সুপার 4

সুপার 4

উপন্যাস জানুয়ারি ২০১২

আহমেদ বায়েজীদ..

দুপুরে খাওয়ার পর নিজের রুমে শুয়ে আছে সাজিন। এ সময় দরজায় নির্দিষ্ট নিয়মে দুটো টোকা পড়লো। শোয়া থেকে উঠে বসলো সাজিন। বুঝতে বাকি নেই কারা এসেছে। উঠে দরজা খুলে দিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইফতি আর ফাহাদ।
কিরে রিমেল কোথায়? বন্ধুদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই প্রশ্ন করলো সাজিন।
বলছি, আগে তো ঘরে ঢুকতে দে! বলতে বলতে সাজিনের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে ফাহাদ।  পেছনে ইফতিও। দরজা লাগিয়ে দেয় সাজিন। ঘরে ঢুকে সাজিনের খাটে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে ফাহাদ। ইফতি চেয়ারে বসে।
রিমেল আসেনি কেন? আবার প্রশ্ন করে সাজিন।
ওর মনে হয় বাসা থেকে বের হতে একটু দেরি হবে। জবাব দেয় ইফতি। আমরা ওর বাসার সামনে দিয়ে আসার সময় জানালা দিয়ে ইশারায় বললো তোরা যা, আমি আসছি।
তুই আবার শুয়ে পড়লি কেন? ওঠ, সময় হয়ে গেছে। ফাহাদকে তাড়া দিলো সাজিন।
কিন্তু রিমেল তো এখনও আসেনি। শুয়েই জবাব দেয় ফাহাদ। ও না এলে...
হয়তো কোন সমস্যা আছে, তাই আসতে দেরি হচ্ছে। তাতে কী! মিটিং যথাসময়েই শুরু হবে।
ইফতি বললো, আমরা না হয় রিমেলের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। শুধু আমরা আমরাই তো, দশ মিনিট পর শুরু করলেও তো কিছু হবে না।
না সেটা সম্ভব নয়। তাহলে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে। যেহেতু তিনজন উপস্থিত আছি, মিটিং যথাসময়েই শুরু হবে। সাজিন বললো।
যাহ্ বাবা একটু আরামে শুয়েছিলাম... উঠে বসতে বসতে বললো ফাহাদ।
তিনজনে খাটের ওপর গোল হয়ে বসলো। শুরু হলো মিটিং। ‘সুপার ফোর’ এর সাপ্তাহিক মিটিং এটা। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনের এই মিটিংয়ে পুরো সপ্তাহের কাজ পর্যালোচনা হয় এবং পরবর্তী কাজ নিয়ে আলোচনা হয়। যদিও কাজ নেই বললেই চলে। তবুও কাজ খোঁজাটাই এখন তাদের কাজ। চার বন্ধুর শখের ডিটেকটিভ ক্লাব সুপার ফোর। গোয়েন্দা উপন্যাস পড়তে পড়তে গোয়েন্দাগিরির প্রতি আগ্রহ থেকেই মূলত এই উদ্যোগ। কোন কেস হাতে পেলেই পেশাদার গোয়েন্দাদের মতো হামলে পড়ে। শুরু হয় ক্লু খোঁজা এবং সেটা নিয়ে টিম ওয়ার্ক। কাজের কাজ এখন পর্যন্ত কমই হয়েছে। একমাত্র ফাহাদের মায়ের সোনার চেইন উদ্ধার ছাড়া। সেটাও অবশ্য চুরি হয়নি, ইঁদুর নিয়ে পালিয়েছিল। খুঁজে পেয়েছে সুপার ফোরের সদস্যরা এই যা। তবু এটাকে নিজেদের একটি সফল মিশন হিসেবে দেখে চার গোয়েন্দা। এ ছাড়া তেমন কোন কেস অবশ্য হাতে পায়নি এখনও। তবে আশপাশের মানুষদের খোঁচা আর টিটকারি পাচ্ছে নিয়মিত। সাজিনের ছোট ভাই মাহিব ওদেরকে দেখলেই ব্যঙ্গ করে বলে সুপার চোর। বাসায় একটি চামচও যদি হারানো যায় মাহিব সাথে সাথে বলে সুপার চোর আছে না, চামচ পাওয়া যাবে। স্কুলের বন্ধুরাও ওদের দেখলে বলে কিরে গোয়েন্দা কোন কেস পেলি? নাকি শুধুই নামের গোয়েন্দা। তাতে অবশ্য চার গোয়েন্দার কিছু আসে যায় না। ওদের যুক্তি দুনিয়াতে যারাই ভালো কিছু করেছে শুরুতে তাদের নিয়েই লোকে হাসাহাসি করেছে। একবার সফল হতে শুরু করলে তখন সবাই বাহাবা দেবে।
এখন পর্যন্ত সাজিনের রুমটাই সুপার ফোরের হেড কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে বসে নিরিবিলি কাজ করা যায়। তবে ওদের ইচ্ছা আছে আলাদা অফিস নেয়ার। আলাদা অফিস না থাকলে ঠিক অফিস অফিস মনে হয় না। ওদের ইচ্ছা দু-একটা কেসে সফল হলে যখন সুপার ফোর সবার কাছে স্বীকৃত হবে তখন আলাদা অফিস নেবে। চারজনের মধ্যে সব সময়ের সম্পর্ক তুই-তোকারি হলেও মিটিংয়ের সময় সেটা তুমিতে রূপ নেয়। সাজিনের যুক্তি হচ্ছে কাজের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলে কাজের পরিবেশ নষ্ট হতে পারে। তাই কাজের সময় বন্ধুত্ব ভুলে যেতে হবে। এ কথাটা সে সুপার ফোরের মূল নীতিতেও লিখে দিয়েছে। অঘোষিতভাবে সাজিনই এখন সুপার ফোরের চিফের দায়িত্ব পালন করছে। ডিটেকটিভ ক্লাব করার আইডিয়াটাও তার মাথা থেকেই এসেছে। সাজিনের নেতৃত্বেই চলছে আজকের মিটিং।
আমাদের তাহলে সুপার ফোরের ভবিষ্যৎ কাজ নিয়ে চিন্তা করা উচিত, তোমরা কী বলো? সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে বললো সাজিন।
কাজই তো নেই, আবার চিন্তা। বিরক্ত হয়ে বললো ফাহাদ।
এভাবে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না, গোয়েন্দাগিরিই যদি না করতে পারি তাহলে ডিটেকটিভ ক্লাব করে কী লাভ হলো? ইফতি বললো।
সে জন্যই তো আমাদের কাজ খুঁজতে হবে। যেহেতু আমরা এখনও গোয়েন্দা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারিনি তাই কেউ আমাদের কাজ দিচ্ছে না। এ পর্যায়ে নিজেদেরকেই কাজ খুঁজে নিতে হবে। সাজিন বললো ।
আমরা কী তাহলে রাস্তায় রাস্তায় কাজ খুঁজবো? গলা চড়ে গেল ফাহাদের।
আরে রাস্তায় কাজ.... সাজিনের কথার মাঝখানে দরজায় নির্দিষ্ট নিয়মে দুটো টোকা পড়লো। বুঝতে পারলো সবাই রিমেল এসেছে। সুপার ফোরের নির্দিষ্ট কোড এটা। এটার অর্থ এবং পদ্ধতি শুধু এর সদস্যরাই জানে। এরকম আরও অনেক সাঙ্কেতিক ভাষা রয়েছে সুপার ফোরের।
স্যরি, বাসায় একটু সমস্যা ছিল তাই দেরি হয়েছে। রুমে ঢুকে বললো রিমেল।
সাজিন কোন কথা না বলে হাতের ইশারায় রিমেলকে বসতে বললো। রিমেল বুঝতে পারলো কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা চলছে। তাই কথা না বাড়িয়ে বসে পড়লো। আবার কথা শুরু করলো সাজিন-
যা বলছিলাম, আমাদেরকে সব সময় চোখ, কান খোলা রাখতে হবে। একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আর গোয়েন্দাদের দৃষ্টি কখনোই এক হবে না। গোয়েন্দাকে সবকিছু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোন ব্যাপারে সন্দেহের সৃষ্টি হলেই হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করতে হবে।
তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে আজকে। অয়ন ভাইয়াকে তো তোমরা জানো। ঢাকায় থাকে, আমার খালাতো ভাই। সে আসছে কাল আমাদের বাসায়। ভাইয়া এবার দশ দিনের সময় নিয়ে বেড়াতে আসছে। তাই এ সময়টা আমরা তাকে কাজে লাগাতে পারবো। অয়ন ভাইয়া একজন ঝানু গোয়েন্দা। স্কুলে তারা কয়েক বন্ধু মিলে একটা ডিটেকটিভ ক্লাব করেছে। অয়ন ভাইয়াই সেটার চিফ। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কেসে তারা সফলও হয়েছে। তাদের স্কুলে ও আশপাশ এলাকায় সেই ডিটেকটিভ ক্লাবের বেশ সুনাম আছে। কাজেই অয়ন ভাইয়া যদি আমাদের কয়েকদিন প্রশিক্ষণ দেয় আশা করি আমরাও সফল হতে পারবো।
প্রশিক্ষণ নিয়ে কী হবে, হাতে কেস তো লাগবে। ইফতি বললো।
আরে বোকা! গোয়েন্দাগিরির কলাকৌশল ভালোভাবে জানলে তখন তো আমাদের কেস খুঁজে পেতেও সহজ হবে, নাকি! বললো সাজিন। একটু থেমে আবার বললো, আজ তাহলে মিটিং শেষ করি। কাল ঠিক এই সময়ে হেডকোয়ার্টারে চলে আসবে। তাকে নিয়ে আমরা বসবো।

দুই.
