মরুর বুকে এক ভূস্বর্গ সালালাহ

মরুর বুকে এক ভূস্বর্গ সালালাহ

ভ্রমণ ফরহাদ হুসাইন সেপ্টেম্বর ২০২৩

ঘুরতে কে না ভালোবাসে। দেশে তো বাবা মায়ের সাথে অনেক জায়গায় যাও তোমরা। আজকাল ছুটিতে দেশের বাইরে যাওয়ারও সুযোগ হয় অনেকের। সাধ্যের ভেতর অনেকের পছন্দ ইউরোপ। সেখানকার শীতল আবহাওয়া আর সবুজ শ্যামল পরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য তো সবার সমান নয়।  তাই আমি আজ সাধ্যের ভেতর এমন একটা দেশের কথা বলছি- যেখানে ইউরোপের ভ্রমণের অনুভূতি পূর্ণ হবে। বলছি মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় দেশ ওমানের একটি বিশেষ অঞ্চলের কথা, যেটা ছিল এক সময় ইয়েমেনের অংশ। নাম সালালাহ। জুন জুলাই আগস্ট মাসে যখন আরবের দেশগুলোর মানুষ ৪৫-৫০ ডিগ্রির তাপমাত্রায় হাঁসফাঁস করতে থাকে, তখন ওমানের এই প্রদেশের তাপমাত্রা থাকে ২২ ডিগ্রিরও নিচে। আমরা তিন বন্ধু মিলে দুবাই থেকে গাড়ি চালিয়ে সরাসরি সালালায় আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পথ আমাদের মাস্কাটের পথেই নিয়ে গেল। আগে দুইবার দেশটির রাজধানী শহর মাস্কাটে ঘুরেছি। তবুও আরেকবার চোখ বুলিয়ে ইয়েমেন সীমান্তবর্তী শহর সালালাহ-এর পথে ছুটছি। ৫ শত কিলোমিটার টানা ড্রাইভ করেছি। পথ বাকি আরো ১ হাজার ১৬ কিলোমিটার। শুনতে সহজ হলেও হাজার কিলোমিটার টানা ড্রাইভ করা অতটা সহজ নয়। এ পথের যেন কেবল শুরুই আছে, শেষ নেই। ইয়েমেনের হাজরামাউত থেকে শুরু হয়ে এই রুব আল খালি মরুভূমি গোটা ওমানের বুক চিরে আমিরাত হয়ে সৌদি আরবে গিয়ে মিশেছে। আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মরুভূমির পথ। প্রচণ্ড গরম আর পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে সীমিত গাড়ির গতি; এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে কখনো মসজিদে নামাজ শেষে সামান্য বিশ্রাম, চা খাওয়ার ছলে রেস্তোরাঁয় বসে ঝিমিয়েছি, অবশেষে গভীর রাতে সালালাহ এর প্রবেশপথে আসতেই প্রকৃতির অদ্ভুত খেলা প্রত্যক্ষ করলাম। আবহাওয়া সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল। যদিও গাড়ির তাপমাত্রার মিটার একটু একটু করে কমছিল, কিন্তু এই অলৌকিক পরিবর্তন প্রত্যাশার বাইরে ছিল। পুলিশ গাড়ি থামিয়ে ডাবল এন্টিগেটর ও ফগ লাইট জ্বালিয়ে ২০ কিলোমিটার গতিতে সামনে যাওয়ার নির্দেশনা দিলেন। ঘন ও গভীর কুয়াশায় আমরা দশ হাত দূরের বস্তুও দেখতে পাচ্ছি না। দুটো বিষয় মনে পড়লো- ১. বছর খানেক আগে এক্সপোতে নিউজিল্যান্ডের এক্সিবিশনে গিয়েছিলাম। তাদের দেশের আবহাওয়ার বাস্তবতা বুঝাতে তুষার হিম কুয়াশায় ঢাকা পথ বেয়ে আমাদের ওপরে নিয়ে যাচ্ছিল। সেদিন ভাবছিলাম এই আবহাওয়া শুধু ইউরোপেই সম্ভব। অথচ আজ তা মরুদেশ ইয়েমেন-ওমান সীমান্তে নিজেই দেখলাম। গত ২৪ ঘণ্টা সফরের কষ্ট মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল। ২. গত ১০ ঘণ্টা আগে একই দেশের মাস্কাট শহরে ৪১ ডিগ্রি তাপে গাড়ির এসি বিকল হবার দশা। সেই একই দেশে কী বিপরীত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আবহাওয়া। কল্পনা করতে পারো- মরুভূমির এই দেশের একটি শহরের প্রবেশপথ তোমাকে স্বাগত জানাবে হিম শীতল কুয়াশা আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দিয়ে! হোটেলে উঠে দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি কাটাতে পরের দিনের পরিকল্পনা পাক্কা করে শুয়ে পড়লাম।

