সূর্য

সূর্য

উপন্যাস জুলাই ২০১১

এনায়েত রসূল

গত সংখ্যার পর

তেরো.

তাঁতিপাড়া থেকে বের হয়ে জেলেপাড়া তেমাথায় এসে থমকে দাঁড়ালো সূর্য। এখান থেকে দুটো পথ দুদিকে চলে গেছে। পথের দুপাশ ছুঁয়ে রয়েছে ছোট ছোট গ্রাম। রয়েছে বিশাল এক খেলার মাঠ। সেই মাঠে মৌঝুরি যুব সংঘের ছেলেরা ফুটবল খেলছে। মাঠেই কি যাবে সূর্য? কিন্তু যে মাঠে সুবোধ খেলবে না সে মাঠে সূর্য গিয়ে কী করবে?

সুবোধের কথা মনে পড়তেই সূর্যের অন্য একটি কথা মনে পড়লো। সূর্য ভাবলো, প্রশান্ত ডাক্তার তো ওকে স্নেহের চোখেই দেখেন। তাকে বলে-কয়ে সুবোধদের বাড়িতে নিয়ে গেলে কেমন হয়? ওর মা হয়তো এ জন্য সূর্যের ওপর রেগে যাবেন। তা রাগুন, বন্ধুকে তো বাঁচাতে হবে।

বন্ধুকে তো বাঁচাতে হবে-এ বোধ সূর্যকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করলো। আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে সূর্য প্রায় ছুটে ছুটে প্রশান্ত সেনের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো।

প্রশান্ত সেনের পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন। এখন আর  সেই জমিদারি নেই। তবে সহায়-সম্পদ যা আছে সে সব দেখভাল করে স্বচ্ছলভাবে দিন কাটাচ্ছেন তারা। তার ওপর প্রশান্ত সেনের উপার্জন তো রয়েছেই।

একটি পুরনো দালানের সামনের অংশের চারটি ঘর নিয়ে প্রশান্ত সেন বসবাস করেন। পেছনের অংশে থাকেন তার ছোট ভাই প্রবীর সেন।

সূর্য যখন প্রশান্ত সেনের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলো তখন দুপুর শেষ হয়ে আসছিলো। প্রশান্ত সেন জলিল খানের সঙ্গে গল্প করছিলেন। সূর্য গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালে প্রশান্ত সেন দেখতে পেলেন হাফপ্যান্ট পরা একটি ছেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রশান্ত সেন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জলিল খান জিজ্ঞেস করলো, তুই মাস্টারবাড়ির ছেলে না? কী যেনো নাম তোর?

সূর্য।

জবাব দিলো সূর্য। জলিল খান বললো, বাবা নাম রেখেছে সূর্য। ওদিকে নিজের জীবনটা অন্ধকারে ঢেকে রেখেছিস। স্কুলে-টিস্কুলে তো যাস না?

সূর্য এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো, দাদু! আমি আপনার কাছে এসেছি।

প্রশান্ত সেন সূর্যের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন, আমার কাছে এসেছিস? তুই কি আমাকে চিনিস?

সূর্য বললো, চিনবো না কেনো? কতোবার আপনার কাছে এসেছি! ওই যে দু-মাস আগে হাফিজ চাচাকে নিয়ে এসেছিলাম, আপনি হাঁপানির ওষুধ দিয়েছিলেন। মনে পড়েছে দাদু?

প্রশান্ত সেন বললেন, যেমন করে সাতকাণ্ড রামায়ণ শোনালি, মনে না পড়ে উপায় আছে? তো আমার কাছে এসেছিস, তাই না? প্রশান্ত সেন দৃষ্টিতে কৌতূহল ছড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকালেন।

সূর্য বললো, আপনাকে একটু তাঁতিপাড়ায় যেতে হবে। আমার বন্ধু সুবোর জ্বর এসেছে। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না।

তাই নাকি? জিজ্ঞেস করলেন প্রশান্ত সেন।

সূর্য বললো, হ্যাঁ দাদু, শুয়েই থাকতে হচ্ছে বেচারাকে। ওদিকে আবার সোমবার তিতিরপুরের মাঠে ফুটবল ম্যাচ।  সুবোকে খেলতে হবে। কিন্তু...

কিন্তু সুস্থ না হয়ে উঠলে সে খেলতে পারবে না-এই তো?

প্রশান্ত সেন মোটা লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকালেন সূর্যের দিকে। সূর্য বললো, তাই তো। তাই বলছি দয়া করে চলুন। টাকা যা লাগে দেবো।

দিবি তো? আমার ভিজিট কতো জানিস?

জানার দারকার নেই। চলুন দাদ্ ুচলুন...

