রহস্যে ভরা সমুদ্র

রহস্যে ভরা সমুদ্র

বিশেষ রচনা রফিক রইচ নভেম্বর ২০২৩

আমাদের জীবনে সমুদ্রের গুরুত্ব অনেক বেশি। কী নেই এই সমুদ্রে! উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, প্রাণী বৈচিত্র্য, অর্থনৈতিক  বৈচিত্র্য সর্বোপরি সৌন্দর্য বৈচিত্র্যে ভরাট হয়ে আছে সমুদ্রের উদর। আছে আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন, মেঘ, বৃষ্টি ও নানা অনিয়ম, অন্যায়, জুলুমের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠার শিক্ষা। আছে হরেক রকম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সহজ সরল পরিষ্কার বিবরণ। আছে শিহরিত হয়ে ওঠার মতো রংধনু রহস্য ও বিশে^র আজব বিস্ময়। যে কারণে সমুদ্রকে নিয়ে ছড়াকার, কবি, কথাসাহিত্যক ও গবেষকদের লেখার কোনো শেষ নেই। গবেষণার অন্ত নেই। নির্মাতাদের নাটক ও সিনেমা বানানোর শেষ নেই। সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি গ্রন্থ পবিত্র আল কুরআনে সমুদ্র নিয়ে যা বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর সত্যতা কতখানি সেটা দেখার জন্য, জানার জন্য বিভিন্ন ধর্মের নানা বর্ণের মানুষেরও যেন কৌতূহলের শেষ নেই। এসব নানাবিধ কারণে সমুদ্র আমাদের কাছে টানে তার নিজস্বতায়, স্বকীয়তায়। আর আমরাও আমাদের জীবন যাপনের প্রয়োজনে সমুদ্রের কাছে যাই। এ যেন এক আশ্চর্য চুম্বকীয় ব্যাপার। সমুদ্র এবং মানুষ যেন চুম্বকের মতোই দুটো বিপরীত মেরু। উত্তর ও দক্ষিণ মেরু। যে মেরুদ্বয় পরস্পরকে আকর্ষণ করে, কাছে টানে, মায়া জাগায়, সবাইকে মিলিত করে।

মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআনে সূরা আন-নাহলের ১৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেন-

“আর তিনিই সেই সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশত খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার অলংকারাদি, যা তোমরা পরিধান কর। আর তাতে নৌযান দেখবে তা পানি চিরে চলছে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার এবং যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।”

সূরা আল ফাতির এর ১২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

“আর দু’টি সমুদ্র সমান নয়, একটি খুবই সুমিষ্ট ও সুপেয়, আরেকটি অত্যন্ত লবণাক্ত আর প্রত্যেকটি থেকে তোমরা তাজা গোশত খাও এবং আহরণ কর অলংকার যা তোমরা পরিধান কর। আর তাতে দেখ নৌযান পানি চিরে চলাচল করে। যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।”

দু’টি আয়াতেই আল্লাহ সমুদ্রের তাজা গোশত বলতে মাছকে বুঝিয়েছেন আবার এ থেকে অলঙ্কারাদির কথা বলেছেন। অলঙ্কার কিন্তু শুধু সামুদ্রিক মাছ থেকেই হয় না, বরং নানান শৈবাল ঝিনুক বা অন্য জলজ প্রাণী থেকেও হয়। 

মাছ বা মৎস্য (ঋরংয) হলো শীতল রক্তবিশিষ্ট মেরুদণ্ডী জলজ প্রাণী যারা কাঁটাযুক্ত জোড় বা বিজোড় পাখার সাহায্যে চলাচল করে, ফুলকার সাহায্যে শ^াসকার্য চালায় এবং দেহত্বক আঁইশে আবৃত বা নগ্ন থাকে। যেমন রুই, কাতলা, শিং, মাগুর (স্বাদুপানি) রূপচাঁন্দা, ফলিচাঁন্দা, মাইট্ট্যা, কালোপোয়া (সামুদ্রিক) ইত্যাদি। পক্ষান্তরে সকল অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলজ বা অর্ধজলজ জীব বা প্রাণীদের মাৎস্য (ঋরংযবৎরবং) বলে। এখানে মাছসহ অন্যান্য সকল জলজ ও অর্ধজলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন বিভিন্ন ধরনের মিঠাপানির বা সামুদ্রিক মাছ, শক্ত খোলকাবৃত্ত মাছ (আসলে মাছ নয় এগুলো মাৎস্য) যেমন চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক, কচ্ছপ, কুমির ইত্যাদি। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল ও নানা প্রকার উদ্ভিদও এর অন্তর্ভুক্ত। মূলত এগুলোর সবকিছু থেকে আল্লাহ আমাদের আহার করতে বলেছেন এবং অলঙ্কার পরিধানের কথা বলেছেন। দয়াময় রব সূরা আল মায়িদার ৯৬ নং আয়াতে বলেছেন-

“তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য, তোমাদের ও মুসাফিরদের আহারের জন্য।”


আমরা তো জানি বাংলাদেশে স্বাদু পানির মাছ মোহনাজলসহ ২৬০ প্রজাতির পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায় ৪৭৫ প্রজাতির। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইলিশ, রূপচাঁন্দা, ট্যাকচাঁন্দা, ফলিচাঁন্দা, মাইট্টা, উড়–ক্কু মাছ, হাউস পাতা, ফাঁসা, পেখম ময়ূরী, কালো পোয়া, রাঙ্গা কই, কুরাল, সাদাপোয়া, প্রজাপতি, পটকা, সোনালি বাটা, করাত হাঙ্গর, হাতুড়ি হাঙ্গর, মইচ্ছা হাঙ্গর, থুট্টা হাঙ্গর ইত্যাদি। 


অনেক প্রজাতির এসব মাছ ছাড়াও বাহারি রঙিন ও আজব আকৃতির মাছে সমুদ্রের রাজকীয় রাজ্য সাজানো হয়েছে। যেগুলোর রঙ আর আকৃতির কারুকাজ দেখলে চোখ শীতল হয়ে আসে। ওদের নড়াচড়া দেখলে হৃদপিণ্ড সতেজ ও বেশি কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। ভালোলাগায় ভরে ওঠে মনের খারাপ লাগার আঙিনা। 

সেসব মাছ অ্যাকুয়ারিয়ামে বা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখা যায়, সেসব রঙিন মাছের মধ্যে সোর্ডটেইন মাছ, গাম্বুসিয়া মাছ, কাউফিশ,পার্কুপাইন ফিশ, ডগফিশ, সাগরের রুফ, পাইপ ফিশ, গার্নার্ড, লালর্তুত, সমুদ্র ড্রাগন, গারফিশ, সাগর মাগুর, অ্যাঞ্জেল মাছ, প্যারট মাছ, স্করপিয়ন ফিশ, ঘোড়া মাছ ইত্যাদি।

চিংড়ি পাওয়া যায় ৩৬ প্রজাতির, শামুক ঝিনুক পাওয়া যায় ৩৩৬ প্রজাতির, লবস্টার পাওয়া যায় ৩ প্রজাতির, কচ্ছপ পাওয়া যায় ৭ প্রজাতির, কাঁকড়া পাওয়া যায় ১৬ প্রজাতির, ব্যাঙ পাওয়া যায় ১০ প্রজাতির, সাপ পাওয়া যায় ২৪ প্রজাতির, ভোঁদড় পাওয়া যায় ৩ প্রজাতির, ডলফিন পাওয়া যায় ৯ প্রজাতির, তিমি পাওয়া যায় ৩ প্রজাতির, শৈবাল পাওয়া যায় ১৬৮ প্রজাতির। 

আমাদের সমুদ্রসীমায় আহরিত মাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ইলিশ। এটি আমাদের জাতীয় মাছ। জেলেদের জালে প্রতি বছর ধরা পড়ে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ। এর মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের রুটি রুজির সংস্থান হয়। গর্বের বিষয় হলো সারা পৃথিবীতে বর্তমানে যত পরিমাণ ইলিশ আহরিত হয় তার ৫০-৬০ শতাংশই আসে আমাদের সমুদ্রসীমা তথা বঙ্গোপসাগর থেকে। ভারতে ধরা পড়ে ১৫-২০ শতাংশ এবং মিয়ানমার তথা বার্মায় ধরা পড়ে ২০-২৫ শতাংশ। বাদ বাকি ৫-১০ শতাংশ অন্যান্য দেশগুলো থেকে। এছাড়া বাগদা ও গলদা চিংড়ির বিশাল সম্ভাবনার আধার আমাদের সমুদ্রসীমা। যা আমাদের অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। 