পরের দিনটা জিয়ারত করেই কাটালাম। জুময়া পড়েই সালাম পেশ করতে গেলাম নবী আইয়ুব আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাজারে। প্রায় তিন কিলোমিটার পাহাড়ের খাড়া রাস্তা মাড়িয়ে চূড়ার ওপর নবীর মাজার। আল্লাহর পরীক্ষা স্বরূপ তাঁর সমস্ত শরীরে দুরারোগ্য রোগ হয়ে পচন ধরেছিল আর তিনি নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় কেবল আল্লাহর প্রশংসায় মগ্ন ছিলেন। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে যে কুয়ার পানিতে গোসল করে তিনি দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সেই কুয়া আজও বিদ্যমান। পাহাড়ের গা বেয়ে আজও নামছে রহমতের পানি, মানুষ সেই পানিতে অজু এবং গোসল করে আল্লাহর শুকরিয়া করে। পাহড়ের চূড়ার একটি চায়ের দোকানে বিকালের চা পান করছিলাম, তখন নিচে মেঘ আর ওপরে আমরা। ঠান্ডা কুয়াশার ঝাপটা আমার বসার জায়গাটা ভিজিয়ে দিচ্ছিল বারবার। এবার আমাদের যাত্রা এক আশেকে নবী হযরত ওয়েজ কুরনি (র)-এর মাজারে। পাহাড়ঘেরা এক নির্জন উপত্যকায় এই নবীপ্রেমিকের কবরে সালাম দিয়ে রওয়ানা হলাম সমুদ্র উপকূল ‘রসুদে’। যেখানে আল্লাহর আদেশে নবী ইউনুস (আ.)-কে মাছ তার নিজের পেট থেকে বাইরে বের করে দিয়েছিল। উত্তাল সমুদ্রকূলের এই নিদর্শন দেখা শেষে দলবলে রওনা হলাম নবী ইমরান (আ.)-এর মাজারে। সালালাহ সিটি সেন্টারের কাছেই মাজারটি অবস্থিত। হযরত ইমরান (আ.) মরিয়ম (আ.)-এর পিতা এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতামহ। তাঁর মাজারটি ১০৮ ফুট দীর্ঘ। ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছাড়াও খ্রিস্ট ধর্মের ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সমাগম দেখা গেল।


পরদিন আমাদের গন্তব্য পাহাড়ি ঝরনা ওয়াদি আল দারাবাত। শহর থেকে প্রায় ৬৪ কিলোমিটার দূরে এই অপরূপ প্রাকৃতিক পাহাড়ি ঝরনা, না দেখলে সালালাহ সফর পূর্ণ হবে না। দীর্ঘপথ এমন পরিচ্ছন্ন এবং সাজানো গোছানো, যেন মনে হবে ইউরোপের কোনো রাস্তায় তুমি চলছো। এখানে প্রতিদিন রিমঝিম বৃষ্টি নামে। ফলে সবুজ শহরের পাশাপাশি পাহাড়েও সবুজের সমারোহ। পাহাড় বেয়ে প্রাকৃতিক ঝরনা নেমে তৈরি হয়েছে বড়ো স্বচ্ছ জলাধার। স্থানীয় ভাষায় তারা এটাকে বলে ওয়াদি। সেখানে শৌখিন ভ্রমণ পিপাসুরা ছোটো ছোটো নৌকা চালিয়ে, সাঁতার কেটে প্রশান্তি পায়। পাহাড়ে চিরসবুজ গাছপালার ঘন বনে দেখা মেলে হরিণসহ নানা রকম প্রাণীর। এখানে দেখা মিলবে প্রায় ৩০ প্রজাতির পাখি। আইন আতুম, তাউ আতুর, আইন আল রজতসহ আরো বেশ কয়েকটি নয়নাভিরাম পাহাড়ি ঝরনা আছে সালালায়।

