সোনার কাঠি রূপার কাঠি

সোনার কাঠি রূপার কাঠি

উপন্যাস ডিসেম্বর ২০১০

নয়ন রহমান

Sonar Kathi-Rupar Kathi‘নদীর তীরে ফুলের মেলা’ বইখানি আমার খালামণি আমাকে আমার কোনো এক জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। তারই উৎসাহে আমি হেঁটে ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’ যেতাম। সে এক অন্য জগৎ। হেঁটে যেতাম নির্বিঘেœ। কারণ তখন রাস্তায় এত ভিড় ভাট্টা ছিল না। মতিঝিল সরকারি কলোনি থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পর্যন্ত ছিল আমার নির্দিষ্ট গতিপথ। আমি খুব বড় মাপের মানুষ হবো, খালামণি তাই চাইতেন। এ জন্য খালামণি আমাকে এক সময় মতিঝিলের একটা নামকরা স্কুলে ভর্তি করিয়েও দিয়েছিলেন। ওই স্কুলে নাকি পড়াশোনা ভালো হয়। চরিত্র গঠনও হয়। খালামণির ধারণা অনেকটাই ভুল ছিল। ভুল না হলে আমার জীবনে অধঃপতন নেমে এলো কেন? আমার জিনের দোষ? নাকি পরিবেশের দোষ? স্বপক্ষে আমার অনেক বক্তব্য আছে। সাফাই গাইতে গিয়ে খালামণিকে আমি অনেক কথা বলেছিলাম। মৃদুকণ্ঠে খালামণি বলেছিলেন, তোমার মত তো কেউ হয়নি?

খালামণি, সবাই কি একরকম হয়?

এই বুড়িগঙ্গাকে তো খালামণিই আমাকে চিনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, নদীর তীরে এলে মন ভালো হয়ে যায়। নদীতে বেড়াতে পারলে আরো ভালো হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজরায় করে ঘুরতেন। রাত্রি যাপন করতেন। তার অনেক বিখ্যাত লেখা নদীর পানিতে ভাসতে ভাসতেই তিনি সৃষ্টি করেছেন। আমার খালামণিও নদীর তীরের মানুষ। গ্রামে তার শেকড় রয়েছে। আমার কোনো গ্রাম নেই। চোখ মেলে দেখেছি এই ঢাকা শহর। নামীদামি এক হসপিটালে জন্ম হয়েছে আমার। আমার আব্বা-আম্মা শহরের জীবনে এতটাই বন্দী হয়ে গেছেন যে, তাদের যে একদা একটা সবুজ গ্রাম ছিল, তাও তারা ভুলে গেছেন। আমারও তাই গ্রাম দেখা হয়নি। গ্রাম দেখেছি টিভি পর্দায়, বুড়িগঙ্গার এপারে দাঁড়িয়ে ওপারের গাছপালা দেখে।

এখন আমি কিশোর অবতীর্ণ এক বালক। বালক কিশোর, না যুবক ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে যুবকদের অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকাল ধরা হবে। কী হাস্যকর কথা। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত যদি শিশুকাল ধরা হয় তাহলে এই বয়সে পা রাখার আগেই তো আমি কত অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছি।

নদীরে, তোর তীরে দাঁড়িয়ে এক সময় খালামণি কত সুন্দর সুন্দর কথাই না বলেছেন! বলেছেন, অমি রে, এই বুড়িগঙ্গা নদীর সৌন্দর্য দেখে একজন কবি লিখেছেন, রূপালী নদীরে তোর রূপ দেইখা হইলাম পাগল। তিনি অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী। আমার শিক্ষক। এখন এই মুহূর্তে বুড়িগঙ্গাকে দেখেও পাগল হতে হয়। মাথা খারাপ হয়ে যায়। তা এর রূপ বা সৌন্দর্য দেখে নয়। এর কুৎসিত রূপ দেখে মাথা খারাপের চাইতে মন খারাপ হয় বেশি। তা যাদের মন বলে বস্তু আছে তাদেরই তো মন খারাপ হওয়ার কথা। বুড়িগঙ্গার এখনকার হাল-হকিকত দেখে কি বলা যায় রূপালী নদীরে ...। কী কালো ঘন পানির কুয়া এখনকার এই বুড়িগঙ্গা। আহারে! আবর্জনায় ভরে গেছে এর তলদেশ। লগি ঠেলে নৌকা বাইতেও কষ্ট হয়। তবু তো ভট ভট করে লঞ্চ চলে। ময়লা আবর্জনা সরিয়ে মানুষ গোসল করে সাবান ঘষে ঘষে। আমার খালামণিকে নদীর এ দুর্দশা দেখতে হয়নি। খালামণি মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। আর আমি? বেঁচেও মরে আছি। আমার মৃত্যু হয়েছে বেঁচে থাকতেই। আমার মরণ দেখে খালামণি বলেছেন, তুই এমন হলি কেন? আমি তোর নাম রেখেছিলাম শখ করে অমিয়Ñ অমৃত। অমৃত না হয়ে তুই বিষ হয়ে গেলি কেন?

খালামণি তোমাকে তো আমি আমার কথা কিছু কিছু বলেছি। তুমি মুখ কালো করে থেকেছ। আমার আব্বা-আম্মার ওপর কোনো কথা বলতে পারনি। একেবারে যে বলনি তা নয়। তা তারা যদি তোমার কথায় কান না দেন তাহলে তুমি কী করতে পার?

ওই যে স্কুলের কথা বললাম না? শিশু বয়সে স্কুলের পরিবেশ মনটাকে উৎফুল্ল করে রাখে। আমার মনটাকে কিন্তু সব সময় বিষণœ করে রাখত। প্রথমে মা আমাকে পাড়ার একটা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দেন। মার সাথে স্কুলে হেঁটে যেতাম। হেঁটে আসতাম। স্কুলে খেলার মাঠ নেই। ফুলের বাগান নেই। আমরা হৈ-হুল্লোড় করতাম। বাড়িওয়ালা খুব বিরক্ত হতো। বছরের মাঝখানে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলো। হেড স্যার বললেন, বছর শেষ হোক। বাড়িওয়ালা আমাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিলো। সে কি অত্যাচার তা বুঝিয়ে বলার নয়।

বাড়িওয়ালার কাজের বুয়া দোতলা থেকে বালতি ভর্তি ময়লা পানি ছুড়ে দিত মাঠে। আমরা ভিজে একসা হতাম। কেউ কেউ পা পিছলে পড়ে ব্যথা পেতাম। অবশেষে পাড়ারই বড় একটা গ্যারেজে জায়গা হলো আমাদের। গরমে ঘামে আমরা অস্থির। ম্যাডামরাও অস্থির। কিভাবে তিনটা মাস কেটেছে বলতে পারব না। এরপর বাসা বদল করে আমরা চলে এলাম বাসাবো। এখানকার স্কুলটা মোটামুটি ভালো। খেলার মাঠ ছোট। ফুলের গাছ টাছ নেই। তবে গাছের ছায়া আর বাতাস প্রচুর। আমাদের বড় আপা নাকি তোমার পরিচিত। আম্মা তোমাকে এ কথা জানাতেই তুমি ছুটে এলে স্কুলে। স্কুল দেখে তোমার পছন্দ হলো না। নিজের দোতলা বাড়িটাকে স্কুল বানিয়েছেন বড় আপা। ছাত্রছাত্রী অগণিত। তোমাকে আমাদের বড় আপা খুব খাতির করলেন। তা দেখে আমার আনন্দ দেখে কে! তা আনন্দ এক ফুঁৎকারে নিভে গেল যেদিন শপাং শপাং বেতের বাড়ি পড়লো আমার পায়ে। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এলাম। মা ছুটে গেলেন তোমার কাছে। তুমি আমার পায়ের অবস্থা দেখে পরদিন ছুটে এলে আমার স্কুলে। বড় আপা তোমার নালিশ শুনে হতবাক। আমাকে তক্ষুনি তার রুমে ডেকে আনা হলো। ডেকে আনা হলো সেই টিচারকে। লম্বা হাড় জিরজিরে ড্রিল টিচারের হাতে তখন শোভা পাচ্ছে সেই বেতটি। বড় আপা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি একে মেরেছেন? টিচার চোখ বড় বড় করে বললেন, কই নাতো? মনে পড়ছে না।

