শরৎ এলো কাশবনে

শরৎ এলো কাশবনে

বিশেষ রচনা আলম শামস সেপ্টেম্বর ২০২৩

ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ভাদ্র ও আশ্বিন এ দু’মাস মিলে শরৎকাল। শরৎকে ইংরেজিতে ‘অটাম’ বলা হয়। পৃথিবীর চারটি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎকাল। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে শরৎকালের আগমন হয়। এ সময় রাত তাড়াতাড়ি আসে এবং আবহাওয়া ঠান্ডা হতে থাকে। শরতে হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ, বকফুল, মিনজিরি, শেফালি, শিউলি, কাশফুলসহ ইত্যাদি ফুল ফুটতে দেখা যায়।

কদম ফুলের বর্ষা শেষ হতে না হতেই শুরু হয় কাশফুলের মেলা। বর্ষার পরেই আসে শরতের কাশবনের সৌন্দর্য। বর্ষার পর পরই যেন লুকিয়ে আসে শরৎ। মানুষ কতই না মুগ্ধ হয় নীল আকাশের মাঝে কখনো কালো মেঘে আবার কখনো সাদা মেঘের আবরণে লুকিয়ে হাসা সোনালি সূর্য আর তারই সঙ্গে বাতাসে শুভ্র সাদা কাশফুলের দোলানো দেখে। বাতাস এলে ফুলগুলো একসাথে দোল খায়। সে দৃশ্য কতই না মনোরম!

খাল-বিল কিংবা নদীর পাড়, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে। এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। তাই নদীর তীরেই কাশফুল বেশি দেখা যায়। কোথাও কোথাও কাশফুল ফুটে বাগানের সৃষ্টি করে।

কাশফুলের নামটি যেমন দারুণ তেমনি লিকলিকে শরীরের গাছটি দেখতেও খুব সুন্দর। মানুষ মনে করে শরৎকাল মানেই কাশফুলের দিন। কাশফুল শরৎকালের অন্যতম রূপ-সৌন্দর্য বর্ধনকারী একটি ফুল। কাশফুলের ঘ্রাণ নেই বটে কিন্তু আছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। শরতের আকাশ থাকে সাদা মেঘে ভরা আর নদীর দু’ধার কাশফুলে ভরা। কাশফুল ছিঁড়ে বাতাসে ছেড়ে দিলে পেঁজা তুলোগুলো উড়ে উড়ে যেন মেঘের তুলোর সাথে মিশে যাবে।

কাশফুল নিয়ে কতই না লেখালিখি করছেন। ছড়া লিখছেন, কবিতা লিখছেন, লিখছেন ছোটগল্প, শরৎ নিয়ে প্রচ্ছদ রচনাও লিখছেন অল্প। শরতের দিনে লেখকদের লেখার মূল বিষয়ই যেন হয়ে ওঠে কাশফুল। শরৎ এর সৌন্দর্য দেখে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় লিখেছেন, ‘কাশফুল মনে সাদা শিহরণ জাগায়, মন বলে কত সুন্দর প্রকৃতি, স্রষ্টার কি অপার সৃষ্টি।’ জীবনানন্দ দাশ শরৎ বন্দনায় লিখেছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ এমন শত শত উক্তি রয়েছে কাশফুল নিয়ে।

শরৎকালে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষরা ছুটে বেড়ায় কাশবাগানে। কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার মাঝে তোলে অজস্র ছবি। শুধু প্রকৃতিপ্রেমী নয় এ সময়ে সবাই কম বেশি কাশবনে ঘুরাঘুরি করে। কাশবাগান তখন লোকে লোকারণ্য থাকে। অনেকেই কাশবনে আসে পায়ে হেঁটেই, কেউবা সাইকেল বা মোটরসাইকেল, আরো আসে প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাসে করে। কেউবা সপরিবারে ঘুরতে আসেন আবার কেউ প্রিয়জনের সঙ্গে এসেছেন সোনালি শরতের মিষ্টি গন্ধের স্বাদ নিতে। ছোটো ছেলেমেয়েরা কাশফুল নিয়ে খেলা করে। কাশফুল মানেই শরতের দিন আর শরতের দিন মানেই কাশফুল।

