শহুরে জীবন সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা

শহুরে জীবন সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা

প্রতিবেদন জুন ২০১৫

আব্দুল হাদী আল-হেলালী# শহুরে জীবন ভাবতেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আলো ঝলমলে অবারিত সুযোগসুবিধা সজ্জিত অপেক্ষাকৃত একটি উন্নত জীবন। আজকের দিনে মনে করা হয়, সমৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার উত্তম উপায় হলো শহরে বসবাস। যে স্বপ্নের হাতছানি একটি দরিদ্র পরিবারকে গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে অভিবাসনে প্রলুব্ধ করে বাস্তবতার রূঢ় আঘাতে তা পরিহাসের চিত্র হয়ে যায়। কল্পনা আর বাস্তবতার মাঝে ব্যবধান অনেক। এ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় যে পরিবার শহুরে জীবনে সম্পৃক্ত হয়, তাদের শিশুদের শুধু বেঁচে থাকার জন্যই এক নিরন্তর লড়াই করে যেতে হয়। তারা না গ্রামে থাকে, না শহরে থাকে। তারা থাকে নোংরা, ঘিঞ্জি পরিবেশে শহরের কোন এক প্রান্তে, যেখানে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বসবাস, অথচ গড়ে ওঠেনি অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধা বা সেবা। এরাই হচ্ছে শহর ও গ্রামের মধ্যকার ধূসর মানচিত্রে অবস্থিত বস্তি ও শহরতলির পিছিয়ে পড়া সুবিধা ও সেবাবঞ্চিত অগণিত শিশু আমাদের আগামী প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
১০০ কোটিরও বেশি শিশুসহ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এখন নগর ও শহরে বাস করে। অনেকেই শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন সুবিধার সুযোগসহ শহুরে জীবনের সুবিধাগুলো ভোগ করছে। তারপরও অসংখ্য শিশু বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসেবার মতো অত্যন্ত জরুরি কিছু সেবা থেকে বঞ্চিত, অথচ তারা সেসব সেবার খুব কাছাকাছিই অবস্থান করে। যখন তাদের লেখাপড়ার জন্য শিক্ষালয়ে যাওয়ার কথা, তখন তারা নিয়োজিত আছে শোষণমূলক, ঝুঁকিপূর্ণ বিপজ্জনক কাজে। এ ছাড়া তাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে আছে রোগ, ব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সরকারি ও বেসরকারি উচ্ছেদের হুমকি।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সহ¯্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। শহরবিষয়ক লক্ষ্যগুলোর একটি হলো ২০২০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার কমপক্ষে ১০ কোটি বস্তিবাসীর জীবনমানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন। এটি অবশ্য বস্তিবিহীন শহর বা Cities without Slums উদ্যোগ নামেও পরিচিত। এর সাথে রয়েছে নিরাপদ পানি ও মৌলিক পয়ঃনিষ্কাশনের টেকসই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা ২০১৫ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার।
শহর জীবনের যে রঙিন স্বপ্ন গ্রামের শিশুদের হাতছানি দিয়ে ডাকে তার পেছনে বাস্তবতার চেয়ে কাল্পনিক প্রাপ্তির আশাই শহরমুখিতার কারণ। কিন্তু অভিবাসনের পরপরই অর্থনৈতিক সঙ্কট, দুর্যোগ, রোগব্যাধি, উচ্ছেদ ও সহিংসতার মূলে স্বপ্নের পরিবর্তে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তারা। সামাজিক স্তর, শ্রেণী বা বর্ণ সৃষ্টিতে শিশুরা কোন ভূমিকা রাখে না। বেশির ভাগ শিশু অভিবাসন প্রক্রিয়ায় তাদের পরিবার বাবা-মা কিংবা অভিভাবকদের সঙ্গে কর্মসংস্থানে বেরিয়ে পড়ে, এলাকা ছেড়ে দেশের ভেতর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। এই এলাকা ত্যাগের কারণ হচ্ছে কর্মসংস্থান এবং আরো সুন্দরভাবে জীবনযাপন ও শিক্ষার সুযোগ পাওয়া এবং নিতান্তই দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাক্সক্ষা। অনেক শিশুই সংঘাত বা দুর্যোগ, ক্ষুধা থেকে মুক্তি পেতে অভিবাসী হয়। এ ছাড়া পারিবারিক ঘটনাপ্রবাহ যেমন পিতামাতার মৃত্যু বা বাড়িতে অস্থিতিশীল ও কঠিন পরিস্থিতিও তাদের অভিবাসী হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। বাধ্য হয়ে বা স্বেচ্ছায়, যে কারণেই হোক না কেন, এসব অভিবাসী শিশু ঝুঁকির শিকার হয়, আর এ সমস্ত ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা অত্যন্ত কঠিন বিধায় এ ক্ষেত্রে আমাদের সকলের তথা রাষ্ট্রের সহযোগিতা মানবিক দায়িত্বও বটে।
