বাদলের অঙ্গীকার

বাদলের অঙ্গীকার

গল্প আতাউল হক মাসুম ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শ্রেণিশিক্ষক ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতেই পেছনের ছেলেটা কলম দিয়ে খোঁচা মারল নাহিদের পিঠে। শুরু থেকেই ছেলেটা তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে যাচ্ছে। এখনো ক্লাসের সবার নামই ঠিকমতো জানা হয়নি নাহিদের। তার এরূপ ব্যবহারের কারণ কী তাও সে জানে না। ছেলেটার নাম বাদল। বয়সে নাহিদের চেয়ে বেশ বড়োই হবে। সিটে বসার সময় সে নাহিদকে নাক বোঁচা বলে কটূক্তি করেছে। এবার নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সে বলল, তুই ক্লাস সেভেনে ভালো করতে পারবি না, সিক্সে তোর আরো এক বছর পড়ে আসা উচিত ছিল।

কালেক্টরেট মডেল স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে নাহিদ বগুড়ার শহরের একটি স্কুলে পড়ত। ওর বাবা একজন পুলিশ অফিসার। তিন মাস হলো তিনি বদলি হয়ে পাবনা এসেছেন। ক্লাসে নতুন মুখ হওয়ায় ভিনগ্রহের প্রাণীর মতো সবাই নাহিদের দিকে তাকিয়ে ছিল। নাহিদ বাদলের কথায় বিরক্ত না হয়ে বরং তার সাথে ভালোভাবে কথা বলছিল। তবে বাদল ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র নয়। সে নাহিদকে এটা ওটা বলে বিরক্ত করেই যাচ্ছিল।

নাহিদ পড়াশোনায় বরাবরই ভালো। লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমেও সে অংশগ্রহণ করে থাকে। ফলে অল্প দিনেই তার বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে লাগল। নাহিদ পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথেই সুন্দরভাবে কথা বলে। তার আম্মু অবশ্য তাকে সবসময়ই সাবধানে চলাফেরা করতে বলেন। ক্লাসের সবাই নাহিদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও বাদল এর ব্যতিক্রম। প্রথম দিন থেকেই অজ্ঞাত কারণে সে নাহিদকে অপছন্দ করে আসছে। শুধু নাহিদ নয়, কারো ভালোই সে সহজে মেনে নিতে পারে না। বাদল পড়াশোনার চেয়ে অন্যান্য কাজকর্মেই বেশি মনোযোগী। একবার স্কুলের পেছনের আমগাছ থেকে পড়ে গিয়ে তার হাত ভেঙে গিয়েছিল। হেডস্যারের কাছে তার নামে অভিযোগের অন্ত নেই।

কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে আন্তঃস্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। ক্লাসে ক্লাসে চলছে প্লেয়ার নির্বাচনের কাজ। সেদিন নাহিদের নাম লেখানোর জন্য রনি খুব পীড়াপীড়ি করছিল। রনি অল্পদিনেই নাহিদের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। নাহিদের অসম্মতি দেখে বাদল এসে ফোড়ন কেটে বলল, ওকে দেখে তো মনে হয় না খেলতে জানে! কোনোদিন কি তুই ব্যাট ধরেছিস? বাদলের সঙ্গের কয়েকজন হেসে উঠল হো হো করে। নাহিদ আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল, বড়ো মাঠে কখনো খেলিনি, তবে বাসায় প্রতিদিন খেলি ছোটো ভাইয়ের সাথে। শুনে বাদলের হাসি যেন থামেই না। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, বাসা আর মাঠ এক নয়। রোদে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি। হা-হা-হা...।

