ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোর

ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোর

বিশেষ রচনা আবু হামীম হারুন জানুয়ারি ২০২৪

ওরা মরুভূমির ফুল হয়ে জন্ম নেয়, জান্নাতের পাখি হয়ে উড়ে যায়। পৃথিবীর মাটিতে আসার পরই ওরা আজানের সুরের সাথে শুনতে পায় গুলি-বোমার আওয়াজ। যখন বুঝতে শেখে তখনই ওরা অপেক্ষায় থাকে কবে উড়ে যাবে জান্নাতের পাখি হয়ে। তাই তো মা-বাবা, ভাই-বোন বন্ধুদের আগেই বলে রাখে যে, শাহাদতের পিয়ালায় চুমুক দিয়ে জান্নাতের পাখি হয়ে উড়াল দেওয়ার পর তারা তাকে নিয়ে কী করবে। নিশ্চয় ওদের চিনতে এখন আর কারো সমস্যা হচ্ছে না? হ্যাঁ, ওরা ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোর।  

ওরা নিজদেশে পরবাসী। ফিলিস্তিনের মুসলিম বাবা-মা’র ঘরে জন্ম নেওয়ার কারণেই ওদের ফুলের মতো সুন্দর জীবন ইহুদি বর্বর সৈনিকদের বুলেট-বোমার আঘাতে এভাবে ঝরে যায়। অভিশপ্ত জাতি ইহুদিরা ফিলিস্তিনের বৈধ অভিবাসীদের উচ্ছেদ করে গড়ে তুলেছে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। সারা দুনিয়া থেকে তারা সেই দেশে গিয়ে বসতি গাড়ছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য বৈধ অধিবাসীদের জমি, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করছে। প্রায় এক শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনে চলছে ইহুদিদের আগ্রাসন। গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকা ঘিরে ইহুদিরা নতুন করে হামলা শুরু করেছে, আল জাজিরার হিসেবে এতে প্রতিদিন ১০০ শিশু-কিশোর শাহাদত বরণ করছে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে ইসরাইলের বোমার আঘাতে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন করে শিশু শাহাদত বরণ করছে।

ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতার ভাষায়-

আজকের দিনটি আগামী দিনের থেকে হয়তো ভালো,

কেবল মৃত্যুগুলোই আজ নতুন

প্রতিদিনই জন্ম নেয় যে নতুন শিশুরা

তারা ঘুমোতে যাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে, মৃত্যুতে।

তাদের গণনা করা মূল্যহীন।


প্রতিদিন প্রতিক্ষণে ইহুদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে হাসি মুখে শাহাদত বরণ করছে শিশু-কিশোররা। তাই তাদের সংখ্যা গণনা করে এখন যা বলা হবে বদলে যাবে কিছুক্ষণ পরই, তা মিথ্যে হয়ে যাবে। ওরা ইহুদি সৈনিকদের গুলি-বোমার মোকাবেলা করছে, নুড়ি, পাথর আর গুলতি হাতে। দেশ-বিদেশের আরবি, ইংরেজি ও বাংলা পত্র-পত্রিকায় ফিলিস্তিনের সাহসী শিশু-কিশোরদের এমন অনেক কথা প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রতিদিন হচ্ছে, তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকে কাঁদায়।  এমন এক মহাকাব্যের নায়ক আমর খামৌর। মাত্র ১৪ বছরের কিশোর আমর খামৌর। কিন্তু ওর বুকভরা সাহস। মা মরিয়মের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র শহর বেথেলহামে আমরের জন্ম। কিন্তু কিশোরের সীমানা পাড়ি দেওয়ার আগেই সে শাহাদত বরণ করে, জান্নাতের পাখি হয়ে উড়ে যায় পরপারের সুন্দর জীবনে ।

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের এক সুন্দর সকাল। সেই দিনটা ছিল চমৎকার। ফজরের আজানের পর মসজিদ থেকে ফিরে আমর মধুর কণ্ঠে পবিত্র কুরআন তেলওয়াত করছিল হয়তো অন্য আর দশটা দিনের মতো। কিন্তু হঠাৎ বাইরে ইসরাইলি সৈনিকদের ট্যাংকের গর্জন শুনে বাইরে আসে। দেখতে পায় তার প্রিয় বসতবাড়ি ভেঙে ইহুদিদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এসেছে ইসরাইলি সেনারা। আমর তার অন্যান্য শিশু-কিশোর বন্ধুদের সাথে হাতে তুলে নেয় নুড়ি পাথর। বর্বর সৈনিকদের লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে। পাথরের মোকাবেলায় ভীরু কাপুরুষ সৈনিকরা গুলি  ছোঁড়ে। দুইটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় আমরের ছোট বুকে।

তার শাহাদতের পর মা-বাবা আমরের মোবাইলে হাতে লেখা এক চিরকুটের ছবি দেখতে পায়। শাহাদতের আগে তাঁর হাতে লেখা এই চিরকুটে লেখা, ‘আমি যদি কোনোদিন শহীদ হিসেবে তোমাদের কাছে ফিরে আসি, তাহলে তোমরা কাঁদবে না। আমার সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেবে। কষ্ট পেয়ো না। আমি শহীদ হতে চেয়েছিলাম, তাই হয়েছি।’ চিরকুটের শেষে প্রিয়বন্ধু কারিওয়ানকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে, ভালোবাসা নিও, আল্লাহ আমাকে তোমার প্রিয়তম করে পাঠিয়েছিল এই বেথেলহামে।’

