ভাগ্যচক্র

ভাগ্যচক্র

তোমাদের গল্প জুয়েল আশরাফ জুলাই ২০২৩

ওমায়ের আজ আবার কাজে দেরি করে পৌঁছালো। শরীফ মাতবর তিরিক্ষি মেজাজে বললেন, তোমার এই রোজকার নাটক কবে শেষ হবে? দেরি করার জন্য টাকা দিচ্ছি না। চলো তাড়াতাড়ি ক্ষেতে গিয়ে লাঙ্গল ধরবে।

ওমায়ের তাড়াতাড়ি ক্ষেতের কাজে মন দিলো। বাড়িতে শুধু সে আর মা থাকেন। মা এখন বৃদ্ধা এবং প্রায়ই অসুস্থ। একসময় মা কাপড় সেলাই করতেন। কিন্তু এখন বুড়ো হয়ে গেছেন। চোখেও কম দেখতে পান, তাই আর কাপড় সেলাই করতে পারেন না। বাবা সমুদ্র জেলে ছিলেন। জাল আর নৌকা ভাড়া করে মাছ ধরতে যেতেন। একবার সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলেন, সেদিনের পর আর ফিরে আসেননি। গ্রামে সমুদ্র জেলেরা তেমন একটা আসে না। প্রতি সপ্তাহে একজন গ্রামে আসতো। কৃষকদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে ফিরে যেতো। জাল ও নৌকার ক্ষতিপূরণ বাবদ হারিয়ে যাওয়া জেলের বাড়িতে এসে ধরনা দিত।

ওমায়েরের কাছে খাবার কেনার টাকাও ছিল না, কোথা থেকে বাবার ঋণ শোধ দিতে পারে। এ কারণে তাকে অনেকবার জাল ও নৌকার মালিকের পক্ষ থেকে মার খাওয়ার ভয় পেতে হয়েছে। ওমায়েরের মনে একটাই স্বপ্ন, কোথাও থেকে অনেক টাকা পেলেই তার জীবন সুখের হয়ে যাবে। তার সব টাকা মায়ের ওষুধেই খরচ হয়। রোজ সকালে ওমায়েরের একটাই দুশ্চিন্তা থাকে আজ কেউ টাকা চাইতে আসবে। জীবনে হাসির সুযোগ খুব কমই পেয়েছে, সে প্রায়ই ক্লান্ত এবং চিন্তায় মগ্ন থাকে।

গত পাঁচ বছর ধরে শরীফ মাতবরের সঙ্গে কাজ করছে ওমায়ের। তার হাতে যেন জাদু আছে, তার ফলানো ফসল কখনও নষ্ট হয়নি এবং পোকাও পায়নি। শরীফ মাতবর তার কাজে খুব খুশি। তাকে বাড়িতে ডেকে এনে মাঝে মাঝে খাওয়ায়, কিন্তু শরীফ মাতবরের স্ত্রী এসব কিছুতেই পছন্দ করেন না। তিনি রেগে শরীফ মাতবরকে বলেন, আপনি একজন দরিদ্র কৃষককে আপনার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে খাওয়াবেন, আপনার কি কোনো লজ্জা আছে? আমাদের আত্মীয়রা দেখলে কী বলবে? 

শরীফ মাতবরের বউয়ের মাথায় টাকার জ্বর। কৃষক ওমায়েরের ফসল বিক্রি করেই যে এত টাকা রোজগার করেন তা তিনি খুব কমই জানেন।

রাত দশটা বাজে। শরীফ মাতবর ও তার বন্ধুরা বাজারে গল্প জমিয়ে বসা আছেন। বন্ধুদের গল্পে সারাদিনের ক্লান্তি মুছে নিচ্ছেন। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান এবং কয়েকজন চাকর রয়েছে। চাকররা রাতের বাসন-কোসন ধুয়ে পরিষ্কার করে তাদের বাড়িতে চলে গেছে।

শরীফ মাতবরের স্ত্রী ঘরে জানালার ধারে বসে আছেন। স্বামীর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় আছেন। হঠাৎ ওমায়েরকে তাদের বাড়ি থেকে বাইরে দৌড়াতে দেখলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি চেয়ারে বসেই চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন যখন ঘুম থেকে উঠলেন, দেখতে পেলেন তার আলমারির তালা ভেঙে গেছে। বুকে হাত রেখে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন। আলমারি খুলে দেখেন তার সব গয়না চুরি হয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে মনে হলো বহু দিনের ক্ষুধার্তের হাত থেকে রুটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। গয়না জায়গায় না পেয়ে সেখানেই শরীফ মাতবরের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

শরীফ মাতবর বাড়িতে চোর খুঁজে বের করার জন্য সব লোককে জড়ো করেন। সমস্ত চাকরদের পাশাপাশি ওমায়েরকেও বাড়িতে ডাকলেন, পুলিশকেও ডাকা হয়েছে। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হঠাৎই শরীফ মাতবরের স্ত্রী সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে আসেন এবং ওমায়েরের গলা চেপে ধরে বললেন, আমার গহনা কোথায়, তাড়াতাড়ি বল, না হলে আমি কী করব সারাজীবন কেঁদেও কূল পাবি না। তোকে মেরে ফেলবো!

