রূপমের স্কুল

রূপমের স্কুল

উপন্যাস জানুয়ারি ২০১৩

আফজাল আনসারী..

রূপম আমার নাম। ছেলেটা খুবই অমায়িক। সবসময় ক্লাসের মধ্যে নিরিবিলি বসে থাকি। লেখাপড়া তেমন পারি না। বসি পেছনের বেঞ্চে। সেই অংশে সারাক্ষণ গণ্ডগোল, স্যার কী বলেন তা বোঝাও যায় না। বড় ক্লাসের মধ্যে সামনের অংশের ছাত্ররা স্যারের প্রশ্নের জবাব দেয়। আমরা না শুনলেও শুনছি শুনছি ভাব দেখাই। পড়ালেখা জীবনে বোরিং লাগে। এর মধ্যে দু’দিন স্কুল কামাই করেছি। তৃতীয় দিন স্যার স্কুলে গেলে নিশ্চয়ই পেটাবেন। আমার বড় বোন উপর ক্লাসে পড়ে। সে হিসাবে সবাই চেনে এটা ঝিনুকের ভাই। ঝিনুক আপা আমাকে অনেক করে অঙ্ক বোঝায়। ক্লাস টুতে পড়ি, আমার অঙ্কের ব্রেইন একেবারেই ভালো না। তারকা চিহ্ন শূন্যস্থান পূরণ শেখানোর জন্য বড় আপা যে শ্রম দিলেন, এর পরও মনে হলো আমার মধ্যে অঙ্ক ঢুকবে না। বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেল। ফলাফল বিপর্যয়। আমাকে জোর করে থ্রিতে উঠাবে। আমি কিছুতেই থ্রিতে যেতে নারাজ। বড় আপা জোর করে আমাকে ওখানে বসিয়ে দিলেন। ধুত্তরি ছাই! আমি আমার ক্লাস টুতেই বসে গেলাম। এর মধ্যে নতুন হেডস্যার এলেন। আমাকে নিয়েই স্যারের এই স্কুলে প্রথম সমস্যা। আদরে ধমকে নানা কৌশলে আমাকে বুঝানো হলো। আমি অনড়। ক্লাস টুতেই থাকব। স্যার আমাকে একটা চড় মারলেন। চড়টা ছোট গালে বেশ মনে হল। দু’দিন স্কুলেই গেলাম না। কিন্তু বাড়িতেও থাকতে পারি না। স্কুলের বেলা হলে সবার তাড়া, মায়ের বকুনি, বোনের তদারক আর নানার খোঁজখবর। সর্বোপরি মামা যদি জানেন আমি স্কুলে যাইনি তাহলে আস্ত পানি দিয়েই গিলে ফেলবে। স্কুলেও সমস্যা। প্রতিদিন স্কুলের নাম করে বের হই। কিন্তু স্কুলের কাছে গিয়ে সটকে পড়ি। এখানে আমাদের দূর সম্পর্কের এক নানীর বাড়ি। বড় বড় ভেন্নাগাছ। এ ভেন্নাগাছের তলেই দিন কাটে। ভেন্না খুটে ব্যাগ বোঝাই করি। আমার সেই নানীর একটু বর্ণনা দেয়া আবশ্যক। ভেন্নাগাছ যেমন লম্বা, আমার সেই নানীও ভেন্নাগাছের মত লম্বা। কিন্তু নানা অত লম্বা না। অনেক খাটো। বলা যায় লিলিপুট। নানার নাম হায়াত প্রামাণিক। সবাই হায়াত বলে, কেউ হায়তা বলেও ডাকে। নানার আবার একটা রোগ আছে। হাঁটার সময় কোমর সোজা করে হাঁটতে পারেন না। কোমর কেমন বাঁকা হয়ে যায়। নানার সব ছেলেমেয়ের মধ্যেও ঐ একই রোগ। সবারই কোমর বাঁকা রোগ। কিন্তু সবাই কর্মঠ, আবার অসম্ভব ধার্মিক। নানীর ঘরের সাথে বিদ্যালয় অথচ নানীর ছেলেমেয়ে কী অসম্ভব ধরনের নিরক্ষর। লেখাপড়ায় কেউ না। স্কুলের মধ্যেও কেউ ঢুকে না। নানী বললেন, কিরে রূপম, স্কুলে যাবি না? না, নানি। কেন যাবি না রূপম? স্যারে মারে। স্যার মারে ক্যান? উপরের কেলাসে উঠাবে তাই। তোর সমস্যা কী? আমি ক্লাস টুতেই পারি না, থ্রিতে উঠব কেন? নানীও আমার কথায় সায় দিলেন। মূর্খ মানুষ হলেও এই একটা জ্ঞান ভালো। শিশুর মন না চাইলে তাকে চাপাচাপি করে লাভ নেই। তাতে মনের উপর আঘাত আসে। একটা ব্যাপার আগে বলা হয়নি। এই নানীর একটা ছেলে মনে হয় একটু পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু হাঁটার সময় মাজা কাৎ না হলেও কেমন চিৎ হয়ে পড়ে যেতে চায়। আমরা সেই সোজা মেরুদণ্ডীকে নাজিম মামা বলে ডাকি। আরো একটা ব্যাপার হল নাজিম মামার একটা বোন সেই মাজা বাঁকা রোগ। তার লাঠি ভর ছাড়া দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। নাজিমের এক বোনের বিবাহ হল আমাদের ঘরের সাথে। নাজিমের বোন অবশ্য সোজা মেরুদণ্ডী হাঁটা হাঁটে। তবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চিৎ হয়ে পড়ে যাওয়ার মত হয়। রোগ বালাই বংশ থেকে বংশে বয়ে চলে। গুরুজন সে কথা বললেও আমরা অত বিশ্বাস করার পক্ষপাতী নই। মনে করেছি নাজিমদের সেই রোগ হয়তো সেই এলাকাতে রেখে এসেছে। নাজিমের বোনের একটা বাচ্চা হল। কিন্তু কিছু দিন পর আস্তে আস্তে নাজিমের বাবার রোগ ওর মধ্যে প্রকাশ হতে লাগল। নাম রাখা হল আনার। আমার বন্ধু। আনারের এমন অবস্থা আমরা মানতে পারি না। আস্তে আস্তে মাজা কোমর বাঁকা হতে লাগল। হাঁটতে গেলে সেই সমস্যা। পায়ের কিছু অংশ বাঁকা হতে লাগল। ছোটরা সবাই আনারকে চিকিৎসা দেয়া শুরু করলাম। আমরা জনা দশেক মিলে ওর গলা পর্যন্ত মাটিতে গর্ত করে পুঁতে রাখি, যাতে ওর পা সোজা হয়ে যায়। পায়খানা প্রস্রাবের যাবতীয় কাজ সেরে তাকে সকাল সকাল মাটিতে গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলি। আমরা চার পাশে বসে। আনার আমাদের দিকে মিটি মিটি তাকিয়ে থাকে। দূর থেকে আনারের মায়েরা খেয়াল করে। আনার কেমন লাগে? ভালোই আরাম। পায়ের অবস্থা কেমন বল। সেটা তো নড়ানো যাচ্ছে না। তাতো আমরাও জানি নড়ানো যাবে না। সোজা হবে তো? মনে হয় হবে। শক্তি পাচ্ছি। আনার শক্তি পাচ্ছে সে কথা শুনে আমাদের মনোবল চাঙ্গা হয়। সারাদিন গর্তের মধ্যে পুঁতে দুপুরের পরপর তুলে ফেলি। কিন্তু আবার সেই মাজা কোমর বাঁকানো হাঁটা। পায়ের সেই রগ টান পড়াÑ সোজা করতে পারি না। মনের মধ্যে অনেক ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে আমরা যার যার বাসায় ফিরি। আনার কেমন অসহায়ের হাসি দিয়ে আমাদের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে। স্কুলে যাওয়ার কথা বলে সেই লম্বু নানির ভেন্না বাগানে খেলা করে কাটাই। নিজের কাছেও খারাপ লাগে। অস্বাভাবিক একটা কাজ দিব্যি করে যাচ্ছি। আমার ব্রেনে অতটা খেয়াল করেনি। স্কুল ছুটি হলেই ছেলেপেলের ভিড়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলি। এইতো স্কুল থেকে এলাম। কিন্তু আমি তো সারাদিন ভেন্না খুঁটে সময় কাটিয়েছি! পথের মধ্যে কথা বলল সুচতুর আব্বাস, কী রে রূপম, তোকে তো ক্লাসে দেখলাম না। তুই ছিলি কোথায়? ক্লাসে যাসনি? বললাম, না যাইনি। হায়তার