বারো শাহজাদীর কাহিনী

বারো শাহজাদীর কাহিনী

অনুবাদ গল্প আগস্ট ২০১৪

ব্রাদার্স গ্রিম
অনুবাদ : সাজ্জাদুল ইসলাম

Konnaএক বাদশাহের ছিল বারোটি মেয়ে। তারা ছিল যেমনি সুন্দরী, তেমনি মেধাবী। বারোটি মেয়ে একটি কক্ষের বারোটি বিছানায় ঘুমাতো। ঘুমানোর আগে তারা জানালা দরজা বন্ধ করে দিতো। কিন্তু প্রতিদিন সকালে তাদের জুতাগুলো জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পাওয়া যেত, মনে হতো এ জুতাগুলো পরে সারারাত তারা যেন নাচগান করে কাটিয়েছে। কেউই বলতে পারতো না এটি কেমন করে হলো অথবা শাহজাদীরা রাতে কোথায় ছিল। কথাটি বাদশাহের কানেও গেল। তিনি তার রাজ্যে ঘোষণা করে দিলেন, শাহজাদীরা রাতে কোথায় নৃত্য করে তা যদি কেউ বের করতে পারে তাহলে সে তাদের মধ্যে থেকে যাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারবে এবং তার মৃত্যুর পর সেই হবে দেশের নতুন বাদশাহ। তবে কেউ যদি এ চেষ্টা করে তিন দিনের মধ্যে তা বের করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। শিগগিরই এক বাদশাহর ছেলে এসে হাজির হলো। তাকে অত্যন্ত সমাদর করা হলো। তারপর শাহজাদীরা রাতে যে কক্ষে থাকে তার পাশের একটা কক্ষ তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে বসে তাকে দেখতে হবে শাহজাদীরা রাতে কোথায় নাচতে যায়। তার আড়ালে যাতে কোন কিছু ঘটতে না পারে সে জন্য তাদের কক্ষের দরজা খুলে রাখা হলো। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে শাহজাদা ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে যখন তার ঘুম ভাঙলো তখন সে দেখতে পেল যে শাহজাদীদের সকলেই নৃত্য করেছিল এবং তাদের জুতার সোলগুলো নৃত্যের কারণে ভেঙে গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটলো। তাই বাদশাহ তার শিরñেদ করার নির্দেশ দিলেন। এরপর আরো কয়েকজন এলো এ রহস্য উন্মোচন করতে। কিন্তু সকলেই ওই শাহজাদার ভাগ্য বরণ করতে হলো। একই দিনে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। একজন সৈনিক যুদ্ধে আহত হয়। তাই এখন আর যুদ্ধ করতে পারে না। সে এ রাজার দেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। যখন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় এক বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। মহিলা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছো? কোথায় যাচ্ছি অথবা কী করলে সবার জন্য ভালো হবে তা আমি জানি না। সৈনিকটি জবাব দিলেন। তবে শাহজাদীরা কোথায় নৃত্য করে তা খুঁজে বের করাই সম্ভবত আমার জন্য উত্তম হবে, তাহলে আমি বাদশাহ হতে পারবো। মহিলা বললেন, ভাল কথা কিন্তু কাজটি বড়ই কঠিন। একমাত্র উপায় হচ্ছে সন্ধ্যায় শাহজাদীদের একজনের আনা পাত্রের কোন পানীয় পান না করা এবং সে চলে যাওয়া মাত্রই আমাকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার ভান করতে হবে। দুই. এরপর তিনি সৈনিকটিকে একটি ঘড়ি দিয়ে বললেন, এটি পরা মাত্রই আপনি অদৃশ্য হয়ে যাবেন এবং শাহজাদীদের পিছু নিয়ে তারা কোথায় যায় তা দেখতে সক্ষম হবেন। সৈনিকটি এসব হিতকর উপদেশ শোনার পর তার ভাগ্য পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই তিনি সরাসরি বাদশাহের দরবারে হাজির হয়ে কাজটি করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। অন্যদের মতো তাকেও সাদরে গ্রহণ ও সমাদর করা হলো। বাদশাহ তার মাথায় শাহিতাজ পরিয়ে দিতে বললেন। সন্ধ্যায় তাকে শাহজাদীদের কামরার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ঠিক সে যখন ঘুমাতে যাচ্ছিলো ঠিক সেই সময়ই সবচেয়ে বড় শাহজাদী এসে তাকে এক কাপ শরবত দিল। কিন্তু সৈনিকটি শরবত পান না করে গোপনে তা ফেলে দিলো এবং সাথে সাথে বিছানায় শুয়ে পড়লো এবং কিছুক্ষণ পরই