বড় আপা আমাকে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন, কখন মেরেছে, কেন মেরেছে? পড়া পারনি, তাই? আমি বললাম, আমি লাইনে ছিলাম, তখন মেরেছেন। টিচার আকর্ণ হেসে বললেন, ওহোÑ তাই আপা তাই। ফুল ইউনিফরম পরে আসেনি যারা তাদের একটু বেত ছুঁইয়ে গেছি।

আমার মা তাড়াতাড়ি আমার পা দেখিয়ে বললেন, এই আপনার বেত ছুঁইয়ে আদর করার নমুনা? দেখুন তো কেমন দাগ হয়ে গেছে! টিচার তখনো বেত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

বড় আপা ধমক দিয়ে বললেন, আপনি বেত নামিয়ে কথা বলুন। আপনাদের আমি কতদিন বলেছি, বাচ্চাদের গায়ে হাত দেবেন না। এ রকম নালিশ আসতে থাকলে তো আমার স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। যান এখান থেকে চলে যান। আর খোকা শোনো, প্রতিদিন ফুল ইউনিফরমে আসবে। তুমি মোজা পরনি। কেডস পরনি। তোমার দেখাদেখি অন্য ছেলেরাও স্যান্ডেল পায়ে আসতে শুরু করবে।

খালামণি বললেন, সে কথা ঠিক তবে অমিয়র পায়ে যে চুলকানি হয়েছে, ডাক্তার ওকে মোজা পরতে নিষেধ করেছেন। সেদিন একটা রফা হলো অবশ্য। আমার খালামণি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের টিচার। তিনি মানুষের মন ভালো বোঝেন। বাসায় এসে মুখ কালো করে বললাম, খালামণি, আমি ওই স্কুলে পড়ব না।

ওমা, কেন কী হলো আবার? বারবার স্কুল পরিবর্তন করা ঠিক নয়। আমি বললাম, শুধু ড্রিল স্যার বেত দিয়ে পিটুনি দেন তাই নয়, ধর্ম স্যারও মারেন। ধর্ম স্যার কেন মারেন, তোমাদের সূরা মুখস্থ করতে বলেন? পার না? এই বয়সেই কিন্তু সূরা মুখস্থ করা সহজ। খালামণি শুনবে? একদিন আমি মৌলভী স্যারের কাছে কি জন্য পিটুনি খেয়েছিলাম? কী জন্য?

আর বল না আপা, ওকে জিজ্ঞেস করেছে তোমার ধর্মের নাম কী? তোমার রাসূলের নাম কী? ও পারেনি। আমি অবশ্য পরে ওকে শিখিয়ে দিয়েছি, আমাদের ধর্মের নাম ইসলাম। আর আমাদের রাসূলের নাম হজরত মুহাম্মদ (সা), আমাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ‘কুরআন শরীফ’। খালামণির মুখে আমি সেদিন চাপা হাসি দেখেছি।

এরপর তো আমি ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম ঢাকার একটা নামকরা স্কুলে। তাও তোমার সৌজন্যে। কত ভালো ভালো স্কুল-কলেজে যে তোমার কত বন্ধু আর ছাত্রছাত্রী আছে! তুমি বললে, এখান থেকে তুমি এসএসসি পাস করে বেরুবে। তার পর সোজা কলেজ। আমিও মনের আনন্দে পড়তে থাকি, কী সুন্দর স্কুল! রোদ খেলানো মাঠ। ফুলের বাগান! চোখ জুড়িয়ে যায়। মন ভরে যায়। মনের আনন্দে পড়াশোনা করি। স্কুলের কড়াকড়ি খুব বেশি। আম্মা বলেন, তা হোক! কড়াকড়ি থাকা ভালো। এখানে ঘড়ির কাঁটা ধরে সবাই চলে। স্কুলের গেট খোলে সকাল সাতটায়। বন্ধ হয় ঠিক আটটায়। ক্লাস শুরু আটটায়। আটটায় গেট বন্ধ হলে কেউ মাথা খুটে মরলেও দারোয়ান ভাই এতটুকু ফাঁকাও করবে না। আমি সময় মত আসি। আম্মা স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যান। আবার এসে বাসায় নিয়ে যান। দিনগুলো তর তর করে বয়ে যায়। মাঠে খেলা করি, স্যাররা আপারা খুব ভালো করে পড়া বুঝিয়ে দেন। কিন্তু ওই যে টিচারের হাতে মার খাওয়া? আমি অবশ্য একদিনও মার খাইনি। কিন্তু অনেক ছেলেমেয়ে মার খায়। দুষ্টুমির জন্য নানা ধরনের শাস্তি পায়। পড়া শিখে না গেলে শাস্তি পায়। বেঞ্চে সারা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা, নীল ডাউন হয়ে থাকাÑ এতো সাধারণ শাস্তি। বেতের চটাং চটাং বাড়ি এখানেও আছে। বেত পড়ে পিঠে, পায়ে, হাতে। এত পেটাতে পারেন টিচাররা? আমি আতঙ্কে থাকি, কোন দিন না আমার কপালে কোনো শাস্তি জোটে। একটা বছর খুব ভালোভাবে কেটে গেল। রেজাল্ট ভালো হলে বৃত্তি পরীক্ষাও দিতে পারব।

কিন্তু কপাল খারাপ! যেদিন রেজাল্ট আউট হলো, দেখলাম পাসের খাতায় আমার নাম নেই। ক্লাসের সবাই অর্থাৎ যারা পাস করেছে তারা এ প্রগ্রেসিভ রিপোর্ট হাতে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি চলে গেল। আমি ডেস্কে মাথা নুইয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমার মত আরো পাঁচ-ছয় জন ছাত্র পাস করতে পারেনি। আমাদেরও প্রগ্রেসিভ রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। তাতে লেখা আছে ‘নট এলাউড’। একটা বিষয়ের নিচে লাল কালির দাগ, বিষয়টা হলো আরবি। আমি আরবিতে ত্রিশ নাম্বার পেয়েছি।

আম্মাকে জড়িয়ে খুব কাঁদলাম। আম্মা বললেন, কান্না কর না। খালামণির বাসায় চলো। আরবিতে মাত্র তিন নাম্বারের জন্য পাস করতে পারনি। এটা এমন কিছু নয়। আমিও ভাবলাম, সত্যি তো, মাত্র তো তিন নাম্বার।

খালামণি খুব গম্ভীর মুখ করে বললেন, এটা আমি তোমার কাছ থেকে আশা করিনি। সব সাবজেক্টে এত ভালো নাম্বার, আরবিতে ফেল করলে কী করে? এ সাবজেক্টে তো লেটার মার্কস পাওয়ার কথা। আম্মা খালামণিকে হেড স্যারের কাছে যাবার অনুরোধ জানালেন।

খালামণি আমাদের ক্লাস টিচারের কাছে প্রথমে গেলেন। খালামণির এক সহপাঠী এই স্কুলের শিক্ষক। উনি বললেন, হেড মৌলভী স্যার যদি তিন নাম্বার বাড়িয়ে দেন তাহলেই প্রমোশন পেতে পারে। খালামণি হেড মৌলভী স্যারের কাছে গেলেন। মৌলভী স্যার প্রথমে ভালো ব্যবহার করলেন। রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে যা বললেন, স্যরি আপা। আমি তিন নাম্বার বাড়িয়ে দিতে পারব না। তবে হেড স্যার যদি বলেন, তাহলে আমি তিন নাম্বার বাড়াতে পারি। কিন্তু আপা, যেখানে আরবিতে প্রায় সব ছাত্রই ম্যাকসিমাম নাম্বার পেয়েছে সেখানে বশির পেয়েছে মাত্র ত্রিশ? (আমার ভালো নাম বশির আহমেদ) ত্রিশ একটা নাম্বার হলো? এই ছেলে, তুমি মুসলমান ঘরের ছেলে না? তুমি ত্রিশ পাও কী করে? খালামণি আমার জন্য সব অপমান সহ্য করে বাসায় ফিরে এলেন। হেড মাস্টার স্যার ব্যস্ত। দেখা করতে পারবেন না।

