শিশুশ্রমিক ও আমাদের সমাজ মুহাম্মদ নুরুল হুদা

শিশুশ্রমিক ও আমাদের সমাজ মুহাম্মদ নুরুল হুদা

ফিচার সেপ্টেম্বর ২০১৬

আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক ও জাতির কর্ণধার। সুতরাং শিশুদের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ ও উন্নয়নের ওপর একটি দেশ ও জাতির মঙ্গল নিভর্রশীল। আমাদের দেশের খুব স্বল্পসংখ্যক কন্যাশিশুই তাদের ন্যূনতম অধিকার ভোগ করে একটি সুন্দর পরিবেশে  বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। যদিও সমাজের বিভিন্ন সচেতন মহল থেকে কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সোচ্চার দাবি জানানো হচ্ছে। এই ব্যাপারটা শুধুমাত্র কন্যাশিশুদের বেলায়ই প্রযোজ্য নয় বরং ছেলেশিশুদের বেলায়ও প্রযোজ্য। কিন্তু এরপর আমাদের গ্রামীণ সমাজ নিম্ন আয়ভুক্ত পরিবারগুলোতে জন্মের সময়ই কন্যাসন্তানকে সাদরে গ্রহণ করা হয় না। দারিদ্র্য আর্থিক অভাব অনটন, নিরাপত্তাবোধের অভাব, পারিবারিক কলহ, ভগ্ন পরিবারের এসব শিশু পরিবারে আশ্রয় না পেয়ে বেছে নেয় পথের জীবন। তাদেরকে পথশিশু বলে আখ্যায়িত করা হয়। যে বয়সে পিতামাতার স্নেহে লালিত হওয়ার কথা সে বয়সে একটি ছোট্ট শিশুকে গৃহস্থালির কাজ করে সইতে হয় গৃহকর্ত্রীর নির্যাতন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বেছে নেয় পথের জীবন। এখানে এসেও তারা জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে। রাস্তায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভাঙ্গাড়ি টুকিয়ে তা বিক্রি করে যে টাকা পায় তা দিয়ে খাবার কিনে খায়। শখের বশে নয়, শিক্ষাজীবন শেষে ভালোভাবে বাঁচার মতো একটি জীবিকা পেয়েও নয়। বরং পরিবারের চরম দারিদ্র্যের কারণেই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে না পেরে বাধ্য হয়ে কাজে নেমেছে শিশুশ্রমিকরা। অথচ ভয়াবহ কষ্ট ঝুঁকি আর প্রতিকূল বিপদসঙ্কুল পরিবেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করতে হচ্ছে দেশের এসব শিশুশ্রমিকের। সামান্য কিছু মজুরি বা বেতনের বাইরে তাদের জন্য নেই তেমন কোন উৎসবভাতা, চিকিৎসাসুবিধা। নেই অবসর বা চিত্তবিনোদনের কোনো সুযোগ।
বেশির ভাগ কর্মজীবী শিশুকে রাসায়নিকভাবে কলুষিত বা দূষিত আবহাওয়ায় কাজ করতে হয়। অধিকাংশ কর্মজীবী শিশুর কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ খারাপ। তাদের অধিকাংশের কাজের জায়গায় কোন নিরাপত্তা থাকে না এবং প্রচন্ড ঝুঁকিসম্পন্ন কাজ করতে হয় তাদের। কাজ করতে গিয়ে শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক থাকে কম শিশুরই। পেশাগত কাজে কর্মরত শিশুদের সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে আঘাতপ্রাপ্তি। প্রায় ২৫ ভাগ শিশুই কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে থাকে। মারাত্মক শব্দদূষণের শিকার হয় ১৮ ভাগ শিশু। কর্মক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত আলো-বাতাসের কারণে স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগতে হয় ১৭ ভাগ শিশুকে। ৬২ শতাংশ শিশুশ্রমিককে রোদ এবং প্রচন্ড তাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। উঁচুস্থান থেকে পড়ে গিয়ে আহত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যেও কাজ করে অনেকে। ভারী বোঝা বহন করতে হয় ৫৭% কর্মজীবী শিশুকে। আঘাত পাওয়া অথবা পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যে কাজ ৬৮%। ৭২ ভাগকেই কোন না কোন ধারালো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কাজ করতে হয়। বাংলাদেশে শিশুপুষ্টি পরিস্থিতি নাজুক। অপুষ্টির কারণে দেশে প্রতিদিন ৫ বছরের কমবয়সী ২৪০টি অর্থাৎ ঘন্টায় ১০টি শিশু মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া অপুষ্টির কারণে শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে তাদের ওজন বাড়ছে, শিশু খাটো হচ্ছে। অথচ মায়ের দুধে ২০০টি পুষ্টি উপাদান আছে। পৃথিবীর আর কোন একক খাদ্যে একক পুষ্টি নেই। এই খাদ্যর কোন বিকল্প নেই। এই ব্যাপারে মায়ের দুধের যথাযথ সমর্থন দেয়া হলে পুষ্টিহীন ও শিশুমৃত্যুর হার সহজেই কমিয়ে আনা যায়।