ভেন্না তলায় ছিলাম। স্যার তোকে খুঁজল। কী বললি? কিছ্ইু বলতে পারিনি। কারণ জানি না তুই কোথায়। আর কী বলল? বলল, আগামীকাল নিয়ে যেতে। স্যার আমার গালে একটা চড় মেরেছিলেন। সেটা আপাতত ভুলে গেছি। এদিকে আব্বাসের জিজ্ঞাসা। আবার সবাই যদি ধরে ফেলে। অনেকগুলো চিন্তা মাথার মধ্যে কিলবিল করছে। পরদিনও আমি নানীর ভেন্না তলায় মেতে রইলাম। স্কুল ছুটি হলো। হঠাৎ করে হেডস্যার আমাকে দেখেই চিনলেন এবং আস্তে করে ডাকলেন। অনেক মোলায়েম সেই ডাক। আমার নরম গালে আদর করে বললেন, ঠিক আছে তুমি ক্লাস টুতেই বসো। কালকে চলে এসো কেমন। সত্যিই সেদিন কত আনন্দ নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে এলাম তা কাউকেও বোঝাতে পারবো না। সারা কিশোরকালে যত না আনন্দ পেয়েছি স্যারের সেদিনের স্বীকৃতি এবং আমার আদরমাখা ক্ষমা আমাকে মুগ্ধ করেছে তার ব্যাখ্যা করার সাধ্য কই। আমাদের বিদ্যালয়ের অঙ্ক স্যারের নাম নুরুল ইসলাম। ডাকনাম তাহাজ্জত। সবাই তাহাজ্জত স্যার বলেই ডাকেন। স্যার বড়ই ভয়ঙ্কর। তার চোখটা অদ্ভুত রকম চক চক করে। অনেকটা সাপের চোখের মত লাগে। এই বিশেষ চোখের দিকে আমরা তাকাতে পারি না। মনে হয় আমাদের ভিতর থেকে রক্ত চুষে নিয়ে যাচ্ছে। স্যার তাকালেই আমাদের বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয়। সারা কিশোরকালে শিক্ষক দেখে ভীতির কথা মনে হলে তাহাজ্জত স্যারের কথা মনে হয়। আমাকে আদর করে সবচেয়ে সহজ অঙ্ক দিতেন। সবাইকে বইয়ের অঙ্ক করতে দিলেও আমাকে ভিন্ন খাতা নিয়ে ডাকতেন। সবচেয়ে সহজ ধরনের যোগ বিয়োগ করতে পারলেই মহা খুশি। স্যারের হাসিটা অদ্ভুত। সারা দেহেই হাসি। আমাদের মনে হতো স্যারের হাত, পা, পেট, চোখ-মুখ সবই হাসছে। ক্লাসে এসেই স্যার জিজ্ঞাসা করতেন, কি রূপম, সকালে কী খেয়েছ? ভাত খাইনি স্যার, মুড়ি খেয়ে এসেছি। ভাত না খেয়ে মুড়ি বা চাল ভাজা খাওয়ার কথা শুনলে অনেক দুঃখ পেতেন। হত দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা না খেয়েই বিদ্যালয়ে আসে। বাবা মায়ের চেয়ে স্যারেরও অনেক ব্যথার জন্ম হয়। এমন ঘটনার উল্লেখ স্যার প্রায় করতেন। স্যারও অতি দরিদ্র থেকেই লেখাপড়া করে এসেছেন। মনের মধ্যে সেই যাতনা সবসময়ই লালন করে চলেন। মানবতার উদ্রেক করেন। আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটি হত দরিদ্র ঘরের। সে কোনো দিনই ভাত খেয়ে আসতে পারে না। শুধু রাতের বেলা পেট পুরে খাওয়া, স্যার এমনভাবে বিষয়টা বলতেন, মায়ার উদ্রেক করত। বড় হয়ে দেখা গেল ভিন্ন। শহরে এসে দেখলাম অনেক বাচ্চাই না খেয়ে ক্লাস করছে। আমরাও ক্লাস করাই। একদিন একটা মেয়ে খুবই অসুস্থ। সবাই ধরাধরি করে অফিসে নিয়ে এলো। সেবা শুশ্রƒষা চলছে। পরে জানা গেলো সে নাস্তা খেয়েই আসেনি। শহরের কোনো শিক্ষক ছাত্রদের খাবার খবর নেয় কি না জানা নেই। অঙ্ক স্যারকে ভয় পাওয়ার কথা বলেছি। স্যার বাড়তি আয় করার জন্য একটু ডাক্তারিও করেন। শিক্ষক হিসাবে দিনের অনেক সময় পড়ে থাকে, সে সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য সেই ডাক্তারি। স্যারের গলায় একটা স্টেথস্কোপ ঝুলানো, সঙ্গে একটা ডাক্তারি ব্যাগ। স্যারের আলাদা একটা পরিচয় তাহাজ্জত ডাক্তার। গ্রামে লোকের মুখে মুখে তাহাজ্জত ডাক্তারই শুনি। স্যার ক্লাসে মন দিয়ে অঙ্ক করাচ্ছেন। আমার শরীর খারাপ। একটু একটু কাশ হচ্ছে, চোখ লাল। স্যার কাছে ডাকলেন। একটা কাশির বড়ি দিলেন। বেশ মিষ্টি, চকলেটের মত। আমার কাশি প্রায় সেরে গেল। বাহ! গলা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা শীতল লাগছে। তপু বলল, এই কেমনরে খেতে? বেশ মিষ্টি। তুই চুষে খেলি না গিলে? চুষে খেলাম চকলেটের মত। শেষের ঘণ্টা স্যার আবার পড়াতে এলেন। এবার তপু কাশতে শুরু করেছে। স্যার বললেন, কী হয়েছে তপু? কাশি স্যার। ঠাণ্ডা লেগেছে? জি স্যার। আবার সেই আসল কাশি দুই একবার এসে যাচ্ছে। স্যার আবার হাত ঢুকালেন সেই বিশেষ ব্যাগে। খয়েরি ট্যাবলেট। আমার জিভে পানি চলে এল। সেই ট্যাবলেটের লোভে আমরা আবার কাশ দিচ্ছি। স্যার সবার হাতেই ট্যাবলেট দিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। একটা ব্যাপার। অঙ্কের সময় স্যার যত মেজাজ গরম করেন, অন্য সব বিষয় পড়াতে ততই নরম। আর তখনি আমরা সুড় সুড় করে স্যারের কাছে আসি আর গলা খাঁকরাতে থাকি। ছোট বড় কাশি দিই। স্যার বলেন, কী হয়েছে? কাশি স্যার। কবে থেকে? আজ থেকে স্যার। কই আগে দেখলাম না তো? হঠাৎ করে স্যার। স্যার আবার ব্যাগটা খুলেন। আমরা দু’চারজন তখন কাশতে থাকি। অঙ্ক স্যার কাশি ভালো করার ওষুধ দেন। অঙ্ক স্যারের আদর শাসনে আমাদের দিন ভালোই কাটছে। ভয় শুধু স্যারের সেই সাপের চোখ। এমন চোখ আরও এক লোকের ছিল। সেটা হল সেই ল্যাংড়া আনারের বাবার। শিশুরা এমনি ভয়কাতুরে। তার উপর যদি কলিজা চমকানো তাড়া দেয়, তাহলে ভয় পাবে। সেই ভয়ের মুহূর্তে যদি সত্যিকার তাড়া দেয় তাহলে জানে পানি থাকে না। আনারের সাথে দিন রাত খেলছি। একে মাটির গর্তে পুরে ফেলে সারাদিন পাশে কুকুর ছানার মতো পাহারা দিই। হঠাৎ একদিন কী কারণে যেন তাকে ধমকেছি। সেই শব্দ শুনে তেড়ে এল আনারের বাবা। বাপরে বাপ! তার চোখ দেখেই ভোঁ দৌড়। এবার দিল পিলে চমকানো তাড়া। দুর দুর করতে করতে সেই পলায়ন। মনে হয় বাকি দুই তিন বছর তার সামনে দিয়ে হাঁটিনি। আনারকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা আমরা করলাম। আস্তে আস্তে তার দাঁড়ানোর ক্ষমতা হ্রাস পেতে পেতে কেমন চার হাত পায়ে হাঁটা। অনেকটা জন্তু-জানোয়ারের মতো। আমরা আর একে খেলায় নিতে পারি না। একটা কিশোর দিব্যি আমাদের সামনে প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে। তা-ও সবাই সেটা মেনে নিচ্ছে। আনার কেমন