বৈশাখ বরণ ও বৈশাখীমেলা

বৈশাখ বরণ ও বৈশাখীমেলা

ফিচার এপ্রিল ২০১৫

মুহাম্মদ নূরুল হুদা#

গ্রামবাংলায় বৈশাখ বরণ নিয়ে এতটা মাতামাতি হয় না যতটা হয় শহর, বন্দর, নগরীতে। তবে বাংলা নববর্ষের একটা আবহমান ধারা গ্রামবাংলায় আমরা লক্ষ্য করে থাকি। অনুষ্ঠিত হয় নানান মেলা। আর হিন্দুদের তো কয়েক দিনব্যাপী ঢাকঢোলের চৈত্রপূজা রয়েছে। হাট-বাজারে পাওয়া যায় মাছ, ঘোড়া, গরু, পাখি, হরিণ সব জাতীয় চিনিসাজ এবং মিষ্টি জাতীয় ও মিষ্টিছড়া মুড়মুড়া বা আখরি। এগুলো বৈশাখকে পরিচিতি করে দেয় গ্রামবাংলায়। আর মেলায় চরকগাছ ঘোরানো। নাগরদোলা খেলাসহ নানা ঐতিহ্যবাহী জিনিস পাওয়া যায়। আরও এ মেলা থেকে কাঁচাআম কাটার ছোট বা চাকুই স্মরণ করিয়ে দেয় আম, কাঁঠাল ও লিচুর মওসুম এসেছে। আর এ সময়ে চিলিসাজ, মুড়মুড়া ও বিন্নিধানের খই নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে দেখা যায়। বৈশাখ মাসে চৈত্রের খরতাপ শেষে কৃষকের কল্যাণে বয়ে যাওয়া শান্তির বারিধারা। কৃষক মহা-আনন্দে আউশ ধান ও পাট চাষের প্রস্তুতি নেয়। ঐ কৃষকের জন্যই তার ছেলেকে সকালের খাবার পান্তাভাত নিয়ে যেতে দেখা যায়। কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট ছোট ধান গাছ (ধানের চারা অর্থাৎ কচি গাছ) ও পাট গাছ গজাতে দেখা যায়। আর চলে নিজের সন্তানের মতোই পরিচর্যা। আবার বৈশাখ মানেই কালবৈশাখী ঝড়, টর্নেডো ইত্যাদি। মুহূর্তেই সব লন্ডভন্ড হয়ে প্রাণ হারায় বহু বনি আদমসহ অসংখ্য জীবজন্তু। আমি ষাটের দশকে দেখেছি কালবৈশাখী ঝড়ে সারস পাখি, শকুন, কাক, জংলী কবুতর, বক, শালিক, চড়–ই, পেঁচা, ডাহুক, এবং ঘুঘুসহ নানা জানা অজানা অসংখ্য পাখি নেতিয়ে পড়ে থাকতে। মনে হয়েছে যেনো কালবৈশাখী ঝড়ে সব লন্ডভন্ড করে গেছে। বাড়িঘর সব ওলট-পালট করে দিয়ে গেছে। বাংলা বর্ষবরণের কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায় না। কারো কারো মতে বাংলা সন চালু করেছেন মোগল স¤্রাট আকবর। বাদশাহী খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই নাকি তিনি হিজরি ৯৬২-৬৩ সনে প্রবর্তন করেছিলেন ফসল কাটার মওসুমে। তাই ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিল বাংলা সনের শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল। এই সনের নাম দেয়া হয় ফসলি বছর। তখন এই বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্য চলতো ঘরে-বাইরে ব্যাপক প্রস্তুতি। সেই যুগের মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিল; নববর্ষের দিনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করলে, গরু বাছুরকে গোসল করানো হলে কেউ কারো সাথে ঝগড়াঝাঁটি না করলে এমনকি আরও ভালো ভালো কাজকর্ম করলে সারা বছর ভালো যাবে। অতীত ও বর্তমানকাল মিলে নববর্ষের আয়োজনে