বিদ্যুতের বিকল্প

বিদ্যুতের বিকল্প

বিজ্ঞান এপ্রিল ২০১২

সাকিব রায়হান..
দেশব্যাপী লোডশেডিংজনিত ভয়াবহ বিদ্যুতের ঘাটতি জনজীবন স্থবির করে তুলেছে। শিল্প-কলকারখানা মারাত্মক হুমকির মধ্যে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা সবাই দেখছি কিন্তু এই মুহূর্তে বিদ্যুতের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। অথচ উন্নত দেশে বিদ্যুতের রয়েছে নানা বিকল্প। যেখানে এসব পদ্ধতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হচ্ছে। কিন্তু কী হতে পারে বিদ্যুতের বিকল্প?
বিকল্প শক্তির উৎস
বিদ্যুতের বিকল্প শক্তির উৎস খোঁজা হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, সমগ্র বিশ্বে এ তৎপরতা বেড়ে চলেছে। তবে নবায়নযোগ্য শক্তিকে কাজে লাগানোর প্রয়াস অগ্রগণ্য। উন্নত দেশসহ উন্নয়নশীল দেশেও বিকল্প শক্তির প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব বিকল্প শক্তি যেমন- সোলার প্ল্যান্ট, উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট, পারমাণবিক শক্তি, ভূ-উত্তাপ শক্তি, সাগরের তাপশক্তির রূপান্তর উল্লেখযোগ্য।
সৌরবিদ্যুৎ : সোলার প্ল্যান্ট
সোলার পাওয়ার একটি নবায়নযোগ্য উৎস। ফলে এখানে বিকল্প বিদ্যুৎ হিসেবে সোলার প্ল্যান্ট কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশে বছরে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ দিন সূর্যালোক থাকে। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কিলোওয়াট ঘণ্টা শক্তি এ দেশের প্রতি বর্গমিটার জমিতে আছড়ে পড়ছে। আর ভূপতিত এই সৌরশক্তিকে সঠিকভাবে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার একটা বড় অংশ মিটিয়ে ফেলা সম্ভব।
একটি সোলার প্ল্যান্টে প্রাথমিক বিনিয়োগ অনেক বেশি মনে হলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ন্যূনতম কিছু খরচ ছাড়া আর তেমন খরচ হয় না। এর জন্য মাসিক কোনো বিল দিতে হচ্ছে না। গরমকালে তিন মাসে বিদ্যুৎ ঘাটতি অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। লক্ষ্য করার বিষয়, সৌরবিদ্যুতের পিক সময় হচ্ছে গরমকাল। অর্থাৎ গরমকালে সূর্যের বিকিরণ হয় সর্বোচ্চ। কাজেই আমাদের দেশে সৌরবিদ্যৎকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব।
কারা ব্যবহার করছেন সৌরবিদ্যুৎ
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে তাদের গবেষণা ও প্রসার অব্যাহত রেখেছে। সাধারণত আমাদের দেশের যেসব এলাকায় অর্থাৎ প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎ এখনও পৌঁছেনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৪০ লাখের মতো মানুষ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। এসব এলাকার সচ্ছল পরিবারের মানুষ এ প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে। ভারতে সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং সেখানে ভবিষ্যতের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নেপালেও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।
বায়ুশক্তিচালিত বিদ্যুৎ : উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট
বাতাসের শক্তিকে একটি সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। আর তা করা যায় উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের দ্বারা। দেশের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় ১০০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট বা বায়ুশক্তিচালিত বিদ্যৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এটিও একটি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সহায়ক হিসেবে কাজে লাগতে পারে। বায়ুশক্তিচালিত টারবাইন দ্বারা যথেষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। বিভিন্ন দেশে এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সমুদ্রের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে অফশোর উইন্ডমিল বানানো এবং রক্ষণাবেক্ষণ ভূমিতে বানানো উইন্ডমিলের চেয়ে ব্যয়বহুল হলেও এটি হবে জোরালো এবং সব সময় বাতাসের উৎস থাকায় উৎপাদন বেড়ে যাবে অনেকাংশে। তা ছাড়া এ ধরনের উইন্ডমিল আকারে বড় হবে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ডেনমার্ক, হল্যান্ড এ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শক্তি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে অনেক অগ্রসরমান। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যেমন- নেপাল ও ভারতে এ ধরনের উইন্ডমিল স্থাপন করা হচ্ছে।
পারমাণবিক শক্তি
পারমাণবিক শক্তি দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। একটি ছোট আকারের পরমাণু কেন্দ্র থেকে অসম্ভব পরিমাণে শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। এ পারমাণবিক শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি সহায়ক সমাধান হতে পারে। তবে এ ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় বাধা হচ্ছে এর ক্ষতিকর বর্জ্য এবং ব্যয়বহুল উৎপাদন ব্যয়।
জিওথার্মাল বা ভূ-উত্তাপ শক্তি
শীতপ্রধান দেশে এ ধরনের শক্তি কাজে লাগানোর প্রয়াস লক্ষণীয়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে যে শক্তি পরিলক্ষিত হয় তার চেয়েও কয়েকগুণ শক্তি ভূপৃষ্ঠের নিচে সংরক্ষিত রয়েছে। এই ভূ-উত্তাপ ব্যবহার করে শীতপ্রধান দেশে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট উষ্ণ রাখাসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে। এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সারা বিশ্বে উৎপাদিত প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট জিওথার্মাল বা ভূ-উত্তাপ শক্তির মধ্যে আমেরিকাতে প্রায় দুই হাজার ৮শ’ মেগাওয়াট শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে। এটি ব্যয়বহুল প্রজেক্ট।
সাগরের তাপশক্তির রূপান্তর
সাগরের পানিতে ওপরে এক রূপ আর নিচের দিকের পানিতে আরেক রূপ। সূর্যের আলোয় ওপরের পানি ক্রমে উষ্ণ হয় এবং নিচের দিকের পানি থাকে শীতল। অল্প তাপে ফুটতে থাকে এমন তরল গ্যাস ব্যবহার করে সাগরের ওপরের দিকের পানি থেকে তাপ সংগ্রহ করে বিশেষ প্ল্যান্টের সহায়তায় টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। আবার এ তরল গ্যাসকে সাগরের গভীরে পাঠিয়ে পানি শীতল করা সম্ভব। এর মাধ্যমে কয়েকগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।
করণীয় যা হতে পারে
আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু হয়েছিল প্রথমে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে। কিন্তু আজ আমাদের জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার যে অবনতি তাতে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনাকে স্তিমিত রাখা মোটেও যুক্তিসঙ্গত হবে না। বরং এ প্রযুক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের। এর মাধ্যমে আমরা বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতে পারব নিঃসন্দেহে। শহরে বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করা যেতে পারে। দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৮৬ ভাগ উৎপন্ন হয় গ্যাসচালিত বিদ্যৎকেন্দ্র থেকে। আর বাকি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তরল জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে। সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় সৌরশক্তি থেকে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। আরও অধিক পরিমাণে সৌরবিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া বায়ুশক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হতে পারে।
আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় বিদ্যুৎ একটি অতীব চাহিদাসম্পন্ন উপকরণ। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সঠিক প্রাপ্তি সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের জীবনযাত্রা, শিল্প, কলকারখানা, অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে যে অচল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় থাকবে না। কাজেই আমাদের যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে, তেমনি প্রচলিত এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বিকল্প কী হতে পারে সে ব্যাপারে ভেবে শিগগিরই একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