বাংলাদেশের চা রাজধানী মৌলভীবাজার

বাংলাদেশের চা রাজধানী মৌলভীবাজার

ফিচার জুলাই ২০১২

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি জেলা মৌলভীবাজার। এ দেশের ৬১.৫২% চা বাগান, বৃহৎ হাওর, বনাঞ্চল ইত্যাদি এ জেলাকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। প্রবাসীদের জীবনাচার, চা-শ্রমিক ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক জীবন, মনিপুরী সংস্কৃতি এ জেলাকে আকর্ষণীয় করার ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
জেলার পটভূমি
প্রাচীন ইতিহাস : বহু পূর্ব থেকেই মৌলভীবাজার তথা সিলেট অঞ্চল পবিত্র ভূমি হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ-পূর্বাংশের কিছু অংশ ছাড়া বাকি সবটুকুই কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
মোগল আমল : এক সময় বর্তমান মৌলভীবাজার অঞ্চল মোগল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে এক যুদ্ধে ইটা রাজ্যের রাজা সুবিদ নারায়ণের মৃত্যুর পর ইটা রাজ্যের সমূহভূমি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে পাঠান বীর খাজা ওসমানের অধিকারে আসে।
সুলতানি আমল : বর্তমান সিলেট অঞ্চল বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের (১৩০১-১৬২২) সময় মুসলমানদের অধিকারে আসে। আরবের ইয়েমেন থেকে আগত প্রখ্যাত দরবেশ হযরত শাহজালাল (রহ)-এর সিলেট আগমনের পর তাঁর সঙ্গী সাথীদের মধ্যে অন্যতম হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রহ) ইসলাম প্রচারের জন্য মৌলভীবাজার অঞ্চলে আসেন। তিনি বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন। মৌলভীবাজার শহরে তাঁর মাজার রয়েছে।
ব্রিটিশ আমল : ১৭৫৭ সালের পর ইংরেজ কর্তৃক এ দেশবাসীকে শোষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইংরেজদের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে স্বাধীনতার প্রথম চেতনা প্রকাশে ঐতিহাসিক সিপাহি বিপ্লব সংঘটনে মৌলভীবাজার অঞ্চলের সিপাহিদের অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৮৫৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের ‘লাতু’ নামক স্থানের নিকটে একদল বিদ্রোহী সেনা ইংরেজদের মুখোমুখি হয়।
নামকরণ : কথিত আছে যে, সৈয়দ শাহ্ মোস্তফার (রহ) ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত ইয়াছিনের (রহ) উত্তরপুরুষ মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ মনু নদীর তীরে ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে যে বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই বাজারটি কালক্রমে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে ১ এপ্রিল বাজারটিকে কেন্দ্র করে ২৬টি পরগনা নিয়ে দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ শ্রীহট্ট বা সাউথ সিলেট নামের বদলে এ মহকুমার নাম মৌলভীবাজার রাখা হয়। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার মহকুমাটি জেলায় উন্নীত হয়।
সীমানা
উত্তরে রয়েছে সিলেট জেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য এবং পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলা।
শিল্প ও বাণিজ্য
বৃহৎ শিল্প : বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা-বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ৯২টি চা বাগান রয়েছে। এজন্য মৌলভীবাজার জেলাকে বাংলাদেশের চা রাজধানী বলা হয়। চা-বাগানগুলোর মধ্যে মাধবপুর চা-বাগান, সাতগাঁও চা-বাগান, রাজনগর চা-বাগান, মাথিউড়া চা-বাগান, সমনভাগ চা-বাগান, দেউন্দি চা-বাগান, ইস্পাহানি গাজীপুর চা-বাগান, জেরিন চা-বাগান, ফিনলে চা-বাগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মাঝারি শিল্প : জেলায় মোট ১০৩২টি মাঝারি শিল্প রয়েছে। তন্মধ্যে বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত আগর আতর শিল্প এবং প্রায় সব উপজেলায় অবস্থিত প্রাকৃতিক রাবার শিল্প উল্লেখযোগ্য।
কুটির শিল্প : মোট ৪৫৭৫টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প রয়েছে। তন্মধ্যে শীতলপাটি, বেত, কাঠ ও বাঁশ শিল্প উল্লেখযোগ্য।
জেপিএল ফার্নিচার : মৌলভীবাজার জেলার বিসিক শিল্প নগরীতে জেপিএল ফার্নিচারের কারখানা অবস্থিত। উন্নতমানের সিজন ও ট্রিটেড কাঠের বিভিন্ন ডিজাইনের দরজা ও ফার্নিচার তৈরি হয়।
খনিজসম্পদ
মৌলভীবাজার জেলায় ২টি গ্যাস ফিল্ড এবং ৫টি গ্যাস কূপ আছে। এগুলো কালাপুর, শ্রীমঙ্গল, ভাটেরা এবং কুলাউড়ায় অবস্থিত।
দর্শনীয় স্থান
চা-বাগান : মৌলভীবাজার জেলার বিস্তৃত অঞ্চলে ছোট ছোট টিলা, পাহাড় ও সমতলে ৯২টি চা বাগান রয়েছে। প্রতিটি চা বাগানে রয়েছে সবুজের সমাহার, অপরূপ সৌন্দর্য, বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি।
মাধবকুণ্ড : বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড। প্রায় ৮৩ মিটার উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে জলরাশি অবিরাম ধারায় নিচে পড়ছে। বিরামহীন এই জলরাশি পতনের ফলে সৃষ্ট কুণ্ডের প্রবাহ শান্তির বারিধারার মতো।
ইকোপার্ক : সিলেট বন বিভাগের আওতাধীন জুড়ী-২ রেঞ্জের বন বিটের মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক স্থাপনের ফলে ইকো-ট্যুরিজমের নব দিগন্তের সূচনা হয়েছে। বিশাল আকৃতির পাথর, বিরল প্রজাতির বৃক্ষরাজি, বাঘ, হরিণ, হাতি, হনুমান ইত্যাদি প্রাণীর পদচারণায় মুখরিত মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক দেশের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তর সিলেটের প্রথম ইকোপার্ক।
হযরত শাহ মোস্তফা (রহ)-এর মাজার শরীফ : হযরত শাহজালাল (রহ)-এর অন্যতম অনুসারী হযরত শাহ মোস্তফা (রহ) ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলীর (রা) বংশধর ছিলেন। প্রায় সাতশত বছর আগে মৌলভীবাজার জেলার মোস্তফাপুরে বসতি স্থাপন করেন এবং এলাকায় ইসলাম প্রচার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেন। মৌলভীবাজার শহরের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ হযরত শাহ মোস্তফা (রহ)-এর বংশধর ছিলেন।
এ ছাড়া অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আছে রাজনগরের পাখি বাড়ি, পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি, হাওর হাকালুকি, জুড়ীর কমলা বাগান, মনু ব্যারেজ, গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ, বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক, কাগাবালা পাখি বাড়ি, শ্রীমঙ্গল টি-রিসোর্ট, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি।
এক নজরে জেলা
প্রতিষ্ঠার তারিখ- ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, আয়তন- ২৭৯৯ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা- ১৬,১২,৩৭৪ জন (২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী), উপজেলা- ৭টি (মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া, বড়লেখা, কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও জুড়ী), পৌরসভা- ৫টি, ইউনিয়ন- ৬৭টি, গ্রাম- ২১৩৪টি, শিক্ষার হার- ৪২.০৬% (২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী), নদ-নদী- ৬টি (মনু, ধলাই, সোনাই, ফানাই, কন্টিনালা ও বিলাম নদী)।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