গত ২০২২ এ যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের দু’টি প্রতিষ্ঠানের সাথে আমাদের সমুদ্রসীমায় জরিপ কাজ করেছে। ফলাফলে বলা হয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অনেক পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও- সি-উইড ২২০ প্রজাতির , সামুদ্রিক মাছ পেয়েছে ৩৪৭ প্রজাতির, ঝিনুক পেয়েছে ৪৯৮ প্রজাতির, চিংড়ি পেয়েছে ৫২ প্রজাতির, লবস্টার পেয়েছে ৫ প্রজাতির, কাঁকড়া পেয়েছে ৬ প্রজাতির, সি-গ্রাস পেয়েছে ৬১ প্রজাতির। 

এবার সামুদ্রিক বর্ণিল শৈবাল বা শেওলা ও নানা প্রজাতির উদ্ভিদ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেওয়া যাক। প্রথমত, প্রশান্ত মহাসাগর বা সমুদ্রের উদ্ভিদের বেশি অংশই হলো ফাইটোপ্লাঙ্কটন। এগুলো এককোষী শৈবাল। এদের প্রজাতির সংখ্যা ১.৩ হাজারের বেশি। তাছাড়া ৪০০ প্রজাতির শৈবাল ২৯ প্রজাতির ঘাস রয়েছে। তবে দৈত্য  শৈবাল এর অন্যতম যা ২০০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছপালার মধ্যে- এককোষী শৈবাল, ডায়াটমস, কেল্প, ক্লাডোফোরাস, স্টিম্পসন, উলভা ছিদ্রযুক্ত, জোস্টেরার সমুদ্র ইত্যাদি।


আর্কটিক মহাসাগরে ২০০ প্রজাতির শৈবালসহ ফুকাস, অ্যানফেলসিয়া, ব্লাকজ্যাক নামের মন হরণকারী উদ্ভিদ পাওয়া যায়। আটলান্টিক মহাসাগরে প্রাপ্ত উদ্ভিদের মধ্যে ফাইটোপ্লাঙ্কটনসহ গাঢ় সবুজ শৈবাল, ফিলোস্প্যাডিক্স, বাদামি শেওলা, ম্যাক্রোস্পিস্টিস, হন্ড্রাস, লাল শেওলা ইত্যাদি বিদ্যমান রয়েছে।

ভারত মহাসাগরে উদ্ভিদের মধ্যে সবুজ, লাল ও বাদামি শেওলা রয়েছে। এগুলোকে সি-উইড বলা হয়। যার আক্ষরিক অর্থ হলো সামুদ্রিক আগাছা বা এক ধরনের শৈবাল। এগুলো সালোক সংশ্লেষকারী ফুলহীন উদ্ভিদ যা সাধারণত সাগরের তলদেশে জন্মায়। এর কোনো শেকড় ডালপালা ও পাতা থাকে না। তিন ধরনের সি-উইডের মধ্যে সবুজটি সাধারণত খাবার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া এসব শৈবাল ডেইরি, ঔষধ, টেক্সটাইল, কাগজ শিল্প জেল জাতীয় কাজে ব্যবহার হয়। বিভিন্ন প্রসাধনী, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে ২২০ প্রজাতির সি-উইড চিহ্নিত করা হয়েছে। যা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলবে। এছাড়া এই সাগরে ম্যাক্রোসাইটিস ফুকাস, নীল সবুজ শেওলা, পসিডোনিয়া ইত্যাদি উদ্ভিদ পাওয়া যায়। 

দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্যভাণ্ডার কখনো ফুরালে সামুদ্রিক শৈবালই আগামী দিনের খাদ্য ও পুষ্টির ভাণ্ডার হবে। যে সকল উদ্ভিদ সমুদ্রের উপকূলে এবং গভীরতায় অবস্থান করে সামুদ্রিক শোভাবর্ধন করে সেগুলো হলো- অ্যাভিসেনিয়া জীবাণু, সাইমোডেসিয়া নোডোসা, হ্যালোডুলে রিঘিটাই, পসিডোনিয়া সামুদ্রিকা, স্পার্টিনা অলটার্নিফ্লোরা, জোস্টের মেরিনা। 

সৈকতে যেসব গাছপালা থাকে সেগুলো হলো- এলিসাম লয়েজেলুরি, আর্মেরিয়া পাঞ্জা, অ্যাসপ্যারাগাস ম্যাক্রোরিহিজাস, ক্রিটমাম মেরিটিয়াম, এরিঙ্গিয়াম সমুদ্রবাহিনী, পিনাস হেলিপেনসিস। 

