মহানবীর (সা) যুগে ঈদ উৎসব

মহানবীর (সা) যুগে ঈদ উৎসব

প্রবন্ধ নিবন্ধ সাকী মাহবুব এপ্রিল ২০২৪

পৃথিবীর সব জাতিরই সুনির্দিষ্ট কিছু উৎসব রয়েছে। ইসলাম পূর্ব জাহেলি যুগেও আরবে নওরোজ ও মেহেরজান নামের দু’টি উৎসব ছিল। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের এর চেয়ে উত্তম দু’টি উৎসব উপহার দেন। তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। মহানবী (সা) তাঁর জীবনে দেখিয়েছেন এসব উৎসবের তাৎপর্য। কীভাবে তিনি ঈদ পালন করতেন এবং কীভাবে ঈদের দিন সময় কাটাতেন, সেদিকে তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। যার প্রতিটি ধাপে ও উদ্যোগে ছিল সৌন্দর্য চর্চা ও শুদ্ধাচারের সুতীব্র প্রভাব। আনন্দের সাথে আধ্যাত্মিকতার এক মিশ্রিত অনুভূতিতে নিজেকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। যা সর্বকালের, সর্বযুগের কালজয়ী আদর্শ হিসেবে ইতিহাসের সোনালি পাতায় অক্ষয় হয়ে আছে। তাহলে এসো প্রিয় নবীর (সা) ঈদ উৎসব কেমন ছিল তা একটু জেনে নেই।


ঈদের নামকরণ

ঈদ শব্দটি আরবি। আরবি ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে  ঈদ শব্দটির অর্থ আনন্দ, খুশি, আমোদ, আহলাদ, উৎসব, পর্ব ইত্যাদি। শব্দের মূল রূপ হলো আওদ। যার অর্থ বারবার ফিরে আসা। পুনঃপুন ফিরে আসা। মুসলমানদের জাতীয় জীবনে ঈদ বারবার ফিরে আসে। ঈদের দিন অত্যন্ত পুণ্যময়, এদিন ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই বিশেষ দিন মুসলমানদের জীবনে বছরে দু’বার ফিরে আসে। এজন্য একে ঈদ বলা হয়। বছরের এই দু’টি বিশেষ উৎসবকে ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় বলা হয় ঈদ। এর একটি ‘ঈদুল ফিতর’ অন্যটি ‘ঈদুল আজহা’। ঈদের দিন বিশ্ব মুসলিম পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে গিয়ে ছোটো-বড়ো, ধনী-গরিব, আমির-ফকির  একই কাতারে দাঁড়িয়ে এই বিশেষ ইবাদত করে থাকে। উম্মতে মুহাম্মদিকে (সা) আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কিছু বরকতময় অনুষ্ঠান প্রদান করেছেন, যা অন্য কোনো নবী-রাসূলের কাওম লাভ করেনি। তন্মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা, প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে এক অনুপম দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের অনুষ্ঠান ঈদ।


ঈদ চালু হয় যেভাবে

মহানবী (সা) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর ঈদের প্রবর্তন হয়। তিনি মদিনায় গিয়ে দেখতে পেলেন পারসিক প্রভাবে মদিনাবাসীরা শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ উৎসব এবং বসন্তের পূর্ণিমায়  ‘মেহেরজান’ উৎসব নিয়মিতভাবেই উদযাপন করছে। এই উৎসবগুলোতে তারা বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ মেলা করতো, যা ছিল উচ্ছৃঙ্খলা, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার মহড়া। মহানবী (সা) মুসলমানদের এই উৎসব দু’টি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। তিনি হযরত আবু বকর (রা)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির আনন্দ-উৎসব রয়েছে। আর আমাদের আনন্দ উৎসবের দিন হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। (বুখারী)

হযরত আনাস বিন মালেক (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আসেন তখন তিনি জানতে পারলেন, মদিনার আনসারগণ বছরে দু’দিন (শরতের পূর্ণিমায় ও বসন্তের পূর্ণিমায়) অত্যন্ত ধুমধামসহ নির্দিষ্ট দু’টি উৎসব পালন করে, রাসূল (সা) তখন তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এই দিনগুলো কোন দৃষ্টিতে তোমরা পালন করো?  জবাবে তারা বললো, আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ এই দু’টি উৎসব পালন করে আসছে, তাই আমরাও পালন করছি। তখন রাসূল (সা) বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এই দুই দিনের পরিবর্তে এখন থেকে অন্য দু’টি দিন মুসলমানদের উৎসবের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। একটি হলো ঈদুল ফিতরের দিন অন্যটি হলো ঈদুল আজহার দিন। (সুনানে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)


মদিনায় প্রথম ঈদ

মুসলমানরা প্রথম ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়ে দ্বিতীয় হিজরি মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মার্চ বা ৩১ মার্চ। তখনকার দিনে বর্তমান ঈদের মতো নতুন জামা-কাপড়, কেনাকাটার ধুমধাম ছিল না। তবে আনন্দ-খুশি কম ছিল না। মহানবী (সা) ঈদের দিন ছোটো বড়ো সবার আনন্দের প্রতি লক্ষ রাখতেন। মদিনার ছোটো ছোটো শিশু কিশোরদের সঙ্গে তিনি আনন্দ উদযাপন করতেন। শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত সব আনন্দ করার অনুমতি দিতেন।


