগিয়ে দিয়ে আমাদের প্রাণে বাঁচায়। না হলে, বুঝতেই পারছো আমাদের অবস্থা সেদিন কী হতো। দীপ্ত বলল, দাদু আপনারা তো সেদিন বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন। তা তো বটেই। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন। দুপুরের নামাজের আজান দিতে দাদু উঠে গেলেন। তিনি এখন মসজিদে যাবেন। মুনতাহাও উঠে যাচ্ছিল তাই দেখে দীপ্ত বলল, তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ? মুনতাহা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ভাইয়া, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। একটু অপেক্ষা কর দেখতে পাবে। মুনতাহা রঙিন কাগজে মোড়ানো একটা প্যাকেট নিয়ে ফিরে এল। দীপ্ত হাতে নিয়ে দেখল প্যাকেটের ভেতরে বেশ কয়েকটা নতুন বই। নতুন বইয়ের গন্ধ দীপ্তর ভাল লাগে। দীপ্ত যখন বইগুলো উল্টে-পাল্টে দেখছে তখনই মুনতাহা বলল, বইগুলো আমি পুরস্কার পেয়েছি। কোথায়? সরকারি গণগ্রন্থাগারে বিজয় দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়। আমি আবৃত্তিতে প্রথম হয়েছি। এই দেখ সার্টিফিকেটও পেয়েছি। তুমি তো একটা দারুণ কাজ করে ফেলেছ। আমি তো জীবনে কোন সার্টিফিকেটই পাইনি। দীপ্ত হাসতে হাসতে বলল। মুনতাহার ঠোঁটেও হাসি। গর্বে ওর বুকটা ফুলে উঠছে। তাই বেশ খুশি নিয়েই বলল, আমি পেলে, তুমিও তো পাবে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেই পার। দীপ্ত বলল, করি তো, সার্টিফিকেট তো কোনদিন পেলাম না। শুধু পুরস্কার পেয়েছি। এমন সময় মুনতাহার আম্মু এলেন। তিনি ওদের খেতে আসতে বললেন। খাবার টেবিলে গিয়ে দীপ্ত খুশি, টেবিলে সাজিয়ে রাখা আছে বিরিয়ানি। ওর সবচেয়ে প্রিয় খাবার। খাওয়া শেষে দীপ্ত বিছানায় এল। দুপুরে খাবার পরে ওর ঘুমানোর অভ্যেস আছে। বিছানায় পড়তে না পড়তেই হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। দীপ্ত স্বপ্ন দেখছে। বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছে দীপ্ত আর মুনতাহা। গভীর বন সূর্যের আলো তেমনভাবে প্রবেশ করে না। ওরা হাঁটছে তো হাঁটছেই। তবু বন শেষ হচ্ছে না। কত যে পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। এত সুন্দর সুন্দর পাখি ওরা আগে কোনদিন দেখেনি। দুটো হরিণ ওদের সামনে দিয়ে ছুটে গেল। ভালোই লাগছে বনের ভেতরে হাঁটতে। একটু ভয় ভয় করছে। কখন হালুম করে লাফিয়ে পড়ে বাঘ ওদের ঘাড়টা মটকে দেয়। স্বপ্ন দেখতে দেখতে দীপ্তর ঘুমটা ভেঙে গেল। রাজ্যের বিরক্তি এসে মনের ভেতরে প্রবেশ করল। শেষ পর্যন্ত ওদের কী হলো তা জানা থেকে গেল না। দীপ্ত বিছানায় উঠে বসতে দেখল সন্ধ্যা হচ্ছে। চারপাশে আঁধার নেমে আসছে। দীপ্ত অবাক হলো। এত দীর্ঘ সময় ও ঘুম দিলো। অথচ কেউ ওকে জাগালো না।