সুস্থ স্বাভাবিক শৈশবের নিশ্চয়তা সব শিশুর জন্মগত অধিকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, দেশের অধিকাংশ শিশু তাদের অধিকার পাচ্ছে না। দুই মুঠো খাবার আর কোনরকম বেঁচে থাকার জন্য শিশুরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সাথে যুক্ত হচ্ছে। নয়-দশ বছরের একটি শিশুর এ বয়সে বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। গরিব বাবার ঘরে দু’বেলা পেটপুরে খাবার জুটে না। বাধ্য হয়ে অন্যের ঘরে কাজ করতে দেয় আদরের শিশুটিকে।
রাজধানীতে অনেক গৃহকর্মী বাসাবাড়িতে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সামান্য অপরাধে দিনের পর দিন চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। পাশবিক নির্যাতনে জীবনও দিতে হয় অনেককে। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এসব মৃত্যুর বেশির ভাগই থেকে যায় অজানা। ছোটখাটো অপরাধে তাদের বেদম মারপিট করা হয়। খন্তি গরম করে ছেঁকা দেয়া হয়। জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরে হাতে পায়ে। এমনকি গরম পানি ঢেলে শাস্তি দেয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। অনেকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। বাসা থেকে পালিয়ে গেছে বলে প্রচার করা হয়। প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার পায় না ভুক্তভোগীরা। বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যায় ‘আজিমপুরে শিশু গৃহকর্মীকে অমানুষিক নির্যাতন’, ‘থানায় নায়িকা নিশির সামনে কিশোরী নূপুর নির্যাতনের মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিল’, ‘এ কেমন নৃশংসতা’, ‘রংপুরে পিতার কোলে ৩ বছরের শিশুর আদালতে হাজিরা’ এবং নির্যাতনের অনেক ঘটনার মীমাংসা হয় টাকার বিনিময়ে’ শীর্ষক খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে শিশুকর্মীদের দুঃসহ যন্ত্রণা ফুটে ওঠে। পাশাপাশি আমাদের সমাজে শিশুদের মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে অনেকেই অবদান রাখছেন। অনেক ক্ষেত্রে অবহেলিত এ শিশুরা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা পেয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা কেউ বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করে দেশ ও সমাজে অবদান রাখছেন।
এই সমাজেও দেখা যায় রাকিবুল ইসলামের মতো ৮-১০ বছরের শিশুকর্মী কিভাবে মানুষ হচ্ছে। মগবাজার ওয়ারলেস রেলগেটের কম্পিউটার ও প্রিন্টারস ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের হেফাজতে থাকা রাকিবুল ইসলামকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আসসালামু আলাইকুম বলে সালাম দিল। আবুল কালাম আজাদের হেফাজতে থাকা ভদ্র ও মার্জিত রাকিব কম্পিউটারের কাজ শেষে বিকেলে লেখাপড়া করে একটি স্কুলে। অদম্য ও দৃঢ়চেতা রাকিবের একটিই কথা, লেখাপড়া করার জন্যই সুদূর বরিশাল থেকে ঢাকা আসা। পাশাপাশি সে সঙ্গীত ও অভিনয় চর্চাও করে। বর্তমানে সে ভালো পরিবেশে বিচরণ করছে। একদিন হয়তো দেখা যাবে মানুষের মতো আদর্শ মানুষ হয়ে দেশ ও সমাজে অনন্য অবদান রাখবে।
দেশে বিশ্বশিশু দিবস এবং জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়ে থাকে প্রতি বছর। এসব দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে ‘সুযোগ চাই বাধ্য নয়, করব আমি বিশ্বজয়’। বাংলাদেশে ১৯৯২ সাল থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ৫ অক্টবর শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপন করা হয়। শিশুদের মানসগঠনে এবং সত্যিকার শিক্ষা প্রদান করতে পারলে একটি আদর্শ ও কল্যাণরাষ্ট্র কায়েম সম্ভব।
মনে রাখা প্রয়োজন যে বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে কোটি কোটি শিশুর ভালো ফসল আমরা তখনই পাবো যখন তাদেরকে গোড়া থেকে আদর্শভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করতে পারব।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