অসহায়ের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। দু’চারটা হালকা খাবার ওর দিকে ফেলে দেয়ার মতো দিলে কৃতজ্ঞতার সেই অবলা হাসি দেয়। ওর নাকে মুখে পশু পাখির মত খাবার লেগে থাকে। কেমন জিহ্বাটা বের করে চেটে চেটে খায়। প্রথম প্রথম আমরাও কাঁধে করে ওকে হাঁটানোর চেষ্টা করেছি। ওর সচল রাখার নিরন্তর প্রাণান্তকর চেষ্টা করলাম। স্কুলের পাশে প্রভাবশালী এক লোকের বাড়ি। তার বর্ণনা একটু দিই। লোকে তার এক নামেই ভয়ে কাঁপতে থাকে। বড় বিরক্তিকর প্রভাবশালী লোক। একবার স্কুলঘর ভেঙে গেলে তাদের বৈঠকখানাতে স্কুল স্থানান্তরিত হল। তার ছেলের নাম জিয়াউল। আমরা সবাই ডাকি জিয়ল বলে। ‘জিয়ল’ শিংমাছের আঞ্চলিক নাম। জিয়লের মত স্বভাব সেই জিয়াউলের। সপ্তাহ পর আবার সেই অঙ্ক স্যার। আমরা কাশির অভিনয় করে চকলেট ট্যাবলেটের জন্য হাঁ করে থাকি। স্যার সেই ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে এলেই ভাবি, কপালে দু’চারটি মিষ্টি ট্যাবলেট পাবোই পাবো। কিসের ভয়, কিসের অঙ্ক, ওয়ান টুয়ের বাচ্চা আমরা। অঙ্ক স্যারের একটি ভয়ের কারণ। স্যার আমাদের কখনই মারতেন না। মারতেন পেটাতেন বড়দের। সেই বড়দের পেটানো দেখেই আমাদের ধড়ে পানি থাকত না। এমনি একদিন স্যার পেটালেন সেই বদমেজাজি জিয়াউলকে। জিয়ল স্যারের হাতে অঙ্ক না পারাজনিত মার খেয়েই বইসহ হনহন করে চলে গেল। স্যারের সামনে দিয়েই। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সেই রকম রাগ করা দেখে আমরা শিশুরাও ভয় পেয়ে গেলাম। জিয়ল আসলেই মারাত্মক। ওর আব্বাকে আমি একবার গোখরা সাপ মারতে দেখেছিলাম। ফালা ব্যবহার করে সেই সাপ মেরে ছিল। গোখরা সাপটা ফণা ধরে আর জিয়াউলের বাবা কি অদ্ভুত কৌশলে গোখরার মাজা বরাবর চিকন ফালা ঢুকিয়ে দিয়েছে। বহুদিন সেই সাপ মারা স্মৃতি আমাদের কচি মনে দাগ কেটে ছিল। আজ শেষ ক্লাসে শুনলাম, জিয়ল সেই সাপমারা বিষাক্ত ফালা দিয়ে স্যারকে গেঁথে ফেলবে। এ জন্য তার বাড়ির পাশে দাঁড়ানো। বাপরে বাপ! আমরা সেই কথা শুনে আগে ভাগে স্কুল থেকে পলায়ন করলাম। শুনলাম আমাদের পর পরই স্যারও অন্য পথে পলায়ন করেছেন। জিয়লের রাগ কমলা না। স্যারও স্কুলে নতুন নতুন এসেই ঐ কাণ্ডটা করে বসেছেন। স্যারের হাত মারার জন্য অনেক খ্যাতি। যাক উল্টো জায়গায় মারার কারণে এই পরিণতি। জিয়ল স্কুল আসে না। ঐ ফালা নিয়ে প্রতিদিন বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এক সপ্তাহ স্যার আর স্কুলে এলেন না। জিয়লও স্কুলে আসে না। স্যার জিয়লকে মেরে ভারী মুশকিলে পড়লেন। এখন স্কুলে যেতে পারেন না। স্কুল কামাই করলে লেখাপড়ার ক্ষতি। স্যার আবার অনুপস্থিত থাকলে সরকারি বেতন কম পাবেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন পেশা করা যায়? আরেক স্যারও এরকম বিপদে পড়েছিলেন। সে কাহিনী ছিল অন্য। এই স্যার যেমন ডাক্তারি করেন। ঐ স্যার করেন মাছ ধরার কাজ। বিকাল হলেই নৌকা নিয়ে জাল নিয়ে নদীতে চলে যান। অনেক মাছ মারেন। রাতে মাছ মারা নিয়ে কোন্দল। এমন কোন্দল যে, স্যারের আঘাতে প্রতিপক্ষ প্রতিবেশীর মাথার রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। আমরা প্রথমে শুনলাম খুন হয়েছে। সেই স্যারের বাবা গেলেন। কী হয়েছে? তোমার ছেলে মেরেছে। কী হল তোরা এক সাথে মাছ মারিস, মিলে মিশে থাকবি। সেটা তোমার ছেলেকে বল গা। ভাই আমার কথা শুনবি না? না শুনব না। কেন শুনবি না? অত ঘ্যান ঘ্যান করো না। ওকে রেডি থাকতে বল। কী রেডি থাকতে বলব? আমার মাথা যেভাবে রক্তাক্ত করেছে, ওর মাথাও তাই হবে। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ। সেই ব্যান্ডেজ মাথা নিয়ে হাতে বিরাট লাঠি। ঠিক শিকারি ধরার জন্য। স্কুলের পথে আমরা যাবার সময় সত্যিই সেই দৃশ্য দেখলাম। স্যার স্কুলে এলেন না। হেড স্যার আমাদের এতগুলো ছেলেপেলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? আমরা মনের আনন্দে স্কুল করি। তেমন লেখাপড়া করতেও হয় না, পড়া দিতেও হয় না। মহাসুখ আর কাকে বলে। আমাদের ছোটদের নেতা রাজ্জাক। ও আমাদের সবার বড়। আমরা সবাই গুরুর মত মানি। হেন কোনো কাজ নেই ওকে ছাড়া আমরা করতে পারি। আমাদের স্কুলের বর্ণনা দেয়া হয়নি। স্কুলটা বাঁশের চটায় বেড়া দেয়া। উপরে ছাউনি টিনের। ক্লাস রুম আলাদা নেই। বিরাট একটা ঘর। বেড়ার পূর্ব অংশ ভাঙা। বৃষ্টি-বাদলা হলে গরু ছাগল সেই অংশ দিয়ে ঢুকে পড়ে। পরদিন আমরা ছাগলের লাদি ঝাড়– দিয়েই ক্লাস করি। আজকে আমাদের ক্লাস হচ্ছে মহা আনন্দে। তাহাজ্জত স্যার পলাতক। সেকেন্ড স্যার মারামারির ঘটনায় অনুপস্থিত। সেই স্যারের বদলে নতুন দু’জন এসে ক্লাস চালাচ্ছেন। তারা ঐ স্যারদের ভাই এবং আত্মীয়। আমাদের মিষ্টি ট্যাবলেট খাওয়া বন্ধ। তবে নতুন একটা আনন্দ যোগ হল, রাজ্জাকের নেতৃত্বে স্কুল পালানো। আর পালিয়ে কুলিয়ে মার্বেল খেলা। অনেক সালিশ দরবার করে দু’জন স্যার আবার এলেন। তবে তাহাজ্জত স্যার স্কুল বদলির জন্য আবেদন করলেন। আমরা শুনলাম স্যার আমাদের এখানে বেশি দিন থাকবেন না। আমরা স্যারদের বদলির কথা অত মনে রাখি না। কিন্তু স্কুল পালানো নিয়মিত হওয়া শুরু হল। রাজ্জাক আমাকে বুদ্ধি দেয়। আমি সবার ছোট বলে স্যার যথেষ্ট আদর করেন। নাক ঝাড়ার কথা বলে বের হই। রাজ্জাক বুদ্ধি করে সেই ছাগল ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বইগুলো পার করে দেয়। আমি বই নিয়ে কেটে পড়ি। স্যারেরা মহা ব্যস্ত অন্য দিকে ক্লাস নিতে। এতোগুলো ছেলের খিস্তি খেউড় স্যারদের ক্লাসের ফাঁকে কেউ নাক ঝাড়া, কেউ কফ ফেলা, কেউ প্রশ্রাব করা নানা অজুহাতে খালি হাতে বাইরে আসে। সবাই সেই লম্বু নানীর ভেন্না তলায়। এরপর দল বেঁধে রাজ্জাকের নেতৃত্বে কোথাও মার্বেল খেলা চলে। ধুমসে খেলা। স্কুল