পরদিন আম্মা খালামণিকে অনুরোধ উপরোধ করে হেড স্যারের সাথে কথা বলার জন্য নিয়ে এলেন। খালামণি আসতে চাননি। হেড স্যার খুব কড়া, কারো কথা রাখেন না। আমিও একদিন খালামণিকে হেড স্যারের কথা বলেছি। এ স্কুলে স্যাররাই যে ছাত্রছাত্রীদের পেটায় বেত দিয়ে তা সবাই জানে। হেড স্যার শাস্তি দিয়েছিলেন আমাদের চাইতে এক ক্লাস ওপরের এক ছাত্রীকে। আমাদের হেড স্যারের শাস্তিটা ছিল অভিনব। তিনি এক ছাত্রীর মাথার চুল ধরে ওপর নিচ করিয়েছিলেন। এ ধরনের শাস্তি আমাদের হাসির উদ্রেক করেছিল। আবার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যিস ছেলেদের চুল ছোট ছোট। তাই চুল ধরে ওপর নিচ করানো সম্ভব নয়। আরো একটা শাস্তির কথা বলে আমরা বন্ধুরা হেসে কুটি কুটি হয়েছিলাম। আমাদের ক্লাসের এক গাট্টা গোট্টা ছেলে প্রায়ই পিঠে-পশ্চাৎদেশে বেতের বাড়ি খায়। ও খুব অমনোযোগী ছাত্র। জানালা দিয়ে বাইরের মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। মার খেলে ও ত্রাহি চিৎকার জুড়ে দেয়। একদিন দেখলাম নকীব মার খেয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্যার কেবলই বলছেন, একদিনও পড়া শিখে আসিস না। পড়া মনে রাখতে পারিস না, তো স্কুলে আসিস কেন? স্যার আচ্ছা করে হাতও চালালেন। স্যার কতক্ষণ ওকে পেটাতেন জানি না। ঘণ্টা পড়ে গেল। স্যার চলে গেলেন। নকীব হি হি করে হেসে উঠলো। আমরা সবাই অবাক। কোথায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদবে তা নয় তো হাসি? আমরা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে হাসছিস কেন? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? নকীবের হাসির রহস্যটা উন্মোচিত হলে আমরাও কেউ হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। নকীব ড্রেসের নিচে টার্কিস গেঞ্জি গায়ে দিয়ে এসেছে। জানি না কতদিন নকীব এভাবে ম্যানেজ করে চলতে পারবে। স্কুলে স্যারদের এ ধরনের শাস্তি খালামণি একদম পছন্দ করেন না। তিনি বলেন, আগে গ্রামের পাঠশালায় অনেক টিচার ছাত্রদের শারীরিক শাস্তি দিতেন। আসলে পিটিয়ে কিছু শেখানো যায় না। অবশেষে আমার মুখ চেয়ে খালামণি আমাদের হেড স্যারের দরবারে গিয়ে হাজির হলেন। হেডস্যার আমার প্রগ্রেসিভ রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে বললেন, এটা তো হেড মৌলভী সাহেবের বিষয়। উনি তিন নাম্বার দিয়ে পাস করিয়ে দিলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আবার হেড মৌলভীর দরবার। উনি পর্বতের মত অটল। না-হক অনেক কথা শোনালেন। রাগে অপমানে খালামণির মুখ তখন গনগনে আগুনের মত। খালামণি বললেন, তোমার প্রমোশনের দরকার নেই। এই ক্লাসেই থাকো। পাকা হয়ে উঠবে। আমার আম্মা তো খালামণির ওপর কথা বলতে পারেন না। আমি বাসায় এসে হুলস্থুল বাঁধিয়ে দিলাম। কিছুতেই আমি এক ক্লাসে দুই বছর থাকব না। আমার বন্ধুরা সব ক্লাস সিক্সে পড়বে আর আমি ক্লাস ফোর থেকে আসা ছেলেদের সাথে পড়ব? না, না আমি পড়ব না। আমি গো ধরে রইলাম। তারপর টিসি এনে আমাকে মা অন্য একটা স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করিয়ে দিলেন। খালামণি নিমরাজি। এখানে খালামণির দু’জন পরিচিত টিচার আছেন। স্নেহের কাছে মানুষ অন্ধ। খালামণি আমাকে ত্যাগ করলেন না। বললেন, মন দিয়ে লেখাপড়া করো। সামনের বছর তুমি আবার ওই স্কুলে ভর্তি হবে। ওই স্কুল ঢাকার নামকরা স্কুল। ওখান থেকে এসএসসি পাস করতে পারলে তুমি যে কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবে। এ স্কুলটায় মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও পড়ে। টিচাররা ভালো। আমার প্রতি তারা যতœশীল। খালামণি স্কুলে এসে আমার সম্পর্কে টিচারদের কাছে খোঁজখবর নেন। আজ ভাবি, হায় খালামণি! আমি কি তোমার আশা পূরণ করতে পেরেছি? পারিনি। তোমাকে আবারো আমি পরিবেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। অবশ্য তুমি তো জান পরিবেশেরও গুরুত্ব কতখানি। স্কুলের পরিবেশ উন্নত কতখানি। স্কুলের পরিবেশ উন্নতমানের নয়। টিচারদের হাতেও বেত শোভা পায়। ছেলেমেয়েরা হইচই চেঁচামেচি করে স্কুলটাকে বাজার বানিয়ে ফেলে। কারোরই পরিচ্ছন্ন পরিপাটি ড্রেস নেই। আমিও মাঝে মাঝে গড্ডালিকা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই। পড়াশোনা ভালোই চলছে। কিন্তু আমার বাসার পরিবেশ? পড়া শিখতে মার কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাই না। বাবা তো রাত বারোটার আগে বাসায় ফেরেন না। যখন ফেরেন আমি তখন ঘুমে কাদা। কিন্তু ঘুম ভেঙে যায় মাঝ রাতে বাবা-মার চেঁচামেচিতে। বাবা যেমন স্নেহশীল তেমনি রাগী। মার সাথে কী নিয়ে এত রাতে রাগারাগি হয় আমি জানি না। ঘুম ভেঙে গেলে আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে এসে আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকেন। সকাল হলে স্কুলের পথে যাত্রা। আম্মা পৌঁছে দেন। আবার ছুটির সময় নিয়ে আসেন। খালামণি একদিন বললেন, অমিয়কে আলাদা বিছানা দাও। ও বড় হয়েছে। এখনো কেন কোলের কাছে নিয়ে শোও? আমি আলাদা বিছানায় থাকতে চাই না। আম্মাকে খুব ভালোবাসি। আব্বাকেও। আব্বার হাত উদার। কত বাজার করেন। আমার জন্য, আম্মার জন্য দামি দামি জামা কাপড় আনেন। ঝুড়ি ভর্তি ফল মিষ্টি সব সময় থাকে। আব্বা সাদা-কালো চব্বিশ ইঞ্চি টিভি এক পাশে সরিয়ে রেখে রঙিন ৪২ ইঞ্চি টিভি নিয়ে এলেন। খালামণি টিভি দেখে খুশি হলেন না। বললেন, ছেলে তো টিভিতে মুখ দিয়ে বসে থাকবে। পড়বে কখন? আর এতবড় টিভি? হলোও তাই। রঙিন টিভি’র আকর্ষণই আলাদা। টিভি আমাকে পেয়ে বসলো। খালামণির পরামর্শে আব্বা আমার জন্য একজন টিচার ঠিক করে দিলেন। টিচার যতক্ষণ পড়ান, ততক্ষণই পড়ি। তারপর টিভি’র কত মজার মজার অনুষ্ঠান! আম্মাও দেখেন। আম্মার প্রতিবেশী বন্ধুরাও দেখেন। আমিও দেখি। আব্বা দেদার বাজার করেন। আব্বা খেতে ভালোবাসেন। চর্ম, চোষ্য, লেহ্য, পেয় খাবার না হলে তার চলে না। খালামণি একদিন দুপুরে এলেন। আম্মা তাকে খেয়ে যেতে বললেন। খালামণি লম্বা ডাইনিং টেবিল জুড়ে নানা পদের খাবার দেখে চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, কি, মেহমান আসবে নাকি? আম্মা হেসে বললেন, নাহ! আমরাই খাবো। তোমরা খাবে? সর্বনাশ! এত খাবার? কী কী করেছ, দেখি? ভর্তা তিন পদের, ভাজি, মাছ, গোশত। বাপরে বাপ! রোজ তোমরা এ রকম খাও? আম্মা মিটি মিটি হেসে বলেন, অমিয়র বাবা নানা পদের খাবার টেবিলে না দেখলে রাগ করেন। তুিম সব তৈরি কর? করি। রান্না করতে করতেই তো তোমার সারা বেলা চলে যায়। কী করব চলুক? আমিতো আর চাকরি-বাকরি করি না? লিলি, এতসব তৈরি করার খরচাও তো কম নয়? আমি তো বাসায় একটা ভাজি, ডাল আর মাছ করি। যেদিন মাছ থাকে সেদিন গোশত থাকে না। আর এত তেলে ডোবানো খাবার তো স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভালো নয়। নারকেলের ভর্তা, চিংড়ির ভর্তা, মুরগি, বড় মাছ, ছোট মাছের চচ্চড়ি, শাক, ডাল... বাপরে বাপ! লিলি, এর নাম তো অপচয়। তোমরা খাওয়া কমাও। অমিয়র বাবাকে বলেন, উনি নিজে বাজার করেন। খালামণি স্পষ্ট খুব বলতে পছন্দ করেন। আব্বার আয় উপার্জন নিয়ে খালামণি একদিন বলেছিলেন, অবশ্য আমার সামনে বলেননি তবে আমি শুনেছি। মা যে উত্তর দিয়েছিলেন তাও কানে এসেছে আমার। আব্বা যে রাত বারাটা-একটা পর্যন্ত তাস পেটান আর অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি হয়ে হম্বি-তম্বি করেন তা অফিসের লোকজনদের আসা যাওয়া দেখে ছোট সময় বুঝিনি, এখন এই কৈশোর পার হয়ে বুঝতে পারি। আমার খালামণি খুব সাদাসিদে চলনে বলনে। ঈদ পর্বে আমাদের সুতির জামা কাপড়ই উপহার দেন। আমার জন্মদিনে জামা-প্যান্টের সাথে এক সেট বই থাকে। তারই জন্য আমি পথের পাঁচালি পড়তে পেরেছি। অপু দুর্গাকে চিনেছি। নুলিয়া ছড়ির ‘সোনার