এতোক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলো সূর্য, এবার ভেতর ঢুকে প্রশান্ত সেনের বাক্সটাকে হাতে তুলে নিলো। তা দেখে প্রশান্ত সেন জলিল খানের দিকে তাকিয়ে বললেন, বিচ্ছুটার সঙ্গে তাঁতিপাড়ায় যাচ্ছি। সময় পেলে কাল আসবেন। গল্প করা যাবে।

উঠোনে পা দিয়েই মাসিমা মাসিমা বলে ডেকে চললো সূর্য। সে ডাক শুনে বাইরে এলেন সুবোধের মা। প্রশান্ত সেন তখনো আড়ালে  ছিলেন বলে তিনি ভাবলেন সূর্য সুবোধের সঙ্গে গল্প করার জন্য এসেছে। সুতরাং মুহূর্তেই তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেলো। তিনি চেঁচিয়ে উঠে বললেন, আবার এসেছিস? বের হ, বের হ বাড়ি থেকে।

সূর্য বললো, সুবোধের জন্য ডাক্তার দাদুকে নিয়ে এসেছি। তাকে ডাকবো? বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।

এবার সুবোধের মা সূর্যের ফিরে আসার কারণ বুঝতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার আচরণ বদলে গেলো। তিনি বললেন, ডাক্তার কাকা এসেছেন? যা সূর্য, কাকাবাবুকে ভেতরে নিয়ে আয়। এমন মান্যিগণ্যি মানুষকে কেউ বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখে?

সুবোধকে পরীক্ষা করে প্রশান্ত সেন বললেন, জ্বর খুব মারাত্মক নয়। দু রকম ওষুধ দিচ্ছি। রাত থেকেই খাওয়াবে।

সুবোধের মা সঙ্কোচের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ওষুধ কিনতে কতো লাগবে?

প্রশান্ত সেন বললেন, খুব বেশি লাগবে না। এই বিচ্ছুটাকে টাকা দিয়ে হারানের ডিসপেন্সারিতে পাঠালেই সে ওষুধ দিয়ে দেবে। বুঝতে পেরেছো?

সুবোধের মা বললেন, বুঝেছি। আপনি এসেছেন, কোনো সমাদর করতে পারলাম না।

প্রশান্ত সেন বললেন, আজকাল তো কারো বাড়ি গিয়ে রোগী দেখি না। সবাই আমাদের বাড়িতেই আসে। কিন্তু এ ছেলেটার অনুরোধ এড়াতে পারলাম না। তো আমি এখন যাই।

যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন প্রশাস্ত সেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারি বাক্স হাতে সূর্য তার পথরোধ করে দাঁড়ালো। প্রশান্ত সেন থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তোর আবার কি হলো?

সূর্য বললো, ওই যে ভিজিট না কি-রোগী দেখার টাকা, নেবেন না? কতো টাকা নেন?

প্রশান্ত সেন বললেন,  বিশ টাকা নিই। মায়ের কাছে যদি থাকে তো নিয়ে আয়। না থাকলে পরে দিস। আমি এগোই। ও হ্যাঁ, বাক্সটা আমাকে দে।

উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন প্রশান্ত সেন। সূর্য তখন সুবোধের মায়ের দিকে ঘুরে বললো, মাসিমা, বিশ টাকা দিতে হবে।

সুবোধের মা বললেন, আমার কাছে সাত টাকা আছে। এ জন্যই ডাক্তার ডাকিনি। তুই ডাকতে গেলি কেনো?

সূর্য বললো, সুবোর জ্বর, তাই ডেকেছি। ওকে তো ভালো হতে হবে!

ভগবান এমনিতেই ভালো করে দিতেন। মাঝখান থেকে ডাক্তারকে কতোগুলো টাকা দিতে হবে।

শুধু ডাক্তারকে কেনো মাসিমা, ওষুধও তো কিনতে হবে-হবে না?

পাশ থেকে প্রয়োজনীয় কথাটা মনে করিয়ে দিলো সূর্য। সে কথা শুনে সুবোধের মা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ছাই কিনে দেবো। এতোক্ষণ কী বললাম শুনতে পাসনি? টাকা নেই আমার কাছে।

সাত টাকা তো আছে? আপাতত তাই দিন।

শিকার ভেতর একটা হাঁড়ি ছিলো। সেখান থেকে এক টাকা দু টাকা মিলিয়ে সাত টাকা সূর্যের হাতে তুলে দিয়ে সুবোধের মা বললেন, নে ধর। যা ছিলো দিলাম।

সূর্য বললো, দিলেন তো। কিন্তু ডাক্তার দাদুকে বিশ টাকা দিতে হবে।

সুবোধের মা বললেন, দিতে পারবো না বলেই ভগবানকে ডেকেছি-ডাক্তার ডাকিনি। ঝামেলা বাধিয়েছিস তুই। কথা নেই বার্তা নেই, ডাক্তার নিয়ে হাজির! সাধে তোকে দু চোখে দেখতে পারি না?...

সুবোধের মা সাত টাকা খরচ হবার দুঃখে সূর্যকে বকাঝকা দিয়ে চললেন। তবে সূর্য সে সব শোনার জন্য অপেক্ষা করলো না। এক দৌড়ে সুবোধদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

চৌদ্দ.

সূর্যের ধারণা ছিলো ভিজিটের টাকা নেয়ার জন্য প্রশান্ত সেন বাইরে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু বাইরে এসে যখন তাকে কোথাও দেখতে পেলো না তখন সূর্যের মনে হলো তিনি বাড়িতে ফিরে গেছেন। সুতরাং সূর্যকে তার বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হবে। সুবোধের জন্য ওষুধও কিনতে হবে। কিন্তু সূর্য টাকা পাবে কোথায়?

