রূপের রানি হেমন্ত
প্রবন্ধ নিবন্ধ শাহীন সুলতানা অক্টোবর ২০২৩
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধানে লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায়ে বায়ু
কলমি লতার দোলন লেগেছে ফুরাল ফুলের আয়ু।’
পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘সুখের বাসর’ কবিতায় কবি এভাবেই ‘হেমন্ত ঋতুর’ অবিনাশী চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন- যা আমাদের মনে এক অভাবনীয় ঐশ্বর্যের দোলা দিয়ে যায়।
ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে বারো মাসে ছয় ঋতু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দু’মাস মিলে হেমন্তকাল। হেমন্ত লাবণ্যময়ী ঋতু, লাস্যময়ী ঋতু। এর রয়েছে অতুল মনোহারী রূপ। তাই এ ঋতুকে বলা হয় ঋতুকন্যা। হেমন্ত আবার কখনো ঋতুরানি।
শরতের শেষ ভাগে হালকা কুয়াশার শাড়ি মাথায় দিয়ে লাজুকলতার মতো আগমন করে মোহনীয় হেমন্ত। এ সময় হিম হিম বাতাসে শরীর ও মনে মাদকতা অনুভূত হয়। দিন ছোটো হয়ে আসে। সূর্য দ্রুত হেলে পড়ে পশ্চিম দিগন্তে। রোদ দেখতে দেখতে পালিয়ে যায় দূর পাহাড়ের দেশে। সন্ধ্যা নামে হিমেল ঠান্ডায়, শান্ত ভঙ্গিতে।
হেমন্তের মোহনীয় রূপে মুগ্ধ হয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন-
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে-এই বাংলায়
... ... ... ...
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
আবার ‘পেঁচা’ কবিতায় তিনি লিখলেন-
প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশপাতা- মরাঘাস-আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!
সত্যি! হেমন্তের রূপ মনোলোভা। কুয়াশা-মাখানো সকাল, ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশিরের ফোঁটা, মিষ্টি রোদ, ঘুঘু ডাকা বিকেল, পাতার ফাঁকে পাখির কিচির-মিচির, দিন জুড়ে মাতাল বাতাস, চারিদিকে রঙের আভা, মাথার মাঠে মাঠে আমন ধান পাকে। পাকা ধানের সোনালি রূপ দেখে কৃষকের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে পরিতৃপ্তির হাসি। কৃষাণীর মনে আনন্দ ধরে না। হেমন্তে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে। সারাদিন চলে ঢেঁকিতে ধান ভানার ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ। গ্রামজুড়ে চলে নবান্নের উৎসব। মেয়েরা রাত জেগে পিঠা তৈরি করে। ক্ষীর, চালের পায়েস আর নানানরকম পিঠা-পুলির মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা হয় প্রকৃতি।
এ সময় গ্রামে-গঞ্জে মেলা বসে। সে মেলায় পাওয়া যায়- বাহারি চুলের ফিতা, রেশমি চুড়ি, কানের দুল, গলার মালা, টিপ ও নানারকম সাজগোজের জিনিসপত্র। ছোটো ছেলে-মেয়েদের খেলনা, মেয়েদের সাংসারিক জিনিস, বাঁশের বাঁশি, ঢোল, একতারা-দোতারা, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, খই- চিঁড়া-মুড়ি-নাড়ু, বাতাসা, জিলাপি, রসগোল্লা আরো কতো কি!