পাঁচ. এখনো তেমনভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি। দীপ্তরা নৌকায় করে পদ্মার চরে যাচ্ছে। আজ ওরা চরের কাশবনে বনভোজন করবে। বড় বড় দুটো নৌকায় করে যাচ্ছে তারা। দীপ্তদের পরিবার, মুনতাহাদের পরিবার, খালাদের পরিবার সাথে দীপ্তদের প্রতিবেশীদেরও একটা পরিবার আছে। জনা পঁচিশেক মানুষ হবে ওদের দলে। ঠিক যেন একটা পারিবারিক বনভোজন। সব রকম ব্যবস্থা ওরা সাথে নিয়ে যাচ্ছে। প্যান্ডেল করার জন্য বাঁশ, সামিয়ানা তো আছেই। সাথে রান্নার জন্য বাবুর্চি পর্যন্ত নিয়েছেন আব্বু। বাহার বাবুর্চির ছেলেকে। অপূর্ব রান্না করেন তিনি। দীপ্ত জন্মদিনে তিনিই তো রান্না করেছিলেন। সকলেই রান্নার প্রশংসা করেছিলেন। বিরিয়ানির স্বাদ তো এখনো ওর মুখে লেগে আছে। মুরগির রোস্ট হয়েছিল মুখে লাগার মতো। স্বচ্ছ নীল পানিতে মৃদু ঢেউ তুলে নৌকা যাচ্ছে। এখন নদীতে তেমন পানি নেই। চারদিকে চর পড়েছে। বাংলাদেশের সব নদীর অবস্থা-ই নাকি এরকম। দীপ্ত ক’দিন আগে টেলিভিশনে খবরে শুনেছে, দেশের সব নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর পরে, নদী বলে কোন কিছু থাকবে না দেশে। সব শুকিয়ে গিয়ে ধু ধু বালুচর হয়ে যাবে। মাথার ওপর দিয়ে একটা বক উড়ে গেল। মুনতাহা খুশিতে হাততালি দিল। চার পাশের চমৎকার দৃশ্য দেখে দীপ্তর চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। খালা লালন গীতি গাইছেন, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, কেমনে এসে যায়।’ সকলেই খুশিতে টগবগ করছে। দীপ্তর কী আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। নৌকা পাড়ে ভিড়তেই ছোটরা লাফিয়ে কাদা মাটিতে নামল। কাঠের সিঁড়ি মাঝি নামিয়ে দিল। ধীরে ধীরে বড়রা নামলেন। পাড় থেকে বেশ কিছুটা ওপরে গিয়ে সামিয়ানা টাঙালে বড়রা গিয়ে ওখানে বসল। দীপ্তরা বালুচরে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। ওদের সামনে বিশাল বালুচর। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন সাদা চাদর বিছিয়ে রেখেছে। একপাশে সাদা সাদা ফুলের কাশবন। চরে বালুর ভেতরে গজিয়েছে ছোট্ট ছোট্ট ঝাউ গাছ। ছোটরা সেগুলো উপড়াতে ব্যস্ত। দীপ্ত আর মুনতাহা বালুর ভেতর দিয়ে হেঁটে সামনে যাচ্ছে। শুনেছে, চরের ওপাশেও নাকি আরেকটা নদী আছে। অবশ্য ওটাও পদ্মা নদী। মাঝখান দিয়ে চর পড়ে দু’ভাগ হয়ে গেছে। ওই নদীটা পেরোলেই সীমান্ত। একপাশে বাংলাদেশ, অন্য দিকে ভারত। নিজেকে এমন স্বাধীন কোনদিন লাগেনি দীপ্তর। ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে। পেছনে সামিয়ানা একটা বিন্দুর মত মনে হচ্ছে। মুনতাহা বলল, আমাদের এখন ফেরা উচিত। অনেক দূরে চলে এসেছি। দীপ্ত মুচকি হাসি দিয়ে বলল, কেন, তোমার ভয় লাগছে? তা নয়। চার পাশে কেমন ফাঁকা ফাঁকা; কোন বিপদে পড়লে কারো সাহায্য পাব না। তা ঠিক। আম্মু অবশ্য বলে এখন সময় খুব খারাপ। বাইরে পা বাড়ালেই নাকি বিপদের গন্ধ পাওয়া যায়। চল তাহলে আমরা ফিরি। হুম। ওরা গল্পের ভেতরে নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলেছিল। এমন