বাদলের কথায় নাহিদের জেদ চেপে গেল। রনিকে বলে অবশেষে সে প্রাথমিক টিমে নাম লেখালো। বিকেলে প্র্যাকটিস ম্যাচে সবাই চলে এলো যথাসময়ে। নাহিদ মাঠে নামল বাদলের বিপক্ষ দলের হয়ে। নাহিদ ভয়ে ভয়ে ছিল। এত বড়ো মাঠে এর আগে সে কখনো খেলেনি। শেষে সাহস দেখাতে গিয়ে আবার না অপমানিত হতে হয়। সবার শেষে ব্যাটিং এ ডাক পড়ল নাহিদের। বাদলরা আগে ব্যাটিং করেছে। নাহিদদের তিন ওভারে তুলতে হবে সাতাশ রান। ক্রিজে নেমে প্রথম ওভার তেমন কিছু করতে পরল না নাহিদ। বিপরীত পার্শে¦র ছেলেটা ভালো খেলছিল। রনি বারবার চেঁচিয়ে নাহিদকে ঠেকিয়ে খেলতে বলছিল। শেষ ওভারে বল করতে এলো বাদল। প্রথম বলটা ঠেকিয়ে দিয়ে পরের বল লেগ সাইড দিয়ে চার মেরে দিলো নাহিদ। ব্যাটিং শিবির থেকে বাহবা দিতে লাগল সবাই। রনি তাকে নির্ভয়ে খেলতে বলল। পরের দুইটা বল ডট গেল। বিপক্ষ দল জয়ধ্বনি দেওয়া শুরু করল। শেষের বলে বিশাল ছক্কা হাঁকিয়ে দল জেতালো নাহিদ। রান দরকার ছিল পাঁচ। বাদল হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে সীমানা দেখে বলল ছক্কা হয়নি। চার হয়েছে। আম্পায়ারের সাথে তর্ক জুড়ে দিলো সে। রনিরা প্রতিবাদ করলে তর্কে হেরে গিয়ে চুপচাপ চলে যায় বাদল। আসলে সে গায়ের জোরে লজ্জা ঢাকতে চাচ্ছিল। নাহিদের নাম লেখা হলো মূল দলে। বাদলেরও স্থান হয়েছে। তবে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে।

বিষয়টা বাদল কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। তার সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ল নাহিদের ওপর। সে না এলে আজ তার এই দশাটা হতো না। মনে মনে একটা ষড়যন্ত্র পাকাল বাদল। যে করেই হোক তার খেলা চাই-ই চাই। দুইদিন পর শুরু হবে প্রথম পর্বের খেলা। নাহিদ খেলতে না পারলেই কেবল সে সুযোগ পাবে।

পরদিন বাদলকে অন্যরকম আবিষ্কার করল নাহিদ। ক্লাসে তার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করছিল সে। ছুটির পর তারা একসাথেই বের হলো। হাঁটতে হাঁটতে বদল বলল, আজ বিকেলে তো প্র্যাকটিস নেই, চল নাহিদ এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি।

আমি যে বাসায় কিছু বলে আসিনি।

ভয় কিসের, তুই মেয়ে মানুষ না কি ব্যাটা! বাজারে আনন্দমেলা হচ্ছে, অনেক কিছু উঠেছে সেখানে। আর আমরা বিকেলের মধ্যেই চলে আসব।

বাদলের গায়ে পড়া কথায় একটু অবাক হলেও মেলা দেখার লোভে রাজি হয়ে গেল নাহিদ। ঘুণাক্ষরেও সে বাদলের দুরভিসন্ধি ধরতে পারল না। বাদল ঠিক করেছে, নিভৃত কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে নাহিদকে এমন ভয় দেখাবে, যাতে সে না খেলে কিংবা খারাপ খেলে। কথা না শুনলে মেরে এমন অবস্থা করবে যাতে খেলার নাম আর মুখে আনতে না পারে। নাহিদ মাঠে নামতে না পারলেই তার অবস্থান নিশ্চিত!

হাঁটতে হাঁটতে ওরা কলেজ রোডে চলে এলো। নাহিদ বলল, আর কতদূর?

বাদল বলল, এইতো সামনেই।

আরও কিছুদূর হেঁটে বাজারের শেষ মাথায় গিয়ে ওরা মেলার দেখা পেল। হরেক রকম পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। দুপুরবেলা হওয়াতে নাগরদোলা কিংবা সার্কাস দেখার ভিড় ছিল না তেমন। বাদল বলল, চল ওদিকে একটু ঘুরে আসি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো সার্কাস। এইসব দেখতে দেখতে কীভাবে যে সময় কেটে গেছে নাহিদ টেরই পায়নি। চারদিকে দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মায়ের কথা মনে হতেই ভয়ে মুখ কালো হয়ে গেল নাহিদের। বাদলকে বলল, চল বাড়ি ফিরে যাই। এতক্ষণে হয়তো আম্মু চিন্তা করছেন!

