বাঘবন্ধু

বাঘবন্ধু

উপন্যাস জাফর তালুকদার সেপ্টেম্বর ২০২৩

(গত সংখ্যার পর)


লজ্জায় মরে গেলাম। ভারি অদ্ভুত ছিল মানুষটা। সারাটা রাত পার হয়েছিল গালগল্পে। মতিকাকুও যেমন। উনিও তেমন। যাকে বলে সমানে সমান।


আমাদের সকাল হলো অবশেষে।

জোয়ারে ভেসে উঠেছে আমাদের নৌকা। পাখিদের ডাকাডাকিতে কান রাখা যায় না। হালকা বাতাস দিয়েছে। সবুজ টাটকা ঘ্রাণে নাক ভরে উঠছে।

পাতলা আঁধার ছড়িয়ে আছে তখনও।

কাকু আড়মোড়া ভেঙে লাফিয়ে উঠলেন, কী ব্যাপার তোমরা এখনো ঘুমিয়ে আছো? কখন নামবে!

আমরা তৈরি হয়েই ছিলাম।

শিকারির মতো আমিও সেজেগুজে নিয়েছি।

ঘাড়ে  বাঁধা বন্দুক। কোমরের মোটা বেল্টে গোঁজা সার সার টোটা। মাথায় কানটুপি। পোকার কামড় ঠেকাতে এতো আয়োজন।

মতিকাকু আড়চোখে তাকিয়ে ফুড়ন কাটলেন, একটা দড়িটড়ি সঙ্গে নাও। বাঘ শিকারে যাচ্ছ, গাছে চড়ে কোমর টোমর বেঁধে রাখতে হবে না ডালের সঙ্গে!

একটু লজ্জিত হলেও ভড়কে গেলাম না। শিকারি লোকটা সব পই পই করে শিখিয়ে নিয়েছেন আমাকে।

মৃদু কেশে বললাম, তাও নিয়েছি। ছুরিও পকেটে আছে।

আর দেরি নয়।

সূর্য উঠার আগেই গাছে চড়ে বসতে হবে। সাতসকালে হরিণের দল লাইন দিয়ে পানি খেতে নামে। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।

আমরা তিনজন তিন গাছে চড়লাম। কুঁজো বক-মারা শিকারি। ভাব দেখে মনে হচ্ছে জোড়া বাঘমারা সেই মেহের আলী!

সেই তেজ। সেই হুঙ্কার।

হুঙ্কারের আওয়াজ বেরোল না। বুক ঢিপ ঢিপ শুরু করল।

শিকারি বানরের গলায় আওয়াজ দিচ্ছে থেমে থেমে।

হরিণ পটানো বুদ্ধি। বানরের ডাকাডাকি শুনে অনেক সময় কেওড়া খাওয়ার লোভে ছুটে আসে হরিণ।

হরিণ আসার আগে ঝাঁক বেঁধে এলো রাজ্যির বাউড়ে পোকা।

মনে হলো সমস্ত শরীর ছিবড়ে খাবে। অবস্থা এমন হলো যেন ভিক্ষা দরকার নেই, কুকুর ঠেকাও।

কিন্তু কে ঠেকাবে কার কুকুর?

পোকার আক্রমণে রীতিমতো পাগল হবার অবস্থা।

সকালটা পাতলা রঙ ধরেছে সামান্য।  হালকা বাতাসে ঝির ঝির গুঞ্জন উঠছে গাছের পাতায়।

একটা পাখি ক ক করে উড়ে গেল মাথার ওপর।

একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছিল তখনও।

হঠাৎ বনবাদাড় কেঁপে ভেসে এলো বাঘের গর্জন। গাছটা অস্বাভাবিক দুলে উঠল। এটা কি রাতের সেই বাঘটা?

তারা এসেছে টের পায়নি তো?


বাঘ নাকি খুব চালাক। নাক শুঁকে মানুষের গন্ধ টের পায়। ওটা কি মানুষখেকো নাকি? তাহলেতো আরো মুশকিল। নাক টেনে টেনে ঠিকই পৌঁছে যাবে গাছের নিচে।

বাঘটা কি চিড়িয়াখানায় দেখা বাঘের মতো অতো বড়ো হবে! খুলনায় এসপি সাহেবের চিড়িয়াখানায় একটা ভয়ঙ্কর বাঘ ছিল। স্কুলের টিফিনের সময় দলবেঁধে দেখতে যেত ছেলেরা।

বড়ো একটা খাঁচার ভেতর ওটা শুয়ে-বসে ঝিমাত। ওর জন্য খেতে দেওয়া হতো জ্যান্ত একটা কুকুর।

সে ভারি কষ্টের দৃশ্য।

ভয়ে এককোণে বসে কুইকুই করে কাঁদত কুকুরটা। আড়চোখে বাঘটাকে দেখত আর কাঁপত থর থর করে।

বাঘটা আগুন আগুন চোখে তাকিয়ে জিভ নাড়ত ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে। এভাবে একটু একটু করে সে নিজেকে তৈরি করত চূড়ান্ত আক্রমণের। অনেকটা যেন আলো জ্বালার আগে সলতে পাকানোর মতো।

এই দেখে ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসত ছেলেরা।

যদি এমন একটা বাঘ সত্যি সত্যি আসে কী করবে সে? মতিকাকুকে ডাকবে? নাকি ওই শিকারি লোকটাকে!