আমরা মিল ও অমিল খুঁজে পাই। বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা সম্ভবত হালখাতা থেকেই বলে অনুমিত হয়। ক্রেতাগণ নির্দিষ্ট কোনো দোকান (পাইকারি ছোট বা খুচরা দোকান) থেকে বাকিতে কেনাকাটা করতেন। দোকানি একটা লাল রঙের গেরুয়া খাতায় বাকির হিসেব লিখে রাখতেন বা এখনও লিখে রাখেন। নববর্ষের হালখাতা অনুষ্ঠানে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ জানানো হতো এবং এখনও জানানো হয়ে থাকে। ক্রেতাগণ কখনও পুরো পাওনা কখনও আংশিক পাওনা পরিশোধ করতেন এবং এখনও করে থাকেন। দোকানি মিষ্টি দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করাতেন। আকর্ষণীয় খেলাধুলার কথা তো রয়েছেই। ঘোড়াদৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, কুস্তি, লাঠিখেলা, তলোয়ার খেলাসহ নানান ধরনের খেলা অনুষ্ঠিত হতো। গরুর দৌড় প্রতিযোগিতাও হতো। জোয়ালে একজোড় করে গরু বেঁধে তার পেছনে মই বেঁধে দেয়া হতো। মইয়ের ওপর বসতেন গরুর মালিক। পুরনো ঢাকায় পায়রা উড়ানোর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। গিরিবাজ পায়রাদের উড়াউড়ি প্রতিযোগিতা দেখার জন্য লোকজনের ভিড় জমে যেতো। নববর্ষের অনেক স্থানের ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো। চৈত্র সংক্রান্তির রাতে পাঠকাঠিতে আগুন জ্বেলে কিশোর ও তরুণেরা গ্রাম প্রদক্ষিণ করতো যাতে নুতন বছরের গ্রামটিতে কোনো রোগ বালাই না থাকে। বর্ষবরণ করার জন্য মেলা হচ্ছে গ্রামীণ মানুষের একটি প্রাচীন উৎসব। মেলায় বিক্রি হতো ঘুড়ি, মুড়কি, খই, বাতাসা, কদমা, মুরালি এসব খাদ্যসামাগ্রী। কুমোরেরা মেলায় নিয়ে আসতেন মাটির তৈরি ঘোড়া, ঝাড়, হরিণ, বাঘ, ময়না, টিয়া, মাছ, আম পেঁপে এসব। ছুতারেরা নিয়ে আসতো কাঠের তৈরি শিশুদের খেলাঘর সাজানোর জিনিসপত্র, বাঁশি, ঢোল, ডুগডুগি এসব বাদ্যযন্ত্র ও রঙিন কাগজে তৈরি নানা রকমের ফুল বিক্রি হতো মেলায়। নাগরদোলা ছাড়াতো মেলার রূপই খুলতো না। হাজার বছরের ঐ টিমের এসব মেলায় আজ হারিয়ে যাচ্ছে। আজ বাংলা নববর্ষকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়ে থাকে, আমি পয়লা বৈশাখের সূর্য, মানুষের পৃথিবীতে আলোর রঙ মশাল জ্বালিয়ে দিতে এসেছি। আকাশ বাতাস, সাগর-নদী প্রভাত সূর্য একসাথে গেয়ে ওঠে- পুরাতন বছরের জীর্ণ-ক্লান্ত রাত্রি, ওই কেটে গেলে ওরে যাত্রী। বৈশাখ বরণ আবহমান বাংলার মধুর বৈশিষ্ট্য। গ্রাম বাংলার রাখালের উদাস বাঁশির সুরে, জারি-সারি ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া মুর্শিদির সুর লাহরিতে, ফল-ফুলের মউ মউ সুরভিতে একতারা হাতে বাউলে মন কেমন করা গানে বেজে ওঠে বৈশাখের নূপুুর ধ্বনি। বাঙালির ঘরে ঘরে নুতন এই দিনটিকে ঘিরে আন্তরিক আয়োজনের ঘটা ঘরে ও বাইরে বর্ণালি আনন্দ অনুষ্ঠান বিদেশী সুরের