ভুলের মাশুল

ভুলের মাশুল

উপন্যাস নাজিব ওয়াদুদ এপ্রিল ২০২৪

নিঃশব্দে কাঁদছিল নিশাত। সে এই বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সদস্য। বয়স বড়ো জোর ছয়। নাদুস-নুদুস স্বাস্থ্য, ফোলা-ফোলা গাল আধ-পাকা টমেটোর মতো হালকা লালচে। চোখ দুটো বড়ো-বড়ো, তাতে গভীর মায়া-জড়ানো। গভীর দীঘির মতো সেই চোখে টলটল করছে মুক্তোর দানার মতো অশ্রু, গাল বেয়ে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়ছে একফোঁটা দুই ফোঁটা করে। তার কান্না শুনে বড়ো বোন মারিয়া ছুটে এলো। তার বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়। একটু চাপা রং, হালকা স্বাস্থ্য, পরনে রঙিন ফুলতোলা কামিজ। গোলাপি ওড়না চাদরের মতো গলায় জড়ানো। উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছোট্ট বোনটি, তাকে দেখে কান্না চাপার চেষ্টা করছে, কিন্তু রাগ এবং দুঃখের চাপে মুখটা ভার। হয়তো কেউ তাকে জ্বালিয়েছে বা অপমান করেছে। না কি কারো সঙ্গে মারামারি হয়েছে?

‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে? আমার ছোট্ট সোনামণি বোন, কাঁদছো কেন?’

গাল ফুলিয়ে কান্না চাপলো নিশাত, কিন্তু কোনো জবাব দিলো না। কান্নার চাপে তার গাল দুটো আরো লালচে হয়ে উঠলো। তাকে জড়িয়ে ধরলো মারিয়া। 

‘বলো আমাকে, আমার সোনামণি বোন, কেউ বকেছে? কী হয়েছে?’

ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে নিশাত। বড়ো বোনের ন্যাওটা বেশ। কিন্তু এখন তার মন খারাপ। কোনো উত্তর করলো না। শুধু বললো, ‘কিচ্ছু না।’ সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। 

‘ওরে ব্বাব্বা! কী শক্তি আমার বোনটার গায়ে! আমি যে পারছি না!’ হাতের বাঁধন একটু হালকা করে দিলো মারিয়া, কিন্তু ছাড়লো না। 

‘কী হয়েছে বলবে তো? কেউ বকেছে?’

‘কিচ্ছু হয়নি!’ অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো সে। 

‘সে আবার কী?’ তার মুখটা দু’হাতের তালুতে ধরলো মারিয়া। ‘তাকাও আমার দিকে। কিচ্ছু না তো কাঁদছো কেন?’ 

ফোঁস-ফোঁস করতে থাকলো নিশাত। 

‘আচ্ছা, আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না বলো? বাসি তো? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো।’

বোনের চোখের দিকে মুখ তুলে তাকালো নিশাত। তার চোখ দুটো লালচে হয়ে উঠেছে। তাতে টলটল করছে অশ্রু।

‘কী হলো, বলো? আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না?’

কোনো জবাব দিলো না নিশাত। কেবল জাপটে ধরলো বোনকে। 

‘হুম! বুঝতে পারছি আমার সোনামণি বোনটার মন খারাপ হয়েছে! কী হয়েছে বলো তো? তুমি না বললে আমি কী করে বুঝবো?’ কণ্ঠে নরম আদর ঢেলে বললো মারিয়া। 

‘খালি...’

‘খালি? খালি কী? বলো?’

‘মা আমাকে...’ তার কথা শেষ হলো না। তার গালে লজ্জার আভা। আবার কান্নার উথাল ঢেউ। 

‘বলো, মা তোমাকে... কী?’

‘কিচ্ছু না।’

‘আবার কিচ্ছু না। কিচ্ছু না হলে কি আর এমনি-এমনি কাঁদছো!’

‘বললাম তো কিচ্ছু না!’ এবার তার কণ্ঠে বড়ো মানুষের মতো বিরক্তি ও ধমকের ভাব ফুটে বেরুলো। 

সেই মুহূর্তে সেখানে এসে হাজির হলো আনিকা। মারিয়ার ছোটো সে। বয়স বছর দশ-এগারো হবে। হালকা-পাতলা গড়ন। নানা রঙের ফুল তোলা ফ্রক তার পরনে। ধবধবে ফর্সা রং তার গায়ের। সবসময় হাসি লেগে রয়েছে তার মুখে। আর যেন স্থির থাকতে পারে না। তাকে সত্যি-সত্যিই পরীর মতো দেখাচ্ছে। সে গান গাইছে মনের আনন্দে। তার হাতে একটা বড়োসড়ো প্লেট, তার ওপর একটা মাঝারি আকারের ফ্রুট-কেক। সেটাকে একবার এদিক তো আরেকবার ওদিক ঘোরাতে লাগলো সে। তার মুখে-চোখে আনন্দের বান, আর কিছুটা গর্বও যেন উছলাচ্ছে। যেন সবাইকে দেখাতে চাইছে সে জিনিসটা। যেন বলতে চাইছে, ‘দেখো তোমরা, কী একটা মহামূল্যবান জিনিস পেয়েছি আমি!’ নিশাতের তো সত্যি-সত্যিই চক্ষু ছানাবড়া। একি দেখছে সে! নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আরো উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো সে।

‘কী ব্যাপার, নিশাত? তুমি এমন করে কাঁদছো কেন? দেখো আমি কী এনেছি।’ বলে কেকটাকে তার চোখের সামনে দিয়ে একবার ঘুরিয়ে নিল। তারপর ঠোঁটটাকে একটু বাঁকিয়ে বললো, ‘এভাবে চিৎকার-চেঁচামেচি করে আমাদের প্রিয় কেক খাওয়ার মজাটা নষ্ট করে দিও না প্লিজ। কেকের ফিস্ট হবে আজ! ’ 

কেক খাওয়ার মজার কথা শুনে নিশাতের কান্না বুঝি আটকে গেল, তার মুখ-চোখ দেখে মনে হলো সে বুঝি হেসে উঠবে। তৎক্ষণাৎ সে আনিকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মারিয়ার মতো না হলেও ছোট্ট বোনটাকে সে-ও কম ভালোবাসে না। সে বললো, ‘একটু সবুর করো, আগে কাগজটা পড়ি, কেকটাকে ছোটো ছোটো করে কাটি, তারপরে না ফিস্ট।’ 

কেকটাকে সে মারিয়ার দিকে এগিয়ে ধরলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার নির্দেশ পালন করলো মারিয়া, হাত বাড়িয়ে কেকের থালাটা ধরলো। তাদের উঠোনের একপাশে টেবিলের মতো একটা পাকা শান বাঁধানো আছে। সেখানে জিনিসপত্র রাখা যায়, বসাও যায়। তার ওপর হাতের কাগজটা পাড়লো আনিকা। 

‘আপা, এবার কেকটা এর ওপর রাখো।’ 

মারিয়া কেকটাকে সাবধানে কাগজের ওপর রাখলো। 

‘তুমি এটা কোথায় পেলে?’ এতক্ষণ অনেকটা হতবাক হয়ে ছিল মারিয়া। সে ভেবে পাচ্ছিল না এত বড়ো আস্ত একটা কেক সে কোথায় পেল। সে যতটুকু জানে, বাড়িতে এ রকম কোনো কেক ছিল না। তাছাড়া থাকলেও এভাবে একজনের হাতে মা ছেড়ে দিবেন না, সবসময় সব জিনিস তিনি সবার মধ্যে ভাগ করে দেন। তাহলে?

‘এটা কোত্থেকে আনলে তুমি?’ জিজ্ঞেস করলো মারিয়া।

‘হুম! পেয়েছি। একজন দিয়েছে।’

‘সেকি কথা। একজন দিয়েছে মানে? কে দিয়েছে?’

‘দিয়েছে!’ রহস্য করে বললো আনিকা।

‘এটা খুব খারাপ কথা আনিকা। কে একজন দিলো আর অমনি তুমি নিয়ে নিলে?’

‘নিব না? কী সুন্দর কেক!’

‘দাঁড়াও, আমি আম্মাকে বলছি!’