নাক ডাকতে শুরু করলো, যেন সৈনিকটি দ্রুত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন। ১২ শাহজাদী এটি শুনতে পাওয়ার পর প্রাণ খুলে হাসলো এবং সবচেয়ে যে বড় সে বললো, হতভাগা লোকটা এভাবেই জীবন না দিয়ে অন্য কোন কাজ করলেই ভালো করতো! এরপর তারা উঠে দাঁড়ালো এবং তাদের ড্রয়ার ও বাক্স খুলে সুন্দর সুন্দর পোশাক বের করে পরলো এবং আয়নার সামনে গিয়ে সাজলো। তারা ক্রমশ নৃত্যের জন্য অধীর হয়ে ওঠায় লাফাচ্ছিল। তবে সবচেয়ে ছোট বোনটি অন্যদেরকে বললো জানি না, আমার কেন এমন হচ্ছে। তোমরা সবাই অত্যন্ত খুশি হলেও আমার মোটেই ভাল লাগছে না। আমি নিশ্চিত যে আমাদের কোন একটা অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। বড় বোনটি তাকে বললো, তুমি একটা বোকা মেয়ে। তুমি সবসময় এমন ভয় পাও। কত রাজার ছেলে যে ইতোমধ্যে জীবন হারালো তা তুমি একেবারেই ভুলে গেছো দেখছি। আর এ সৈনিককে আমি ঘুমের ওষুধ না দেয়া সত্ত্বেও সে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে। তারা সকলে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর ওঠে সৈনিকটির কাছে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করে দেখলো। সে তখন নাক ডাকছিলো এবং তার হাত-পা নড়াচড়া করছিল না। তাই তারা মনে করলো তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে। এরপর সবার বড় বোন তার নিজের বিছানায় উঠে হাততালি দিল। বিছানাটি একটি মেঝের সাথে মিশে গেল এবং একটি গোপন দরজা খুলে গেল। সৈনিকটি দেখতে পেলো যে তারা এক এক করে গোপন দরজা দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। সবার আগে রয়েছে বড় বোনটি। সে ভাবল আর সময় নষ্ট করা যাবে না। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে বৃদ্ধ মহিলার দেয়া ঘড়িটি হাতে পরে নিয়ে তাদের অনুসরণ করতে লাগলো। অবশ্য সিঁড়ির মাঝামাঝি স্থানে এসে সবচেয়ে ছোট শাহজাদীর গাউনের ওপর তার পা পড়ে। সে সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে তার বোনদেরকে বলে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। কে যেন আমার গাউন টেনে ধরেছিল। সবার বড় বোনটি বললো, তুমি একটা বোকা মেয়ে, কিছুই হয়নি। দেয়ালের অমসৃণ স্থানে হয়তো উঠে গিয়েছিল। তারা সবাই নিচে নেমে এলো। কী চমৎকার কুঞ্জবন! গাছপালার পাতাগুলো রুপার তৈরি, সেগুলো ঝলমল করছিল এবং মনোমুগ্ধকর দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। সৈনিকটি স্থানটি থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহের ইচ্ছা করলো। তাই সে একটি গাছের ছোট একটি ডাল ভাঙলো, এতে গাছ থেকে জোরে শব্দের সৃষ্টি হলো। এতে সর্বকনিষ্ঠ মেয়েটি আবারও বললো, আমি নিশ্চিত যে সবকিছু ঠিক মতো এগোচ্ছে না। তোমরা কি শব্দ শুনতে পাওনি? আগে কখনো তো এমনটি হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে বড় বোনটি আবারও বললো, এটা হচ্ছে আমাদের শাহজাদাদের আনন্দের শব্দ। আমরা কাছাকাছি চলে আসায় তারা এ আনন্দ প্রকাশ করছে। এরপর তারা আরেক ফুলবাগানে প্রবেশ করলো। এ বাগানের গাছগুলোতে সোনার পাতা শোভা পাচ্ছে। এ বাগান পার হয়ে তারা আরেকটি কুঞ্জবনে প্রবেশ করলো, এ বাগানের গাছে হীরার পাতাগুলো অসাধারণ মোহনায় দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। সৈনিকটি প্রতিটি বাগান থেকে একটা করে গাছের ডাল ভেঙে নিল। প্রতিবারই ডাল ভাঙার সময় বেশ শব্দের সৃষ্টি হয়। এতে ছোট বোনটি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু প্রতিবারই সবচেয়ে বড় বোনটি বলে যে, এটি হচ্ছে শাহজাদের আনন্দধ্বনি। তারা হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় হ্রদের কাছে গেল। ঘাটে ১২টি ছোট নৌকা বাঁধা ছিল। তাতে ১২ জন সুদর্শন শাহজাদা অপেক্ষা করছিল। দেখে মনে হলো তারা জন্য শাহজাদীদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। একজন করে শাহজাদী একটি করে নৌকায় গিয়ে উঠলো। সৈনিকটি সবচেয়ে ছোট মেয়েটির নৌকায় যেয়ে উঠলো। ওদের পানিতে নৌকা বেয়ে যাবার সময় সবচেয়ে ছোট শাহজাদী ও সৈনিকটিকে বহনকারী নৌকার শাহজাদা বললো, আমি সর্বশক্তি দিয়ে নৌকা চালানো সত্ত্বেও নৌকা আগের মতো দ্রুত চলছে না কেন বুঝতে পারছি না। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। নৌকাটি আজ অত্যন্ত ভারী মনে হচ্ছে। শাহজাদী বললো, গরমের কারণেই এমনটি হচ্ছে। আমারও খুব গরম লাগছে। হ্রদের অপর পাড়ে একটি সুন্দর আলো ঝলমলে দুর্গ। সেখান থেকে সুমিষ্ট সুর ভেসে আসছিল। একে একে সকলে নৌকা থেকে নেমে দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। প্রত্যেক শাহজাদা তার সঙ্গী শাহজাদীর সঙ্গে নৃত্যে মেতে উঠলো। সৈনিকটি এখনো সবার চোখের বাইরে থেকে সবকিছুই দেখছিলো এবং তাদের সাথে সাথে সেও নাচ্ছিলো। কোন শাহজাদী যখনই তার গ্লাসে পানীয় ঢালছিল তখনই সে তা এক চুমুকে খেয়ে ফেলছিল। তাই সে যখন গ্লাস মুখে তুলছিল তখন তা শূন্যে ছিল, সবচেয়ে ছোট বোনটির কাছে যখন এ ঘটনা ধরা পড়লো তখন সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু সবচেয়ে বড় বোন বরাবরের মতো এবারও তাকে শান্ত করলো। রাত ৩টা পর্যন্ত তারা নাচলো। নাচতে নাচতে ইতোমধ্যে তাদের সকলের জুতা ছিঁড়ে গেছে। তাই তারা চলে যেতে বাধ্য হলো। শাহজাদারা নৌকায় করে তাদেরকে হ্রদের ওপাড়ে নিয়ে গেল। এ সময় সৈনিকটি সবচেয়ে বড় শাহজাদীর নৌকায় উঠলো। তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল। শাহজাদীরা পরের রাতে আবারও আসার প্রতিশ্রুতি দিল। তারা সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই সৈনিকটি শাহজাদীদের আগেই উঠে এসে তার বিছানায় শুয়ে পড়লো। ক্লান্ত ১২ বোন ধীরে ধীরে উপরে ওঠার সময় বিছানায় শুয়ে তার নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল, তারা বললো, এখন আমরা সবাই সম্পূর্ণ নিরাপদ। এবার তারা তাদের সুন্দর পোশাক ও জুতা খুলে নিজ নিজ বিছানায় শুয়ে পড়ে। পরদিন সকালে সৈনিকটি কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে কোনো কথা বললো না। শাহজাদীদের সে বিস্ময়কর অভিযান সম্পর্কে আরো জানতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাতেও তাদের সাথে গেল। আগের রাতের মতোই সবকিছু ঘটলো। জুতাগুলো ছিঁড়ে টুকরা টুকরা না হওয়া পর্যন্ত শাহজাদীরা নাচতে থাকলো। এরপর ঘরে ফিরে এলো। তৃতীয় রাতে সৈনিকটি একটি সোনার কাপ কোথায় যে ছিল তার প্রমাণ হিসেবে সঙ্গে করে নিয়ে এলো। গোপন কথা ঘোষণা করার সময় ঘনিয়ে আসা মাত্র সে তিনটি শাখা ও সোনার কাপ নিয়ে বাদশাহের সামনে হাজির হলো। সে কী বলে তা শোনার জন্য ১২ শাহজাদী দরজার পেছেন গিয়ে দাঁড়ালো। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ১২ মেয়ে কোথায় রাতে নাচ করেছিল? জবাবে সৈনিকটি বলল, ভূগর্ভের এক দুর্গে বারোজন শাহজাদের সঙ্গে। এরপর সে বাদশাহকে যা যা ঘটেছিল তা বললো এবং সে সঙ্গে করে আনা গাছের তিনটি ভাঙা শাখা ও সোনার কাপ তাকে দেখালো। বাদশাহ এবার শাহজাদীদের ডাকলেন এবং সৈনিকটি যা বলছে তা সত্য কিনা জানতে চাইলেন তারা যখন দেখতে পেল যে তাদের গোপন বিষয় প্রকাশ হয়ে গেছে তাই তা অস্বীকার করে এখন আর কোনো লাভও হবে না। তারা তাদের সব কথাই স্বীকার করলো। তখন বাদশাহ সৈনিকটিকে বললেন, কোন শাহজাদীকে সে বিয়ে করতে চায়? সে বললো, আমি খুব অল্প বয়সী নই, তাই আমি সবচেয়ে বড় শাহজাদীকে চাই... সে দিনই তাদের বিয়ে হয়ে গেলো এবং সৈনিকটিকে বাদশাহর উত্তরাধিকারী মনোনীত করা হলো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