পরদিন সকালবেলা সাজিনের অয়ন ভাইয়া চলে এলো ঢাকা থেকে। অয়নকে পেয়ে সাজিন তো মহাখুশি। সাথে সাথে নিয়ে গেল নিজের ঘরে। সুপার ফোরের কথা খুলে বললো সব।
সাজিনের মা নাস্তা খেতে ডাকলেন। অয়ন হাত মুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে সাজিনের সাথে নাস্তা খেতে বসলো। অয়ন, সাজিন আর সাজিনের ছোট ভাই মাহিব নাস্তা খাচ্ছে এ সময় কিছুটা ব্যস্ত হয়ে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলো সাজিনের আব্বু। সাজিনের আম্মুকে ডেকে নিয়ে গেল নিজের রুমে। কতক্ষণ পর আম্মু ফিরে এলেন। তার চেহারায় চিন্তার রেখা। আম্মু সাজিনকে বললেন- সাজিন তুমি তোমার আব্বুর রুমে গিয়েছিলে?
আজকে তো যাইনি। সাজিন জবাব দেয়। কেন আম্মু কিছু হয়েছে?
হ্যাঁ, যাই হোক তোমরা নাস্তা কর, আমি যাই ওদিকে।
আবার বেরিয়ে গেলেন সাজিনের আম্মু। সাজিন তাকালো অয়নের দিকে। কিছু বুঝতে পারছে না।
অয়ন বললো, সামথিং রঙ, চলতো গিয়ে দেখি।
নাস্তা শেষ না করেই সাজিন ও অয়ন উঠে চলে গেল ওর আব্বুর স্টাডি রুমের দিকে। আব্বু-আম্মু সেখানেই রয়েছে। ভেতরে ঢুকে দেখলো দু’জনে মিলে রুমের সব ফাইলপত্র ঘাঁটছে। কোন কিছু খুঁজছে তারা বুঝলো। সাজিনের আব্বুকে দেখলো খাটের তলা, তোশকের নিচ, টেবিল আলমিরার ড্রয়ার সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজছে।
মনে হয় কিছু হারিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু। সাজিনকে নিচু গলায় বললো অয়ন।
তাই হবে। দেখি আব্বুকে জিজ্ঞেস করে। বলে সাজিন ওর আব্বুকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে আব্বু, কিছু খুঁজছো? সাজিনের প্রশ্নে খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন আব্বু। জবাব না দিয়ে সাজিনকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তুমি আমার রুমে এসেছিলে সকালে কিংবা কাল রাতে?
নাতো! কেন কিছু কি হারিয়েছে?
হ্যাঁ, একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের রূপাতলির জমির দলিলটা। কাল সন্ধ্যায় আমি টেবিলে রেখেছিলাম। আজ সকালে উকিলের কাছে যাওয়ার কথা ওটা নিয়ে।
আমিও কি খুঁজে দেখবো? বললো সাজিন।
না তোমার খোঁজার দরকার নেই। তুমি তোমার ঘরে যাও। আর শোন, কথাটা কাউকে বলো না। আবার খুঁজতে শুরু করলেন সাজিনের আব্বু।
সাজিন অয়নকে নিয়ে বের হয়ে এলো আব্বুর স্টাডি রুম থেকে। সোজা চলে এলো নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে অয়নকে নিয়ে বসে পড়লো খাটে। কিছুটা উত্তেজিত।
অয়ন সাজিনের চোখে চোখ রেখে বললো, কী ব্যাপার বল্তো, তুই এরকম করছিস কেন?
শুনলে না আমাদের জমির দলিলটা হারানো গেছে আব্বুর রুম থেকে।
এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো আর তুই মনে হচ্ছে খুশি হয়েছিস, ব্যাপার কী বলতো।
অয়নের কথায় লজ্জা পেল সাজিন। মাথা নিচু করে বললো, এটা কি আমাদের জন্য একটা কেস হতে পারে না।
কাদের জন্য কেস হবে? বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে অয়ন।
সুপার ফোর। আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাব।
ও এই কথা। খালু ফাইল হারিয়ে বিপদে পড়েছেন আর তুই আছিস গোয়েন্দাগিরির চিন্তায়। কারও পৌষমাস কারও সর্বনাশ। একটু থেমে কিছু একটা চিন্তা করলো অয়ন, তারপর আবার বললো, কথাটা অবশ্য খারাপ বলিসনি, বিষয়টা সে রকম হতেও পারে। তবে এ ব্যাপারে বাসায় কাউকে কিছু বলিস না। খালুর এমনিতেই মন খারাপ। শুনলে রেগে যাবেন।
আরে নাহ্ এসব কথা কি কাউকে বলা যায়? তবে তুমি যেহেতু এই লাইনেরই লোক তাই তোমাকে বললাম। তুমি একটু বিষয়টা ভেবে দেখ অয়ন ভাইয়া। আমরা কিন্তু প্রস্তুত।
ঠিক আছে বিষয়টা নিয়ে আমি ভাবছি। তার আগে তুই আমাকে একটু খুলে বলতো দলিলটা সম্পর্কে।
শহরের দক্ষিণ দিকে রূপাতলিতে আমাদের একটা জমি আছে সে কথাতো জানো। বরিশাল পটুয়াখালী সড়কের পাশে। বলতে শুরু করে সাজিন।
তিন চার বছর আগে যেটা খালু কিনেছিলেন? প্রশ্ন করে অয়ন।
সেটাই। কয়েক মাস ধরে সেটার মালিকানা নিয়ে একটা ঝামেলা চলছে। খুলেই বলি- ঐ এলাকারই এক লোক ঐ জমির মালিকানা দাবি করছে। তার দাবি জমির মালিক নাকি তার কাছ থেকেও টাকা নিয়েছে এবং তার নামে রেজিস্ট্রেশনও হয়েছে। সে দাবি করছে তার কাগজ পত্রই সঠিক। অন্যদিকে আমাদের নামেও তো জমির রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। এক পর্যায়ে সেই লোক জমিতে বিল্ডিং তুলতে শুরু করে। এরপর মামলা ঠুকে দেন আব্বু। তিন-চার মাস ধরে মামলা চলছে। এ মাসের পঁচিশ তারিখ মামলার রায়ের দিন ঠিক হয়েছে। আব্বু বলেছেন মামলার পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে, আমাদেরই জয় হবে। কিন্তু জমির দলিল দেখাতে না পারলে তো আদালত আমাদের বিপক্ষে মামলার রায় দেবে। তার মানে আমাদের জমি ঐ লোকটা পেয়ে যাবে। প্রায় দশ লাখ টাকা দাম ঐ জমিটার।
আরে না, দলিল হারিয়ে গেলেই জমি অন্য লোকের হয়ে যায় না। নতুন দলিল উঠানো যায়। সাজিনকে সান্ত্বনা দিলো অয়ন। তবে নতুন করে দলিল তুলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। যেহেতু মামলা এখন শেষপর্যায়ে এই সময়ে এসে মামলা পিছিয়ে গেলেও তো অনেক সময়ক্ষেপণ হবে। আবার নতুন করে শুনানি শুরু হবে। কাজেই রায়ের আগেই দলিলটা খুঁজে পাওয়া খুব জরুরি। এখন আগে ভালোভাবে শুনতে হবে দলিলটা কিভাবে হারালো। তারপর চিন্তা করতে হবে কিভাবে সেটা পাওয়া যায়।
চলো তাহলে আব্বুর কাছে জিজ্ঞেস করি দলিলটা কিভাবে হারালো। কাউকে সন্দেহ হয় কি না?