‘আম্মা জানে। আম্মাকে আমি দেখিয়েছি।’ 

এ কথা শুনে আরো অবাক হলো মারিয়া। 

‘সত্যি বলছো?’

‘একশো বার সত্যি, হাজার বার সত্যি।’

‘দেখো আনিকা, তুমি সত্যি করে বলো, কোথায় পেলে এটা?’ এবার কিছুটা কঠিন স্বরে বললো মারিয়া। তার কথায় ও আচরণে বড়ো বোনসুলভ ভারিক্কি ভাব ফুটে উঠলো। তাতেই কাবু হয়ে পড়লো আনিকা। 

‘তুমি কি ভাবছো আমি চুরি করেছি?’ আনিকাও এবার একটু শক্ত হলো।

মারিয়া দুর্বল হয়ে পড়লো। সত্যি, একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে সে। এমন কৈফিয়ত চাওয়ার মতো করে বলা তার উচিত হয়নি। সে এবার নরম সুরে বললো, ‘না, আমি সেটা বোঝাতে চাইনি। আমি কেবল জানতে চাচ্ছি এত বড়ো কেক তুমি কোথায় পেলে?’

তখন রহস্য ভাঙলো আনিকা। তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা দোকান রয়েছে। সেখানে পেন্সিল কিনতে গিয়েছিল সে। তখন তাদের মেজো চাচা কেক কিনছিলেন। তো তাকেও একটা কেক কিনে দিয়েছেন তিনি।

‘এটা ঠিক হয়নি তোমার।’ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো মারিয়া। ‘কেউ একটা কিছু দিলো আর অমনি তুমি নিয়ে নিলে সেটা ঠিক হয়নি। তোমার মনে নেই মা কতদিন বলেছেন অপরের থেকে কিছু নিতে হয় না?’

‘ও মা, আমি কি অপরের কাছ থেকে নিয়েছি? আমাদের আপন চাচা দিয়েছেন। তিনি কি পর?’ 

‘তবুও...। তোমার এটা নেওয়া ঠিক হয়নি।’

‘কেন ঠিক হয়নি? চাচা দিলেন... আমি নিতে চাচ্ছিলাম না। তবু চাচা জোর করে দিলেন। পেন্সিলের দামটাও তিনিই দিয়ে দিলেন।’ 

‘কেকটা খুব ভালো, তাই না আপা? দেখে মনে হচ্ছে খুব টেস্টি হবে।’ বলে ফেললো নিশাত। বড়ো দুই বোনের বাক্বিতণ্ডা শুনে বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে। মেজো আপুর তুলনায় বড়ো আপুকেই সে বেশি ভালোবাসে, বেশি মান্য-গণ্য করে। কিন্তু এই মুহূর্তে বড়ো আপার ওপরেই বিরক্ত হচ্ছিল সে। অযথা বাগড়া দিচ্ছে বড়ো আপু, সেটা সে মানতে পারছে না।

‘হ্যাঁ, তোমার তো শুধু খাই-খাই, খাবার কিছু পেলে আর তর সয় না।’ মারিয়ার তিরস্কার শুনে মুখ ছোটো হয়ে গেল নিশাতের। কিন্তু আনিকার মজা লাগলো। কারণ, সে জানে ছোট্ট এই বোনটা বড়ো আপার খুব ন্যাওটা। সে খুব উপভোগ করলো ব্যাপারটা। বললো, ‘ও তো ঠিকই বলেছে আপু, ওকে কেন বকছো! কেকটা সত্যিই খুব টেস্টি হবে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাই না নিশাত সোনা?’

ছোট্ট মেয়েটি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। একদিকে বড়ো আপু যে তাকে খুব ভালোবাসে, প্রশ্রয় দেয়, কিন্তু এই মুহূর্তে তার ভূমিকা কিছুটা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। অন্যদিকে মেজো আপু যে তাকে মাঝে-মাঝেই খোঁচা দিতে ছাড়ে না, কিন্তু এখন সে তার প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে, বিশেষ করে তার হাতেই এখন কেকের কর্তৃত্ব। সে কোন কূল রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না। সেটা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে আনিকা।

‘ঠিক আছে তোমাকে কিছু বলতে হবে না। এসো, আমরা কেক কাটি।’ 

দু’হাতের চেটোয় চোখ মুছে অনেকটা দৌড় দেওয়ার মতো করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো নিশাত। তার মুখে আনন্দের হাসি।

‘আপু, তুমি এসো। বলে দাও কীভাবে কাটবো। তুমি তো জানো আমি সমান করে কাটতে পারি না, ছোটো-বড়ো আর আঁকাবাঁকা হয়ে যায়।’ তার চোখে কিছুটা মিনতি ফুটে উঠলো।

বোনের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারলো না মারিয়া। সে-ও এসে হাত লাগালো।

তারা কেকটাকে ছোটো ছোটো টুকরো করে কাটলো। কেকের ওপরে যেমন, ভেতরেও তেমনই নানা রঙের ফলের কুচি-কুচি টুকরো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব সুস্বাদু কেক। আর চমৎকার সুবাসও ছড়াচ্ছে। নিশাতের আর তর সইছে না। সে একটা টুকরা নেওয়ার জন্যে হাত বাড়ালো। 

‘না-না, থামো। দাঁড়াও। এখনই না, একে একে সবাই নিবে।’ আনিকা তাকে বাধা দিলো।

মারিয়া বললো, ‘একটু সবুর করো। আমরা বরং সেলিব্রেট করি। না কী বলো, আনিকা?’

‘তুমি ঠিক বলেছ, আপু। এসো আমরা সেলিব্রেট করি।’

প্লেটের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল নিশাত। তার মুখে-চোখে অপমানের অসহায়তা ফুটে উঠলো। কিন্তু উপায় নেই। সে তার অপমানকে চাপা দিতে হাত-পা নাড়াতে লাগলো, যেন ব্যায়াম করছে, বা যেন তার হাত-পা ঝিম ধরে গেছে, আড়ষ্টতা কাটাচ্ছে এমন ভাব করতে লাগলো। ছোট্ট বোনটার করুণ অবস্থা দেখে মায়া হয় মারিয়ার, আবার মনে মনে হাসিও পায় তার হাব-ভাব দেখে। এত খাবার-পাগল হয়েছে মেয়েটা! আর কোনো ভাই-বোন তো এ রকম হয়নি। এ কথা ভাবতে গিয়ে তাদের একমাত্র ভাইটার কথা মনে পড়লো মারিয়ার। আনিকার ছোটো আর নিশাতের বড়ো সে। তার শরীরের খুব বাড়-বাড়ন্ত। এখনই আনিকাকে ছাড়িয়ে গেছে সে উচ্চতায়, প্রায় মারিয়ার সমানই বলতে গেলে। তার হাব-ভাব ও কথায়-বার্তায়ও বেশ পাকামি। এই সেলিব্রেশনে সে-ও থাকলে খুব ভালো হতো, ভাবলো মারিয়া। একমাত্র ভাই বলে কথা। সে বললো, ‘শামীম কোথায়? তাকে ছেড়ে সেলিব্রেশন করা আমাদের ঠিক হচ্ছে না।’

‘ওহ-হো! তার কথা আমি ভুলে গেলাম কী করে!’ যেন হঠাৎ মনে পড়েছে, লাফিয়ে উঠলো আনিকা। ‘কোথায় গেল সে? আমি যে তাকে আসতে বললাম। আসছে না কেন?’ ঘরের দিকে তাকালো সে।

‘কোথায় সে?’

‘ও ঘরেই আছে।’ আনিকা বললো।

‘ওকে ডাকতে হবে না। ও কেক পছন্দ করে না।’ নিশাত বললো।

নিশাতের কথা মিথ্যে নয়, কেক খুব একটা পছন্দ করে না শামীম। 

‘না করুক পছন্দ, তবু তাকে রেখে আমাদের খাওয়া ঠিক হবে না,’ মারিয়া বললো। 

‘আপু ঠিক বলেছে। ও আমাদের ভাই না?’ এ কথা বলে নিশাতের দিকে তাকিয়ে আনিকা বললো, ‘তুমি শুধু নিজেরটা বোঝো। ছি: নিশাত!’ 