আমরা যেমন টাকা পয়সা সোনাদানা অলংকার নিরাপত্তার বেষ্টনী দিয়ে রাখি সমুদ্রও কিন্তু এর বাইরে নয়। নানা রহস্য রোমাঞ্চ ও বিপদসংকুল পরিবেশেই সমুদ্র তার উদরস্থ সোনাদানা খনিজসম্পদ লুকিয়ে রাখে। যে কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদ এখনো মানুষের হাতে আসেনি। এসব সম্পদের বেশির ভাগটাই ঘুমিয়ে রয়েছে সমুদ্রের রাজ প্রাসাদের গহীন গহ্বরে।

ফোর্বসের একটি প্রতিবেদনে ভূ-গবেষক ট্রেভরনেস জানিয়েছেন- সমুদ্রের অতলেই লুকিয়ে আছে ২ কোটি টন সোনা। কতজন এসেছে এ সোনার খোঁজে। তবে পায়নি কেউ। এখনো এসব সম্পদ অধরাই রয়ে গেছে। 


সমুদ্রের তলদেশে মজুদ থাকা সোনার পাশাপাশি সমুদ্রে ভেসে বেড়ায় ভাসমান সোনা। এ ভাসমান সোনা হলো- স্পার্ম হোয়েল বা তিমির পরিপাকের সময় এক ধরনের মোমজাতীয় পদার্থ বের হয়, স্পার্ম হোয়েল বা তিমির সেই মুখ নিঃসৃত পদার্থকে আঞ্চলিক কথায় তিমির বমিও বলে। এর ভালো নাম হলো- অ্যাম্বারগ্রিস। এই অ্যাম্বারগ্রিস বা তিমির এই বমিকেই সমুদ্রের ভাসমান সোনা বলে।


এটি খুবই মূল্যবান সম্পদ বিশ^বাজারে। যা সোনার মূল্যকেও হার মানায়। এর কেজি প্রতি মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকার উপরে। কারণ এই পদার্থ বা অ্যাম্বারগ্রিস বা তিমির বমি থেকেই দামি সুগন্ধি বা পারফিউম তৈরি হয়। কখনো কখনো এটি প্রায় ৯-৩০ কেজি আকারে তিমির শরীর থেকে বের হয়ে সমুদ্রের পানিতে ভেসে থাকে। এগুলোকে খুঁজে পেয়ে অনেক জেলে কোটিপতি হয়েছে। তবে বিভিন্ন দেশ এটিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসাবে ঘোষণা করেছে। এর ক্রয় বিক্রয় দণ্ডনীয় অপরাধ। একটি কথা বলে রাখি, তিমি কিন্তু মাছ নয়। এটি মানুষের মতো জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী। তিমিকে আরেকটি কারণে মাছ বলা যাবে না। সেটি হলো মাছ শ^াস নেয় ফুলকার সাহায্যে কিন্তু তিমি শ^াস নেয় আমাদের মতো ফুসফুসের সাহায্যে। 

সমুদ্রের তলদেশ সোনার পাশাপাশি আমাদের অতিপ্রয়োজনীয় মূল্যবান খনিজসম্পদ ভরে আছে। এর মধ্যে শত সহ¯্র টন তেল, গ্যাস অন্যতম। আমাদের বঙ্গোপসাগরেও এর পরিমাণ কোন অংশে কম নেই। পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে- এখানে রয়েছে ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম। ১৩টি স্থানে সোনার চেয়ে মূল্যবান বালি। যাতে মিশে আছে গার্নেট, সিলিমানাইট, জিরকন, ইলমেনাইট, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট। অগভীর স্থানে জমে ‘ক্লে’ যার পরিমাণ হিমালয়কেও হার মানায়। যেটা দিয়ে তৈরি হয় সিমেন্ট। দামি তেল ও গ্যাসের সন্ধানও মিলেছে। 

সমুদ্রের অথই পানির তলদেশে আছে আগুন। আগ্নেয়গিরি। অথচ পানি ও আগুন পরস্পর বিরোধী। অনেকটা সাপ আর নেউলের মতো ব্যাপার। কিন্তু তারপরেও সমুদ্রে ধরে যায় আগুন। আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভা বের হয়ে আসে সমুদ্রের অথই পানির বুক চিরে। পবিত্র আল কুরআনে এ ব্যাপারে সূরা আত তাকভীরের ৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন- “যখন সমুদ্রগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে।” সূরা ইনফিতারের ৩ নং আয়াতে মহান রব বলেছেন- “যখন সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলা হবে বা সমুদ্রকে ফাটিয়ে ফেলা হবে।”

বর্তমানে বিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্যমতে পৃথিবীতে সমুদ্রের নিচে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সংখ্যা ১০০ থেকে ১০০০ এর মধ্যে। এইসব আগ্নেয়গিরি শুধুমাত্র আগুনের দগদগে লাভাই ছড়ায় না, অনেক ছাইও তৈরি করে। পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরি সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর চার ভাগের তিন ভাগই ঘটে সমুদ্রের তলদেশে। কী আজব রহস্য সমুদ্রের শরীরে লুকিয়ে রয়েছে! 