না, এখন নয়। আমরা দলিলের তদন্তে নামবো শুনলে খালু রাগ করবেন। বরং কৌশলে তার কাছ থেকে সব জানতে হবে। তুই এক কাজ কর, আজ বিকেলে তোর ডিটেকটিভ ক্লাবের মিটিং ডাক।
ঠিক আছে, তাই হবে। আমি এখনই সবাইকে খবর দিচ্ছি। বললো সাজিন।

দুপুরে বাসার সবাই একসাথে খেতে বসলো। সাজিনের আব্বু বিষণœ মনে চুপচাপ খাচ্ছেন। সাজিন অয়নের দিকে চোরা চোখে তাকালো। অয়ন ইঙ্গিতে বললো শুরু কর। সাজিন বললো, আব্বু দলিলটা কি পাওয়া গেছে?
না।
কিভাবে হারালো ওটা?
বাসায়ই তো ছিল। আমার টেবিলে। কাল সন্ধ্যায় আমি আলমারি থেকে বের করে টেবিলে রেখেছি। সকালে উকিলের কাছে যাবার কথা ছিল। গিয়ে দেখি টেবিলে নেই।
চোর টোর ঢুকতে পারে বাসায়! সুযোগ বুঝে কথা শুরু করলো অয়ন।
চোর ঢুকলে কি আর ফাইল চুরি করবে, টাকা পয়সা রেখে? অন্য কিছুই তো হারানো যায়নি বাসার।
অয়ন আবার বললো, এমন কোন চোর কি হতে পারে দলিলটা যার কাছে টাকা পয়সার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? মানে ওটার সাথে যার স্বার্থ আছে?
কী বলছো তুমি, একটু বুঝিয়ে বলো তো। অয়নের কথায় আগ্রহী হলেন সাজিনের আব্বু।
খালুকে আগ্রহী দেখে সুযোগটা নিলো অয়ন। আমি বলছিলাম কি খালু দলিলটা হারালে আপনি যে অসুবিধায় পড়বেন এবং তাতে যার লাভ হবে এমন কেউ ওটা চুরি করতে পারে। এ রকম কাউকে আপনার সন্দেহ হয় কি না?
দলিল হারালে তো লাভ হবে আমার প্রতিপক্ষদের। মামলার রায় পিছিয়ে যাবে। এমনিতেই অনেক দিন হলো জমিটায় ঘর তুলতে পারছি না। কিন্তু তারা তো কেউ আসেনি বাড়িতে, কিংবা চোর ঢোকারও তো কোন আলামত পাচ্ছি না।
প্রতিপক্ষ অথবা বাইরের আর কাউকে কি আপনার সন্দেহ হয়?
কোন কিছু হারানো গেলে তো তাদেরই সন্দেহ হওয়া উচিত যাদের সাথে এর স্বার্থ জড়িয়ে আছে, তুমি শুরুতে যেটা বলেছ। কিন্তু কাউকে সন্দেহ করার মত তো পর্যাপ্ত কারণ থাকতে হবে। বাড়িতে কোন চোর ঢোকেনি কিংবা নাসির শেখের পক্ষের কোন লোকও আসেনি।
নাসির শেখ কে? অয়ন জানতে চাইলো।
যার সাথে আমার জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে।
থানায় ডায়েরি করেছো আব্বু? সাজিন জানতে চাইলো।
না বিষয়টা জানাজানি হলে সমস্যা হতে পারে। তোমরাও কাউকে বলো না।
খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন সাজিনের আব্বু। অয়ন সাজিনও খাওয়া শেষ করলো।

তিন.
বিকেল বেলা ডিটেকটিভ ক্লাব সুপার ফোরের হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত হয়েছে সব সদস্য। আজকের মিটিংয়ে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই চলে এসেছে সবাই। ভেতরে ভেতরে সবাই বেশ উত্তেজিত। সাজিন ফোনে সবাইকে বলেছে যে একটা কেস পাওয়া গেছে। সবাই আগে চলে এলেও সাজিন বলেছে মিটিং নির্দিষ্ট সময়েই শুরু হবে। তা ছাড়া অয়ন ভাইয়া এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু ফাহাদ, ইফতি আর রিমেলের যেন তর সইছে না। মনে হচ্ছে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় রহস্যের সন্ধানে।
চারটা বাজার দুই মিনিট আগে অয়ন এলো সাজিনের রুমে। চারটায় শুরু হলো মিটিং।
শুরুতে সাজিন সংক্ষেপে দলিল হারানোর ঘটনাটা বললো সবাইকে। সবাই গভীর মনোযোগের সাথে শুনলো ঝানু গোয়েন্দাদের মত। সাজিন বললো, তোমরা তো সব শুনলে। এই কেসটাকে আমরা সুপার ফোরের সদস্যরা তদন্ত করতে চাই। এ বিষয়ে কিভাবে কী করতে হবে অয়ন ভাইয়া তা বলবে। এই কেসটায় সেই আমাদের চিফের দায়িত্ব পালন করবে।
অয়ন বললো, না না, তোমাদের ক্লাব তোমরাই কাজ করবে, আমি পাশে থেকে তোমাদের সহযোগিতা করবো। শোন, অভিজ্ঞ ভাব নিয়েই কথা শুরু করলো অয়ন। এই কেসটায় আমাদের সামনে আপাতত কোন ক্লু নেই। এক প্রকার অন্ধকারেই আছি আমরা। তাই আমাদেরকে খুব সাবধানে সামনে এগোতে হবে। আমাদের দুটো কাজ করতে হবে। এক, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা। দুই, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ওপর নজর রাখা।
আমরা তো কাউকেই সন্দেহ করিনি। এমনকি আব্বুও কাউকে সন্দেহ করতে পারছেন না। সাজিন বললো।
সন্দেহজনক কোন কিছু চোখে পড়েনি তাই খালু কাউকে সন্দেহ করছে না। কিন্তু গোয়েন্দাদের কাছে কেউ নির্দোষ নয়। এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে পারে সম্ভাব্য এমন সবাইকে নিয়ে আমরা যাচাই বাছাই করবো। যথেষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কাউকে নির্দোষ বলা যাবে না।
তাহলে তো প্রথমেই আসে নাসির শেখের নাম। মানে যার সাথে জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব। বললো সাজিন।
হ্যাঁ, নাসির শেখই এখন আমাদের সন্দেহের তালিকায় এক নম্বর ব্যক্তি। তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে হবে।
নাসির শেখ তো এলাকার পরিচিত মানুষ। রিমেল বললো। এলাকায় তার প্রভাবও বেশ। তার সাথে লাগতে গেলে খবর আছে।
অয়নের নেতৃত্বে খুদে গোয়েন্দা দল বের হল সাজিনের রুম থেকে।