ছোটো বোনটার সাহায্যে এগিয়ে এলো মারিয়া। ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ও তো এখনো কত ছোটো। ও কি আর এতকিছু বোঝে?’ নিশাতকে কাছে টেনে নেয় মারিয়া। তার মাথায় হাত বুলায়। ‘তুমি বরং শামীমকে ডেকে আনো।’ 

‘আমি?’ এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো সে। কিন্তু এমন কেউ নেই এখানে যাকে দায়িত্বটা দেওয়া যায়। 

‘কী খুঁজছো?’ মারিয়া প্রশ্ন করলো। 

‘না, কিছু না। ভাবছিলাম... আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমরা তাহলে কেকগুলো দেখে রাখো, আমি শামীমকে ডেকে আনি।’ ঘরের দিকে ছুটল আনিকা।

শামীমকে একটু বেশিই ভালোবাসে আনিকা, সেটা সবাই জানে। মনে মনে হাসলো মারিয়া।

কিন্তু খুশি হতে পারলো না নিশাত। এই শামীমটার জন্যে কেক খাওয়া আটকে গেল। অনাকাক্সিক্ষত দেরির জন্যে তার মন বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে গেল। 

‘এই শামীমটা সবখানে গোলমাল পাকায়। নচ্ছার একটা!’ মনের ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলো না সে।

‘ছি:! নিশাত! ওভাবে বলে না। শামীম তোমার বড়ো না? বড়োদের সম্পর্কে অমন করে বলে!’ মারিয়ার কণ্ঠে একইসঙ্গে আদর আর শাসন ঝরে পড়ে।

‘বড়ো না ছাই। আমাকে খালি জ্বালায়।’

‘সে তোমাকে ভালোবাসে বলে জ্বালায়। ওটাও একধরনের খেলা। ও তুমি গায়ে মেখো না। আর আমি নিষেধ করে দেবো।’ মারিয়া বললো।

নিশাতের বিরক্তি বেড়ে যাচ্ছে। এমন সুগন্ধিময় সুস্বাদু খাবার সামনে নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়! যেমন হয়েছে শামীম, তেমনি হয়েছে মেজো আপু। বড়ো আপুও কম যায় না। ওর জন্যে একটা টুকরা রেখে দিলেই তো হতো। এত ডাকাডাকি করে বেড়ানোর কী দরকার ছিল? এনে মনে এসব কথা ভাবে আর গজরায় নিশাত। তারপর শিগগিরই সে বিরক্তি দূর করার উপায় আবিষ্কার করলো। সে কেকের কাছে গিয়ে তার গন্ধ শুঁকতে লাগলো। আহ! কী মজার! মনে মনে তৃপ্তি অনুভব করতে লাগলো সে। একটু পর লক্ষ করলো কেক কাটার সময় তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা খসে পড়ে এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্লেটের ওপর। সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে মুখে পুরতে লাগলো সে। মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘খুব সুস্বাদু!’ কিন্তু দ্রুতই সেগুলো শেষ হয়ে গেল। এখন কী করবে সে? আনিকার কোনো খবর নেই। মনে হচ্ছে কত কাল হয়ে গেছে, সে ফেরার আর নাম নেই। কেকের ছোটো একটা টুকরার ওপর একটা লাল চেরি ফলের অর্ধেকটা মুখ বের করে তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন ডাকছে তাকে। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে হাত বাড়ালো সে।

‘না নিশাত, না। ও কাজ ভুলেও কোরো না।’ মারিয়ার কণ্ঠ নরম, কিন্তু তার মধ্যেই এমন কঠিন শাসন ছিল যে তা অগ্রাহ্য করতে পারলো না নিশাত। সে হাত ফিরিয়ে নিল।

‘এভাবে তাকিয়ে থেকো না, নজর লাগবে। ওদিক থেকে বরং একটু ঘুরে এসো, দেখো আনিকার দেরি হচ্ছে কেন।’

কিন্তু নড়লো না নিশাত। কেক না খেয়ে এ জায়গা ছাড়বে না সে, জানে মারিয়া। সে চলে যাবে, আর সেই ফাঁকে কেক খাওয়া হয়ে যাবে, সে বঞ্চিত হবে, তা কোনো মতেই ঘটতে দিতে চায় না সে। 

বোনের মনোভাব বুঝতে পারে মারিয়া। বল্লে, ‘বেশ, আমিই যাচ্ছি। তুমি এখান থেকে একটুও নড়বে না কিন্তু। এগুলো দেখে রেখো, পাখি বা বিড়াল এসে যেন নষ্ট না করে।’

কেক রেখে অন্য কোনো চুলায় যেতে চায় না নিশাত। ঘাড় নাড়লো সে।

মারিয়া চলে গেলে কেকের প্লেটের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো সে। গুণে দেখলো কেকের এগারটা টুকরো হয়েছে। বেশির ভাগ বেশ ছোটো ছোটো। বড়ো বড়ো টুকরা মাত্র চারটা। সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পরখ করে দেখতে থাকলো সে। টুকরোগুলো মসৃণ হয়নি, সমান হয়নি। চাকুটায় ভালো কাটেনি, তাই কেকের টুকরোগুলোর কোনো কোনোটা আঁকাবাঁকাও হয়েছে। নিশাত ভাবলো এতগুলো টুকরোর মধ্যে থেকে একটা-দুটা যদি না থাকে তাতে কী-ই বা আসে-যায়? নিশাতের মনের মধ্যে গেয়ে উঠলো কে যেন। কেউ বুঝতেও পারবে না, অভয় দিলো সে। যেমনই ভাবা অমনই একটা বড়ো টুকরা তুলে মুখে পুরে দিলো সে। ভালো করে চিবানোর ফুরসতও পেল না। দ্রুত খেয়ে মুখ মুছে নিল। খানিকক্ষণ বসে থাকলো চুপচাপ। আনিকা, শামীম, বা মারিয়া কারোরই পাত্তা নেই এখনো। সে কেকের টুকরোগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পরখ করতে লাগলো। আর কখন যে তার মধ্যে থেকে ছোটো একটা টুকরা মুখে পুরলো তা সে নিজেও টের পেল না। আরো দ্রুত, অনেকটা কোঁত-কোঁত করে গিলে নিল সে কেকের টুকরোটা। কিছুক্ষণ পর মারিয়া ফিরলো। হতাশা তার চোখে-মুখে।

‘কোথায় যে গেল!’

‘আসবে না নাকি?’ নিশাত বললো।

‘না, না, আসবে না কেন? মনে হয় শামীমকে খুঁজে পাচ্ছে না।’

‘শামীম তো ওরকমই। ওকে ডাকার কী দরকার?’

‘কী যে বলো না তুমি! একটু আগেই তো বললাম ও আমাদের একমাত্র ভাই। তোমার মতো ওকেও আমরা সবাই কত্ত ভালোবাসি। এখন তাকে বাদ দিয়ে একা-একা কেক খাবো আমরা?’ 

‘না, দেরি হচ্ছে দেখে বললাম। তাছাড়া ওদের জন্যে রেখে দিলেই তো হয়।’ মিনমিন করে বললো নিশাত।

মারিয়া তার কথার কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না। বড়ো বোনকে চুপ থাকতে দেখে উৎসাহিত বোধ করলো নিশাত। ‘এভাবে কেক কেটে ফেলে রেখে দেয় কেউ? কেকের স্বাদই মনে হয় নষ্ট হয়ে যাবে!’ বললো সে।

তার কথার পিঠে কথা বলতে যাচ্ছিল মারিয়া, ঠিক সেই মুহূর্তে আনিকা আর শামীম এসে হাজির হলো। তারা সোজা কেকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। 

‘এত দেরি হলো কেন তোমাদের?’ জিজ্ঞেস করলো মারিয়া।

‘আর বোলো না, ছবি আঁকছিল শামীম। শেষ করে তবে এলো।’ আনিকা উত্তর দিলো।

‘তার মানে তোমরা ছাদের ওপর ছিলে? হায় আল্লাহ! এদিকে আমি তোমাদের ঘরের মধ্যে খুঁজছিলাম। আমি তো ডাকছিলাম তোমাদের, শুনতে পাওনি তোমরা?’