টাকার কথা ভাবতে ভাবতে সূর্যের একটি কথা মনে পড়লো-ঢেঁড়শ-বেগুন বিক্রি করে সূর্য যতোবার মাকে টাকা দিয়েছে, ততোবার মা ওকে এক টাকা করে দিয়েছেন। সূর্য সেগুলো মাটির ব্যাংকে জমিয়েছে। সেখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে এ সমস্যা মিটিয়ে ফেলা যাবে।

ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার জন্য সূর্য যখন বাড়িতে এলো বিকেল তখন ঢলে পড়েছে। সূর্যকে ফিরে আসতে দেখে মা বললেন, এসেছিস? হাতমুখ ধুয়ে আয়। চাল ভেজেছি। তেল-মরিচ দিয়ে মেখে দিই, খেতে ভালো লাগবে।

সূর্য বললো, এখন ওসব খাওয়ার সময় নেই। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। সুবোর জন্য ওষুধ কিনতে হবে, ডাক্তার দাদুর বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হবে। আমার অনেক কাজ।

মা বললেন, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কাজগুলো সেরে আসলেই পারতি!

তা পারতাম। কিন্তু কিছু টাকা দরকার। টাকা নেয়ার জন্য এসেছি।

টাকা দরকার কেনো? মা প্রশ্নমাখা চোখে সূর্যের দিকে তাকালেন।

সূর্য বললো, সুবোর জ্বর এসেছে মা। আমি গিয়ে ডাক্তার দাদুকে নিয়ে এসেছি। তাকে টাকা দিতে হবে।

মা বললেন, তা তো হবেই। এর সঙ্গে তোর সম্পর্ক কি?

সূর্য বললো, বিশ টাকা লাগবে-মাসিমার কাছে সাত টাকা ছিলো। আবার সুবোর জন্য ওষুধও কিনতে হবে। তাই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিতে এসেছি।

মা অভিভূত হলেন ছেলের কথা শুনে। এতো দুষ্টু ছেলেটা, অথচ মানুষের জন্য মনে কতো মায়া! কিন্তু মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য ব্যাঙ্ক ভাঙবে কেনো?

মা বললেন, সব মিলিয়ে আর কতো টাকা লাগবে?

সূর্য বললো, ঠিক জানি না। অন্তত আরো পঁচিশ টাকা তো লাগবেই।

মা  বললেন, পঁচিশ টাকা আমি দেবো। ব্যাঙ্ক ভাঙবি না।

সূর্য বললো, আচ্ছা। কিন্তু তুমি টাকা দেবে কোথা থেকে? তোমার কাছে তো টাকা ছিলো না।

মা বললেন, একেবারেই যে ছিলো না তা নয়। পরশু ছিলো না। কাল তোর মামা এসেছিলেন। তিনি আমাকে কাপড় কেনার জন্য একশো টাকা দিয়ে গেছেন। সেখান থেকে তোকে পঁচিশ টাকা দেবো।

আর তোমার কাপড়? কাপড় কেনার কি হবে?

অকৃত্রিম আন্তরিকতা ঝরে পড়লো সূর্যের কণ্ঠে। সে প্রশ্ন শুনে মা ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। তারপর বললেন, কাপড় পরে কিনবো। দুজন মিলে টাকা জমিয়ে তোর আর আমার জন্য সুন্দর দুটো কাপড় কিনবো।

সূর্য বললো, তাহলে টাকা দাও। সন্ধ্যা হয়ে এলো।

পনেরো.

হারানের ডিসপেন্সারিতে গিয়ে ওষুধের দাম শুনে সূর্য অবাক হলো। ঝকঝকে রুপালি রঙের পাতার ভেতর সাদা ধবধবে দশটি ট্যাবলেট-দাম তিন টাকা। আর অন্য একটি ছোট শিশিতে যে ওষুধ হারান দিলো, তার দাম ছয় টাকা। মাত্র নয় টাকার ভেতর ওষুধ কেনা সম্ভব হলো, এ তো এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। অথচ মনে মনে কতো ভয় পেয়েছিলো সূর্য!

এখনো ডাক্তারের টাকা দেয়া হয়নি। বত্রিশ টাকা সঙ্গে ছিলো সূর্যের। ওষুধ কেনার পর তেইশ টাকা হাতে রয়েছে। ডাক্তারকে দিতে হবে বিশ টাকা। তিন টাকা বেঁচে যাবে। এ টাকাটা কাকে দেবে সূর্য-মাকে, না সুবোধের মাকে? যা করার তা মায়ের সঙ্গে আলাপ করে করবে, ভাবলো সূর্য।

সূর্য যেখানে দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবছিলো, সেখান থেকে একটি পায়েচলা পথ প্রশান্ত সেনের বাড়ির দিকে চলে গেছে। সে পথ দিয়ে সূর্য যখন সেনবাড়িতে গিয়ে পৌঁছলো তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। সূর্য দেখতে পেলো ডাক্তারখানা হিসেবে ব্যবহৃত ঘরে সুন্দর একটা ল্যাম্প জ্বেলে প্রশান্ত সেন খবরের কাগজ পড়ছেন।

সূর্য ধীরে ধীরে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর গলার স্বরটাকে নিচু করে ডাক দিলো, দাদু!

দুবার ডাকার পর খবরের কাগজের ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে প্রশান্ত সেন দরজার দিকে তাকালেন। কিন্তু আলো কম থাকার কারণে কে এসেছে তা বুঝতে পারলেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি?