সাজিনদের বাড়িটা দক্ষিণমুখী একতলা বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের চার পাশে কিছু খালি জায়গা তারপর সীমানা দেয়াল। সামনে ড্রয়িং রুমের পাশে সাজিনের ঘর। এরপর ডাইনিং রুম তার দুই পাশে দুটো বেড রুম। তার একটাতে থাকে সাজিনের আব্বু-আম্মু। একদম পূর্ব পাশে সাজিনের আব্বুর স্টাডি রুম। তার যাবতীয় কাগজপত্র সেখানেই থাকে। গোয়েন্দা দল প্রথমে এসে ঢুকলো সাজিনের আব্বুর স্টাডি রুমে। দরজা, জানালা, ভেন্টিলেটর, জানালার গ্রিল সবকিছুই পরীক্ষা করলো একে একে। কিন্তু কিছুই পেল না। কোথাও কোন লক্ষণ নেই চোর ঢোকার।
কিছুইতো পেলাম না। হতাশ হয়ে বললো সাজিন।
অয়ন বললো, চল বড়ির বাইরেটা চেক করতে হবে।
বাইরে সাজিনের আব্বুর স্টাডি রুমের জানালার কাছে এলো সবাই। জানালা থেকে দেয়াল পর্যন্ত ফাঁকা জায়গাটা চেক করতে বললো অয়ন সবাইকে, সবাই ভালোভাবে দেখ কোন জুতার দাগ কিংবা অন্য কিছু পাও কি না।
আরও পনের মিনিট ধরে চেক করলো সবাই; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। শেষে রণে ক্ষান্ত দিল।
অয়ন বললো- চোর ঢোকার কোন আলামত তো পেলাম না।
তাহলে কী হতে পারে ঘটনাটা? ইফতি বললো।
নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তো ঢুকেছে। ফাইলটাসহ দলিল তো আর জিন পরী নিয়ে যায়নি। বললো সাজিন।
যাই হোক এভাবে যেহেতু হবে না, আমাদেরকে অন্যভাবে চেষ্টা করতে হবে। চলো সাজিনের রুমে চলো। বাইরে বসে এসব কথা বলা ঠিক নয়।
সাজিনের রুমে এসে অয়ন সবাইকে বুঝিয়ে বললো এখন কী করতে হবে। বললো, এখন আমাদের হাতে একটাই সূত্র আছে সামনে এগোনোর। সেটা হলো নাসির শেখ।
আমাদের প্রথম কাজ হলো তার ওপর নজর রাখা। তোমরা কি কেউ বলতে পারবে তাকে অধিকাংশ সময় কোথায় পাওয়া যায়।
রিমেল বললো, নাসির শেখের বাসা তো আলেকান্দায়। তবে সদর রোডে তার একটি ছোট অফিস আছে, যেখানে বসে ব্যবসায় দেখাশুনা করে। দিনের বেলায় তাকে সেখানেই পাওয়া যাবে।
গুড! আমরা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নাসির শেখের ওপর নজর রাখবো। সাজিন, ফাহাদ আর ইফতি যাবে নাসির শেখের বাসার কাছে। আমি আর রিমেল যাব তার অফিসে। কাল সকাল থেকেই শুরু হবে কাজ। তবে খুব সাবধানে কাজ করতে হবে। কেউ যেন কিছু সন্দেহ করতে না পারে। বাসার পাশে ঘুরঘুর করবে না। কোন দোকান বা মাঠে সময় কাটাবে। বাড়িতে যারা আসবে যাবে তাদের পরিচয় জানতে চেষ্টা করবে। তিনজন একসাথে না থাকাই ভালো। সম্ভব হলে আলাদা থাকবে।
কিন্তু ভাইয়া, ফাহাদ বললো। আমরা সেখানে কী তথ্য সংগ্রহ করবো?
আপাতত নাসির শেখের গতিবিধি লক্ষ্য রাখবে। সে কোথায় যায়, তার কাছে কারা আসে ইত্যাদি। বিশেষ করে ভূমি অফিস বা আদালত সংশ্লিষ্ট কোন লোক আসে কি না দেখবে। সে বাড়ি থেকে বের হলে আমাকে মোবাইল ফোনে জানাবে। কোথায় যায় সম্ভব হলে জানবে। সাথে নোট বুক রাখতে ভুল করো না। গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য নোট করে রাখবে। বললো অয়ন।
তুমি আর রিমেল কিভাবে কাজ করবে? জানতে চাইলো সাজিন।
আমরাও তোমাদের মত নাসির শেখের অফিসে তার ওপর নজরদারি করবো। সম্ভব হলে অফিসে ঢুকতে চেষ্টা করব। আপাতত তো আমাদের এছাড়া কিছু করার নেই। সবচেয়ে ভালো হতো তার অফিসে এবং বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করতে পারলে।
মিটিং শেষ করে ইফতি, ফাহাদ আর রিমেল চলে গেল। রাতে অয়ন সাজিনের আব্বুর সাথে কথা বলে ফাইল সম্পর্কে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিল। এবং সে অনুযায়ী কাজের পরিকল্পনা করলো।
চার.
পরদিন সকাল সকাল সাজিন ফাহাদ আর ইফতিকে নিয়ে চলে গেল নাসির শেখের বাড়ির কাছে। ঘণ্টা খানেক পরে বেশ উৎসাহের সাথে ফোনে অয়নকে জানালো যে নাসির শেখ সাধারণত কোন জরুরি কাজ না থাকলে সকাল এগারোটার আগে বাড়ি থেকে বের হয় না। আজকেও সেরকমই হবে।
গুড, ভেরিগুড। অয়ন বললো। থাক ওখানেই। তথ্যটা দেবার জন্য ধন্যবাদ।
অয়ন রিমেলকে নিয়ে চলে গেল নাসির শেখের অফিসের কাছে। অফিস বলতে মাঝারি সাইজের একটি রুম। ভেতরে একটি টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার।
কী ব্যবসা তার? অয়নের প্রশ্ন।
এত কিছু জানি না তবে শহরের বাইরে একটা মাছের ঘের আছে। মাছের পোনাও বিক্রি করে। আর কয়েকটা স্টল আছে ভাড়া দেয়।
অয়ন আর রিমেল নাসির শেখের অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালো।  ভেতরে একটা বিশ-বাইশ বছর বয়সী ছেলে ঝাড়ু দিচ্ছে। বুঝলো পিয়ন হবে। কয়েক মিনিট পর অয়ন বললো, চলো নাসির শেখের অফিসের ভেতরে যাই।
কী বলে ঢুকবে? অবাক হলো রিমেল।
তুমি কোন কথা বলবে না। চলো আমার সাথে।
নিজের মনে কিছু কথা গুছিয়ে নিয়ে অয়ন পা বাড়ালো অফিসের দিকে। পেছনে চললো রিমেল।
নাসির শেখের অফিসে ঢুকতে পিয়ন ছেলেটি বললো, কী চাই?
এটা নাসির আঙ্কেলের অফিস না? জানতে চাইলো অয়ন।
হ্যাঁ, তোমরা কারা?
আমরা বাকেরগঞ্জ থেকে এসেছি। আমাদেরও মাছের ঘেরের ব্যবসায় আছে। আব্বু বলেছেন নাসির আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে। পাকা অভিনেতার মত বললো অয়ন।
কী দরকার স্যারের সাথে?