সি¤ফনি ও মডার্ন ইনস্ট্রুমেন্টের উত্তাল তরঙ্গ সরিয়ে দিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে আবহমান বাংলার গান। বাংলায় বসে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। ধারাবাহিকতায় আসে বৈশাখী মেলা। বাতাসে মিশে থাকে ধুলোর গন্ধ। চড়ক পুজো, গাজনের গান আর ঢাকের বাদ্যতে মুখরিত হয়ে ওঠে রোদজলা দিন। রেনুবান, পাতার মর্মরে শেষ বসন্তের উদাস হাওয়ায় উত্থিত হতে থাকে করুণ সুর- বিদায় পৃথিবীর মানুষ, বিদায় পৃথিবীর মানুষ, বিদায়। আসে নুতন বছর। বিভিন্ন দেশে নববর্ষ উৎসবের আনন্দে অবগাহন করার রেওয়াজ রয়েছে। ইরানের অনুষ্ঠানের নাম নওরোজ, চীন দেশে সামাজিকভাবে চান্দ্র নববর্ষের যে উৎসব ওরা উদযাপন করে তার নাম উনান দান। রাশিয়ার রাদুনিভসা উৎসব। নববর্ষের নাম রুশ হাশনা ভিয়েতনামীদের উৎসবের নাম তেত। বৈশাখের এই দিনটিতে লালপাড়ের সাদা শাড়ি আর লাল টিপে বাঙালি নারী পয়লা বৈশাখের উৎসবে নিয়ে আসে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা। পান্তা খাওয়ার ধুম পড়ে যায় রমনার বটমূলে, উৎসব প্রাঙ্গণে। মিষ্টিপ্রিয় বাঙালি খাবার টেবিলকে ভরে তোলেন হরেক রকম মিষ্টির সমারোহে। একদিনের এই বাঙালি বনে যাওয়াকে কেউ কেউ ভাবতে পারেন হুজুগ দেখনেপনা। আরেকভাবে বলা যায় আমাদের দেশের কৃষকদের ক্ষুধার উপকরণ শুঁটকি পান্তা খাওয়ার এই ধুমপড়া কি তাদের ভাগ্যের প্রতি নির্মম বিদ্রুপ নয়। শহরে বসে ফ্রিজ থেকে মাটির শানকিতে কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার ন্যাকামি কি আধুনিক মানুষের রুচিতে ধরে? আসলে বৈশাখে মেলা উপলক্ষে আমরা যা-ই বর্ণনা করি না কেন একে লক্ষ্য করে উৎসবের আয়োজন ক্রমইে কার্নিভালের রূপ নিচ্ছে। আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে একটি বছরের শেষ ও আরেকটির শুরুতে গ্রামীণ মেলায় অন্যান্য মনোহারিতে সামগ্রীর পাশাপাশি ফলফলাদি, কৃষি পণ্যও বিক্রি হতো। কৃষকরা ঘরদোর সাফসুতরা করে আরও একটি বছরে ফসলের জন্য লড়াইয়ের সঙ্কল্প নিতো। হিন্দু সম্প্রদায় মেলায় পূজার ঢাকঢোল বাজাতো, পাঁঠা বলি দিতো পূজামন্ত্রে নাচও হতো। বৈশাখী মেলার উৎসবে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের নিজস্ব বিশ্বাস ও রীতিনীতি অনুযায়ী ভিন্ন অভিব্যক্তি থাকলেও সে সময়ের সংস্কৃতিতে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ছিল। তবে বর্তমানে বৈশাখী অনুষ্ঠানে এমন সব বিষয় আমদানি করা হচ্ছে যা মানুষের দৃষ্টিকটু ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ-তরুণীদের উচ্ছল মাতামাতি অনেক সময় সংঘাতে রূপ নেয়। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের বাঙালি ঐতিহ্যকে ধারণ করে বৈশাখী মেলা উৎযাপিত হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