শীত

শীত

প্রবন্ধ নিবন্ধ ড. মোজাফফর হোসেন জানুয়ারি ২০২৪

শীতের রোদে মুক্তা ঝরে

পড়লে শিশির ঘাসের ‘পর

শীতসকালে পিঠার রসে

মুখের পরে দুধের সর 

শীতের দিনে মিষ্টি রোদে

পিঠাপুলির নাইরে শেষ

শীতের রাতে লেপের ভেতর

উষ্ণ হলে আরাম বেশ 

শীতকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের এরকম ছড়া-কবিতা শীতের মতোই উপভোগ্য। কবিরা অনেকাংশে প্রকৃতি প্রেমিক হয়। সেজন্য প্রকৃতির বৈচিত্র্য ধরা পড়ে কবিতার ফ্রেমে। শুধু কাব্যিক পুরুষই নয়; সব মানুষই ঋতুর পরিবর্তন উপভোগ করে; আবার বিড়ম্বনাও সহ্য করে।

এখন কথা হচ্ছে; ঋতুর পরিবর্তন কেন হয়? কিভাবে হয়? ঋতু নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা আছে। গবেষণা থেকে জানা গেছে- পৃথিবী স্থির নয়। পৃথিবীর গতি আছে। পৃথিবী নিজ অক্ষের চারদিকে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর এই ঘূর্ণন বা আবর্তনকে পৃথিবীর গতি বলে। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অক্ষপথে একবার ঘুরে আসাকে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বলে। পৃথিবীর এই আহ্নিক গতির ফলে ঋতুরও পরিবর্তন ঘটে; দিন-রাত্রি হয় এবং পৃথিবীর তাপমাত্রার হ্রাস ও বৃদ্ধি ঘটে। আহ্নিক গতির কারণে তাপমাত্রা কমে গেলে শীত বা ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। অর্থাৎ পৃথিবী সূর্যের চারপাশ দিয়ে ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী যখন সূর্য থেকে বেশ দূরে চলে যায় তখন সূর্যের তাপ পৃথিবীতে কম পড়ে আর তখনই পৃথিবী ঠাণ্ডা হতে থাকে। বছরের যে সময়টাতে শীত বা ঠাণ্ডা অনুভূত হয় সেই সময়টাই শীতকাল। বাংলাদেশে এই সময়টা হচ্ছে পৌষ ও মাঘ মাস।


বাংলাদেশকে ছয় ঋতুর দেশ বলা হয়। ঋতুর মাসগুলো জলবায়ুকেন্দ্রিক প্রকৃতির এক একটা মৌসুম। মৌসুমের আরেক নাম ঋতু। প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য ও জলবায়ুর প্রভাবে এই ছয় ঋতুকে বিভিন্ন নামে চেনা যায়। যেমন- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। শীতঋতুর অবস্থান পঞ্চম। 

শীতঋতু আরম্ভ হয় হেমন্তের পরে। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস  হেমন্ত ঋতু। এই ঋতুর কার্তিক মাস অভাবের মাস। এ সময় কৃষকের হাতে পয়সা থাকে না; মুখে হাসিও থাকে না। তবে মাঠ ভরা থাকে ফসল। বিশেষ করে সবুজ ধানের ক্ষেতে মাঠের পরে মাঠ  সেজে ওঠে নবযৌবনা কিশোরীর মতো। অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে সবুজ ধান পেকে সোনালি রূপ ধারণ করে। তখন কৃষকের বুকে আনন্দের ঢেউ লাগে। নতুন ধানের ঘ্রাণে গ্রামে গ্রামে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। শুরু হয় কৃষকের বাড়ি বাড়ি নবান্ন উৎসব। যার যেমন সামর্থ্য তেমন আয়োজনে নতুন চালে রান্না করা হয় ভাত। বউবেটি; জামাইমেয়ে; আত্মীয়স্বজন দাওয়াত করে খাওয়া হয় নতুন চালের ভাত। ভাত খাওয়ার এই উৎসবের নাম নবান্ন। নবান্নের পর মাঠের ধান উঠানে আসতে শুরু করে। সাথে সাথে ধান মাড়াইও শুরু হয়। অর্ধেক রাত পর্যন্ত শোনা যায় ধানমাড়াই কলের ঘড়াত ঘড়াত শব্দ। এ শব্দ হেমন্তের শেষ প্রহর অবধি চলে। চলে ধানের দরদাম চলে বেচাকেনা। ধান মাড়াইয়ের ঘড়াত ঘড়াত শব্দ মিলিয়ে যেতে যেতেই প্রকৃতিতে নেমে আসে শীত।

পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস নিয়ে হয় শীতকাল বা শীতঋতু। প্রতিটি ঋতুর পরিবর্তন হয় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে। শীতেরও জন্ম হয় জলবায়ু পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে। শীতের বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে। বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকার কারণে অনেক মানুষের হাত-পা-ঠোঁট ফেটে যায়। এই সময়টাতে তাপমাত্রাও কমে আসে। ফলে ঠাণ্ডা অনুভূত হতে থাকে।  রাতে আকাশ থেকে শিশির নামে। কুয়াশা হয়। সকাল কুয়াশার মেঘে ঢাকা পড়ে। মাঝে মাঝেই কুয়াশার চাদরে  সূর্য মুখ লুকায়। কখনো কখনো সূর্য লুকিয়ে থাকে একটানা এক সপ্তাহ বা তারও বেশি। যে দিন সূর্য সকাল সকাল আলো ছাড়ে; সেই আলোতে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা ফোঁটা ফোঁটা শিশির; মুক্তা দানার মতো চিক চিক করে ওঠে। চিক চিক করা শিশির বিন্দুর ওপর চোখ পড়লে মনটাও উৎফুল্লে নেচে ওঠে। কি এক ভালো লাগা তখন শরীরে শিহরণ জাগায়; অনুরণ হয় মনের ভেতর; আনমনে মন গান গেয়ে যায় মনে মনে।

শীত ঐশ্বর্য নিয়ে আগমন করে। শীতের ঐশ্বর্য হলো ফসল ভরা মাঠ। শীত মৌসুমে মাঠে কৃষক সবুজ শাকসবজির বাগান করে। এ সময় সরিষার চাষ হয়। সরিষার হলুদ ফুলে ফুলে মাঠের পর মাঠ মৌমাছি ওড়াউড়ি করে। মৌমাছির ভনভন শব্দে সরিষা ক্ষেত গমগম করে। সরিষা ফুলের রং হলুদ।  হলুদ রংকে বাসন্তী রংও বলা হয়। মাঠ ভরা সেই বাসন্তী রঙের বিপুল সমারোহ দেখে; তরুণ ছেলে-মেয়েদের মন হারিয়ে যেতে চায়। তখন তারা সরিষা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে নিজের ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। শীত ঋতুতে লাল শাকেরও চাষ হয়। এইজন্য শীতঋতুকে শাকসবজির মৌসুমও বলা হয়। এ সময়  বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলা, গাজর, আলু, মরিচের সবুজ ক্ষেতে মাঠ ভরে ওঠে। একই মাঠে পাশাপাশি সবুজ শাকসবজি; অন্য পাশে সরিষার হলুদ ফুল। কোথাও সবরিকলার  সবুজ বাগান, আখের ক্ষেত মাঠকে যেন বানিয়ে দেয় ঐশ্বর্যের রানি। টমেটো, বেগুন ক্ষেত আর বরবটির মাচায় কৃষকের আনন্দ দোলা দিয়ে যায়। এ দৃশ্য অপূর্ব। চমৎকার গ্রাফিকস। দক্ষ শিল্পীর তুলির আঁচড়। স্বর্গীয় এই সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য যেন শতরঞ্জি বিছিয়ে রেখেছে কৃষাণ। সবজির ক্ষেত শিশিরে ভিজে নিজেকে করে রাখে শুভ্র সতেজ। শিশিরের পারদ সবুজে মেখে যখন সবজি ক্ষেত সূর্যের রশ্মিকে কাছে টানে তখন টসটসে তাজা কাঁচাপাকা লালসবুজ টমেটোর শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ে শিশিরের শুভ্র ফোঁটা। এ দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এ সৌন্দর্য মহান সত্তার অবদান।