তা জানি না। আব্বু ফোনে তার সাথে কথা বলবেন। আমাদের শুধু বলেছেন দেখা করতে।
স্যার তো এগারোটার আগে অফিসে আসেন না। তোমরা বসো, স্যার এলে কথা বলো।
নাসির শেখের টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার। অয়ন একটি চেয়ার টান দিয়ে তার চেয়ারের সমান্তরালে নিয়ে টেবিলের ডান পাশে বসলো সামনের দিকে ফিরে, যাতে টেবিলের ভেতর পাশটা দেখা যায়। একপলকে দেখে নিল টেবিলে দুটো ড্রয়ার আর পাশে একটি ফাইল রাখার র‌্যাক। রিমেল বসলো টেবিলের সামনের অন্য একটি চেয়ারে।
চুপচাপ বসে রইলো দুজনে। টেবিলের ড্রয়ার দুটো সার্চ করার লোভ হলো অয়নের। কিন্তু সেজন্য পিয়নটাকে বাইরে পাঠাতে হবে। অজুহাত খুঁজতে লাগলো। এক পর্যায়ে চোখে পড়লো রুমের এক কোনে একটি খালি জগ রাখা পাশে একটি গ্লাস। কতক্ষণ পর অয়ন পিয়ন ছেলেটিকে বললো, ভাই একটু পানি খাবো।
পানি তো নেই, দাঁড়াও আমি এনে দেই। বলে পিয়ন ছেলেটি জগ হাতে নিয়ে বাইরে গেল। অয়ন সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে টেবিলের একটি ড্রয়ার টান দিয়ে খুলে ফেললো। অয়নের কাজ দেখে রিমেল উঠে কাছে চলে এলো। অয়ন বললো, যাও চেয়ারেই বসে থাকো। যা দেখার আমি দেখছি। দ্রুত দুটো ড্রয়ারই চেক করলো। শেষে ফাইলের র‌্যাকটিও। কিছুই পেল না। এর মধ্যে পিয়ন ছেলেটি চলে এলো পানি নিয়ে। পানি খেল দু’জনেই। পানি খাওয়ার পর অয়ন পিয়ন ছেলেটিকে বললো, এগারোটা বাজতে তো এখনও প্রায় এক ঘণ্টা বাকি, আমরা বরং একটু ঘুরে আসি।
বেরিয়ে এলো দু’জন নাসির শেখের অফিস থেকে।
রাস্তায় এসে অয়ন রিমেলকে বললো, রিকশা নাও।
কেন, কোথায় যাবে? রিমেল বললো।
বাসায়, এখানকার কাজ শেষ।
শেষ মানে! কাজতো কিছুই হলো না। অবাক হয়ে বললো রিমেল।
এখানে ফাইল নেই। নাসির শেখ যদি সাজিনদের বাসা থেকে দলিল চুরি করেও থাকে তবে আমার মনে হয় অন্য কোথাও রেখেছে। সম্ভাবনাটা বাড়িতেই বেশি। তবে সে আসলেই দোষী কিনা সেটা বোঝার জন্য নজর রাখা দরকার। যাই হোক আপাতত বাসায় চলো। দরকার হলে পরে আবার আসবো।
রিমেলকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে অয়ন রিকশা নিয়ে চললো বাসার দিকে। ফোন করে সাজিনকে বললো দুপুর পর্যন্ত থেকে চলে আসতে। রিকশায় আসতে আসতে কেসটা নিয়ে ভাবতে লাগলো আপন মনে। যেভাবে তদন্ত শুরু করেছে সেভাবে খুব বেশি এগোতে পারবে না। কোন ক্লু ছাড়া নাসির শেখের  পেছনে দৌড়ানো বৃথাও যেতে পারে। আবার অন্য কাউকে সন্দেহও করতে পারছে না। এভাবে আন্দাজে তদন্ত চালানো যায় না। বাড়িতে চোর ঢোকার কোন লক্ষণও নেই। অন্য কোনভাবে কি... অন্য কিভাবে হতে পারে? এলোমেলো ভাবনায় হাবুডুবু খাচ্ছে অয়ন। কিছুতেই কূল পাচ্ছে না। মাথায় কোন সমাধানই আসছে না। শেষে জোর করে মাথা থেকে বিষয়টি তাড়াতে চেষ্টা করলো। এভাবে কাজ হবে না। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে।
রিকশা এসে থামলো সাজিনদের বাসার সামনে। রিকশা থেকে নেমে বাসায় ঢুকলো অয়ন। দরজা খুললো সাজিনের মা। বললো, কিরে তুই একা এসেছিস সাজিন কোথায়?
ও একটু পরে আসবে খালাম্মা।
শুনেছিস দলিলের খবর?
কী খবর?
সকালে একটি চিঠি এসেছে তোর খালুর নামে। কোন নাম ঠিকানা নেই, লিখেছে মামলার রায়ের আগে দলিল ফেরত পেতে হলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে।
কোথায় চিঠি? দ্রুত জিজ্ঞেস করলো অয়ন।
তোর খালুর কাছে। ঘরেই আছে সে।
সাজিনের আব্বুর ঘরে গেল অয়ন। শুয়ে আছেন। খালু দলিলের ব্যাপারে নাকি একটি বেনামি চিঠি এসেছে?
হ্যাঁ, সকালে কুরিয়ার সার্ভিসে এসেছে। উঠে বসতে বসতে বললো সাজিনের আব্বু। মামলার তারিখের আগে দলিল ফেরত পেতে হলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। নইলে দলিল নষ্ট করে ফেলবে।
আমি একটু দেখতে পারি চিঠিটা? অয়ন বললো।
খাটে বালিশের পাশ থেকে একটি খাকি রঙের খাম তুলে দিল সাজিনের আব্বু। খামটি হাতে নিয়ে ভালোভাবে দেখলো অয়ন। কম্পিউটার কম্পোজ করে ঠিকানা লেখা সাদা কাগজ গাম দিয়ে লাগানো। খামটি উল্টে পাল্টে দেখলো আর কিছুই লেখা নেই।  ভেতরে হাত ঢুকিয়ে চিঠিটা বের করে আনলো। একটি এ ফোর সাইজের কাগজ অর্ধেক করে কাটা। মাঝখানে কম্পিউটার কম্পোজ করে লেখা- ‘আপনার দলিল আমাদের কাছে যতেœ আছে। মামলার রায়ের আগে ফেরত পেতে চাইলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। আপনি টাকা দিতে প্রস্তুত বুঝলে আমরা আবার যোগাযোগ করবো। পুলিশকে জানালে দলিল চিরতরে হারিয়ে যাবে।’
আর কিছু লেখা নেই চিঠিতে। অয়ন ভালোভাবে কয়েকবার পড়লো চিঠিটা। এরপর আবার খামে ঢুকিয়ে রাখলো।
এখন কী করবেন খালু? অয়ন প্রশ্ন করলো।
কী করবো তাই তো ভাবছি? মনে হচ্ছে টাকার জন্যই কেউ কাজটা করেছে।
চিঠিটা কোথা থেকে কুরিয়ারে বুকিং দেয়া হয়েছে খেয়াল করেছেন?
না, সেটা বুঝবো কিভাবে? পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি।
কেন চিঠি দেয়ার সময় কুরিয়ারের লোক যে রিসিভ ফরমে আপনার স্বাক্ষর নিয়েছে সেখানে তো লেখা আছে।
সে কথা তো আমার মাথায় আসেনি। এসব বিষয় তো কখনো দরকারও হয় না, তাই খেয়াল করিনি।
পুলিশকে জানাতে চান?
না এখনই জানানো ঠিক হবে হবে। দেখি আরও দু-একদিন।
আমার মনে হয় কাজটা যে বা যারাই করেছে তারা আমাদের খুব কাছ থেকে দেখছে। কারণ চিঠিতে লিখেছে টাকা দিতে চাইলে ওরা আবার যোগাযোগ করবে। তার মানে আমাদের ওপর সব সময় তাদের নজর আছে। বললো অয়ন।

পাঁচ.
সাজিন বাসায় আসতে সব কিছু খুলে বললো অয়ন। বিকেলেই মিটিংয়ে বসলো সুপার ফোরের সদস্যরা।
তোমরা তো শুনলে বিষয়টা। ঘটনা এখন অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। বললো অয়ন।
সাজিন বললো, আমরা তাহলে নাসির শেখকে বাদ দিতে পারি আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে।
সে চুরি করলে তো করবে মামলা আটকানোর জন্য। সে তো টাকা চাইবে না। সাজিনের সাথে সুর মেলালো ইফতি।
ফাহাদ বললো, তাহলে কে করলো কাজটা? আর কারো সাথে তো সাজিনদের শত্রুতা নেই।
এসব করতে শত্র“তা লাগে না। বললো অয়ন। নাসির শেখ কাজটা করলে সেটা হবে শত্রুতাবশত; কিন্তু অন্য কেউ মানে তৃতীয় যে কোন পক্ষ টাকার লোভে কাজটা করতে পারে।
কিন্তু তাদের আমরা কিভাবে খুঁজে পাবো? বললো সাজিন।
আমার মনে হয় আমাদের তদন্ত আবার প্রথম থেকে শুরু করা উচিত। কারণ পুরো ঘটনাই পাল্টে দিয়েছে ঐ বেনামি চিঠিটা। বললো রিমেল।
কিন্তু ফাইলটা বাড়ির বাইরে গেল কিভাবে? যেহেতু চোর ঢোকেনি বাড়িতে? চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো ফাহাদ।
অয়ন বললো, রিমেল যে বললো না পুরো ঘটনা পাল্টে দিয়েছে বেনামি চিঠি, তাই এ ধারণাটাও পাল্টাতে হবে আমাদের।
কোন ধারণা পাল্টাতে বলছো অয়ন ভাইয়া? জানতে চাইলো ইফতি।
চোর ঢোকার ঘটনা।
তাহলে ফাইল বাইরে গেল কিভাবে? সাজিন অবাক হবার ভঙ্গিতে বললো। বাড়িতে তো তেমন কেউ নেই দারোয়ান কিংবা কাজের লোক; যারা এ কাজ করতে পারে। নিশ্চয়ই বাইরের কেউ ঢুকেছে।
হ্যাঁ, কেউ না কেউ তো ফাইলটা সরানোর জন্য ঢুকেছেই। কিন্তু চোর হয়ে না, বন্ধু বেশে। বললো অয়ন।
মানে! একসাথে বললো চারজনে।
মানে খুব সোজা তোদের বাসায় কোন লোক এসেছে অন্য কোন কাজের কথা বলে। কেউ সেটা বুঝতে পারেনি। সুযোগ মতো ফাইলটা হাতিয়ে নিয়েছে, ব্যস।
ঠিকই বলেছো আমরা তো এভাবে ভেবে দেখিনি। বললো সাজিন। এখন কী করবে?
