সেমাই ঈদে মজার খুশি

সেমাই ঈদে মজার খুশি

প্রবন্ধ নিবন্ধ ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ এপ্রিল ২০২৩

‘সেমাই ঈদে মজার খুশি জোছনা আলো ছড়িয়ে

চারিদিকে ভালোবাসায় মনটা দিলো ভরিয়ে।’

তাইতো ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই খুশি। ঈদ মানেই গলাগলি, ঈদ মানে কোলাকুলি। ঈদ মানে হাসাহাসি। ঈদ ভালোবাসাবাসি। এই আনন্দ ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবার জন্যই। তবে বয়স ভেদে ঈদের আনন্দও রঙ বদলায়। শিশুদের ঈদ, তারুণ্যের ঈদ, যুবসমাজের ঈদ আর বয়স্ক মানুষের ঈদ। একেক জনের কাছে ঈদ আনন্দ একেক রকম। তবুও একটি জায়গায় সকলের মিল আছে। সেটি হলো ঈদের নামাজ। ঈদ আমাদের ধর্মীয় উৎসব। ঐতিহ্যের সোনালি দিন। ঈদ উৎসবে মহান আল্লাহকে খুশি করা যায়। মানুষে মানুষে ভালোবাসা তৈরি হয়। সবাই সবার কল্যাণ কামনা করে। তাইতো সবাই মিলে মিশে উচ্চারণ করি ‘সেমাই ঈদে মজার খুশি, ভাগ করে নেই চলো।’

ঈদ কিভাবে আমাদের হলো

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. মদিনায় এলেন। সকলেই খুশি। সবার ঘরে ঘরে ঈদের মতো আনন্দ। কেউ নতুন নতুন খাবার বানাচ্ছেন। কেউবা বাড়িঘর সুন্দর করে সাজাচ্ছেন। কেউ মক্কা থেকে বাড়িঘর ছেড়ে আসা মুহাজির ভাইবোনদের জন্য জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করছেন। তবে শিশু-কিশোরের আনন্দ একটু ভিন্ন। তারা আরো বেশি মজা করতে লাগলো। ‘তলায়াল বাদরু আলাইনা’ গান গেয়ে স্বাগত জানালো প্রিয়নবীকে। অনেক দিন সেই আনন্দের ধারা চলতে থাকলো। তরুণরা বেশি উৎসাহিত হলো। ইয়াসরিব নামক জায়গাটির নামও বদলে দিলো। নাম হয়ে গেলো মদিনা। এটাকে মদিতুন্নবী বা নবীর শহর হিসেবে গড়ে তোলা হলো। তৈরি হলো মদিনার সনদ। একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বদলে গেলো পুরো মদিনা।

খুশির জোয়ার গোটা মদিনা জুড়ে। পবিত্রতার খুশি। এতো পরিপূর্ণ আনন্দের মধ্যেও দেখা গেলো মদিনার মানুষেরা শরৎ এবং বসন্তে দুটো বড় উৎসবে মেতে উঠছে। একটির নাম নওরোজ আরেকটির নাম মিহিরজান। সাহাবিগণও উৎসব করছেন। মহানবী সা. জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এসব কী করছো? তারা বলেন, এগুলো আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে পালন করে আসছি। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘আমাদেরও দুটো ঈদ আছে। একটি রমজান মাসের রোজার শেষে সাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে।’ এটাকে বলা হয় ঈদুল ফিতর। ‘আরেকটি জিলহাজ মাসের দশ তারিখে। এটাকে বলা হয় ঈদুল আজহা।’ আমরা এটাকে কুরবানির ঈদ বলে থাকি। এ দুটো অনুষ্ঠানে মজাও করা যায় আবার সওয়াবও হাসিল করা যায়। সাহাবিগণ দারুণভাবে উৎসাহিত হলেন। নওরোজ এবং মিহিরজান বাদ দিয়ে ঈদের আনন্দে মেতে উঠলেন। এখনও আমরা সেই ঈদের আনন্দ উপভোগ করি।

ঈদের সাথে কিসের মজা

একা একা ঈদের আনন্দ উপভোগ করা যায় না। সবাইকে নিয়ে মজা করতে হয়। একসাথে সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করার নামই ঈদ। পাড়া প্রতিবেশীর সাথে এক হয়ে যাওয়ার নামই ঈদ। আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নত করা ঈদের অন্যতম উদ্দেশ্য। যাদের খাবার নেই তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেয়ার মধ্যেই ঈদের আনন্দ। যাদের কাপড় নেই তাদের ঘরে নতুন কাপড় দিয়ে আসাই ঈদের সাজসজ্জা। ধনী গরিব ভেদাভেদ ভুলে যাওয়াই ঈদের শিক্ষা। একে অপরে সাথে কোলাকুলি করার মধ্য দিয়ে ভালোবাসা গভীর করার শিক্ষা দেয় ঈদ। এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করার মধ্য দিয়ে সবাইকে সমান করে দেখার প্রশিক্ষণ পাওয়া যায়। ঈদের খুতবা শুনে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় জানার সুযোগ হয় ঈদগাহে। ঈদের সারাটা দিন শুধু ভালো ভালো। ভালো চিন্তা। ভালো কাজ। মন্দ কাজকে জীবন থেকে গুডবাই জানানোর পরিবেশ তৈরি করে ঈদ। অতীতের মারামারি-ঝগড়াঝাঁটি, হিংসা-বিদ্বেষ সবকিছু ভুলে যাবার সংস্কৃতিই ঈদ। একে অপরের বন্ধুত্ব বাড়ানোই ঈদের সৌরভ। তাইতো ঈদের আনন্দের মধ্য দিয়ে সুন্দর জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়।