মহানবী (সা) যেভাবে ঈদ উদযাপন করতেন

মহানবী (সা) ঈদের দিন গোসল করতেন, সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। ঈদুল ফিতরে কিছু মিষ্টি দ্রব্য খেতেন। হাদিসে এসেছে ঈদুল ফিতরের দিনে সকালে খেজুর খেতেন। অন্য এক বর্ণনামতে, তিনি বিজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন। তবে ঈদুল আজহায় কিছু খেতেন না। কুরবানির গোশত দিয়ে দিবসের প্রথম খাবার খেতেন। ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যেতেন, অন্য রাস্তা দিয়ে আসতেন। তিনি ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাতেন। গরিব-দুঃখীদের খোঁজ-খবর নিতেন। অতঃপর ঈদগাহে গিয়ে অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। নামাজ শেষ করে খুতবাহ দিতেন। ঈদুল ফিতরের খুতবায় ঈদের করণীয় কাজ এবং ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব বর্ণনা করতেন।


সাহাবায়ে কেরামদের ঈদ

সাহাবিরা যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি তাঁদের একনিষ্ঠ ভালোবাসা, ইসলামের জন্য ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ তাঁদের চির স্মরণীয় করেছে ইতিহাসের পাতায়। তাঁদের অনুসৃত পথ সঠিক ও নির্ভুল পথ। সাহাবায়ে কেরামের জীবন ও চরিত্র আমাদের আদর্শ নমুনা। তাঁরা কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের জন্য তারকাতুল্য ও অনুসরণীয়। মহানবী (সা)-এর আদর্শের চমৎকার নিদর্শন সাহাবায়ে কেরামদের ঈদ কেমন ছিল তা থেকেও  আমরা ঈদ উদযাপনের ধারণা নিতে পারি। সাহাবায়ে কেরাম জীবনের সর্বক্ষেত্রে মহানবী (সা)-এর অনুকরণ ও অনুসরণ করতেন। তাঁরা এ বাক্যের মাধ্যমে ঈদের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন ‘তাকাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থাৎ মহান আল্লাহ আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। 

সাহাবায়ে কেরাম মাহে রমজানে গুনাহ মাফ হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে বেশি চিন্তিত থাকতেন। তাই আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর ফারুক (রা) ঈদুল ফিতরের নামাজে ইমামতি করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতেন। তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে বলতে থাকেন, আমার গুনাহ মাফ না হলে আমি ঈদগাহে গিয়ে কীভাবে ইমামতি করতে পারি? তাঁদের ঈদে নতুন জামা, জুতা ও খাওয়াদাওয়ার ধুমধাম ছিল না। তবে আনন্দ কম ছিল না। মহানবী (সা)-এর সান্নিধ্য লাভ করা, তাঁকে কাছে পাওয়া, তাঁর নির্দেশ পালন করাই ছিল তাঁদের প্রকৃত আনন্দ। ঈদের দিন অনেক দূর থেকে সাহাবায়ে কেরাম ছুটে যেতেন মহানবী (সা)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এবং তার পেছনে দুই রাকাত নামাজ পড়ার জন্য।

এক ঈদুল ফিতরের দিনে হযরত ওমর (রা) কাঁদছেন খুব অঝোরে। সবাই যার যার মতো করে আনন্দ করছেন। হঠাৎ সাহাবারা খেয়াল করলেন ওমর (রা) কাঁদছেন। অবাক হয়ে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কাঁদছেন? এই ঈদের দিনেও। তখন ওমর (রা) জবাব দিলেন, আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ ইবাদত করে গুনাহ মাফ করে নিতে পারলো না, সে ধ্বংস হোক। এখন রোজা শেষ হয়ে আজ ঈদের দিন। আমি এখনও জানি না আমার গুনাহ মাফ হয়েছে কি না? আমি কীভাবে নিশ্চিত হয়ে ঈদ আনন্দ করি? 

হযরত আলী (রা)-কে ঈদের দিন শুকনো রুটি খেতে দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আজ তো ঈদের দিন, আপনি শুকনো রুটি খাচ্ছেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, ঈদ আনন্দ তো তাদের জন্য, আল্লাহ যাদের রোজা কবুল করেছেন, যাদের গুনাহ ক্ষমা করেছেন। কিন্তু আমি তো নিশ্চিত নই, আমার ইবাদতগুলো কবুল হয়েছে কি না। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবিদের যদি এই চেতনা, তবে আমাদের চেতনা কেমন হওয়া উচিত তা ভেবে দেখা দরকার। সাহাবায়ে কেরামগণ ভালো পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিধান করতেন, অনেক বেশি দান করতেন। সাধ্যের সবটুকু বিলিয়ে দিতেন। এটাই ছিল সাহাবায়ে কেরামদের ঈদ।

বছরে যে কটি রাতে আল্লাহ তায়ালা ইবাদত কবুল করেন, দোয়া কবুল করেন। তার মধ্যে দুই ঈদের রাত অন্যতম। এ রাত্রিগুলোতে সাহাবায়ে কেরামগণ আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। আমরাও যদি তাদের পথে চলি, তাদের পথে হাঁটি, আল্লাহ আমাদের ওপরও রাজি খুশি ও সন্তুষ্ট হবেন।


পথের শিশুর প্রতি মহানবীর (সা) ভালোবাসা

পথের শিশুর প্রতি মহানবী (সা) অত্যন্ত দয়াশীল ছিলেন। এক ঈদের দিন তিনি রাস্তার পাশে একটি ছেলেকে কাঁদতে দেখে তার কাছে যান। ছেলেটি বললো, তার মা ও বাবা কেউই নেই। মহানবী (সা) ছেলেটিকে বাড়িতে এনে বললেন, আমি তোমার পিতা আর আয়েশা তোমার মা, ফাতেমা তোমার বোন হাসান-হোসাইন তোমার খেলার সঙ্গী। তিনি এতিম ছেলেটিকে সন্তানের মর্যাদা দেন। এভাবে মহানবী (সা) ঈদের দিনটি উদযাপন করতেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে  মহানবী (সা) ও সাহাবায়ে কেরামের মতো ঈদ উদযাপন করার তাওফিক দান করুন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