বই হোক উত্তম বন্ধু    -মুহাম্মদ তারেক হোসাঈন

বই হোক উত্তম বন্ধু -মুহাম্মদ তারেক হোসাঈন

ফিচার জুন ২০১৬

মানবসভ্যতা বিকাশে বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যভাবে বলা যায় সভ্যতা বিনির্মাণে সেই জিনিস সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তার নাম বই। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের জ্ঞানভান্ডার আজ মহাসমুদ্র হয়ে স্বল্পায়ু মানুষের জ্ঞানপিপসা মেটানোর অপেক্ষায় আছে বইয়ের রূপ ধারণ করে। জ্ঞানের মহাসমুদ্রের কল্লোল শোনা যায় বইয়ের পাতায়। বইয়ের পাতার কালো অক্ষরে অমর হয়ে আছে মানুষের আত্মার চিরন্তন দ্যুতি। বইয়ের পথ মানে জ্ঞানার্জনের পথ। বইয়ের পথ মানে আনন্দ অভিসারের পথ। উৎকৃষ্ট সংস্কৃতির মহাস্মরণ রচিত হয় বইয়ের বুক চিড়ে, যুগ যুগ ধরে মানুষকে যা বিস্মিত করে। পরম আনন্দ দেয়। বই তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু বই আপনি কোনোভাবেই এড়াতে পারবেন না। বারবার আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে, নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করবে।
প্রদীপের সাথে তুলনা করা হয় জ্ঞানের। আর সেই জ্ঞানের রহস্যময় ভান্ডার হলো বই। বই যেমন মানুষকে বিশুদ্ধ করে তেমনি তথ্য জ্ঞাপন করে মেলে ধরে। তেমনি মন, চিন্তা ও প্রজ্ঞা সেভাবে পরিপক্বতা অর্জন করে।
এমনকি বই আপনার আবেগের সাথেও কথা বলে। এমন সব বই আছে যখন তা পাঠ করবেন। তখন যেন মনে হবে সরাসরি আপনার আত্মার সাথে কথা বলেছেন। আপনার নানান সমস্যা জটিলতা, সুখ-দুঃখ, বেদনা-বিশ্বাস, যুক্তি ও জিজ্ঞাসায় বই গভীরভাবে আপনাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। কোনো কোনো বই আছে যা আপনার লালিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে এমন সব সত্যের মুখোমুখি করে তুলতে সক্ষম যা আপনার জীবন দারুণভাবে বদলে যেতে পারে। কোনো কোনো বই এমন যে, শতবার পড়ার পর আবার পড়তে ইচ্ছা করে, অথচ কোনো ক্লান্তি আসবে না। বই সবসময় চিরায়ত আবেদনময়, যা অনুসন্ধানকে আরও বিলুপভাবে সমৃদ্ধ করে। বইহীন সংস্কৃতির আরেক নাম হতে পারে নিরাশার বালিয়াড়ি।
বই পড়া যে পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠতম শখ ও সাধনা এ বিষয়ে সব দেশের সবকালের মনীষীরাই তাদের মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে বই পড়া কোনো কালেই সামাজিক আন্দোলনে রূপলাভ করেনি। আমরা চায়ের দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিই, রাস্তা বা গলির মোড়ে অকারণে সময় নষ্ট করি। বাসে বা ট্রেনে যাতায়াতকালে একটা সংবাদপত্র কিনে দুই এক পৃষ্ঠা পড়ি, পড়া শেষ হলে সেটাকে রোদ ঠেকানোর কাজে ব্যবহার করি। আমরা কোনদিনই বই পড়ার গুরুত্ব যথাযথভাবে বুঝতে পারিনি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের দেশের একটি মানুষের নিবিড় যোগাযোগে থাকুক আমরা চাই। কিন্তু নৈতিক জ্ঞানের শিক্ষা থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গিয়ে আমরা কি ধরে রাখতে পারবো প্রযুক্তিনির্ভর উন্নতি? অতীতে দেখেছি একখানা ভালো বই পড়ার জন্য আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে কী রকম আগ্রহ ছিল। কে কার আগে কোন বই পড়বে এটা ছিল অতীতকালে ছাত্রদের নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পুরোটাই উল্টা। এখন ছাত্ররা বইয়ের চেয়ে ফেসবুক বেশি পড়ে। এখন শিক্ষার্থীরা কার আগে কে কোন সফটওয়্যার ডাউনলোড করবে সেটাই হলো তাদের আলোচনার বিষয়। অথচ তারা জানে না বিজ্ঞান চর্চা যদি মানবিকতা বিবর্জিত হয়, তাহলেই সেই বিজ্ঞানচর্চা পরিণামে ধ্বংস ডেকে আনবে। পৃথিবীর দেশে দেশে এখন আমরা সেই ঘটনাই প্রত্যক্ষ করছি।
প্রজন্মের ছাত্র এবং অভিভাবক সকলেই পাস চায় কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানার্জনের খুব একটা আগ্রহ দেখা হয় না। বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক। শিক্ষার্থীরা আজকাল অবলীলায় বলে তাদের সার্টিফিকেট দরকার, জ্ঞানের দরকার নেই। অভিভাবকেরাও তাতে খুশি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না বই দূরে ঠেলে দিয়ে, বই পড়া ভুলে গিয়ে কিসে আমরা বোকা জাতিতে পরিণত হচ্ছি।