ছুটি হলে সবাই বাড়ি ফিরি। লেখাপড়া তেমন নেই। শুধু খেলা আর খেলা। স্কুলে যাওয়ার আগে নদীতে গোসল। নৌকা বাইচ। বন্যার নতুন পানি। দৌড়ঝাঁপ দিতে দিতে চোখ লাল করে ফেলি। রাজ্জাক একটু সিনিয়র। ও দুয়েক জনকে তাস ধরিয়েও ফেললো। হালকা ধূমপানও চলছে। রাজ্জাকের পালাবদল হচ্ছে। ওর বাবা নৌকাতে মাছ ধরে। কাগমারিতে প্রচুর মাছ। রাজ্জাক জোগানদাতা। কাজেই বার্ষিক পরীক্ষার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ও চলে গেল কাগমারি। আমরা নেতৃত্বশূন্য। সকাল সন্ধ্যা পড়তে বসার নিয়ম হয় না। আস্তে আস্তে লেখাপড়ায় ঘুন শুরু। তাহাজ্জত স্যার বদলি হলেন। নতুন এক স্যার মাসখানেকের মধ্যে এলেন। এবং আমার নানার বাড়িতেই লজিং। আমরা এবার সেই স্যারের কাছে নিয়মিত সকাল সন্ধ্যা পড়াশোনা করছি। নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছি। সন্ধ্যা হলে হালিম হারিকেন জ্বালায়। ইংরেজি শব্দার্থ স্যার বলে দিচ্ছেন। সকালে সহজ নিয়মে অঙ্ক শেখান। ক্লাসে নিয়মিত পড়া হচ্ছে, স্কুল পালানো ভুলে গেলাম। ক্লাস টুতে এবার একটু ভালো ফল হল। এই প্রথম সেই তারকা চিহ্নিত শূন্যস্থান নিজে নিজে বুঝলাম। যেটা গত এক বছর প্রচেষ্টায় ঝিনুক আপা আমাকে বোঝাতে পারেনি এবার একটু পেছনে যাওয়া যাক। গত বছর যে পরীক্ষা দিলাম তার কাহিনী। ছাত্র আমরা চারজনÑ আব্বাস, হালিম, মহিদ এবং আমি। রাজ্জাক অনিয়মিত। মাঝে মধ্যে ক্লাস করে স্কুল পালানোর নেতা। বার্ষিক পরীক্ষার আগে আমাদের স্কুলের নামে জমি ছিল না। নতুন জমি হল। এতদিন পুরাতন ঈদের মাঠেই একটা টিনের ঘরে স্কুলের ক্লাস চলছিল। নতুন হেড স্যার। সিদ্ধান্ত নিলেন যে করেই হোক বার্ষিক পরীক্ষা স্কুলের নিজস্ব জমিতেই হবে। কিন্তু সেটা তো ঢিলের মাঠ। বড় বড় মাটির চাকা। সব ছাত্র-শিক্ষক মিলে একদিন মাটিভাঙ্গা মুগুর দিয়ে ঢিল ভেঙে এলাম। শীতকাল বলে ভালোই লাগল। নরম নরম রোদে সবাই বড় বড় ঢিল ভাঙছি। গ্রামের লোকজনও এল। বিরাট উৎসব। ফাঁকা মাঠে দুই তিন বিঘা জমির ওপর স্কুল হবে। পরদিন সেই ফাঁকা মাঠে পরীক্ষা। বড় বড় হাই বেঞ্চ মাথায় করে, কাঁধে করে ওই মাঠে নিচ্ছি। লাইন ধরে বেঞ্চ টানার দৃশ্যটা বড়ই সুন্দর। কোনো গাছপালা নেই, ঘরবাড়ি নেই। ফাঁকা মাঠে থরে থরে বেঞ্চ সাজানো। স্যারদের টেবিল চেয়ার তা ঐ ফাঁকা মাঠেই। বার্ষিক পরীক্ষা ওখানে হবে। এরপর স্কুল ঘর না হওয়া পর্যন্ত পুরান ঘরেই চলবে। তবে দ্রুতই নতুন স্কুলে যেতে হবে। ফাঁকা মাঠে ক্লাস টুতে চারজন পরীক্ষা দিচ্ছি। আর ক্লাস ওয়ানের পরীক্ষা মৌখিক চলছে। হেড স্যার দূরে বসে সেই পরীক্ষা নিচ্ছেন। মহিদ এবং আমি এক বেঞ্চে। হালকা দূরে হালিম এবং আব্বাস। ফাঁকা মাঠ বলে হাত বিশ-ত্রিশ দূরে দূরে বেঞ্চ। পড়ালেখার আমি তো কিছুই জানি না। তারকা চিহ্নিত শূন্যস্থান পূরণ গত একবছরে আমার বড় বোন আমাকে বুঝাতে পারেনি। আমি সে প্রশ্নের আনসার করব কী করে। মহিদ আমাকে বলে না। ও বয়সে আমাদের সবার বড়। মহিদের কবুতর বলে একটা গল্প ছিল। সেটার ছবিও আমাদের মহিদের মতই। মহিদকে আমরা ক্ষেপাতাম, ও দেখতে সত্যিই একটা বড় মানুষ। দিব্যি বিয়ে করা মানুষের মত এবং চোখ মুখও মাঠের চাষির মত। আমাকে কিছুই দেখাচ্ছে নাÑ পরীক্ষার সময় চলে যাচ্ছে। এক ঘণ্টা পড়ে যাবে যাবে। এমন সময় আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল। আব্বাস আর হালিম যে বেঞ্চে বসা ওখানে গেলে মন্দ হয় না। ওরা হয়তো বলতে পারে। ভিন্ন এক জোড়া বেঞ্চ নিয়ে রওয়ানা দিলাম। ত্রিশ হাত দূরে ওরা দু’জন দেখা দেখি করে মহা আনন্দে পরীক্ষা দিচ্ছে। আমি একবার লো বেঞ্চ, আর একবার হাইবেঞ্চ সর সর করে টানছি। গন্তব্য হালিমদের বেঞ্চ। খালি পায়ে হেঁটে আসলে স্যার তো দেখে ফেলবেন। বেঞ্চ টানতে টানতে এদের কাছাকাছি আসতে বেশ সময় লাগলা। স্যারের টেবিল আমার এখান থেকে দুশো হাত দূরে। স্যারেরা শীতের রোদ পোহাচ্ছেন। উত্তরের বাতাসটাও ফাঁকা মাঠে বেশি। কিন্তু কাজ হলো না। আব্বাস হালিম তারা কি লিখেছে তার কিছুই দেখালো না। আবার রওয়ানা হলাম মহিদকে ফেলে এসেছি সেই গন্তব্যে। আসতে বেশ সময় লাগল। একবার হাইবেঞ্চ একবার লো বেঞ্চে। মহিদও আমাকে বলে না কিছুই। শূন্য খাতা জমা দিয়ে চলে এলাম। ফলাফল বের হল। মহিদের রোল এক, আব্বাসের রোল দুই, হালিমের তিন, আমার রোল চার এবং রাজ্জাক যেহেতু কাগমারিতে চলে গেছে মাছ মারতে ওর রোল পাঁচ। আমাদের খণ্ডকালীন শিক্ষক হলেন নূরু মামা। তিনি মাঝে মধ্যে আমাদের ক্লাস নিতেন। পরীক্ষার খাতাও তিনি কাটলেন। এবং তিনি প্রাইমারি হাইস্কুল সবখানেই খণ্ডকালীন অঙ্ক শেখাতেন। অঙ্কে তার অনেক মেধা। অঙ্কের জাহাজ বলা যায়। নির্ভুলভাবে বড় এবং জটিল অঙ্ক করার অদ্ভুত ক্ষমতা। হাতের লেখাও বেজায় সুন্দর। সুন্দর ইংরেজদের মত ইংরেজি অক্ষর লিখছেন। খাতার নম্বর তোলা এবং লেখা দেখে আমরা ছোট বেলায় নূরু মামা হতে চাইতাম। নূরু মামা আমার খাতা দেখলেন বেজায় ধরনের খারাপ। তাই মাঝে মধ্যে শিক্ষক না থাকাকালীন সময়ে আমাদের পড়াতেন। এবং শহর থেকে এসে আমাদের পড়ালেখার খোঁজখবর নিতেন। তাতে কি আমাদের চাহিদা মিটে? আমাদের নিয়মিত পরিচর্যা দরকার। নতুন স্যার এলেন। রাতের পড়া, সকালে অঙ্ক করা। বিকাল বেলা ফুটবল খেলা, সে খেলায় বল কুড়িয়ে দেয়া। নামাজের সময় আমাদের সাথে নেয়া। আমূল পরিবর্তন এল। স্যারের সাথেই স্কুলে যাই। এবার ক্লাস টুতে পরীক্ষা দিলাম। স¤পূর্ণ নিজের মত করে। কাউকে কিছুই বলতে হলো না। পরীক্ষার প্রশ্নটা নিয়ে বাড়িতে এলে নানা সব প্রশ্ন একে একে ধরতেন। আমি জবাব দিতাম। নানা খুশি হতেন। কিন্তু গত পরীক্ষার প্রশ্ন রাস্তার পাশে ফেলে এলাম। নানা বললেন প্রশ্ন কই? আমি বললাম হারিয়ে গেছে। পড়ে যাওয়া প্রশ্নে আর কী ধরবেন। নানাও মন খারাপ করে হাসতেন। তিনি আগে ভাগেই