ভিনগ্রহী বন্ধু

ভিনগ্রহী বন্ধু

উপন্যাস আহমেদ বায়েজীদ মার্চ ২০২৪

সূর্যের আলো এসে চোখে পড়ায় ঘুম ভাঙলো প্রফেসর রিকির। শুরুতে আলোর ঝলকানিতে চোখ খুলতে কষ্ট হলো কিছুটা। তারপর সয়ে এলো ধীরে ধীরে। বহু বছর পর এমনটা হলো তার জীবনে। সাধারণত বেডরুমে সূর্যের আলো ঢোকার সুযোগ এই কংক্রিটের পৃথিবীতে এখন বিরল। তাই আজকের পরিবেশটা চিন্তা করে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল প্রফেসর রিকির। তবে সেটা কাটতেও সময় লাগলো না। মাত্র কয়েক সেকেন্ড এই প্রশান্তিটা স্থায়ী হলো, এরপরই মনে পড়লো তিনি এখন কোথায় আছেন।

‘আমি কোথায়?’

নিজেকেই প্রশ্ন করলেন প্রফেসর রিকি। তবে জবাবটা তার জানাই। জায়গাটা অচেনা হলেও অজানা নয়। এখানে তিনি স্বেচ্ছায়ই এসেছেন। চিৎ হয়ে শুয়ে থেকেই চোখ ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখলেন। বিশাল বেডরুম। প্রয়োজনীয় সব ফার্নিচারই আছে। এক পাশে বিশাল খাট। রুমের দখিন পাশটায় পুরোটা জুড়েই কাচের দেওয়াল। পর্দাগুলোও সরানো। যে কারণে সকালের সূর্যটা রোদ ছড়াতেই প্রফেসর রিকির চোখে এসে লাগে। আর এই আলোতে ঘুমিয়ে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। বিছানায় উঠে বসলেন প্রফেসর। কাচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরে দৃষ্টি দিলেন। দেওয়ালের বাইরে একটা বাগান। ছোটো ছোটো গাছগুলো দেখে বোঝা যায়, বাগানটার বয়স বেশি নয়। মাঝখানে পায়ে হাঁটা পথ। পথের দুই ধারে ফুল আর সৌন্দর্যবর্ধক গাছ। ফলগাছও আছে মনে হয় কিছু।

বাগানটা পেরিয়ে আরো সামনে দৃষ্টি দিলেন প্রফেসর। বাগানের পরে একটা সবুজ চত্বর, তারপর উঁচু দেওয়াল দেখা যাচ্ছে। বাড়িটা আকারে বেশ বড়োই হবে বুঝলেন প্রফেসর। এটাই এখন তার নতুন ঠিকানা। গতকাল রাতে এখানে এসেছেন তিনি। আগামী কিছুদিন তাকে এখানেই থাকতে হবে। সেটা কতদিন তিনি নিজেও জানেন না। কারণ এখানে নিজের ইচ্ছায় এলেও, নিজের ইচ্ছেয় যে যেতে পারবেন না সেটি তার বোঝা হয়ে গেছে।

‘তাহলে কি আমি বন্দি?’

আবারো নিজেকে প্রশ্ন করেন প্রফেসর। তবে উত্তর খুঁজতে আগ্রহ হলো না। সামনে কী হবে সেটা নিয়ে অযথা টেনশনে থাকতে রাজি নন তিনি। বরাবরই বর্তমানটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন আর দিনরাত কাজ করেছেন। যার ফলও পেয়েছেন। নিজেকে বিশ্বের সেরা গবেষকদের কাতারে নিতে পেরেছেন। তাই সামনের অনিশ্চয়তা নিয়ে না ভেবে বরং পেছনে কী ঘটেছে সেটা মনে করলেন।

ঘটনাটার শুরু মাস ছয়েক বা তারও কিছু আগে। একটু চেষ্টা করলে সঠিক তারিখটাও মনে করতে পারেন প্রফেসর; কিন্তু অযথা সেটা করতে চাইলেন না। সে সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুবই প্রসিদ্ধ একটা জার্নালে তার একটি গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়। অক্সিজেন ছাড়াও মানুষ কীভাবে বসবাস করতে পারবে সেটাই ছিল তার গবেষণার বিষয়। প্রবন্ধে নিজের এই ধারণার পক্ষে অনেকগুলো বাস্তবসম্মত যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি। অক্সিজেন ছাড়া অন্য কোনো গ্যাস কীভাবে মানুষের ফুসফুসে সহনশীল হতে পারে সেটাই ছিল তার গবেষণার বিষয়বস্তু।

প্রবন্ধের সাথে এ বিষয়ক গবেষণা কীভাবে হতে পারে তার একটি রূপরেখাও দিয়েছেন। বিশ^জুড়ে, বিশেষ করে- গবেষক ও বিজ্ঞানী মহলে দারুণ প্রশংসিত হয়েছে তার গবেষণাটি। সেই সাথে মানুষ আশার আলো দেখতে শুরু করে, মহাকাশে কিংবা অন্যগ্রহে যেখানে অক্সিজেন নেই- সেখানে গিয়ে বসবাসের। অক্সিজেন ছাড়া অন্য কোনো গ্যাস দিয়ে যদি মানুষের নিঃশ্বাস চালু রাখা যায়, সেটা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈপ্লবিক আবিষ্কার। মহাকাশে কিংবা অন্যগ্রহে ভ্রমণকারীদের অক্সিজেন মাস্ক পরতে হবে না। ওই গ্রহের পরিবেশে থাকা ক্ষতিকারক নয় এমন কোনো গ্যাস দিয়েই বেঁচে থাকতে পারবে মানুষ।

মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দারুণভাবে আশাবাদী করে তোলে এই গবেষণা; কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় গবেষণার খরচ ও প্রযুক্তি নিয়ে। প্রফেসর রিকি তার প্রবন্ধে গবেষণার যে রূপরেখা দিয়েছেন- সেটি বাস্তবায়নের জন্য আরো উন্নত প্রযুক্তি দরকার, যেটা এই মুহূর্তে মানুষের হাতে নেই। সেই প্রযুক্তি দাঁড় করাতে অন্তত কয়েক বছর সময় লাগবে। আর এসব করতে হলে দরকার প্রচুর অর্থ। সাধারণত এখনকার সময়ে একটি গবেষণা প্রকল্পে যে অর্থ খরচ হয়, তার কয়েকগুণ অর্থ খরচ হবে প্রফেসর রিকির গবেষণা শেষ করতে। কাজেই বিষয়টি সেখানেই থেমে ছিল। প্রফেসর রিকি আর কোনো দৌড়ঝাঁপ না করে অপেক্ষা করতে থাকেন। কোনোদিন ফান্ড জোগাড় হলে গবেষণা শুরু করবেন। না হলে পরবর্তী প্রজন্মের কোনো বিজ্ঞানী এসে সেটা করবে।

বিষয়টি সেখানেই থামিয়ে রেখে তিনি নতুন কাজে মনোযোগ দিচ্ছিলেন। ঠিক সে সময় তার কাছে একটি বার্তা আসে। সর্বাধুনিক কমিউনিকেশন মডিউলে কেউ নিজের পরিচয় গোপন করে প্রফেসর রিকির সাথে যোগাযোগ করে। যোগাযোগকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে জানায়- তার প্রতিষ্ঠান গবেষণাটির পেছনে অর্থ বরাদ্দ করতে রাজি আছে।

আশার আলো দেখতে পান প্রফেসর রিকি। এরপর প্রতিষ্ঠানটি ও সেই ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার সাথে কিছুদিন যোগাযোগ করা হয়। তারা গবেষণার ধরন, খরচের পরিমাণ, ল্যাবরেটরি সুবিধাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা চায়। এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি সব শর্ত মেনেই গবেষণার পেছনে খরচ করতে রাজি হয়। প্রাথমিকভাবে প্রফেসর রিকির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিরাট অঙ্কের অর্থ পাঠিয়ে- তাকে কাজ শুরু করতে বলা হয়। তবে তাদের একটাই শর্ত, গবেষণাটি হতে হবে খুব গোপনে। গবেষণার সাথে যুক্ত লোকজন ছাড়া আর কেউ জানবে না এ বিষয়ে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির নামটাও তাকে বলা হয়নি। গোপনীয়তার স্বার্থেই নতুন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে। এবং গবেষণার সময়টা সেখানেই থাকতে হবে প্রফেসর রিকিকে। নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় তিনি সব কিছুতে রাজি হয়ে যান।

কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে বুঝতে পারেন তাকে কেউ ফাঁদে ফেলেছে। তার গবেষণার বদলে তাকে দিয়ে অন্য কোনো কাজ করিয়ে নিতে চায় কেউ একজন। সেই একজনটা কে, সেটা না জেনেই এমনভাবে ফেঁসে গেছেন তিনি, আর পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। বাধ্য হয়ে এই বাড়িতে তাকে চলে আসতে হয়েছে গত রাতে। কবে এখান থেকে বের হতে পারবেন, আদৌ পারবেন কি না সেটা জানেন না প্রফেসর রিকি। তবে দৃঢ়চেতা প্রফেসর এত সহজে ভেঙে পড়তেও চান না। তিনি এর শেষ দেখতে চান। সামনে যাই আসুক মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাশাপাশি এই চক্র ভেঙে কীভাবে বের হওয়া যায় সেটাও তার ভাবনায় রয়েছে; কিন্তু এখনই সেটা বুঝতে দিতে চান না।

দুই.

বিস্তীর্ণ একটা খোলা জায়গা। মরুভূমির মতো। ঠিক মরুভূমিও নয়। জায়গাটা পাথর আর বালুতে ভরা। কিছুদূর পরপর ছোটো ছোটো পাথুরে টিলা দেখা যায়। সর্বত্র প্রায় একই রকম দৃশ্য, তাই ভিন্ন ভিন্ন জায়াগায় দাঁড়িয়েও মনে হতে পারে বুঝি একটিই জায়গা। পুরো জমিন এভাবেই পড়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। তবে কিছু নির্দিষ্ট পাথুরে টিলার আকৃতি অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। এই টিলাগুলোর গায়ে গুহার মতো ফাঁকা। গুহার মুখগুলো প্রস্থ ও উচ্চতায় ১০-১২ ফুট করে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে টিলার গায়ে এই গুহাগুলো প্রাকৃতিক নয়। এগুলো তৈরি করা হয়েছে।

এগুলো মূলত প্রবেশপথ। গুহার মুখ দিয়ে ঢুকলেই কোথাও সিঁড়ি, কোথাও লিফট বা কোথাও আরো উন্নত কোনো যন্ত্র সামনে পড়বে। এগুলোতে চড়ে চলে যাওয়া যায় ভূগর্ভের জগতে। মাটির নিচেই এখানকার আসল জগৎ। সেখানে আছে সমাজ, সভ্যতা, জ্ঞানচর্চা- সব কিছু। ওপরে এই যে ধূ ধূ বালুকাময় প্রান্তর তার নিচেই বাসিন্দারা গড়ে তুলেছে বসবাসের সব ব্যবস্থা। দিনের বেলা নক্ষত্র প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়ায়। যে কারণে এই মরু প্রান্তরে গাছপালা বা ফসল কিছুই জন্মায় না। এমনকি কোনো প্রাণীও এই উত্তাপে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। বাসিন্দাদের পাতাল জগৎ থেকে বাইরে আসতে হলে বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হয়। বাইরে যতটা রুক্ষ আর কঠিন পরিবেশ, মাটির নিচে ঠিক তার উল্টোটা। খুবই পরিকল্পিতভাবে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে এক নগর।