শরীফ মাতবর ওমায়েরকে স্ত্রীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কীভাবে জানলে ওমায়ের চোর।

স্ত্রী জানায়, রাতে ওমায়েরকে তাদের বাসার নিচ থেকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন। পুলিশ ওমায়েরকে জিজ্ঞেস করল, তিনি কি সত্যি কথা বলছেন? তুমি কি সত্যিই রাতে তাদের বাসার নিচ থেকে পালিয়ে গেছো।

ওমায়ের কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ। সত্যি বলছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি চুরি করেছি।

পুলিশ অফিসার বলল, তাহলে কাল রাতে ওখানে কী করছিলে?

ওমায়ের ঘাবড়ে গিয়ে বলল, আমি আমার অসুস্থ মায়ের জন্য ওষুধ আনতে গিয়েছিলাম। দ্রুত ওষুধ নিয়ে বাড়িতে ছুটছিলাম। শরীফ মাতবর ও পুলিশ সদস্যরা তাকে বিশ্বাস করল। পুলিশ সকলের বাড়িতে তল্লাশি চালালে তা পাওয়া যায়। গহনাগুলো শরীফ মাতবরের একজন চাকর চুরি করেছে। পুলিশ তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। শরীফ মাতবরের এখন ওমায়েরের প্রতি আরও অটল বিশ্বাস।

একদিন ওমায়ের বনে নদীর ধারে পানি এনে শস্যক্ষেতে দেওয়ার ব্যবস্থা করল। এখানে দুই রাত তাকে থাকতে হবে। শস্য পাহারা শেষ হলে যাওয়ার সময় এক লোককে মাটিতে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল। দ্রুত লোকটিকে তুলে নিয়ে পানি খাওয়াল। লোকটি প্রাণ ফিরে পেল। ওমায়েরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, তোমাকে খুব মন খারাপ দেখাচ্ছে, ব্যাপারটা কী?

ওমায়ের লোকটিকে তার জীবনের কষ্টের কথা জানাল। লোকটি বললেন, শিগগিরই তোমার সমস্ত দুঃখের অবসান ঘটতে চলেছে। তুমি যেভাবে করছো সেভাবে তোমার কাজ করে যাও। 

এই বলে লোকটি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ওমায়েরও বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথ ধরল। সেদিন গ্রামে অনেক দস্যুরা প্রবেশ করেছে। দস্যুদের দেখে সকলেই খুব আতঙ্কিত হয়। লোকেরা রাজাকে বিষয়টি জানালেও রাজা সেই ডাকাতদের সম্পর্কে কিছুই করতে পারেননি, কারণ কেউ জানে না যে ডাকাতরা কোথা থেকে আসে এবং মালামাল নিয়ে কোথায় যায়। ওমায়ের যখন বন থেকে বাড়ি ফিরল, তখন সে ভাবল বনের ভেতর লোকটি তাকে কী বলে চলে গেল! ভাবতে ভাবতে সে পথ হারিয়ে ফেলেছে।

কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারল ওমায়ের বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে ফেলেছে। ঘুরতে ঘুরতে একটি গুহার কাছে চলে যায়। সে খুব ক্লান্ত তাই বিশ্রাম নিতে গুহার ভেতরে যায়। গুহায় ঢোকার সাথে সাথেই দেখে পুরো গুহা সোনায় ভরে গেছে। গুহা জুড়ে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র পড়ে আছে। একজন লোক সেই জিনিসগুলো পাহারা দিচ্ছে।

ওমায়ের আতঙ্কিত হয়। গুহা থেকে বের হয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটে যায়। বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথে সে রাজাকে এই কথা বলার কথা ভাবে। দ্রুত রাজপ্রাসাদের দিকে ছুটে যায়।

রাজপ্রাসাদের প্রবেশপথে তাকে রাজার রক্ষীরা থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছ ভাই? রাজা এখন ব্যস্ত, এখনই দেখা করতে পারবে না।

ওমায়ের হাত জোড় করে রক্ষকদের বলে, আমাকে ভেতরে যেতে দাও, আমাকে রাজাকে ডাকাতদের সম্পর্কে কিছু বলতে হবে।

ডাকাতদের নাম শুনে প্রহরীরা ওমায়েরকে ভেতরে যেতে নির্দেশ দেয়। ওমায়ের গিয়ে রাজাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। গুহার পথও বলল। রাজা তার বাহিনী পাঠালেন বনে দস্যুদের ধরতে। শিগগিরই সৈন্যরা দস্যুদের ধরে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসে কারাগারে বন্দী করে। রাজা ওমায়েরের কাজে খুব খুশি হলেন। তাকে সোনার টুকরো দিয়ে পুরস্কৃত করলেন। সেই সঙ্গে ওমায়েরকে রাজার গুপ্তচরদের বাহিনীতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজা তার মায়ের যত্ন নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে একজন ডাক্তারকেও পাঠালেন।

ওমায়ের এখন রাজার বিশেষ লোকে পরিণত হয়েছে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