মারিয়ার কথা যেন শুনতেই পেল না আনিকা। সে কেকের প্লেটের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময়। সে মনে মনে ভাবে, তার ভুল হচ্ছে না তো? সে মনোযোগ দিয়ে দেখলো আবার কেকগুলো। নাহ্, ঠিক! তার ধারণাই ঠিক। কেকের টুকরা যেন কম মনে হচ্ছে। 

তার হাব-ভাব দেখে মারিয়া বললো, ‘কী ব্যাপার? কী দেখছো অমন করে?’

‘না...মানে... দেখে মনে হচ্ছে দু’একটা টুকরা নেই।’

‘নেই মানে? না-না, তুমি ভুল বলছো। কম হবে কেন? তুমি কী বলতে চাচ্ছো?’

‘না...মানে...আমার মনে হচ্ছিল আরকি। বাদ দাও আপা।’ আনিকার একটা বাঁকা দৃষ্টি তার অজান্তেই নিশাতের ওপর দিয়ে ঘুরে গেল। তার মনে হলো, নিশাতের দ্বারা অনেক কিছুই সম্ভব। সন্দেহ হলেও সেটা বলা যাচ্ছে না, কারণ এখানে তার সঙ্গে মারিয়াও ছিল। সে তাদের বড়ো বোন, খুব সমঝদার মেয়ে। তাকে অবিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মন থেকে অশুভ চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেললো আনিকা। 

মারিয়াও ভাবলো বিষয়টা নিয়ে। সে তো ছিল না খানিকক্ষণ। সেই ফাঁকে কি নিশাত কিছু করেছে? যা লোভী মেয়ে সে, তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। তবু দেখেনি যখন তখন এ নিয়ে কিছু না বলাই ভালো, সন্দেহ করাও উচিত নয়। সে শুনেছে, কুরআনে আল্লাহ অনর্থক সন্দেহ করতে নিষেধ করেছেন। তাই সে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করলো না। 

কেকের একটা বড়ো টুকরা শামীমের দিকে এগিয়ে ধরলো আনিকা। 

শামীম বললো, ‘ওহ-নো! লেডিস ফার্স্ট!’ বয়সে সে নিশাতের বড়ো, মারিয়া ও আনিকার ছোটো, কিন্তু কথায় ও আচরণে পাকামির শেষ নেই।

‘তাহলে এদিকে এসো নিশাত, তুমি আগে নাও।’ মারিয়া বললো। আনিকা আপত্তি করলো না। হাজার হলেও ছোটো বোন তো।

শামীমকে আগে ডাকায় নিশাতের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এবার ডাক পেয়ে সব ভুলে গেল সে, তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। অমনি তার কোলের ভেতর থেকে কেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা ঝরে পড়লো। সকলের অগোচরে গপ-গপ করে কেক খাওয়ার সময় এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো তার ফ্রকের ভাঁজের মধ্যে আটকে গিয়েছিল, সে খেয়াল করেনি। বড়ো বড়ো চোখ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো সবাই।

‘এগুলো কী, নিশাত?’ আনিকা বললো।

‘এই হচ্ছে তাহলে কাণ্ড! কী আর বলা যাবে। যার যা কাজ আরকি!’ ঠেস মেরে কথাটা বললো শামীম।

মারিয়া নিশাতের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, ‘এসব কখন করলে তুমি?’

‘না...মানে...’

‘মিথ্যা গল্প বানিয়ো না নিশাত, যথেষ্ট হয়েছে।’

‘না...’

‘আবার না-না করছো! তুমি আসলেই লোভী। খুব খারাপ তুমি।’ শামীম বললো।

‘তুমি আমাকে গালি দিচ্ছো? আমি মাকে বলে দেবো।’ নিশাত কাঁদতে লাগলো।

‘এটা গালি নয়, বদনাম করাও নয়। তোমার স্বভাবের কথা বলা হচ্ছে।’ মারিয়ার দিকে তাকিয়ে শামীম বলতে শুরু করলো, ‘জানো আপা, একটু আগে মা আমাদের দু’জনকে ছোটো দু প্যাকেট বিস্কুট দিয়েছে।’

আনিকা আশ্চর্য হয়ে বললো, ‘তাই নাকি? তাহলে আমাদেরকে তো মা দেননি! আপা, তোমাকে দিয়েছেন?’ 

মারিয়া ঘাড় নাড়লো, ‘না।’

‘তোমরা তখন ছিলে না। তো ও করলো কী জানো?’

‘জানবো না কেন? ও আরো নেওয়ার জন্যে কান্না জুড়ে দিলো।’ আনিকা বললো।

‘ঠিক বলেছো। ও আরো নিবে বলে কাঁদতে লাগলো। কী আর করবো... আমি আমারটার অর্ধেক দিলাম। তবু সে সন্তুষ্ট হলো না, কারণ সে জেনে গিয়েছিল তোমাদের দুজনের জন্যে একটা প্যাকেট রয়েছে। ওটাও তার চাই। তাই সে কাঁদতেই থাকলো।’

‘ও ওরকম করবে সে তো আমি জানিই। কিন্তু আম্মা কিছু বললেন না?’ জিজ্ঞেস করলো আনিকা।

শামীম বললো, ‘আম্মা একটু বোঝালেন। কিন্তু ও কি বোঝার মানুষ? কাঁদতেই থাকলো। মা খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন।’

‘ও... তাই বলো! ...তুমি তখন তাহলে এইজন্যে কাঁদছিলে?’ মারিয়া জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কোনো উত্তর পেল না।

‘এটা খুব খারাপ, নিশাত। তুমি আমাদের ছোটো বোন, তোমাকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি, তোমার সেটা বোঝা উচিত।’ সে বলে চললো, ‘এই যে দেখো, আনিকা কেকটা এনে চুপি-চুপি একা-একা খেয়ে নিতে পারতো। পারতো কি না বলো? বলো?’

মাথা নাড়লো নিশাত।

‘কিন্তু খায়নি। সবাইকে সাথে নিয়ে ভাগ করে খেতে চেয়েছে। তোমাকেও দিচ্ছে। এভাবে সবাইকে দিয়ে-থুয়ে খেতে হয়।’ মারিয়া মুরুব্বির মতো উপদেশের সুরে বললো কথাগুলো।

অবশেষে আনিকা তার হাতের কেকের টুকরাটা নিশাতের দিকে এগিয়ে ধরলো। এতটুকুও লজ্জা, দ্বিধা বা দেরি না করে সেটা হাতে নিল সে, এবং তৎক্ষণাৎ চিবুতে লাগলো। তাই দেখে হেসে উঠলো আনিকা। দেখাদেখি অন্যরাও হাসতে লাগলো। মারিয়া নিশাতকে জড়িয়ে ধরে কাতুকুতু দিতে লাগলো, ‘আমাদের বোনটা এমন পেটুক হলো কী করে গো!’

বেশ মজা করে কেক খেলো ওরা। মায়ের জন্যও এক টুকরা কেক রেখে দিলো। 

‘এটাকে যেন আবার সাবাড় করে দিও না। খুব খারাপ হবে তাহলে।’ একই সঙ্গে টিপ্পনী আর হুঁশিয়ারি ছুড়ে দিলো শামীম।

মারিয়া তাকে সমর্থন করে বললো, ‘ও কিন্তু ঠিকই বলেছে। ওটাতে হাত লাগিও না, বা আম্মার কাছে বায়না করো না যেন।’

কথা বলার ফুরসত নেই তার। কারণ সে তার ভাগের চেয়ে এক টুকরা বেশি কেক পেয়েছে। সে ইশারায় এবং অস্ফুট শব্দে তার অঙ্গীকার জানালো। 

খাওয়া শেষে তারা বাড়ির বাইরে বাগানে গেল। বিকেল এখন, সন্ধ্যে পর্যন্ত তাদের খেলাধুলা করার সময়। মাগরিবের আজান হলেই বাড়িতে ঢুকতে হবে, নামাজ পড়ে পড়তে বসতে হবে। ততক্ষণ তাদের অবসর।

বাগানে তখন মালী চাচা কাজ করছিলেন। তাদের দেখে হাতের ইশারায় ডাকলেন তিনি। তারা কাছে যেতে ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে তিনি ফিস-ফিস করে বললেন, ‘আস্তে..., শব্দ কোরো না।’ তারপর হাতের ইশারা করলেন

‘ওদিকে তাকিয়ে দেখো কী! দেখতে পাচ্ছো?’