গ্রহটির নাম ‘থ্রি টু ফোর’। একটি নক্ষত্রকে ঘিরে প্রতি ৯৪২ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে গ্রহটি। আর নিজ অক্ষের ওপর আবর্তন করে ৬০ ঘণ্টায় একবার। যার ফলে এখানে ৩০ ঘণ্টা করে রাত-দিন হয়। নক্ষত্রটি হালকা নীলাভ আলো ছড়ায়, তবে আলো হালকা হলেও তার তাপ প্রচণ্ড, যে কারণে বাসিন্দাদের থাকতে হয় মাটির নিচে। নক্ষত্র ডোবার আগে আগে সাদা হয়ে যায়। আর এরপরই নেমে আসে অন্ধকার। রাতে আবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, যাতে কয়েক মিনিট দাঁড়ালেই হাড়ে কাঁপন ধরে। বাইরে এমন বৈরি আবহাওয়া হলেও ভূগর্ভে আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। প্রযুক্তিতে তারা বিশ^ব্রহ্মাণ্ডের অনেকের চেয়ে অগ্রগামী বলেই, এত বিরূপ পরিবেশের গ্রহেও ঠিকই বসবাসের জায়গা করে নিয়েছে।

মাটির নিচে গড়ে তোলা নগরের এক প্রান্তে একটি এলাকা ভীষণরকম সুরক্ষিত। নাম স্পেশাল সোলজার এরিয়া। বেশ কয়েকটি ভবন, অনেকগুলো খোলা চত্বরসহ বিশাল এক এলাকা এটি। জায়গাটি কমান্ডার অফিস নামেও পরিচিত। তারই একটি ভবনের নিচতলায় বড়ো একটি কক্ষে চলছে কমান্ডার অফিসের মিটিং। সারিবদ্ধভাবে দুই পাশে বসে আছে অনেকে। মাঝখানে বড়ো একটি টেবিল। টেবিলের এক মাথায় বসে আছেন কমান্ডার। তার নেতৃত্বেই চলছে মিটিং। তিনিই এখানে সবার প্রধান। শুধু এখানে বললে ভুল হবে, এই গ্রহেরই প্রধান হচ্ছেন কমান্ডার।

কমান্ডারের মুখ গম্ভীর। তিনি দুই পাশে বসা প্রত্যেকের কাছ থেকে এক এক করে কথা শুনছেন। সবাই যার যার মতো করে কথা বলে গেল। বেশির ভাগই ‘জি হুজুর’ টাইপের বক্তব্য। কেউ কেউ কমান্ডারের প্রচুর প্রশংসা করলো। কমান্ডারও সেসব শুনে মাথা দোলান। সবাই তার অনুগত থাকবে সেটাই তার চাওয়া।

বৈঠকে সবশেষে কথা বলার পালা এলো যার, তাকে সবাই ডেপুটি-থ্রি হিসেবে চেনে। সেটাই তার পরিচয়। দায়িত্বের জন্য তার যে পদবি সেটার জন্যই তাকে ডেপুটি-থ্রি হিসেবে ডাকা হয়। অন্যদেরও সবার এমন একটা পরিচয় আছে। সেটা অবশ্যই যার যার দায়িত্ব ও পদবি অনুযায়ী নির্ধারিত। এখানে এটাই নিয়ম। এখানে কারো নাম বলে কিছু নেই। জন্মের পর সবাইকে কমান্ডার অফিসের পক্ষ থেকে একটি করে আইডি নম্বর দেওয়া হয়, সেটাই হয়ে ওঠে তার পরিচিতি। আর যারা গ্রহের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের সাথে জড়িত তাদের ডাকা হয় পদবি ধরে।

এই গ্রহের সব কিছুই কোড নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। গ্রহের নাম যেমন ‘থ্রি টু ফোর’, তেমনি বাসিন্দাদের প্রজাতির নাম ‘এন টু’। তাদের শরীর না মানুষের মতো না চেনা অন্য কোনো প্রাণীর মতো। অনেকটা মানুষ আর সরীসৃপের মিশ্রণ বলা যায়। মাথা ও মুখমণ্ডল অনেকটা মানুষের মতো। চোখ দু’টি স্বাভাবিকের চেয়ে বড়ো। নাক বলতে কিছু নেই, সেখানে শুধু দুটো ছিদ্র। শরীরের দিকটা সরীসৃপের মতো। বুকের কাছে দুটো পা, আর শরীরের পেছনের দিকে দুটো পা। লম্বা লেজও আছে। পেছনের পা আর লেজে ভর করে প্রাণীগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। খুব দ্রুত গতিতে চলতে পারে এরা। বড়ো বড়ো লাফ দিয়ে নিমিষেই চলে যেতে পারে অনেক দূর।

‘এন টু’রা প্রয়োজন মতো নিজেদের শরীরকে বড়ো ছোটোও করতে পারে। প্রয়োজনে লম্বা হয়ে যাওয়া কিংবা খাটো হয়ে যাওয়া তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এই গ্রহের প্রাণীরা- বিশেষ করে সোলজাররা মোটেই শান্তিপ্রিয় নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসরতার কারণে তারা প্রায়ই গ্রহের বাইরেও দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে। আশপাশের অনেক গ্রহের বাসিন্দাদের সাথে তাদের সম্পর্ক খুবই খারাপ। যুদ্ধও হয়েছে কয়েকবার। এবার তারা নজর দিয়েছে গ্যালাক্সির বাইরে। তারা এবার টার্গেট করেছে কয়েক আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্রহকে।

‘থ্রি টু ফোর’ গ্রহের প্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে অল্প কিছু লোক। কমান্ডারের নেতৃত্বে এই গ্রুপটিতে কয়েকশো লোক রয়েছে। তাদের সবাইকে সোলজার হিসেবে ডাকা হয়। পরিচয় সৈন্য হলেও তারাই মূলত এই গ্রহের শাসনকর্তা। গ্রহের বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের। কমান্ডার তাদের নেতা। তার কথাই এখানে আইন। কমান্ডার এই গ্রহে সবচেয়ে ক্ষমতাবান। গ্রহের সাধারণ বাসিন্দাদের সবাই নির্দিষ্ট কয়েকটি আবাসিক এলাকায় বাস করে। এর বাইরে তাদের যাওয়ার হুকুম নেই। যারা গ্রহটি শাসন করে তারা অবশ্য সব জায়গাতেই যেতে পারে। সাধারণ বাসিন্দাদের শুধু দৈনন্দিন জীবনযাপন ছাড়া আর কোনো বিষয়ে নাক গলাতে দেওয়া হয় না।

ডেপুটি-থ্রি দাঁড়িয়ে কমান্ডারকে বিশেষ পদ্ধতিতে সম্মান জানিয়ে নিজের কথা শুরু করলো।

:  মহামান্য কমান্ডার, আমার ধারণা এই অপারেশনে বিশেষ ঝুঁকি রয়েছে। তাই আরো বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। নইলে সোলজারদের জীবনের হুমকি তৈরি হতে পারে।

কমান্ডার মাথা তুলে চাইলেন ডেপুটি-থ্রি’র দিকে। কথাগুলোর তার যে পছন্দ হয়টি সেটা চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বললেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। কাজ কীভাবে অগ্রসর হবে সেটা নিয়ে তোমার মতামত চাইছি।

: কিন্তু মহামান্য এতে বিশাল সংখ্যক সোলজারের প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায়- যেটার সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না- সেখানে এতবড়ো অপারেশন চালানো কতটা বাস্তব সম্মত? আর আপনি কীভাবে সব কিছু করতে চাইছেন সেটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আমরা সব জানতে চাই।

: এ নিয়ে চিন্তার সময় পেরিয়ে গেছে। বললেন কমান্ডার। আর সবার জন্য সব কিছু জানাও জরুরি নয়। এ বিষয়ে যে কমান্ডিং টিম গঠন করা হয়েছে, তারাই শুধু অপারেশনের সব কিছু জানবে। আর তোমাকে তোমার এই সীমা লঙ্ঘনের শাস্তি নিশ্চয়ই পেতে হবে।

কমান্ডারের কথা শেষ হওয়া মাত্র রুমের বাইরে থেকে দু’জন সোলজার লাফিয়ে ভেতরে চলে এলো। ডেপুটি থ্রিকে দু’পাশ থেকে ধরে নিয়ে গেল তারা। অন্যরা সবাই চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে রইলো। ডেপুটি থ্রি’র করুণ মুখ তাদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর সৃষ্টি করলো না।

এরপর কমান্ডার সবার উদ্দেশে বললেন, আশা করি আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। এখানে আদেশ পালনে কোনো দ্বিধা সহ্য করা হয় না সেটা সবার জানা। তবুও কেউ বোকামি করলে দায়টা তাকেই নিতে হবে। বলে একটু থামলেন। এরপর আবার বললেন, যথা সময়ে অপারেশন শুরু হবে। এ বিষয়ে সব প্রস্তুতি চলছে। কমান্ডিং টিম আরো অনেকদিন আগেই তাদের কাজ শুরু করেছে। যে গ্রহটি আমাদের টার্গেট সেখানেও আমাদের গুপ্তচর আছে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা সেটি এমন এক গ্রহ যেটি দখলে নিতে পারলে প্রচুর সম্পদ, প্রযুক্তিসহ অনেক কিছু আমাদের হাতে চলে আসবে। আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে একদল বুদ্ধিমান প্রাণী।

কমান্ডারের কথা শেষ হতে সবাই ‘জি, বুঝতে পেরেছি’ এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। এটাই এই গ্রহের নিয়ম। এখানে কমান্ডারই সর্বেসর্বা। তার সাথে তর্ক করা কিংবা দ্বিমত করার সুযোগ কাউকে দেয়া হয় না। কেউ বিদ্রোহ করতে চাইলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। গ্রহের সাধারণ প্রাণীরা তো বটেই, সোলজাররাও সবাই এটা মেনে নিয়েছে। মাঝে মধ্যে কেউ ডেপুটি থ্রি’র মতো ‘ভুল’ করলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়।

সেদিনের মিটিংয়ের পর থেকে ডেপুটি থ্রিকে আর দেখা যায়নি। চিরতরে সে হারিয়ে যায় ‘থ্রি টু ফোর’ গ্রহ থেকে।

তিন.