শীতঋতুর ঐশ্বর্য গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছের রস। একসময় গ্রামগঞ্জের মানুষ খেজুর রস আর মুড়ি দিয়ে সকালের নাশতা সেরে নিত। সন্ধ্যেবেলাতে খেজুর গাছিরা খেজুর গাছ চেঁচে মাটির হাঁড়ি লাগিয়ে রাখতো। সারা রাতে ফোঁটা ফোঁটা রস পড়ে হাঁড়ি ভরে যেত। ভোরবেলায় সেসব হাঁড়ি নামিয়ে গাছিরা মাটির কলসিতে রস ভরে; সিঁকাবাউকে সাজিয়ে ঘাড়ে করে; গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিকাতে যেত। শীতের সকালে সেই ঠাণ্ডা রস কেনার জন্য ছোটবড় সকলেই লাইন দিতো। কনকনে ঠাণ্ডায় উঠানে বসে মুড়ি আর খেজুর রস একসাথে খাওয়ার স্বাদ অমৃত; আর মজাই আলাদা। এখনও গাছিরা খেজুর গাছের রস নামায়। তবে শীতের সকালে মানুষ আর সেভাবে রসমুড়ি খায় না। খেজুরের ঠাণ্ডা রস খেলে না কি নিপা ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। এই ভয়ে আজকাল মানুষ শীতের সকালে খেজুর রস খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। এখন গাছিরা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় করে। সেই গুড় দিয়ে মানুষ পিঠাপায়েস খাওয়ার অভ্যাস গড়েছে। শীতের পিঠার কদর বেশি। শীতের সন্ধ্যায় শহর-বন্দরে; পাড়ামহল্লার অলিতে গলিতে; ভাপাপিঠার যেন হাট বসে। 

শীতের দিনগুলো মানুষ নানাভাবে উপভোগ করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রংবেরঙের নতুন নতুন গরম জামা-জুতা-মুজা পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। শুরু হয় নানারকমের খেলাধুলা। হাডুডু খেলা ছিল গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। কাবাডিও ছিল অন্যতম। এখন অবশ্য ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, টেবিল টেনিস, ক্রিকেটের আসর বসে। গ্রামেগঞ্জে বসে পৌষমেলা। বসে গানের আসর। যাত্রাপালা; জারিগান; পালাগান; কবিগান; মঞ্চনাটকের মঞ্চায়ন নিয়ে পাড়া-মহল্লায় চলে প্রতিযোগিতা। চলে ধর্মীয় সভা; পথসভা; আলোচনা। মাঘের শেষে বেটি-নারীরা বাপের বাড়িতে নাইয়র যায়। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা বনভোজন; পিকনিক; শিক্ষাসফরে যাত্রা করে। শীতঋতুকেই মানুষ ভ্রমণের উপযুক্ত সময় মনে করে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ এ সময় দূর-দূরান্তে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়ে। শীতঋতুতে মানুষ বিয়ে-শাদিরও আয়োজন করে।

শীত বিনোদনের ঋতু হলেও অনেক মানুষের জীবনে এ ঋতু দুঃখ-কষ্টেরও কারণ হয়ে থাকে। এ ঋতুতে অনেক মানুষের অল্পতেই ঠাণ্ডা লাগে। তারা সর্দি-কাশিতে ভোগে। ঘন ঘন গলাব্যথা হয়। তাপমাত্রা বেশি কমে গেলে বয়স্ক মানুষের হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা বেড়ে যায়। শীতের প্রকোপে গবাদিপশু পাখপাখালি কষ্ট পায়। কষ্ট পায় পথশিশু; ছিন্নমূল ভবঘুরে মানুষ; গরিব-দুঃখী। যাদের একমুঠো খাবারেরই নিশ্চয়তা থাকে না; তারা কিনতে পারে না শীত নিবারণের গরম কাপড়। ফলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাঙা ঘরে শীতের কনকনে হাওয়ায় পেতে থাকে তারা নিদারুণ কষ্ট। এক টুকরো গরম কাপড়ের জন্য তাদের হতে হয় মানুষের মুখাপেক্ষী। এ অবস্থায় অনুভূতি সম্পন্ন দরিদ্র মানুষের যে কী বেদনা তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। দরিদ্র মানুষ হলেই যে তাদের অনুভূতি থাকবে না; তা নয়। সব মানুষই কমবেশি অনুভূতি সম্পন্ন। এসব দরিদ্র মানুষকে গরম কাপড় ও খাবার কিনে দেওয়া সচ্ছল মানুষের কর্তব্য। সুখ-দুঃখে শীত চলে গেলে আসে বসন্ত।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