মধুমাসে মধুফল

মধুমাসে মধুফল

প্রচ্ছদ রচনা মঈনুল হক চৌধুরী মে ২০২৩

ছয়টি ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ঋতুর পরিক্রমায় বাংলাদেশে এখন গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মকাল বাংলা ষড়ঋতুর প্রথম ঋতুু। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মিলে এ দু’ মাস গ্রীষ্মকাল। বৈশাখ শেষে বাংলার প্রকৃতিতে এখন জ্যৈষ্ঠের উপস্থিতি। সূর্যের প্রখর তাপে হাওড়, নদী, বাঁওড় জল শুকিয়ে মেঘ জমাট বাঁধে বর্ষার প্রস্তুতি সাজে। গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে শোভা পায় সোনালু ফুল। চারদিক টসটসে লালে ছাপিয়ে দেয় লীলাবতী কৃষ্ণচূড়া! এই দুই ফুলের নয়নকাড়া সৌন্দর্য জ্যৈষ্ঠকে করে আরও মনভোলানো। সাজো সাজো মহিমায় প্রকৃতির আনাচে-কানাচে ভরে উঠে নানা জাতের বাহারি সুস্বাদু ফলে। এমন ফলের অধিক সরবরাহ থাকায় সবার কাছে মাসটি ‘মধুমাস’ নামেই পরিচিত। তাই রসালো ফলের মৌ মৌ গন্ধে উতলা এখন প্রকৃতি। চারদিক এখন পাকা ফলের সৌরভে মাতোয়ারা। সুবাসিত আবেশ। গাছে গাছে এখন পুরুষ্ট কাঁঠালের বর্ণাঢ্য বিভা। গাঢ় সবুজ আমের শরীরে লাল লাল ছোপ। পেকে ওঠা লিচুগাছ ঘিরে দিনে পাখি আর রাতে বাদুড়ের কোলাহল। পাকা জামের মধুর রসে মুখ রঙিন করার স্বপ্নের দোলা। জাম-জামরুল-লিচু, আনারস, করমচা, আতা, তরমুজ, ফুটি, বাঙ্গি, বেল, খেজুর, কাঁচাতাল, জাম্বুরা, কাউফল, গোলাপজাম, কামরাঙা, লটকনসহ হরেক ফলের স্বাদ আর রঙের ছোঁয়ায় বাঙালির রসনা তৃিপ্তর মৌসুম। বাহারি আর পুষ্টিকর সব ফলের প্রাচুর্য এই মৌসুমকে দিয়েছে মধুমাসের মহিমা। গ্রামের হাটবাজারে এখন মিষ্টি ফলের সুবাস। গ্রামের মতো শহরে ফলের দোকান সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। বছরজুড়ে কমবেশি ফল পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায় এ জ্যৈষ্ঠ মাসে। রঙবাহারি বিভিন্ন ফলের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। ষড়ঋতুর এদেশে রোদে তেতে ওঠা জ্যৈষ্ঠে তৃষ্ণার্ত মানুষ পিপাসা মেটায় বিভিন্ন প্রজাতির রসালো ফল দিয়ে। এখন নানান ফলের মৌ মৌ গন্ধ আর ভ্রমরের গুঞ্জন। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ নানা রসালো ফলে প্রকৃতি ঢেলে দিয়েছে তার সমস্ত রস। রসনাবিলাসী বাঙালিকে এই রস আস্বাদনে মাতিয়ে তুলতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে দেদার কেনাবেচা হচ্ছে মৌসুমি ফল। জ্যৈষ্ঠের বাতাসেও যেন মধুমাসের রসালো ফলের ঘ্রাণ। বাজারে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা লিচুর। সঙ্গে আমের চাহিদাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর বর্ষার আগাম বর্ষণে কাঁঠালও জানান দিচ্ছে ‘আমিও আসছি’। বাঙালির চিরায়ত রীতি অনুযায়ী জ্যৈষ্ঠ মাসেই মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিকে ফল দিয়ে আদর-আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে থাকেন গ্রামে বাস করা বাবা-মায়েরা। লেখাপড়া, চাকরি কিংবা ব্যবসার কারণে যারা শহরে থাকে তারাও গ্রামে ফেরে মধুমাসের মধুর রসে মুখকে রাঙিয়ে তুলতে। আবার অনেক সময় দেখা যায় মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি না আসতে পারলেও তাদের জন্য ফল পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 