এক কাপ কফি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলেন প্রফেসর রিকি। বেডরুমে ঢুকতেই দেখলেন দেওয়ালের গায়ে লাগানো হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা অন হয়ে গেছে। কফির কাপে চুমুক না দিয়ে স্ক্রিনটার কাছে গেলেন প্রফেসর। সেখানে একটি ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে, চেহারা বা মুখের আকৃতি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

স্ক্রিনের সামনে গিয়ে প্রফেসর বললেন, এভাবে বসে থাকার তো অভ্যাস নেই আমার। কাজ শুরু করতে চাই।

: ভেরি গুড প্রফেসর। কথা বলে উঠলো স্ক্রিনের ছায়ামূর্তিটা। আমরাও সেটাই ভাবছিলাম। আপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কাজ না দিয়ে বসিয়ে রাখার কোনো অর্থ হয় না। আপনার প্রতিটা সময় খুব মূল্যবান। দ্রুতই আপনার কাজ শুরু হবে। শিগগিরই আমার প্রতিনিধি আপনার সাথে যোগাযোগ করবে। আপনার গবেষণার সব কিছু বুঝিয়ে দেয়া হবে।

কথা শেষ হতেই স্ক্রিনটা বন্ধ হয়ে গেল। কী চাইছে লোকটা- ভাবলেন প্রফেসর। তার গবেষণায় বিনিয়োগ করার কথা বলে তাকে এই বাড়িতে আনা হয়েছে। প্রচুর টাকাও খরচ করেছে লোকটা। শহরের বাইরে বিশাল এই বাড়ি বানিয়েছে। সাথে ল্যাবরেটরি। এই কয়দিন কোনো কাজ না থাকায় বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখেছেন প্রফেসর। আধুনিক যুগে একটা বাড়িতে যা থাকে তার কোনোকিছুরই অভাব নেই। জিম থেকে থিয়েটার রুম সবই আছে। প্রফেসরের একাকিত্ব কাটানোর জন্য বাড়িতে একটি পোষা বেড়াল আর একটি কুকুরও আছে; কিন্তু লোক বলতে প্রফেসর একাই। কয়েকদিন পর পর তার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আসে পার্সেল যোগে। কে পাঠায়, কোথা থেকে আসে সে সবের কিছুই জানার সুযোগ নেই। বিরাট একটি লাইব্রেরিও আছে বাড়িতে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকর্ম সব বিষয়ের বইয়ের বিশাল সংগ্রহ সেখানে।

একতলা আবাসিক ভবনটার কিছুটা দূরে আরেকটা দোতলা ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে ল্যাবরেটরি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার- বিশেষ করে প্রফেসর রিকি যে ধরনের গবেষণা করেন- তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে ল্যাবরেটরিটি। দেখলেই বোঝা যায়, এখানে এর আগে কেউ ঢোকেনি। তার মানে প্রফেসর রিকির জন্য তৈরি করা হয়েছে এই বাড়ি ও ল্যাবরেটরি।

কিন্তু কে আছে এসবের পেছনে, তার উদ্দেশ্য কী সেটা- এই কদিনে ভেবে কোনো কিনারা করতে পারেননি প্রফেসর। এক পর্যায়ে কোনো উপায় না দেখে ভাবনা বাদ দিয়েছেন। কয়েকটা দিন হয়েছে তিনি এই বাড়িতে এসেছেন, এর মধ্যে লোকটা গবেষণা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। আজই প্রথম এ বিষয়ে কথা বললো। তবে প্রফেসর বুঝতে পেরেছেন যে এই লোকের উদ্দেশ্য ভিন্ন কিছু। মানে মানুষের ফুসফুস নিয়ে গবেষণার খরচ জোগানোর কথা বলে তাকে এখানে আনা হলেও সেটা করা হবে না তার। বরং এই লোক তার কাছ থেকে অন্য কিছু আদায় করতে চায়। ‘কী সেটা?’ আবারো নিজেকে প্রশ্ন করলেন প্রফেসর; কিন্তু জবাব খুঁজে পেলেন না।

ডোর বেলের শব্দে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরলেন প্রফেসর। কফির মগ হাতে ধরা থাকলেও সেটায় চুমুক দেয়া হয়নি এতক্ষণ। এবার চুমুক দিলেন, কিন্তু ততক্ষণে সেটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মগটা টেবিলে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির গেইটের দিকে গেলেন। পার্সেল সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যান এসেছে। একটা পার্সেল প্রফেসর রিকির হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল লোকটা। ঘরে ফিরে পার্সেলটা খুললেন প্রফেসর। অনেকগুলো ডকুমেন্ট ভেতরে। সময় নিয়ে সবগুলো পড়লেন তিনি। পড়ে অবাক হয়ে গেলেন। এত এক মহাপরিকল্পনা!

কেন এসব করতে চাইছে লোকটা তার কোনো কারণ বুঝতে পারলেন না প্রফেসর। নথিগুলোতে যা লেখা আছে তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়- ভিনগ্রহের একটি প্রাণীর ওপর গবেষণা করতে হবে প্রফেসরকে। প্রাণীটিকে বহুদূরের এক গ্রহ থেকে আনা হয়েছে। সেটিকে পৃথিবীর আবহাওয়ায় বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। প্রাণীটির ফুসফুস যাতে পৃথিবীর মানুষদের মতো অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে সেটাই করতে হবে প্রফেসর রিকিকে। এর আগে মানুষকে অন্য গ্রহের আবহাওয়ায় টিকে থাকার বিষয়ে তিনি যে থিউরি ও গবেষণার রূপরেখা দিয়েছেন, সেটা দেখেই তাকে এই কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনিই একই কাজটি করতে পারবেন বলে মনে করছে লোকটি। শিগগিরই তার কাছে প্রাণীটি পাঠানো হবে। তার আগে প্রাণীর ডিএনএসহ শরীরের কিছু কোষের স্যাম্পল পাঠানো হয়েছে। এগুলো পাওয়া মাত্রই কাজ শুরু করতে হবে প্রফেসর রিকিকে।

এর কয়েক সপ্তাহ পর একদিন বিকেলে ল্যাবরেটরিতে ঢুকে প্রফেসর দেখতে পান কাচের ঘরে বন্দি অদ্ভুত দেখতে একটি প্রাণী রাখা রয়েছে এক পাশে। কে কখন এটা রেখে গেছে জানেন না তিনি। শুরুতে অদ্ভুত প্রাণীটিকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন প্রফেসর রিকি। তবে প্রাণীটা বন্দি আর অচেতন তাই সাহস ফিরে পেলেন। এমন জিনিস আগে কখনো দেখেননি। দেখবেনই বা কীভাবে এই প্রাণীর অস্তিত্ব তো আর এই পৃথিবীতে নেই। কাচের বাক্সের চারপাশে ঘুরে ঘুরে প্রাণীটাকে দেখলেন তিনি। এটার শরীর না মানুষের মতো, না কোনো চেনা প্রাণীর মতো। অনেকটা মানুষ আর সরীসৃপের মিশ্রণ বলা যায়। মাথা ও মুখমণ্ডল অনেকটা মানুষের মতো। চোখ দু’টি স্বাভাবিকের চেয়ে বড়ো। নাক বলতে কিছু নেই, সেখানে শুধু দুটো ছিদ্র। শরীরের দিকটা সরীসৃপের মতো। বুকের কাছে দুটো পা, আর শরীরের পেছনের দিকে দুটো পা। লম্বা লেজও আছে। সব মিলে লম্বায় ১০ থেকে ১২ ফুট হতে পারে। কাচের বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছে প্রাণীটা। হয়তো ওটাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে অথবা অচেতন করে রাখা হয়েছে।

একটা সময় ভয় কেটে গেল প্রফেসরের, তার জায়গায় তৈরি হলো কৌতূহল। কাছে গিয়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন প্রাণীটাকে। এমন অদ্ভুত প্রাণী যে এই সৃষ্টি জগতে থাকতে পারে, সেটা তার চিন্তায়ও ছিল না; কিন্তু চিন্তার অধিক সেই বাস্তবতার সামনে এখন দাঁড়িয়ে তিনি। এই প্রাণীটার ওপর গবেষণা করতে হবে তাকে। কোথা থেকে এসেছে প্রাণীটা জানেন না প্রফেসর। তবে এর ডিএনএ ও কোষের স্যাম্পল তাকে আগেই দেয়া হয়েছিল। সেগুলো পরীক্ষা করে বুঝেছেন, প্রাণীটা এমন একটা জায়গায় বাস করে যেখানে প্রচণ্ড তাপ আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা দুটোই আছে। ডিনোজেন নামের এক ধরনের গ্যাস নিঃশ^াসের সাথে গ্রহণ করে, আবার সেটাই ত্যাগ করে। অর্থাৎ এর ফুসফুসে ডিনোজেন প্রবেশ করার পর তার কিছু অংশ ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রক্তের সাথে মিশে যায়, আর কিছু অংশ বেরিয়ে যায় নিঃশ^াস ছাড়ার সময়। ডিনোজেন নামের গ্যাস পৃথিবীর বাতাসে পাওয়া যায় না। তবে এই প্রাণীটা যেখান থেকে এসেছে, সেখানে তার উপস্থিতি রয়েছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

এখন এর ফুসফুসকে অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বনডাই অক্সাইড ত্যাগের প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করতে হবে প্রফেসরকে। কাজটা খুব একটা কঠিন হবে না তার জন্য। এর জন্য প্রাণীটার ফুসফুসে একটা অপারেশন করতে হবে। সেখানে ছোট্ট একটা যন্ত্র বসাতে হবে। আর ফুসফুসের পাশে থাকা ডায়াফ্রাম নামের পেশিগুলো বদলে সেখানে কৃত্রিম পেশি সংযোজন করতে হবে। কোনো মানুষের ফুসফুস অকার্যকর হয়ে গেলে যেভাবে কৃত্রিম যন্ত্র লাগিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কাজটা অনেকটা সেই ধরনের।

মনে মনে কাজ শুরু করার একটা প্রস্তুতি নিয়ে সেদিনের মতো ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর রিকি। বাইরে বেরিয়ে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলেন অদ্ভুত এই প্রাণীটা সম্পর্কে। এটাকে কেন পৃথিবীতে বসবাসের উপযোগী বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা তিনি জানেন না। তবে জানতে হবে। আমাকে দিয়ে কেউ কোনো কাজ করিয়ে নেবে আর আমি তা জানবো না, সেটা হতে পারে না- আপন মনে বিড়বিড় করে বললেন প্রফেসর। আমাকে অবশ্যই এই রহস্য ভেদ করতে হবে। তার জন্য সব কিছুর আগে প্রাণীটার সাথে কথা বলতে হবে। ওকে জাগিয়ে তুলে ওর মনোভাব ও ভাব প্রকাশের পদ্ধতিটা জানতে হবে। কে ও, কীভাবে এখানে এসেছে সেটাও জানতে হবে। যেহেতু পৃথিবীর বাইরের প্রাণী তার ভাষাও হবে ভিন্ন, সে জন্য সবার আগে প্রাণীটার সাথে ভাব বিনিময়ের বিষয়টা নিয়ে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন প্রফেসর।

সেদিনই এই বিষয়টা নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন প্রফেসর রিকি। কয়েকটা সম্ভাব্য পদ্ধতিও ঠিক করলেন প্রাণীটার ভাষা বোঝার জন্য। কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে যোগাযোগকারী লোকটাকে বললেন। দুদিনের মধ্যে যন্ত্রপাতিগুলো পাঠানো হলো। সাথে একটা বার্তা। লোকটাকে খুব উৎসাহী ও খুশি মনে হলো প্রফেসরের। কাজ শুরু হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরেই সম্ভবত তিনি এত খুশি। বার্তাটায় লেখা ছিল, ধন্যবাদ প্রফেসর। আপনি কাজ শুরু করেছেন জেনে আমি ভীষণ আনন্দিত। আশা করি শিগগিরই আমরা সফলতার খবর পাবো।

বার্তা পড়ে কাগজটা মুচড়ে ঝুড়িতে ফেলে দিলেন প্রফেসর। মনে মনে বললেন, খুব বেশি খুশি হয়ো না বাছাধন। তুমি কে, তোমার উদ্দেশ্য কী সেসব না জেনেই বিজ্ঞানের যুগান্তকারী কোনো আবিষ্কার তোমার হাতে তুলে দেবো এত বোকা আমি নই। কাজ ঠিকই অগ্রসর হবে তবে সেটা আমার সিদ্ধান্ত মতো।

চার.

