সকাল বেলার পাখি   -আহমদ মতিউর রহমান

সকাল বেলার পাখি -আহমদ মতিউর রহমান

স্মরণ মে ২০১৮

আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠবো আমি ডাকি ...
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে মাগো সকাল হবে তবে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ কবিতাটি সবারই জানা। তিনি বড়দের যেমন ঘুম জাগানিয়া কবি তেমনি ছোটদেরও অজস্র কবিতার রচয়িতা। তিনি বড়দের জন্য কবিতা লিখে সবাইকে জাগাতে চেয়েছেন, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বের হয়ে আসার জোরালো প্রেরণা দিয়েছেন, লেখায় ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দিয়েছেন আগুন। তেমনি ছোটদের লেখায় অনুরূপ প্রেরণা তো আছেই সেই সাথে আছে শিশু মনস্তত্ত্বের প্রকাশ। শিশুরা কী চায় কেন চায় তিনি তা জানতেন এবং তাদের মনের মতো লেখা রচনা করে তাদের মনের সুপ্ত ইচ্ছা মেটাতেন। তিনি সকাল বেলার পাখি হয়ে সবার আগে ঘুম থেকে জেগে উঠতে এবং অন্যকে জাগাতে প্রেরণা জুগিয়েছেন। এই জেগে ওঠা আক্ষরিকভাবে ঘুম থেকে জাগা যেমন সত্য তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে পরাধীনতার বিরুদ্ধে জেগে ওঠার ক্ষেত্রেও সমান সত্য।

২.
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ২৪ মে ১৮৯৯ সালে, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়ায় অবস্থিত। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম। নজরুলের জন্মের আগে তাঁর কয়েক ভাই জন্মের পরপরই মারা যায়। তাই নজরুলের ডাক নাম রাখা হয় ‘দুখু মিয়া’। কিশোর বয়সেই পিতা ফকির আহমদের মৃত্যুর পর নজরুলকে উপার্জনের দিকে ঝুঁকতে হয়। তিনি কিশোর বয়সেই গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। করেন ইমামতির কাজও। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবনও বাধাগ্রস্ত হয়। আগেই বলেছি নিতান্ত অল্প বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাঁকে। এ সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়। তাঁর ইসলামী গান ও গজল আজো কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। এই ক্ষেত্রে একটা উদাহরণই যথেষ্ট, আর তা হচ্ছে ঈদুল ফিতর নিয়ে তার গান, মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। বলা যায় এ গান ছাড়া আমাদের ঈদ পূর্ণতা পায় না।

৩.
নজরুল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক, যিনি বাংলাকাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশাত্মবোধের প্রেরণাদাতা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালি মনীষার এক উজ্জ্বল নিদর্শন নজরুল। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয় ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। এত প্রতিবাদ ও অগ্নিঝরা লেখা আর কারো কবিতায় দেখা যায়নি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘অগ্নিবীণা’। বলতে গেলে এ কবিতা গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে তিনি আগুন ছড়িয়েছেন, আগুনের বীণা বাজিয়েছেন। এত আগুন, এত প্রখরতা বাংলা ভাষায় আগে কেউ দেখেনি।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে, কাজেও ‘বিদ্রোহী কবি’।

৪.
নজরুল যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। পুরুলিয়ার সিয়ারসোল রাজ স্কুল, বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার (আগেকার ত্রিশাল থানা) কাজীর সিমলায় দরিরামপুর হাইস্কুলসহ বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া শেষে পুরুলিয়ার আগের স্কুলে পড়া অবস্থায় তিনি সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে করাচি চলে যান। যুদ্ধ শেষে কলকাতায় ফিরে এসে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এ সময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। তাঁর বারুদগন্ধী লেখায় রুষ্ট হলো সরকার। হুলিয়া জারি হলো তাঁর বিরুদ্ধে। এর পর জেলে বন্দী হলেন। জেলে বন্দী হওয়ার পর লিখেন “রাজবন্দীর জবানবন্দী”। এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলাকাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। কবি নজরুলের চেয়ে সঙ্গীত রচয়িতা ও সুরকার নজরুলও কম নন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত হিসেবে পরিচিত এবং উভয় বাংলাতেই সমান জনপ্রিয়।
তাঁর চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় তার দখল ছিল। এ ছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়াল বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয়।
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন। আর্থিক সমস্যা তাকে বেশি দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিষ্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্যজীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহর সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। এসব কথা আগেই বলেছি, এখানে একটু বিস্তারিত তুলে ধরা হলো। তো তিনি ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহ- সৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। এই করাচি সেনানিবাসে থাকার সময় তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

৫.
কলকাতায় অবস্থান কালেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতি লাভ করে।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দু’বার প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু,
আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
ধূমকেতু পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে কলকাতার আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দিজীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।

৬.
১৯২২ সালে তাঁর বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে পরপর এর কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনেও এই বিদ্রোহী কবিতা অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃত।
নজরুল শিশুদের জন্যও অজস্র লেখা লিখেছেন। শিশু-কিশোররা কী ভালোবাসে, তাদের দুরন্তপনা, তাদের জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় কী করণীয় তিনি সবই জানতেন। জানতেন শিশু মনস্তত্ত্ব। খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাদু-দাদু ইত্যাদি কবিতা তারই প্রমাণ। তিনি অজস্র বৈচিত্র্যপূর্ণ গান লিখেছেন, তাতে সুর দিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন গানের নতুন নতুন শিল্পী। গীতিকার ও সুর স্রষ্টা হিসেবেও মহাকাল তাকে স্মরণ করবে আপন মহিমায়।

৭.
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নজরুলের গান ও কবিতা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তাঁর রচিত ‘চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়েছে। নজরুল ৭৭ বছর বেঁচে থাকলেও মাত্র ৪৩ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নির্বাক জীবন কাটিয়েছেন। তাই তাঁর পরিণত বয়সের লেখা থেকে দেশ জাতি বলতে গেলে বঞ্চিতই হয়েছে। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি চলার শক্তি লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির অবশিষ্ট জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারি করা হয়। ধানমন্ডিতে কবিকে যে ভবনে রাখা হয়েছিল তা এখন কবি ভবন হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে তাঁর স্মৃতি রক্ষায় গড়ে তোলা হয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট। এটি সরকারের সংস্কৃত মন্ত্রণালয় পরিচালিত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশে আনয়নের পর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তাঁর একটি গানে লিখেছেন, ‘মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়। এরপর সেখানে গড়ে তোলা হয় তাঁর সমাধি। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে কবিভক্তরা আসেন তা দেখতে ও ফাতেহা পাঠ করতে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