সময় ব্যাপারটা ঘটল। মুনতাহার পায়ের পাশ দিয়ে একটা সাপ ছুটে পালাল। ভয়ে ও চিৎকার দিলো। জড়িয়ে ধরল দীপ্তকে। সাপটা বাচ্চা সাপ। দ্রুত দৌড়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল ছোট্ট ঝাউ গাছের ভেতরে। দীপ্ত কাছে গিয়ে সাপটা দেখতে পেল না। মাটির ঢেলা দিয়ে ঝাউ গাছে ছুড়ে মারল। তবু সাপটা বেরুল না। আরও কিছুক্ষণ দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মুনতাহার কারণে তা সম্ভব হলো না। ও খুব ভয় পেয়েছে। দ্রুত ফিরে যেতে চাচ্ছে আব্বু-আম্মুদের কাছে। দীপ্ত নিষেধ করে দিল মুনতাহাকে ব্যাপারটা ও যেন না বলে বড়দের। তাতে বনভোজনের সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। আব্বু-আম্মু বকাবকি করবেন; ওরা কেন অতটা দূরে গিয়েছিল। এতে ভবিষ্যতে হয়তো আর কোথাও যাওয়া-ই হবে না। মুনতাহা বুঝল ব্যাপারটা। তাই দীপ্তর কথাতেই সায় দিল। ওরা ফিরে এসে দেখল সকলে নাস্তা করছেন। আম্মু জানতে চাইল ওরা কোথায় গিয়েছিল। দু’জনই চরে হাঁটতে গিয়েছিল বলে জানাল। সকলের সাথে নাস্তা করতে বসে গেল ওরা। খালা বাসা থেকে পরোটা তৈরি করে নিয়ে এসেছেন। সাথে গরুর গোশত ভুনা। বেশ মজা লাগছে। সকলেই খাচ্ছে। বাহার চাচার ছেলে রান্না শুরু করে দিয়েছেন। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে সুন্দর খুশবু। আজ রান্না হচ্ছে, সাদা পোলাও, খাশির গোশ্ত, মাছের কোপ্তা আর ছোলার ডালের সাথে কলিজা। কোকের বোতলগুলো কে যেন পানিতে ডুবিয়ে রেখেন। ক্রীড়ানুষ্ঠান শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সকলে। এটা দীপ্তর খালুর পরিকল্পনা। তিনি যখন বনভোজনের কথা শুনলেন, তখন প্রস্তাব করলেন, শুধু খেয়ে-দেয়ে সবকিছু শেষ করে দিলেই হবে না। নিজেদের শারীরিক এবং মানসিক উৎকর্ষতার বিকাশে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা প্রয়োজন। তাঁরই চিন্তা-ভাবনার ফসল এই আয়োজন। কুইজ প্রতিযোগিতাও আছে। অনুষ্ঠান শেষে বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করা হবে। দীপ্তর আব্বু বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন। খালু এক গাদা বই কিনে নিয়ে এসেছেন। পুরস্কার হিসেবে সেগুলোই সকলে পাবে। ছোটদের বিস্কুট দৌড় প্রতিযোগিতায় দীপ্ত প্রথম হলো। মুনতাহা সকলের শেষে দৌড় শেষ করলো। দীপ্তর আম্মুও মহিলাদের মিউজিক্যাল চেয়ারে দ্বিতীয় হয়েছেন। মাঝখানে খালা চেঁচামেচি করে বললেন, দীপ্তর আব্বু নাকি কাঁটায় কাঁটায় বিচার করছেন। এ যুগে নাকি এটা ব্যতিক্রম। তবে সবই ছিল নির্দোষ আনন্দ পাওয়ার জন্য। দুপুর দুটোর দিকে খাবার দেয়া হলো। শুক্রবার হওয়ায় পুরুষরা জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। দীপ্তও বড়দের সাথে গিয়েছিল। অনেক দূর হেঁটে ওরা গ্রামের ভেতরে একটা মসজিদে গিয়েছিল। খুব সুন্দর মসজিদটা। চারদিকে পাকা দেয়াল। ওপরে টিনের ছাদ। অনেক মানুষে ভরে গিয়েছিল মসজিদটা। দীপ্তরা খাওয়া শেষে দল বেঁধে করতে বসল। বড়রা বড়দের দলে, ছোটরা ছোটদের দলে। বাড়ি ফেরার জন্য শেষ বিকেলে ওরা নৌকায় চাপল। সূর্য তখন কিছুটা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। আজকের দিনটা বেশ আনন্দে কাটল দীপ্তর। অনেকদিন মনে থাকবে আজকের দিনটার কথা।