সূর্য বললো, এরই মধ্যে ভুলে গেছেন? আমি সূর্য। আপনি যাকে বিচ্ছু বলে ডাকেন।

প্রশান্ত সেন বললেন, বুঝেছি। তোর সঙ্গে আজ তাঁতিপাড়ায় গিয়েছিলাম। তা কী খবর? ছেলেটার জ্বর বেড়েছে?

সূর্য বললো, না দাদু, জ্বরের জন্য নয়। আপনার টাকা দিতে এসেছি। ওদের কাছে পুরো টাকা ছিলো না, তাই এখন নিয়ে এসেছি।

প্রশান্ত সেন বললেন, আয়, ভেতরে আয়।

সূর্য ঘরে ঢুকে টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এবার ল্যাম্পের আলোয় ওকে ভালো মতো দেখার সুযোগ পেলেন প্রশান্ত সেন। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সূর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বললেন, খুব চঞ্চল ছেলে তুই। ছেলেবেলায় আমিও এমন ছিলাম।

সূর্য বললো দাদু, এই নিন টাকা।

প্যান্টের পকেট থেকে টাকা বের করে সূর্য টেবিলের ওপর রাখলো। তারপর বললো, টাকাটা দিতে দেরি হলো। হবে না কেনো! মাসিমা দিয়েছেন সাত টাকা। আমার মায়ের কাছ থেকে নিয়েছি পঁচিশ টাকা। মোট বত্রিশ টাকা নিয়ে গিয়েছি ওষুধ কিনতে। সব কিছুই তো আমাকে করতে হয়েছে। তাই আপনার কাছে আসতে একটু দেরি হলো। রাগ করেননি তো?

প্রশান্ত সেন মিটিমিটি হেসে বললেন, রাগ করলে কী করবি? আরো পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিবি?

সূর্য বললো, তা একেবারেই সম্ভব নয়। আপনার বিশ টাকা জোগাড় করতেই আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। আর আছে মাত্র তিন টাকা। পাঁচ টাকা দেবো কোথা থেকে?

প্রশান্ত সেন জমিদার বংশের সন্তান। তার ওপর বিলেত ফেরত ডাক্তার। সবাই তার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলে। তার ভেতর থাকে মেকী ভদ্রতার প্রাচুর্য। কিন্তু জীবনে এই প্রথম কতোগুলো নির্ভেজাল সত্য কথা শুনতে পেলেন তিনি সূর্যের মুখে। আর সে কথা তাকে এতোটাই অভিভূত করলো যে, বিপুল ভালোবাসা নিয়ে তিনি সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সে অবসরে সূর্য বললো, টাকা রাখুন। রাত হয়ে যাচ্ছে, আমাকে আবার সুবোদের বাড়িতে যেতে হবে। ওর ওষুধ রয়েছে আমার কাছে।

প্রশান্ত সেন বললেন, তাই তো! তোকে তো আবার সেই ছেলেটির বাড়িতে যেতে হবে। আচ্ছা বিচ্ছু, ওর বাবা কি করেন?

সূর্য বললো, সুবোর বাবা মারা গেছেন। এখন সুবোরও বাবা নেই আমারও বাবা নেই। তাই আমরা দুজন দুজনার বন্ধু।

বাবা নেই বলে তোরা দুজন দুজনার বন্ধু? আমারও বাবা নেই। আজ থেকে আমিও তোদের বন্ধু। ঠিক আছে?

সূর্য বললো, না, ঠিক নেই। এতো বুড়ো মানুষের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হবে না। আপনি টাকাটা রাখুন।

প্রশান্ত সেন টাকাগুলো হাতে নিলেন। তারপর সূর্যের হাত টেনে নিয়ে সেই টাকা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, তুই আমাকে বন্ধু ভাবিস আর না ভাবিস, আমি তোকে বন্ধু ভাববো। বন্ধু হিসেবে এ টাকাগুলো তোকে দিলাম। তোর যা ইচ্ছে কিনে নিস।

প্রশান্ত সেনের কাণ্ড দেখে সূর্য হতবাক হলো। রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে বললো, না দাদু, এ টাকা নেবো না। নেয়া উচিত হবে না।

প্রশান্ত সেন বুঝতে পারলেন ছেলেটি দুষ্টু হলেও ব্যক্তিত্বহীন নয়। এ বোধকে আহত করা ঠিক হবে না। কিন্তু যে টাকা ছেলেটির হাতে দিয়েছেন তা ফেরত নেবেন কেমন করে?

প্রশান্ত সেন ভাবলেন এক মুহূর্ত। তারপর বললেন, আচ্ছা তোকে নিতে হবে না। এখান থেকে সাত টাকা ওই ছেলেটার মাকে দিয়ে দিস।

আর বাকি টাকা?

বাকি টাকা তোর মাকে দিবি!

আচ্ছা। তাহলে আমি যাই। আপনি খুব ভালো মানুষ।

কথাটা বলে সূর্য এমন লজ্জা পেলো যে, প্রশান্ত সেনের জবাবের জন্য অপেক্ষা  করলো না। এক দৌড়ে সেনবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।

ষোল.