বর্ষার শেষে বৃষ্টির সমাপ্তি ঘটলে বাংলার নিসর্গ নতুনভাবে সজ্জিত হয়। নীল আকাশে উড়ে বেড়ায় শুভ্রমেঘ, মেঘ-রোদের লুকোচুরি খেলায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে ঝলমলে, বাতাস হয়ে ওঠে অমলিন।

আকাশ এ সময়ে গাঢ় নীল রঙের হয়ে থাকে। আকাশের ওই ঝলমলে নীল রঙের আভার কিনারা ছুঁয়ে ফুলের মালার মতো দলবেঁধে উড়ে যায় নানা জাতের পাখি। নিসর্গের বুকে শরৎ নিয়ে আসে অন্যরকম এক শোভা। এসময় বিভাবসুর কিরণে হরিৎ বর্ণের ধানক্ষেত হয়ে ওঠে চিরসুখময় স্থান। মৃত্তিকা ও সবুজ ধানগাছের ডগায় রৌদ্র-ছায়ার খেলা আমাদের মনকে মোহিত করে।

মোদ্দা কথা, এ ঋতুর অনন্য রূপ মানুষ-জাতিকে সব সময় মুগ্ধ করেছে। এ সময়ে গাছগাছড়া, বন বাগান হয়ে ওঠে সজীব সতেজ।‌ চারপাশের পরিবেশ হয়ে ওঠে প্রাণপূর্ণ ও মনোহরা। ধানক্ষেত হয়ে ওঠে সবুজ প্রান্তর। নদীর ধারে, বিলের কিংবা খালের পাড়ে শরতের মৃদু বাতাসে দুলতে থাকে সাদা সাদা কাশফুল।

শিউলি ও বকুল গাছের নিচে শিশিরভেজা দূর্বাঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছানো থাকে সুগন্ধিযুক্ত অসংখ্য শিউলি-বকুল ফুল। এসময়ে পুকুর-ঝিলে পদ্মফুল ফোটে, হাওর-বিলে ফোটে নানা রঙের শাপলা। ফল হিসেবে হাটবাজারে দেখা মিলে আম, আনারস, পেয়ারা, মাল্টা, আমলকী, জলপাই, জগডুমুর, তাল, অরবরই, করমচা, চালতা, ডেউয়া ইত্যাদি। এসব ফুলফলের সুঘ্রাণে বাংলার মানুষ এসময় আনন্দের জোয়ারে ভাসে।

শরতের উপস্থিতিতে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল, চড়ুই ও ময়নার মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। এক কথায় প্রকৃতি সাজে অপূর্ব সাজে।

শরতে বিভিন্ন অঞ্চলে শরৎ উৎসব বা শরৎ মেলা হতে দেখা যায়। উল্লাসে মুখরিত হয়ে উৎসবে মাতোয়ারা হয় দু’দেশের বাঙালিরা। স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এ সময় অনেক আনন্দ করে থাকে। উৎসবের ঋতু শরৎকালে শরতের নানা উৎসব এসময় মানুষের মনকে আনন্দে ভরিয়ে রাখে।

আকাশে ভেসে বেড়ানো শুভ্রমেঘ, নদীতীরে কিংবা খালপাড়ে মৃদুমন্দ বাতাসে দুলে ওঠা শুভ্র কাশফুল, ভোরে হেসে ওঠা শিশিরভেজা শিউলি-বকুল ফুলের উপস্থিতি সব মিলিয়ে শরৎ যেন শুদ্ধতার ঋতু। শরতের রাতে মেঘহীন আকাশে জোছনার সৌন্দর্য খুব মনোহর।

শরৎকালে জোছনার এই মনছোঁয়া সৌন্দর্য আপন নয়নে না দেখলে বোঝা যায় না। তবে এটা সত্য যে, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বহুকাল আগে থেকেই এসময় মানবদেহে বেশ কয়েকটি রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। তার মধ্যে আমাশয়, সর্দি-জ্বর উল্লেখ করার মতো। তবু শরতের ভেতর আনন্দময় একটা ঘ্রাণ আছে যা অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না।

উৎসবের ঋতু শরৎ, নৈসর্গিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ঋতু শরৎ, বাংলার তৃতীয় ঋতু।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