অভিভাবকহীন শিশু একাকী অভিবাসী হলে তারা বিশেষভাবে প্রতারণা, নিপীড়ন ও পাচারের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। উদ্বাস্তু শিশুরা একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া যে সমস্ত শিশু উচ্চতর পড়াশোনার আশা নিয়ে শহরে আসে তাদের জন্য সে আশা পূরণ যখন দুঃসাধ্য হয়ে যায়, তখন তাদের কাজ করতে হয় এবং কর্মস্থল থেকে পড়ার অনুমতি পাওয়া যায় না। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট, ব্যাপক বেকারত্ব, কাজের পরিবেশের অবনতি, খাদ্য ও জ্বালানি সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধি, প্রকৃত আয় হ্রাস ইত্যাদি কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর্মসংস্থানের অভাব ও বেকারত্ব ১৫-২৪ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে বেশি। অধিকাংশ তরুণই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয় না বলে তাদের পরিসংখ্যানগত ত্রুটি রয়েছে। একটি নিম্নমুখী অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তরুণরাই বেশি হতাশাগ্রস্ত হয় এবং তাদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এ ক্ষোভ থেকে সৃষ্টি হয় অপরাধ করার প্রতি আগ্রহ, যা কাজে লাগায় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল। অপরাধ ও সহিংসতা শহর এলাকায় লাখ লাখ শিশুর জীবনে সহিংস পরিবেশের এমন অভিজ্ঞতা দেয়, যা পরবর্তীতে মানুষ ও সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতি তাদের বিশ্বাসকে ভেঙে দেয় এবং তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করে। শিশুদের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়, ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যাও বেড়ে যায়। শিশু মনে সৃষ্টি হয় ভীতি, হতাশা, আক্রমণাত্মক প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব। তারা হারিয়ে ফেলে আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।hade1
শহরে শিশুদের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর একটি চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্য পীড়িত শিশুদের অসহায়ত্ব ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস ও ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ের কারণে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ও জনসংখ্যার অতি ঘনত্ব শহরগুলোকে বিপজ্জনক করে তুলছে। এখানে নেই দুর্যোগ মোকাবেলার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও উপকরণ। কাজেই দুর্যোগ যখন নেমে আসে হতাহত হওয়ার ক্ষেত্রে শিশুরাই থাকছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব শিশুর বাস করতে হয় ভূমিধস এলাকা, বর্জ্য ফেলার নিকটবর্তী জায়গা, নদীর পাড়, পুরনো অট্টালিকার মত সবচেয়ে নাজুক জমি বা এলাকায়। ভগ্ন স্বাস্থ্য ও দৃষ্টিহীন এসব শিশু পরিবেশগত বিপর্যয়ে আরো দুর্গত অবস্থার শিকার হয়।
নগরজীবনে শিশুদের নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে। সহিংসতা প্রতিরোধে সমাজের সকল স্তরকে সম্পৃক্ত করে, শিশু, পরিবার বিদ্যালয় ও অন্যান্য সংস্থা ও স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে সরকারকে কার্যকর ও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সুসমন্বিত করতে হবে, সামর্থ্য বাড়াতে হবে। শিশুদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুদের কথা মাথায় রেখে শহরের নকশা প্রণয়ন করতে হবে। শিশুদের ওপর প্রভাব রাখে এমন দারিদ্র্য, অসমতা ও বিচ্ছিন্নতা কার্যকরভাবে দূর করতে হবে। কিভাবে দারিদ্র্য ও বিচ্ছিন্নতা শহুরে পরিবেশে শিশুদের জীবনকে প্রভাবিত করে, বঞ্চনা সৃষ্টি করে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মে তা বহাল থাকে, তা অনুধাবন করতে হবে। একটি বৈষম্যহীন নগরের পথে বিশ্বের জনসংখ্যার এ বিরাট অংশ শিশুদের কখনই অবহেলা করা যাবে না। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ (CRC) এ বৈষম্যহীন, বেঁচে থাকা, উন্নয়ন, অংশগ্রহণ ইত্যাদি নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই শিশুদের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তাদের সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তাই নগর পরিকল্পনা শিশুবান্ধব, বৈষম্যহীন ও সুরক্ষামূলক হিসেবে প্রণীত হওয়া উচিত। আর তা হলেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম টিকে থাকবে সুন্দর পরিবেশে নগরজীবনের সব রকম কঠিন আর রূঢ় চ্যালেঞ্জগুলোকে জয় করে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