সুবোধের মা যখন শুনলেন প্রশান্ত সেন ভিজিটের টাকা নেননি তখন যতোটা না খুশি হলেন, তার চেয়ে বেশি খুশি হলেন তার ছেলের প্রতি সূর্যের ভালোবাসার গভীরতা দেখে। সুবোধের ওষুধ কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য সূর্য নিজের ব্যাংক ভাঙতে চেয়েছিলো, পরে ওর মা টাকা দিয়েছেন-এ ঘটনাগুলোও সুবোধের মাকে অভিভূত করলো। তিনি সূর্যকে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, জানিস তো সংসারের অবস্থা-নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এটা থাকে না ওটা খুঁজে পাই না। আজকাল সারাটা ক্ষণ মেজাজটা বিগড়ে থাকে। তাই তোকে বকাঝকা করেছি। কিছু মনে করিস না।

সূর্য বললো, বকাঝকা করেছেন বলে খারাপ লাগেনি। খারাপ ছেলে বলেছেন বলে দুঃখ পেয়েছি। হয়তো দুষ্টুমি করি, কিন্তু আমি খারাপ ছেলে নই।

সুবোধের মা বললেন, আমি তা জানি। সেবার সুবোধের জীবন বাঁচিয়েছিলি, সে কথা কি ভুলে গেছি? না বাবা, কোনো মা তা ভুলে যেতে পারে না। আসলে আমি মন থেকে কিছু বলিনি।

আমার মাও তাই বলেছেন, আপনি মন থেকে কিছু বলেননি।

হঠাৎ কথাটা বলে ফেললো সূর্য। আর সে কথা শুনে সুবোধের মা চমকে উঠে বললেন, তোর মাকে এসব বলেছিস?

সূর্য বললো, আমি কিছু বলতে চাইনি। মন খারাপ ছিলো, তা দেখে মা বুঝে গেছেন কিছু একটা হয়েছে। বারবার জানতে চাওয়ায় বাধ্য হয়ে বলেছি মাসিমা আমাকে খারাপ ছেলে বলেছেন। সে কথা শুনে মা বলেছেন আপনি মন থেকে এসব বলেননি। দুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

সুবোধের মা বললেন, আসলেও আমি মন থেকে কিছু বলিনি। এখন থেকে রোজ তোরা একসঙ্গে খেলবি-ঠিক দুটি ভাইয়ের মতো?

সত্যি?

সত্যি নয় তো কী? আমি তো নিজেই বললাম একসঙ্গে খেলবি! এতো বকাঝকা করার পরও যখন প্রশান্ত কাকাকে ডেকে এনেছিস, তখনই বুঝতে পেরেছি কতো ভালো ছেলে তুই।

নিজ থেকেই কৈফিয়ত দিলেন সুবোধের মা। তারপর বললেন, রাত হয়ে যাচ্ছে। চল তোকে এগিয়ে দিই।

যেতে যেতে সূর্যদের বাড়ি পর্যন্ত এসে গেলেন সুবোধের মা। হাতে ছিলো নিবু নিবু হারিকেন। ওটা উঁচিয়ে ধরে বললেন, এবার যেতে পারবি?

সূর্য বললো, পারবো। তো মাসিমা, বাড়িতে যখন এসেই গেছেন, মায়ের সঙ্গে দেখা করে যান।

সূর্যের এ অনুরোধে সুবোধের মা বিব্রত বোধ করলেন। তিনি যে সূর্যের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন আর সূর্যের মা তা জানতে পেরেছেন, সে কথা তার মনে পড়লো। তিনি ভাবলেন, আরো দু-চার দিন পর মুখোমুখি হলে প্রসঙ্গটাকে এড়ানো যাবে।

সুবোধের মা বললেন, দেখা করে যেতে তো মন চাইছে। কিন্তু সুবোধটাকে রেখে এসেছি। কাল-পরশু এসে দেখা করে যাবো।

সূর্য বললো, কাল-পরশুর কথা কাল-পরশু। আজ উঠোনে এসে ফিরে যাবেন, তা হবে না। আসুন তো মাসিমা, ভেতরে আসুন।

এ কথা বলেই মা মা বলে চেঁচিয়ে উঠলো সূর্য। সুতরাং ওর অনুরোধটাকে এড়াবার উপায় রইলো না। সুবোধের মা বললেন, চেঁচাস না তো! চল, ভাবীর সঙ্গে দেখা করে যাই।

সুবোধের মা যতোক্ষণ কথা বললেন ততোক্ষণ শুধু সূর্যের প্রশংসাই করলেন। সূর্য ডাক্তার ডেকে এনেছে, ওষুধের টাকা জোগাড় করে ওষুধ কিনে এনেছে-এমন সব প্রশংসা। শুনে সূর্যের যতো ভালো লাগলো, তার চেয়ে বেশি ভালো লাগলো মায়ের। তবে মা সূর্যের সামনে তা প্রকাশ করলেন না। বরং বললেন, বুঝলাম তো সূর্য একটা-দুটো ভালো কাজ  করেছে। কিন্তু কোথায় কোন কাণ্ড ঘটিয়ে বসে, সে চিন্তায় আমি দু চোখের পাতা এক করতে পারি না।

মায়ের অভিযোগ শুনে সূর্য বললো, দু চোখের পাতা থাকে দু জায়গায়। এক করবে কেমন করে? তুমি মা শুধু শুধুই আমার দোষ দিচ্ছো!