সবার আগে খালু মানে তোর আব্বুর সাথে কথা বলতে হবে। এই দিন কারা কারা এসেছিল বাসায় তা জানতে হবে। এরপর সন্দেহজনক লোকদের পিছনে লাগতে হবে।
সবাইকে বিদায় করে দিয়ে সাজিন আর অয়ন গেল সাজিনের আব্বুর ঘরে। কথা শুরু করলো সাজিন।
আব্বু দলিলের বিষয়ে কোন সমাধান করতে পেরেছো?
না, এখনও কিছুই তো করতে পারলাম না। হতাশা ঝড়লো সাজিনের আব্বুর কণ্ঠে।
বাড়িতে তো চোর ঢোকার কোন লক্ষণ পাওয়া যায়নি। অয়ন বললো। আমার মনে হয় খালু অন্য কোনভাবে দলিলটা বাইরে গেছে।
অন্য কিভাবে?
স্বাভাবিকভাবে কেউ অন্য কাজে এসে এটা করতে পারে।
তেমন কে আছে এ কাজ করার?
আপনি একটু ভেবে দেখুন খালু সেদিন দলিল হারানোর আগে কেউ এসেছিল কি না আপনার সাথে দেখা করতে।
একটু সময় নিয়ে ভাবলেন সাজিনের আব্বু। হ্যাঁ, এসেছিল দু’জন; কিন্তু তাদের মধ্যে তো কেউ তেমন নয়।
কে কে এসেছিল? অয়ন প্রশ্ন করলো।
সন্ধ্যায় এসেছিল রফিক সাহেব, মানে রফিক খান। পশ্চিম দিকে দুটো বাড়ির পর তার বাড়ি। আর রাত ৮টার দিকে আসে বশির মিয়া। কেসের দালাল।
তাদের মধ্যে কেউ এটা করতে পারে?
না না, রফিক সাহেবের ব্যাপারে এসব চিন্তা করাও পাপ, তার সাথে তো আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক।
আর বশির মিয়া? কথা শেষ হওয়ার আগেই বললো অয়ন।
বশির মিয়াও তো আমার পক্ষের লোক। আমি মামলায় জিতলে ও টাকা পাবে। আমার মামলা সংক্রান্ত কাজ তো ওই করে দেয়।
বশির মিয়া লোক হিসেবে কেমন? ঝানু গোয়েন্দাদের মত জেরা করতে শুরু করে অয়ন।
দালালরা সাধারণত যেমন হয়। একটু নয়-ছয় করে কথা বলে, টাকার ধান্ধায় থাকে। তবে আমার এই মামলার জন্য ও অনেক খেটেছে।
সেটা তো টাকা দিয়েছেন বলেই, নাকি?
তা তো ঠিকই।
কিন্তু সে যদি একসাথে অনেক টাকা হাতে পাওয়ার পথ পেয়ে যায়, সেটা কি ছাড়বে?
অয়নের কথায় একটু দমে গেলেন সাজিনের আব্বু। বললেন, তোমার কথায় যুক্তি আছে। দেখি আমি একটু চিন্তা করি বিষয়টা নিয়ে।
কথা শেষ করলো অয়ন। আপাতত আর কিছু জানার নেই। বের হয়ে যাওয়ার সময় সেই বেনামি চিঠিটা আবার দেখতে চাইলো সাজিনের আব্বুর কাছে। হাতে নিয়ে দেখলো। আগেই খেয়াল করেছিল বিষয়টা, আবার একটু শিওর হলো। খুব জোরালো না হলেও মোটামুটি একটা ক্লু পাওয়া গেছে। বের হয়ে এলো অয়ন আর সাজিন।

পরদিন সকালে আবার মিটিং বসলো ডিটেকটিভ ক্লাব সুপার ফোরের।
আমাদের সামনে এখন সন্দেহ করার মত লোক আছে দুই জন। এক, কেসের দালাল বশির মিয়া দুই, রফিক খা....
কিন্তু আব্বু তো বলেছে রফিক আঙ্কেল কিছুতেই এ কাজ করতে পারে না। অয়নের কথা কেড়ে নিয়ে বলে সাজিন।
শোন, খালু বলেছে তার সম্পর্কের কথা চিন্তা করে। কিন্তু গোয়েন্দাদের কাছে সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। মনে রাখবি গোয়েন্দাদের কাছে কেউ নির্দোষ নয়। বললো অয়ন।
তদন্তে নির্দোষ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত। সুর মেলালো ফাহাদ।
আবার তাহলে নতুন করে তদন্ত করতে হবে? প্রশ্ন করার ঢঙে বললো ইফতি।
হ্যাঁ নতুন করে। তবে আমার মনে হয় এবার একটু চেষ্টা করলেই আমরা সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবো। আত্মবিশ্বাস অয়নের কণ্ঠে।
কিন্তু ভাইয়া কোন ক্লু ছাড়া নজরদারি করতে ভালো লাগে না। রিমেল বললো।
এবার অবশ্য একটা ক্লু আছে আমাদের হাতে।
কী! একসাথে জানতে চাইলো সাজিন, ফাহাদ, ইফতি আর রিমেল।
চিঠি।
চিঠিতে তো কোন নাম ঠিকানা নেই। ওটা আবার ক্লু হলো কিভাবে! সাজিন অবাক।
চিঠিটা তো সাজিন পড়েছিস। তোর হয়তো চোখে পড়েনি। চিঠির একটি বানানে ভুল আছে এবং সেটাই একটা ক্লু।
আরে বানান ভুল তো কম্পিউটারে লিখলে হতেই পারে। তুমি কি বলতে চাও এখন যারা বাংলা বানান ভালো পারে না তাদের সবাইকে চোর বানাবো! বলে হেসে ফেললো সাজিন। সাথে অন্যরাও।
অয়ন গম্ভীর। বললো, বানান ভুল ঠিক না, কম্পিউটারের ফন্ট সমস্যা।
কী রকম? এবার জানতে উদগ্রীব হলো সাজিন।
চিঠিটার যেখানে লেখা ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। সেটা ভালোভাবে খেয়াল করলেই ধরতে পারতে। পঞ্চাশ লেখায় যুক্তাক্ষরটা ছিল অসম্পূর্ণ। কম্পিউটারে ফন্ট সমস্যার কারণে অনেক সময় যুক্তাক্ষর ঠিকভাবে লেখা যায় না।
অয়ন আবার বললো, এখন আমরা তদন্ত নিয়ে আলাপ করবো। এবং দায়িত্ব ভাগ করে দেব।
কাজের কথা শুনে নড়েচড়ে বসলো চারজন।
আমাদের প্রথম কাজ হলো সেই কম্পিউটারটি খুঁজে বের করা। যেহেতু আমাদের সন্দেহের তালিকাটা ছোট, তাই খুব কষ্ট হবে না আশা করি। যে চিঠিটা এসেছে সেটা হচ্ছে গোপনীয় একটি ব্যাপার। তুমি কি মনে করেছো অপরাধী এটা কম্পোজ করানোর জন্য কোন দোকানে গেছে! নিশ্চয়ই না। হয় নিজে করেছে, অথবা বিষয়টা জানে এমন কারও সাহায্য নিয়েছে। বললো অয়ন।
তাহলে এখন কী করবো আমরা? সাজিন বললো।
দুটো কাজ, প্রথমত রফিক খানের বাসায় গিয়ে তার কম্পিউটার এর ফন্ট চেক করা, দ্বিতীয়ত বশির মিয়ার সম্পর্কে খোঁজ নেয়া। আজকেই এ দুটো কাজ করতে হবে।

ছয়.