বিজ্ঞান একাডেমির মহাকাশ গবেষণা বিভাগে হুলস্থূল পড়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা অস্থির হয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ঘাঁটাঘাঁটি করছেন, কেউ কম্পিউটারের সামনে বসে বিভিন্ন সফটওয়ারের ডাটা যাচাই করছেন। অনেক বড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেছে সম্প্রতি পৃথিবীতে; কিন্তু বিজ্ঞান একাডেমির রাডারে কিছুই ধরা পড়েনি। এমনটা হবে তা কেউ কখনো ভাবেনি।

বিজ্ঞান একাডেমি বিশ্বের বিজ্ঞান ও গবেষণা কার্যক্রমের সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান। সারা বিশে^র সেরা বিজ্ঞানীরা এখানে কাজ করেন। গত ৫০ বছরে বিশে^ যত বড়ো বড়ো গবেষণা হয়েছে তার প্রায় সবই এই একাডেমির নেতৃত্বে হয়েছে। এখানে পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা, মহাকাশ বিদ্যাসহ বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর আলাদা শাখা রয়েছে। প্রতিটি শাখায় কাজ করেন ওই বিষয়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা।

সকাল থেকেই মহাকাশ গবেষণা বিভাগের সবাই বেশ অস্থিরতার মধ্যে কাটাচ্ছে। ৪৮ ঘণ্টা আগে পৃথিবীর আকাশে একটা অচেনা আকাশযানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে; কিন্তু কোনো রাডারেই সেটির সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ধরা পড়েনি। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য আকাশযানটির তথ্য টের পায় সেন্ট্রাল রাডার, পর মুহূর্তে সেটি হারিয়ে যায়। এরপর সেন্ট্রাল রাডার থেকে সব জায়গায় সতর্ক সংকেত পাঠানো হয় দ্রুত। তৎপর হয়ে ওঠে বিশে^র সব প্রান্তের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলো; কিন্তু তারা কেউ কিছু খুঁজে পায়নি। ৪-৫ সেকেন্ডের জন্য সেন্ট্রাল রাডারে যে বস্তুটি দেখা গেছে সেটি বেশ বড়ো এবং গোলাকৃতির। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো ভিনগ্রহী সসার হতে পারে; কিন্তু পৃথিবীর রাডার সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে সেটি কোথাও নামবে তা বিশ্বাস করা কঠিন। যে কারণে বিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছেন, রাডার হয়তো ভুলক্রম পৃথিবীরই কোনো আকাশযানকে অচেনা বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাই বিজ্ঞানীরা কোনোকিছু খুঁজে না পেয়ে সতর্ক সংকেত নামিয়ে নিয়েছেন।

৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে অচেনা একটা বস্তুকে পৃথিবীতে নামতে দেখা গেছে ঠিকই। এরপরই সবাই নড়েচড়ে বসে। স্যাটেলাইটের তোলা ছবিগুলো থেকে দেখা গেছে একটি খোলা জায়গায় রয়েছে গোলাকার একটি বস্তু। পরের আরো কিছু ছবিতে বস্তুটির পাশে একাধিক লোককে দেখা গেছে। মহাকাশ থেকে তোলা ছবি, তাই খুব একটা স্পষ্ট নয়; কিন্তু ওখানে যে কিছু একটা ঘটেছে তা নিয়ে সন্দেহ করার সুযোগ নেই।

দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যাকাডেমির কর্মকর্তারা। জায়গাটিতে একটি অনুসন্ধানী টিম পাঠানো হলো। তারা সেখানে গিয়ে কোনোকিছু অবতরণের আলামত দেখতে পান। ঘাস, মাটি ও কংক্রিটের নমুনা সংগ্রহ করা হলো পরীক্ষার জন্য। পাশাপাশি ওই এলাকায় সেই রাতের সব তৎপরতার বিষয়ে খোঁজখবর জানাতে মাঠে নামানো হলো পুলিশকে।

মাটি পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা জানালেন, জায়গাটিতে বড়ো এবং ভারি কোনোকিছু একটা নেমেছিল। আর আশপাশের মাটি, ঘাস ও কংক্রিট পরীক্ষা করে জানা গেছে, কয়েকজন লোকের পদচিহ্ন পড়েছে সেখানে। মানুষগুলো সসারের ভেতর থেকে নেমেছে, নাকি বাইরের- সেটি নিশ্চত হওয়া যায়নি। অন্তত দুটি বড়ো গাড়ি উপস্থিত থাকার আলামতও পাওয়া গেছে। চাকার ছাপ ও অন্যান্য আলামত দেখে বড়ো ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যান হতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এরপর তারা বিষয়টিতে তদন্তের জন্য বড়ো একটি টিম মাঠে নামায়।

আকাশে অচেনা বস্তুর উপস্থিতি নিয়ে বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সদস্যদের যখন ঘুম হারাম অবস্থা, পুলিশ যখন মাটিতে থাকা ছাপ পরীক্ষা করে তদন্তে ব্যস্ত- এদিকে সেই খবর টিভিতে দেখতে দেখতে হাসছিল টেফান। হাসির কারণ এত বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী আর আধুনিক সব যন্ত্রপাতিকে ফাঁকি দিয়ে জিনিসটি যেমন তার হাতে পৌঁছেছে, তেমনি ধূর্ত পুলিশ সদস্যদের কিছু বুঝতে না দিয়েই সেটি জায়গা মতো পৌঁছে দিতে পেরেছে সে।

কাজটিতে মারাত্মক রকমের ঝুঁকি ছিল সেটা জানতো টেফান। এখনো যে ঝুঁকি কেটে গেছে তা নয়। পুলিশ কিংবা গোয়েন্দারা সূত্র ধরে খুঁজতে খুঁজতে যে-কোনো দিন তার দরজায় পৌঁছে যেতে পারে। তবু জীবনে বড়ো কিছু পেতে গেলে তো একটু আধটু ঝুঁকি নিতেই হবে। টেফানও তাই জেনেশুনেই ঝুঁকিটা নিয়েছে। পেশায় একজন বিজ্ঞানী টেফান। বয়স এখনো ৪০ হয়নি, তবু বিজ্ঞান চর্চায় সে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। বিশে^র নামীদামি বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাথে কাজেরও সুযোগ পেয়েছে। যদিও সেটা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। তাতে অবশ্য নিজের দোষ দেখে না টেফান। তার ভাষায় ‘ওই বুড়ো বিজ্ঞানীটা সামান্য বিষয় নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেছে। তাই তার চাকরিটা চলে গেছে।’

একটা গবেষণা কর্মের চূড়ান্ত প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আরেক বিজ্ঞানীর গবেষণা প্রতিবেদনের কিছু অংশ জুড়ে দিয়েছিল টেফান। কাজটা তাকে দিয়েছিল তার সিনিয়র। টেফান যাকে ‘ওই বুড়োটা’ বলেই সম্বোধন করে এখন; কিন্তু সামান্য একটু গড়বড় হতেই তিনি ভীষণ ক্ষেপে যান। বলেন, বিজ্ঞান নিয়ে নাকি ‘নয়-ছয়’ করার সুযোগ নেই, এর সাথে মানুষ, সমাজ ও সভ্যতার ভাগ্য জড়িত। এরকম একগাদা উপদেশ দিয়ে টেফানকে বের করে দেন চাকরি থেকে; কিন্তু ভাগ্য টেফানকে বঞ্চিত করেনি। বরং তার চেয়ে বড়ো কিছু পাওয়ার সুযোগ তার হাতে এসে নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে। তাই তো এখন টেফানের মুখে হাসি আর বুকে স্বপ্ন অনেক বড়ো কিছু হওয়ার।

কিছুদিন আগে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে টেফানের সাথে। পৃথিবীর বাইরে কোথাও থেকে একটা মেসেজ পায় সে। ঘরের কমিউনিকেশন মডিউলে মেসেজটা পাঠিয়ে বলা হয়, ভিন গ্রহের একদল লোক- যদিও তারা মানুষ কি না টেফান জানে না- টেফানের সাথে কাজ করতে চায়। একটা বিশেষ প্রজেক্টে তারা টেফানের সহযোগিতা চায়। বিনিময়ে টেফানকে শুধু অর্থবিত্তই নয়, অনেক ক্ষমতার আশ্বাস দেয়া হয়। মাত্র কয়েকদিন আগেই চাকরি হারিয়েছে টেফান। তার চেয়েও বড়ো কথা বিজ্ঞানী হিসেবে তার ক্যারিয়ারের সুনাম সব শেষ হয়ে গেছে ওই এক ঘটনায়। পৃথিবীর আর কোনো বিজ্ঞানী বা প্রতিষ্ঠান যে তার সাথে এখন আর কাজ করবে না সেটা টেফান বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে। তাই তো সে বেশি কিছু বুঝতে বা জানতে না চেয়ে ভিনগ্রহীদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে যতগুলো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, এরা তাদের মধ্যে কেউ নয়। সম্পূর্ণ আলাদা একটি গ্রহের এই বাসিন্দারা বলেছে, পৃথিবীতে টেফানই একমাত্র লোক যার সাথে তারা যোগাযোগ করেছে। যদি প্রজেক্ট সফল হয় তখন টেফান যেমন পৃথিবীজোড়া খ্যাতি অর্জন করবে, তেমনি পাবে অনেক ক্ষমতা। শুধু একটাই শর্ত, সব কিছু গোপন রেখে ভিনগ্রহীদের কথা মতো কাজ করে যেতে হবে আগামী কয়েকটা মাস।

টেফান রাজি হয়েছে এবং তাদের কথা মতো কাজ করে যাচ্ছে। প্রজেক্টটা কী টেফান এখনো পুরোপুরি জানে না, যখন যে রকম কাজ করতে বলা হয়- সেটুকু পর্যন্তই তাকে জানানো হয়। সেই কথা মতো আজ ভিনগ্রহ থেকে একটা বাক্স আসে পৃথিবীতে। খুব গোপনে সেটা টেফানকে পৌঁছে দিতে বলা হয় নতুন বানানো সেই বাড়িটায়। বাড়িটা বানানোর সময়ও টেফান সব কিছু দেখাশোনা করেছে; কিন্তু  এখন অনুমতি ছাড়া তার বাড়িটায় ঢোকা নিষেধ। টেফান করেছে কাজটা ঠিক মতোই; কিন্তু নির্ভার থাকতে পারছে না। কারণ টিভির খবরে কয়েক ঘণ্টা পরপরই তদন্তের আপডেট জানানো হচ্ছে। সর্বশেষ জানা গেছে, পুলিশ তদন্তে নেমেছে, তারা কয়েকজন লোককে খুঁজছে।

টেফানের সাথে যারা ছিল তারা কেউ বিজ্ঞানী নয়। তাদের টেফান ভাড়া করেছে টাকার বিনিময়ে। শুধু বলেছে, কাজ করতে হবে গোপনে, আর কাজের কথা গোপন রাখলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের কাজে আবারো ডাকা হবে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পেয়ে লোকগুলো বিষয়টি নিয়ে চুপ থাকলেও পুলিশের জেরার মুখে পড়লে তারা সব বলে দিতে পারে, সেটাই এখন টেফানের জন্য চিন্তার।

যদিও কাজে সে কোনো ধরনের ফাঁক রাখেনি। বাক্সটি যাদের মাধ্যমে গাড়িতে তোলা হয়েছে, তাদের সেখানেই বিদায় করা হয়েছে। তারা জানে না বাক্সে কী আছে, বা সেটি কোথায় যাবে। আবার পরে গাড়ি থেকে বাক্সটি নামিয়েছে আরেকদল লোক। এভাবে প্রতিটি পদক্ষেপেই সাবধানে পা ফেলেছে। তবু পুলিশকে বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে না। যে কারণে গা ঢাকা দিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো টেফান। লোকচক্ষুর আড়ালে কোথাও কয়েকটা দিন লুকিয়ে থাকলেই বোঝা যাবে পুলিশ তাকে খুঁজছে কি না। পুলিশ জানতে পারলে, আত্মগোপনেই থাকতে হবে মাস ছয়েক। আর তারপরই আসবে তার মহা আনন্দের দিন। ক্ষমতা, অর্থ সব কিছু ধরা দেবে তার হাতে।

পাঁচ.