বুঝতেন আমাদের কী হয়েছে। তাই এই নতুন শিক্ষককে তিনি আমাদের জন্য এ বাড়িতেই রেখেছিলেন। আমরা আসলে নানার সেই বুদ্ধির প্রশংসা করতে থাকি। আসলেই এবার আর কোনো প্রশ্ন হারায় না। টুতে ছাত্র সংখ্যা এবার দশ-বার জন। নতুন স্থানে স্কুল হওয়াতে এসব এলাকার অনেক ছেলেই স্কুলে ভর্তি হল। আর স্যারের সাথে পড়তেও অনেক মজা। তাহাজ্জত স্যারের মারের কথা সারা কিশোরকাল আমাদের ভাবিয়ে তুলত। আর মিষ্টি চকলেট খেয়ে তা ভুলে যেতাম। স্যারও চলে গেলেন, তার স্থানে নতুন স্যার এলেন। হেড স্যার বদল হল। নতুন একজন এলেন, হেড স্যার শত পরিশ্রমে নতুন স্কুল গড়ে তুললেন, সেখানেই নতুন ক্লাস। আমাদের জীবনটাও কেমন নতুন হতে লাগল। প্রকৃতি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। লম্বু নানীর সেই ছেলেগুলো স্কুলমুখো হয় না। এখানেও স্কুলের একেবারে পাশে যারা তারাও দেখলাম কেমন স্কুলবিমুখ। রাজ্জাক আর পড়ালেখাই করল না। এদিকে ল্যাংড়া আনার দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে, আমরা ভালো করার জন্য সারা কিশোরকাল কতনা চিকিৎসা করি। আনারের দাদী যা-তা মহিলা। ছোটকালে শুনেছি অসম্ভব সুন্দরী, অমন সুন্দরী মহিলা আমাদের গাঁয়ে নেই। ঘণ্টা মিনিট ভাগ করে পান খান। আমাদের খেলার জায়গা আনারদের বাঁশতলা। ওখানে আরো অনেক মহিলার সাথে কাঁথা সেলাই করে। বুড়ি মুরগি যেমন মোটা মোটা পা ফেলে সারা বাড়ি চড়ায় বেড়ায়, সারা গ্রামে তেমনি আনারের দাদী দাপিয়ে বেড়ায়। আনারের বাবাকে ভয় পাওয়ার কারণ ঐ আনারের দাদী। আমি বড়শি দিয়ে মাছ ধরছি। বড়শিতে মাছ ধরার জন্য অনেকগুলো কেঁচো আনতে হয়েছে। কেঁচো রেখে দাউলিখানা আমি উল্টিয়ে রেখেছি। আনার তখনও একটু একটু হাঁটতে পারে। তবে বসার সময় অত ব্যালেন্স রাখতে পারে না। বসা শুরু করলেই কেমন যেন ধপাস করে বসে পড়ে। বসার মঝখানে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেই। আমি এক ধ্যানে মাছ ধরছি। আনারকে দূর থেকে একবার দেখলাম এদিকে আসছে। হয়তো এদিক দিয়েই যাবে। আমার কাছে এসেই বসবে তেমন ভাবনা ভাবতে পারিনি। ও আমার বড়শি নলের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বসে পড়ল। ধপাস করে শব্দ হল, অমনি চিৎকার। কি আনার তোর কী হল? কেটে গেছে। কী কেটে গেছে? ও হাত দিয়ে দেখাল। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। ও ধপাস করে আমরা দাউলির উপর পড়েছে। দাউলি উল্টো দিকেই ধার থাকে। ওর হাতে রক্ত। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই, জোরে জোরে কাঁদছে। মনে হচ্ছে আমিই ইচ্ছে করে ওর এই সর্বনাশ করেছি। বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। ওদের বাড়ির সাথেই ঘটনা। ওর দাদী আসতে বাকি নেই। একান সেকান হওয়ার আগে দাউলি বড়শি নিয়ে পগারপার। কিসের মাছ, কিসের কেঁচো। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। বিকাল বেলা আমার মায়ের প্রতি হামলা চালাল। আমি তো বাড়িতেই আসিনি। আসলে অনেক রাতেই আসব। তখন যা বলার বলব। এর বাপকে তো আগে দেখেই ভয় পাই। আনার কিন্তু জানে দোষটা আমার না। আনারের দাদী সোজা আমাদের বাড়ি। নানা দুপুরের পর ডাকলেন, রূপম? জি নানা। লেখাপড়া কেমন লাগেরে? খুব ভালো নানা। প্রশ্ন এখন হারায়? না নানা, এবার হারায়নি। আর হারাবে না। স্যার কেমন পড়ায়। খুব ভালো। অঙ্ক কেমন? অনেক ভালো। তাজাজ্জতের চেয়ে ভাল? সে কথা ভালো বলতে পারব না। আমরা ক্লাস টুতে পড়ি। তাহাজ্জত স্যার অঙ্ক পড়ান ক্লাস ফোর-ফাইভে। আমরা ওসব জানব কী করে? সেগুলো জানে বড় আপারা। জিয়লেরা। শীতকালের মাঠে প্যারেড হয়। জাতীয় সঙ্গীত গায় দু’জন। বেলাল আর তোফাজ্জল। বেলালের কণ্ঠ খুব তীক্ষè। তার চিকন গলা আমাদের কানে লাগে, মধুর সুর। গানের কণ্ঠও বেশ ভালো। ওর ছোট ভাই আলাল আমার ক্লাসে পড়ে। আব্বাস হালিম উপরে চলে গেল। সঙ্গী পেলাম আলাল, নতুন জায়গায় স্কুলের নতুন দুজন ছাত্র-ছাত্রী এল। ওরা আরও বড়। কিতাব আলী আর রোকেয়া। ওরা ভাইবোন। একই ক্লাসে। বয়স মনে হয় দশম শ্রেণীর হলে মানায়। কিন্তু এরা পড়ে সেই ক্লাস ফোরে। কিতাব আলী বেজায় কম কথা বলে। ওর বাবাও কম কথা বলে। সবসময় পর্যবেক্ষণে থাকে। এদের গ্রামের ধারে পাশে কোনো বিদ্যালয় নেই। তাই পড়ালেখা হয়নি। কিন্তু কিতাব আলীর বাবার অবস্থা ভালো। কিতাব আলীর বাবার বড় বড় অনেক নৌকা। বাইচ খেলার জন্য লম্বা লম্বা ছিপ নৌকা। বর্ষাকালে কিতাব আলী স্কুলে আসলে নৌকা করে আসে। কিতাব আলীর চোখটা কেমন নিবু নিবু। নিচের ঠোঁট একটু বড়। কিতাব আলী হেড স্যারের প্রিয়। হাজিরা খাতা- ডাস্টার আনা নেওয়ার দায়িত্ব তার। হেডস্যার আজ আসেননি। ক্লাসের মধ্যে বড় বিশৃঙ্খলা, কিতাব আলীকে দিয়েই আমাদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। আমাদের ক্লাসে এল। ছাত্রকে স্যার বলতে ভাল লাগে না। হাজার হলেও প্রতিদিন ওদেরকে ক্লাস করতে দেখি। তাছাড়া পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র হলেও কথা ছিল। কিন্তু এরা তো ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে। কিতাব আলী দেখতে ৫ম শ্রেণীর চেয়েও অনেক বড়। কিতাব আলী ক্লাস করাতে পেরে অনেক গর্বিত। হাজার হলেও হোক না ক্লাস টু। তাতে হবে কি। কিতাব আলী আগেই একটু মুরব্বী স্টাইলের। এবার থেকে সত্যিই মুরব্বী। এখন থেকে হাসি-তামাশাও কম করে। কিতাব আলীকে আমরা ভাই বলে ডাকতেও লজ্জা পাই। একবার স্কুলের মাঠে এক গরু চোর আনা হয়েছিল। সেই গরু চোরেকে স্যার মাথা ধরে গালের মধ্যে চড়াতে শুরু করলেন। সে দৃশ্য বর্ণনা করা মুশকিল। অন্তত পঞ্চাশটা চড় মেরে ছিলেন স্যার। চড় মারার পর স্যার শিশুর মত কান্না শুরু করলেন। তাহাজ্জত স্যারের একটু বর্ণনা দেয়া আবশ্যক। হালকা ফিনফিনে দেহ। মুখে