সূরা রুমের ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- “স্থলভাগ এবং জলভাগের মধ্যে যা কিছু পরিবর্তন হয়েছে বা বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে তা তোমাদের দুই হাতের কামাই।”

অর্থাৎ আমরা শান্ত পরিবেশকে অশান্ত বানিয়ে ডেকে নিয়ে আসি বিপদ। যে বিপদের কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত জান ও মালের ক্ষতি হচ্ছে। 

বাংলাদেশ সরকারি তথ্যানুসারে ১৯৬০-২০১৭ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৩৩টি বড় বড় সাইক্লোন আঘাত হেনেছে সমুদ্র থেকে। 


বাংলাদেশে যত বড় বড় ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হলো ১৯৭০ এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়। এর পরেই রয়েছে সাইক্লোন সিডর। এসব ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক। লাখ লাখ লোক প্রাণ হারায় এসব ঘূর্ণিঝড়ে। তাছাড়া গরু বাছুর, হাঁস-মুরগিসহ নানা অর্থনৈতিক সম্পদ মাটির সাথে মিশে দিয়ে গেছে এসব ঘূর্ণিঝড়। এছাড়াও বাংলাদেশে যেসব ঘূর্ণিঝড় ইতোমধ্যে আঘাত হেনে ফসলের জানমালের ক্ষয়ক্ষতিসহ সহস্র পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে তাদের মধ্যে আইলা, বাকেরগঞ্জের ঘূর্ণিঝড়, ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, মাহাসেন, কোমেন, রোয়ানু, মোরা, মোখা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রে সৃষ্টি হয় এবং আঘাত হানে আমাদের জনপদে। প্রতিশোধ নিয়ে সমুদ্র একসময় শান্ত ও সুনীল হয়। তখন মনে হয় না এই ভালোবাসা ও মায়ার সমুদ্র লাখ লাখ মানুষ ও মানুষের জানমাল পরিবার পরিজনদের জীবনকে করে দিয়েছে তছনছ ও লণ্ডভণ্ড। এগুলো পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্টি হয় যার জন্য মানুষই সবচেয়ে বেশি দায়ী। আমাদের এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে হবে। সচেতন হয়ে উঠতে হবে সমুদ্র দূষণের ব্যাপারে। জানতে হবে কী কী কারণে হচ্ছে সমুদ্র দূষণ। যেগুলো সমুদ্র দূষণ ঘটায় সেগুলোর নাম কী? মূলত মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণেই প্রতিনিয়ত সমুদ্রের পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। আমরা এমনটি চাই না। যে সব কারণে সমুদ্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেগুলো হলো- (ক) প্লাস্টিক বর্জ্য (খ) কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ (গ) সামুদ্রিক জাহাজের বর্জ্য প্রভৃতি।

যাহোক সমুদ্রের কারণে হয়তো আমাদের জনজীবনে মাঝে মাঝে নেমে আসে দুর্যোগ দুর্ভোগ তারপরও আমাদের জীবনের বিকাশে এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনে সমুদ্রের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের বসবাস উপযোগী পৃথিবী নামক এ গ্রহের তিন ভাগ পানি এবং এক ভাগ স্থল বা মাটি। এ পৃথিবীর প্রায় ১০০ কোটি মানুষের আমিষ বা প্রোটিনের চাহিদা মিটিয়ে থাকে এই বিস্ময়কর সমুদ্র তথা মহাসাগর। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এই সমুদ্রের সাথে বিশে^র প্রায় ৪ কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে সংযুক্ত থাকবে। মহান প্রভুর সৃষ্টি এই রহস্যময় সমুদ্রের ওপর রয়েছে আমাদের আনন্দ বিনোদনের নির্ভরশীলতা, মানবিক বিকাশের ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে শিল্পিত বেঁচে থাকার নির্ভরশীলতা। তাই আমাদের প্রয়োজনেই সম্পদ স¤্রাট সমুদ্রের যত্ন নেওয়া একান্ত জরুরি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