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন প্রফেসর রিকি। দূরে খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টি। চোখ দুটো আকাশের দিকে, তবে তার মনটা পড়ে আছে বাড়িতে। আজ সকাল থেকে মনটা ভার হয়ে আছে। অথচ আজকেই কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ শুরু করার কথা। পরিবারের কথা আজ বারবার মনে পড়ছে তার। কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেছে তিনি বাড়ির বাইরে। এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। বাড়িতে সবাই কেমন আছে সেটাও জানার সুযোগ নেই। তার স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ আর ৫ বছরের একটা নাতি আছে বাড়িতে। নাতিটাকেই বেশি মনে পড়ছে প্রফেসর রিকির। সারাদিন বাড়িটা মাতিয়ে রাখে পিচ্চিটা। বিকেলে বাড়ির সামনের ছোট্ট মাঠটাতে নাতির সাথে ফুটবল খেলা কিংবা সন্ধ্যায় লিভিং রুমে খুনসুটি করে অবসর সময়টা কাটতো তার। বাচ্চাটা না জানি কতটা একা হয়ে পড়েছে- ভাবছেন প্রফেসর। হয়তো খেলতে না পেরে মন খারাপ করে থাকে সারাদিন।

ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে পানি এসে জমা হলো প্রফেসরের। হাত বাড়ালেই পাশের টেবিল থেকে টিস্যু নিতে পারতেন; কিন্তু ইচ্ছে হলো না তার। চশমা খুলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়েই মুছলেন চোখের পানি। আগেও গবেষণার জন্য বাইরে গিয়ে একটানা কয়েক সপ্তাহ থাকার অভ্যাস আছে তার; তাই বাড়ির বড়োদের হয়তো খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না; কিন্তু প্রফেসর জানেন এবারের আসাটা সম্পূর্ণ আলাদা। এবার বাড়ির সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারছেন না, আবার কবে এখান থেকে মুক্তি পাবেন সেটাও জানে না। যে কারণে প্রায়ই মন খারাপ হয় তার। গবেষণা আর পড়াশোনার কাজ ছাড়া বাকি সময়টা পরিবার নিয়ে ভেবেই পার করেন। কারণ কাজের বাইরে পরিবারই তার আপন জায়গায়। কাজ আর পরিবার- এ দুটো ছাড়া প্রফেসর দীর্ঘ পেশাজীবনে অন্য কোনোকিছুতে সময় ব্যয় করেননি; কিন্তু আজ সেই কাজের জন্য পরিবার থেকে সরে থাকতে হচ্ছে।

কে তার সাথে এই আচরণটা করছে সেটাও এখন পর্যন্ত জানতে পারেননি। তবে সে যেই হোক- তার উদ্দেশ্য যে মহৎ নয় সেটা বুঝতে পারছেন প্রফেসর। আর তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই উদ্দেশ্য সফল হতে দেবেন না কিছুতেই। কারণ লোকটা যা চাইছে এবং যেভাবে পৃথিবীর সবাইকে অন্ধকারে রেখে কাজ করিয়ে নিচ্ছে- তাতে মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু যে নেই তা নিশ্চিত। আর সারাজীবন পৃথিবীর কল্যাণে কাজ করে যাওয়া প্রফেসর রিকি তাই জীবন দিয়ে হলেও এই অসৎ উদ্দেশ্য ঠেকাবেন। এই সিদ্ধান্ত তিনি কয়েকদিন আগেই নিয়েছেন; কিন্তু কিছু বুঝতে না দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন রুটিনমতো।

ঘণ্টা দুয়েক পর ল্যাবরেটরিতে ঢুকলেন প্রফেসর রিকি। ঢুকেই ধীর পায়ে গেলেন কাচের বাক্সবন্দি প্রাণীটার কাছে। প্রাণীটা ঘুমুচ্ছে। এটা স্বাভাবিক ঘুম। অচেতন অবস্থা থেকে দুই দিন আগে ওটার চেতনা ফিরিয়েছেন তিনি। প্রাণীটা ভাব প্রকাশ করতে চায়; কিন্তু তার ভাষা বুঝতে পারেননি প্রফেসর। তাই এই দুই দিন সেটা নিয়েই কাজ করেছেন। ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে ওটার সাথে ভাব বিনিময়ের একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। যথেষ্ট খাটুনি গেছে কাজটা করতে; কিন্তু প্রফেসর এখন একটা উপায় খুঁজে পেয়েছেন অদ্ভুত প্রাণীটার কথা শোনার। যন্ত্রটা সেটও করেছেন কাচের বাক্সের সাথে। আজকে সেটা ব্যবহার করতে চান।

কাঁপা কাঁপা হাতে একটা সুইচে চাপ দিলেন প্রফেসর। টু..উ..উ. করে ছোটো একটা শব্দ হলো। ট্রান্সলেটরটা চালু হয়েছে। হেডফোন পরে নিলেন তিনি। এরপর মাইক্রোফোনটা মুখের কাছে সেট করে কথা বলা শুরু করলেন, এই যে, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? এই যে আগন্তুক জেগে ওঠো। তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছ?

ধীরে ধীরে চোখ খুললো প্রাণীটা। তারপর শোয়া থেকে উঠে বসলো। কয়েক মুহূর্ত প্রফেসরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। যেন বুঝতে চেষ্টা করছে তিনি কী বলছেন। এরপর কয়েকটা শব্দ করলো প্রাণীটা। ট্রান্সলেটরে ধরা পড়লো শব্দগুলো; কিন্তু অর্থ স্পষ্ট হলো না। ভাঙা ভাঙা কয়েকটা শব্দ বুঝতে পারলেন প্রফেসর। ট্রান্সলেটরের কয়েকটা সুইচ কয়েকবার এদিক ওদিক ঘোরালেন। ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাডজাস্ট করে নেওয়ার চেষ্টা।

এবার হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। ইয়েস... বলে এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালুতে ঘুষি মারলেন প্রফেসর। প্রাণীটার কথা এবার তিনি বুঝতে পারছেন। যদিও সব কিছু নয়, তবু এগুলোর একটা অর্থ ধরে নেওয়া যায়।

: কে তুমি? প্রশ্ন করলেন প্রফেসর।

: ডেপুটি থ্রি

: সেটা আবার কী, তোমার নাম বলো।

: নাম কী জিনিস? আমার আইডি নম্বর ট্রিপল নাইন ফোর টু জিরো। তবে সবাই ডেপুটি থ্রি বলেই ডাকে।

: কোথা থেকে এসেছো তুমি?

: ‘থ্রি টু ফোর’ গ্রহ থেকে। আমরা ‘এন টু’ প্রজাতির প্রাণী। তুমি কে? আমি কোথায়? নিজের পরিচয় দেয়ার পর এক সাথে দুটো প্রশ্ন করলো প্রাণীটা।

মোটামুটি ভালোভাবেই ওটা যে মানুষের ভাষা বুঝতে পারছে সেটা নিশ্চিত হলেন প্রফেসর। নিজের পরিচয় দিলেন তিনি। বললেন, আমি প্রফেসর রিকি। এটাই আমার নাম। এখানে সবাইকে আলাদা আলাদা নামে পরিচয় দেয়া হয়। আর এই জায়গাটা পৃথিবী। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সূর্য নামকে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে যে গ্রহগুলো তার একটি পৃথিবী। আর আমি একজন মানুষ। মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ও সভ্য প্রজাতির প্রাণী।

: পৃথিবী! এমনভাবে বললো প্রাণীটা যেন নামটা পরিচিত তার কাছে।

প্রফেসর জানতে চাইলেন, তুমি পৃথিবীর কথা জানতে?

: অবশ্যই। আমাদের গ্রহ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরের একটা গ্রহ। সভ্য প্রাণীরা থাকে সেটাও জানি। এরপর একটু চুপ করে রইলো প্রাণীটা। তারপর বললো, কমান্ডারই তাহলে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে শাস্তি হিসেবে।

: কে কমান্ডার?

: আমাদের গ্রহের শাসনকর্তা, খুবই নিষ্ঠুর। এককভাবে সব ক্ষমতা ভোগ করতে চায়। কেউ তার বিরুদ্ধে গেলেই মেরে ফেলে; কিন্তু আমাকে মেরে না ফেলে এই গ্রহে পাঠানো হয়েছে কেন বুঝতে পারছি না।

: আমি বুঝতে পারছি। বললেন প্রফেসর। পেশায় আমি একজন বিজ্ঞানী। তোমাকে নিয়ে গবেষণা করছি কয়েকদিন হলো। সম্ভবত এই কাজের জন্যই তোমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে আমার কাছে।

প্রফেসর সব খুলে বললেন ডেপুটিকে। কীভাবে তার সাথে মিথ্যা বলে যোগাযোগ করা হয়েছে। কীভাবে ফাঁদে ফেলে এই গবেষণা করতে বাধ্য করা হয়েছে সব জানালেন। আর প্রাণীটাও জানালো তার গ্রহের ভয়ংকর পরিকল্পনার কথা। গ্রহবাসীরা জেনে গেছে, পৃথিবী নামের গ্রহটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক অগ্রসর। এখানকার আবহাওয়া আরামদায়ক এবং মাটির নিচে রয়েছে প্রচুর মূল্যবান খনিজসম্পদ। এসব কারণেই পৃথিবীতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ‘থ্রি টু ফোর’ গ্রহের কমান্ডার। নেওয়া হয়েছে বিশাল এক পরিকল্পনা এবং শিগগিরই পৃথিবী দখল করতে অভিযান শুরু করবে সেখানকার সোলজাররা। সে আরো জানালো, এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করার জন্যই তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে গিনিপিগ বানিয়ে।