দুপুরের আগেই অয়নের বুদ্ধিমত সাজিন গেল রফিক খানের বাসায়। উদ্দেশ্য তার কম্পিউটারের ফন্ট যাচাই করা। গিয়ে বললো, আঙ্কেল আমার একটু কম্পিউটার কম্পোজ করা দরকার; কিন্তু আমাদের বাসার কম্পিউটারে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
রফিক খান বললেন, ঠিক আছে তুমি আমার কম্পিউটারে করো।
রফিক খান কম্পিউটার খুলে দিলেন। সাজিন অয়নের শেখানো মতো লিখলো গ্রুপ ক, পঞ্চম শ্রেণী, মোট পঞ্চাশ জন। ভাবখানা এমন যেন স্কুলের কোন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করলো। লেখা শেষে প্রিন্ট করে নিয়ে এলো। লেখার সময়ই সাজিন বুঝলো ওরা যে কম্পিউটার খুঁজছে এটা সেই কম্পিউটার নয়। কারণ এটাতে পঞ্চাশ কিংবা পঞ্চম লিখতে যুক্তাক্ষর ভাঙেনি। তবুও অয়নকে দেখানোর জন্য প্রিন্ট করে নিয়ে এলো।
অয়ন দেখে বলল, তাহলে রফিক খানকে আপাতত বাদ দেয়া যায় সন্দেহের তালিকা থেকে। এখন বাকি থাকে শুধু বশির মিয়া। তুই এক কাজ কর সাজিন, কোন এক অজুহাতে বশির মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখে আয় যে তার বাসায় কম্পিউটার আছে কিনা।
বশির মিয়া বাসায় নেই জেনেই সাজিন গেল তাকে খুঁজতে। তার স্ত্রী কাছ থেকে কৌশলে জেনে এলো তার বাসায় কোন কম্পিউটার নেই।
সাজিনের আব্বুর সাথে আলাপ করে অয়ন জেনে নিল বশির মিয়াকে কোথায় বেশির ভাগ সময় পাওয়া যায়। সাজিনের আব্বু বললেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আদালত আর ভূমি অফিসেই থাকে। বিকেলে সাধারণত কোন কাজ না থাকলে আমতলা মোড়ে একটা কম্পিউটারের দোকানে আড্ডা দেয়। দোকানটির নাম মোহনা কম্পিউটার।
কম্পিউটার দোকানের কথা শুনে ভাঁজ পড়লো অয়নের কপালে। খুশিতে চিকচিক করে উঠলো চোখ। কিন্তু কাউকে কিছু বললো না। সন্ধ্যায় অয়ন সাজিন আর ফাহাদকে নিয়ে গেল আমতলার মোড়ে মোহনা কম্পিউটারে। ইফতি আর রিমেলকে পাঠালো বশির মিয়ার বাসায় নজর রাখতে।
ছোট একটি দোকান মোহনা কম্পিউটার। একটি কম্পিউটার আর একটি ফটোস্ট্যাট মেশিন নিয়ে মালিক নিজেই চালায় দোকান। দোকানেই পাওয়া গেল বশির মিয়াকে। দোকান মালিক মানিকের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মানিক অল্প বয়সী। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হবে বয়স।
দোকানে ঢুকলো খুদে গোয়েন্দারা। সাজিনকে আগেই চেনে বশির মিয়া। বললো, কী ব্যাপার সাজিন কিছু লাগবে?
সাজিন বললো, হ্যাঁ বাসার কম্পিউটারটা সমস্যা দিচ্ছে, একটু কম্পোজ করতে হবে।
কী কম্পোজ করতে হবে? এসো। মানিক বললো।
সাজিন মানিকের পাশে বসে সেই একই কথাগুলো বললো আর মানিক লিখতে লাগলো। মানিকের লেখা শেষ হতেই অয়নের দিকে একসাথে চোখ ঘুরিয়ে চাইলো সাজিন আর ফাহাদ। অয়নও খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। কম্পিউটারে পঞ্চম আর পঞ্চাশ লিখতে যুক্তাক্ষরগুলো ভেঙে যাচ্ছে। ওরা কিছু বলার আগেই অয়ন বললো, ভাই যুক্তাক্ষরগুলো ঠিক করে দিন।
মানিক বললো, আমার কম্পিউটারের ফন্টে কিছু সমস্যা আছে, দু-একটা যুক্তাক্ষর ভেঙে যায়।
ঠিক আছে কী আর করা যাবে। বললো অয়ন। ওভাবেই প্রিন্ট করে দিন।
মানিক লেখাটা প্রিন্ট করে দিল। সাজিন দাম মিটিয়ে দিল। এ সময় বশির মিয়া সাজিনকে বললো, তোমাদের দলিল কি পাওয়া গেছে?
সাজিন কিছু বলার আগেই অয়ন দ্রুত বললো, কিসের দলিল? হারানো গিয়েছে নাকি?
কেন শুনলাম সাজিনদের যে জমিটা নিয়ে মামলা চলছে সেই জমির দলিল হারানো গিয়েছে। কারা নাকি চিঠিও দিয়েছে দলিলের বিনিময়ে টাকা চেয়ে।
অয়নের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো সাজিন। বললো, কই আমরা তো কিছু জানি না। আপনি জানলেন কিভাবে?
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল বশির মিয়া। বললো, ঐ মামলায় তো আমিই তোমাদের পক্ষে কাজ করছি। দলিল হারানোর পরদিন আমি সাজিনদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, সে সময় ওর আব্বু বলেছে।
কী জানি! তবে আব্বুকে কয়েকদিন যাবৎ শুনছি টাকা নিয়ে বেশ আলাপ সালাপ করছে। কী একটা কাজের জন্য নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। বললো সাজিন।
সাজিন টাকার কথা বলতেই দোকানদার মানিক ঘুরে ওদের দিকে তাকালো। চোখ-মুখে একটা খুশির ঝিলিক। বিষয়টা চোখ এড়ালো না অয়নের।
বশির মিয়া আবার বললো, টাকাটা দিয়ে হলেও দলিলটা উদ্ধার করা উচিত। কারণ মামলায় তোমরাই জিতবে। কিন্তু দলিল না পাওয়া গেলে তো মামলা পিছিয়ে যাবে। তাতে সময়ও লাগবে, টাকাও যাবে।
তাহলে মনে হয় সাজিনের আব্বু সেই টাকাই জোগাড় করছে। অয়ন বললো।
আর কথা বাড়ালো না অয়ন। যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। বশির মিয়াই দলিল চুরির হোতা। সঙ্গে আছে দোকানদার মানিক। সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে।
বাইরে এসে অয়ন চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। খুশিতে লাফিয়ে উঠে সাজিন বললো, ভাইয়া আমরাতো তাহলে চোর পেয়েই গেছি।
এই কেসে আমরা তাহলে সফল। বলে ফাহাদ জড়িয়ে ধরলো সাজিনকে।
অয়নের সেদিকে খেয়াল নেই। আনমনে কী যেন ভাবতে ভাবতে হাঁটছে ওদের সামনে। সাজিন  পেছন থেকে ধাক্কা দিল। এই ভাইয়া কী হলো তোমার? আমরা এতবড় একটা রহস্যের সমাধান করে ফেললাম আর তুমি কোন কথাই বলছো না। ব্যাপার কী?
সাজিনের ধাক্কা খেয়ে সম্বিত ফিরে পেলো অয়ন। তাড়াহুড়ো করে বললো, কী বললি সাজিন?
বলেছি তো অনেক কিছুই, তুমি তো ধ্যানে ছিলে। এবার বলো দলিল কিভাবে উদ্ধার করবে?
সেটাই তো ভাবছি। তবে ওদের কানে যেহেতু দিতে পেরেছি যে খালু টাকা দেবে, আমার মনে হয় ওরাই যোগাযোগ করবে। না করলে অন্য চেষ্টা করতে হবে। এখন বাসায় চলো। খালুর সাথে আলাপ আছে।

বাসায় এসে সাজিনের আব্বুর কাছে গেল অয়ন আর সাজিন।
সাজিন জানতে চাইলো দলিল হারানোর বিষয়ে বশির মিয়া কিছু জানে কি না?
সাজিনের আব্বু বললেন, বশির মিয়া তো এ ক’দিনে বাসায় আসেনি। সে জানবে কিভাবে?
ভালোভাবে মনে করে দেখ তো তার জানার আর কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে কি না?
না, সে কেন কেউই তো জানে না। আমি তো থানায় ডায়েরিও করিনি। এমনকি আমার উকিলের সাথেও আলাপ করিনি বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু তোমরা এত কিছু জিজ্ঞেস করছো কেন বলতো? এর আগেও দেখেছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছো।
আমরা কেসটার সমাধান করে ফেলেছি। সাজিন খুশিতে আটখান।
আমরা মানে কারা! অবাক হয়ে বললেন সাজিনের আব্বু।
আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাব সুপার ফোর। আমাদের সাথে ছিল অয়ন ভাইয়া।
বশির মিয়াই দলিল চুরি করেছে। তার সাথে আছে মোহনা কম্পিউটারের মালিক মানিক। বললো অয়ন।
বিষয়টা একটু খুলে বলো তো। তোমরা এতকিছু কিভাবে আন্দাজ করলে?