ওরা পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে পা টিপে-টিপে নিঃশব্দে এগুলো। বাগানের কোনায় একটা আ¤্রপালি আমের গাছ। বেশি বড়ো নয়, কিন্তু বেশ ঝাঁকড়া। তারই একটা ডালে কী যেন আটকে আছে।

‘পাখির বাসা?’ জিজ্ঞেস করলো মারিয়া।

‘ঠিক, পাখির বাসা।’ শামীম বললো।

‘আমি দেখবো।’ নিশাত প্রায় চেঁচিয়ে ওঠার মতো করে বললো। তার মুখ চেপে ধরলো মারিয়া। 

‘আস্তে! চেঁচিও না।’

‘ওর মধ্যে কী যেন নড়ছে।’ ফিসফিস করে বললো আনিকা।

ওরা আরো কাছে গেল। 

‘চারটে।’

‘হ্যাঁ, ভালো করে দেখো।’ মালী চাচা বললেন। ‘এগুলো হচ্ছে পাখির ছানা। শরীরে এখনো লোম গজায়নি। লালচে উদোম শরীর।’ তিনি আঙুল দিয়ে বাচ্চাগুলোকে ছুঁতে গেলেন। অমনি তারা একসঙ্গে ঘাড় তুলে ধরলো। হাঁ করে জিভ নাড়াতে লাগলো। তাদের হাঁ-মুখের ভেতর দিয়ে একেবারে গলার নিচ পর্যন্ত যেন দেখা যায়। ভারি মজা পেলো ছেলেমেয়েরা।  

‘ওরা এমন করছে কেন জানো?’ জিজ্ঞেস করলেন মালী চাচা।  

‘কেন?’

‘ওরা মনে করছে ওদের মা এসেছে, ওদের জন্য খাবার এনেছে। খাবার খাওয়ার জন্য অমন করে হাঁ করছে। ওদের বয়স বেশি হয়নি। বড়ো জোর তিন-চার দিন হবে হয়তো। এখনো চোখ ফোটেনি।’ মালী চাচা বললেন।

‘ওরা অন্ধ!’ শামীম বললো।

‘হ্যাঁ।’ 

‘ওদের মা যা এনে দেবে তাই খাবে ওরা?’ আনিকা জিজ্ঞেস করলো।

‘হ্যাঁ, ওরা ওদের মায়ের ওপর নির্ভরশীল। মা যা খাওয়াবে তাই খাবে ওরা।’

‘ওদের মা কোথায় গিয়েছে?’ জিজ্ঞেস করে নিশাত।

‘খাবারের সন্ধানে গিয়েছে। এখনই আসবে হয়তো।’ মালী চাচা বললেন। ‘কিন্তু আমরা না গেলে সে আসবে না।’

‘কেন, আসবে না কেন?’

‘বা রে! ওর ভয় করবে না?’

‘ও। ঠিক আছে তাহলে।’ বলে বাসাটা আলতোভাবে স্পর্শ করলো শামীম। অমনি পাখির ছানাগুলো ঘাড় তুলে হাঁ করে মাথা নাড়াতে লাগলো, তাদের পালকবিহীন পাখা আর লেজ ঝাপটাচ্ছে।

‘কী বড়ো হাঁ করেছে দেখো।’ আনিকা বললো।

‘ওদের মনে হয় খুব খিদে পেয়েছে।’ নিশাত বললো।

‘ঠিক। যার কষ্ট যে বোঝে!’ টিপ্পনী কাটলো শামীম।

মুচকি হেসে চোখের ইশারায় তাকে নিষেধ করলো মারিয়া। 

‘আমার মনে হয় নিশাত ঠিক বলেছে, ওদের খিদে পেয়েছে।’

‘এক কাজ করলে হয় না?’

সবাই তাকালো নিশাতের দিকে। সে বললো ‘কেকের কুচি এনে খাওয়ালে কেমন হয়?’

ছোট্ট বোনটার বুদ্ধির তীক্ষèতা দেখে অবাক ওরা। তৎক্ষণাৎ ছুটলো আনিকা। এক দৌড়ে কেকের অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুচি কুড়িয়ে আনলো। সেগুলোকে হাতের তালুতে ডলে আরো ক্ষুদ্র গুঁড়ো করে ফেললো। পাখির ছানারা অনেক কষ্ট করে গিললো কেকের গুঁড়ো। 

‘ওদের মায়ের মতো সুন্দর করে খাওয়াতে পারছি না আমরা।’ মারিয়া বললো।

‘হ্যাঁ, মা-পাখি খাবার একেবারে ওদের গলার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। সেটা আমরা পারছি না।’ বললেন মালী চাচা। ‘ওদের এভাবে না খাওয়ানোই ভালো। ক্ষতি হতে পারে।’

‘কিন্তু ওরা আরো চাচ্ছে, দেখেন।’

সত্যি, ওরা আরো বড়ো হাঁ করে গলা বাড়াচ্ছে। তাই দেখে আরো কিছু কেকের গুঁড়া দিলো শামীম।

‘আচ্ছা, অনেক হয়েছে। এবার চলো আমরা যাই। আমরা না গেলে ওদের মা আসতে পারবে না।’

‘আমি ওদের মা’র খাওয়ানো দেখবো।’ নিশাত বায়না ধরলো।

‘বেশ তো। সেজন্য আমাদের এখান থেকে যেতে হবে। তা নাহলে মা-ই যে আসবে না।’

মারিয়া বললো, ‘আমরা দূরে গিয়ে লুকিয়ে থাকি। তাহলে ওদের মা আসবে। তাই না চাচা?’

‘ঠিক বলেছো।’ মালী চাচা একমত হলেন।

তারা ওখান থেকে পিছিয়ে গিয়ে লেবু গাছের ঝোপের আড়ালে চলে গেল। কারো সাড়া না পেয়ে পাখির ছানাগুলো গুটিসুটি মেরে পরস্পর জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়লো।

বেশি দেরি করতে হলো না ওদের। মা-পাখিটা এসে বাসার চারপাশে চক্কর মারতে লাগলো। তার ঠোঁটে একটা ছোট্ট পোকা। 

‘বাসায় না বসে অমন ঘুরছে কেন?’ জিজ্ঞেস করলো আনিকা।

মালী চাচা বললেন, ‘সব ঠিক-ঠাক আছে কিনা দেখে নিচ্ছে। কখন বিপদ আসে বলা তো যায় না।’

‘কীসের বিপদ?’

‘সাপ-খোপ, শিকারি পাখি, এসব আছে না?’

‘ও!’ মারিয়ার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালো নিশাত। তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে নিল সে।

‘তাছাড়া মানুষের ভয়ও কম নয়।’ বললেন মালী চাচা। 

মানল তারা। না মেনে উপায় নেই। কারণ তারা এটা দেখে অভ্যস্ত যে মানুষ পশু-পাখি ধরে, মারে, খায়।

অবশেষে মা-পাখিটা বসলো বাসায়। অমনি যেন ঘুম ভেঙে গেল বাচ্চাগুলোর, হাঁ করে ঘাড় বাড়িয়ে পাখা ঝাপটাতে লাগলো। মা-পাখি একজনের মুখের ভেতর ঠোঁট ঢুকিয়ে পোকাটাকে তার গলার মধ্যে সেঁধিয়ে দিলো। তারপর উড়ে গেল। বাকিদের ডানা ঝাপটানোই সার। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারলো তাদের মা চলে গেছে তখন তারা প্রত্যেকে শান্ত হয়ে গেল, চুপ করে আবার তারা জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়লো।

‘ওই অতুটুকু মাত্র একটা পোকা! ওতে পেট ভরবে!’ নিশাত বললো।

‘ওর মা ভালো জানে ওর জন্য কতটুকু দরকার। ছানাটাও মা যা দিচ্ছে তাতেই সন্তুষ্ট। এতেই তার পুষ্টি হবে যথেষ্ট, কোনো সমস্যাও হবে না।’ মালী চাচা বললেন।

‘একজন মাত্র খেতে পেলো, কিন্তু বাকিরাও সবাই কেমন শান্ত হয়ে রইলো।’ অবাক হয়ে বললো মারিয়া।

