রমজান নিয়ে এলো রহমের দিন

রমজান নিয়ে এলো রহমের দিন

প্রবন্ধ নিবন্ধ আবু মিনহাল জাদীদ মার্চ ২০২৪

নতুন চাঁদ তো প্রতিমাসেই ভেসে ওঠে আকাশের সুনীল দরিয়ায়। কাঁচির মতো বাঁকা এ চাঁদ উঠলেই শুরু হয়ে যায় চান্দ্রবছরের একেকটি মাস। এ মাসগুলো কখনও উনত্রিশ দিনের আবার কখনও তিরিশ দিনের। কোন মাস কতদিনের হবে, তা নির্ধারিত নয়। বরং তা চাঁদ দেখার ওপরই নির্ভরশীল। 

সব চাঁদের কথা আমরা মনে রাখি না। সব মাসের চাঁদের উদয়পথেও আমরা চেয়ে থাকি না।

কিছু চাঁদ আমাদের বড়ো ভালোবাসার! সে এলেই আমরা আনন্দে দুলে উঠি বাঁধভাঙা নদীর মতো। তার একটি- রমজানের চাঁদ! এ চাঁদ আমাদের রহমতে ডুবিয়ে রাখে দীর্ঘ এক মাস। আমরা অনুভব করি বেহেশতের অনাবিল সুবাস। রাইয়্যান দরজা দিয়ে যেন আমাদের ঘরে নেমে আসে সালসাবিলের ঢেউ! তারপর আরেকটি চাঁদ আমাদের অপেক্ষায় রাখে। অবশেষে হাজির হয় রাজপুত্রের মতো। সে হলো শাওয়ালের চাঁদ। ঈদের চাঁদ। 

রমজানের চাঁদ দেখে নবীজিও খুশি হয়ে যেতেন, স্বাগত জানাতেন তাকে। দোয়া করতেন হৃদয় খুলে- ‘হে আল্লাহ! আমাদের ওপর এ চাঁদ উদয় করো বরকত ও ঈমানের সাথে। শান্তি ও ইসলামের সাথে। হে নতুন চাঁদ! আল্লাহ তায়ালা আমারও প্রভু, তোমারও প্রভু’। (তিরমিজি)

রমজান হলো হিজরি সনের নবম মাস। এ মাস কেন এত অনুপম? এ মাস নিয়ে কেনই-বা এত আলোচনা, এত আয়োজন?


প্রথম ওহীর আলো

নবীজি তখন হেরাগুহায় একাকী সময় কাটান। সমাজ থেকে, জনমানুষ থেকে আলাদা থাকছেন তিনি। হয়তো তাঁর হৃদয়ে কোনো শূন্যতা বিরাজ করছে। কী এক হাহাকার তাকে ভাবিয়ে তুলছে অবিরাম! না দেখা, না জানা কোনো পরম দয়ালুর রহম দরিয়ায় তিনি ডুবছেন তো ডুবছেনই। তিনি জানতেন না, তাঁর এ ভাবনার রহস্য ভেদ করে অচিরেই নেমে আসবে আসমানী কালাম।

একরাতে!

একরাতে জিবরিল এলেন তাঁর কাছে! বললেন- ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। পড়ো, তোমার রব তো মহামহিম। যিনি কলমের সাহায্যে শিখিয়েছেন। এমন কিছু শিখিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না’! (সূরা আল আলাক: ১-৫)

আল কুরআনের এ প্রথম আলো নাজিল হয়েছে রমজান মাসেই। লাইলাতুল কদর তথা কদরের রাতে। মর্যাদার রজনীতে! এ কারণেই রমজানের এত দাম!


হাজার মাসের সৌরভ 

লাইলাতুল কদর কী?

লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমজানের শেষ দশদিনের কোনো এক বেজোড় রজনি। একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাতাশ কিবা উনত্রিশ। এ রাত যেন এক শীতল মখমল। জোছনাধোয়া রুপালি ঈদ। হাজার মাসের ইবাদাতের সৌরভ মিশে আছে এর পরতে পরতে। আল্লাহ বলেছেন- ‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। ফেরেশতারা এবং জিবরিল এ রাতে নেমে আসে প্রতিটি কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতি নিয়ে। এ রাত শান্তির, ফজরের উদয়কাল অবধি’! (সূরা আল কদর : ৩-৫)

যে রাতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে ছুটে আসে, সে রাত কতই না নির্মল! কত ফেরেশতা আসেন সে রাতে? অসংখ্য। নবীজির ভাষায়, ‘তাদের সংখ্যা পাথরকুচির চেয়েও বেশি’! (মুসনাদ আহমাদ)

তারা আসেন সারা বছরের অবধারিত ঘটনাবলি নিয়ে, আসেন সবার ভাগ্যলিপি নিয়ে!