অধিকাংশ ফলেরই উৎপাদন হয় মধু মাসে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে দেশের মোট ফল উৎপাদনের শতকরা ৫৪ ভাগই উৎপাদিত ও বাজারজাত করা হয়। বাকি শতকরা ৪৬ ভাগ ফলের উৎপাদন হয় অবশিষ্ট ৮ মাসে। মধুমাসে উৎপাদিত ফলগুলোর মধ্যে আম, কাঁঠাল, লিচু ও আনারস অন্যতম। বছরের অন্য সময় উৎপাদিত ফলগুলোর মধ্যে আছে কুল, আমড়া, আমলকী, বেল, সফেদা, জলপাই, ডালিম, কামরাঙ্গা ইত্যাদি। পেঁপে ও কলা সারা বছরই উৎপাদিত হয়। ফল নিয়ে প্রতি বছরই জ্যৈষ্ঠ আসে মধুমাস হয়ে। ফল হোক সে নিজের বাগানের কিংবা বাজারের, তার স্বাদ পেতে কম বেশি সবারই ভালো লাগে। বন্ধুরা, এবার মধুমাসের কিছু ফলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জেনে নিই। আমে আছে প্রচুর ক্যারোটিন। আমের এই ক্যারোটিন মানুষের ত্বকের মসৃণতা বাড়ায়। সৌন্দর্য বাড়াতে আমের জুড়ি নেই। চুলের রুক্ষতা কমায় পাকা আম। সাধারণত অন্যান্য ফলের এই বিশেষ গুণটি কম থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে আছে আন্তর্জাতিক এককে ২৫০০-৮০০০ ক্যারোটিন। জলীয় অংশ থাকে ৭৫ থেকে ৮৫ ভাগ। শর্করা ১৪ ভাগ, ফলিক এসিড চার ভাগ, অ্যালকোহল দুই ভাগ, ভিটামিন সি ১৭৫ মিলিগ্রাম। ১০০ গ্রাম কাঁচা আমে থাকে ৯০ ভাগ জলীয় অংশ। শর্করা ৮.৮ ভাগ,  প্রোটিন ০.৭ ভাগ, চর্বি ০.১ ভাগ, ক্যালসিয়াম ০.০১ ভাগ, শর্করা ৮.৮ ভাগ। এ ছাড়া ভিটামিন সি তিন মিলিগ্রাম। আমের জলীয় অংশ মানুষের দেহের খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে এবং শরীরের দূষিত পদার্থ বের করে দিতেও সাহায্য করে। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে সাহায্য করে আম। আম ঔষধি গুণেও ভরপুর। যকৃৎ ভালো রাখতে আম হতে পারে উৎকৃষ্ট ফল। কখনো কখনো ডায়রিয়া রোগের ওষুধ এই আম। তাই মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই যত খুশি আম খেয়ে নাও। জাম আমাদের অবহেলিত দেশী ফল হলেও পুষ্টি ও ভেষজগুণসমৃদ্ধ। জামে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান আছে। ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আম, কলা, আনারস, পেয়ারা, বরই ও তরমুজের চেয়ে বেশি। আয়রনের পরিমাণ আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস, পেয়ারা, লিচু, বরই, আঙুর, কমলা ও লেবুর চেয়ে অনেক বেশি। ভিটামিন এ-এর পরিমাণ কলা, পেয়ারা, লিচু ও তরমুজের চেয়ে বেশি। ভিটামিন সি-এর পরিমাণও আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস, লিচু, বরই, লেবু ও তরমুজের চেয়ে সামান্য বেশি। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী জামে রয়েছে জলীয় অংশ ৯৬.৬ গ্রাম,  মোট খনিজ পদার্থ ০.১ গ্রাম, আমিষ ১ গ্রাম, শর্করা ১.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২২ মিলিগ্রাম, আয়রন ৪.৩ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ১২০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.০৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.০২৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৬০ মিলিগ্রাম ও খাদ্যশক্তি ১১ কিলোক্যালরি। তবে এই পুষ্টিমান জামের বিভিন্ন জাত ও মাটির ভিন্নতার জন্য কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে সাধারণত ৯টি প্রধান ও ৪৮টি অপ্রধান ফলের উৎপাদন লক্ষ করা যায়। এদের চাষাধীন জমির পরিমাণ ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। মোট উৎপাদন ৪৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টন। প্রধান ফলগুলোর মধ্যে আম, কলা, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, লিচু ও কুল প্রায় শতকরা ৭৯ ভাগ জমি দখল করে রয়েছে। অবশিষ্ট শতকরা ২১ ভাগ জমিতে হয় অপ্রধান ফলগুলোর চাষ। বাংলাদেশের মৌসুমি ফল ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং ওমানে রফতানি হচ্ছে। রফতানিকৃত ফলগুলোর মধ্যে আছে কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, কুল, সাতকরা, আম, আমড়া, সুপারি, জলপাই ও পেয়ারা। দিনের পর দিন বিদেশে এগুলোর চাহিদা বাড়ছে। আগামী দিনে, চীন, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশী ফল রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য, আমাদের মধুমাসের ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজার জাতকরণ অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা। ফলের উৎপাদন  মৌসুমভিত্তিক বলে কৃষকরা এর ন্যায্য দাম পায় না। 