ঈদের মজা ছড়িয়ে দেবো

চান রাত থেকেই মহা হৈচৈ শুরু হয়। ঈদ উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে এক সময় বেশি কৌতূহল ছিলো। চাঁদ দেখে আনন্দ করা ইসলামের সংস্কৃতি। আগে শহর-গ্রামে সবাই চাঁদ দেখার প্রস্তুতি নিয়ে থাকতো। চাঁদ দেখতে অনেকে বাসার ছাদে উঠতো। খোলা মাঠে, উঁচু জায়গায় অবস্থান নিয়ে থাকতো। চাঁদ দেখার সাথে সাথেই ‘আল্লাহু আকবার’, ‘ঈদ মুবারক’, ‘আস্সালামু আলাইকুম’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত করতো। ঈদকে স্বাগত জানিয়ে অনেক আনন্দ মিছিলও হয়। রেডিও-টেলিভিশনের খবর এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তি কারণে এই আনন্দ কিছুটা কমে গেছে। তবু চাঁদ দেখার সুন্নতি সংস্কৃতি আমাদের জেগে তোলার জন্য তৎপর থাকতে হবে।

ঈদকে ঘিরে পারিবারিক বন্ধন মজবুত হয়। ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে হয়। গোটা বছর জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করতে হয়। কিন্তু ঈদে সবাই পৈতৃক বাড়িতে একত্রিত হয়। আমাদের বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের শেকড় গ্রামে। গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে আসে অনেকেই। এতে শিশু-কিশোরদের জন্য পরিবারের চাচা-চাচী, মামা-খালা, ফুফু-ফুফাসহ সকলের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আনন্দ উৎসবের অন্যরকম মাত্রা নিয়ে শিশু-কিশোরদের জীবনে ঈদ আসে। পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, ফিরনি, পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। 

ঈদের দাওয়াত দেয়া সুন্নত। ইসলামের এই সুন্দর সংস্কৃতিকে নান্দনিকভাবে ছড়িয়ে দেয়াটাও ঈদের সংস্কৃতি। নিজের হাতে  বিভিন্ন ডিজাইনের কার্ড তৈরির মজাই আলাদা। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে সেই ডিজাইন করা কার্ড দিয়ে ঈদের দাওয়াত দিলে সকলেই খুশি হয়। ঈদকার্ডে নিজ হাতে আল্পনা আঁকিবুঁকির যোগ্যতা বাড়ে। মননশীলতা এবং উন্নত রুচির প্রকাশ পায়। নতুন নতুন কবিতা-ছন্দ লিখে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যে শিল্পচর্চার দিগন্ত খোলে। প্রযুক্তির কল্যাণে মোবাইলে সুন্দর সুন্দর খুদে বার্তাও ঈদের মজাকে বাড়িয়ে দেয়। ফেইসবুক, টুইটার, ভাইবারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেও খারাপ লাগে না। নতুন নতুন বিষয়-সংস্কৃতির উদ্ভাবন করা যায়। 

ইন্টারনেট এখন ছড়িয়ে গেছে সবখানে। স্মার্টফোনও সকলের হাতে হাতে। তাইতো আগের মতো তেমন কোনো খেলাধুলা চোখে পড়ে না। সবাই মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে গেম খেলে। ইন্টারনেটে সিনেমা কিংবা বিদেশী মুভি দেখে। ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এর কারণে ঈদের সত্যিকারের মজা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এ বিষয়ে পরিবারের অভিভাবকদেরও আরো সচেতন হতে হবে। ঈদ উপলক্ষে সবাইকে সময় দিতে হবে। ঘুরতে যেতে হবে একসাথে।   