সূর্যের কথা শুনে সুবোধের মা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। আর সূর্যের মা বললেন, সব সময় ছেলেটা এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে! এ জন্যই সবাই বলে সূর্যটা মানুষ নয়-লেজকাটা হনুমান।

সুবোধের মা ঠোঁটের কোণে হাসির আভা জিইয়ে রেখে বললেন, আজকালকার ছেলেরা সবাই হনুমান। আপনি তো সূর্যের কথা বললেন। আমার সুবোধই কি সুবোধ ছেলে? সূর্য-সুবোধ দুজন যখন একসঙ্গে হয়, তখন চারপাশে ভূমিকম্প শুরু হয়। সে জন্যই কখনো কখনো রেগে গিয়ে দু-চার কথা বলে  বসি। শুনেছেন নিশ্চয়ই কাল...

শুনেছি। ওসব কোনো ব্যাপার হলো! একসঙ্গে থাকলে কতো কিছু হয়। তা বৌদি, সুবোধ কেমন আছে?

প্রসঙ্গটাকে হালকা করে দিলেন সূর্যের মা। তাতে সুবোধের মাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিনি বললেন, ওষুধ খেয়েছে। জ্বরটা অনেক কমেছে। তো আমি এখন যাই। সুবোধ বাড়িতে একা রয়েছে।

মা বললেন, আমি সকালে গিয়ে দেখে আসবো। সূর্য, তোর মাসিমাকে এগিয়ে দিয়ে আয়।

সতেরো.

বাড়ির পেছনে ঢেঁড়শ আর বেগুন খেত করেছেন মা। নিজেই গাছের দেখভাল করেন আর ফল হলে তা টুকরিতে সাজিয়ে সূর্যের মাথায় তুলে দেন। কয়েকটি মুরগি ডিম পাড়ে। সেগুলো এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বিক্রি করতে হয়। তবে এ কাজটা মা নিজেই করেন।

আজ বেগুন চারার গোড়াগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মা আলগা করে দিচ্ছিলেন, এমন সময় কাজিম মোল্লার ছেলে বাচ্চু এসে বললো, চাচী। আপনাকে চেয়ারম্যান চাচা যেতে বলেছেন।

বিচার-আচার বা অন্য কোনো কাজে চেয়ারম্যান সাহেব অনেককেই ডেকে পাঠান। কিন্তু সূর্যের মাকে কখনো তার কাছে যেতে হয়নি। আজ তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন কেনো?

বাচ্চু পাশেই ছিলো। মা জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে ডেকেছেন কেনো?

: তা তো জানি না। বাড়ির সামনে দিয়ে আসছিলাম। আমাকে ডেকে বললেন, যা তো বাচ্চু, সূর্যের মাকে গিয়ে বল আমি ডেকেছি। তো আমি এসে  আপনাকে জানালাম।

বাচ্চুর কথা শুনে মা চিন্তিত হলেন। কারণ এ পর্যন্ত যাদেরকেই চেয়ারম্যান সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন তাদের কারো জন্যই তা সুখকর হয়নি। তা না হোক, তার ডাক অগ্রাহ্য করার মতো সাহস কারো নেই-মায়ের তো নেইই। সুতরাং দুরুদুরু বুকে তিনি চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলেন।

বিশাল ড্রইংরুমে বসে চেনা-অচেনা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন চেয়ারম্যান সাহেব। মা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি উঠে সালাম জানালেন। তারপর ঘরে বসে থাকা লোকজনদের বললেন, কথা তো হলো। এবার ভাবীর সঙ্গে কথা বলবো।

সূর্যের মায়ের ধারণা ছিলো কেউ কেউ হয়তো ঘরে থেকে যাবে। কিন্তু এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেলো। চেয়ারম্যান সাহেব তখন একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসুন ভাবী। একই গ্রামে রয়েছি অথচ আপনার সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। কেমন আছেন?

মা চেয়ারম্যান সাহেবের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।

চেয়ারম্যান  সাহেব বললেন, আপনি জানেন কিনা জানি না, আমজাদ ভাই আমার বন্ধু ছিলেন। স্কুল জীবন আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি।  আমাদের বিয়েও হয়েছে এক মাস আগে-পিছে। আমার বিয়েই আগে হয়েছে। হা...হা...হা...

ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন চেয়ারম্যান সাহেব। তাতে মা আরো সঙ্কুচিত হলেন। আগেই মাথায় ঘোমটা দিয়েছিলেন, সে ঘোমটা আরো টেনে নামালেন।

চেয়ারম্যান সাহেব কী বুঝলেন কে জানে! তিনি বললেন, আমি আপনার ভাইয়ের মতো। আমাকে লজ্জা পাবার কিছু নেই। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি বরং আপনার ভাবীকে ডেকে আনি।

মা মাথা কাত করে এ প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন। চেয়ারম্যান সাহেব জানালার দিকে ঘুরে কাকে যেনো কী বললেন, তারপর আবার ঘুরে বসলেন।

এতোক্ষণে নিজেকে কিছুটা মানিয়ে নিয়েছিলেন মা। তিনি বললেন, আমাকে কেনো ডেকেছেন বুঝতে পারছি না।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, তেমন কোনো কারণে নয়। অনেক আগেই  খোঁজ-খবর নেয়ার দরকার ছিলো। কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। বারো ভূতের বেগাড় খেটেই দিন কেটে যায়। আমজাদ ভাইও চলে গেলেন আমাদের সম্পর্কও থমকে গেলো। তো ভাবী, আপনার একটাই ছেলে, তাই না?