ছয়. ছোট্ট একটা ট্রেনে তারা চলেছে। তার মত বয়সের অনেকে আছে। দীপ্ত সকলকে চিনতে পারছে না। ক্লাসের বন্ধুরা তাকে দেখে হাততালি দেয়। তার পাশে বসে আছে মুনতাহা। সুন্দর একটা ড্রেস পরেছে আজ ও। ঠিক যেন পরীর মত লাগছে। তারা কী পরীর দেশে যাচ্ছে? শিশুপার্কের মতো ছোট্ট ট্রেনটা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে কু ঝিক ঝিক করতে করতে চলে যাচ্ছে। ভারি মজার ব্যাপার তো। পাহাড় শেষ হতেই নদী শুরু হয়ে গেল। নদীতে কাচের মতো টলটলে পানি। দীপ্ত জানালার পাশে বসে আছে। জানালার ওপাশ দিয়ে মেঘ ছুটে যাচ্ছে। হাত বাড়ালেই সে ছুঁয়ে ফেলতে পারবে। দীপ্তর মেঘ ছুঁতে ইচ্ছে করে না। চুপচাপ বসে মেঘের ওড়াউড়ি দেখতে ভাল লাগে। সুন্দর একটা স্টেশনে এসে ট্রেন দাঁড়াল। ঘন গোঁফঅলা একজন বুড়ো মানুষ ঢংঢং করে লোহার ঘণ্টা পেটাচ্ছেন। দীপ্তরা হুড়মুড় করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। মুনতাহা অল্পের জন্য বেঁচে গেল। পড়েই যাচ্ছিল, দীপ্ত ধরে ফেলল। স্টেশনের মেঝেতে মসৃণ টাইলস লাগান আছে। সুন্দর, ছিমছাম স্টেশনটা। কোথাও কোন ময়লা পড়ে নেই। স্টেশন বিল্ডিংটা দেখে মনে হচ্ছে যেন রাজ প্রাসাদ। এমন চমৎকার স্টেশন দীপ্ত জীবনেও দেখেনি। বিশাল সিংহ দরজা পেরিয়ে দীপ্তরা বাইরে এল। ঝাঁ চকচকে মেইন রোড দিয়ে সুন্দর সুন্দর গাড়ি ছুটে চলেছে। ওদের সামনে একটা ট্যাক্সি ক্যাব এসে দাঁড়াল। ওরা উঠে বসতেই ক্যাবটা চলা শুরু করল। কোথায় যাবে বলতেও হলো না। চালক দক্ষ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে। কুড়ি মিনিটের মতো চলার পর ক্যাবটা একটা আলিসান বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। সূর্যের আলোতে বিল্ডিংটা সোনার মত চকচক করছে। উর্দি পরা সান্ত্রী ওকে আর মুনতাহাকে অভিবাদন জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। কারুকার্য খচিত কার্পেট মাড়িয়ে ওরা প্রাসাদে প্রবেশ করল। ফুটবল মাঠের মত বিশাল দরবার হল। মণি-মানিক্যখচিত সিংহাসনে বসে আছেন রাজা। দীপ্ত আর মুনতাহা প্রবেশ করা মাত্র রাজা উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করলেন। ওদেরকে বসতে দিল সিংহাসনের মত কুর্শিতে। রাজা দীপ্ত আর মুনতাহাকে সামনের দিকে হাত বাড়াতে বললেন। তারা হাত বাড়াতে অদৃশ্য কোথাও থেকে সোনার থালায় চলে এল হরেক রকমের ফলমূল। লাল-হলুদ-সবুজ নানান রঙের ফলমূল। রাজা তাদের ইশারায় খেতে বললেন। তারা খেতে শুরু করল। কী যে সুস্বাদু সেইসব ফল। মধুর চেয়েও মিষ্টি। এমন স্বাদের ফল তারা জীবনেও খায়নি। খাওয়া শেষে থালাটা সামনের দিকে ধরতেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তারা আবার সামনে হাত বাড়াল, ম্যাজিকের মত হাতে চলে এল রুপার গ্লাসে দুধ মেশানো জাফরান ফুলের শরবত। তারা গ্লাসে চুমুক দিতেই অমৃতের স্বাদ পেল। খাওয়া শেষে তারা রাজ প্রাসাদ ঘুরে দেখতে বের হল। প্রথমে অবাক করা একটা ব্যাপার তাদের চোখে পড়ল। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দরজা নিজে থেকেই খুলে যাচ্ছে। কাউকে খুলে দিতে হচ্ছে না। তারা গিয়ে একটার পর একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা নিজেই নিজেকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। দীপ্ত আর মুনতাহা প্রবেশ করছে। হীরা-জহরত-মণি-মুক্তায় সাজানো পুরো রাজ প্রাসাদ। যেটা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তারা। টেনিস কোর্টের মত একটা পালং দেখল তারা। রাজা মশায় নাকি এখানে ঘুমান। সমস্ত পালংটা সোনার তৈরি। মাথার দিকে করা আছে হীরের কারুকাজ। সবুজ লন পেরিয়ে তারা বাগানে চলে এল। হাজারো ফুল ফুটে আছে। চমৎকার সুঘ্রাণ তাদের। মুনতাহা ফুল ছিঁড়ে চুলের ক্লিপের ভেতরে আটকে দিলো। ফুলের বাগান শেষে শুরু হয়েছে ফলের বাগান। আঙুর ঝুলছে থোকায় থোকায়। লাল টুকটুকে আপেলের ভারে গাছের ডাল মাটি স্পর্শ করছে। লাল স্ট্রবেরি সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে। দীপ্ত আর মুনতাহা যত দেখছে অবাক হয়ে যাচ্ছে। ফলের বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীরের নদী। মিষ্টি একটা গন্ধ বাতাসে ভাসছে। দুধ সাদা ক্ষীর থেকে ভাঁপ বের হচ্ছে। এই রাজ্যের জনসাধারণ ইচ্ছে করলেই নদী থেকে ক্ষীর নিয়ে খেতে পারে। দীপ্তরা এবার একটা সুন্দর ঘোড়ার গাড়িতে করে ক্ষীরের নদীর পাশ দিয়ে রঙিন পাথরের খনি দেখতে ছুটল। এখানে হরেক রঙের পাথর তোলে খনি থেকে থেকে শ্রমিকেরা। কালো পোশাক পরে শ্রমিকরা পাথর তুলছে। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-কালো কত যে রঙ পাথরের। নামও আছে ভিন্ন ভিন্ন। তাদের সাথে আসা রাজার সান্ত্রীরা তাদেরকে নানান রঙের পাথর উপহার দিল। পাথরের খনি থেকে সমুদ্র দেখতে এলো দীপ্ত আর মুনতাহা। নীল জলরাশি ছলাৎ ছলাৎ করে পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। সৈকত জুড়ে ঝাউবন। বাতাস শন শন করে বইছে। কী যে চমৎকার সমুদ্র সৈকত, যে দিকে তাকাচ্ছে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। বড় বড় জাহাজ জলে ভাসছে। নানার বয়সের মানুষ সেই জাহাজে চড়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। বামে তাকাতে তারা অবাক হয়ে গেল। আরে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে একটা সবুজ পাহাড় আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মুনতাহা প্রস্তাব করল পাহাড় দেখতে যাওয়ার। তারা পাহাড়ের দিকে চলল। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণা নামছে। অপূর্ব ভঙ্গিতে শুভ্র জলরাশি লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে নিচের দিকে। দীপ্তর ইচ্ছে করছিল পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে। মুনতাহার প্রথমে ভয় ভয় করলেও পরে সেও পাহাড়ের চূড়ো দেখার লোভ সংবরণ করতে পারল না। দীপ্ত দেখতে পেল মোটা একটা রশি ঝুলছে। চূড়ো থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে। প্রথমে দীপ্ত পেছনে পেছনে মুনতাহা সেই রশি বেয়ে উঠতে শুরু করল। তারা উঠছে তো উঠছেই। আধা ঘণ্টার মত তারা এভাবে একটানা উঠল। বেশ ক্লান্ত বোধ করছে। ঘাস বিছানো ছোট্ট একটা জায়গায় থামল। তাদের পাশ দিয়ে ঝর্ণার পানি নাচুনে কন্যার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। তারা দু’জনে আঁজলা ভরে পানি পান করল। বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠতে শুরু করল। সম্ভবত হাত কুড়ি উঠেছে এমন সময় টের পেল রশিটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তারা প্রাণপণে রশিটা আঁকড়ে ধরল। তবু রশিটা ছিঁড়ে গেল। তার নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা নানান পাহাড়ি গাছ ধরে নিজেদের পতন ঠেকানোর কাজ করছে। কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তারা ক্রমাগত নিচের দিকে পড়তেই আছে। শেষ পর্যন্ত তারা পাহাড়ের নিচে একটা গভীর খাদে গিয়ে পড়ল। তাদের হাড় ভেঙে গেছে। সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। চামড়া ছড়ে গেছে এখানে-ওখানে। দীপ্ত আর মুনতাহা খাদের অতলে নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। বোধ হয় মারাই যাচ্ছে। এমন সময় তারা দেখতে পেল একটা সবুজ রঙের মস্ত সাপ তাদের গিলে ফেলতে ছুটে আসছে। ভয়ে দু’জনে মরণ চিৎকার ছাড়ল। ঘুম ছুটে যেতে দীপ্ত দেখল তার সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। প্রচণ্ড পানির তেষ্টা পেয়েছে। শূন্য পাওয়ারের বাল্ব মিটিমিটি জ্বলছে। এই ঘরে একাই থাকে সে। বিছানা থেকে নেমে টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি পান করল দীপ্ত। পুনরায় বিছানায় ফিরে এসে দীপ্ত অনুভব করল এতক্ষণ সে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল। এই তো নিজের ঘরেই আছে সে। এতক্ষণ তার পড়ে থাকার কথা পাহাড়ের খাদে। আর মুনতাহাও বা কোথায়? দীপ্ত দুই ঠোঁটে হাসি এলো। ঘুমের মধ্যে কত অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন না মানুষ দেখে। এই তো কিছুক্ষণ আগে সে ঘুরে বেড়াচ্ছিল স্বপ্নের দেশে। কিন্তু একটা ব্যাপারে তার খটকা লাগছে। মানুষ নাকি স্বপ্নে সবকিছু সাদা-কালো দেখে। তাহলে সে কী করে সবকিছু রঙিন দেখল! অনেক চেষ্টা করেও ব্যাপারটার রহস্য বের করতে পারল না।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