শহর-গাঁয়ে ঈদের মজা

শহরের ঈদ খানিকটা উৎসব আমেজে কাটে। বিত্তশালীরা শপিংমল এবং বড় বড় বিপণিকেন্দ্রে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। জমকালো বাহারি পোশাক-আশাক কিনতে ব্যস্ত হয়ে যায়। প্রসাধনী কিনতে লাখ লাখ টাকার ব্যয় করে। অনেকে বিদেশে গিয়ে ঈদ শপিং সেরে আসে। ঈদ মানেই টাকা খরচের মহোৎসব। অথচ ফুটপাথে ও বস্তিতে থাকা হাজার হাজার মানুষের কাছে ঈদের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। এটাকে ইসলামের পরিভাষায় ঈদ বলা হয় না। এটা নিছক বিলাসিতা। নিজেদের একাধিক নতুন পোশাক না কিনেও ঈদের মজা আরো বেশি উপভোগ করা যায়। একজন গরিবকে নতুন পোশাক দান করলে সে খুশি হবে। তার হাসি ঈদের সবচেয়ে বেশি আনন্দ বয়ে আনবে। 

গ্রাম-গঞ্জের ঈদ আজো খুব একটা বিলাসবহুল হয়ে ওঠেনি। সচরাচর গ্রামের লোকজন অধিকাংশই কৃষিজীবী। ইচ্ছা করলেই তারা ঈদের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনতে পারে না। নতুন ফসল ঘরে উঠলেই কেবল নতুন জামা কাপড় কিনতে পারে। যাদের সামর্থ্য নেই তাদের অনেকেই চানরাতে পুরনো জামাকাপড় নতুন করে কেচে অথবা ঘষে মেজে পরিষ্কার করে ঈদের প্রস্তুতি নেয়। এর মধ্যেও তারা আনন্দ খুঁজে নেয়। ছুটে চলে এ পাড়া ও পাড়া। এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। 

ঈদের চাঁদ উঠলে অনেকেই পটকা ফুটিয়ে মজা করি। ঈদে অনেক আজে বাজে খরচ করে টাকা পয়সা উড়িয়ে দেই। এগুলো মজা সাময়িক। এতে ক্ষতিও আছে। পটকার শব্দে অনেকেরই কষ্ট হয়। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। পয়সা অপচয় হয়। তার চেয়ে সবাই মিলে ভালো কোনো কাজে হৈচৈ করলে বেশি মজা। 

তরুণদের অনেকেই বাইক নেশায় মেতে ওঠে ঈদের দিনে। তিন চারজন মিলে একবাইকে ওঠে। কয়েকটি বাইক একসাথে রেস করে। দুর্ঘটনা ঘটে প্রায়ই। অনেকেই নিহত হয়। ঈদ আনন্দকে ঘিরে দুঃসংবাদের কালো ছায়া নেমে আসে আমাদের মাঝে। এগুলোকে আনন্দ বলে না। এটা এক ধরনের পাগলামি। এখানে আনন্দের চেয়ে কষ্টই বেশি।

ঈদ খুশিতে সবাই শামিল হবো

‘ঈদ তো বড় লোকের জন্যি। হামরা গরিব মানুষ। হামারে আর কিসের ঈদ আছে বাহে। প্যাটোত ভাত নাই। ঈদ করমো ক্যাংকা করে।’ এমন কষ্টের কথা শোনা যায় অনেকের মুখে। বাংলাদেশে এখনো অনেক গ্রাম আছে যেখানে মানুষের তিনবেলা খাবার জোটানোই কঠিন। শহরে অনেক বস্তি আছে যেখানে পেটপুরে খাওয়াটাই বড় স্বপ্নের বিষয়। আমাদের পাশেই কোনো প্রতিবেশী আছে যার চিকিৎসার জন্য টাকা নেই। সন্তানকে খাতা কলম কিনে দেয়ার মতো সামর্থ্য নেই। অনেক বুড়ো মানুষ আছেন যাদের দেখভাল করার মতো কেউ নেই। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করে। কাউকে কিছু বলতেও পারে না। এমন সব লোকের পাশে দাঁড়ানোই তো ঈদ। আমাদের যাদের একটু সামর্থ্য আছে তারা যদি ঈদের খরচ কমিয়ে এ সকল মানুষের পাশে একটু দাঁড়াতে পারি তাহলেই ঈদ পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।

পরিশেষে বলা যায়, ঈদ মানে দুঃখ কষ্ট ভুলে যাওয়ার দিন। কারো মনে কষ্ট দিলে তা ভালোবাসা দিয়ে ক্ষমা করে নেবার দিন। কেউ কারো কাছে কষ্ট পেলে তা মাফ করে দেবার দিন। কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ থাকলে তা মিটিয়ে ফেলার দিন। ছোটদের ¯েœহ করার দিন। বড়দের শ্রদ্ধা করার দিন। ভালো কাজে প্রতিজ্ঞা করার দিন। খারাপ কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবার দিন। ঈদের দিনের দোয়া সবচেয়ে বেশি কবুল হয়। অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হয় ঈদের দিন সকালে। তাইতো ঈদের নামাজের ব্যাপারে আরো যত্নবান হবো। খুতবা শুনবো। সালাম দেবো। ভালোবাসা বিলাবো। আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর নেবো। গরিব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াবো। ভাগ করে নেবো সকলের সুখ এবং দুঃখ। গড়ে তুলবো সুন্দর পৃথিবী।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