এ রাত আমরা কীভাবে পার করবো? ইবাদাতে, অবশ্যই ইবাদাতে। নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও জিকিরসহ সব ধরনের নেক আমলে। আর মহান করুণাময়ের কাছে দোয়া করবো অবিরত। আয়েশা (রা) নবীজিকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি কদরের রাত পেয়ে যাই, তাহলে কী দোয়া পড়বো? তিনি বললেন, তুমি বলবে- ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাকারী! আপনি তো ক্ষমা করতেই ভালোবাসেন! সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন’। (ইবনে মাজাহ)


মুছে যায় গোনাহের দাগ

রমজান মাসে রোজা রাখা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ। ‘তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে, সে যেন রোজা রাখে’- সূরা আল বাকারার ১৮৫তম আয়াতে এমন আদেশই দিয়েছেন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন। অবশ্য কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা সফরে থাকে, তার কথা ভিন্ন। সে অন্য কোনো সহজ সময়ে তা আদায় করে নেবে। আর ‘যে ঈমানের সাথে, সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা পালন করে, তার বিগত দিনের গোনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়’। (বুখারি)

রমজানের রাতে ইশার নামাজের পর শুরু হয় তারাবীহ্’র সময়। নফল নামাজ। এ নামাজ যারা আদায় করবে তাদের জন্যও রয়েছে একই সুসংবাদ। নবীজি বলেছেন-‘যে ঈমানের সাথে, সওয়াবের আশায় রমজানের রাতে নামাজ আদায় করে, তার বিগত দিনের গোনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়’। (বুখারি)

এভাবেই দিনের সিয়াম, রাতের কিয়াম মুমিনকে করে নিষ্পাপ! তার আমলনামা থেকে মুছে দেয় গোনাহের দাগ।


ডাকে রাইয়্যান

জান্নাতের কথা শুনতে কার না ভালো লাগে? যদি জান্নাতের দরজা খুলে যায়, আর আমাদের কাছে ছুটে আসে তার অনাবিল ঘ্রাণ- তাহলে কেমন হবে? হ্যাঁ, নবীজি তো এমন খবরই দিয়েছেন! রমজান এলেই তিনি বলতেন- ‘তোমাদের নিকট রমজান এসেছে। পবিত্র মাস। আল্লাহ তোমাদের ওপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসেই জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে করা হয় বন্দি...। (মুসনাদ আহমাদ) 

শুধু কি তা-ই?

‘জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোজাদাররাই প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, রোজাদাররা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে আর কেউ প্রবেশ না করে।’ (বুখারী)

রাইয়্যান! 


মিশ্কের ঘ্রাণ হার মানে

রোজাদারকে আল্লাহ ভালোবাসেন। ভীষণ ভালোবাসেন। কত ভালোবাসেন? তাঁর অসীম ভালোবাসা কি আর পরিমাপ করা যায়? অনুভব করা যায়? শুধু একটু ধারণা নেওয়া যায়। সারাদিন না খেয়ে থাকলে মুখে একধরনের দুর্গন্ধ তৈরি হয়। কোনো মানুষই এ গন্ধ পছন্দ করবে না। অথচ, নবীজি কসম করে বলেছেন- ‘অবশ্যই রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশ্কের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম’!  

মুমিন তো আল্লাহকে ভালোবেসেই রোজা রাখে। আহার-পানি ছেড়ে দেয় তাঁর খুশির জন্যই। অন্য সময়ের হালাল কাজও তাঁর আদেশে হারাম করে নেয় নিজের ওপর। আল্লাহ তাই পরম মমতায় ঘোষণা দিয়েছেন- ‘রোজা আমার জন্যই! আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো’! (বুখারী) 

আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার বুঝে নিতে পারে কেবল সৌভাগ্যবান রোজাদাররাই।


আনন্দের দুই নদী

সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে কেমন লাগে আমাদের? সেটা তো বলে বোঝানো যাবে না। যে রোজা রাখে, কেবল সে-ই জানে। এমন খুশির মুহূর্ত আমাদের জীবনে খুব কমই আসে। যেন ঈদের আগেই আরেক ঈদের উৎসব। তা-ও একদিনের ঈদ নয়, পুরো একমাস আমরা ভাসতে থাকি এ খুশির ঢেউতোলা নদীতে। এ ছাড়াও আরেক অপার আনন্দ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কী সেটা? নবীজির মুখ থেকেই শুনি- ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ। এক আনন্দ- যখন সে ইফতার করে। আরেক আনন্দ- যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে! (বুখারী)

এ-কি ভাবা যায়? স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে সাক্ষাৎ!

হ্যাঁ, বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য! ‘জান্নাতিগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবেন, আল্লাহ বলবেন- তোমরা কি চাও, আমি আরও কিছু বাড়িয়ে দিই? তারা বলবে, আপনি কি আমাদের চেহারা উজ্জ্বল করে দেননি? আমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাননি? জাহান্নাম থেকে নাজাত দেননি? নবীজি বলেন- এরপর আল্লাহ আবরণ তুলে নেবেন। আল্লাহর সাক্ষাতের চেয়ে প্রিয়তর কোনোকিছুই তাদের দেওয়া হয়নি’। (মুসলিম)

সুবহানাল্লাহ!

আমরা তো সেদিনেরই পথ চেয়ে আছি!


এসো রহম কুড়াই

রমজান মানেই রহমের দিন। সোনাঝরা মওসুম। এ মওসুমে আমের মুকুলের মতো ফুটে থাকে সওয়াবের ফুল।  রোজাদার হাত তুললেই দোয়া কবুল হয়ে যায় এ মাসে। তার জন্য রোজা হয়ে যায় ঢাল। রক্ষা করে জাহান্নামের লেলিহান আগুন থেকে।

‘কিয়ামতের দিন রোজা এবং কুরআন উভয়েই আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে মানুষের জন্য।  রোজা বলবে- হে আমার রব! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার জন্য আমার সুপারিশ তুমি গ্রহণ করো। কুরআন বলবে- হে আমার রব! রাতের ঘুম থেকে তাকে আমি দূরে রেখেছি। (জেগে জেগে সে আমাকে তিলাওয়াত করেছে) সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করো। রাসূল (সা) বলেছেন, সেদিন উভয়ের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে।’ (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব)

এ মাসে আমরা পরিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতা করতেই পারি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