পাহাড়’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। খালামণি আমার মনের জগৎটা সুন্দর করে তৈরি করতে চেয়েছেন। আমার মনটা সুন্দর হতে হতে হয়নি। মাঝপথে থেমে গেছে। ঈদের সময় বাবা আমাকে তিন চার সেট জামা দিতেন। মার জন্যও দামি শাড়ি নিয়ে আসতেন। খালামণি বলতেন, এত দামি জামা-কাপড় বাচ্চাদের দিয়ে লাভ কী? এক বছর পর তো আর পরতে পারবে না। দু’তিন সেট জামা-প্যান্ট না হলে আমারও মন ভরত না। খালামণি সব সময় বলতেন, লিলি, আয় অনুসারে ব্যয় করতে হয়। দুই হাজার টাকার সেট না এনে টাকা বাঁচিয়ে গরিব আত্মীয়স্বজনকে কাপড় চোপড় দেয়া অনেক ভালো। এত কথা আজ এই বুড়িগঙ্গার তীরে বসে মনে পড়ছে। বুড়িগঙ্গার মত আমার জীবনটাও পচে গেছে। আমি ড্রেনে নয় ম্যানহোলে পড়ে গেছি। আমার সুন্দর কৈশোর হারিয়ে গেছে। আজ খালামণি নেই! কে আমাকে ম্যানহোল থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলবে? আবার স্কুলের কথায় ফিরে আসি। রেজাল্ট আউট হবে। আমার মনে দুশ্চিন্তা। আমি কি সব সাবজেক্টে পাস করে প্রমোশন পাব? আরবি স্যার অবশ্য বলেছেন, তুই উতরে গেছিস রে বশির। তাহলে আমার ভয়টা কী? আব্বা অফিসে যাওয়ার আগে বললেন, কিরে পাস করবি তো? মাস্টার রেখে দিয়েছি। ফার্স্ট-সেকেন্ড তো হওয়ার কথা, হু এবার পাস না করলে ফ্যানের সাথে টাঙিয়ে মারবো। আমার মার তো দেখনি। আম্মা মুখ কালো করে বললেন, কী আজেবাজে কথা বলছ? ও এবার ঠিক পাস করবে। ক্লাসে বসে বুকের ধুকপুকানি কমাতে পারি না। আব্বা কি সত্যি সত্যি ফ্যানে ঝুলিয়ে আমাকে পেটাবেন? ক্লাস টিচার ক্লাসে ঢুকেই আমাকে বললেন, কি বশির আহমেদ, অঙ্ক টঙ্ক মাথায় ঢোকে না? তোমরা অবশ্য অনেকেই অঙ্কে বড় বড় রসগোল্লা পেয়েছ। বাসায় গিয়ে ঐ রসগোল্লা খেয়ো। স্যারের কথা শুনে দুনিয়া শুদ্ধ কেঁপে ওঠে। হেড স্যার এখনো আসেননি। উনি এলেই হল ঘরে, সবাইকে ডেকে রেজাল্ট দেয়া হবে। আমার কী যে হলো! আমি গুটি গুটি পা করে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, দারোয়ান আমাকে ভালো করে চেনে। চেনে খালামণিকেও। আমি রিকশা ঠিক করে উঠে বসলাম। দারোয়ানকে বললাম, আমি একটু খালামণির বাসা থেকে আসছি। যাব আর আসব। তারপর! হইচই হুলস্থুল। রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট আরো কত জায়গায় লোক পাঠানো হল। খোঁজাখুঁজির ধুম। মা ছুটে গেলেন খালামণির বাসায়। খালামণি তখন ইউনিভার্সিটিতে। খালামণি দুপুরে বাসায় এসে সব শুনে ছুটে এলেন স্কুলে। অমিয় অঙ্কে পাস করেনি। কিন্তু প্রমোশন দেয়া হয়েছে। টিচারের কাছে এ কথা শুনে বাসায় চলে এলেন। বেলা পড়ে এলো। সব রাগ গিয়ে পড়লো দারোয়ানের ওপর। স্কুলের স্যাররাও চিন্তিত। মা তো বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছেন। খালামণি আব্বাকে নাকি এক চোট নিয়েছেন পরে শুনেছি। খালামণি বলেছেন, বাচ্চাদের ওই রকম ভয় দেখাতে হয়? তোমরা বাবা-মা হবার উপযুক্ত নও। এদিকে আমি কী করেছি? আমার হাতে দশটি টাকা ছিল, সোজা চলে গেলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়। ওর জ্বর। স্কুলে আসেনি। গল্প স্বল্প করে দুপুরে খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওর কাছে বসে থাকলাম। মনে একটু একটু ভয়। কোথায় যাবো? কার কাছে যাব! হাতে আছে পাঁচ টাকা। সন্ধ্যার আগেই বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমাকে দেখে আব্বা কোলে তুলে নিলেন। আমার জ্ঞান ফিরলো। খালামণিকে শুভ সংবাদটা জানানো হল। তারপর... আব্বা-আম্মা আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেন। তারা আমাকে ওই স্কুলে দিতে আর সাহস পেলেন না। আমি নাকি আবারো স্কুল পালাতে পারি। খালামণির সাথে কোনো পরামর্শ না করেই আব্বা-আম্মা আমাকে অন্য একটা স্কুলে ক্লাস সেভেনেই ভর্তি করিয়ে দিলেন। এ স্কুলটা আব্বার এক বন্ধুর। তার তিনতলা বাড়িতেই স্কুল। ছাত্রদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আব্বা-আম্মা আমাকে রেখে যখন চলে যাচ্ছেন, আমিও তাদের সাথে যেতে চাইলাম। আব্বা মিষ্টি করে বললেন, তুমি এখানে থাকবে। এটা হোস্টেল। তোমার আঙ্কল-আন্টি তোমার দেখাশুনা করবেন। এখানে আরো ছেলে আছে। এখানে ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত ছেলেরা পড়ে। আমরা সপ্তাহে দু’তিন দিন আসব। আব্বার বন্ধু এসে আমাকে একটা ছোট্ট রুমে নিয়ে বললেন, এটা তোমার রুম। আর একটি ছেলে তোমার সাথে আলাদা খাটে থাকবে। আমরা সব সময় তোমাদের সাথে থাকব। সে রাতে আমি অনেক কাঁদলাম। খেতে চাইনি। জোর করে আন্টি কাছে বসে খাওয়ালেন। হোস্টেলের দু’তিনজন ছাত্র এসে আমাকে দেখে গেল। এখানে পড়ার জন্য আলাদা একটা বড় রুমও আছে। কেউ নিজের রুমে বসেও পড়তে পারে। পরদিন আব্বা-আম্মা আমার জন্য অনেক খাবার দাবার নিয়ে এলেন। সব আমার পছন্দের খাবার। নিজেদের বাড়িতে এরা স্কুল ও হোস্টেল করেছে। এই আঙ্কেল-আন্টি আমাদের বাসায় অনেক দিন বেড়াতেও গেছেন। আমার চোখের পানি আর বন্ধ হয় না। আম্মাকে ছেড়ে তো কখনো থাকিনি! খালামণির কথা মনে পড়ে। উনি কেন আসেন না? এই হোস্টেলে থেকে এই মডেল স্কুল থেকে আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। অর্থাৎ চার বছর আমি এখানে কাটিয়ে দিয়েছি। একজন প্রাইভেট টিচার আমাকে পড়াতেন। মাসখানেকের মাথায় মা’র সাথে খালামণি এলেন। আমার অভিমান হলো। খালামণি যখন মাথায় হাত দিয়ে কোলের কাছে টেনে নিলেন, তখন সব অভিমান ভেসে গেল। এখানকার আন্টি আম্মাকে ও খালামণিকে না খাইয়ে ছাড়লেন না। খাবার দাবার মন্দ নয়। মাছ, ডাল ভাজি নিত্যদিনের খাবার। সপ্তাহে একদিন গোশত। আমরা ৩০ জন বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্র। আস্তে আস্তে সবই সয়ে এলো। খালামণি যাবার সময় বললেন, মন দিয়ে পড়াশোনা করো। না হলে তোমার বাবা-মা তোমাকে জেলখানায় দিয়ে আসবে। আমার মনে হলো, খালামণি আব্বা-আম্মার এই সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেননি। আমি ভাগ্যকে মেনে নিলাম। বাসায় মাসে একদিন গিয়ে থাকি। বাসায় ভালো লাগে না। কোথায় যেন একটা সুতো ছিঁড়ে গেছে। খালামণির বাসায় যাওয়া হয় না। তার সাথে সম্পর্ক আলগা হয়ে গেছে। খালামণি আব্বা-আম্মাকে উচিত কথা বলেন। আম্মা এটা পছন্দ করেন না। আমার জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেল। নিজেকে খালামণি আমার কাছ থেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিলেন। আমি হোস্টেলের বন্দিজীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। খালামণি অবশ্য তখনো আমাকে গল্পের বই উপহার দেন জন্মদিনে। আমার দু’চোখ ভরে পানি আসে। এ হোস্টেল জীবনে আনন্দ উল্লাস নেই। বড় ক্লাসের ছাত্ররা দাদাগিরি করে। ওদের সাথে মিশতে ভালো লাগে না। ওরা কেউ কেউ জোর করে এসে আমার বিছানায় শোয়। আমার বিষ লাগে। এক অপরিচিত জগৎ আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হয়। আমি খালামণির চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না। মনে হয় খালামণি আমার চোখ দেখে, মুখ দেখে ঠিক বুঝতে পারবেন আমার একটা পরিবর্তন হয়েছে। তের-চৌদ্দ বছরে একটা ছেলেকে কেউই ভালো করে বুঝতে পারে না। এরা বড়দের সাথে ভালো করে মিশতে পারে না। ছোটদের সাথেও না। আমি ‘আপদ’ হয়ে হোস্টেলের জীবন কাটিয়ে দিলাম। এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষার আগে খালামণিকে সালাম করে এসেছি। খালামণি হোস্টেলে এসে আমাকে একটা হরলিক্স দিয়ে গেছেন। পরীক্ষা শেষ হতেই বাসায় চলে আসি। বন্ধুবান্ধব অনেক জুটেছে। ওরাও আমাদের বাসায় আসে। শুধু বন্ধু নয়, কয়েকজন বান্ধবীও জুটেছে। এরা আমার কোচিংয়ের বান্ধবী। মাস তিন-চার আমি কোচিং করেছি। রেজাল্ট আউট হবে শিগগির। বাবা-মা খুব টেনশনে। খালামণির কি টেনশন হয় আমাকে নিয়ে?