সারি সারি নারিকেল ও কলার বাগান দেখে মনে হলো আরেকটি বাংলাদেশ। ইয়েমেন সীমান্তবর্তী ভূস্বর্গ সালালায় এই খারিফ বা বর্ষা ঋতুতে সাগরপাড়ের দারিস-এ বাংলাদেশি ফল ব্যবসায়ীরা কয়েকশ ফলের দোকান খুলে বসে জাঁকিয়ে ফলমূলের ব্যাবসা করছেন। যেখানে নানা ধরনের আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, আনার, পেঁপে, কলা, কচি ডাব, আনারস, আতা, তরমুজ, বাঙ্গি, কমলা, পেয়ারা, কাঠবাদামসহ আরও অনেক কিছু পাওয়া যায়। মজার বিষয় হলো- চাঁপা কলা, সবরি কলা, সাগর কলাসহ আর যত ফল এখানে পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগই কিন্তু বাংলাদেশিদের হাতে শ্রমে ঘামে উৎপন্ন এবং বাংলাদেশিদের দোকানে বিকিকিনি হচ্ছে। হাজার কিলোমিটার দূরে মরু বালুকাবেলার দেশে একটি বাংলাদেশ খুঁজে পেয়ে, মরুর বুকে সবুজ ফোটানো দেশের মানুষদের সাথে সুখ দুঃখের আলাপনে তোমাদের মনও পুলকিত হবে।

জাদুঘরের প্রতি আমার জাদুময়ী দুর্বলতা। এক সময় ইয়েমেনের ভাগে থাকা সালালাহ জাদুঘরে কী আছে আমার তা জানা ছিল না। কিন্তু চৌম্বক টান ছিল জাদুঘরে যাওয়ার। রাতে হোটেলের প্রশস্ত বৈঠকঘরে আয়েশি মেজাজে বসে আগামী কালের ছক আঁকলাম। প্রথমে যাব জাদুঘরে, বন্ধুরা এক কথায় সায় দিলেন। যে কথা সেই কাজ, আমাদের ছোটো গাড়িটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন সালালাহ বিদ্যুৎ সেক্টরের অন্যতম প্রধান প্রকৌশলী আজাদ সাহেবের বিলাসী পাজেরো; ‍যিনি বিদেশে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কিন্তু সুঠাম অস্ত্রধারী পুলিশ সটান পথরোধ করে জানিয়ে দিলো আজ ছুটি, তাই ইতিহাসের কারাগারটি আজ বন্ধ। আমার চেহারায় ঘাম জমে উঠলো। কিন্তু বেচারা একেবারে নিরাশ করলেন না। তিনি জানালেন ‘বেলা তিনটার পর বিশেষ ব্যবস্থায় পরিদর্শন করা যাবে জাদুঘর।’ আমাদের দিনের পরিকল্পনা কিছুটা কাটছাঁট করে জাদুঘর দেখার সিদ্ধান্তে স্থির থাকলাম এবং যথাসময় হাজির হলাম। শান্ত স্বচ্ছ পানির লেকের পাশে চমৎকার স্থাপত্য নিদর্শনের সৌন্দর্যমণ্ডিত এই জাদুঘর ভবনটি। হঠাৎ চোখ আটকে গেল কাচের বাক্সের চমৎকার সুদৃশ্য স্ট্যান্ডের ওপর রাখা একটি চিঠির দিকে। নিচে রাসূল (সা.) ব্যবহৃত সেই মোহরের ছাপ, সেই সোনালি আভা, শরীরে শীতলতা অনুভব করলাম। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.) এই চিঠির প্রেরক, বাহক ছিলেন তাঁর প্রিয় সাহাবী আমর ইবনুল আস আর তিনি চিঠিটি পৌঁছে দিয়েছিলেন ওমানের তৎকালীন যৌথ শাসক দুই ভাই যাইফর এবং অবদর এর কাছে। এই চিঠিটি ওমানের মানুষকে ইসলামের সন্ধান দিয়েছিল।