সব শুনে প্রফেসর বুঝলেন এ এক মহাপরিকল্পনা। পৃথিবীতে রাজত্ব করতে হলে ভিনগ্রহীদের পৃথিবীর আবহাওয়ায় টিকতে হবে, তাইতো ডেপুটিকে পাঠিয়েছে সেই পরীক্ষার জন্য। প্রফেসরের রূপান্তরের পর ডেপুটি যদি অক্সিজেন গ্রহণ করে পৃথিবীতে মানুষের মতো টিকতে পারে, তবে ওরা সবাই একই পদ্ধতিতে নিজেদের বদলে নেবে এবং পৃথিবী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবে। তখন আর পৃথিবীতে বিচরণ করতে ওদের গ্যাস মাস্ক ব্যবহার করতে হবে না। যা পৃথবীর জন্য ভয়ংকর এক বিপদ। এই বিপদ থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে; কিন্তু কীভাবে- সেটা একটি বড়ো প্রশ্ন। তিনি এই বাড়িতে যা করছেন, তা সবই টের পেয়ে যাচ্ছে ভিনগ্রহী শত্রুরা। তবে পৃথিবীতেও এমন কেউ আছে, যে ওদের সাহায্য করে।

কে সে? ভিনগ্রহীদের সাথে যোগাযোগ, এই বাড়ি ও গবেষণাগার নির্মাণ, ডেপুটিকে এখানে পৌঁছে দেয়া, আবার প্রফেসরের চাহিদা মতো যে-কোনো সামগ্রী সরবরাহ করা- এত কিছু যে করছে সেই লোকটাকেও খুঁজে পেতে হবে। নিশ্চয়ই কোনো বিজ্ঞানী হবে। যে-ই হোক, পৃথিবীবাসীর সাথে এই বিশ^াসঘাতকতার শাস্তিও তাকে দিতে হবে। তবে ওদেরকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নীরবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন প্রফেসর রিকি।

ধীরে ধীরে ডেপুটির সাথে খুব খাতির হয়ে গেল প্রফেসরের। রোজ ল্যাবে ঢুকেই তিনি কিছুক্ষণ ডেপুটির সাথে গল্প করেন। ওদের গ্রহের জীবন সম্পর্কে জানেন। ডেপুটিরও খুব আগ্রহ পৃথিবীকে নিয়ে। প্রফেসরের কাছে মানুষের জীবন সম্পর্কে নানা কিছু জানতে চায় সে। মোট কথা দু’জনে বন্ধু হয়ে যায়। তবে ডেপুটি এখনো সেই কাচের ঘরেই বন্দি জীবন কাটাচ্ছে। কারণ তাকে যে উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে সেটি এখনো শেষ করেননি প্রফেসর।

এর মধ্যে প্রফেসরের ওপর দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য চাপ আসতে থাকে। ডেপুটির ফুসফুসে অপারেশনের জন্য তাড়া দেয়া হয়। প্রফেসর কাজটা করতে দ্বিধা করছেন এটা বুঝতে পেরে ওরা প্রফেসরের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা পরিবারের ওপর আঘাত হানার হুমকি দেয়। বলা হয়, দ্রুত কাজ শেষ না করলে তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় নাতিটাকে মেরে ফেলা হবে।

ছয়.

কমান্ডার অফিসে ভীষণ ব্যস্ততা। সোলজাররা সবাই বিভিন্ন জায়গায় নিজ নিজ কাজ করছে। বড়ো কোনো কাজ সামনে থাকলে কোনো অফিস বা বাড়িতে যে রকম ব্যস্ততা থাকে অনেকটা সেরকম। এক পর্যায়ে কমান্ডার সবাইকে কনফারেন্স রুমে ডাকলেন। সবার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন তিনি। যার সারমর্ম হচ্ছে- আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু হবে। চারটি ফ্লাইং সসার চার ব্যাটেলিয়ন সোলজার নিয়ে রওয়ানা হবে। একটি সসারে থাকবে অভিযানের নেতা ডেপুটি ওয়ান। সে থাকবে এক নম্বর সসারে। এই সসারটি সবচেয়ে বড়ো এবং এটি থেকে অন্যগুলোতে পাওয়ার সাপ্লাই করা হবে। কমান্ডার নিজে অভিযানে যাবেন না। তবে তিনি সব কিছু তদারকি করবেন। এ যাবৎকালের আবিষ্কৃত ভয়ঙ্করসব মারণাস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে প্রতিটি টিম।

দীর্ঘ বক্তৃতার শেষ দিকে এসে কমান্ডার বললেন, প্রিয় সোলজারগণ আজ আমরা আমাদের গ্রহের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো অভিযান শুরু করছি। সেখানে পৌঁছে তোমাদের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে জন্য অনেক আগে থেকেই আমি পরিকল্পনা নিয়েছি। আশা করি পৃথিবীতে নেমে তোমরা দ্রুত নিজেদের সেখানকার আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে। আমাদের ডেপুটি থ্রিকে কয়েক মাস আগেই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আর পৃথিবীর দু’জন বিজ্ঞানী আমাদের হয়ে কাজ করছে। ডেপুটি আশা করি কয়েক দিনের মধ্যে পৃথিবীর আবহাওয়া টিকে থাকার উপায় পেয়ে যাবে। তারপর তোমরাও একই পদ্ধতিতে নিজের রূপান্তর করবে।

কমান্ডারের পরিকল্পনা হলো, পৃথিবীর বুকে নেমে সোলজারদের চারটি গ্রুপের মধ্যে তিনটি গ্রুপ গ্রহটির ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কাজ করবে। এজন্য প্রচণ্ড লড়াই করতে হতে পারে। তবে তার বিশ্বাস শারীরিক শক্তি আর অস্ত্রের ক্ষমতা- দুটোতেই তারা পৃথিবীবাসীকে কাবু করতে পারবে। চতুর্থ দলটি চলে যাবে পৃথিবীতে এন টুদের স্থাপিত ল্যাবরেটরিতে। সেখানে দু’জন বিজ্ঞানী সেই দলটিকে ডেপুটি থ্রির মতো পৃথিবীতে টিকে থাকার উপযোগী করে তুলবে। দ্রুততার সাথে তাদের রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে। তাহলে তারা গ্যাসমাস্ক খুলেই পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে একেকটি দল ল্যাবে যাবে, আর বাকি তিনটি দল অভিযান চালাতে থাকবে।

ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো দখল করা হলে কমান্ডার নিজে যাবেন বিজয় উদযাপন করতে। আর ডেপুটি থ্রিকেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন তিনি। কমান্ডারের সাথে বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য সে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার উপযুক্ত হলেও পৃথিবীতে গিয়ে জাতির জন্য অবদান রাখায় তাকে ক্ষমা করা হবে।

এরপর সোলজারের দল সারি বেঁধে বেরিয়ে এলো পাতালপুরীর শহর থেকে। ধূধূ বালুকাময় প্রান্তরে বিশেষ ব্যবস্থায় সসার উৎক্ষেপণ সেন্টার বানানো হয়েছে। সেখানে সবাই কমান্ডারকে শেষবারের মতো বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে সসারে উঠলো। কয়েক মিনিট পর পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো চারটি সসার। যেগুলো আলোর গতিতে পৌঁছে যাবে কোটি কোটি আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে।

সসারগুলো নিঃশব্দে একে একে উড্ডয়ন করলো। সেগুলোর উদ্দেশ্যে তাকিয়ে হাসলেন কমান্ডার। সেই হাসিতে মিশে আছে নিষ্ঠুরতা আর ক্ষমতার লোভ।

সাত.

চাপের কাছে ভেঙে পড়তেই হলো প্রফেসরকে। প্রিয় নাতিটার মৃত্যুর হুমকি তাকে নরম করে তুললো। সে ডেপুটির ওপর অপারেশন শুরু করলো। তবে আশার কথা হলো, ডেপুটি ইতোমধ্যেই পৃথিবী নামক গ্রহটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এবং তার গ্রহের নিষ্ঠুর শাসক কমান্ডারের অন্যায় আচরণ থেকে পৃথিবীবাসীকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। প্রফেসরকে বলেছে, অপারেশন সফল হলে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য নিজ গ্রহের প্রাণীদের বিরুদ্ধে সে লড়াই করবে। এত সুন্দর পৃথিবী একটা লোভী কমান্ডারের হাতে ধ্বংস হবে সেটা ডেপুটি কিছুতেই মেনে নেবে না।

যেদিন অপারেশন হওয়ার কথা সেদিন সকালেই প্রফেসরের বাড়িতে এসে হাজির হলো টেফান। তার এক সময়ের সহকারী, যাকে গবেষণা কর্মে চুরির দায়ে চাকরিচ্যুত করেছিলেন প্রফেসর রিকি। টেফানকে দেখেই রেগে গেলেন তিনি। কিছুটা আশ্চর্যও হলেন, টেফান এই বাড়ির ঠিকানা জানলো কী করে। টেফানের সাথে একজন সার্জনও আছে। যিনি প্রফেসরের দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী ডেপুটির ফুসফুসে অপারেশন করবেন। সার্জন লোকটাকে আগে কখনো দেখেননি প্রফেসর; কিন্তু টেফানকে দেখে তিনি রাগ সামলাতে পারলেন না।

: তুমি এখানে, টেফান!

: জি প্রফেসর, আপনার যুগান্তকারী আবিষ্কারের সাক্ষী হতে এসেছি। ভিনগ্রহের প্রাণীটার ওপর আপনি যখন অপারেশন করবেন তখন আমি আপনার সাথে থাকবো।

: তাহলে তুমিই সেই বিশ্বাসঘাতক, তুমিই জড়িত আছো এই ষড়যন্ত্রের সাথে? আমি আগেই ধারণা করেছিলাম, পৃথিবীর কোনো বদমাশ বিজ্ঞানী এর সাথে জড়িত আছে; কিন্তু সেটা যে তুমি তা ভাবতে পারিনি। তোমার প্রতি আমার ঘৃণা হচ্ছে। তোমার মতো লোক আমার সাথে একসময় কাজ করেছে সেটা ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে।

প্রফেসরের কথায় কিছুটা চুপসে গেল টেফান। অনেকদিন যার সাথে জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন, অনেক কিছু শিখেছে, তার ভর্ৎসনা টেফানের বিবেককে কিছুটা হলেও ধাক্কা দিলো। তবে কয়েক মুহূর্ত পরেই সে নিজেকে সামলে নিলো। বললো, এসব এখন বলে লাভ নেই প্রফেসর রিকি। আপনি আপনার কাজ শুরু করুন। আমি যা করেছি, সেটা বুঝে শুনেই করেছি। এখন এসেছি আপনার অপারেশনে সহায়তা করতে। চলুন  দ্রুত অপারেশন শুরু করুন। শেষ কথাগুলো অনেকটা নির্দেশের সুরে বললো টেফান।

কাচের বাক্সবন্দি অবস্থাতেই অপারেশনের টেবিলে তোলা হলো ডেপুটিকে। কারণ এখনো ওই বাক্সের বাইরে বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করতে পারেনি সে। অপারেশনের আগে প্রফেসরকে মনমরা দেখে ডেপুটি জানতে চাইলো, প্রফেসর আপনার মন খারাপ কেন? আর এই লোকটা কে- যে আপনার ওপর খবরদারি করতে চাইছে?