হয় বই! আম্মাকে ফোন করে বললেন, রেজাল্ট যেমন হয় মেনে নেবে। বকা ঝকা করবে না, মারবে না। রেজাল্ট ভালোই হল। আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি। ছুটে গেলাম খালামণির কাছে। খালামণি খুব খুশি। তখন ঈদের আয়োজন চলছে। আমাদের বাসায় তো এলাহি কাণ্ড! আমার জন্য দামি দামি জামা-কাপড়। আমি কি চাই বলতেই আমি একটা সাইকেলের আবদার করলাম। আমার হাতে তো কবেই ঘড়ি উঠেছে। আরো একটা দামি ঘড়ি আনা হলো।

খালামণি সাইকেল কিনে দিয়েছে শুনে আম্মাকে একটু রাগ করলেন। বললেন, ঠিক করনি। এই সাইকেল নিয়ে ছেলে তোমার ঢাকা শহর চষে বেড়াবে। কী অঘটন ঘটায় তাই দেখো, আম্মা বললেন, ওর আব্বা বলেছেন, কোনো আশাই আমি আমার ছেলের অúূর্ণ রাখবো না।

ঈদ এলো। খালামণি খালুকে নিয়ে এলেন। কিছু একটা মুখে দিলেন কি দিলেন না। ড্রইং রুম জুড়ে আমাদের বড় ভেলভেট মোড়ানো সোফা। খালামণির চোখ চড়ক গাছ। এত দামি সোফা কিনেছ কেন লিলি? আর এসব সোফা তো এয়ারকন্ডিশন ঘরে শোভা পায়। খালামণি আমার ড্রইংরুমের শোভা দেখে খুশি হলেন না। খালামণিদের ড্রইরুম খুবই সাধারণ। খালামণি কি আমাদের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত? আমার মনও তখন অনেক বদলে গেছে।

ঈদের দিন আমার রুমে আমার বন্ধু-বান্ধবীরা উচ্চস্বরে বাজনা দিয়ে ফুর্তি করছি। কেউ কেউ নাচছে। আমাদের দরজা বন্ধ। অবশ্য আমি খালামণি আর খালুকে সালাম করে এসেছি। হঠাৎ দরজায় খট খট শব্দ শুনে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি খালামণি। আমি বলি, খালামণি ভেতরে আসুন। খালামণি দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? বললাম, এরা আমার বন্ধু। কোচিং করতে গিয়ে পরিচয়, বন্ধুত্ব। ওরা এক এক স্কুলে পড়াশোনা করেছে। আমি এক এক করে ওদের স্কুলের নাম বললাম। খালামণি ভেতরে এলেন না। পরে শুনেছি মাকে নাকি খালামণি দু’ কথা শুনিয়ে গেছেন।

খালামণি মাকে বলেছেন, এটা ঠিক নয় লিলি? সব ছেলেমেয়ে গাদাগাদি করে এক বিছানায় বসেছে। ওদের অল্প বয়স। আর এ বয়সটা খুব ডেঞ্জারাস। ছেলেকে সামলাও। ওদের এ বয়সে অবাধ মেলামেশা ঠিক নয়। উচ্চবিত্ত পরিবারে এ রকম হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে মানায় না। তা ছাড়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা দূরত্ব থাকা দরকার। আমাদের ধর্মেও এরকম অবাধ মেলামেশার সুযোগ নেই। আমার আম্মা একটু সরলসিধা। খালামণি যা যা বলেছেন সব আমাকে বলে দিয়েছেন। আম্মা অবশ্য বলেছেন, ওর আব্বা মেলামেশা নিষেধ করে না। খালামণি, আমার মনের যে কতখানি পরিবর্তন হয়ে গেছে তা তো তুমি জান না। আমরা ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু নিয়ে খুব খুশি। খুব আনন্দিত। পা ফসকাতে ফসকাতে যখন আমি খাদে পড়ে গেলাম, তখন আমি তোমাকে বুঝতে পারলাম। চিনতে পারলাম। কিন্তু তখন অনেক অনেক দেরি হয়ে গেছে। চৌদ্দ পনের বছর বয়সে আমিও তখন অনেকের চোখে নায়ক।