ইসরাইলের হাতে শাহাদত বরণ করা অনেক শিশু-কিশোরই আমরের মতো ‘চিরকুট’ লিখে গেছে। অনেকে রেখে গেছে ভিডিও চিত্র। এসব ভিডিওতে তাঁরা এ-ও বলে গেছে, স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশ নিচ্ছে শাহাদত বরণ করার নিয়তেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমরের মতো কিশোর কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য নয়। কিন্তু ইসরাইলের সেনাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার ইচ্ছা তারা সবসময় মনেপ্রাণে ধারণ করে। তাঁরা যখন বুঝতে শিখে তখন থেকেই মনে করে, যেকোনো সময় আসতে পারে জান্নাতের আহ্বান, তাই তারা এভাবে চিরকুটে তাদের শেষ ইচ্ছার কথা প্রিয়জনদের জন্য লিখে রাখে। এতে যেমন থাকে ক্ষমা করে দেওয়ার অনুরোধ, তেমনি থাকে উপদেশ। এসব যেন চিরকুট নয় কোনো ‘উইল’।  ইসরাইলের নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়নের মুখে কিশোর-তরুণরা শাহাদতের মৃত্যুকে ‘বীরোচিত’ গর্বের বলে মনে করে। এসব চিরকুটই তার প্রমাণ। 

আমরকে কবর দেওয়া হয়েছে, তার বন্ধু আদম আয়াদ (১৫)-এর কবরের পাশে। আমরের শাহাদতের দুই সপ্তাহেরও কম সময় আগে ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে শাহাদত বরণ করেছে তার বন্ধু আদম আয়াদ। তখনই আমর সবাইকে জানিয়ে রেখেছিল, শাহাদতের পর তাকে যেন আদম আয়াদের কবরের পাশে দাফন করা হয়।

শাহাদতের আগে আয়াদ আদমের মা ওয়াফা তার ঘরে একটি চিরকুট পেয়েছিলেন। সেও আমরের মতো চিরকুটে একই ধরনের কথা লিখেছিল। চিরকুট পাওয়ার পর আদমের মা তার কাছে আকুতি জানান, যেন সে এমন কোনো চিরকুট আর লিখে না রাখে। কিন্তু গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আদমের পকেটে আরও এক চিরকুট পাওয়া যায়। সেই চিরকুটে আদম লিখেছিল, ‘আমি অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা এমন এক জায়গায় বাস করি, যেখানে নিজের স্বপ্ন পূরণ করা অসম্ভব। শহীদ হওয়া মানেই জয়ী হওয়া। এটা সত্য যে এরমধ্য দিয়ে একজনের জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু অন্তত শান্তি নিয়ে হলেও তো চলে যাওয়া যাবে।’

আমরের মতো তার অনেক বন্ধুই চিরকুট লিখে আমরের মতো জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত এ কথা জানিয়েছে। কেউ কেউ এও বলে, কোথায় সমাহিত হতে চায়, তারা সেটা জানিয়ে রেখেছে।

কিশোরদের এমন ইচ্ছার কথা জেনে হৌশিয়া নামের একজন স্কুলশিক্ষক ছাত্রদের ফেরাতে উদ্যোগ নেন। তিনি তাদের সবাইকে একটি ক্লাসে একসাথে বসিয়ে বলেন, ‘ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা মানে জীবন উৎসর্গ করা নয়। এই প্রতিরোধ পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্য দিয়েও করা যেতে পারে। তিনি ছাত্রদের বলেন, তারা যেন এভাবে চিরকুট না লেখে। এর বদলে তারা যেন পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। কিন্তু তার কথা ছাত্ররা সমর্থন করে না। তাদের কেউ কেউ তাকে বলে, ‘ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন ভূমি চাইলে এমন আত্মদানের দরকার আছে। তারাও চিরকুট লিখে রেখেছে।’

হৌশিয়ার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘শিশু-কিশোররা কেন একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ ভাবনার আগেই নিজের মৃত্যুর কথা নিয়ে ভাবছে?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে একজন মনোবিজ্ঞানী তাকে বলেন, ‘ইসরাইলের দখল করা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিদের একের পর এক প্রজন্ম যে মারাত্মক প্রহসনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে আসছে। ফিলিস্তিনি কিশোর-তরুণদের অনেকে মনে করছেন, দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে। এবার তাঁদেরই ইসরাইলের সেনাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।’ পশ্চিম তীরের বাসিন্দা ও লেখক জালাল আবু খাতার মনে করেন, ‘বিষয়টা এমন নয় যে তাঁরা মরে যেতে চান। বরং তাঁরা মনে করছেন, ‘আত্মদান ছাড়া তাঁদের কাছে প্রিয় জন্মভূমি ফিলিস্তিনকে দেওয়ার মতো আর কিছু অবশিষ্ট নেই।’ ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরদের আত্মত্যাগ ও শাহাদতের এমন অসংখ্য কাহিনী একটি মহাকাব্য লিখেও শেষ করা যাবে না। আমর, আদমের মতো প্রতিদিনই ফোটার আগেই ঝরে যাচ্ছে : সাদিল, সালমা ফিরাজ, তামান্না, ওমর, আলী, ওসমান, আয়াজসহ নাম জানা না জানা শিশুরা। বিগত প্রায় একশত বছর ধরে ঝরে পড়া সেই ফুলগুলো জান্নাতের পাখি হয়ে উড়ছে। তাদের হিসেব রাখার খাতাগুলোও তো ছাই হয়ে গেছে ইসরাইলের বর্বর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ইহুদি সৈনিকদের বোমার আঘাতে। এসো তাদের সুন্দর স্বপ্ন দেখাতে এসো, সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়াই। গোটা বিশ্বকে জাগিয়ে তুলি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