প্রফেসর বললেন, এই সেই বিজ্ঞানী যে পৃথিবীর সাথে বিশ^াসঘাতকতা করে তোমাদের গ্রহের সাথে হাত মিলিয়েছে। এক সময় আমার জুনিয়র ছিল; কিন্তু অপকর্মের জন্য ওকে আমি বহিষ্কার করেছিলাম। অপরাধের শাস্তি পেয়ে সে শোধরায়নি, বরং আরো বড়ো অপরাধী হয়ে গেছে। এবার সে পুরো পৃথিবীর সর্বনাশ করার ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে।

প্রফেসরের কথা শুনে ডেপুটি কিছু বললো না। শুধু জানতে চাইলো, অপারেশন সফল হলে তার চেতনা ফিরে আসতে কতক্ষণ লাগবে।

২৪ ঘণ্টা লাগবে, বললেন প্রফেসর। কিছু কম বেশিও হতে পারে।

এসব কথার কিছুই শুনতে পেল না টেফান, কারণ ডেপুটির সাথে কথা বলার সময় প্রফেসর হেডফোন ব্যবহার করেন। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো অপারেশন। ডেপুটিকে কাচের বাক্সে রেখেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় কিছু যন্ত্রপাতি ঢুকানো হলো বাক্সটিতে। শুরুতে ডেপুটিকে অচেতন করার ঔষধ দেয়া হলো। এরপর তিন ঘণ্টা ধরে চললো অপারেশন। কাজ শেষ ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর।

নিজের রুমে গিয়ে একাকী বসে রইলেন তিনি। মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। তার বিশ^াস টেফান সঠিকভাবেই রূপান্তর প্রক্রিয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে; কিন্তু তারপর কী হবে? ডেপুটির গ্রহের প্রাণীরা কি পৃথিবীতে আক্রমণ করবে? ডেপুটি পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হতে দেবে না অঙ্গীকার করেছে; কিন্তু ও তো একা। ওর গ্রহের প্রাণীদের মোকাবেলায় পৃথিবীর নিরাপত্তা বাহিনী সফল হতে পারবে তো? ওরা নিশ্চয়ই অনেক আধুনিক ও ক্ষমতাধর। নইলে গ্যালাক্সির বাইরে থেকে আরেকটা গ্রহে আক্রমণ চালানোর সাহস পেত না।

এসব বাজে চিন্তায় সময় কাটতে লাগলো প্রফেসরের। কখনো সোফায় বসে, কখনো বারান্দায় পায়চারি করে কাটালেন তিনি। এর মধ্যে রাত নামলো; কিন্তু তার চোখে ঘুম এলো না। কখন ২৪ ঘণ্টা শেষ হবে তার জন্য অপেক্ষা। এরপর কী হবে সেটাও আরো বড়ো শঙ্কা। টেফান সব কিছু জেনে নিয়েছে। সেই এখন ভিনগ্রহীদের পৃথিবীবাসী প্রাণীতে রূপান্তরিত করতে পারবে। টেফানকে কীভাবে ঠেকানো যায় সেই চিন্তাটাও করতে শুরু করে দিয়েছেন প্রফেসর।

প্রফেসর বেরিয়ে গেলেও সার্জনকে নিয়ে ল্যাবরেটরিতেই থাকলো টেফান। কিছুক্ষণ পরপর কমিউনিকেশন মডিউলে সে যোগাযোগ রাখলো ‘থ্রি টু ফোর’ গ্রহের কমান্ডারের সাথে। কমান্ডার ওকে জানিয়েছে, আর কয়েক ঘণ্টা পরেই পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করবে তাদের সোলজারবাহী সসারগুলো। এরপর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে সুবিধা মতো জায়গা দেখে নিয়ে অবতরণ করবে পৃথিবীর বুকে। পৃথিবীর সব রাডার সিস্টেমকে ফাঁকি দেয়ার ব্যবস্থা তাদের রয়েছে। প্রতিটি সসারের চারদিকে এমন এক আলোকরশ্মি ছড়ানো হবে, যাতে সেটিকে কোনো যন্ত্র চিহ্নিত করতে না পারে। আবার এসব রশ্মি ভেদ করে কোনো হামলাও সসারগুলোকে ধ্বংস করতে পারবে না।

ভিনগ্রহীরা টেফানকে জানিয়েছে, চারটি পয়েন্টে তারা অবতরণ করবে। এরপর তিনটি গ্রুপ পৃথিবীর ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো দখল করতে যাবে। আর একটি গ্রুপকে ল্যাবরেটরিতে রূপান্তরের জন্য পাঠানো হবে। প্রফেসর ও সার্জনকে নিয়ে টেফান দ্রুততার সাথে তাদের অপারেশন করতে থাকবে। এভাবে সবগুলো গ্রুপকে এই প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে টিকে থাকার উপযোগী করতে হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে, কারণ তাদের প্রত্যেকের কাছে যে গ্যাস মাস্ক রয়েছে, তাতে পৃথিবীতে এক সপ্তাহ তারা টিকতে পারবে।

আট.

ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করলেন প্রফেসর রিকি। ডেপুটির ওপর অপারেশনের ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে এখন তার চেতনা ফেরার কথা। বারবার ঘড়ি দেখতে থাকলেন প্রফেসর। চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার মাথায়। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে টেফান। কোনো কথা বলছে না, শুধু চুপচাপ প্রফেসরের কর্মকাণ্ড খেয়াল করছে খুব মনোযোগের সাথে।

কয়েক মিনিট পর হেডফোনটা সেট করে নিয়ে কাচের বাক্সের ওপর ঝুঁকে ডাকতে শুরু করেন প্রফেসর রিকি। ‘ডেপুটি! ডেপুটি! তুমি কি জেগে আছো? আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ডেপুটি?

ধীরে ধীরে চোখ খুললো ডেপুটি। প্রায় আধা মিনিট সেভাবেই শুয়ে রইলো। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখলো। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলো। প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললো, সব কিছু ঠিক আছে প্রফেসর?

এখনো বুঝতে পারছি না। আমি অক্সিজেন সরবরাহ করছি তোমাকে। তুমি দেখো সেটা তোমার ফুসফুস গ্রহণ করে কিনা।

কাচের বাক্সে একটি অক্সিজেন পাইপ ঢুকিয়ে দিলেন প্রফেসর। ডেপুটি পাইপটি তার নাকে ঢুকিয়ে নিলো। কয়েকবার জোরে নিঃশ্বাস নিতে দেখা গেল তাকে। তারপর প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললো, মনে হয় পারছি প্রফেসর। আপনার গবেষণা সফল হয়েছে। অভিনন্দন আপনাকে! ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন আপনি।

ডেপুটির এই প্রশংসা শুনে হাসি ফুটলো প্রফেসর রিকির মুখে। তবে পরক্ষণেই তা মিলিয়ে গেল। সেখানে ভর করলো একরাশ শঙ্কা। কারণ তিনি জানেন, তার এই সফলতার অর্থ কী হতে যাচ্ছে।

এতক্ষণ পাশ থেকে সব কিছু দেখছিল টেফান। এবার সে এক ঝটকায় প্রফেসরের মাথা থেকে হেডফোনটা খুলে নিলো। নিজের মাথায় পরে নিয়ে, ডেপুটির সাথে কথা বললো। খুশির ঝিলিক দেখা গেল তার চেহারায়। একটা লেজার গান তুলে ফায়ার করে ডেপুটির কাচের বাক্সটা ভেঙে ফেললো টেফান। এমনভাবে কাজটা করলো যাতে ডেপুটির গায়ে লেজার রশ্মি না লাগে। তবে সে জানে না, লেজার রশ্মি ডেপুটির কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কারণ তার ও তার গ্রহের প্রাণীদের শরীর লেজার রশ্মির আক্রমণ সহ্য করতে পারে।

কাচের বাক্সটা ভেঙে পড়তেই পেছনের দুই পা আর লেজে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ডেপুটি। এক লাফে কিছুটা সামনে চলে এলো। ল্যাবরেটরির মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রফেসরকে তাদের গ্রহের বিশেষ ভঙ্গিতে সম্মান জানালো। মাথা থেকে হেডফোনটা খুলে ফেললো টেফান, কারণ এখন তারা ডেপুটির সব কথা সরাসরিই শুনতে পাবেন। ওর গায়ে স্থাপিত ট্রান্সলেটর ওর কথাগুলোকে পৃথিবীর ভাষায় প্রকাশ করবে। আচমকা টেফান এসে প্রফেসরের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল একটি ঘরের দিকে। তাকে ঘরটিতে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ডেপুটি জানতে চাইলে, তাকে কেন বন্দি করলে?

টেফান বললো, তার কাজ শেষ। এখন সব কাজ আমি করবো। তার প্রয়োজনও আমাদের জন্য ফুরিয়ে গেছে। আপাতত সে এই ঘরে বন্দি থাকবে। পরে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই বলে সে, কমিউনিকেশন মডিউলটার সামনে গিয়ে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা সসারগুলোর সাথে যোগাযোগ করলো। সসারগুলো থেকে জানানো হলো, তারা আর কিছুক্ষণের মাঝেই পৃথিবীতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে। টেফান জানালো এদিকের কাজও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ডেপুটি এখন মুক্ত পৃথিবীর বাসিন্দা। সসার থেকে টেফানকে অভিনন্দন জানালো অভিযানের নেতা। কথা শেষ করে কমিউনিকেশন মডিউল বন্ধ করে দিলো টেফান।

এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল ডেপুটি। এবার তার চোখে মুখে ক্ষোভ ফুটে উঠলো। এক লাফে টেফানের সামনে এসে দাঁড়ালো ডেপুটি। বললো, নিজ গ্রহের মানুষের সাথে বেঈমানি করছো তুমি। তোমাকে আমি সফল হতে দেবো না।

টেফান অবাক হয়ে গেল ডেপুটির কথায়। বললো, আমি তো তোমাদের জন্যই কাজ করছি ডেপুটি। তোমাদের কমান্ডারের নির্দেশ মানছি।

‘কিন্তু আমি মানছি না’ প্রায় চিৎকার করার মতো স্বরে বললো ডেপুটি। নিষ্ঠুর কমান্ডারের এই ধ্বংসযজ্ঞ আমি বন্ধ করবো। বলেই টেফানকে তুলে ধরে দেওয়ালের দিকে ছুড়ে মারলো। দেওয়ালের গায়ে এত জোরে পড়েছে যে, টেফান সেখানেই আধমরা হয়ে গেল। চেতনা হারিয়ে পড়ে রইলো মেঝেতে। দরজা খুলে প্রফেসরকে মুক্ত করলো ডেপুটি।

প্রফেসরকে তার ঘরে থাকতে বলে বাইরে চলে গেল ডেপুটি। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। ভিনগ্রহীদের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। তারা চারটি পয়েন্টে সসার নিয়ে নেমে পৃথিবীর ক্ষমতা আর প্রযুক্তির কেন্দ্রগুলো দখল করতে অগ্রসর হচ্ছে। বিপদ সংকে জারি করা হয়েছে সর্বত্র। যার ফলে রাস্তাঘাট ফাঁকা। লোকজন সব ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। দ্রুত গতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে মিলিটারি সেন্টারের দিকে অগ্রসর হলো ডেপুটি। পৌঁছে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে। সেখানে একটি হল রুমে জরুরি বৈঠক চলছে কর্নেল জেনারেল রুশোর নেতৃত্বে। তিনি এই প্রতিরক্ষা অভিযানের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তার কাঁধেই এখন পৃথিবীকে রক্ষার মহান দায়িত্ব।