দাড়ি। দাঁতগুলো অসম্ভব ফর্সা। কালো মাজনের সাথে এলোপ্যাথিক কি একটা ওষুধ নিয়ে দাঁত মাজেন। সপ্তাহে একদিন লবণ সরিষার তৈল কাঁচা নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে আদায় করেন। দারিদ্র্যের সংঘাতে মন ভালো লাগে না। বাড়ি থেকে ক্লাস করেন। ওষুধের ডাক্তারি ব্যাগটা সব সময় হাতে থাকে। ৫০% ডাক্তার আর ৫০% শিক্ষকের অবয়ব। আজকে কেমন অন্য মনস্ক। নামাজের মধ্যে একাই হু হু করে কাঁদেন। আমাকে ডাকলেন, রূপম? জি স্যার। তোমার মা কেমন আছে? ভালো স্যার। তোমরা কেমন আছ? এই তো দেখছেন স্যার। তোমার কাশি ভালো হয়েছে? জি স্যার। কাশির ট্যাবলেট খেতে মন চায়? স্যারের ঐ মারের দৃশ্যের পর সত্যি সত্যিই খয়েরি ট্যাবলেটের মিষ্টতাও কমে গেছে। তেমন খেতে মন চায় না। আমিও জবাব দিলাম না। আমাদের বিদ্যালয়ের সবচেয়ে চালাক ছেলে আব্বাস। ওর চালাকি অদ্ভুত। ব্রেন মেধাও অসাধারণ। ওদের অবস্থা মোটামুটি। খেয়ে দেয়ে চলে যায়। ওর বাবা আবার বড়ই মাছ পোকা। মাছের সন্ধান পেলে সেখানে হাজির হবেই। একবার চরের মধ্যে এক কুপয়াতে ছোট ছোট মাছ লাফাতে দেখে বাড়িতে চলে এল। ঘোষণা দিল বিশাল মাছের খানি পাওয়া গেছে। আব্বাসের বাবার কথায় জাল লগি নিয়ে হাজির। সেই কুপয়া ছেঁকে সামান্য ক’টা খয়রা মাছ। কার কথা শুনে এই ভরদুপুরে এখানে? সবাই আব্বাসের বাবার উপর চটে গেল। আব্বাস সবার ছোট। মায়ের কোলের সন্তান। ছোট ছেলে বা মেয়েকে কোলের সন্তান বলে। আমিও আমার মায়ের কোলের। হালিমও তার মায়ের কোলের। সেই অর্থে আমরা সবাই একই। আজ আব্বাস ক্লাসে আসেনি। হেডস্যার সংবাদ নিতে বললেন। আমি আর হালিম হাজির। অবাক ব্যাপার, রাত্রে আব্বাসের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। আব্বাসকে বললাম, তোরা টের পাসনি? বলিস কি, আমাকে বেঁধে রেখেছিল। অন্য ঘরের লোকেরা? সবার ঘরে শিকল দিয়ে আটকিয়ে রেখেছে। আব্বাসের বাবা বুড়ো। তার আবার ভয় ডর অনেক। ডাকাতের কাছে মাফ চেয়েছে। যা খুশি নিয়ে যাক। প্রাণে যেন না মারে। কী কী নিয়েছে রে? এক বস্তা চাল ডাল। বলিস কী? ডাকাত চাল নেবে কেন? বাক্স খুলেছিল তাতে তেমন কিছু পায়নি তাই। আব্বাসের বাবার গলায় একটা চকচকে ছুরি ধরেছিল। ওতেই ওর বাবার জ্ঞান হারানোর পালা। অন্য ঘরে ঝি বৌরা থাকে। ডাকাতেরা সহজ ভাবে যা বলেছে তাই করতে হল। ডাকাতেরা যাবার সময় আবব্বাসের মাকে বলল, ভাবীজান পান খাব। পাজিগুলো বলে কী? ডাকাতি করে মাল সামান নিয়ে যাচ্ছে। আবার বলছে পান খাব। আব্বাসের বাবা বললেন, ভাই সাহেবরা যা বলে তাই কর। ভালো ঘ্রাণওয়ালা জর্দা দিয়ে পান দেও। একজন বলল, ভাবী এক গেলাস চিনি শরবত। একটু লেবু দিয়েন। আব্বাসের মা তাও দিলো। যেন শ্বশুর বাড়ি, যা চাইবে তা-ই পাবে। যাবার সময় সেই লম্বা ছুরিখানা রেখে গেছে। আব্বাস এনে দেখাল। অতি লম্বা একটা পুরাতন জংপড়া ফেলনা চিকন ছুরি। ওটাই আব্বাসের বাবার বর্ণনার চকচকে ধারাল ছুরি। নদীর চরের ডানকুনে আর খয়রা মাছকে বিশাল মাছ বলেছিল। ডাকাতদের কাহিনী আমাদের কাছে কেমন কেমন লাগল। কারণ ডাকাত সোনাদানা হরণ করে জীবন সংহার করে। এ ডাকাত পান খায়, শরবত চায়, চাল ডাল নেয়Ñ কেমন কথা! আমাদের সেকেন্ড স্যারকে যে তাড়া করেছিল তার বাড়িতে একবার ডাকাত এলো, সে কি আক্রমণ! কুড়াল দিয়ে দরজা কাটে। দূর থেকে শব্দ হয়। ভয়ে কাঁপি। ডাকাতি হচ্ছে টাকা পয়সা না নিতে পেরে তার কান কেটে নিয়ে গেল। জীবন সংহার করছে প্রায়। অমনি তার বৌ এসে তবেই রক্ষা। অনেক কান্নাকাটি করে বললেন, ভাই আপনারা যা পান নিয়ে যান। আমার স্বামীকে প্রাণে মাইরেন না। স্কুলে তিন দিন আব্বাসকে ডাকাতের কাহিনী বলতে হল। হেডস্যার তো ডাকাতের গল্প শুনে আব্বাসকে ধন্যবাদ দিলেন। আব্বাস ডাকাতদের ভয় পায়নি বরং সাহস রেখে কথা বলেছে। আব্বাসের বাড়ি ডাকাতি হওয়ার পর থেকে আব্বাসের একটু ভিন্ন পরিচয় হল। বিশেষ করে আব্বাসের মায়ের হাতে ডাকাতদের পান খাওয়া আর শরবত খাওয়ার কথা শুনে সবাই মুচকি হাসি। ডাকাতগুলো কেমন ছিল আব্বাস? অল্প বয়সী। আচার ব্যবহার? ভালো স্যার, তবে বেতমিজের একশেষ। ওরা স্যার যাবার সময় আমার বৃদ্ধ বাবা আর মাকে ওদের জন্য দু’হাত তুলে মুনাজাত করতে বাধ্য করেছে। বল কী? জি স্যার। যাতে ওদের গোনাহ না লাগে, সে জন্য দোয়ার ব্যবস্থা। আমার বাবা কেঁদে কুটে ওদের জন্য দোয়া করেছে। আব্বাসের মনে জিদ চাপল যে করেই হোক ডাকাতদের ধরার ব্যবস্থা করবে। আব্বাসের হাতের নিরিখ ভালো। গুলতি মেরে দূরের ঘুঘু পাখির বুক ঝাঁঝরা করে। কতবার পুকুরের মধ্যে ঢোড়া সাপ মেরেছে! মাথায় আঘাত পেয়ে সেই হলুদ সাপের মোচড়ানো দৃশ্য চোখের সামনে ভাসে কিন্তু পারল না এই ডাকাতের সাথে। এখনও মনে হয় হাত খোলা থাকলে দূর থেকে গুলতি মেরে ডাকাতের চোখের নাড়িভুঁড়ি বের করবে। কিন্তু পারবে কী করে তার হাত পিছ মোড়া করে বাঁধা। চোখ দু’টিও বন্ধ। নতুন স্কুলের পাশে এসে অনেকগুলো জিনিস নতুন জানতে পারছি। মার্বেল দিয়ে জুয়া খেলা। আমরা মার্বেল খেলেছি। কিন্তু মার্বেল দিয়ে জুয়া খেলে কিভাবে তা জানতাম না। আশ্চর্য ব্যাপার স্যার একদিন বিচার করছেন। এর নাম আতর। স্যার পেটাচ্ছেন, জুয়া খেলার বয়স আছে। তাই বলে এই সময়ে? যে নাকি এখনও স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেনি! অদ্ভুত আরো একটা জিনিসের পরিচয় হচ্ছে। স্কুলটা আসলে ভাল মহল্লায় আসেনি। পৃথিবীর সব আদিম জিনিস নিয়ে এরা চলাফেরা করে। আমরা আস্তে আস্তে নোংরা পরিবেশের সাথে মিশে যাচ্ছি। ল্যাংড়া আনার আস্তে আস্তে জন্তুজানোয়ারের কাতারে চলে যাচ্ছে। এখন সে চার হাত পায়ে হাঁটে। তা আমাদের সামনেই। একে ভালো করব কি করে? এর দাদী, এর বাবা অন্য প্রকৃতির মানুষ। এর মধ্যে রাজ্জাক ফিরে এসেছে। আমরা ততদিনে ভালো ছাত্রতে পরিণত হয়েছি। রাজ্জাক