বয়স অনুসারে আমার গড়ন ছিল বাড়ন্ত। আব্বার শারীরিক গঠন খুব সুন্দর। আমার মজবুত শরীর। বাসাতেই বাবা ব্যায়ামের অনেক উপকরণ এনে দিয়েছেন। আমি যেমন লম্বা তেমনি সুন্দর শারীরিক গঠনের। সেই চৌদ্দ-পনের বছর বয়সে বন্ধুরা আমাকে ‘আমির খান’ উপাধি দিয়েছিল। এটাই আমার কাল হল।

খালামণির ইচ্ছা আমি ঢাকা কলেজে অথবা নটর ডেম কলেজে আইএসসি-তে ভর্তি হই। ভর্তি পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। উত্তীর্ণ হতে পারিনি। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই তো বইপত্রের সাথে সব সম্পর্ক ঘুচে গিয়েছিল আমার। খালামণি বলতেন, প্রতিদিন কিছুটা সময় বইপত্তর নিয়ে বসবে। পড়া ঝালাই করবে। ফলটা তো হাতে হাতে পেলাম। অবশেষে একটা প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হলাম। যে কলেজে ভর্তি হলাম সে কলেজ খালামণির বেশি পছন্দের নয়। এ কলেজেও খালামণির বন্ধুরা আছেন। তারা আমাকে খুব আদর করেন। খালামণির পছন্দের কলেজটি খুবই ভালো ছিল। সেখানেও তার কয়েকজন বন্ধু আছেন। আমি একটা খোঁড়া অজুহাত দিলাম। আম্মাকে বললাম, আমি টিনের চালা আর মাটির ঘরÑ এ রকম কলেজে পড়বো না। আম্মা খালামণিকে তা বলে দিয়েছিল। খালামণি এ কথা শুনে মনে খুব ব্যথা পেয়েছিলেন। এ কলেজটি একজন সুফী সাধকের নামে ছিল। আমার ও-রকম মন্তব্য করা উচিত হয়নি।

আমি সেকেন্ড ডিভিশনে আইএসসি পাস করলাম। দু’বছরে আমি নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। এর কোনোটাই আমার জীবনে সুফল বয়ে আনেনি। আমি তখন কাদায় আটকে গেছি। প্রথমে পা ডুবেছে। ধীরে ধীরে কোমর পর্যন্ত যখন আটকে গেলাম আমি, আম্মা আমাকে টেনে তুলতে ব্যর্থ হয়ে খালামণির কাছে ছুটে গিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন। অগতির গতি খালামণিরও সাধ্য নেই আমাকে পরিষ্কার করে সভ্য সমাজে দাঁড় করানোর। তবু তিনি দমে গেলেন না। তিনি যে আমাকে বড় স্নেহ করেন। আমার জন্মের মুহূর্তে তিনি আমার মায়ের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার ডাক্তার বন্ধুর পারমিশন নিয়ে, সহজে আমি মায়ের অন্ধকার গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি।

সারারাত খালামণি মা’র পাশে ছিলেন। পরদিন সকাল ১০টায় একটা সেমিনারে তার বক্তৃতা দেয়ার কথা। যদি আমি আটটায় পৃথিবীর আলো দেখতে পাই তাহলেও খালামণি সেমিনারে অ্যাটেন্ড করতে পারেন। আমাকে না দেখে মাকে ফেলে তার সেমিনারে যাওয়া হলো না। ফরসেফ ডেলিভারি করে আমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে হলো। ডাক্তার আন্টি নাকি বলেছিলেন, এর চাইতে সিজার করা অনেক ভালো ছিল। ওর মাথায় বেশি চাপ পড়েছে। এ জন্যই কি আমার অসঙ্গত আচরণ? সকলের মাথা খারাপ করে দেবার মত ব্যবহার?

খালামণি আমার অদ্ভুত আচরণের কারণ খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আমি তো আগেই বুঝেছি, পরিবেশ আমার অবস্থার জন্য দায়ী। আব্বা-আম্মার নিত্যদিনের ঝগড়া-ঝাটি মারামারি, অতিরিক্ত আহলাদ আমাকে অনেকটাই বেপরোয়া করে তুলেছে। বন্ধুদের প্রভাবও তো কম ছিল না? খালামণি শুধু বলতেন, পনের-ষোল বছরের একটা ছেলের এত বন্ধু থাকবে কেন? তারা এত আড্ডা দেবে কেন? সব বন্ধু কি স্বচ্ছ চিন্তাধারার? ওকে সামলাও লিলি।

আমার অবস্থা আমি তখন নিজেও বুঝতে পারছি না। প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যাই। আত্মহননের স্পৃহায় আমি উন্মাদের মতো আচরণ করি। খালামণি আমাকে এক বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলেন। তিন সপ্তাহ ধরে আমাকে সিটিং দিলেন। এই সিটিং থেকেই আমার মনোরাজ্যের অনেক রহস্য বেরিয়ে এলো। খালামণির তখন পাগলের মতো অবস্থা। আম্মাকে বকেন। আব্বাকে বকেন। এ তোমরা কী করেছ? ছেলেকে শাসনের নামে পিটিয়েছ! অল্প বয়সে পড়াশোনার জন্য বন্দিশালায় রেখেছ। বন্ধুত্ব করার বেলা ছেলেমেয়ে বাছবিচার করনি। অবাধ মেলামেশার সুযোগ দিয়ে ছেলের মনোরাজ্যে তুফান তুলেছ। এখন এর ফল ভোগ করো। খালামণির শরীরও এখন খারাপ যাচ্ছিল।

আম্মা-আব্বা কেউই সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। আমি তখন একা খড় কুটোর মত পড়ে আছি। আমার জগতে কোনো বই নেই। বই যা আছে তা তালাচাবি দেয়া আলমারিতে বন্দী। আমি নাকি বই পড়ে পড়ে ইঁচড়ে পেকে গেছি। আসলে এক ব্যাগ শঙ্কর পড়ে কি কেউ ইঁচড়ে পেকে যায়? বই তো আলোর জগতের সন্ধান দেয়। খালামণি আমাকে আলোর সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন। তিনিই তো আমাকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চিনিয়েছিলেন। সেই আলোর জগৎ থেকে কী করে আমি অন্ধকার জগতে হারিয়ে গেলাম তা আমি নিজেও বলতে পারি না। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েকে গাইড করা দরকার। ভালো স্কুলে ভর্তি হয়েও সে গাইডেন্স আমি পাইনি।

আমার আব্বা আমাকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে পেটাবেন এরকম ভয় না দেখালে তো আমি স্কুল পালাতাম না! আমার স্কুল পালানো বন্ধ করার জন্য কেন আমাকে এক বন্দিশালায় ভর্তি করে দিলেন? বাড়ির মধ্যে ঐ স্কুল হোস্টেলকে তো আমি বন্দিশালাই বলব। সেখানে আমি প্রতিদিন রাত্রিবেলা চুপি চুপি কাঁদতাম। মায়ের কোলের উষ্ণতা চাইতাম। পেতাম বড় ভাইদের উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্পর্শ। সে সব কথা কি খুলে বলা যায়? আমি শৈশবের কৈশোরের নির্মল দিনগুলো হারিয়ে ফেললাম। কলেজে ভর্তি হয়ে তো আমি আরো অবাধ স্বাধীনতা পেলাম। পেলাম অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। মেয়ে বন্ধু, ছেলে বন্ধুরা আমাকে কি কম শোষণ করেছে? খালামণির আদর আর শাসনের ছায়া আমার জীবন থেকে সরে গেলে আমি নর্দমার পানিতে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। সতের বছরের এক কিশোরের জীবন পঙ্কিলতায় ডুবে গেল। খালামণি আম্মাকে কতবার বলেছেন, লিলি তোমার ছেলেকে গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাও। আত্মীয়স্বজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। গ্রামের মাঠে ছুটোছুটি করতে দাও। তুমিও তো গ্রামের মেয়ে। গ্রামের কাদামাটি গায়ে মেখে বড় হয়েছ। গ্রামের নির্মল বাতাস বুক ভরে নিতে দাও ছেলেকে।