ডেপুটিকে মিলিটারি সেন্টারে ঢুকতে গার্ডরা বাধা দিল না। কারণ প্রফেসর রিকি আগেই টেলিফোন করে কর্নেল জেনারেলকে তার কথা জানিয়েছেন। ডেপুটি যে পৃথিবীবাসীকে রক্ষা করতে চায় সেটা বলেছেন। তাই বৈঠক কক্ষে ডেপুটিকে স্বাগত জানালো সবাই। কর্নেল জেনারেল রুশো ডেপুটিকে বললেন, আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী সর্বাধুনিক সব অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। তোমাদের গ্রহের প্রাণীরা অগ্রসর হতে শুরু করেছে বলে খবর পেয়েছি।

ডেপুটি বললো, এসব অস্ত্র দিয়ে এন টুদের ঘায়েল করা কঠিন। কারণ আমাদের দৃষ্টি ও মস্তিষ্ক এত তীক্ষè যে- কোনো দিক থেকে আক্রমণ হলেই আমরা টের পাই। দ্রুত পজিশন বদল করে নিজেদের রক্ষা করতে আমাদের মতো দক্ষ কেউ নয়।

তাহলে উপায়! জানতে চাইলেন কর্নেল জেনারেল রুশো।

তারপরও লড়াই করে যেতে হবে। আপনার বাহিনীকে বলুন ওদের দেখা মাত্র আক্রমণ শুরু করতে। তবে ওরা যোদ্ধা হিসেবে যেমন দুর্ধর্ষ, তেমনি নিষ্ঠুর। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

কয়েক মিনিট পরেই তুমুল হামলা শুরু করলো ভিনগ্রহী প্রাণী এন টুদের দল। মিলিটারি সেন্টারের খুব কাছে পৌঁছে গেছে ওদের একটি টিম। সৈন্যরা যথাসম্ভব লড়াই করে যাচ্ছে; কিন্তু তাদের একেকটি গোলায় প্রচুর সৈন্য মারা পড়ছে। অন্যদিকে এন টুদের কাবু করা যাচ্ছে না। ডেপুটি সৈন্যদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সেগুলো খুব একটা কাজে আসছে না। কারণ ওদের দিকে গোলা ছোড়া হলেই ওরা এক লাফে কয়েক মিটার দূরে সরে যায়। যে কারণে টার্গেট করা যাচ্ছে না। ওদের সসারগুলো লক্ষ্য করে মিসাইল ছোড়া হচ্ছে; কিন্তু সব মিসাইল আকাশে ওঠার সাথে সাথেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ওদের ছড়িয়ে দেয়া এয়ার প্রটেকশন সিস্টেমের কারণে। ওরা সবরকম আক্রমণ সামলানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে।

খুব দ্রুত মিলিটারি সেন্টারের মেইন গেইটের কাছে চলে এসেছে এন টুরা। জেনারেল রুশো জানালেন, বিজ্ঞান একাডেমিতেও ঢুকে পড়ছে ওরা। পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ কেন্দ্রটি এখন ভিনগ্রহী এন টুদের দখলে। মিলিটারি সেন্টারটাকেও হয়তো বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখা যাবে না। রাগে ক্ষোভে টেবিলে ঘুষি মারতে লাগলেন জেনারেল। 

জেনারেলের রুমে ঢুকে ডেপুটি বললো, এখন একটাই উপায় আছে এই দানবদের ঠেকানোর।

: কীভাবে?

: আমি জানি। এ জন্য আমার খুব শক্তিশালী একটি বোমা চাই। যেটা খুব শক্তিশালী; কিন্তু বোমার ধ্বংস ক্ষমতা খুব বেশি দূরে যাবে না। বড়োজোর এক বর্গকিলোমিটার এলাকা উড়িয়ে দিতে পারবে এমন বোমা চাই।

: কী করতে চাও তুমি? জানতে চাইলেন জেনারেল রুশো।

: এত কিছু বলার সময় নেই জেনারেল। আপনি দ্রুত বোমা দেয়ার ব্যবস্থা করুন। আর ল্যাবরেটরিতে ফোন করে প্রফেসর রিকিকে বলুন পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে অনেক দূরে সরে যেতে। অন্তত ৭ দিন যেন সে লোকালয়ে না আসে। যে-কোনোভাবেই হোক তাকে সাত দিন লুকিয়ে থাকতে হবে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে অস্ত্রাগার থেকে শক্তিশালী একটি বোমা দেয়া হলো ডেপুটিকে। বোমাটি এক বর্গকিলোমিটার এলাকা নিমেষে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারবে। কয়েক লাফে পেছনের দরজা দিয়ে মিলিটারি সেন্টার থেকে বেরিয়ে গেল ডেপুটি। জেনারেল রুশো তাকে কিছু বলতে চাইলো; কিন্তু সময় দিলো না সে। দ্রুত বেরিয়ে গেল। জেনারেল বুঝলেন, প্রফেসর রিকির ল্যাবরেটরির দিকেই যাচ্ছে ডেপুটি।

বাইরে তখন প্রচণ্ড লড়াই চলছে। ল্যাবরেটরির পেছন দিকের রাস্তা ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে চললো ডেপুটি। কাছাকাছি গিয়ে দেখলো, প্রফেসর খুব তাড়াহুড়ো করে বাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসছেন। ডেপুটিকে দেখে যেন স্বস্তি পেলেন প্রফেসর। বললেন, কী খবর ডেপুটি? জেনারেল ফোন করে আমাকে এখান থেকে পালাতে বলেছেন।

: তাই করুন। দ্রুত পালান। সোজা জঙ্গলের দিকে চলে যান। আগামী এক সপ্তাহ আপনাকে যেন লোকালয়ে দেখা না যায়। বললো ডেপুটি।

: তুমি কোথায় যাচ্ছ?

: ল্যাবরেটরিতে যাচ্ছি। 

: ল্যাবের গেটের কাছে এন টুরা পৌঁছে গেছে। তুমি সেখানে গেলে বিপদ হতে পারে। বললেন প্রফেসর।

ডেপুটি বললো, না গেলে বিপদ আরো বাড়বে। আপনাকে যা বলেছি তাই করুন প্রফেসর। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। যান..... পালান। খুব দ্রুত জঙ্গলের মধ্যে চলে যান।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডেপুটির নির্দেশ পালন করলেন প্রফেসর। বললেন, আমি যাচ্ছি। তুমি সাবধানে থেকো। আশা করি দ্রুতই দেখা হবে আবার। 

প্রফেসরের যাত্রা পথের দিকে চেয়ে রইলো ডেপুটি। সে জানে আর কখনো তার সাথে প্রফেসরের দেখা হবে না। ডেপুটির মনটা কেঁদে উঠলো পৃথিবীবাসী এক বিজ্ঞানীর জন্য। যার সাথে গত কিছুদিন কাটিয়েছে সে। এমন ভালো মানুষ আছে বলেই হয়তো পৃথিবী নামক গ্রহটা এত সুন্দর।

প্রফেসর পথের বাঁক পেরিয়ে যতক্ষণ না জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলো ততক্ষণ তার পথের দিকে চেয়ে রইলো ডেপুটি। এরপর হাত নেড়ে ‘বিদায় প্রফেসর’ বলে ঘুরলো নিজের যাত্রাপথের দিকে। দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে পৌঁছে গেল ল্যাবরেটরির পেছনের দরজায়।

কয়েক মিনিট পর প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে উড়ে গেল ল্যাবরেটরিসহ গোটা বাড়িটা। ধুলায় মিশে গেল সব কিছু। সেখানে পৌঁছে যাওয়া কিছু ভিনগ্রহী প্রাণীও মারা পড়লো বিস্ফোরণে। মারা পড়লো বিশ্বাসঘাতক বিজ্ঞানী টেফান আর তার সঙ্গী সার্জন। সেই সাথে বোমার আঘাতে উড়ে গেল ডেপুটিও। পৃথিবীবাসীকে রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করলো সে।

এক সপ্তাহ পর।

ধ্বংস হওয়া বাড়িটার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর রিকি, জেনারেল রুশোসহ পৃথবীর বড়ো বড়ো নীতি নির্ধারকরা। গোটা এলাকাটা এখন দেখতে মরুভূমির মতো লাগছে। প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমার আঘাতে সব কিছু ধুলো হয়ে গেছে। মাটিতে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পুড়ে লালচে হয়ে গেছে গোটা জায়গাটার মাটি।

এন টুদের সাথে লড়াই করে পৃথিবীবাসীকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে ডেপুটি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। সে জানতো, এন টুদের গ্যাস মাস্ক তাদের এক সপ্তাহ পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখতে পারবে। এক সপ্তাহের মধ্যে অপারেশন করে ফুসফুস অক্সিজেন গ্রহণে উপযোগী করা না হলে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হবে। এটা ভেবেই শেষ পর্যন্ত ল্যাবরেটরিটা উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডেপুটি। যেহেতু মিসাইল উৎক্ষেপণ করা যাচ্ছে না, তাই ডেপুটি নিজেই বোমা নিয়ে সেখানে চলে যায়। বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয় বাড়িটা। পৃথিবীবাসীকে রক্ষার জন্য উৎসর্গ করে নিজের জীবন। আর প্রফেসরকে লুকিয়ে থাকতে বলেছে, যাতে তাকে দিয়ে আবার ল্যাবরেটরিটা দাঁড় করানোর কোনো সুযোগ না পায় এন টু’রা।

ল্যাবরেটরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ভিনগ্রহীরা বুঝতে পারে তাদের আর পৃথিবীতে টিকে থাকার সুযোগ নেই। সাত দিন পার হয়ে গেলেই তারা মারা পড়বে। তাই দ্রুত সসারে উঠে পালায়। পৃথিবী দখলের স্বপ্ন ত্যাগ করে আগ্রাসী প্রাণীগুলো। আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পৃথিবীবাসী।

মাটিতে ঝুঁকে বোমায় পুড়ে যাওয়া জায়গাটার এক মুঠো ধুলো তুলে নিলেন প্রফেসর রিকি। হাতের তালুতে নিয়ে কতক্ষণ চেয়ে রইলেন সেগুলোর দিকে। এই মাটিতেই মিশে আছে ডেপুটির দেহ। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো প্রফেসর রিকির। এরপর ধুলো ভরা হাতটা বুকের সাথে চেপে ধরলেন প্রফেসর। সেই সাথে শিশুদের মতো ডুকরে কেঁদে উঠলেন বুড়ো মানুষটা।

উপস্থিত সবার চোখেই তখন পানি। জেনারেল রুশো এসে প্রফেসরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, কাঁদবেন না প্রফেসর। ডেপুটি আমাদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তার জন্য আমরা শুধু গর্বই করতে পারি। পৃথিবীবাসী না হয়েও সে পৃথিবীর বন্ধু হয়ে উঠেছিল। এবং শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিয়ে বন্ধুত্বের মূল্য শোধ করেছে। পৃথিবীর প্রতি ওর এই ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল আপনার কারণেই। যতদিন পৃথিবী টিকে থাকবে, ততদিন ইতিহাসে লেখা থাকবে আমাদের এই ভিনগ্রহী বন্ধুর নাম।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