জ্বি। ওর নাম সূর্য।

সূর্য! তার মানে আলোর উৎস। আমারও একটাই ছেলে। ওর নাম দীপ। দীপও কিন্তু আলো দেয়, তবে সূর্যের মতো উজ্জ্বল নয়। হা...হা...হা...

আবার হাসিতে ভেঙে পড়লেন চেয়ারম্যান সাহেব। তাতে মা এটুকু বুঝলেন, কথার ফাঁকে ফাঁকে হেসে ওঠা তার জটিল পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তোলার প্রচেষ্টা। সে যা হোক, চেয়ারম্যান সাহেব তাকে ডেকেছেন কেনো? নিশ্চয়ই ঘরোয়া বিষয়ে আলাপ করার জন্য নয়!

হাসির রেশ শেষ হতে না হতেই চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী ঘরে ঢুকলেন। তিনি মাকে সালাম জানিয়ে পাশের চেয়ারে বসলেন।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আমি পরিচয় করিয়ে দিই। ফোয়ারা! ইনি আমজাদ ভাইয়ের স্ত্রী-আমাদের প্রিয় ভাবী। আর ভাবী, ইনি আমার স্ত্রী ফোয়ারা বেগম। ফোয়ারা, ভাবীকে ডেকেছিলাম দীপের ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করার জন্য। স্বাভাবিক কারণেই ভাবী আন ইজি ফিল করছিলেন, তাই তোমাকে ডেকে আনতে হলো।

চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ফোয়ারা বেগম বললেন, আপনার ছেলে সূর্য?

মা বললেন, হ্যাঁ। আপনি সূর্যকে চেনেন?

ফোয়ার বেগম বললেন, ঠিক চেনা যাকে বলে তা নয়, দু-একবার ওর নাম শুনেছি। আজ এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছে যে, আপনাকে জানানো দরকার মনে হলো। যদিও ব্যাপারটা ছোটদের, তবুও বড়োদের জানা থাকা ভালো। তাতে ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার আগেই সামলিয়ে নেয়া যায়। কী বলেন ভাবী?

ফোয়ারা বেগমের কথা শুনে মায়ের বুক ধক্ করে উঠলো। কয়েকটি মুহূর্ত তিনি কোনো কথাই বলতে পারলেন না। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সূর্য কিছু করেছে?

ফোয়ারা বেগম সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতে গিয়ে কিছু বলেনি?

না ভাবী। সূর্য এখনো বাড়িতে আসেনি। সন্ধ্যার আগ দিয়ে আসবে। অমন সময়ই ও বাড়িতে আসে।

অমন সময়ই আসে! ছোট একটা ছেলে। কী করে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে কাটায়?

মা বললেন, ঘোরাঘুরি করে। বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলে...

আর মারামারি করে।

ঝট করে কথাটা বলেই পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য সচেষ্ট হলেন ফোয়ারা বেগম। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন, এ বয়সে অবশ্য সব ছেলেই মারামারি করে-কম আর বেশি।

মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হয়েছে কী ভাবী? সূর্য কি কারো সঙ্গে মারামারি করেছে?

ফোয়ারা বেগম জবাব দেয়ার আগেই এবার কথা বললেন চেয়ারম্যান সাহেব। তিনি বললেন, কী বলবো ভাবী, মারামারি তো হয় দু পক্ষে-এক পক্ষে হয় মার দেয়া। সূর্য আজ আমার ছেলেকে মার দিয়েছে।

মার দিয়েছে বললে কম বলা হয়। বলো পিটিয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের কথা সংশোধন করে দিলেন ফোয়ারা বেগম।

এদের দুজনার মাঝখানে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো মায়ের। কোনো কথা না বলে মা আঁচলের প্রান্ত দিয়ে ঘাম মুছলেন।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আমাদের ভুল বুঝবেন না ভাবী। সূর্য আমার ছেলের মতো। আমি শুধু চাইছি, যে ঘটনাটা সূর্য ঘটিয়েছে তা যেনো এখানেই শেষ হয়ে যায়। বোঝেন তো, প্রথম সব ঘটনাই ছোট থাকে-পরে তিল থেকে তাল হয়ে যায়। তো ভাবী, ছেলেটাকে একটু বশে রাখবেন।

একদমে কতোগুলো উপদেশবাণী শুনিয়ে কথার উপসংহার টানলেন চেয়ারম্যান সাহেব। মায়ের বুক ভেঙে কান্না আসতে চাইছিলো। তিনি কোনোক্রমে তা চেপে রেখে বললেন, চেষ্টা তো করি, মানাতে পারি না। বাবা না থাকলে যা হয়।

কথাটা যেমন ঠিক তেমন ঠিকও না। আপনাদের চেয়ারম্যান সাহেব তো শিশু বয়সেই বাবাকে হারিয়েছেন। তিনি কি মানুষ হননি? এক নামে দশ জেলার মানুষ তাকে চেনে। আসল কথা হলো...

আরো কী যেনো বলতে যাচ্ছিলেন ফোয়ারা বেগম, তাকে থামিয়ে দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, শুধু কথাই বলবে নাকি? ভাবী আজ প্রথম এলেন। তার জন্য চা-বিস্কিটের ব্যবস্থা করো!

ফোয়ারা বেগম বললেন, একটু বসুন ভাবী। আমি যাবো আর আসবো।

ফোয়ারা বেগম বেরিয়ে যাবার পর মা বললেন, আপনি আমার ভাইয়ের মতো। বোন হিসেবে কি একটা কথা জানতে চাইবো?