রাতে তো কতো গল্প শোনাল। এসব বিড়ালকে সে থোড়াই ডরায়। আসুক না একটা। চোখ গলিয়ে দেবে আঙুল দিয়ে।

বলে কী মানুষটা! এতো দেখি আরেক পচাব্দী গাজী?

কাজ নেই বাপু কাউকে ডেকে। যা থাকে কপালে তাতো হবেই।

অদ্ভুত নিঝুম চারদিকটা। একটা পাতা পড়লেও চমকে উঠছে।

নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন।

মহা মুশকিল হলো বন্দুকটা এমন করে কাঁপছে কেন?

হাত খসে পড়ে যাবে নাতো?

বাঘটা যদি এসেই বসে কী হবে তাহলে? কী আর হবে!

কপাল বরাবর গুলি চালিয়ে দেব।

পিন্টুর ক্যামেরাটা আনলে বেশ হতো। ওর বিলু মামা একটা ডায়না ক্যামেরা এনে দিয়েছে ঢাকা থেকে।

গুলিতে মারা বাঘটার কাছে দাঁড়িয়ে ছবিটা নিতে পারলে মন্দ হতো না।

মেহের আলীরা বহু পুরস্কার পেয়েছে বাঘ শিকার করে।

ফরেস্টার সাহেব নিশ্চয় খুব অবাক হবেন। চোখ কপালে তুলে বলবেন, তাহলে তুমিই মানুষখেকোটার দফারফা করতে পারলে? কী কা- বলতো! তোমাকে তো মোটা পুরস্কার না দিয়ে উপায় নেই।

বাড়ি ফিরলে না জানি কী ঘটে যায়!

বাবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে নিশ্চয়।

কী কা- করেছিসরে পাগলা! তোর কুঁজো বক মারা হাতের এমন দুর্দান্ত টিপ? হ্যাঁ, দেখতে হবে তো কার ছেলে!

পাড়ার লোকজন ছুটে আসবে চোখ বড়ো বড়ো করে। নীলু ভাই হাসতে হাসতে বলবেন, তোকে আমাদের পল্লীমঙ্গল থেকে একটা সংবর্ধনা দেব। ভীরু মানুষের অনেক কিছু শেখার আছে তোর কাছে।

ওরে বীর আধমরাকে ঘা মেরে তুই বাঁচা।


কীসের শব্দ?

মচ, মচ, মচ, মচ...

মতিকাকুর সাড়া নেই কেন?

শিকারি লোকটা কী করছে!

একটা বানর কিচকিচ করে উঠল।

বাঘ আসছে না তো?

একি হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে কেন?

মচ, মচ, মচ, মচ, মচ, মচ, মচ...

শব্দটা এখন আরো কাছে।

বন্দুকের নলটা এ রকম অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে কেন? মনে হয় হাত পিছলে ওটা এখনই পড়ে যাবে মাটিতে।


খোকা কথার মাঝে ফুড়ন কাটল, তারপর কী হলো মামা! বাঘ শিকার করলে?

এই হলো তোদের দোষ। কথার মাঝে হুট করে বাম হাত ঢোকানো।

দিলি তো মুডটা নষ্ট করে। অমন একটা এক্সাইটেড মুহূর্ত!

হাওয়েভার, কী যেন বলছিলাম...।

স্যরি মামা, ভুল হয়ে গেছে। যা বলছিলে তুমি বলো।

মামা রেগে গেলে পুটুস পুটুস ইংরেজি বের হয়।

নো মেনশান। তো বাঘটা আসছে...। আসুক। কে পরোয়া করছে! আমি কি তোর ওই পুতু পুতু জিম করবেট নাকি! উনি একটা রোগা চিতা মেরে কত বাহানা। আর আমার সামনে এখন মচ মচ করে আসছেন দ্য গ্রেট রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

মতিকাকু বিশেষ সঙ্কেত দিলেন।

অর্থাৎ উনি আসছেন। সাবধান...।

সর্বনাশ বন্দুকের নলের সঙ্গে হাত-পা সমান তালে কাঁপছে। প্যান্টের সামনের অংশটা কখন ভিজে গেছে টের পাইনি। মাথাটা এমন করে গুলিয়ে উঠছে কেন? চোখটোখ মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরল নৌকায় এসে।

মতিকাকু মানুষটা রসিক। শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, তুই একটা রেকর্ড করলিরে মন্টা। গুইসাপের পায়ের শব্দেই গাছ থেকে উল্টে পড়লি! সত্যি সত্যি বাঘ এলেতো খুঁজেই পাওয়া যেত না। বন্দুক ভেঙেছে ভাঙুক। ভাগ্যিস গুলিটা ফোটেনি।

এই হলো আমার বাঘ শিকারের কাহিনি। কিরে বুঝলি কিছু!

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