দেখল ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। ওর খালাতো ভাই হাশেম নৌকাতে থেকেই পুরো ইংরেজি ওয়ার্ড বুক মুখস্থ করে ফেলেছ। ছোট একটা ইংরেজি ডিকশনারি প্রায় অর্ধেক শব্দ না দেখেই বলতে পারে। সেও নৌকাতে মাছ মারে। কিন্তু রাজ্জাকের সেদিকে নজর নেই। স্কুল পালানোর কথা আমাদের বলতে পারে না। বরং রাজ্জাকের আর স্কুলে আসাই হল না। এবার মাছ মারতে যাবে আরো দূরে জলংগীর ঘাটে ও হুগলি নদীতে। সেখানে থাকতে হবে আরও ছয় মাস। তবে যে কয়দিন ছিল সে কয়দিন আমরা নৌকার গল্প শুনি, মাছের গল্প শুনি। হালিমের প্রতি রাজ্জাকের একটা বিরাট অধিকার ছিল। একেবারে কেনা গোলাম বলা যায়। বিড়ি সিগারেটে ধরেছে। গোপনে গোপনে হালিমকে বিড়ি আনতে বলে জয়েনের বাড়ি চলে যায়। আবার ম্যাচ, ব্লেড আনতে ওদের বাড়ি যাওয়া লাগে। আমরা রাজ্জাকের কথা তেমন শুনি না। রাজ্জাক ফিরে আসার পর আবার সেই আদেশ দিল। ওমা হালিম দেখি ম্যাচ বিড়ি আনার জন্য যাচ্ছে। সেই জয়েনের বাড়ি। জয়েনের বড় ছেলে, আমরা ওকে বলি মেছের। মেছের বা মিসির বিরাট ঘুড়ি তৈরি করে। তার নাম চিলি ঘুড়ি। আট হাত দৈর্ঘ্য চার হাত প্রস্থ। সেই ঘুড়ি যখন আকাশে উড়ায় গোঁ গোঁ ডাকতে থাকে। ঘুড়ির মাথায় মিসির বেতের বাঁশি দিয়ে দেয় সেটাই শব্দ করে। প্রথম প্রথম ক’দিন আমি, হালিম, আব্বাস, সবাই মিলে তাকিয়ে থাকি। চাঁদের রাতেও দূর থেকে সে শব্দ অনেক দূরে যায়। জানান দেয় এখানে মিসিরের ঘুড়ি আছে। মেছেরের স্বামী পরিত্যক্তা বোনের নাম মেহেরজান। সবাই ডাকে মেজান। মেছেরের বাড়ি দোকান বাড়ি। সবাই সে বাড়িতে বিভিন্ন অজুহাতেই যাই। কত হাজার বার আমিও মেজানদের বাড়ি গেছি, আটআনা দামের চায়না ব্লেড আর পাতার বিড়ি কিনতে। রাজ্জাক কলংগির ঘাটে যাওয়ার পূর্বদিন আগের প্রথা রক্ষার মত স্কুলে এল। যদিও বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তার নাম যেন কাটা না পড়ে তাই আসা কিন্তু কেউ তাকে চিনল না। নতুন ক্লাসে অধিকাংশই নতুন। রাজ্জাককে দেখে মহর আলী ছেলেটা গণ্ডগোল করতে লাগল। মহর আর শহর দুইভাই আমাদের শ্রেণীতে পড়ে। আরও একজন পাগলা মত। পুরো গ্যাং আমাদের ক্লাসে। সেই পাগলাটার চোখ ঘন, দাঁতে ভীষণ ময়লা। কথা বলার সময় কেমন চোখ কান জড়ো হয়ে যায়। আধা বাঙ্গাল ভাষায় কথা বলে। একটা শব্দ বিকৃতভাবে উচ্চারণ করার জন্য আমি কী বলতেই আমাকে ধাক্কা মারল। নতুন স্কুলের লোহার পেরেকে ধাক্কা খেলাম। কাঁদতে লাগলাম। বিচার করতে আসলেন সেই রাগি তাহাজ্জত স্যার। আমার কান্না থেমে গেছে। স্যার চেয়ারে বসা। যে পাগলা আমাকে ধাক্কা দিয়েছে ও হাফ প্যান্ট পরে কাঁপছে। স্যারের হাতে কঞ্চির বেত। স্যার কী কথা বলতেই সেই লম্বা ছেলেটা প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলল। আমাদের সামনে রুম ভেসে যাচ্ছে। রাজ্জাক দেখল স্কুলের সব পরিবর্তন। স্যার নতুন, ছাত্র নতুন। স্কুলঘরও নতুন। নতুনের মধ্যে ওর মন ভরল না। ওর মন নৌকাতে পড়ে থাকে। নতুন মাছ শিকার করে নতুন পয়সা। ভালো পেশা। সেখানে লেখাপড়ার মত অত জটিল সমীকরণ নেই। আমরা গল্প শুনব। সেই বিদায় লগ্নে রাজ্জাক আমাদের ডাকল। নৌকাতে কেমন লাগে? খাওয়া দাওয়া কেমন? খুব স্বাদের। তাজা মাছ খাওয়ার মজা। তরিতরকারি কাছকাছি হাট থেকে কেনা যায়। ঝড় বৃষ্টি হলে? নৌকার মধ্যেই কেটে যায়। ছইয়ের তলে জায়গা কম। শীত হলে ভালো নারে? শীত গরম সবই ভালো। মশা লাগেনারে? না, নদীতে কোনো মশা নেই। চাঁদের আলো কেমন লাগে? চাঁদের আলোতে আমরা খুব আনন্দে থাকি। হারিকেন জ্বালাতেও হয় না। তবে একটা সমস্যা, একবার আমাদের সবার কৃমি হল। কী সেই জ্বালাতন। কৃমি মারব কী দিয়ে? কেন, দোকান থেকে কৃমির ওষুধ আনতে পারলি না? আরে বোকা, নদীর তীরে অধিকাংশ হাট মাছ-তরকারির। সেখানে ওষুধ পাবো কই? এবার কৃমির ওষুধ নিয়ে যাচ্ছো? হ এবার কৃমি আর জ্বরের ওষুধ নিয়ে যাচ্ছি। রাজ্জাকের কথা শুনে আমাদেরও সখ জাগল নৌকাতে দু’চার রাত থাকলে মন্দ হত না। আমি আর হালিম একদিন তাই করলাম। বর্ষাকাল। বাড়ির সাথেই নৌকা বাঁধা। ওখানে পড়ার জন্য কয়েকটা বই আর হারিকেন নিয়ে হাজির হলাম। নানা ডাকলেন, যাও কই? নৌকায়। ওখানে পড়াশুনা করব। পড়াশোনার কথা শুনে নানা খুশি হলেন। দু’জনই হারিকেন কাঁথা বালিশ আর কয়েকটি বই নিয়ে নৌকাতে। চাঁদের আলোতে মন ভরে যাচ্ছে। এতো সৌন্দর্যে অন্য কোনো কাজ করতে মন চায়? শুধু চাঁদের আলো পানির ওপর মুক্তার পাতের মত খেলছে। আলোর ফিনিক ফুটেছে। কিসের পড়াশোনা? বিছানায় শুতেই কানের কাছে গুড়ি গুড়ি অসংখ্য ঢেউয়ের আওয়াজ। যে ঢেউগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে নৌকাতে এবং নৌকার বুকে আঘাত করছে। আমি আর হালিম আনন্দে আটখানা। সেই গুড়ি গুড়ি ঢেউয়ের মৃদু শব্দ আমাদের বুকের গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছে। বর্ষাকালে আমাদের বাড়ির চারিদিকে পানি আর পানি। বৈঠকখানাতে রাখাল কৃষাণেরা ঘুমায়। বৈঠকখানার সাথেই ছইওয়ালা মাছ মারা নৌকা বাঁধা। বাড়ির মধ্যখানে পানি উঠতে বিঘতখানেক বাকি। আমরা নৌকাতে শুয়ে শুয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাই। ভুলে যাই লাল বুড়ি নানির কোলে শুয়ে গল্প শোনার কথা আর শীতল তালপাখার বাতাসের কথা। প্রকৃতির কোলে সবই অমূল্য তা এই রাতে মনে হয়। বর্ষাকাল শেষ হলে আরেক আনন্দ। ডোগা দিয়ে মাছ ধরা। শুকনো ধনচির টুকরার মাথা সুতাসহ বড়শি লাগানো। সাত সকালে কেঁচো গেঁথে মাছ ধরি। মাছ সারা রাত ঘুমায়। সকাল বেলা খাবারের সন্ধান করে। হালিম এ কাজের ওস্তাদ। আমি তত মাছ পাই না। একবার আমার কি কারণে দ্বন্দ্ব। সেই রাজ্জাকের কথা বলে খোটা কেটেছি। আমাকে পৃথক করে দিল। আমার বড়শি সংখ্যা গোটা বিশেক। আর হালিমের পঞ্চাশের উপর। দু’জন মাছ মারছি। ও