এছাড়া মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। লোকগীতি, বাউলগান, পালাগানের আসর বসে। দেশীয় নৃত্যে অংশগ্রহণ করে পাড়ার ছেলেমেয়েরা। ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলাও বাদ যায় না সে আয়োজন থেকে। ছেলে বুড়ো সবার মনে বিরাজ করে এক অন্তহীন উদ্দীপনা, প্রাণচাঞ্চল্য। আকাশে-বাতাসে ভাসে আনন্দের ফোয়ারা। মানব মনকে প্রফুল্ল রাখতে হেমন্তের জুড়ি মেলা ভার।
হেমন্ত মানে পাতাঝরার ঋতু; শীতের আগমনি বার্তা। একদিকে পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি অপরদিকে বিষাদগ্রস্ততা এ ঋতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। হেমন্তের শুরুর দিকে অভাব কড়া নাড়ে দরজায়। অনেক কৃষক মহাজনের কাছ থেকে ধারে টাকা নিয়ে ফসল উৎপাদন করে। ঘাড়ে থাকে ঋণের বোঝা। বর্ষার শেষভাগে যে আমন-আউশ ধান বোনা হয়, কার্তিকে সেই ধানের গায়ে রঙ আসে। তখন কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক খেলে যায়। কাঁচা-পাকা ধানের মাতাল ঘ্রাণে বাতাস দোল খায়।
কৃষক ধান কেটে গোলা ভর্তি করে। ফসল বিক্রি করে মহাজনের টাকা শোধ করে। হেমন্তকে ধান উৎপাদনের ঋতুও বলা হয়।
বলা হয়ে থাকে: সোনার আর এক নাম ‘হেম’। হেমন্ত ঋতুতে প্রকৃতি সোনালি রঙ ধারণ করে মানব অন্তরে ‘অপরূপা’ হিসেবে ধরা দেয় দেয়-- সেজন্য এ সময়কে হেমন্তকাল বলে। হেমন্তের আলোকোজ্জ্বল উপস্থিতি মানব মনকে আলোড়িত করে, উচ্ছ্বসিত করে।
মূলত শান্ত-স্নিগ্ধ-রূপবতী ঋতু হেমন্ত। এ সময় প্রকৃতি জুড়ে নানারকম ফুল ফোটে। সেসব ফুলে থাকে বৈচিত্র্যময় রঙ। বকফুল, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজ অশোক, কাঁঠালচাঁপা দৃষ্টিকে তাক লাগিয়ে দেয়। গন্ধরাজ, মল্লিকা, দোলনচাঁপা, কামিনী ও শিউলির মনমাতানো সৌরভ মনে করিয়ে দেয় হেমন্ত এসে গেছে। গাছের হলুদ পাতা টুপটুপ করে খসে পড়ে ঘাসের চাদরে, পথের উপরে, উঠোনে, বাগানে। মাঠের দু’ধারে বিচিত্র সব জংলি ফুল মাথা উঁচু করে হাসে। সবুজ ডাব, চালতা ও হলদে কামরাঙা মুখ বের করে হাসতে থাকে পাতার ফাঁকে।
ঋতুকন্যা হেমন্ত মূলত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। হেমন্ত মানেই সমৃদ্ধির ঋতু, সম্ভাবনার ঋতু, আশা পূরণের ঋতু। সবুজ-সোনালি প্রকৃতি, ফসল ভরা মাঠ, ভরপুর স্নিগ্ধতা এ ঋতুকে ঋতুরানির মর্যাদা দিয়েছে।
ওপরে বিস্তীর্ণ নীলাকাশ, রাতের আকাশে চাঁদের আলো, মধ্যরাতে পাতা বেয়ে নেমে আসা শিশিরের টুপটাপ শব্দ, ঘরে ঘরে নবান্নের আমেজ হেমন্ত কে করে তোলে অদ্বিতীয়া।
রঙে-রূপে-গন্ধে হেমন্ত অনন্য-অপরাজিতা। তাইতো কালে কালে কবি সাহিত্যিক হেমন্তের মোহনীয় রূপে মুগ্ধ হয়ে করেছেন রূপ বন্দনা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় সমৃদ্ধ হেমন্তের উদারতাকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর হেমন্ত বন্দনা আমাদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে:
ধরার আঁচল ভরিয়ে দিলে প্রচুর সোনার ধানে
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।
আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে,
আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় এঁকে দিয়েছেন হেমন্তের এক শাশ্বত রূপ। তিনি লিখলেন-
ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাত।
‘গিন্নি-পাগল’ চালের ফিরনি,
তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত
শিরনি রাঁধেন বড়ো বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।
কবি সুফিয়া কামালের চিরসবুজ কবিতা ‘হেমন্ত’। এখানে কবি লিখলেন-
সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে
কোন পাথারের ওপার থেকে /আনল ডেকে হেমন্তকে?
যুগে যুগে হেমন্ত নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবি-লেখক-সাহিত্যিক। হেমন্ত নিয়ে লেখেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কবি ফররুখ আহমদ হেমন্ত নিয়ে লিখলেন:
হিম হিম শির হেমন্ত মাঠ/ কাঠুরিয়া যায় কেটে কাঠ
রাত্রিশেষে ঝলমলে দিন/ বেড়ায় মাঠে সোনার হরিণ।
‘এই নবান্নে’ কবিতায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখলেন-
এই হেমন্তে কাটা হবে ধান
আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান।
ধানে-গানে, ফুলে-ফসলে এক মনোহারী ঋতু হেমন্ত। মাঠে মাঠে ফসলের সমারোহ। এ সময় কপি, মুলা, টমেটো, পালংশাক, আলু প্রভৃতি রকমারি সবজিতে হেসে ওঠে প্রান্তর। সতেজ ফসলের ও প্রকৃতির রূপ দেখে জুড়িয়ে যায় হৃদয় মন।
আরও পড়ুন...