মালী চাচা বললেন, ‘হ্যাঁ। তারা জানে তারাও পাবে, মা তাদের সব্বাইকে একে-একে খাওয়াবে। যতক্ষণ না তাদের পালা আসে ততক্ষণ তাদের শান্ত থাকতে হবে।’ 

‘ইস! কী ভালো ওরা।’ আনিকা বললো

‘অন্যের ভাগে বাগড়া দেয় না ওরা। এ নিয়ে ঝগড়া-কান্নাও করে না।’ বয়স্কদের মতো একটা ভারিক্কি ভাব ফুটে উঠলো শামীমের কণ্ঠে। নিশাত একবার এর দিকে আরেকবার ওর দিকে তাকাতে লাগলো। সে বুঝতে পারছিল ভাইবোনেদের এসব কথার মধ্যে তার প্রতি ঠেস আছে। কিন্তু সে কিছু বললো না। তার পেটের মধ্যে কেমন যেন করছে বেশ খানিকক্ষণ থেকে। ব্যথা-ব্যথা ভাব। ক্রমেই বাড়ছে সেটা। 

‘দেখা যাক, এবার মা-পাখিটা কাকে খাওয়ায়। আর অন্য বাচ্চাগুলোই বা কী করে।’

তারা মা-পাখির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

নিশাত বললো, ‘আমি মা’র কাছে যাবো। আমার শরীর খারাপ করছে।’

‘সে কি কথা! সত্যি বলছো?’

কাঁদতে লাগলো নিশাত। ‘আমার পেট ব্যথা করছে।’ পেট চেপে ধরেছে সে।

‘সত্যি বলছো তো?’ মারিয়া তাকে কাছে টেনে নিল।

পেট চেপে ধরে সে আরো জোরে কাঁদতে লাগলো। ঘাবড়ে গেল ওরা।

‘চলো সবাই, চলো। এটা পরে দেখা যাবে।’ তাড়া দিয়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ি গেল মারিয়া।

‘তোমার পেটুক স্বভাবের জন্য এটা হয়েছে। বাপ-মা, অভিভাবক, বড়োদের কথা শুনতে হয়, বুঝলে? উলটা-পালটা খাওয়ার জন্য এরকম হয়েছে।’ ধমকালেন মা।

‘ওষুধ আনব, মা?’ মারিয়া বললো।

‘আচ্ছা, একটু দেখি। ওর বমি হলে ভালো হতো।’ মা বললেন।

কিন্তু বমি হচ্ছে না, পেটব্যথাও কমছে না। নিশাত কাহিল হয়ে পড়ছে। ‘আমার পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে মা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

শামীম টিপ্পনী কাটলো, ‘নিজেরটাও খাবে, অন্যেরটাও খাবে। দেখো মজা এখন।’

‘তুমি চুপ করো।’ ব্যথায় কঁকাতে কঁকাতেই ঝামটা মারলো নিশাত।

‘কেকটা কি খারাপ ছিল?’ মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন মা।

‘না মা। আসলে লোভে পড়ে ও অনেক বেশি খেয়ে ফেলেছে। চুরি করেও খেয়েছে।’ আগ বেড়ে বললো শামীম। তার কথায় অবাক হলেন না মা। তিনি চেনেন তার প্রত্যেক সন্তানকে। 

‘আর কী খেয়েছো?’

এমনিতেই ব্যথায় তার কষ্ট হচ্ছে। মায়ের প্রশ্নে তার মুখটা আরো করুণ হয়ে গেল।

‘কী খেয়েছো? বলো।’ মা আবার জিজ্ঞেস করলেন।

মুখটা আরো ভার করে নিশাত বললো, ‘বাদাম।’

‘বাদাম? বাদাম কোথায় পেলে? ঘরে তো বাদাম ছিল না।’ মায়ের এ কথায় নিশাতের মুখ-চোখ এবার একেবারে কালো হয়ে গেল।

‘কোথায় পেলে বাদাম?’

‘রান্নাঘরে।’ মিনমিন করে বললো নিশাত।

‘হায় আল্লাহ!’ চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মারিয়ার। ‘আম্মা, মনে হয় ওই বাদামগুলো। আপনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ওই নষ্ট বাদামগুলো।’ 

কপাল চাপড়াতে লাগলেন মা। ‘এ তুমি কী করেছো নিশাত! ওই নষ্ট বাদামগুলো ফেলে দেবো বলে ওখানে রেখেছিলাম। হায় আল্লাহ! আমি তখনি কেন ফেললাম না ওগুলো।’

নিশাত এবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ‘আমার পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে!’

‘হুম। ওষুধ ছাড়া সারবে না মনে হচ্ছে,’ মা বললেন। ‘আমার ওষুধের বাক্সটা আনো তো কেউ।’

মায়ের নির্দেশ পেয়ে ছুটলো মারিয়া। নিশাতকে সোফার ওপর শুইয়ে দিলেন মা। আনিকা তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। শামীমও তার পাশে গিয়ে বসলো। ছোটো বোনের কষ্ট দেখে তারও কষ্ট হচ্ছে। ‘ভালো হয়ে যাবে। মা ওষুধ দিলেই ভালো হয়ে যাবে।’ সে বললো।

কিন্তু মায়ের ওষুধেও কোনো ফল হলো না। বমি হলো, তবু পেটব্যথা কমলো না। জ্বর এসে গেল। তারপর পাতলা পায়খানা শুরু হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিতে হলো। পুরো তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল। 

বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে কী যে শান্তি পেল নিশাত। ভাইবোনরা সব হইহই করতে লাগলো। বাড়ির সবাই খুব মুষড়ে পড়েছিল। সবার মুখে হাসি এখন। 

‘যাক বাবা! আমি তো মনে করেছিলাম হাসপাতালে এক-আধ মাস থাকা লাগে নাকি। আরো বড়ো-বড়ো ইঞ্জেকশন, স্যালাইন, নাকে নল লাগে কিনা তাই ভাবছিলাম।’ আনিকার দিকে তাকিয়ে বললো শামীম। কিন্তু তার লক্ষ্য যে সে তা বুঝতে অসুবিধে হলো না নিশাতের। তাকে ভয় দেখানোর কৌশল এটা, জানে সে। তাই অব্যর্থ অস্ত্রটাই ছাড়লো- ‘মা!’ 

মা ধমকে উঠলেন, ‘ওকে জ্বালিও না বাছারা। ওর এমনিতেই কাহিল অবস্থা। শিক্ষা হয়েছে, বলো? হয়েছে তো?’

অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো নিশাত। মুখে অপরাধবোধের লাজুক হাসি। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মা। বললেন, ‘দেখলে তো গুরুজনদের কথা না শুনলে কী হয়?’

খব দুর্বল নিশাত। মারিয়া মাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। দেখাদেখি আনিকা ও শামীমও হাত লাগালো। এক রকম চ্যাংদোলা করে নিশাতকে ঘরে নিয়ে গেল ওরা। আপত্তি করলো না নিশাত, জানে তাতে এখন কোনো লাভ হবে না। তার চাইতে বরং নাগরদোলা চড়ার সখ মেটানোই ভালো, ভাবলো সে। 

ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো নিশাত। এখন বেশ আরাম বোধ হচ্ছে।

 ‘বেশ, এবার চলো সবাই। ও বিশ্রাম করুক।’

সবাই চলে গেলে সে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। তার মন ছুটে যেতে চাইছে বাইরে। মনে হচ্ছে কত কাল যেন বাড়িছাড়া। সবকিছু যেন নতুন-নতুন লাগছে। উঠোনে, বাহির বাড়িতে, বাগানটায় কতদিন যেন ছোটাছুটি করা হয়নি। বাগানের কথায় পাখির বাসার কথা মনে পড়লো তার। মাথার ভেতর পাখির ছানাগুলো পাখা ঝাপটাতে লাগলো। ওই বাচ্চাগুলো তার চাই। অন্য সময় হলে এই বায়না নিয়ে জোর কান্নাকাটি শুরু করে দিতো সে। এখন তার মনে হচ্ছে সেটা ঠিক হবে না। বরং সুযোগ মতো মাকেই বলবে সে। একটা শুধু ভয়, শামীম বাচ্চাগুলো সব নিয়ে নিল কি না। যা ডানপিটে আর দুঃসাহসী ছেলে! এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়লো তা টেরই পেল না।

পরদিন স্কুল থেকে ফিরেই শামীম এলো তার কাছে। ‘ওই পাখির বাচ্চাগুলোর কথা মনে আছে তোমার? কী সুন্দর, তাই না?’

বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো নিশাতের। ও তো ভোলেনি দেখছি, মনে মনে ভাবলো সে। এই কয়দিন সে ছিল না। এই ফাঁকে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সে কী করেছে কে জানে!

‘চলো দেখি গিয়ে পাখির বাচ্চাগুলো কেমন আছে।’

শামীমের কথা শুনে নিশাত বুঝতে পারলো এই কয়দিন সে পাখির বাসার কাছে যায়নি। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘দেখনি এই কয়দিন?’

‘না। তোমার জন্যই তো হয়নি। চলো যাই গিয়ে দেখে আসি।’ 

‘না বাবা, মা বকবে।’

‘আরে বকবে না। আজ মালী চাচা নেই। আমরা চুপিচুপি যাবো, কেউ বুঝতে পারবে না।’

নিশাতের মনে হলো, শামীম তো অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে, অনেক খোঁজ-খবরও নিয়ে ফেলেছে। তার মানে তার মাথার ভেতর পাখির ছানাগুলো ভালোভাবেই ঢুকে পড়েছে। প্রমাদ গুনলো সে। চিন্তাটাকে তার মাথা থেকে তাড়াতে চাইলো। সে বললো, ‘এতসব ভাবতে যেও না, মা ঠিক জেনে যাবে। তখন দেখো মজা।’

‘তা-ও ঠিক। তাহলে বড়ো আপাকে বলি গিয়ে।’ বোনের আগ্রহ না দেখে একা-একাই ছুটলো শামীম। 

পরদিন পাখির বাসা দেখতে যাওয়ার কথাটা শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছে উঠলো। সব শুনলেন মা। বললেন, ‘ডাকো সবাইকে’। 

সবাই এলো। কিন্তু নিশাত নেই। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। শামীম বললো, ‘আমার মনে হয় ও বাগানে গেছে।’

‘তাহলে ও পাখির বাসার কাছে যায়নি তো?’

সন্দেহটা কেউ নাকচ করতে পারলো না। ওরা দ্রুত বাগানের দিকে ছুটল। আর অবাক হয়ে দেখলো তাদের ধারণাই ঠিক। পাখির বাসার ওপর ঝুঁকে পড়ে হাত দিয়ে কী যেন করছে সে।

‘ও নিশ্চয় খারাপ কিছু একটা ঘটাচ্ছে।’ বলেই দৌড় লাগালো শামীম। তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো নিশাত। বেশ ঘাবড়েও গেল। একটু পেছনে সরে দাঁড়ালো সে।

শামীম সেখানে গিয়ে যা দেখলো তাতে তার চোখ ছানাবড়া। পাখির ছানাগুলোর মুখে পাউরুটির টুকরা, সেগুলো তারা না পারছে গিলতে না পারছে উগরে দিতে। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।  

‘হায় আল্লাহ! বাচ্চাগুলোকে ও মেরে ফেলেছে!’ চেঁচাতে লাগলো শামীম। 

বাচ্চাগুলোর গলনালির তুলনায় রুটির টুকরোগুলো বেশ বড়ো, তাই সেগুলো তাদের গলা দিয়ে ভেতরে নামতে পারছে না, আটকে গেছে। মা দ্রুত বাচ্চাগুলোর গলা থেকে রুটির টুকরো বের করতে লাগলেন। কিন্তু শেষের বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না। রুটির টুকরা তার গলার অনেকটা নিচে চলে গেছে, না নামছে না উঠছে। মা আঙুল দিয়ে সেটা বের করতে পারলেন না। তাদের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লো বাচ্চাটা। খুব কষ্ট পেল ওরা। 

‘এ তুমি কী করলে নিশাত!’

নিশাত ভয় পেয়ে গেছে। পাখির ছানার মৃত্যুতে কষ্টও পেয়েছে। সে কাঁদতে লাগলো। 

মা-পাখিটা ফিরে এলো। বাসার কাছে এতগুলো মানুষ দেখে সে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো, কিচিরমিচির করে ডানা ঝাপটে চারপাশে উড়ে বেড়াতে লাগলো। 

মা বললেন, ‘ওদের মা এসেছে। তোমরা চলে এসো এবার। ওদের মা-ই ভালো জানে ওদের কী করে বাঁচিয়ে তুলতে হবে।’   

ওরা দূরে সরে এলো। মা-পাখিটা খানিকক্ষণ বাসার ওপর চক্কর দিলো। তারপর বসলো। সে আর্তস্বরে কিচিরমিচির করতে লাগলো।

‘আহ! একেই বলে মা। কীভাবে কাঁদছে দেখ। কী খারাপ কাজটাই না তুমি করলে, নিশাত।’ মা বললেন।

‘তুমি কী করে এমন নিষ্ঠুর হতে পারলে নিশাত? বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেললে?’ ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত কণ্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো শামীম।

ভয়ে জড়সড় হয়ে পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। এমন দুর্ঘটনা ঘটবে জানলে এ কাজ করতো না সে। ‘আমি মারতে চাইনি। আমি ওদের খাওয়াতে চেয়েছিলাম।’   

মারিয়া বললো, ‘তুমি খাওয়াতে চেয়েছিলে, কিন্তু কী করে খাওয়াতে হয় তা তো তুমি জানো না, তাই না? আর এই দায়িত্বও তোমাকে কেউ দেয়নি।’

‘তোমার বোকামির জন্য কত বড়ো সর্বনাশ হয়ে গেল!’ আনিকা বললো।

মা দেখলেন নিশাত মুষড়ে পড়েছে। সে অপরাধবোধে ভুগছে। তাকে কাছে টেনে নিলেন তিনি। 

‘দেখলে তো তোমার অবিবেচক দয়ার ফল কী হলো!’

‘দয়া?’ মায়ের কথা শুনে বিস্মিত সবাই। 

‘একে আপনি দয়া বলছেন আম্মা?’

‘হ্যাঁ, সে দয়া করতেই চেয়েছিল, কিন্তু বুঝতে পারেনি তার বোকামির কারণে সেই দয়া বাচ্চাগুলোর প্রাণ কেড়ে নিতে পারে!’

‘ও একটা খুনি!’ শামীম বললো। তার রাগ কোনো কিছুতেই কমছে না।

‘না বাছা, ওভাবে বোলো না। ও আসলে বুঝতে পারেনি। বাচ্চাগুলোর বয়স এবং খাওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তাছাড়া কোনো ধরনের খাবার তাদের জন্য উপযোগী সেটাও বিবেচনা করতে হবে। সেটা ওদের মা-ই সবচেয়ে ভালো জানে।’

মা ওদের বোঝাতে লাগলেন, ‘বাচ্চাগুলো অন্ধ, এবং অনভিজ্ঞ, তারা সম্পূর্ণরূপে তাদের মায়ের ওপর নির্ভরশীল। মা যখন খাবার নিয়ে আসে তখন তারা খুশিতে নেচে ওঠে, খাওয়ার জন্য হাঁ করে, মা তাদের মুখের মধ্যে খাবার ঢুকিয়ে দেয়। যে খাবার তারা খেতে পারবে, যতটুকু গ্রাস তারা গিলতে পারবে, সেই খাবার ততটুকু পরিমাণেই মা তাদের মুখে দেয়। মা তাদের প্রত্যেককে একে একে খাওয়ায়। তারাও মায়ের ওপর ভরসা করে, মায়ের দেওয়া খাবার পেয়ে তারা সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকে। এজন্য মারামারি বা কান্নাকাটি করে না। কে খাবার দিলো, কী খাবার দিলো, তারা বোঝে না। যতক্ষণ মায়ের ¯েœহ ও প্রজ্ঞা কাজ করে ততক্ষণ তাদের কোনো অসুবিধা হয় না, অন্যেরা এর মধ্যে মাথা গলালেই সমস্যা।’

ওরা মন দিয়ে মায়ের কথা শুনছিল। মা-পাখিটা বাচ্চাগুলোকে তার পাখনার নিচে টেনে নিয়েছে।   

মা বললেন, ‘দেখো তোমরা, উদ্দেশ্য ভালোই ছিল, নিশাত বাচ্চাগুলোকে খাওয়াতে চেয়েছিল, কিন্তু খাবারটা গুণে ও পরিমাণে তাদের উপযোগী ছিল না, তাতেই বিপত্তি। এর ফল কী মারাত্মক হয় দেখলে তো? একটা বাচ্চা মারা গেল। বাকিগুলোর কী হবে বলা যায় না।’ 

নিশাতের দিকে তাকিয়ে মা বললেন, ‘ওরা নিশ্চিন্তে খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত, তাই লোভীর মতো যা পেয়েছে তাই গিলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, ভেবে দেখেনি ওটা গিলতে পারবে কি না। সে ধরনের বুদ্ধি বা বিবেক অবশ্য তাদের নেই। তাই যে-যা দিচ্ছে তার তা-ই তারা খাচ্ছে। তাতে তাদের কোনো ক্ষতি হবে কি না ভেবে দেখছে না। আসলে পশু-পাখিদের সে বিবেচনা খুব কম। সেটা তাদের দোষ নয় বটে কিন্তু ক্ষতির কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেখলে তো!’

