স্বপ্ন ভঙ্গে সুখ

স্বপ্ন ভঙ্গে সুখ

তোমাদের গল্প মিজান ইবনে মোবারক ফেব্রুয়ারি ২০২৪

‘মামা এইটায় আসেন, এইদিকে মামা। আসেন, আসেন, জলদি আসেন। এখনই ছাইড়া দিবো।’

এভাবে নদীর ঘাটে অবিরত ডাকতে থাকে আবির। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে ওর ডাক শুনে, কেউবা আবার উঠবে কি উঠবে না ভেবে দাঁড়িয়ে আছে।

আবিরের বয়স এগারো বছর। গ্রামের আর দশটা সহজ-সরল ছেলের মতোই ওর বেড়ে ওঠা। সকাল হলে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙা, গাছের লতাপাতা ভেদ করে দিনের প্রথম সূর্যের সোনালি মিষ্টি আলো ছোঁয়া, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, চোখ জুড়ানো সবুজ গাছপালা এসবের মধ্যে বেড়ে উঠেছে আবির। আবির গ্রামে থেকেও স্বপ্ন দেখত অনেক বড়ো হওয়ার। একবার ওদের স্কুলে জেলা থেকে পরিদর্শক এসেছিলেন। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগী ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিলেন। আবিরের একটা কথা প্রায়ই খুব মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আজ তোমরা ছোটো হলেও তোমাদের ইচ্ছেগুলো, তোমাদের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাগুলো কখনো ছোটো নয়। তোমরা চাইলে অনেক বড়ো হতে পারবে। তাই এখন থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী হও।’ তখন থেকেই আবির স্বপ্ন দেখছে বড়ো হওয়ার।

আবির পরিবারের বড়ো সন্তান। আবিরের ছোটো ছোটো আরো দুটি বোন রয়েছে। একজনের বয়স সাত বছর, আরেকজনের বয়স তিন বছর। আবিরের বাবা নদীর ঘাটের মাঝি। এপার থেকে ওপার লোকজন পারাপার করিয়ে যা টাকা-পয়সা পায়, তা দিয়েই তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনোরকম খেয়েপরে দিন কাটায় আবিরের বাবা। একদিন হঠাৎ করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল আবিরের বাবা। হাসপাতালে নিয়ে টেস্ট করার পরে ক্যান্সার ধরা পড়ল। এ রোগের চিকিৎসা খরচ বহন করার সাধ্য নেই আবিরের পরিবারের। তাই হাসপাতালে কয়দিন থাকার পরে বাড়িতে নিয়ে এসেছে সবাই।

পরিবারের হাল ধরতে হলো এগারো বছর বয়সের আবিরকে। তখন সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে উঠেছিল আবির। কি করবে ভেবে পায় না। বাবার সাথে বেশ কয়েকবার নদীর ঘাটে গিয়ে নৌকা চালিয়েছিল শখের বশে। কিন্তু এ নৌকাই যে কয়দিন পরে জীবিকা নির্বাহের জন্য ধরতে হবে তা বুঝতে পারেনি ঘুর্ণাক্ষরেও। বেছে নিল বাবার পেশা। প্রথম প্রথম বেশ কষ্ট হয়েছিল আবিরের। লোকজন উঠতে চাইত না ওর নৌকায়। তবুও আবির নিজেকে শক্ত রাখত। ওর বাবা বলেছিলেন, যে-কোনো কাজে সফল হতে চাইলে লেগে থাকতে হবে।

আজ এক মাস হলো আবিরের বাবা মারা গেছে। সংসার সামলানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন আবিরের কাঁধে। বাবা মারা যাওয়ার পর ভেঙে পড়ে আবির। দু চোখে শুধু অন্ধকার দেখতে পায়। গ্রামে থাকত বলে তেমন কোনো কাজও পেত না। তাই বাধ্য হয়ে আবিরকে নদীর ঘাটে নৌকা চালানোর পেশাই বেছে নিতে হলো। সেই সকালবেলায় অন্ধকার থাকতেই বৈঠা নিয়ে চলে যেত ঘাটে। যাওয়ার সময় মা এক বাটি খাবার দিয়ে দিতেন। তাতে পান্তা ভাত, দুটো মরিচ,  পেঁয়াজ এগুলোই বেশি থাকত। খুব একটা ভালো খাবার জুটত না ওদের। নদীর ঘাটে গিয়ে নদীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে প্রায়ই তাকিয়ে থাকত আবির। স্কুলের সেই স্যারের কথা মনে পড়ে যিনি বলেছিলেন, তোমরা চাইলে অনেক বড়ো হতে পারো। আবিরও চেয়েছিল বড়ো কিছু হতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! আবিরের সেই বড়ো হওয়ার স্বপ্নটি স্বপ্নই থেকে গেল।

এর মাঝে কেটে যায় অনেকগুলো বছর।

আবিরের স্বপ্ন আর পূর্ণতার মুখ দেখেনি। তবে স্বপ্ন ভঙ্গের মাঝেও রয়েছে আবিরের সুখ, আবিরের ভালো লাগা। আবির বড়ো না হতে পারলেও ছোট্ট বোন দুটিকে মানুষ করেছে। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়ে বোন দুটিকে ডাক্তার বানিয়েছে। এখানেই আবিরের সুখ রাশি রাশি। নিজের স্বপ্ন ভঙ্গে সুখ। নিজে বড়ো না হতে পারলেও বোন দুটির স্বপ্ন তো পূরণ করেছে!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