আন্দাজ নয় আব্বু আমরা নিশ্চিত। সাজিন বললো।
অয়ন খুলে বললো সব কিছু। কিভাবে ওরা সন্দেহ করলো বশির মিয়াকে। কোন ক্লু ধরে তদন্ত চালিয়েছে। কিভাবে তা প্রমাণ করেছে ইত্যাদি।
তোমাদের কথা তো যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। তবে একটা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। বশির মিয়া যদি দলিল চুরি করে তাহলে সে এত সহজে ধরা দেবে কেন? তোমাদের সাথেই বা কেন দলিলের ব্যাপারে আলাপ করবে।
এটাই হচ্ছে তার ভুল। অয়ন বললো। তবে কি খালু, আমার মনে হয় পেশাদার ক্রিমিনাল তো নয় তাই এত ফাঁক ফোকর চিন্তা করেনি। তাছাড়া আমরা যে এই ঘটনার বিষয়ে গোয়েন্দাগিরি করছি সেটা তো তার ধারণারও বাইরে ছিল। আমাদেরকে ছোট ভেবেই সে এমন কথা জানতে চেয়েছে।
আরেকটা কথা। একটু থেমে আবার বললো অয়ন। আমার মনে হয় বড় কোন প্লান নিয়ে বশির মিয়া কাজটি করেনি। দলিলটা দেখে হয়তো হঠাৎ দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় এলো, আপনিও কোন কাজে ঘরের  ভেতর গেলেন। তখনই নিয়ে নিল।
তুমি ঠিকই বলেছ অয়ন। কাজের মেয়েটা চলে যাবার পর মেহমান এলে আমিই ঘরের ভেতর গিয়ে চা-টা আনি। সেদিন ওর হাতে অন্য কিসের যেন কয়েকটা ফাইল ছিল। সেসবের মধ্যে লুকিয়ে নিয়েছে তাই যাবার সময়ও হয়তো বুঝতে পারিনি। বলে একটু থামলেন সাজিনের আব্বু। মাথা নিচু করে কিছু চিন্তা করলেন। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা তুলে বললেন, তাহলে এখন বিষয়টি পুলিশকে জানাতে হয় নাকি?
আমার মনে হয় এখনই বিষয়টি পুলিশকে না জানিয়ে একটু অপেক্ষা করা ভালো। বললো অয়ন।
কিসের অপেক্ষা?
বশির মিয়া তো চিঠিতে বলেছে আপনি টাকা দেবেন জানলে তারা আবার যোগাযোগ করবে। আমরা তাদের কৌশলে জানিয়ে দিয়েছি যে আপনি টাকা জোগাড় করছেন। টাকা দিয়েই দলিল উদ্ধার করবেন। তাই বশির মিয়ার যোগাযোগের জন্য অপেক্ষা করুন। ওদেরকে বলবেন টাকা রেডি এখন দলিল ফেরত দাও।
কিভাবে দলিল ফেরত দেবে?
সেটা ওরাই ঠিক করবে। এবং তাতেই আমার মনে হয় ওদের হাতে-নাতে ধরার একটা পথ তৈরি হবে। যেহেতু ওরা সে রকম চালাক লোক না তাই কোন না কোন ভুল করবেই। আপনি শুধু খেয়াল রাখবেন আমরা যে ওদের ধরার প্লান করছি সেটা যেন কিছুইে বুঝতে না পারে।

সাত.
অয়নের কথাই ঠিক হলো। সেদিন রাত এগারোটার দিকে একটি অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে ফোন এলো সাজিনের আব্বুর কাছে। জানতে চাইলো দলিল ফেরত নিতে চায় কি না?
সাজিনের আব্বু দেন দরবার করলো টাকা কমানোর জন্য। যাতে ওরা কিছু সন্দেহ করতে না পারে। অনেকভাবে অনুরোধ করার পর ওরা দশ হাজার টাকা কমিয়ে দিল। বললো চল্লিশ হাজার টাকা দিতে হবে। বললেন, কাল সকালে আপনি বাঁধন রেস্তোরাঁয় আসবেন টাকা নিয়ে। আর আমাদের লোক যাবে দলিল নিয়ে।
সকালে তো পারবো না এখনও কিছু টাকা বাকি। বিকেলে পারবো। বললেন সাজিনের আব্বু।
আসল কারণটা বলতে পারলো না। পুলিশকে জানাতে হবে।
রাজি হলো ঐ প্রান্ত থেকে। বললো, ঠিক আছে বিকেলেই আসুন। আপনি টাকা কাগজ দিয়ে পেঁচিয়ে টেবিলের ওপর রাখবেন। তখন আমাদের লোক গিয়ে আপনার সামনের চেয়ারে বসবে। আপনি তার সাথে হাসিমুখে হাত মেলাবেন যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। এরপর আমাদের লোক একটি ফাইল রাখবে টেবিলে আপনি ফাইল খুলে দেখবেন সব ঠিক আছে কিনা। সব ঠিক থাকলে চায়ের অর্ডার দেবেন। এরপর চা খেয়ে দু’জন চলে যাবেন যার যার পথে। তবে খবরদার পুলিশ বা হোটেলের লোক যদি কিছু জানতে পারে তবে কিন্তু দলিলও হারাবেন সাথে আপনিও বাঁচতে পারবেন না।
আরও অনেকভাবে সাবধান করে দিয়ে লাইন কেটে দিল ওপাশ থেকে।
পরদিন সকালেই থানায় গেলেন সাজিনের আব্বু। পুলিশকে জানালেন সব। থানার ওসি তার সেকেন্ড অফিসারকে সব বুঝিয়ে দিলেন। প্লান মতো সাদা পোশাকের পুলিশ থাকবে হোটেলের ভেতরে ও বাইরে। হাতেনাতে গ্রেফতার করা হবে সবাইকে।
বিকেলে অয়নের আব্বু কিছু টাকা পত্রিকার কাগজে পেঁচিয়ে গেলেন বাঁধন রেস্তোরাঁয়। ভেতরে ঢুকে একটি খালি টেবিলে বসলেন। কয়েক টেবিল পরের একটি টেবিলে বসে সাধারণ কাস্টমারের মত খেতে খেতে গল্প করছে অয়ন, ফাহাদ, ইফতি আর রিমেল। ওরাও দেখতে চায় ঘটনাটা নিজেদের চোখে। সাজিন আসেনি কারণ বশির মিয়ার লোক চিনে ফেলতে পারে।
সাজিনের আব্বু বসে টাকার প্যাকেটটি টেবিলের ওপর রাখলেন। এ সময় এক যুবক এসে বসলো তার সামনে। কথামত দু’জনে হাত মিলানোর পর সেই যুবক একটি ফাইল রাখলো টেবিলে। সাজিনের আব্বু ফাইলটি খুলে তার দলিল পেয়ে গেলেন। এরপর চায়ের অর্ডার দিলেন। যুবকটি টাকার প্যাকেটটি হাতে নিল। এ সময় দুই পাশের দুই টেবিল থেকে কাস্টমারবেশী দু’জন সাদা পোশাকের পুলিশ এসে যুবকটিকে ধরে ফেললো। একজন হাতকড়া লাগালো হাতে। ঘটনাটা এত আকস্মিক ঘটলো যে যুবকটি পালানোর চেষ্টা করতেও পারলো না। হোটেলের বাইরে থেকে পুলিশ গ্রেফতার করলো মোহনা কম্পিউটারের মালিক মানিককে। পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গ্রেফতার হলো বশির।
পুরো মহল্লা এবং স্কুলে জানাজানি হয়ে গেল সুপার ফোরের কৃতিত্ব। হিরো বনে গেল সুপার ফোরের সদস্যরা। সবাই প্রশংসা করতে লাগলো তাদের। বন্ধুরা এসে গল্প শুনতে লাগলো কিভাবে খুদে গোয়েন্দারা উদ্ধার করলো হারানো দলিল। সেই সাথে অপরাধীদের ধরিয়ে দিল পুলিশের কাছে।    (সমাপ্ত)
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