‘নিশাতকে ভালো করে বোঝান, মা। ওর লোভ বেশি।’ শামীম ফোড়ন কাটলো।

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। তবে সবাইকেই ব্যাপারটা বুঝতে হবে। আমি তোমাদের খাবার দিই, ভাগ করে-করে দিই। আমি মা, আমি জানি কখন তোমাদের কার কী কতটুকু দরকার। কিন্তু তোমরা অনেক সময় সেটা বুঝতে চাও না, বা বুঝতে পারো না, তা মানতে চাও না। বিশেষ করে নিশাত, তুমি, তুমি এটা বেশি করো। তোমাদের আমি কেক ভাগ করে দিলাম। কিন্তু নিশাত লোভ করে নিজেরটুকু তো খেলোই, অন্যের অংশও খেয়ে নিল। নষ্ট ফেলে দেওয়া বাদামের লোভটাও সামলাতে পারলো না। এমনকি চুরি পর্যন্ত করলো। খুব খারাপ কাজ এটা। চুরি করা একটা অপরাধ। খুব খারাপ অপরাধ। লোভে পড়ে তুমি সেটাও করলে! আহ!’ বুকটা চেপে ধরলেন মা। ‘কী হলো আম্মা! খারাপ লাগছে?’ ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো মারিয়া। 

‘হ্যাঁ, মনটা বড্ড খারাপ লাগছে। নিশাত নিজেও ভুগলো, আবার পাখিগুলোকেও ভোগালো। এমনকি একটা বাচ্চা মরেও গেল। কত বড়ো খারাপ কাজ হলো, বলো তো! ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।’

মায়ের কষ্ট দেখে নিশাতেরও কষ্ট বোধ হতে লাগলো। সে করুণ মুখে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। মা তাকে জড়িয়ে নিলেন। ‘আমার সিদ্ধান্ত অমান্য করলে তুমি, লোভের কারণে তোমার পেট খারাপ হলো, তুমি কষ্ট পেলে, আমাদেরও কষ্ট দিলে। আবার তুমি পাখির বাচ্চাগুলোকে খাওয়াতে গেলে। অথচ তুমি জানো না তাদের জন্য কোনো খাবার দরকার, কখন দরকার, কতটুকু দরকার। এসব তাদের মা-ই ভালো জানে। তাদের মা যা করবে সেটাই তাদের জন্য কল্যাণকর।’

মারিয়া বললো, ‘আম্মা, আপনি সেদিন বলেছিলেন না যে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, তোমরা যাকে কল্যাণকর মনে করো তা আসলে অকল্যাণকর, আর যাকে অকল্যাণকর মনে করো তাই তোমাদের জন্য প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর। কিন্তু তোমরা তা জানো না, বুঝতে পারো না।’

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছো। মা যেমন জানেন তার সন্তানদের কিসে মঙ্গল হবে, আমাদের সৃষ্টিকর্তাও তেমনি সবচেয়ে ভালো জানেন আমাদের কিসে কল্যাণ হবে। সেসব কথাই তিনি পবিত্র কুরআনে বলেছেন, আমাদের রাসূল (সা)ও সেসব জিনিসই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু অনেক মানুষই তা মানতে চায় না। তার জন্যই পৃথিবীতে এত অশান্তি, এত অকল্যাণ। মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগের শেষ নেই।’ 

‘তাই তো আল্লাহ আমাদের দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন- রব্বানা আতিনা ফিদ্-দুনিয়া হাসানাতাঁও, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাঁও, ওয়া ক্বিনা আযাবান্-নার।’ মারিয়া বললো।

‘হ্যাঁ, খুব ভালো দোয়া। এর মানে জানো?’

আনিকা ছটফটিয়ে বলে উঠলো, ‘জানি, জানি, আমি জানি, আম্মা।’

‘জানো? বেশ, বলো তো তাহলে।’ মা বললেন। 

‘হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি আমাদের এই দুনিয়াতে কল্যাণ দান করো, পরকালেও কল্যাণ দান করো, আর আমাদের দোযখের আগুন থেকে রক্ষা কোরো।’ 

‘বাহ! বেশ বলেছো। এই দোয়াটা তোমরা সবাই অর্থসহ মুখস্থ করে নিবে। আর উঠতে-বসতে সবসময় দোয়া করবে। আল্লাহর কাছে যত চাইবে আল্লাহ তত খুশি হবেন, তিনি তত দিবেন। কারণ তাঁর দয়ার শেষ নেই, আর তিনি দান করতে পছন্দ করেন।’

‘কিন্তু ওর পেটুক স্বভাবের কী হবে তাই বলুন আম্মা।’ শামীম বললো।

‘না বাছা, ও ভুল করেছে বলে ওর সঙ্গে রূঢ় আচরণ করো না। তবে তোমাকে একটা হাদিস শোনাই, ছোট্ট সোনামণি আমার।’ বলে আবার নিশাতকে বুকে টেনে নিলেন মা। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘একবার এক ভিনদেশি বাদশা আমাদের রাসূলের কাছে তিনজন ডাক্তার পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ তাদের রোগী দেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। বেশ কয়েকদিন পর ওই ডাক্তাররা রাসূলের কাছে গিয়ে বললেন, তাদের কাছে কোনো রোগী আসে না। একথা শুনে রাসূল বললেন, ‘আমার লোকদের সহজে অসুখ হয় না। কারণ, ওরা যখন খায়, তখন পেট পুরে খায় না। তারা পেটের এক-তৃতীয়াংশ ভরে খাবার খায়, এক-তৃতীয়াংশ পানি খেয়ে ভরায়, আর পরে পানি খাওয়ার জন্য পেটের এক-তৃতীয়াংশ খালি রাখে।’ বুঝলে তো, সব সময় পেট কিছু খালি রেখে খেতে হয়। তাহলে অসুখ কম হয়। নিশাত, বুঝলে?’

মাথা নাড়লো নিশাত, ‘বুঝেছি। আমি আর লোভ করবো না। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।’ 

‘সাবাশ! তুমি যদি এক-পা এগিয়ে যাও তাহলে আল্লাহ দশ-পা এগিয়ে আসবেন। তার মানে হলো তুমি যদি মনে-প্রাণে চেষ্টা করো তাহলে আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন। করবেনই। তুমি নিশ্চয়ই সফল হবে।’

‘আমরাও তোমাকে সাহায্য করবো।’ মারিয়া ছোট্ট বোনটির নাক টিপে দিলো। দেখাদেখি আনিকা এবং শামীমও তার গাল টিপে দিলো। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো নিশাতের মুখ। 

‘বুড়ি মেয়ে লজ্জা পাচ্ছে দেখো!... বলে তাকে জড়িয়ে ধরে কাতু-কুতু দিতে লাগলো ওরা। হাসির বান ছুটলো ওদের মুখে। 

ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক ভালোবাসা ও আনন্দ দেখে মায়ের মুখে প্রশান্তির ¯িœগ্ধ মায়া ছড়িয়ে পড়লো। তিনিও নীরবে হাসতে লাগলেন। ‘আল্লাহ, তুমি ওদের হেফাজত করো।’

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