আমার খালামণি গ্রাম খুব ভালবাসতেন। মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, আমাকে শহরের মাটিতে দাফন করবে না। গ্রামের সুশীতল ছায়ায় আমি চির নিন্দ্রায় থাকতে চাই। খালু তাই করেছেন। আমার খালামণি গ্রামের ঠাণ্ডা মাটিতে গাছের ছায়ায় শুয়ে আছেন। এই বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে আরো কত অজানা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হবে খালামণির কাছে! আমি খালামণির কাছে যেতে চাই। আমি তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইব। আব্বা-আম্মা তার কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে যে অন্যায় করেছেন, যে পাপ করেছেন তার জন্য আমি ক্ষমা চাইব।

সে দিনটির কথা আমার এখন খুব মনে পড়ে। স্কুল পালানোর পর খালামণি বলেছিলেন, লিলি, তোর ছেলেকে আমার কাছে সপ্তাহখানেক রেখে যা আমি ওকে একটু বোঝাব। মা আমাকে রেখেও গিয়েছিলেন। সে দু’দিন খুব আনন্দে কেটেছে আমার। আম্মা এক দুপুরে এসে বললেন, চল, বাসায় চল। আমি যেতে চাইলাম না। খালামণি বললেন, সাত দিনের দু’দিন মাত্র কেটেছে, এত তাড়াতাড়ি নিতে এলে কেন। আম্মা কোনো কথা শুনলেন না। জামা-কাপড় ব্যাগে ভরে বললেন, চল। আমি খালি হাতে যাবো না। আমিও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি খালামণির হাত ধরে। আম্মা হ্যাচকা টান দিয়ে খালামণির হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিলেন। একটা চড়ও দিলেন আমার গালে। বাইরে কি গনগনে রোদ! খালামণি বললেন, ঠিক আছে যাবি তো যা, রোদ পড়ুক। তারপর...।

আম্মা কোনো কথা শুনতে চান না। আসলে আমি খালামণিকে বেশি ভালোবাসি এটা আম্মা সহ্য করতে পারছিলেন না। খালামণি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ঠিক আছে, মার কথা শুনতে হয় বাবু। আর লিলি, বাসায় গিয়ে ওকে মারধর করবি না। লিলি, তুই নাকি একটু এদিক ওদিক হলেই ছেলের গায়ে হাত তুলিস? খবরদার, মারবি না। মনে থাকবে তো? আম্মার কি তখন মাথা খারাপ হয়ে গেছিল? আম্মা বললেন, ওহ্! নালিশ করা হয়ে গেছে? খালামণি বললেন, এটা নালিশ না লিলি। গায়ে হাত তুলিস, ভয় দেখাস, তাই তো ছেলে পালায়। আম্মা আমাকে টানতে টানতে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বললেন, আমার ছেলেকে আমি দরকার হলে মারব, আবার ভালোও বাসব।

আমার খালামণি পাথরের মূর্তির মত সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন খালামণির দুঃখ বুঝিনি। এখন বুঝি নিঃসন্তান খালামণির আপত্যস্নেহকে কতখানি ব্যঙ্গ করেছিলেন আমার আম্মা। খালামণি, তুমিতো আমাকে ত্যাগ করতে পারনি। এত অপমান গায়ে মেখেও তুমি আমার বিপদের সময় ছুটে এসেছ। তখন আমার ঘোর বিপদ। আমি ডিগ্রি ক্লাসে ভর্তি হতে পারিনি। পড়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। এই তো তখন বুড়িগঙ্গার তীরে এসে দাঁড়িয়েছি। খালামণি, তোমার কথা মনে হলেই আমার নদীর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে গাছপালার কথা, গ্রামের কথা। গ্রাম নাকি শান্তির আবাস, ঠিক বলেছ। আমি গ্রামে যেতে চাই। আমি তোমার কাছে যেতে চাই। যেতে চাই তুমি যেখানে শুয়ে আছ সেখানে। শহরের জটিল-কুটিল জীবন আমাকে অস্থির করে তুলেছে।

আমি গ্রামে যাবো কী করে? আমি যে পথ চিনি না। বুড়িগঙ্গা সাঁতরে যাব। সেই তুমিই তো আমাকে সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছ। মাকে বলেছ, বাংলাদেশের ছেলে সাঁতার জানবে না এটা একটা কথা হলো! সুইমিং পুলে গিয়ে আমি সাঁতার শিখেছি। আম্মা তো ভয়ে অস্থির। তুমি বলেছ, লিলি তুইও তো সাঁতার জানিস। তুই আমার সাথে পাল্লা দিয়ে পুকুরে সাঁতার কাটিসনি? ছেলেকে নিয়ে তোর এত ভয় কিসের? আমি সত্যি ভাল সাঁতারু হয়েছি। তুমি খুশি হয়েছ। তুমি আমাদের দেশের ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাশের গল্প আমাকে শুনিয়েছ। তুমি বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর গল্পও শুনিয়েছ। বড় হওয়ার জন্য মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য কত উপদেশ-ই না তুমি আমাকে দিয়েছিলে। আমি কেন তোমার আদর্শ ধরে রাখতে পারলাম না?

এখন আমার অনুতাপ হচ্ছে, অনুশোচনা হচ্ছে। এখন কি আমি নতুন করে তোমার বলা আদর্শের পথে হাঁটতে পারব? তুমি আমার অস্থিরতা দেখে বলেছিলে, অমিয় রে, নতুন করে জীবন শুরু কর। ভালো কাজ যে কোনো সময় শুরু করা যায়। একবার শুরু করে দিলেই হলো।

আমি, এই আঠারোতে পা রেখে কি জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে পারব? তোমার কথা মনে করেই আমার সে রকম ইচ্ছে হচ্ছে। আম্মাকে তুমি কতভাবে বলেছ, একটা ছেলে তোর। বেশি লাই দিবি না। বেশি শাসনও করবি না। আদর দিয়ে বাঁদর বানাবি না। আর ধর্মীয় অনুশাসনের কথা মনে রাখবি। সব ধর্মেই জীবন উন্নত করে গড়ে তোলার কথা বলা আছে। সব ধর্মেই মহাপুরুষ আছেন। তাদের জীবনচরিতও পড়া উচিত।

খালামণি তুমি বলেছিলে, যখন আমাকে সাইক্রিয়াট্রিস্ট ধ্যানের পরামর্শ দিয়েছিলেন মন স্থির করার জন্য, অমিয় ভালো হওয়ার স্বপ্ন মনের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে হয় আর ভালো কাজ যে কোনো সময় শুরু করা যায়। আমি কি এখনই শুরু করতে পারি? কিন্তু খালামণি তুমি তো ওই আকাশের ওপার থেকে দেখতে পাচ্ছ, আমি অন্ধকার ম্যানহোলে পড়ে ছটফট করছি। আমার সারা শরীর দুর্গন্ধময়। এখান থেকে কে আমাকে উদ্ধার করবে? তুমি প্লিজ বেহেশতের বাগান থেকে তোমার পবিত্র হাত বাড়িয়ে দাও। তোমার হাতের স্পর্শে আমি পবিত্র হয়ে যাবো। তুমি ছাড়া কেউ আমাকে এই অন্ধকার দুর্গন্ধময় জীবন থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। এখন তো সরকার বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করার জন্য নানা প্রকল্প নিয়েছে। বুড়িগঙ্গার আবর্জনা একদিন দূর হবে। ময়লা-নোংরা পানি দূর হয়ে যাবে। পরিষ্কার টলটলে পানি নিয়ে বুড়িগঙ্গা হেসে উঠবে। আমিও তোমার স্বর্গীয় হাতের স্পর্শে সূর্যের কিরণ গায়ে মেখে হেসে উঠব। আমি ভালো হওয়ার শপথ এখই নিতে চাই। ইচ্ছে ছিল, তুমি যেখানে শুয়ে আছ, সেই মাটির ছোট্ট কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি নতুনভাবে জীবন গড়ে তোলার শপথ নেবো। সেটা পূরণ হতে অনেক অনেক সময় লাগবে। কে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে? আম্মা? আম্মা নাকি গ্রামের মুখ আর দেখবে না। কেন, জানি না।