অনেক সময় উৎপাদকগণ বিক্রয় মূল্যের অর্ধেক দামও পায় না। কয়েক হাত বদলের মাধ্যমে ফল ভোক্তার হাতে পৌঁছায় বলে ভোক্তা প্রদত্ত দামের প্রায় অর্ধেকের বেশি নিয়ে যায় মধ্যস্বত্বভোগী। উপযুক্ত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে শতকরা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য ফলের ভর মৌসুমে বিশেষ করে মধুমাসে বিদেশ থেকে ফল আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষণ নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে উৎসাহিত করতে হবে। জ্যৈষ্ঠ মাস মধুমাস, ফলের উৎসবের মাস। এ সময় দেশী ফলের উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। তাই ফল পচে অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে এ আশঙ্কায় অনেক অসাধু বিক্রেতা ফলকে তাজা দেখাতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করে, যা মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ অপতৎপরতা বন্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি শরীর গঠনে দেশী ফল পুষ্টিমানের দিক দিয়ে বিদেশী ফলের চেয়ে অনেক ভালো। অনেকে অসচেতনতার কারণে বিদেশী ফলকে প্রাধান্য দিলেও তাদের এ ধারণা ভুল। সব শেষে এ কথাটিও মনে রাখতে হবে, আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের অনেক অপ্রচলিত ফল হারিয়ে যেতে বসেছে। দেশী জাতের ফল সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশীয় ঐতিহ্য ধরে রাখাও আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব। তবুও মধু ফল বলে কথা। মধু সময়ের মধু ফলে বাঙালির চিরকালীন দুর্বলতা। তাপদাহের যন্ত্রণায় জনমনে একটু শীতলতার পরশ ও প্রশান্তি মধুমাসের এই মধু ফলে। তাই, বেশি করে মধুমাসের ফল খাওয়া উচিত সবার। কারণ ফলে রয়েছে ফাইবার, যা খাবার হজমে সাহায্য করে। ফলের মধ্যে প্রচুর পানি রয়েছে। ফল অ্যান্টি-অ্যাসিডিক। এতে উপস্থিত অর্গানিক অ্যাসিড ও ন্যাচারাল হাই সুগার শরীর সুস্থ ও তাজা রাখে, সঙ্গে সঙ্গে এনার্জি দেয়। ফলে প্রোটিন ও ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। ভিটামিন, মিনারেল ও এনজাইমে সমৃদ্ধ ফল আমাদের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এক্সারসাইজ করার জন্য বেশি এনার্জি পাওয়া যায়। ফল হাই ব্লাডপ্রেসার ও  কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে হার্টের সমস্যা প্রতিরোধ করে। নিয়মিত ফল খেলে টাইপ-টু ডায়বেটিস হওয়ার আশঙ্কা কমে। ফল বার্ধক্য প্রতিরোধ করে, স্থুলতা ঠেকাতে টক জাতীয় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খেলে উপকার পাওয়া যায়। এ জন্য নিয়মিত ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুদের জন্য প্রতিদিন অন্তত একটি ফল খাওয়া অপরিহার্য। ছয় ঋতুর বাংলাদেশ যার রূপের শেষ নেই। জ্যৈষ্ঠ তার মধুর রসে বাঙালিকে দেয় প্রাণ সঞ্জীবনী। আর তাই তো জ্যৈষ্ঠ হলো মিষ্টি ফলের রসে ভরা মধুমাস।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