একটি লোবান (লোবান গাছ থেকে দুনিয়ার সেরা সুগন্ধি উৎপাদন হয়) গাছের চারপাশ ঘিরে চমৎকার ভবনে মূলত দুটো প্রধান হল- মেরিটাইম হল এবং হিস্ট্রি হল। মেরিটাইম হল এ প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে নৌকার উদ্ভব, ক্রমবিকাশ থেকে আধুনিক মেরিন শিল্প পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে। এটি বাত্তিল, বুম, সাম্বুক, গঞ্জার মতো ওমানি নৌকাগুলোর সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের মডেলগুলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। এছাড়াও নেভিগেশনাল যন্ত্র এবং অন্যান্য অনুরূপ জিনিস দেখা যাবে এই হলে।

 

হিস্টোরি হলে অষ্টম শতাব্দীতে পাঠানো রাসূল (সা.)-এর চিঠি ছাড়াও রয়েছে হাতে লেখা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি, অন্যান্য কবিতা এবং ভাষাগত পাণ্ডুলিপি। এছাড়া হলটিতে ওমানের বিভিন্ন মসজিদ ও সমাধির মডেল রয়েছে। নবী আইয়ুবের সমাধি, নবী হুদ এবং নবী সালেহ এবং সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদের মডেল দেখা যাবে হলটিতে।


সালালাহতে পাঁচটা সি বিচ রয়েছে। একটার চেয়ে আরেকটার সৌন্দর্যের কোনো কমতি নেই। আমরা যেহেতু সাগরের দেশেই থাকি তাই কেবল মুগছেল বিচ-ই আমাদের গন্তব্য। এত চমৎকার বিচ আমি এখনো দেখিনি। ধবধবে সাদা বালিতে নীল জলরাশি। সেখানে পিকনিক এবং সমুদ্র ড্রাইভ করার জন্য চমৎকার জায়গা আছে। এখানে সারি সারি ঘর বুকিং ‍নিয়ে পারিবারিক ভোজন সেরে নিতে পারবে অনায়াসে।


সালালাহ সফরে সুলতান কাবুস মসজিদ না দেখলে অবশ্যই আক্ষেপ থাকবে। বিস্তৃত জমিনের ওপর নয়নাভিরাম মসজিদ দেখলেই তোমাদের চোখ শীতল হবে। হাতে বোনা কার্পেট এবং দেয়ালের জটিল নিদর্শনসহ সুলতান কাবুস মসজিদের বিস্তৃত নকশা দর্শনার্থীদের মোহিত করে। এছাড়া এখানে ২০০৯ সালে সমাপ্ত একটি বিশাল স্ফটিক ঝাড়বাতি এবং সূক্ষ্ম রঙে হাতে বোনা কার্পেট, বিস্তৃত প্রাচীরের নিদর্শন, আকর্ষণীয় মাঠ এবং সাদা ও সোনালী রঙের গম্বুজ এবং মিনারসহ একটি চমৎকার ডিজাইন করা পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য পৃথক নামাজের কক্ষ রয়েছে। 

আমাদের এবারের ভ্রমণ ছিল এ পর্যন্তই। তোমরাও সুযোগ পেলে ঘুরে আসতে পারো ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এ শহর থেকে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