আচানক বাদল গম্ভীর স্বরে বলল, চিন্তা তো করতেই হবে। নাহিদ ভয় পেয়ে বাদলের মুখের দিকে চেয়ে রইল। বাদল একটু থেমে বলল, শোন তোকে একটা কথা বলার জন্য এতদূর ডেকে নিয়ে এসেছি। তুই উড়ে এসে জুড়ে বসেছিস। তোর কারণে আমার খেলা পণ্ড হয়ে গেল। তুই স্যারকে বলে তোর নাম কেটে দিবি। না হলে আমি মেরে তোর হাড়-গোড় ভেঙে খেলার সাধ-মিটিয়ে দেবো।

হঠাৎ অদূরে একটি পুলিশের ভ্যান এসে থামল। উৎসুক জনতার সমস্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করল গাড়ি থেকে নামা জনাচারেক পুলিশ।

ওদিকে ঘটেছে আরেক ঘটনা। দুপুর পেরিয়ে বিকেলেও নাহিদ বাসায় না ফিরলে নাহিদের আম্মু নাহিদের আব্বুকে ফোনে বিষয়টা জানায়। সহজ-সরল ছেলেটাকে নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। প্রথম প্রথম কিছুদিন নাহিদের আম্মু স্কুলে যেতেন। এখন নাহিদ একাই যাওয়া আসা করে। তাছাড়া ক্লাস সেভেন তো আর ছোটো ক্লাস নয়। নাহিদের কিছু হয়ে গেলে ওর আম্মু নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না। নাহিদের আব্বু পুলিশ কর্মকর্তা জামান সাহেব সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে ফোন দিয়ে জানতে পারলেন যথাসময়ে স্কুল বন্ধ হয়েছে এবং সবাই চলে গিয়েছে। নানান দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরল তাকে। কয়েকজন কনস্টেবলকে বিভিন্ন লোকেশেনে সন্ধানে পাঠিয়ে তিনি বাসায় গেলেন স্ত্রীর কাছে। দেশে আজকাল কিডন্যাপ করে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে অহরহ। কিছুক্ষণ পর অনুসন্ধিৎসু পুলিশ ফোন করে জানায় বাজারের আনন্দ মেলায় দুই কিশোরকে দেখা গেছে। জামান সাহেব তাদের সঙ্গে নিয়ে থানায় যেতে বলে তিনিও থানার পথ ধরলেন। নাহিদের আব্বুর সাথে নাহিদের আম্মুও গেলেন। অশুভ আশঙ্কায় তিনি ইতোমধ্যে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন।

নাহিদ আর বাদলকে যখন পিকআপ ভ্যান থেকে নামানো হলো তখন মাগরিবের আযান হচ্ছিল। নাহিদের আম্মু ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। নাহিদ ভয় এবং লজ্জা মেশানো চেহারা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। অপর দিকে ভয় এবং উৎকণ্ঠায় বাদলের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। দিনরাত ঘুরাঘুরিতে তার ভয়-বাধা নেই। সে ভয় পাচ্ছিল নাহিদ ওর বাবাকে সব বলে দিলে তার কি হবে এই ভেবে। নাহিদের বাবা যে একজন পুলিশ অফিসার তা সে জানত না। কিন্তু নাহিদ তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, সে-ই বাদলকে ডেকে নিয়ে মেলায় গিয়েছিল সার্কাস দেখতে, বাদলের কোনো দোষ নেই। আরও কিছু বলছিল নাহিদ। কিন্তু তা আর বাদলের কানে ঢুকল না। সে একমনে চেয়ে রইল নাহিদের দিকে। চোখের কোণ ভিজে উঠছে তার। নাহিদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেল বাদল। সেদিনের পর থেকে তারা দুজন হয়ে গেল ক্লাসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাদল যাবতীয় বদঅভ্যাস ত্যাগ করে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার অঙ্গীকার করল। নাহিদ স্যারকে অনুরোধ করলে তিনি নাহিদ এবং বাদল দু’জনকেই ক্লাস সেভেনের হয়ে খেলার সুযোগ করে দিলেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