চিন্তার রাজ্যের বিস্তৃতি চিত্তের আনন্দ দান ছাড়াও সভ্যতা বিকাশের ধাপে ধাপে বই কিভাবে ফল্গুধারার মতো গোপনে প্রেরণা জুগিয়েছে সেই কথা আমরা অনেকেই জানি না। যদি জানতাম তাহলে আমরা বিস্মিত, বিমুগ্ধ এবং আবেগে উদ্বেলিত হতাম।
বই সম্পর্কে জগদ্বিখ্যাত ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে যদি উত্তম বলে কিছু থাকে তার জন্য আমরা বইয়ের কাছে ঋণী।
বই আমাদের জন্য অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দেয়।
মানবজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সংরক্ষণাগার হচ্ছে বই। বইয়ের সঙ্গে মানুষের নিত্য কথা হয়। আমার মনে হয় একেকটি বই একেকটি জীবন্ত কণ্ঠস্বর। মানবমনের একটি স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় হলো অজানাকে জানা। বিশ্বপ্রকৃতির আদি-অন্তহীন রহস্যকে উদঘাটন করা মোটেই সহজসাধ্য নয়। বিশ্বরহস্যের এই দুর্ভেধ্য কুহেলি ভেদ করার মোক্ষম হাতিয়ার বই। বই নতুন নতুন জ্ঞান বিতরণ সক্ষম, নব নব আনন্দদানে পারঙ্গম, নতুন তথ্যের জোগান দিতেও বই অতুলনীয়। লিউ টলস্টয় বলেছিলেন, জীবনে তিনটি জিনিস প্রয়োজন, বই বই এবং বই। বইয়ের ইংরেজি Book. Best owner of knowledge.. সুতরাং সভ্যতার বীজমন্ত্র বইয়ের পাতায় লুক্কায়িত এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
যুগে যুগে অনুসন্ধিৎসু মানবগোষ্ঠী তার যাতায়াতে যে বিচিত্র জ্ঞান আহরণ করেছে তারই লিখিত রূপ বই। বই নিরাশার আলো, পথভোলার পথপ্রদর্শক। বই মানবমননে সৃষ্টি করে নীতি, নৈতিকতা, মহানুভূতি, ¯স্নহ বীরত্ব, সুন্দরের সাধনা, ত্যাগের দীক্ষা। কবি ওমর খৈয়াম বইকে বলেছেন চির নবীন, চির অমর, আনন্দের সাথী। সে জন্যই কবির বাণীটি আজও চির অম্লান ‘রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য সংস্কৃতি, অন্তরের সত্য ও স্বপ্ন সবকিছুর সমন্বয়ে সাহিত্যের জন্ম। বইয়ের জ্ঞান ছাড়া বেহেশতের আনন্দ অচিন্ত্যনীয়। বই মানুষকে নরকে প্রজ্বলিত আগুন থেকে ফুলের হাসি ফুটানো দুঃসাহস দান করে। অভিজ্ঞতাহীন অপূর্ণতা দিয়ে পৃথিবীতে মানুষের আগমন তা পূর্ণ করে বইয়ের জ্ঞান।
আজকাল আমাদের তরুণসমাজ যান্ত্রিকতায় বিমোহিত। কিন্তু সময়ের দ্রুত পরিবর্তন-বিবর্তনের দ্বারা যান্ত্রিক সভ্যতার কবলে মানুষ বরণ করেছে দিন দিন যান্ত্রিক সভ্যতা। মানুষের মন মেজাজও হয়ে উঠছে যান্ত্রিক। ফলে অধিকাংশ তরুণসমাজ সাহিত্যবিমুখ। শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ ও ঔপনিবেশিক কাঠামোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্বাধীন দেশে বহাল থাকায় উচ্চশিক্ষারও একই হালচাল। মুক্ত সংস্কৃতি তরুণদের পড়ার সময় হরণ করছে। ভার্চুয়াল জগৎকে বইয়ের বিকল্প ভাবা ঠিক নয়।
নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যায়, তখন এই চোরাবালি থেকে মুক্তি দিতে পারে একটি ভালো বই।
এ প্রসঙ্গে মনীষী বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেয়া, যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়। আর বইপাঠই সেই ভুবন সৃষ্টিতে সর্বাধিক বেশি সাহায্য করে। বই শুধু জ্ঞানার্জনের উপায়ই নয়, বই সত্য, সুন্দর, আনন্দময় অনুভূতিতে পাঠকদেরকেও আলোড়িত করে। মানুষ বইপাঠের মাধ্যমে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। যুগে যুগে গ্রন্থ এনেছে ত্যাগের দীক্ষা, সত্য ও সুন্দরের সাধনা।
বিখ্যাত কবি ও সাধক জালালুদ্দিন রুমী তার একটি কবিতায় লিখেছেন :
“I am so small I can barely be seen
How can this great love be inside me?
Look at your eyes, they are small
But they see enormous things.”
বই হলো রুমীর চোখের মত, অতি ক্ষুদ্র অথচ চারপাশের সবকিছুকে বৃহদাকারে দেখতে পায়।
সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, ‘লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে একরকম মনের হাসপাতাল।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