আমি দূরে বসে, যে বুড়িগঙ্গাকে তুমি ভালবাসতে, সেই বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে শপথ করছি, আমি ভালো হবো। শুচি শুদ্ধ হবো। ওই ছাইপাশ আর খাবো না। বাজে বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করব। তুমি দোয়া করোÑ ওহো তুমি তো বলেছিলে, যারা আল্লাহর কাছে চলে যায় তারা পৃথিবীর কোনো মানুষের জন্য দোয়া করতে পারে না। পৃথিবীর মানুষ, অর্থাৎ আপনজনরা তাদের জন্য দোয়া করতে পারে। তাদের রূহের মাগফিরাত করে। তা বেঁচে থাকতে তুমি তো সব সময় আমার জন্য দোয়া করেছ। সেই দোয়ার জোরে আমি ভালো হবো। তোমার দেয়া ‘অমিয়’ নাম আমার সার্থক হবে। আমি অমৃত হবো। আমি আবার বই হাতে তুলে নেবো। তোমার দেয়া কত বই আলমারিতে বন্দী হয়ে আছে! আমি যখন ভালো করে নামও উচ্চারণ করতে পারতাম না তখন তুমি আমাকে উপেন্দ্র কিশোর রায়ের গল্পের বই জন্মদিনে উপহার দিয়েছ। যখন ক্লাস সেভেন উঠলাম তখন তুমি আমাকে জসীম উদ্দীনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে। আমার কি তখন বই পড়ার দিকে মন ছিল? কিছু বন্ধু জুটে গেছে তখুনি। তবুও বই পড়েছি। তোমার দেয়া বই না পড়ে কি পারি?

তারপর তো সবই ওলট পালট। ধুম ধারাক্কা। তুমি কবে শেষবারের মতো এসেছিলে আমাদের বাসায়? সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছিল আমার বাসায় ফিরতে ফিরতে। তুমি নাকি মায়ের ওপর রাগ করেছিলে। বলেছিলে, সন্ধ্যার পর ছেলে বাইরে কেন শুনি? আম্মা তোমাকে একটু ভয়ও পেত। আম্মা নাকি বলেছিলেন, এই তো এসে যাবে। আমি যখন এলাম তখন সন্ধ্যে সাতটা। তুমি কি আমার ফেরার জন্য অপেক্ষা করেছিলে? আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমার আর আম্মার কথাবার্তা শুনছিলাম। তোমার মেজাজ চড়ে গেছে তা বুঝতে পারলাম। তুমি বাবাকে লক্ষ্য করেও কিছু কথা বলেছিলে। এই প্রথম আমি জানতে পারলাম, আমাদের সব জলুসের পেছনে রয়েছে ঘুষের টাকা। আব্বা ঘুষ খায়? কী করে খায়? আম্মা তোমার কথার প্রতিবাদে খুবই মোলায়েম গলায় বলেছিল, আমি অত সব জানি না, আমার জানার দরকারও নেই।

খালামণি তুমি রূঢ়কণ্ঠে বলেছিলে, তোমার জানতে হবে লিলি। স্বামীকে জিজ্ঞেস করবে তোমার বেতন কত? এত টাকা কোথায় পাও? তোমার দায়িত্ব স্বামীর আয়ের উৎস জানা। মনে রেখো ঘুষের টাকা বেশি দিন থাকে না। আর ঘুষের টাকায় ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না। তুমি রুম থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধকার বারান্দায় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু চমকে উঠলে, আমি তোমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তুমি বললে, থাক থাক আর সালাম করতে হবে না। আমি তোমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রিকশা ঠিক করে দিলাম। সাহস করে বলতে পারলাম না, আমি কি তোমার সাথে আসব? মতিঝিল থেকে মগবাজার। পথ বেশি নয়। আর তখন তো রাস্তায় এত যানজট ছিল না।

আমি ঘরে ঢুকতেই আম্মা আমার ওপর রাগে ফেটে পড়লেন। আজ তোর জন্য আমাকে এত কথা শুনতে হলো। ঘুষের পয়সায় নাকি ছেলে মানুষ হয় না! আমি সপ্তাহে সপ্তাহে বুয়াদের কাছ থেকে ইন্ডিয়ান শাড়ি কিনি, তা নিয়েও আমাকে কথা শুনালো। আম্মা আরো কত কি বলতে লাগলেন, আমার মাথা তখন ঝিম ঝিম করছে।

এর পর তুমি কি আমাদের বাসায় এসেছিলে? হয়ত এসেছিলে, আমি দেখিনি। আম্মাকেও তুমি খুব স্নেহ করতে। তোমার যে একটা স্নেহশীল মন ছিল। আমি বা আম্মা কেউ তোমার স্নেহের মর্যাদা দিতে পারিনি। খালামণি, তুমি আর ক’টা দিন বাঁচলে না কেন? তুমি বেঁচে থাকলে আমাকে এভাবে মরতে দিতে না। আমি তো মরেই গেছি। আমার বর্তমান নেই, ভূত নেই, ভবিষ্যতও নেই। তবু মানুষ তো আশায় বুক বাঁধে। আমি তোমার কথা মনে করেই নোংরা জীবন পেছনে ফেলে সুন্দর জীবনে ফিরে যাব। ওই তো সূর্যটা টুপ করে বুড়িগঙ্গার নোংরা পানিতে ডুবে গেল। সূর্য কত বড়! কত উজ্জ্বল! সূর্য বুড়িগঙ্গার নোংরা পানিতে ডুব দিয়ে বুড়িগঙ্গাকে ধন্য করে দিয়ে গেল।

আজ পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলো দেখে তা বুঝতে পারছি। আমি কি বুড়িগঙ্গায় একবার ঝাঁপিয়ে পড়ব? শুচি শুদ্ধ হবো? সব নোংরা আমার শরীর থেকে বিসর্জন দেব এই নদীতে? নদী তো ভালো মন্দ সবই বুক পেতে গ্রহণ করে। আমার শরীর মন পবিত্র হয়ে যাবে এই পানিতে, এই বুড়িগঙ্গার পানিতে অবগাহন করে। খালামণি, তুমি বেঁচে থাকলে তোমার পবিত্র হাতের স্পর্শে আমি পবিত্র হয়ে যেতাম। তুমি নদী ভালোবাসতে, বুড়িগঙ্গাকে ভালোবাসতে, তাই আমি বুড়িগঙ্গার স্পর্শ পেতে চাই। আমি শরীর মার্জনা করে সব ময়লা, সব পাপ এই বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিতে চাই। তুমি আকাশের ওপার থেকে দেখো খালামণি, আমি ডুব সাঁতার, চিৎসাঁতার কেটে পানি তোলপাড় করে আমার শরীর-মন কেমন সাফ করে নিচ্ছি।

তোমার কথা আমার খুব মনে পড়ছে। এই সময়টা আমি হারাতে চাই না। এই দেখো, আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পানি উথাল পাথাল করে আমি সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে পানির গভীরতা আছে। আছে কিছুটা স্বচ্ছতা। দু-চারটে নৌকা ভাসছে। বকের মতো, রাজহাঁসের মতো সাদা ছোট বড় লঞ্চ ধীরগতিতে নদীর পানিতে ঢেউ তুলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ঢেউ উঠছে, ভাঙছে। আমি দুই হাত প্রসারিত করে সাঁতার কাটছি। ডুবও দিচ্ছি। আমার শরীর-মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। আমি চিৎসাঁতার কেটে আকাশের বুকে ভেসে ওঠা চাঁদের মুখে তোমার মুখখানি খুঁজছি। হ্যাঁ খালামণি, ওই তো তোমার হাসিমাখা মুখখানি আমি দেখতে পাচ্ছি! আর আমার ভয় নেই। আমি ম্যানহোলের দম বন্ধ করা দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পেয়েছি।

হ্যাঁ খালামণি, তোমার কথাই আমার বুকে বারবার অনুরণিত হচ্ছে। ভালো কাজের কোনো সময় অসময় নেই। শুরু করলেই হলো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