সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন ছোট সোনা মসজিদ

সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন ছোট সোনা মসজিদ

বিবিধ তাজ অয়ালিউল্লাহ নভেম্বর ২০২৩

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যা কিছু ঘটেছে তা আজ অতীত বলে পরিচিত। অতীতের স্বাক্ষর ইতিহাস। অতীতের বিভিন্ন ঘটনাবলি ঘটে যাওয়ার স্থানকে ঐতিহাসিক স্থান বলে। ইতিহাস রচনায় স্বাক্ষর প্রমাণ ও তথ্যাদি হলো পুরাকীর্তি। পুরাকীর্তি দেশের অতীত কালের স্বাক্ষর বহন করে। এমনি এক পুরাকীর্তির পরিচয় বহন করে দেশের উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদ। যা একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসাবে উল্লিখিত। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাজার থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন শাহবাজপুরে এই সোনা মসজিদের অবস্থান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় যেসব ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে সোনা মসজিদ উল্লেখযোগ্য। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী আসেন এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ দেখার জন্য।

নীল আকাশের নিচে আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে নির্মিত হয়েছিল এই সোনা মসজিদ। আজও দেশের সর্ব পশ্চিমের উপজেলা শিবগঞ্জের বুকে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই মসজিদটি।

ছোট সোনা মসজিদকে ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলা হয়। এটি বাংলার রাজধানী গৌড় লখনতির পিরোজপুর কোয়ার্টার হয়ে তোহাখানা কমপ্লেক্স থেকে অর্ধকিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কতুয়ালি দরজা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত।

মসজিদের প্রধান ফটকের উপরিভাগে স্থাপিত শিললিপি থেকে যানা যায় জনৈক মজলিশ ওয়ালি মুহাম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়েছিলো। শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখ সম্মিলিত অক্ষরগুলো মুছে গেলেও সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ নামের উল্লেখ থেকে স্পষ্ট যে মসজিদটির নির্মাণকাল ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সালের কোনো এক সময়। 

প্রচলিত আছে যে, মসজিদের বাইরের দেয়ালগুলো এক সময় সোনালি রঙের হওয়ায় সূর্যের আলোতে দেয়ালগুলোকে সোনার মতো ঝলমলে লাগতো। মনে হতো যেন সোনার আবরণ দ্বারা আবৃত। তাই লোকমুখে এই মসজিদের নামকরণ হয়ে যায় সোনা মসজিদ। নামকরণের বিভিন্ন মতভেদ থাকলেও এই কারণটিই প্রসিদ্ধ বলে মনে করেন স্থানীয়রা। 

এই মসজিদটি নির্মাণের প্রাক্কালে সুলতান নুশরত শাহ্ প্রায় একই রকম দেখতে আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যা ছিলো এই মসজিদের থেকেও আকারে বৃহত্তর। উক্ত কারণে তৎকালীন স্থানীয়রা নগরীর এই মসজিদটিকে বড় সোনা মসজিদ এবং নগরীর বাইরে অবস্থিত মসজিদটিকে ছোট সোনা মসজিদ বলে আখ্যায়িত করেন। 

ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য মসজিদের পূর্বপার্শে ৫টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ পার্শে ৩টি করে সর্বমোট ১১টি দরজা রয়েছে। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৫২ ফুট চওড়া। মেঝে থেকে মসজিদের ছাদের উচ্চতা মোট ২০ ফুট। মসজিদে প্রবেশ করলে বিশেষ বিশেষ জায়গায় আটটি প্যাসকেল রয়েছে। মসজিদের দেওয়ালগুলো ছয় ফুট পুরু এবং ইটের তৈরি। ইটের দু’পাশে পাথর দিয়ে মোড়ানো। মসজিদের চার কোণে চারটি বুরুজ রয়েছে এবং এই বুরুজগুলো অষ্টকোনাকার। 

এই মসজিদের উত্তর পাশে দরজার কাছে রয়েছে একটি বিশেষ সিঁড়ি যা পৌঁছে দেয় উপরের এক বিশেষ কামরায়। এই মসজিদে এক সময় বিচারব্যবস্থা চালু ছিলো আর যিনি বিচার করতেন তাকে বলা হতো কাজী সাহেব। 

এই মসজিদ প্রাঙ্গণেই রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শেষাংশে তিনি শহিদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অবস্থানরত অবস্থায় ১৪ই ডিসেম্বর মহানন্দা নদীর তীরে রেহায়চর নামক গ্রামে সম্মুখ যুদ্ধে তিনি শহিদ হন এবং বিশেষ মর্যাদায় সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়। অনেক দর্শনার্থী প্রতিদিন সোনা মসজিদ ভ্রমণ করতে এসে এই মহান বীরশ্রেষ্ঠের সমাধিস্থলে উপনীত হন এবং তাঁর আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন। 

১৫ গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের পূর্বপাশে একটি কবরস্থান রয়েছে। যেখানে শায়িত আছেন বিভিন্ন সময়ে মসজিদের দায়িত্বে কর্মরত মহান ব্যক্তিগণ। 

এই মসজিদের আর একটি বিশেষ মর্যাদা হলো বাংলাদেশের পুরাতন ‘বিশ’ টাকার নোটে এই ছোট সোনা মসজিদের ছবি রয়েছে। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি পার্কসহ বিভিন্ন পিকনিক স্পট।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