বারবার মাছ বেশি পায়। একদিন হল কী, হাঁটু পানিতে মাছ ধরছি। দশ-বারোটা টাকি বাইলি পেয়েছি। হালিম অনেক বেশি পেয়েছে। আমার সামনে একটা ডাগুর ডুবে তলিয়ে গেল। অনেক দূরে চলে গেছে। নিশ্চয়ই বড় মাছ। নইলে ডাগুর তলিয়ে নিয়ে যাবে কী কারণে? আমি দৌড়ে কোমর পানিতে গিয়েই সেটা ধরে ফেললাম। অবাক কাণ্ড! দেড় কেজি ওজনের একটা গজার মাছ। লুঙ্গি চেপে উপরে আনলাম। হালিম বলল, রূপম? কী বল? তোমার আলাদা হওয়ার দরকার নেই। আমি হাসলাম। সফলতা মানুষকে কাছে টানে। জীবনে সফল হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিশোরকালের এই এমন অভিজ্ঞতায় আমরা মুচকি হাসি। হেডস্যার বহুদিন পর আমাদের ডাকলেন। বড় ছোট সকল ছেলেকে বললেন, আগামী বৃহস্পতিবার আমরা বিশেষ এক কাজ করব। কী কাজ স্যার? নাটক করব। কার নাটক স্যার, কিসের নাটক? স্যার বললেন, পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ের নাটক। আমরা নাটক দেখব তাতে বেশ মজা, অনেক আনন্দ। স্যারের মুখ থেকে শোনার পর থেকে আনন্দে সবাই মাতোয়ারা। স্যার দু’দিন আগে ভাগ করে দিলেন কে কি অভিনয় করবে। আমাকে দেয়া হলো খরগোশের অভিনয়। খরগোশের ডায়ালগ অনেক। মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। স্যার বলবেন। আমরা খালি অভিনয় করে দেখাব। বাঘ সিংহ নানা প্রাণীর অভিনয় আছে। খরগোশের অভিনয় চমৎকার! খরগোশের সেই হাস্যকর অভিনয় আমি করলাম। হাসিতে আনন্দে কে স্যার, কে ছাত্র আমরা ভুলে গেছি। সবাই হাত তালি দিল। তাহাজ্জত স্যারকে আমরা এতো ভয় করি। সেই স্যারও আমাকে বাহবা দিলেন। তার মুখে বহুদিন পর একটু হাসি দেখলাম। অনেক দিন কেন জানি মহা টেনশনে তার মুখ থেকে হাসি উড়ে গেছে। সেই হাসিটাই এই নাটকের বদলে জুড়ে বসল। হেডস্যার বললেন, যা তুই বড় হবি। তাহাজ্জত স্যার চলে যাবার পর আমাদের অতি প্রিয় নতুন স্যার এলেন। স্যার অসম্ভব স্বাস্থ্যবান। সুন্দর ফর্সা। গায়ে সুন্দর সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরেন। সাদা পাঞ্জাবি কাচার সময় নীলের বড়ি ভেঙে দেন। সাদা আরও মোহনীয় লাগে। স্যার মাঝে মধ্যে সেই নিল খান। অবাক ব্যাপার দুয়েক দিন আমরা ও দেখি। প্রতি দু’তিন সপ্তাহ পর নিজের বাড়ি ঘুরে আসেন। স্যার পড়া না পারলে বেজায় মারেন। বেত সবিশেষ ব্যবহার করেন না। স্যারের হাতের কবজি বেশ চিকন। কিন্তু মুষ্টি বেজায় মোটা। পড়া না পারলে সেই কবজি এবং বজ্রমুষ্টির ব্যবহার। আমাদের পিঠ শক্ত করে রাখতে হয়। স্যার মরলে দম বন্ধ করে রাখি। নইলে দম আটকে যায়। একবার স্যারের কিল খেয়ে কিতাব আলীর সেই অবস্থা। কিতাব আলী এমনিতেই নড়চড় হীন ছেলে। স্যারের কিল খেয়েও তেমন নড়চড় করেনি। ওতেই ওর দম আটকানো অবস্থা। আমার নতুন স্যারের নাম মনির স্যার। লজিং থাকার কারণে স্যারের রাতের খানাটা আমাদের দিতে হয়। তবে যে যেদিন মার খাই সেদিন সে স্যারের খানা আনি না। এটা স্যারের প্রতি আমাদের পানিশমেন্ট। লেখাপড়ায় যারা দুর্র্বল স্যার বাড়িতে গেলে কামনা করি স্যার যেন পুরা সপ্তাহ বাড়িতে কাটিয়ে আসেন। স্যার যে এলাকা থেকে এখানে শিক্ষকতা করতে এসেছেন সে এলাকা এখান থেকে বহুদূর। ঐ এলাকার তিন স্যার আমাদের আশপাশে থাকেন। একজনের নাম তৈমুর লং, সেই সাইজের লম্বু। যদিও জহির উদ্দীন মুহাম্মদ বাবুরের পিতার নাম। আমরা স্যারের অসম্ভব লম্বা হওয়াকেই লং নামোর মাহাত্ম্য জানি। দ্বিতীয় জন আলাউদ্দীন বর্দী। নবাব সিরাজ উদদৌলার নানার বংশীয় লোক। দেখতেও ঠিক আলিবর্দীর অবিকল। রেপ্লিকা বলা যায়। বৃহস্পতিবার হলেই তিন স্যার যুক্ত করে বাড়ি চলে যান। আবার শনিবার হাজির হন। মহর শহর অন্য স্কুলের ফার্স্ট বয়। ওরা এখানে এসে আমাদের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ। ক্লাস থ্রিতে সেবার সুন্দর পরীক্ষা। ছাত্রছাত্রী অনেক। শীতকালে বার্ষিক পরীক্ষা হল। সবাইকে অবাক করে আমি ক্লাস থ্রি প্রথম হলাম। পুরা স্কুলেই রেকর্ড নম্বর পেলাম। রোকেয়া ৫ম শ্রেণীতে পরীক্ষা দিতে পারল না, ওর বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। তাহাজ্জত স্যার সেই কবেই চলে গেছেন। অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়ে নৌকা হারিয়ে রাজ্জাক ফিরে এল। ল্যাংড়া আনারকে ভালো করার নিরন্তর চেষ্টা সত্ত্বেও জন্তু জানোয়ারের মত উপুড় হয়ে মরে পড়ে আছে। ওর ঠ্যাং কোনো দিনই সোজা করা গেল না। মৃত্যুর পরও ওকে ঠ্যাং বাঁকানো অবস্থায় কবর দেয়া হল। আমরা সবাই ওর গোরস্থানে গেলাম। মুখখানা খুলে দেখালো। অসহায়ের হাসিমাখা মুখ নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে। শীতের আকাশ রাঙিয়ে নতুন সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। স্কুলঘর আলোকিত হয়ে সে আলো গড়িয়ে পড়ছে পুরো মহল্লায়। পাশের ক্লাস রুম থেকে অজস্র কণ্ঠ ভেসে আসছে। এক একে এক, দুই একে দুই, তিন একে তিন। জিয়াউল একবার স্যারকে ফালা নিয়ে তাড়া করার জন্য ফালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বেকারের মত দাঁড়িয়ে দিন কাটাচ্ছে। জিয়াউলের পিতা ফালা দিয়ে গোখরা শিকার করেছিল। সে নিজেই গোখরার শিকার। লাঠি হাতে আরেকজন প্রতিবেশী সেকেন্ড স্যারকে মারতে চেয়েছিল। অল্প বয়সেই অনেক সম্পদ রেখে চলে গেলেন। স্কুল আঙিনায় এসে দেখি আমার সেই প্রিয় হেড স্যারও নেই। বছর দুই আগে বেহেশত নসিব হয়েছে। বুকের উপর একটা পাথর চেপে বসল। সে পাথরটা সরাতে পারবো বলে মনে হয় না। শীতের কুয়াশা, জীবনটাও কেমন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা লাগছে। এতদিন পর স্কুলে গিয়ে স্কুলের আঙিনায় অজানা অচেনা পথিকের মত বসে পড়লাম। ভেজা চোখে স্কুলঘরের দিকে তাকালাম। (সমাপ্ত)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