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, অবশ্যই। এটা আবার অনুমতি নেয়ার মতো ব্যাপার নাকি? কী জানতে চান বলুন?

মা বললেন, ঘটনাটা কি, তা বুঝতে পারলাম না। আগে তো ওদের মধ্যে ঝগড়া-টগড়া হয়েছে বলে শুনিনি। হঠাৎ সূর্য দীপকে মারতে গেলো কেনো? আমি একটু দীপের সাথে কথা বলবো।

চেয়ারম্যান সাহেব সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, ওহ্ এই কথা? আরে ভাবী, আপনি এখনো ওসব নিয়ে ভাবছেন! জানেনই তো সূর্য একটু রগচটা গোছের ছেলে-আমারটা আবার হাবাগোবা ভ্যাবলা কিছিমের। নয়-ছয় বোঝে না। কী থেকে কী হয়েছে, সূর্য ওকে...। বাদ দিন এসব কথা। আরে চা আনছো না কেনো? কোথায় গেলে ফোয়ারা...

চেয়ারম্যান সাহেব চিৎকার করে ফোয়ারা বেগমকে ডেকে  চললেন। তবে সূর্যের মায়ের আর বসে থাকার মতো মনের অবস্থা ছিলো না। অনেক আগেই চোখ ভিজে এসেছিলো। দ্রুতহাতে সেই চোখ মুছে তিনি বললেন, ভাবীকে আর ডাকবেন না ভাই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি যাবো।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আবার আসবেন ভাবী-আবার আসবেন। চা খেয়ে গেলে...

শেষের কথাগুলো মায়ের কানে পৌঁছলো না। তিনি ততোক্ষণে বাংলাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

আঠারো.

কয়েক মাস আগে যেমন দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিলো, আজ আবার তেমন দৃশ্যের মুখোমুখি হলো সূর্য। ঘরের ভেতর পা দিয়েই দেখলো মা চুপ করে বসে আছেন-যেনো মানুষ নয়, প্রাণহীন কোনো পাথুরে মূর্তি! সূর্য যে ধুমধাম করে ঘরে ঢুকেছে, তা শুনতেও পাননি তিনি।

মা সাধারণত দুঃখ পেলে এমন স্তব্ধ হয়ে যান। আর সেই দুঃখ যদি সূর্যের কাছ থেকে আসে, তবে মায়ের হাত-পা নিশ্চল হয়ে যায়। সচল থাকে শুধু চোখ দুটো। সেই চোখ দিয়ে নিঃশব্দে পানি পড়ে। আজও কি পানি পড়ছে? বোঝাই যাচ্ছে না।

মা বসে আছেন জানালার পাশে বাইরের দিকে মুখ করে। শুধু এটুকু বোঝা যাচ্ছে, তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। সূর্যের মনে পড়লো সূর্য যখন ছোট ছিলো তখন রাতে মা গল্প বলে ওকে ঘুম পাড়াতেন। সে সময় একটা জ্বলজ্বলে তারাকে দেখিয়ে মা বলতেন, সূর্য! ওই যে তারাটা দেখছিস, তোর বাবা ওই তারার গায়ে মিশে গেছেন। তোর যখন বাবাকে মনে পড়বে, ওই তারাটার দিকে তাকিয়ে থাকিস, মনে শান্তি পাবি। আজ মা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তবে কি তারার মাঝে মা বাবাকে খুঁজছেন? মা ছাড়া আর কে দেবে এ প্রশ্নের জবাব?

সূর্য ধীরে ধীরে মায়ের কাঁধে হাত ছোঁয়ালো। অমনি মা চমকে উঠেই আবার নিথর হয়ে গেলেন।

সূর্য মায়ের মুখ ধরে নিজের দিকে ঘোরালো। সূর্য দেখলো মায়ের গাল দুটো ভিজে আছে। চোখ থেকে অঝোরে কান্না ঝরছে-মা কাঁদছেন! সেই কান্না ভেজা চোখ দুটো থির হয়ে আছে জ্বলজ্বলে তারাটির দিকে।

সূর্য মাকে জিজ্ঞেস করলো, মা! কী হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেনো?

মা বললেন, তোর বাবাকে খুব মনে পড়ছে। কেনো যে তিনি এতো আগে চলে গেলেন! তোর যন্ত্রণা আর মানুষের অপমান সইবার জন্য আমাকে রেখে গেলেন। আমি আর পারছি না সূর্য-আর পারছি না।

এতোক্ষণ নীরবে কাঁদছিলেন-এবার ঝরঝর করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা। থরথর করে কেঁপে উঠলো তার শরীর।

মাকে কাঁদতে দেখলে সূর্যের বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। সূর্যের মনে হয়, যদি সাধ্যে কুলোয় তবে আকাশ-পাতাল একাকার করে সূর্য মায়ের জন্য সুখ ছিনিয়ে আনবে। কিন্তু সূর্য এক ছোট ছেলে। আকাশ-পাতাল একাকার করার সাধ্য কি ওর আছে!

মায়ের মুখটাকে নিজের ছোট্ট বুকের মাঝে চেপে ধরে সূর্য জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে মা? বাবাকে মনে পড়ছে কেনো?

(চলবে)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